বুদ্ধির অগোচরে

বুদ্ধির অগোচরে 

তারপর একদিন বিছানা ছেড়ে উঠে একটু-আধটু বাইরে যাবার অনুমতি পেল সে। আবার বুঝি কিছু হয় এই ভয়ে বাড়ি থেকে বেশি দূরে বা অন্য কোনো বাড়িতে ওরা তাকে যেতে দিত না। 

সকালবেলায় যখন তার বন্ধুরা সবাই স্কুলে চলে যায় শুধু তখনই ওকে বাইরে বের হতে দেওয়া হয়। শুরিকের বয়স এখনও সাত বছর পূর্ণ হয় নি, কিন্তু তবুও ওকে স্কুলে যেতে হচ্ছে। বাবা-মা ঐ সব উল্কির ঘটনার পরেই ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। যখন তখন বাইরে বেরিয়ে দুষ্টুমিতে মন দিতে পারবে না। তাছাড়া মাস্টার মহাশয়দের চোখের সামনেও থাকবে…ছোটদের সঙ্গে খেলতে সেরিওজার ভালো লাগে না। 

একদিন সে উঠানে নেমে আসতেই দেখল ছেঁড়া টুপি মাথায় অদ্ভুত চেহারার একটি লোক তাদের চালাঘরের পাশে একগাদা কাঠের উপর বসে আছে। মুখখানি তার বড্ড শুকনো আর গায়ের জামা শতচ্ছিন্ন। লোকটা একটা সিগারেটের খুব ছোট্ট একটা টুকরো থেকে ধূমপান করছে, টুকরোটা এত ছোট যে মনে হচ্ছে আঙুলের ফাঁক দিয়েই বুঝি ধোঁয়াটা উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। লোকটার আঙুল এবার পুড়ে না যায়!… অন্য হাতে একটা নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ফিতের বদলের দড়ি দিয়ে লোকটার জুতো বাঁধা। এক পলকে লোকটার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সেরিওজা এবার প্রশ্ন করল : 

‘তুমি বুঝি করোস্তেলিওভের কাছে এসেছ?’ 

লোকটা বলল, ‘সে আবার কে? আমি তাকে চিনি না।’ 

‘তাহলে লুকিয়ানিচকে চাও?’ 

‘তাকেও আমি চিনি না।’ 

‘ওরা কেউই বাড়ি নেই। শুধু আমি আর পাশা খালা আছি। আচ্ছা, তোমার ব্যথা লাগছে না?’ 

‘কোথায়?’ 

‘তোমার আঙুল পুড়ে যাচ্ছে যে।’ 

‘ও!’ 

শেষবারের মতো সিগারেটের টুকরোটাতে একটা টান মেরে সে ওটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে মাড়িয়ে আগুনটা নেভাল। 

সেরিওজা এবার বলল, ‘তোমার ঐ হাতটা…ওটাও কী আগে পুড়িয়েছ নাকি?’ 

লোকটা কোনো উত্তর দিল না। ওর দিকে করুণ কাতর দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে একটা মুখভঙ্গি করল শুধু। সেরিওজা অবাক হয়ে ভাবল ও কেন আমার দিকে অমন করে তাকাচ্ছে? লোকটা এবার ওকে প্রশ্ন করল : 

‘আচ্ছা খোকা, তোমরা এখানে কেমন আছ? বেশ ভালো?’ 

‘হাঁ, খুব ভালো আছি।’ 

‘এখানে জিনিসপত্র বেশ ভালোই পাওয়া যায়? 

‘কী রকম জিনিসপত্র? 

‘আচ্ছা, তোমাদের কী কী জিনিসপত্র আছে বল তো?’ 

‘আমার একটা সাইকেল আছে। তাছাড়া খেলনা তো আছেই। যত রকমের খেলনা চাও সব পাবে। লিওনিয়ার কিন্তু শুধু ঝুমঝুমি ছাড়া তেমন কোনো খেলনা নেই।’ 

‘আচ্ছা, তোমাদের কাপড়-চোপড় কোথায় থাকে বলতে পার খোকা? এই ধর কোট বা স্যুট তৈরি করবার কাপড়?’ 

‘ওসব তো আমাদের এখানে বিশেষ কিছু নেই। ভাস্কার মা’র ওখানে অনেক আছে।’

‘ভাস্কার মা কে? কোথায় থাকে? 

আরও কী কথাবার্তা ওদের চলত কে বলতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তে সদর দরজা খোলার শব্দ হল। লুকিয়ানিচ ঢুকেই লোকটাকে দেখতে পেয়ে বলল : 

‘কে তুমি? কী চাও?’ লোকটা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বেচারার মতো করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। 

তারপর বলল, ‘আমি কাজ খুঁজছি।’ 

‘বাড়ির ভেতর ঢুকে কাজ খোঁজা হচ্ছে? কোথায় থাক তুমি?’ 

‘থাকবার জায়গা নেই এখন।’ 

‘আগে কোথায় থাকতে?’ 

‘অনেকদিন আগেই সে আস্তানা ঘুচে গেছে।’ 

‘তাহলে, জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছ বুঝি?’ 

‘হাঁ, একমাস আগে ছাড়া পেয়েছি।’ 

‘জেলে গিয়েছিলে কেন?’ 

কিছুক্ষণ নীরব থেকে লোকটা বলল, ‘ওদের মতে আমার নিজের জিনিস আর পরের জিনিসে নাকি আমি তফাত কিছু দেখি নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওসব আমি কিছুই করি নি। ভুল করে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।’ 

‘তা, ছাড়া পেয়ে তুমি তোমার বাড়িতে না গিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করছ কেন বল তো?’ 

‘বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু বৌ আমাকে ঘরে ঢুকতে দেয় নি। এখন সে অন্য একজন লোককে বিয়ে করেছে, সে একটা দোকানদার। তাই আমি ভবঘুরে হয়ে পথে পথে ঘুরছি আমার মা অনেক দূরে চিতায় থাকে। ভাবছি তার কাছেই চলে যাব।’ 

সেরিওজা হাঁ করে অবাক হয়ে লোকটার কথা শুনছিল। এই লোকটা জেলে ছিল!….. বইয়ে সে জেলখানার ছবি দেখছে। শক্ত লোহার শিক দিয়ে ঘেরা জেলখানা। ঢাল-তলোয়ার হাতে গোঁফ-দাড়িওয়ালা পাহারাওয়ালারা জেলখানার ফটকে। লোকটার আবার মা-ও আছে তাহলে! মা নিশ্চয়ই ওর জন্য কত কাঁদে। বেচারি মা…ছেলে এবার মায়ের কাছে ফিরে গেলে মা না-জানি কত খুশি হবে! ছেলেকে মা এবার একটা পোশাক তৈরি করিয়ে দেবে, জুতোর ফিতেও কিনে দেবে… 

লুকিয়ানিচ বলছিল, ‘চিতা…সে তো অনেকটা পথ। এখন তাহলে কী করবে শুনি? সৎপথে রোজগার করবে তো? না, আবার সেই রকম তোমার নিজের আর আমার জিনিসের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ রাখবে না?…’ 

‘আপনার এই কাঠগুলো চিরতে দিন আমায়’, লোকটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল এবার।

‘আচ্ছা, বেশ তো। লুকিয়ানিচ চালাঘরের ভেতর থেকে একটা করাত এনে লোকটার হাতে দিল। 

পাশা খালা ওদের এই কথাবার্তা শুনতে পেয়ে কিছুক্ষণ হল উঠানের একপাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এবার কেন কে জানে খালা হঠাৎ মুরগিগুলোকে ওদের খুপড়িতে ঢুকবার জন্য ডাকাডাকি শুরু করে দিল। ওদের ঘুমের সময় কিন্তু এখনও হয় নি। তবুও খালা ওদের খাঁচায় পুরে ঘরের দরজাটায় তালা লাগিয়ে চাবিটা পকেটের রাখল। তারপর সেরিওজাকে ফিসফিস করে বলল : 

‘লোকটার ওপর একটু নজর রেখ তো। দেখ, করাতটা যেন আবার নিয়ে না পালায়।’ তারপর থেকে সেরিওজা লোকটার আশপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। তার ডাগর দু-টি চোখে কেমন একটু কৌতূহল, সন্দেহ, ভয়, করুণা মেশানো বিচিত্র দৃষ্টি। আর লোকটার সঙ্গে কথা বলতে সাহস হচ্ছে না তার। লোকটার জীবন কী রহস্য আর বৈচিত্র্যে ভরা, একথা ভেবে ভেবে তাকে যেন সে একটু শ্রদ্ধার চোখেই দেখছে। লোকটাও আর কোনো কথা বলছে না। খুব উৎসাহ নিয়ে কাঠের বুকে করাত চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে একটু বসে সিগারেট বানিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। 

সেরিওজাকে দুপুরে খেতে ডাকলে সে বাড়ির মধ্যে গেল। মা আর করোস্তেলিওভ আজ বাড়িতে নেই। ওরা তিনজনে খেতে বসল। খাওয়াদাওয়ার পর লুকিয়ানিচ পাশা খালাকে বলল : 

‘ঐ লোকটাকে আমার পুরানো জুতোজোড়াটা দিয়ে দিও তো।’ 

খালা বলল, ‘আরও কয়েকদিন ওটা তুমিই পরতে পারবে। লোকটার তো জুতো রয়েছে দেখলাম। 

ঐ জুতো পরে ও চিতায় পৌঁছতে পারবে নাকি?’ 

‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে। কালকের অনেক খাবার রয়েছে, ওকে কিছু খেতে দিই।’

লুকিয়ানিচ এবার বিশ্রাম করতে গেল। খালা খাবার টেবিলের উপর থেকে টেবিলক্লথটা সরিয়ে রাখল। 

সেরিওজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘টেবিলক্লথটা সরালে কেন?’ 

খালা বলল, ‘দেখছ-না কী রকম নোংরা লোকটা, টেবিলক্লথ ছাড়াই ওর চলবে।’

তারপর খালা সুপটা গরম করে কয়েক টুকরো রুটি নিয়ে লোকটাকে ডেকে বলল : ‘এই যে খেয়ে নাও।’ 

লোকটা এগিয়ে এলে খালা ওর হাতমুখ ধোয়ার জন্য জল ঢেলে দিল। ছোট একটা তাকের উপর দুটো পাত্রে সাবান ছিল। একটা গোলাপি রঙের, অন্যটা ছাই রঙের। লোকটা ছাই রঙের কাপড়কাচার সাবানটাকে নিয়ে হাত ধুল। গোলাপি রঙের সাবানটা দিয়ে যে হাতমুখ ধুতে হয় বেচারা বোধহয় তা জানেও না, হয়তো টেবিলক্লথ বা আজকের সুপের মতো গোলাপি সাবানটাও ওর জন্য নয়। ওকে কত নিরীহ আর গোবেচারাই-না মনে হচ্ছে! কিছুটা অদ্ভুতভাবে, কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে সে রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে গেল, যেন তার পায়ের ভরে মেঝেটা ভেঙে যাবে ভেবে ভয় পাচ্ছে। পাশা খালার নজর কিন্তু তার দিকে আছেই। তারপর খেতে বসে সে নিজের দেহের উপর হাত দিয়ে ক্রশচিহ্ন আঁকল। সেরিওজা দেখল, খালা ওতে খুশি হয়েছে। ওকে অনেকটা ঝোল আর রুটি দিয়ে বলল : 

‘নাও, পেট ভরে খেয়ে নাও।’ 

লোকটা যেন চক্ষের পলকে সবটা ঝোল আর তিন টুকরো রুটি গোগ্রাসে গিলে ফেলল। খালা আরো একটু ঝোল আর ছোট্ট একটা গ্লাসে একটু ভদকা দিয়ে বলল : 

‘এবার ভদকা খেতে পার। খালি পেটে খেলেই অসুখ করে। 

খুব খুশি হয়ে মুখের কাছে গ্লাসটা তুলে ধরে ও বলল : 

‘ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।’ 

তারপর এক লহমায় তলানিটুকু পর্যন্ত ঢকঢক করে গিলে ফেলে শূন্য গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখল। সেরিওজা সপ্রশংস দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল আর ভাবছিল, সত্যি লোকটা কী চটপটে! 

ও এবার আস্তে আস্তে খেতে লাগল এবং খালার সঙ্গে বেশ আলাপ জমিয়ে তুলল। ওর বউ ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে সেকথা খালাকে জানিয়ে ও বলল : 

‘জানেন, আমার অনেক জিনিস ছিল। সেলাইকল, গ্রামোফোন, বাসনপত্তর কোনোটার অভাব ছিল না…কিন্তু আমাকে ও একটা জিনিসও দিল না। আমাকে দেখেই বলল, ‘যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও। আমার জীবনটা তো নষ্ট করেছ, আর কেন?’ আমি ওকে অনেক অনুরোধ করে বললাম, শুধু গ্রামোফোনটা দাও আমাকে। ওটা তো আমাদের দু-জনের টাকায় কেনা হয়েছিল। তবু ওটা দিল না। সে তার নিজের পোশাক করেছে আমার স্যুট কেটে। আমার কোট বেচে দিয়েছে দোকানে। 

‘আগে কেমন ছিলে? দু-জনে বেশ সুখে ছিলে?’ খালা প্রশ্ন করল। 

‘হাঁ, একেবারে কপোত-কপোতীর মতো। আমাদের দু-জনের মধ্যে কত ভালোবাসাই না ছিল! আমার জন্য একেবারে পাগল ছিল সে। কিন্তু এখন সব বদলে গেছে। একটা হতচ্ছাড়া লোককে বিয়ে করেছে, লোকটা দেখতে কদাকার, বেঁটে, একটা দোকানদার।’ 

তারপর সে তার মায়ের গল্প বলতে লাগল। মা ওকে জেলখানায় কত কী জিনিস পাঠাত তা-ও বলল। ওর দুঃখের কাহিনী শুনে খালা তো নরম হয়ে গেছে মনে হল। এবার কয়েক টুকরো মাংস আর চা এনে দিল। তারপর একটা সিগারেটও দিল। 

লোকটা আবার বলল, ‘মা’র কাছে যাচ্ছি। একটা কিছু তার জন্য নিয়ে যেতে পারলে ভালো হত। গ্রামোফোনটা যদি নিতে পারতাম!’ 

সেরিওজা ভাবল, ‘সত্যি বেচারা গ্রামোফোনটা পেলে কত খুশি হত! ওরা মা-ছেলে গান বাজিয়ে শুনতে পেত!’ 

পাশা খালা সান্ত্বনার সুরে বলল, ‘তুমি কাজকর্ম করতে আরম্ভ করলে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ। আবার সব হবে।’ 

‘সবই তো বুঝি! কিন্তু যা ঘটে গেছে তারপর কাজকর্ম পাওয়াও বড় মুশকিল কিনা। খালা ওর দুঃখে দুঃখিত হয়ে বুঝি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। 

লোকটা আবার বলল, ‘আমি অনেক কিছুই হতে পারতাম, দোকানদারও হতে পারতাম, কিন্তু কিছু না করে আলসেমি করে জীবনের দামী সময়টা নষ্ট করলাম। এখন অনুতাপ হচ্ছে।’ 

‘সে তো তোমারই দোষ। কেন অমন করতে গেলে?’ 

‘সে কথা ভেবে আজ আর লাভ কী বলুন? যা হবার হয়ে গেছে। আচ্ছা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি এবার বাইরে গিয়ে কাঠ চেরা শেষ করিগে।’ 

লোকটা এবার উঠানে ফিরে গেল। কিন্তু টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পাশা খালা সেরিওজাকে বাইরে যেতে দিল না। 

সেরিওজা হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘লোকটা ওরকম কেন?’ 

‘ও জেলে ছিল কিনা! সব তো শুনলেই।’ 

‘কেন জেলে গিয়েছিল?’ 

‘কোনো খারাপ কাজ করেছিল বোধহয়। ভালো কাজ করলে জেলে নিয়ে যেত না।’

লুকিয়ানিচ দুপুরের ঘুমটুকু সেরে উঠে এবার আবার অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। সেরিওজা তার কাছে এসে প্রশ্ন করল : 

‘আচ্ছা, লোকে মন্দ কাজ করলে তাকে জেলে নিয়ে যায় বুঝি?’ 

‘হাঁ, ঐ লোকটা অন্যের জিনিস চুরি করেছিল কিনা। ধর, আমি পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করলাম, তা দিয়ে একটা জিনিস কিনলাম। আর একটা লোক এসে সেটা না বলে নিয়ে গেল। এটা কি ভালো কাজ হল?’ 

‘না।’ 

‘নিশ্চয়ই না, এটা খুব অন্যায়।’

‘তাহলে, লোকটা ভালো নয়? 

‘নিশ্চয়ই নয়।’ 

‘তা হলে খালাকে কেন বললে তোমার পুরনো জুতোজোড়াটা ওকে দিয়ে দিতে?’

‘ওর জন্য দুঃখ হল কিনা, তাই।’ 

‘যারা মন্দ কাজ করে, তাদের জন্য তা হলে তোমার কষ্ট হয়?’ 

‘হাঁ… তা কথাটা কী জান…ও যে মন্দ লোক তার জন্য আমার কষ্ট নয়। ওর ছেঁড়া জুতোটা দেখে, ওকে এরপর খালি পায়ে হাঁটতে হবে ভেবেই ওর জন্য কষ্ট হল। তা ছাড়া, কোনো লোককে তুমি মন্দ ভেবে সবসময় কেবল ঘৃণাই করতে পার না… তবে হাঁ, একথা সত্যি লোকটা চোর না হলে ওকে খুশি হয়ে খুব ভালো জুতোই দিতাম… আচ্ছা, এবার আমাকে যেতে হবে।’ লুকিয়ানিচ তাড়াতাড়ি চলে গেল। 

সেরিওজা ভাবতে থাকে লুকিয়ানিচ এমন সব অদ্ভুত কথা বলে যার কিছুই বোঝা যায় না যেন। 

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও এবার বাইরের ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আনমনে ভেবে চলল লুকিয়ানিচের কথাগুলোর কী মানে হতে পারে। হঠাৎ দেখল লোকটা ছেঁড়া টুপিটা মাথায় দিয়ে একজোড়া জুতো হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মা লিওনিয়াকে কোলে নিয়ে ফিরল। 

সেরিওজা তক্ষুনি মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা মা, তোমার মনে আছে স্কুলের একটা বাচ্চা ছেলে একবার একটা খাতা চুরি করেছিল? ওকে কি জেলে ধরে নিয়ে গিয়েছিল নাকি?’ 

‘কেন, জেলে নেবে কেন?’ মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। 

‘কিন্তু কেন জেলে নেবে না?’ 

‘ও তো বাচ্চা ছেলে। মাত্র আট বছর তো বয়স।’ 

‘তা হলে ছোট্ট ছেলেদের বুঝি ওসব করতে দেওয়া হয়?’

‘কী সব?’

‘চুরি।’ 

‘না, বাচ্চারাও চুরি করবে না। আমি ওকে খুব ধমকে দিয়েছিলাম, তাই আর কোনোদিন ও চুরি করবে না। কিন্তু এসব কথা ভাবছ কেন বল তো?’ 

সেরিওজা এবার মা’কে জেল ফেরত ঐ লোকটার সব গল্প বলল। সব শুনে মা বলল, ‘হাঁ, কতকগুলো লোক ওরকম মন্দ থাকে। তুমি আরো বড় হলে এসব বিষয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করব, কেমন? এখন খালার কাছ থেকে রিফু করার ছুঁচটা নিয়ে এস তো।’ 

সেরিওজা ছুঁচটা নিয়ে এসে আবার বলল, ‘লোকটা কেন চুরি করল? 

‘কাজ করতে ওর হয়তো ভালো লাগত না।’ 

‘কিন্তু ও কি জানত না চুরি করলে জেলে যেতে হয়।’ 

‘নিশ্চয়ই জানত।’ 

‘তা হলে? ওর ভয় করল না? জেলখানা তো খুব ভয়ঙ্কর জায়গা, না মা?’ 

মা এবার বিরক্তিভরা সুরে বলে উঠল, ‘অনেক হয়েছে, আর নয় এসব কথা। আমি তো তোমাকে বললামই এখনও এসব ব্যাপার বুঝবার মতো বড় হও নি তুমি। অন্য কিছু ভাব, এ বিষয়ে আর একটি কথাও আমি শুনতে চাই না, বুঝলে?’ 

সেরিওজা মায়ের বিরক্তিভরা মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে একটা গ্লাসে খানিকটা জল ঢেলে নিল। মাথা হেলিয়ে মুখটা যথাসম্ভব হাঁ করে জলটা এক ঢোকে গিয়ে ফেলবার চেষ্টা করল, কিন্তু জলটা পড়ে ওর জামা ভিজে গেল। পেছনের কলারটাও ভিজে সপসপে হয়ে গেল, পিঠে জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ভিজে শার্টের কথা সে কাউকে কিছু বলল না। বললেই ওরা সবাই তাকে বকবে আর এ নিয়ে অকারণ হৈ হৈ শুরু করবে। রাত্রিবেলা ঘুমুতে যাবার আগে ভিজে শার্টটা তার গায়েই শুকিয়ে গেল। 

…সে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে বড়রা খাবারঘরে বেশ জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করল। 

করোস্তেলিওভকে বলতে শুনল, ‘সব ব্যাপারেই একটা হাঁ কি না স্পষ্ট জবাব শুনতে চায় ও। এই দুয়ের মাঝে কিছু-একটা বললেই ও বেচারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।’

লুকিয়ানিচ বলছে, ‘আমি তো পালিয়ে বাঁচলাম তখন। ওর হাজার প্রশ্নের জবাব কে দেবে?’ 

মা বলছে, ‘বাচ্চাদের সব প্রশ্নর উত্তর দিতে নেই। ও যা বুঝবে-না তা নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করা কেন? তাতে কী লাভটা হবে শুনি; এবং উল্টো ফল হয় তাতে। ওর মনের ওপর অকারণ চাপ পড়ে আর আজেবাজে যত ভাবনা ভাবতে শুরু করে। একটা লোক খারাপ কাজ করলে শাস্তি পায়, ব্যস, শুধু এটুকু জানাই ওর পক্ষে যথেষ্ট। তোমাদের কাছে অনুরোধ করছি ওর সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কখনো এত আলোচনা করো না তোমরা।’ 

লুকিয়ানিচ এবার প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘কে ওর সঙ্গে ওসব নিয়ে আলাপ করতে গেছে? ওই তো প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে।’ 

পাশের অন্ধকার ঘর থেকে সেরিওজা এবার চাপা গলায় ডাকল, ‘করোস্তেলিওভ!’

সবাই তক্ষুনি নীরব হয়ে গেল… 

করোস্তেলিওভ উত্তর দিল, ‘এই যে আমি, যাচ্ছি। এবং ঘরে ঢুকে গেল।

সেরিওজা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, দোকানদার কাকে বলে? 

করোস্তেলিওভ স্নেহ-মাখান স্বরে বলল, ‘এখনও ঘুমোও নি দুষ্টু ছেলে? এই যে আমি তোমার পাশে বসেছি, নাও এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড় লক্ষ্মী ছেলের মতো, কেমন?’ সেরিওজা তেমনই বড় বড় চোখ দুটি মেলে অস্পষ্ট আলোতে তাকিয়ে রইল তার প্রশ্নের উত্তর শোনার আশায়। করোস্তেলিওভ তার মুখের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে খুব চুপিসারে (যাতে ও-ঘর থেকে মা কিছু শুনতে না পায়) তার প্রশ্নের জবাবটা তার কানে কানে বলে দিল…। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *