বাড়িতে এল পরিবর্তন

বাড়িতে এল পরিবর্তন 

একদিন মা ওকে বলল, ‘সেরিওজা, শোন…ভাবছি, আমাদের বাবা থাকলে বেশ হয়।’ ও অবাক হয়ে মাথা তুলে মা’র দিকে তাকাল। এ কথা তো ও কোনোদিন ভাবে নি! ওর বন্ধুদের অনেকেরই বাবা আছে বটে, আবার অনেকের নেইও। ওরও বাবা নেই। ওর বাবা নাকি যুদ্ধে মারা গেছে। বাবাকে ও কোনোদিন দেখেও নি। শুধু ছবি দেখেছে। মা মাঝে মাঝে সেই ছবিতে চুমু দেয় আবার ওকেও চুমু দেবার জন্য দেয়। মায়ের গরম নিঃশ্বাসে ছবির আব্‌ছা কাচের ওপর ও অনেকবারই চুমু দিয়েছে কিন্তু ছবির বাবাকে ও একটুও ভালোবাসতে পারে নি। শুধু শুধু ছবিতে দেখে কি কাউকে ভালোবাসা যায় নাকি? 

আর আজ মা একি বলছে? মায়ের দু-হাঁটুর মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে সেরিওজা অবাক দৃষ্টিতে মা’র দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখখানি কেমন লালচে হয়ে উঠছে যেন; প্রথমে গাল দুটো, তারপর কপাল কান সব লাল হয়ে উঠল… মা ওকে হাঁটুর কাছে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় চুমু খেল। এখন আর ও মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, শুধু মায়ের জামার নীল হাতায় শাদা দাগগুলো ওর চোখে পড়ছে। মা চুপি চুপি বলছে, ‘বাবা থাকলে বেশ হয়, তাই না সেরিওজা?’ 

সেরিওজাও চুপি চুপি বলল, ‘হুঁ…’ 

কিন্তু সত্যি কি আর ও তাই ভাবছে? মাকে খুশি করবার জন্য ও মায়ের কথায় সায় দিল। তক্ষুনি ও ভাবতে বসল, আচ্ছা বাবা থাকা ভালো, নাকি, না-থাকাই ভালো? কোন্‌টা? তিমোখিন যখন ওদের সবাইকে তার লরিতে বেড়াতে নিয়ে যায় তখন শুধু শুরিক তিমোখিনের পাশে লরির সামনে বসতে পায়। ওরা সব্বাই ওকে এ জন্য হিংসে করলেও কিছু বলতে পারে না, কারণ তিমোখিন যে শুরিকের বাবা। আবার শুরিক দুষ্টুমি করলে তিমোখিন ওকে চাকায়। তখন শুরিক কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেললে ওকে খুশি করবার জন্য সেরিওজাকেই ওর সব খেলনাগুলো দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু তা হোক…তবু যেন বাবা থাকাই ভালো। কয়েকদিন আগে ভাস্কা লিদাকে খেপালে লিদা বলেছিল, ‘আমার বাবা আছে। তোমার তো বাবা নেই। দুয়ো!’ 

সেরিওজা হঠাৎ মায়ের বুক থেকে মুখখানি তুলে মায়ের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করল, ‘ওখানে ওটা কী ধুক ধুক করছে, মা?’ 

মা একটু হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলল, ‘ওটা আমার বুক। সেরিওজা মাথা নিচু করে মায়ের বুকের ওপর কান পেতে রেখে বলল, ‘আমারও বুক আছে?’ 

‘হাঁ, তোমারও আছে।’ 

‘কই, আমি তো আমার বুকের ধুকধুকানি শুনতে পাচ্ছি না।’ 

‘না শুনতে পেলেও ওটা ঠিকই ধুক ধুক করে যাচ্ছে। না হলে কেউ বাঁচতে পারে না। ‘ওটা সব সময় ওরকম করে?’ 

‘হাঁ।’ 

‘তুমি আমার বুকের ধুক ধুক শব্দ শুনতে পাও?’ 

‘হাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি। আর তুমিও হাত দিলে বুঝতে পারবে। এই যে, হাত দাও এখানে।’ মা ওর হাতখানি টেনে নিয়ে ওর বুকের পাঁজরে রেখে বলল, ‘বুঝতে পারছ?’ 

‘হাঁ… ওঃ! বেশ জোরে জোরে শব্দ করছে তো! ওটা কি অনেক বড়?’ 

‘হাতটা মুঠো কর। হাঁ, এবার এই মুঠো হাতটির মতো বড় ওটা, বুঝলে?’

আচমকা কী ভেবে মায়ের কোল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সেরিওজা ছুটে চলল।

মা প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

‘আসছি এক্ষুনি।’ 

ও এবার এক দৌড়ে রাস্তার ওপর চলে এসে ভাস্কা আর জেঙ্কাকে দেখতে পেয়ে ওদের কাছে গিয়ে বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলল, ‘দেখ, দেখ, এই যে এখানে আমার বুক রয়েছে। আমি হাত দিয়ে টের পাচ্ছি। তোমরাও হাত দিয়ে দেখ না?’ 

‘ফুঃ! তোমার বুক! ও তো সবারই আছে,’ ভাস্কা গম্ভীর মুখে বিজ্ঞের মতো বলল।

জেঙ্কা এগিয়ে এসে ওর বুকে হাত রেখে বলল, ‘তাই নাকি?’ 

সেরিওজা এবার বলল, ‘বুঝতে পারছ?’ 

‘হুঁ।’ 

‘আমার হাতের মুঠোর মতো বড় ওটা।’ 

‘কে বলল?’ 

‘মা বলেছে।’ হঠাৎ কথাটা মনে পড়ায় ও বলে ফেলল, ‘জান, আমার বাবা আসছে!’ কিন্তু ভাস্কা আর জেঙ্কা ওর কথায় একটুও কান দিল না। ওরা ওষুধের জন্য কী সব লতাপাতা নিয়ে চলেছে, একটা দোকানে ওসব দিয়ে হাতখরচের টাকা রোজগার করবে ওরা। দু-দিন ধরে তাই ওরা রাস্তার ধারে ধারে ঐসব গাছগাছড়া লতাপাতা আতিপাতি করে খুঁজে বেড়িয়েছে। ভাস্কার মা ওর লতাগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করে পাতলা ভিজে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু জেঙ্কার তো আর মা নেই। ওর খালা আর বোনও যার যার কাজে ব্যস্ত। তাই সে তার গাছগাছড়াগুলোকে নোংরাভাবেই একটা পুঁটলি করে বেঁধে নিয়ে চলেছে। কিন্তু ভাস্কার চাইতে ওর গাছগাছড়ার সংগ্রহ অনেক বেশি, তাই তার পুঁটলিটাকে পিঠে চাপিয়ে ভারে নুয়ে পড়ে ও চলেছে। 

সেরিওজা ওদের পেছনে দৌড়ে গিয়ে কাতর স্বরে বলল, ‘আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।’

‘না, বাড়ি যাও। আমরা কাজে যাচ্ছি,’ ভাস্কা গম্ভীর গলায় আদেশের ভঙ্গিতে বলল।

সেরিওজা আবার বলল, ‘শুধু তোমাদের সঙ্গে যাব। 

‘না, না, বাড়ি যাও বলছি। এটা তো আর খেলা নয়। তোমার মতো বাচ্চা ছেলেরা ওখানে যায় না, বুঝলে?’ ভাস্কা আবার ধমকে উঠল।

সেরিওজা এবার থেমে গেল। ওর ঠোঁট দুটি অভিমানে কাঁপছে। কিন্তু না, ও কাঁদবে না। লিদা আছে কাছেই, সে এসে খেপাবে ছিঁচকাঁদুনে বলে। 

তবুও সে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা তোমাকে নেবে না বুঝি?’ 

সেরিওজা চোখ মুছে বলল এবার, ‘আমি ওদের চাইতে অনেক বেশি লতাপাতা জোগাড় করতে পারি। ঐ আকাশের চেয়েও উঁচু করে লতাপাতা জমাব দেখ।’ 

লিদা হেসে লুটোপুটি খেয়ে বলল, ‘আকাশের চাইতেও উঁচু? ছেলের কথা শোন! আকাশের চেয়েও উঁচু হয় নাকি বোকা ছেলে?’ 

‘আমার বাবা আসবে, দেখ, আমি না পারলেও আমার বাবা ঠিক পারবে।’ 

‘ও তো বানানো গল্প। তোমার বাবা আসবে না আরো কিছু? আর এলেই-বা কী, বাবারাও তা পারে না, কেউ পারে না।’ 

সেরিওজা এবার মাথা হেলিয়ে আকাশের দিকে তাকাল, সত্যি কি কেউ ঐ আকাশের চেয়েও উঁচু করে গাছগাছড়া লতাপাতা জমাতে পারে না? সেরিওজা এ কথাটা ভেবেই চলেছে। লিদা কোন ফাঁকে এক দৌড়ে বাড়ি গিয়ে একটা রঙিন স্কার্ফ-যেটা ওর মা মাঝে মাঝে মাথায়, গলায় পরে থাকেন–নিয়ে এসে দু-হাত দুলিয়ে কী একটা গান গেয়ে পা ঠুকে ঠুকে নাচতে শুরু করল। সেরিওজা অবাক হয়ে ওকে দেখছে এবার। 

লিদা বলল, ‘নাদকা কী গল্পই করতে পারে! ও নাকি ব্যালেতে নাচ শিখবে।’ 

পরে বললে, ‘মস্কো আর লেনিনগ্রাদের ব্যালেতে নাচ শেখায়। 

বলতে বলতে সেরিওজার চোখে বিস্ময় আর প্রশংসার ছায়া দেখে লিদা আবার নাচ থামিয়ে হেসে প্রশ্ন করল, ‘কী দেখছ? তুমিও নাচবে নাকি? আমাকে দেখে দেখে নাচ না।’

সেরিওজা ওকে নকল করতে লাগল, কিন্তু ঐ স্কার্ফ ছাড়া কী করে নাচ হয়? লিদা ওকে গান গাইতে বলছে। কিন্তু গান গেয়েও ঠিক অমনটি হচ্ছে না যে! 

‘স্কার্ফটা একটু দাও না আমায়’, কাতর স্বরে ও বলল। 

কিন্তু লিদা ও কথা শুনেও শুনল না। ঠিক সেই মুহূর্তে সেরিওজার বাড়ির দরজায় একটা গাড়ি এসে থামল। একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলে পাশা খালাও ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। 

‘এই যে, দমিত্রি কর্নেয়েভিচ এসব পাঠিয়েছে,’ মেয়েটি বলল। 

একটা স্যুটকেস, একটা বইয়ের বান্ডিল আর একটা কী ভারি ছাই রঙের জিনিস প্যাকেটে জড়ান রয়েছে। একটু পরেই বোঝা গেল ওটা একটা ফৌজি কোর্ট। ওরা দু-জনে জিনিসগুলো ভেতরে নিয়ে চলল। মা জানালা দিয়ে একটিবার উঁকি মেরে কোথায় সরে গেল। মেয়েটি মুচকি হেসে খালাকে বলল, ‘দেখেছ, যৌতুক বিশেষ কিছুই নেই।’

খালা কেমন দুঃখিত স্বরে বলল, ‘নতুন একটা কোট কিনলেও পারত অন্তত।’

‘কিনবে গো কিনবে। সময়মতো সবই কিনবে, দেখ। এই যে, চিঠিটা ওকে দিও।’

একটা চিঠি খালার হাতে দিয়ে মেয়েটি এবার গাড়িতে উঠে গাড়িটা চালিয়ে চলে গেল। সেরিওজা এবার এক ছুটে বাড়ির মধ্যে এসে চেঁচাতে শুরু করল, ‘মা, মাগো, করোস্তেলিওভ তার ফৌজি কোটটা পাঠিয়েছে দেখ!’ 

(মিত্রি কর্নেয়েভিচ করোস্তেলিওভ ওদের বাড়িতে প্রায়ই আসত আগে। সেরিওজার জন্য সে কত খেলনা আনত। শীতকালে একবার সেরিওজাকে স্লেজে করে নিয়ে বেড়াল। তার ফৌজি কোটটা সে এনেছিল যুদ্ধ থেকে, তার আবার কাঁধে বেল্ট নেই। সেরিওজা তার বিদ্ঘুটে এই নামটা কোনোমতেই যেন ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারে না। তাই তাকে শুধু করোস্তেলিওভ বলেই ডাকে।) 

বিরাট কোটটা এতক্ষণে আলনায় ঝুলছে। মা চিঠিটা পড়ছে একমনে। ওর কথার কোনো উত্তর দিল না। চিঠিটা পড়া শেষ করে বলল, ‘হাঁ, আমি তা জানি। এখন থেকে উনি আমাদের এখানেই থাকবেন সেরিওজা। উনিই তোমার বাবা হবেন যে।’ মা আবার চিঠিটা পড়তে শুরু করল। 

‘বাবা’ কথাটায় যার ছবি সেরিওজার চোখে ভেসে উঠে সে কেমন যেন অজানা, অচেনা। কিন্তু করোস্তেলিওভ তো ওদের অনেকদিনকার পুরনো বন্ধু। খালা আর লুকিয়ানিচ তো তাকে ‘মিতিয়া’ বলে ডাকে। মা এসব কী বলছে আবোল-তাবোল? ও প্রশ্ন করে বসল, ‘কেন?’ 

‘আঃ! আমাকে চিঠিটা শেষ করতে দেব না নাকি দুষ্টু ছেলে?’ মা বলল। 

চিঠিটা শেষ করার পরেও মা ওর প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। ব্যস্তসমস্ত হয়ে কেবল এ-কাজ সে-কাজ করতে লাগল। বইয়ের বান্ডিল খুলে বইগুলো ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ঝকঝকে করে তাকে গুছিয়ে রাখল। পরিষ্কার ঘর-দোরকে আরো একবার পরিষ্কার করে, তকতকে মেঝেকে আবার ধুয়ে মুছে মা নতুন করে ঘর সাজাতে লাগল। পর্দা, টেবিলক্লথ সব পালটে ফেলে বাগান থেকে একগুচ্ছ ফুল তুলে এনে টেবিলের উপর ফুলদানিতে রাখল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে পিঠে তৈরি করতে লাগল। খালা ময়দার গোলা তৈরি করে দিয়ে মাকে সাহায্য করছে, সেরিওজাও কিছুটা ময়দা-গোলা আর জ্যাম নিয়ে পিঠে বানাতে বসে গেল। 

তারপর করোস্তেলিওভ এলে সমস্ত কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ও আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জান, আমি পিঠে তৈরি করেছি!’ করোস্তেলিওভ নত হয়ে দু-হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে চুমু খেল। সেরিওজা ভাবল : আমার বাবা হয়েছে বলেই বুঝি ও আজ এতক্ষণ ধরে আমাকে চুমু খাচ্ছে। 

করোস্তেলিওভ এবার ঘরে ঢুকে তার স্যুটকেস খুলে মায়ের একখানি ছবি বার করে হাতুড়ি আর পেরেক নিয়ে সেরিওজার ঘরে দেওয়ালের গায়ে ঠুক ঠুক করে টানাতে লাগল। 

মা বলল, ‘ছবি দিয়ে আর কী হবে? আসল মানুষটিকেই তো এখন থেকে সব সময় কাছে পাবে।’ 

করোস্তেলিওভ এবার মায়ের হাতখানি তার হাতে তুলে নিয়ে দু-জনে কাছাকাছি দাঁড়াল। কিন্তু ওর দিকে তাদের দৃষ্টি পড়তেই দু-জনে তক্ষুনি সরে গেল। মা ঘর থেকে বার হয়ে গেল, আর করোস্তেলিওভ একটা চেয়ারে বসে পড়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে সেরিওজা আমি তো তোমাদের সঙ্গে থাকব বলে এসেছি, তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?’ 

‘বরাবর থাকবে?’

‘হাঁ, বরাবর।’ 

‘আমাকে মারবে না তো?’ 

করোস্তেলিওভ অবাক হয়ে বলল এবার, ‘কেন? মারব কেন?’ 

‘আমি দুষ্টুমি করলে?’ 

‘না, আমার মনে হয় দুষ্টুমি করলেও বাচ্চাদের মারধর করাটা খুব বোকামি।’

‘হাঁ, ঠিক বলেছ, মারলে কান্না পায়, তাই না?’ সেরিওজা বেশ খুশি হয়ে উঠল যেন।

করোস্তেলিওভ আবার বলল, ‘আমরা দু-জন দু’জনকে বুঝতে চেষ্টা করব, কেমন?’

‘তুমি কোথায় ঘুমোবে?’ সেরিওজা এবার অন্য প্রশ্ন করল। 

‘মনে হচ্ছে এ ঘরেই ঘুমোব। হাঁ, শোন, আসছে রবিবার সকালে তুমি আর আমি এক জায়গায় যাব। কোথায় বল তো? খেলনার দোকানে, তোমার যা খুশি নেবে, কেমন?’ 

‘সত্যি? আমি তাহলে একটা সাইকেল চাই। রবিবারটা আসতে আর কত দেরি বল তো?’ 

‘আর দেরি নেই।’ 

‘কতদিন আর?’ 

‘আসছে কাল তো শুক্রবার। তার পরের দিন শনিবার। তার পরের দিনটাই তো রবিবার। 

‘উঃ! এ-তো দেরি এখনও?’ সেরিওজা বলে উঠল। 

তারপর ওরা তিন জন-সেরিওজা, মা আর করোস্তেলিওভ চা খেতে বসল। পাশা খালা আর লুকিয়ানিচ কোথায় বেড়াতে গেছে। সেরিওজার বড্ড ঘুম পাচ্ছে এবার। চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ঐ যে আলোটার চারদিক ঘিরে ছাই রঙের প্রজাপতিগুলো কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে, তারপর এক সময় টেবিলক্লথের ধারে ছোট্ট পাখা পত পত করতে করতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ছে, ওদের দেখে দেখে ওর যেন আরো বেশি ঘুম পাচ্ছে। আচমকা ও দেখল করোস্তেলিওভ যেন ওর খাটটা কোথায় নিয়ে চলেছে। 

‘আমার খাটটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ সেরিওজা বলল। 

মা-কে এবার বলতে শুনল, ‘ঘুমিয়ে পড়লে তো? এস, হাত-পা ধুয়ে শোবে এস।’

ভোরবেলা ঘুম ভেঙেও কিন্তু প্রথমটা বুঝতেই পারছে না কোথায় আছে ও। দুটো জানালার জায়গায় তিনটে দেখা যাচ্ছে কেন? বিছানার উল্টো দিকে তো কোনো জানালা ছিল না! পর্দাগুলোও তো একেবারে অন্যরকম। তাহলে কি ও… হাঁ, এবার বুঝতে পারছে খালার ঘরে ও শুয়েছে কাল। এ ঘরখানিও ভারি সুন্দরভাবে সাজান। জানালার তাকে ফুলদানিতে ফুল রয়েছে। আয়নার পিছনে ঐ তো ময়ূরপুচ্ছের পাখাটা ঝুলছে। খালার বিছানা কেমন পরিপাটি করে পাতা। খোলা জানালার শার্সি দিয়ে ভোরবেলার সোনালি রোদ ঘরের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে। সেরিওজা এবার সব বুঝতে পারল। বিছানা থেকে তড়াক করে উঠে পড়ে রাত জামাটা একটানে খুলে ফেলে প্যান্টটা পরে খাবার ঘরের দিকে চলল। ওর ঘরের সামনে গিয়ে দেখে ঘরের দরজা তখনো বন্ধ। বাইরে থেকে হাতলটা ঘোরাবার চেষ্টা করল কত, কিন্তু দরজা খুলল না। তার সব খেলনা যে ও ঘরেই রয়েছে, তাই তাকে এখন ও ঘরে না ঢুকলেই নয়। ওর ছোট্ট নতুন কোদালিটাও রয়েছে। হঠাৎ যেন তার অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হল, সে এখনই সেই কোদালিটা দিয়ে বাগানের মাটি খুঁড়বে। 

সেরিওজা এবার মাকে ডাকতে লাগল, ‘মা, মাগো!’ 

দরজা তেমনই বন্ধ রইল, ভেতরে সব চুপচাপ।

আবার প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মা, মা, মাগো!’ 

খালা কোথা থেকে দৌড়ে এসে এক হেঁচকায় ওকে টেনে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলল। ফিসফিস করে খালা ওকে বলছে, ‘এটা কী হচ্ছে শুনি? এত চেঁচাচ্ছ কেন? ছি, এমন করতে নেই! তুমি কি এখনও ছোট্ট ছেলেটি আছ নাকি? মা ঘুমুচ্ছে, তার ঘুম ভাঙাচ্ছ কেন?’ 

‘আমি আমার কোদালিটা দেব।’ 

‘নেবে তো নেবে। ওটা কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি? মা উঠলেই ওটা নিতে পারবে। এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো এই গুলতিটা নিয়ে খেলা কর তো সোনা। গাজর খাবে? এই যে নাও, নিজে নিজে পরিষ্কার করে খাও। কিন্তু খাওয়ার আগে ভদ্রলোকেরা হাত মুখ ধুয়ে নেয় তা জান তো? 

কেউ আদর করে কথা বললে সেরিওজা কেমন যেন হয়ে যায়, তার কথা না শুনে পারে না। শান্ত ছেলের মতো খালার হাতে হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ দুধ খেল ও। তারপর গুলতি হাতে নিয়ে বাইরে চলে এল। রাস্তার ওধারে বেড়ার উপর ঐ যে একটা চড়ুই বসে আছে। ভালো করে তাক না করেই সে পাখিটার দিকে একটা গুলি ছুড়ল। পাখিটা ফুড়ত করে উড়ে গেল। সে কিন্তু সব সময় লক্ষ্যহীনভাবেই গুলি ছোড়ে। সে জানে যে ‘ কারণেই হোক তার গুলি কখনো কোথাও ঠিক লাগবে না। লক্ষ্য ঠিক করে তাক করেও জায়গামতো গুলি লাগাতে না পারলে লিদা ওকে খেপিয়ে পাগলা করে দেবে। তাই ও যেমন-তেমন যেখানে-সেখানে গুলি ছুড়তেই ভালোবাসে। 

ওদিকে শুরিক ওর বাসার সামনে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেরিওজাকে দেখে সে বলল, ‘এস না আমরা বনে বেড়িয়ে আসি।’ 

‘বয়ে গেছে আমার বনে যেতে।’ 

দরজার সামনে বেঞ্চের ওপর সেরিওজা এবার পা দুলিয়ে বসল। আবার তার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। উঠান দিয়ে আসবার সময় ও দেখেছে ওর ঘরের শার্সিগুলো পর্যন্ত বন্ধ। তখন সে কিছু মনে করে নি। এখন হঠাৎ তার মনে পড়ল, গরমকালে কোনোদিন তো ওদের ঘরের জানালাগুলো এরকম বন্ধ থাকে না! কেবল শীতকালে যখন চারদিকে বরফ পড়তে থাকে তখনই এমনভাবে দরজা জানালা বন্ধ থাকে। আজ এ কী হল? খেলনাগুলো আনবার আর কোনো উপায়ই নেই তা হলে। কিন্তু এই মুহূর্তে খেলনাগুলো পাবার জন্য তার মনটা এমন উতলা হয়ে উঠল কেন? তার ইচ্ছে হচ্ছে আছড়ে পড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদে এখন। কিন্তু সে কি আর আগের মতো ছোট্টটি রয়েছে নাকি? তাই এখন আর মাটিতে পড়ে কাঁদাও চলে না। কিন্তু বড় হলেও-বা কী? মনটা তো মানছে না। সে যে এক্ষুনি এই মুহূর্তে তার কোদালিটা চাইছে, মা ও করোস্তেলিওভ তো তা গ্রাহ্যই করছে না! 

সে ভাবতে লাগল, ওরা উঠলেই সে তার প্রত্যেকটি খেলনা ও-ঘর থেকে খালার ঘরে নিয়ে আসবে। দেরাজের পেছন থেকে বাড়ি তৈরি করবার ব্লকটাও আনতে ভুলবে না। 

ভাস্কা আর জেঙ্কা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লিদাও ছোট্ট ভিক্তরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সবাই সেরিওজার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কোনো কথা না বলে শুধু পা দোলাতে লাগল। জেঙ্কা এবার প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’ 

ভাস্কা উত্তর দিল, ‘জান না বুঝি, ওর মা আবার বিয়ে করেছে।’ 

সবাই এবার চুপচাপ। 

একটু পরে জেঙ্কা বলল আবার, ‘কাকে বিয়ে করেছে? 

ভাস্কা বলল, ‘ইয়াস্মি বেরেগ’ রাষ্ট্রীয় খামারের ডিরেক্টার করোস্তেলিওভকে। গত মিটিঙে সে কী বকুনিই-না খেয়েছে! 

‘কেন শুনি?’ জেঙ্কা জিজ্ঞেস করল। 

‘কোনো কারণ ছিল নিশ্চয়ই’, বলে ভাস্কা ওর পকেট থেকে দোমড়ান একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল। 

জেঙ্কা বলে উঠল, ‘আমাকে একটা দাও।’ 

‘মনে হয় মাত্র একটাই আছে’, বলে ভাস্কা নিজে একটা নিয়ে জেঙ্কাকেও একটা সিগারেট এগিয়ে দিল কিন্তু। তারপর নিজে সিগারেটটা ধরিয়ে জেঙ্কাকে আগুনটা দিল। উজ্জ্বল রোদে ছোট দেশলাই কাঠির শিখাটা দেখাই যাচ্ছিল না মোটে। সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলী কেমন সুন্দর পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। মাটির উপরে দেশলাইয়ের কাঠিটা জ্বলে পুড়ে বাঁকা আর কালো হয়ে গেল। রাস্তার এধারে ওরা যেখানে সবাই জড়ো হয়েছে সেখানটায় কেমন সোনালি রোদ চিক্‌মিক্ করছে। কিন্তু ওধারটায় এখনও রোদের দেখা নেই, কেমন ছায়া ছায়া। ওদিকটায় বেড়ার কাঁটাগাছের পাতায় শিশিরকণা জমে টলমল করছে এখনও। রাস্তার ধুলোয় আঁকাবাঁকা দুটো দাগ। কে যেন ট্রাক্টর চালিয়ে গিয়েছে ঐ রাস্তা দিয়ে। 

লিদা শুরিককে ডেকে বলল, ‘জান, সেরিওজার মন খারাপ। ওর নতুন বাবা হয়েছে কিনা।’ 

ভাস্কা ওর দিকে চেয়ে সান্ত্বনার স্বরে বলল, ‘না, না, এ জন্য এত ভেব না তুমি। ভদ্রলোককে তো বেশ ভালোই মনে হল। তুমি যেমন আছ তেমনিই থাকবে। তোমার কী তাতে?’ 

সেরিওজা হঠাৎ গতরাত্রের কথাটা মনে পড়ায় বলে উঠল, ‘জান, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে বলেছে?’ 

ভাস্কা বলল, ‘সত্যি দেবে? না, এমনিই বলেছে?’ 

‘সত্যি সত্যি দেবে। আমরা দু-জনে আসছে রবিবার দোকানে যাব। কাল তো শুক্রবার, তার পরের দিন শনিবার, তার পরেই তো রবিবার।’ 

জেঙ্কা বলল, ‘দু-চাকাওয়ালা সাইকেল তো? না তিন-চাকাওয়ালা বাচ্চাদের সাইকেল?’

ভাস্কা এবার বিজ্ঞের মতো বলে উঠল, ‘না, না, বাচ্চাদের সাইকেল নিও না যেন। তুমি তো বড় হচ্ছ, এখন দু-চাকাওয়ালা সাইকেলই ভালো হবে।’ 

লিদা এতক্ষণ পর বলল, ‘ও সব বানিয়ে বলছে। ওকে কোনো সাইকেল কিনে দেবে না। 

শুরিক বলে উঠল, ‘আমার বাবাও আমাকে সাইকেল দেবে বলেছে। আসছে মাসে মাইনে পেয়েই কিনে দেবে।’ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *