জেঙ্কা

জেঙ্কা 

জেঙ্কার মা-বাবা নেই। ও ওর খালার কাছে থাকে। খালার এক মেয়ে। সে মেয়েটি দিনের বেলায় কোথায় কী কাজে যায় আর সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে কেবল নিজের পোশাক ইস্ত্রি করে। সারাটা সন্ধেবেলা কেবল ইস্ত্রি করবে, তারপর পরিপাটি করে সেজেগুঁজে ক্লাবে নাচতে চলে যাবে। পরদিন সন্ধেবেলায় আবার সেই ইস্ত্রি নিয়ে মাতবে। 

জেঙ্কার খালাও কোথায় কাজ করে। সে কলতলায় দাঁড়িয়ে প্রতিবেশিনীদের শুনিয়ে অভিযোগের সুরে কেবলই বলবে ধোয়ামোছা আর চিঠিপত্র পাঠানো দুটো কাজ করে কিন্তু বেতন পায় একজনের। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে সকলকে শোনাবে, নিজের নালিশে সে যা লিখে দিয়েছে তাতে ম্যানেজার কী রকম জব্দ হয়েছে। 

খালা সর্বদা জেঙ্কার ওপর রেগে আছে। ও নাকি কেবল একগাদা খেতেই জানে, বাড়ির কোনো কাজের বেলায় একেবারে অকর্মা। 

জেঙ্কার সত্যি কিন্তু কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই যা খাবার থাকে তা খেয়ে রাস্তার অন্য ছেলের সঙ্গে খেলতে চলে যায়। 

তারপর সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে বা পাড়াপড়শিদের সঙ্গে খেলে গল্পগুজব করে কেমন দিব্যি কাটিয়ে দেয়। সেরিওজার বাড়িতে এলে পাশা খালা ওকে সবসয়ই একটা না একটা কিছু খেতে দেবে। ওর খালা কাজ থেকে ফিরবার একটু আগে জেঙ্কা বাড়ি ফিরে ওর পড়া নিয়ে বসবে। ক্লাসে ও অনেক পিছিয়ে পড়ে আছে বলে ছুটির পড়া অনেক জমে গেছে। প্রতি বছর প্রতিটি ক্লাসে ও ফেল করছে। ভাস্কা ওর অনেক নিচু ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু এখন ভাস্কা আর ও এক সঙ্গে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে যদিও ভাস্কাও একবার ফেল করেছে। 

জেস্কার চাইতে ভাস্কা দেখতে এখন অনেক বড়সড় হয়ে গেছে, শরীরের শক্তিও অনেক বেশি ওর… 

স্যাররা প্রথম প্রথম জেঙ্কার জন্য চিন্তিত ব্যস্ত হয়ে ওর খালার কাছে যেতেন বা তাকে পাঠাতেন। খালা তাঁদের বলত : 

‘আমার যেমন পোড়া বরাত, তাই ঐ লক্ষ্মীছাড়া ছেলে আমার কাঁধে চেপেছে। ওকে নিয়ে আপনারা যা খুশি করুন, আমাকে কিছু বলবেন না। আমাকে ওটা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাচ্ছে বিশ্বাস করুন। 

খালা পড়শিদের কাছেও অভিযোগ করে বলবে, মাস্টাররা বলে ওকে নিরিবিলি পড়বার জন্য একটু বিশেষ ব্যবস্থা করে দিই না কেন কিন্তু ওর তো সে ব্যবস্থার কোনো দরকার নেই। ওর দরকার হল আচ্ছা করে চাবুক খাওয়া। কিন্তু কী করব, মরা বোনের ছেলে বলে তা-ও পারি না যে। 

স্যাররা তারপর থেকে খালার কাছে আসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁরা সবাই জেঙ্কাকে বলতে কি প্রশংসাও করেন কারণ ও নাকি খুব শান্ত আর নিরীহ। অন্য ছেলেরা ক্লাসে কেবল বকবক করে কিন্তু জেঙ্কা চুপটি করে বসে থাকে। শুধু পড়াটা বলতে পারে না একদম আর প্রায়ই ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে, এই যা দোষ। 

সুন্দর মিষ্টি স্বভাবের জন্য প্রতিবার ও সবার চেয়ে বেশি নম্বর পায়, গানের জন্যও তাই। কিন্তু অন্য সমস্ত বিষয়ে নম্বর পায় একেবারে কম। 

খালার সামনে জেঙ্কা পড়বার বা লিখবার ভান করে বলে খালা কিছু বলতেও পারে না। বাড়ি ফিরে খালা ঠিকই দেখবে জেঙ্কা রান্নাঘরের টেবিলের ময়লা বাসনপত্তর পাঁজা করে এককোণে সরিয়ে রেখে খাতা-পেন্সিল নিয়ে একমনে অঙ্ক কষছে। 

খালাই প্রথম কথা বলবে, ‘কী পাজি তুমি, খাবার জল আন নি! কেরোসিন তেলটাও তো দেখি আন নি! আঃ একটা কাজও যদি তোমাকে দিয়ে হয়! এমন অকর্মার ধাড়ি ছেলেকে আর কত দিন এমনি বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব আমি?’ 

জেঙ্কা হয়তো বলল, ‘আমি তো অঙ্ক কষছিলাম।’ 

খালা তেমনি রুক্ষ মেজাজে বকে চলল, জেঙ্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোতল হাতে নিল তেল আনতে যাবে বলে। 

খালা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে ধমকে উঠল, ‘ফাজলামো পেয়েছ, না? এখন দোকান বন্ধ হয়ে গেছে জান না ন্যাকা ছেলে?’ 

‘তা হলে কী করব বল? চেঁচাচ্ছ কেন?’ জেঙ্কা বলল। 

বাজখাই গলায় ভীষণ চেঁচিয়ে উঠে খালা এবার বলল, ‘যাও, কাঠ কেটে আন গে!! এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে বেরিয়ে যাও হতচ্ছাড়া ছেলে! কাঠ না-নিয়ে বাড়িতে একবার ঢুকেই দেখ-না!’ 

তারপর এক ঝটকায় বালতি টেনে নিয়ে তেমনই চিৎকার করতে করতে খালা জল তুলতে চলে গেল আর জেঙ্কা ধীরে-সুস্থে কাঠ কাটতে গুদামের দিকে চলল। 

খালা যে ওকে অলস, অকর্মা বলে, এটা কিন্তু একেবারেই সত্যি নয়। পাশা খালা বা ছেলেরা কেউ ওকে যে কোনো কাজ করতে বললে ও হাসিমুখে তক্ষুনি তা করে দেয়। আর একটু প্রশংসা করলে, ভালোবেসে দুটো মিষ্টিকথা বললে তো আর কথাই নেই। প্রাণপণ করে তার কাজ করে দেবার চেষ্টা করবে ও। একবার ও আর ভাস্কা একগাদা কাঠ কেটে ঠিকঠাক করে গুদামে তুলে দিয়েছিল। 

সবাই যে ওকে বোকা বলে তাও ও নয় কিন্তু। সেরিওজার মেকানো-সেটটা নিয়ে জেঙ্কা আর শুরিক একবার এমন সুন্দর নিখুঁত একটি রেলওয়ে সিগন্যাল তৈরি করেছিল যে অনেক দূর থেকে, এমনকি কালিনিন স্ট্রিট থেকেও ছেলেরা সেটা দেখতে এসেছিল। সিগন্যালটায় একটা লাল আর সবুজ আলো জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটা তৈরি করতে শুরিক অবশ্য অনেক সাহায্য করেছে। শুরিক কলকব্জার কাজ আবার বেশ ভালোই বোঝে আর জানে। কারণ ওর বাবা তিমোখিন লরি চালায় কিনা। কিন্তু সেরিওজার নববর্ষের গাছ সাজাবার জন্য খেলনা থেকে ঐ লাল আর সবুজ আলো সিগন্যালটায় জুড়ে দেবার কথা জেঙ্কাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। 

সেরিওজার প্লাস্টাসিন দিয়ে ও কতবার ছোট ছোট জীবজন্তু ও মানুষ তৈরি করেছে, দেখতে সত্যিকারের মতো। সেরিওজার মা তা দেখে তাকেও ওরকম একবাক্স প্লাস্টাসিন কিনে দিয়েছে। কিন্তু জেঙ্কার খালা দেখে রেগে আগুন। বাক্সভরা প্লাস্টাসিন সে ছুড়ে ফেলে দেয়। 

ভাস্কার কাছ থেকে জেঙ্কা কিন্তু সিগারেট খাবার বদঅভ্যাসটি আয়ত্ত করেছে। ওর তো আর পয়সা নেই, তাই ভাস্কার কাছ থেকেই খায়, রাস্তার উপর সিগারেটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখলেই ও তা কুড়িয়ে নিয়ে টানতে শুরু করবে। সেরিওজাও ওর কষ্ট বুঝতে পারে, তাই রাস্তা থেকে সিগারেটের টুকরো তুলে এনে প্রায়ই ওকে দেয়। 

ভাস্কার মতো জেঙ্কা অবশ্য ছোটদের সঙ্গে কখনো মাতব্বরি করতে যায় না। সে যখন-তখন ছোট ছেলেদের সঙ্গে ওরা যেমন চায় খেলা করতে ভালোবাসে। সৈন্য সৈন্য খেলা বা লটো খেলা, যা হোক! সবার চেয়ে ও বয়সে বড় বলে সৈন্য সৈন্য খেলায় সেনাপতি হতে চায়। আর লটো খেলায় জিতলে খুব খুশি কিন্তু হারলেই মুখ গোমড়া হয়ে যায়। 

জেঙ্কার মুখখানি দেখতে বেশ মিষ্টি, ঠোঁট বেশ বড়, কান দুটো লম্বা লম্বা আর চুলগুলো ঘাড় বেয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। কারণ চুল তো কাটা হয় খুব কদাচিৎ। 

একদিন সেরিওজাকে সঙ্গে নিয়ে ভাস্কা আর জেঙ্কা বনের মধ্যে গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে আলু পোড়াতে লেগে গেল। আলু, নুন আর কচি পেঁয়াজ ওরা সঙ্গেই এনেছে। ধিকিয়ে ধিকিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে আগুন জ্বলছে। ভাস্কা জেঙ্কাকে বলল, ‘ভবিষ্যৎ জীবনে তুমি কী হবে বল শুনি।’ 

জেঙ্কা হাঁটু গুটিয়ে বসে আছে। খাটো পায়জামা উঠে গিয়ে ওর সরু লিকলিকে পা দুটো দেখা যাচ্ছে। উদাস অপলক দৃষ্টিতে ও আগুনের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আছে নীরবে। 

ভাস্কাই আবার বলল, ‘ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক, স্কুলটা তো আগে শেষ করতে হবে, কী বল? শিক্ষা না থাকলে জীবনটাই যে ব্যর্থ!’ ভাস্কা বেশ ভারিক্কি চালে কথাটা বলল যেন পড়াশোনায় সে একেবারে প্রথম, জেঙ্কার থেকে যেন গোটা পাঁচেক ক্লাস উপরে পড়ছে। 

জেঙ্কা মাথা নেড়ে বলল, ‘তা সত্যি। পড়াশোনা না করলে কোনো কাজেই লাগব না আমি।’ 

একটা কাঠি তুলে নিয়ে ও এবার আগুনটা খুঁচিয়ে দিল, ভিজে ডালপালাগুলো ছ্যাক্ ছ্যাঁক্ করে উঠল। পাতার রস পড়ে আগুনটা খানিক ঝিমিয়ে গেল। রকমারি গাছের মাঝখানটিতে একটু ফাঁকা জায়গায় ওরা বসে আছে। এ জায়গাটা ওদের কাছে খেলার আদর্শ জায়গা। বসন্তকালে এখানে কত বুনো ফুল ফোটে। গরমকালে আবার বেজায় মশার দৌরাত্ম্য হয়। এখন ধোঁয়ার জন্য মশারা তেমন সুবিধা করতে পারছে না, তবে মশাদের মধ্যেও যারা বেশ সাহসী আর চালাক তারাই মাঝে মাঝে ওদের হাতে পায়ে হুল ফুটিয়ে দিচ্ছে সুযোগমতো। আর ওরা দু-হাতে মুখ-হাত-পা চাপড়াচ্ছে। 

ভাস্কা আবার বলল, ‘তোমার খালাটা বড় বাড়াবাড়ি করছে, একটু সমঝে দেওয়া যায় না?’ 

‘ওকে বাবা!’ জেঙ্কা বলে উঠল, ‘একবার দিয়েই দেখ না!’ 

‘তাকে একদম গ্রাহ্যই করবে না, বুঝলে?’ 

‘গ্রাহ্য আমি তেমন করি না। কিন্তু জান তো, খালা সারাক্ষণই পেছনে লেগে আছে। তাই আর আমার ভালো লাগে না।’ 

‘লিউস্কা কী বলে? ওর ব্যবহার কেমন?’ 

‘তা, ও তেমন দুর্ব্যবহার করে না। তাছাড়া ওর তো বিয়েই হয়ে যাচ্ছে।’ 

‘কাকে বিয়ে করছে?’ 

‘কে জানে! যে কেউ হোক একজনকে করবেই। ওর নাকি অফিসার বিয়ে করবার সাধ হয়েছে। তা, এখানে আর অফিসার কোথায় আছে বল? তাই হয়তো অফিসার বরের খোঁজে অন্য কোথাও যাবে।’ 

লকলকে জিভ বের করে এতক্ষণে আগুনটা আরো একআঁটি জ্বালানি আর একরাশ পাতা গিলে ফেলল যেন। এবার আর তেমন ধোঁয়া উঠছে না। পট্ করে কী যেন ফুটল, ধোঁয়া চলে গিয়েছে। 

ভাস্কা সেরিওজাকে বলল, ‘কিছু শুকনো ডালপালা কুড়িয়ে নিয়ে এস তো।’ 

সেরিওজা দৌড়ে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে দেখে ভাস্কা এক মনে গম্ভীর চালে জেঙ্কার কথা শুনছে। 

জেঙ্কা তখন বলছে, ‘আমি ওখানে রাজার হালে থাকব, সন্ধেবেলায় হোস্টেলে ফিরে দেখব আমার জন্য বিছানার পাশে একটা আলমারি। আমি খুশিমতো শুয়ে থাকব, রেডিও শুনব, চেকার্স খেলব, বকাবকি করার কেউ থাকবে না। খেলাধুলা চলবে। কী মজা! তারপর রাত্রিবেলা আটটার সময় খেতে দেবে… 

‘শুনতে তো বেশ ভালোই লাগছে। কিন্তু তোমাকে নেবে তো?’

‘আমি দরখাস্ত পাঠাব। কেন নেবে না? নিশ্চয়ই নেবে।’ 

‘তোমার বয়স এখন কত হল বল তো?’ 

‘গত সপ্তাহে চোদ্দ পূর্ণ হয়েছে। 

‘তোমার খালার কোনো আপত্তি নেই তো?’ 

‘না, খালার কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্তু শুধু ভয় যে আমি ভবিষ্যতে হয়তো তাকে কোনো সাহায্যই করব না।’ 

‘মরুক গে তোমার খালা। তার কথা কে আর ভাবছে?’ ভাস্কা তার জোরালো ভাষায় আরো কী গালাগালি দিল। 

জেঙ্কা বলল, ‘ভাবছি আমি যেমন করে পারি যাবই ওখানে।’ 

‘তোমার এখন কাজ হচ্ছে, কী করবে না করবে সে সম্বন্ধে মন স্থির করে ফেলা এবং যা করার করে ফেলা’, ভাস্কা বলল। ‘তুমি বলছ, তুমি ভাবছ। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পড়াশোনার মরশুম শুরু হবে, আবারও যে-কে-সেই হয়ে দাঁড়াবে।’ 

জেঙ্কা বলল, ‘হাঁ, মনে হয় মন-স্থির করে যা করার করে ফেলব। তুমি জান ভাস্কা, প্রায়ই এ কথাটা আমি ভাবি। শিগগিরই যে সেপ্টেম্বর আসছে, সে কথা মনে হলেই আতঙ্ক হয়, সমস্ত উৎসাহ দমে যায় একদম…’ 

ভাস্কা বলল, ‘কিছুই আশ্চর্য নয় তাতে।’ 

আলুগুলো সেদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত ওরা জেঙ্কার পরিকল্পনা সম্বন্ধেই জল্পনা-কল্পনা করল। তারপর আঙুল পুড়িয়ে কচি পেঁয়াজের সরস গোড়াগুলো কড়মড় করে চিবিয়ে আলুসেদ্ধগুলো পরম তৃপ্তিভরে খেয়ে ওরা এখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। 

দুপুর গড়িয়ে বেলাশেষে সূয্যিমামা ঢলে পড়ল একপাশে, বনের ভিতর ফাঁকা এই সুন্দর জায়গাটুকু ক্রমে অন্ধকার হয়ে এল। গাছের গোড়াগুলো পড়ন্ত সূর্যের আলোয় লালচে হয়ে এল। ছাইচাপা আগুনের উপর বনের ছায়া এসে পড়ল। ওরা ঘুমোবার সময় সেরিওজাকে মশা তাড়াবার জন্য ওদের গায়ে হাওয়া করতে বলেছিল। তাই সে বাধ্য ছেলের মতো একটা পাতাওয়ালা ডাল হাতে নিয়ে ওদের গায়ের ওপর দোলাচ্ছে। ডালটা দোলাতে দোলাতে ভাবছে, জেঙ্কা কোনোদিন কাজ করলে ওর খালাকে কি সত্যিই টাকা দেবে? কেন দেবে? ওর খালাটা তো কেবল ওকে বকে আর ধমকায়। তবে? একটু পরেই এসব ভাবতে ভাবতে সেরিওজা নিজেও ওদের দু-জনের মাঝখানটিতে অকাতরে ঘুমে ঢলে পড়ল। তারপর সে স্বপ্ন দেখতে লাগল—একদল অফিসারের সঙ্গে জেঙ্কার খালাত বোন লিউস্কা হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে। 

সাধারণত জেঙ্কা শুধু ভাবে, ভাবনাকে কাজে পরিণত করতে চেষ্টা করে না কখনো। কিন্তু পয়লা সেপ্টেম্বর এগিয়ে আসছে, স্কুল খোলার তোড়জোড় শুরু করেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে গিয়ে নতুন বইপত্র নিয়ে এল। লিদা নতুন ইউনিফর্ম পরে গর্বিতভাবে সকলকে দেখাতে লাগল। নতুন বছর শুরু হয়ে এল বলে। এমনি সময়ে জেঙ্কা মন স্থির করে ফেলল। কোনো ট্রেড স্কুলে অথবা কলকারখানার স্কুলে, যেখানে হোক ওকে যেতেই হবে। 

অনেকেই ওকে এ ব্যাপারে সাহায্য করল। ওকে নেবার জন্য তদ্বির করে স্কুল থেকে বিশেষ পরিচয়পত্র দেওয়া হল। করোস্তেলিওভ আর মা ওকে পথখরচের জন্য পয়সা দিয়ে দিল। এমনকি ওর খালাও পথে খাবার জন্য পিঠে তৈরি করে ওর সঙ্গে দিল। 

যাবার দিন সকালবেলা ওর খালা একটুও চিৎকার না করে শান্তস্বরে ওকে বিদায় সম্ভাষণ জানাল আর তাদের উপকারের কথা ভুলে না যেতে অনুরোধ করল বার বার। জেঙ্কা বলল, ‘হাঁ, মনে রাখব। তুমি যা করেছ তার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, খালা। খালা কাজে চলে গেলে জেঙ্কা যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল। 

খালা ওকে একটা সবুজ রঙের কাঠের নড়বড়ে বাক্স দিয়েছে। দেবে কি দেবে না তা ভাবতে ভাবতেও অনেক সময় গেছে। তারপর অবশ্য বাক্সটা দিয়ে বলেছে, ‘আমার একখানি হাত যেন কেটে তোমায় দিয়ে দিলাম, বুঝলে তো?’ সেই বাক্সটায় জেঙ্কা ওর একটা শার্ট, ছেঁড়াখোঁড়া এক জোড়া মোজা, একটা তোয়ালে আর পিঠেগুলো ভরে নিল। অন্য ছেলেরা ওর বাঁধাছাঁদা দেখতে লাগল। সেরিওজা এক দৌড়ে বাড়িতে চলে গেল। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই রেলওয়ে সিগন্যালটা হাতে নিয়ে ফিরে এল। এতদিন এটাকে টেবিলের উপর অতিথি-অভ্যাগতদের দেখাবার জন্যই সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। আজ ওটা জেঙ্কার হাতে দিয়ে সে বলল, ‘এটা নিয়ে যাও, তোমাকে দিলাম।’ 

জেঙ্কা বলল, ‘এটাকে নিয়ে কী করব আমি? কেমন করে নিয়ে যাব? এমনিতেই তো পনের কিলোগ্রাম মাল হয়েছে!’ 

সেরিওজা আবার এক দৌড়ে গিয়ে একটা বাক্স হাতে ফিরে এল। বলল, ‘তাহলে এই বাক্সটা নাও। এর মধ্যে ওটাকে ভরে নিতে পারবে। বেশ হালকা এটা!’ 

জেঙ্কা বাক্সটা নিয়ে খুলে দেখে খেলনা বানাবার জন্য প্লাস্টাসিনের কতগুলো টুকরো রয়েছে তার মধ্যে। জেঙ্কার মুখখানি এবার খুশিতে ঝলমল করে উঠল। বাক্সে গুছিয়ে নিল সেগুলো। 

তিমোখিন জেঙ্কাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলেছিল। শহরে এখনও রেললাইন বসে নি, স্টেশনটা আবার ত্রিশ কিলোমিটার দূরে…কিন্তু ঠিক আগের দিন তিমোখিনের লরিটা কী জানি কেন বিগড়ে বসল। শুরিক এসে বলল, লরিটাকে কারখানায় সারাতে দেওয়া হয়েছে আর ওর বাবা এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। 

ভাস্কা বলল, ‘ভেব না। কেউ না কেউ তোমাকে ঠিক তার গাড়িতে তুলে নেবেই।’

সেরিওজা বলল, ‘কেন, বাসেও তো যেতে পার।’ 

শুরিক বলে উঠল, ‘কী বোকা ছেলে, বাসে যেতে পয়সা লাগে না?’ 

জেঙ্কা বলল, ‘আচ্ছা চল, বড় রাস্তায় যাওয়া যাক তো, গাড়ি যেতে দেখলে হাত দেখিয়ে গাড়িটা থামালে আমাকে নিশ্চয়ই তুলে নেবে।’ 

ভাস্কা ওকে এক প্যাকেট সিগারেট দিল। ভাস্কার কাছে দেশলাই না থাকায় জেঙ্কা ওর খালার দেশলাইটাই নিয়ে নিল। তারপর ওরা সবাই বের হল। জেঙ্কা বাড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা সিঁড়ির তলায় রেখে দিল। তারপর সবাই মিলে রওনা হল। উঃ! বাক্সটা কী ভারি, একতাল সিসে যেন! জেঙ্কা একবার এ-হাত ও-হাত বদলে বদলে বাক্সটা নিয়ে চলল। ভাস্কা জেঙ্কার কোটটা নিয়েছে। লিদা ছোট্ট ভিক্তরকে কোলে করে চলেছে। পেটের সঙ্গে জাপটে ধরে মাঝে মাঝে বাচ্চাটাকে ধমকাচ্ছে, ‘আঃ! চুপ কর না দুষ্টু ছেলে!’ 

হু হু করে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। শহর ছাড়িয়ে যে বড় রাস্তাটা স্টেশনের দিকে চলে গেছে ওরা তার উপর দিয়ে চলল। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ধুলো ওদের চোখের ভেতরে ঢুকতে লাগল। রাস্তার দু-পাশে ধুলোয় ঢাকা ছাই রঙের ঘাস আর বিবর্ণ ফুলগুলো মাটিতে লুটিয়ে কাঁপছে কেবল। উপরে নীল আকাশের বুকে শাদা শাদা হালকা মেঘের দল আপন মনে ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। একটু নিচে কালো এক টুকরো মেঘ কোথা থেকে তেড়ে ফুঁসে আসছে যেন। সেইটে থেকে যেন বাতাস বইছে আর মাঝে মাঝে ধুলোর মধ্য দিয়ে ধারালো, তাজা এক-একটা আমেজ আসছে আর বুকে বেশ আরাম হচ্ছে। ছেলের দল রাস্তার একপাশে থমকে দাঁড়াল, বাক্সাটা নামিয়ে রেখে লরি বা গাড়ির অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চর্য, আজ সমস্ত লরি আর গাড়িগুলোই যেন উল্টো দিকে যাচ্ছে। যাক্ শেষ পর্যন্ত ভারি বাক্স বোঝাই একটা লরি আসছে দেখা গেল। ড্রাইভারের পাশটিতে কেউ নেই। ছেলেরা হাত ওঠাল কিন্তু ড্রাইভার এক নজর তাকিয়ে দেখেই লরিটা নিয়ে উধাও হয়ে গেল। তারপর একটা গাড়ি এগিয়ে এল। ড্রাইভার ছাড়া আর একজন মাত্র আরোহী ছিল গাড়িটাতে। কিন্তু এই গাড়িটাও হুস্ করে চলে গেল। 

শুরিক বলে উঠল, ‘কী আপদ!’ 

ভাস্কা এবার বলল, ‘তোমরা সবাই মিলে হাত তুলছ কেন বল তো? কী বোকামি! ওরা ভাবছে আমরা সকলে মিলে বুঝি গাড়িতে যেতে চাইছি। জেঙ্কা, তুমি এগিয়ে এসে একা হাত দেখাও তো। ঐ যে, আরেকটা গাড়ি আসছে।’ 

ছেলেরা সবাই ভাস্কার নির্দেশ মেনে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়িটা এগিয়ে আসতেই জেঙ্কা আর ভাস্কা হাত তুলল শুধু। ভাস্কা নিজেই নিজের নির্দেশ অমান্য করল। বড় ছেলেরা অবশ্য ছোটদের যা করতে বলবে নিজেরা কখনো তা করবে না, এটাই ওদের রীতি… 

গাড়িটা একটু এগিয়ে গিয়ে তারপর আচমকা থেমে গেল। জেঙ্কা বাক্স হাতে দৌড়ে গেল। ভাস্কাও এগিয়ে গেল কোটটা হাতে নিয়ে। ক্লিক করে দরজাটা খুলে যেতে জেঙ্কা এক লহমায় গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে ভাস্কাও গাড়ির ভেতর উধাও। তারপর একরাশ ধুলো উড়িয়ে চারদিকে অন্ধকার করে দিয়ে গাড়িটাও উধাও হয়ে গেল। ধুলো একটু কমলে ওরা অবাক হয়ে দেখল জেঙ্কা আর ভাস্কাকে নিয়ে গাড়িটা ততক্ষণে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। এবার বুঝল ভাস্কা ওদের সঙ্গে কী চালাকি করল। কাউকে কিছু না বলে কেমন চালাকি করে জেঙ্কার সঙ্গে গাড়িতে চড়ে সে-ও স্টেশনে চলে গেছে! 

ওরা আর কী করবে? বাড়ি ফিরে চলল। বাতাসটা এবার ওদের পিঠের ওপর আছড়ে পড়ে ওদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে যেন। সেরিওজার ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে তার চোখেমুখে পড়ছে বার বার। 

লিদা বলল, ‘জেঙ্কার জামাটা একেবারে ছেঁড়া। খালা ওকে একটাও জামা তৈরি করিয়ে দেয় নি।’ 

‘খালা বেচারিই-বা কী করবে বল? যেখানে কাজ করে সেখানকার ম্যানেজারটা মহা পাজি, রীতিমতো ঠকায় ওকে’, শুরিক বলল। 

এদিকে সেরিওজা বাতাসের ধাক্কায় পথ চলতে চলতে অন্য কথা ভাবছিল। সে ভাবছে জেঙ্কাটা কী ভাগ্যবান! কেমন মজা করে ট্রেনে চড়বে! জন্মে অবধি সেরিওজা তো কোনোদিন ট্রেনে চড়ে নি…সহসা আকাশ কেমন কালো থমথমে হয়ে এল। এদিক থেকে ওদিকে আকাশের বুক ছিঁড়ে একটা আগুনের হলকা চলে গেল, মাথার উপর কামান থেকে যেন ভীষণ মেঘ ডাকল, তারপরই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল ওদের উপর…ওরা প্রাণপণে দৌড়োচ্ছে আর দৌড়োচ্ছে। কাদায় পা পিছলে যেতে চায়। সমস্ত আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের নাচানাকি শুরু হয়েছে, বাতাসের মাতামাতির সঙ্গে বাজ পড়ার হুঙ্কারও শোনা যাচ্ছে। ছোট্ট ভিক্তর এবার কাঁদতে শুরু করল… 

এমনি করে জেঙ্কা ওদের ছেড়ে চলে গেল। কিছুদিন পর ওর দুটো চিঠি এল, একটা ভাস্কার কাছে, আরেকটা খালার কাছে। ভাস্কাকে ও কী লিখেছে ওদের কাউকে কিছু বলল না। এমন হাবভাব করল যেন কত গোপন কথা লেখা আছে চিঠিটাতে। কিন্তু খালার কাছ থেকেই সবাই জানতে পারল জেঙ্কা ট্রেড স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং হোস্টেলে থাকে। ওরা নাকি ওকে একটা নতুন পোশাকও দিয়েছে। খালা চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে, যাক, ছেলেটার একটা হিল্লে করে দিতে পারলাম বলে ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। এখন ছোঁড়াটা মানুষ হয়ে যাবে। আমিই তো সব করলাম!’ 

জেঙ্কা কোনোদিনই ওদের দলের সর্দার হতে পারে নি। ও একটু ভাবুক প্রকৃতির ছিল বলেই সর্দারি মোড়লি করতে পারত না। তাই ছেলেরা ক্রমে ক্রমে ওর কথা ভুলে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে যখন ওরা ওকে মনে করত তখন শুধু ভাবত জেঙ্কা ওখানে কেমন আরামেই আছে-বিছানার পাশে আলমারি, ওকে আনন্দ দেবার জন্য কত নাচ গান। সৈন্য সৈন্য খেলবার সময় এখন শুরিক বা সেরিওজাই সেনাপতি সাজে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *