যাত্রা হল শুরু

যাত্রা হল শুরু 

ভোর হতেই দিনটা কেমন মেঘাচ্ছন্ন মনে হল, রোদ নেই, কুয়াশাও নেই। মাটির বুকের বরফ সব গলে গেছে, শুধু একটু পাতলা আস্তরণ ঝিকিমিকি করছে। আকাশটা ধূসরবর্ণ। পায়ের নিচে মাটি একটু ভিজে ভিজে। এমন দিনে স্লেজগাড়ি চালান অসম্ভব, উঠানে যেতেই মন চায় না। 

করোস্তেলিওভ ওর কথামতো স্লেজগাড়িতে নতুন দড়ি বেঁধে দিয়েছে। সেরিওজা ঘুম থেকে জেগেই বারান্দার এক কোণে স্লেজগাড়িটা দেখতে পেল। 

কিন্তু করোস্তেলিওভ গেল কোথায়? 

মা লিওনিয়াকে খাওয়াচ্ছে। খাওয়ানো যেন আর শেষ হতে চায় না… কিছুক্ষণ পর মা তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘দেখ, ওর নাকটা কী অদ্ভুত খাটো।’ 

সেরিওজা ভালো করে তাকিয়ে দেখল। অত্যন্ত সাধারণ একটা নাক, অদ্ভুত বা সুন্দর কিছু তো নয়! মা অমন করে বলছে তার একমাত্র কারণ মা লিওনিয়াকে সত্যি ভালোবাসে। মা আগে আমাকেও কত ভালোবাসত। এখন আমাকে আর ভালোবাসে না, ওকেই ভালোবাসে। 

সেরিওজা এবার আনমনে পাশা খালার কাছে রান্নাঘরে এল। খালার হাজারটা কুসংস্কার আছে, খুঁতখুঁতানি আছে। কিন্তু তবুও খালা তাকে ভালোবাসে, তার কথা মন দিয়ে শোনে। 

পাশা খালার কাছে এসে সে প্রশ্ন করল, ‘কী করছ?’ 

‘দেখতে পাচ্ছ না? মাংসের কাটলেট রাঁধছি।’ 

‘এতগুলো কেন?’ 

মাংসের কাটলেট সারা টেবিলটায় ছড়িয়ে আছে। 

‘এ বেলা আমরা সবাই খাব, ওরাও রাস্তার খাবার সঙ্গে করে নেবে। 

‘এখনই চলে যাবে ওরা?’ 

‘ঠিক এক্ষুনি নয়, সন্ধেবেলায় যাবে।’ 

‘আর কত ঘণ্টা বাকি আছে?’ 

‘অনেক দেরি এখনও। সন্ধের পর রওনা হবে। দিনের বেলা যাবে না।’ 

খালা আর কোনো কথা না বলে কাটলেট ভাজতে লাগল। সেরিওজা টেবিলটার কোণে মাথা হেলিয়ে ভাবতে লাগল কত কী : .’লুকিয়ানিচ আমাকে ভালোবাসে…এখন থেকে আরো অনেক বেশি বেশি করে ভালোবাসবে… ওর সঙ্গে নৌকো করে বেড়াতে যাব আমি। তারপর ডুবে যাব নদীতে। তারপর ওরা আমাকে বড়নানির মতো মাটিতে শুইয়ে কবর দিয়ে দেবে। করোস্তলিওভ আর মা যখন শুনবে সে কথা ওরা দুঃখ পাবে আর বলবে কেন আমরা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম না। ছেলেটা ওর বয়সের তুলনায় কত বেশি চালাক ছিল। কত ভালো ছিল। লিওনিয়ার চাইতেও হাজার গুণে ভালো ছিল। কখনো কাঁদত না, বিরক্ত করত না আমাদের। না, না, বড়নানির মতো আমাকে কবর দিতে দেব না। আমি তাহলে যে ভয় পাব, একা একা কেমন করে ওখানে শুয়ে থাকব… এখানেই বেশ থাকতে পারব আমি। লুকিয়ানিচ আমাকে কত আপেল, চকোলেট এনে দেবে, এমনি করে একদিন আমি কত বড় হব। ক্যাপ্টেন হব। তখন মা আর করোস্তেলিওভ একেবারে গরিব হয়ে যাবে। করোস্তেলিওভ একদিন আমার কাছে এসে বলবে : তোমার কাঠ কাটতে দাও আমাকে। আমি তখন খালাকে বলব : ওকে কালকের বাসি খাবারগুলো খেতে দাও তো।’ 

এসব উদ্ভট ভাবনা ভাবতে ভাবতে আচমকা সেরিওজার মা আর করোস্তেলিওভের জন্য এমন কষ্ট হল যে সে তক্ষুনি কেঁদে ফেলল। পাশা খালা তার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল একবার, ‘হায় ভগবান!’ সেরিওজার সেই মুহূর্তে মনে পড়ল সে করোস্তেলিওভকে কথা দিয়েছে আর কাঁদবে না। সে তাড়িতাড়ি বলে উঠল, ‘আর কাঁদব না আমি!’ 

এমন সময় নাস্তিয়া নানি সেই কালো ব্যাগ হাতে রান্নাঘরে ঢুকে প্রশ্ন করল, ‘মিতিয়া বাড়ি নেই?’ 

খালা বলল, ‘গাড়ির ব্যবস্থা করতে বাইরে গেছে। আভের্কিয়েভ কী ছোটলোক- করোস্তেলিওভকে গাড়ি দেবে না।’ 

নানি বলল, ‘ছোটলোক কেন? লরি দিয়েছে তো! গাড়ি তো ওর খামারের জন্য প্রয়োজন। আর মালপত্র নিয়ে তো লরিতে যাওয়াই সুবিধে।’ 

পাশা খালা বলল, ‘মালপত্রের জন্য ভালো, কিন্তু একটা গাড়ি পেলে মারিয়াশা আর বাচ্চাটার খুব সুবিধে হত।’ 

নানি বিরক্তিভরা সুরে বলল, ‘আজকালকার লোকগুলোই হয়েছে অদ্ভুত। আমাদের দিনে আমরা গাড়ি বা লরিতে বাচ্চাদের নিতামই না। আমরাও তো ছেলেপুলে মানুষ করেছি বাপু। ও বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসে বেশ যেতে পারে।’ 

সেরিওজা চোখ মুছতে মুছতে ওদের বকবকানি শুনছে। আসন্ন ও নিশ্চিত বিদায়ের ভাবনায় মনটা তার কেমন বিষণ্ন হয়ে আছে। গাড়ি বা লরি যাতেই হোক না কেন, ওরা আর কিছুক্ষণ বাদেই তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সে ওদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তবুও ওরা তাকে ফেলে রেখে চলে যাবে। 

নানি আবার বলছে, ‘মিতিয়া এতক্ষণ কী করছে? আমি তার সঙ্গে দেখা করতে এলাম!’ 

খালা বলল, ‘কেন, আপনি ওদের যাবার সময় আসবেন না?’ 

‘না। আমাকে আবার কনফারেন্সে যেতে হবে কিনা।’ নানি এবার মায়ের কাছে চলে গেল। তারপর আবার সব চুপচাপ। দিনটা আরো মেঘলা হল। ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। শার্সিগুলো বাতাসের ধাক্কায় ঝটপট নড়ছে। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার বরফ পড়া শুরু হল। সেরিওজা খালার কাছে প্রশ্ন করল, ‘আর ক’ঘণ্টা বাকি আছে?’ 

…খাবারঘরের একদিকে আসবাবপত্তরগুলো বাঁধাছাঁদা করে রাখা হয়েছে, মা আর নানি সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। নানি বলছে, ‘ওঃ, মিতিয়া এতক্ষণ কী করছে বলে তো? আমার সঙ্গে ওর আর দেখা হবে কিনা কে জানে!’ 

সেরিওজা নানির কথা শুনে ভাবল, নানিও বুঝি ভয় পাচ্ছে যদি ওরা আর ফিরে না আসে, একেবারে চলে যায়! 

সেরিগুজা লক্ষ করল দিনের আলো প্রায় নিবু নিবু হয়ে আসছে। আর একটু পরেই হয়তো আলো জ্বালাতে হবে। কত তাড়াতাড়ি সময় বয়ে যাচ্ছে আজ! 

পাশের ঘরে লিওনিয়া কেঁদে উঠল, মা পড়ি কি মরি করে সেরিওজাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় তার দিকে এক পলক তাকিয়ে স্নেহভরে বলে গেল, ‘খেলা করছ না কেন সেরিওজা?’ 

হাঁ, খেলা করতে পারলে তো ও নিজেও খুশি হত। সেই বাঁদরিটাকে নিয়ে খেলা করতে সে কত চেষ্টা করল। তারপর সেই খেলনা দালানটাও তৈরি করতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না যে! কিছুই তার ভালো লাগছে না আজ। 

রান্নাঘরের দরজা খোলার শব্দের সঙ্গে ভারী পায়ে শব্দ এবং করোস্তেলিওভের উঁচু স্বর শোনা গেল, ‘এক ঘণ্টার মধ্যে লরি আসবে। আমরা এবার খেয়ে নিই চল।’ 

নানি ডাকে দেখে প্রশ্ন করল এবার, ‘তা হলে গাড়ি পেলে না?’ 

‘না, ওদের কাজ আছে বলল। থাকগে, আমরা লরিতেই বেশ যেতে পারব।’ 

করোস্তেলিওভের গলা শুনে অন্যদিনের মতোই সেরিওজার মনটা আনন্দে খুশিতে ভরে উঠল, ইচ্ছে হল এক্ষুনি গিয়ে ছুটে ওর কোলে ওঠে। কিন্তু তখনই আবার মনটা বলে উঠল, না, আর একটু বাদেই তো ওরা চলে যাবে…তবে আর কেন… আনমনে সে আবার খেলনাগুলোই নাড়াচাড়া করতে লাগল। 

করোস্তেলিওভ এবার তার দিকে তাকিয়ে অপ্রতিভভাবে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘কী খবর সেরিওজা?’ 

…তারপর ওরা খেতে বসল। খুব তাড়াহুড়ো করেই খেয়ে উঠল। নানি চলে গেল। এখন বেশ আঁধার হয়ে আসছে চারদিক। করোস্তেলিওভ টেলিফোনে কাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে। সেরিওজা ওর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনে কথা বলতে বলতে করোস্তেলিওভ ওর লম্বা লম্বা আঙুলগুলো তার নরম চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিচ্ছে… 

এমনি সময় তিমোখিন ঘরে ঢুকে বলল, ‘এই যে, সব তৈরি তো? আমাকে একটা কোদাল দাও তো। বরফ না কাটলে তো ফটকটা খোলাই যাবে না।’ 

লুকিয়ানিচও তার সঙ্গে বরফ কাটতে গেল। মা লিওনিয়াকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি কাঁথায় জড়িয়ে নিতে লাগল। 

করোস্তেলিওভ বলল, ‘এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? এখনও অনেক সময় আছে।’ 

তারপর করোস্তেলিওভ, লুকিয়ানিচ আর তিমোখিন তিনজনে মিলে বাঁধাছাঁদা জিনিসপত্তর সব তুলতে আরম্ভ করল। ওদের প্রত্যেকের জুতোয় বরফ ঢুকে গেছে। কিন্তু কেউ আজ বরফ ঝেড়ে ফেলে ঘরে আসছে না। পাশা খালাও আজ এজন্য ওদের বকছে না। সমস্ত মেঝে জলে একাকার হয়ে গেল। ঘরের এদিকে-ওদিক যত রাজ্যের নোংরা টুকিটাকি ছড়িয়ে আছে। মা লিওনিয়াকে কোলে নিয়ে সেরিওজার কাছে এসে এক হাত দিয়ে তাকে একটু কাছে টেনে নিয়ে আর মাথাটা কোলের কাছে নিতে চেষ্টা করতেই সে দূরে সরে গেল। মা তাকে ফেলে রেখেই চলে যেতে পারছে, তবে কেন আর এভাবে জড়িয়ে ধরতে আসা? 

একে একে সব জিনিসপত্তর লরিতে ওঠানো হল। উঃ! ঘরগুলোকে কী শূন্য দেখাচ্ছে! এদিক-ওদিক মেঝের উপর দু-এক টুকরো কাগজ বা খালি ওষুধের শিশি পড়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে শুধু। সব জিনিপত্তর বোঝাই হয়ে ঘরগুলো কী সুন্দরই-না ছিল দেখতে! আর এখন মনে হচ্ছে সমস্ত বাড়িটাই কী পুরনো আর বিশ্রী! লুকিয়ানিচ পাশা খালার হাতে একটা কোট দিয়ে বলছে, ‘নাও, ওটা পরে নাও। নাও। বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা।’ 

সেরিওজা হঠাৎ যেন কী এক আতঙ্কে চমকে উঠে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বলল, ‘আমিও বাইরে যাব!’ 

পাশা খালা নরম সুরে বলল, ‘হাঁ, যাবে বৈকি, এস, তোমায় কোটটা পরিয়ে দিই।’ মা আর করোস্তেলিওভও ওদের কোট পরে নিচ্ছে। করোস্তেলিওভ সেরিওজাকে কোলে তুলে নিয়ে গভীর স্নেহে চুমু খেতে লাগল। একটু পর বলল, ‘কিছুদিনের জন্য বিদায় সোনা। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে নাও। আমাদের যা কথা হয়েছে মনে রেখ, কেমন? 

মা-ও এবার তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল, তারপর হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। কান্না-জড়ানো স্বরে মা আবার বলল, ‘আমাকে বিদায় জানালে না, সেরিওজা?’ 

।সেরিওজা খুব তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘বিদায়’, কিন্তু সে তখন করোস্তেলিওভের দিকেই তাকিয়ে আছে। করোস্তেলিওভ আবার বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলে। 

মা তখনো কাঁদছে। পাশা খালা আর লুকিয়ানিচকে মা বলছে, ‘তোমরা যা করেছ তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। 

খালা বলল, ‘ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। 

‘সেরিওজাকে দেখ। 

সে জন্য তুমি কিছু ভেব না। খালাও এবার কেঁদে ফেলল। কেঁদে কেঁদেই বলল, ‘এক মিনিট আমাদের সবাইকে এক সঙ্গে বসতে হবে যে! এস!…’ 

লুকিয়ানিচ চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘কোথায় বসবে?’ 

পাশা খালা বলল, ‘হা ভগবান! আচ্ছা এস, আমাদের ঘরেই এস না-হয়!’

তারা সবাই এবার খালার ঘরে গিয়ে নীরবে কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথা নিচু করে বসল। তারপর খালাই প্রথম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন। 

এবার ওরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে এল। বাইরে তখন বরফ পড়েছে আর চারদিকে কেমন শাদা শাদা দেখাচ্ছে। ফটকটা খুলে দেওয়া হয়েছে। বাইরেও একটা লণ্ঠন জ্বেলে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মালবোঝাই লরিটা বাইরে ভূতের মতন দাঁড়িয়ে আছে। তিযোখিন ক্যানভাসের পর্দা দিয়ে সব জিনিসপত্তরগুলো ভালো করে ঢেকে দিচ্ছে। শুরিকও ওর বাবাকে সাহায্য করছে। ভাস্কার মা, লিদা, পাড়াপড়শি আরো অনেকে বাইরে বাড়ির সামনে এসে জড়ো হয়েছে ওদের বিদায় দেবার জন্য। সেরিওজার মনে হচ্ছে ওদের জীবনে এই প্রথম সে দেখছে। সমস্ত কিছুই তার কাছে বড় অদ্ভুত, অজানা মনে হচ্ছে। ওদের কথাগুলোও যেন একেবারে অন্যরকম… উঠানটাকেও ওদের উঠান বলে মনে হচ্ছে না তো! এখানে যেন সে কোনোদিনই থাকে নি, ঐ ছেলেদের সঙ্গে খেলাও করে নি কোনোদিন। এই লরিটাতে চড়েও নি কোনোকালে। এসবের কিছুই যেন তার কোনোদিন ছিল না, আর হবেও না; কারণ সে আজ পরিত্যক্ত। 

তিমোখিন বলছে, ‘আজ গাড়ি চালানো মুশকিল। পথঘাট এত পিছল হয়ে গেছে!’ করোস্তেলিওভ এবার মা আর লিওনিয়াকে সামনের সিটে বসিয়ে একটা শাল দিয়ে ওদের ঢেকে দিল। করোস্তেলিওভ ওদের সবার চাইতে বেশি ভালোবাসে। তাই এত যত্ন নিচ্ছে। ওদের যাতে ঠাণ্ডা না লাগে, ওরা যাতে আরাম করে যেতে পারে সেজন্যই ও এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে…তারপর নিজে লরির পেছনে উঠে দাঁড়াল। নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে ওকে। 

পাশা খালা ওকে ডেকে বলল, ‘ক্যানভাসের ভিতরে যাও মিতিয়া, নইলে মুখে বরফ পড়বে যে!’ 

করোস্তেলিওভ কোনো কথা বলল না, নড়লও না। 

সেরিওজার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল এবার, ‘একটু পেছনে সরে যাও সোনা। না হলে চাপা পড়বে যে। 

লরিটা এবার গর্জন করতে শুরু করল। তিমোখিন উঠে বসেছে। লরিটা তাই হাঁকডাক করতে করতে নড়বার চেষ্টা করছে…একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ওরা একটু পেছনে সরল, তারপর আবার সামনে, আবার একটুখানি পেছনে সরল, তারপর আবার সামনে, আবার একটুখানি পেছনে সরল। এখন ওরা রওনা হবে, হুস করে চলে যাবে। তারপর ফটকটা বন্ধ করে দেওয়া হবে, আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে…আর সব শেষ হয়ে যাবে। 

সেরিওজা একপাশে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। বরফ পড়ছে সর্বাঙ্গে। প্রাণপণ শক্তিতে সে কেবল তার প্রতিজ্ঞার কথা মনে করছে আর কান্না চাপবার চেষ্টা করছে। কেউ দেখতে না পায় এমনিভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে শুধু। নীরব অসহায় সেই কান্নার এক ফোঁটা জল চোখ ফেটে বেরিয়ে এল আর আলোতে চিক চিক করতে লাগল। ছোট্ট ছেলের অবুঝ কান্না নয় কিন্তু, বয়স্ক ছেলের মান-অভিমান-অপমান মেশানো তিক্ত অশ্রু… 

না, আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। সে এবার পেছন ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়ল, ছোট্ট শরীরটাকে অনেক কষ্টে টেনে নিয়ে চলল বাড়ির মধ্যে। 

করোস্তেলিওভ হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এই গাড়ি থামাও, থামাও! সেরিওজা, এস, তাড়াতাড়ি চলে এস! তোমার জিনিসপত্তর নিয়ে চলে এস! তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে! 

এবার সে লরি থেকে লাফিয়ে নিচে নামল। 

তারপর আবার চেঁচিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলে এস! তোমার ওখানে কী আছে? শুধু কয়েকটা খেলনা নিয়ে এস! এক মিনিটও দেরি কর না, এস!’ 

দরজার ওদিকে থেকে পাশা খালা আর লরির ভেতর থেকে মা প্রায় এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘মিতিয়া, তুমি ভাবছ কী? কী করছ ভেবে দেখেছ? পাগল হলে নাকি?’ 

করোস্তেলিওভ এবার রেগে বলে উঠল, ‘আঃ! তোমরা চুপ কর তো। তোমরা কি কিছুই বোঝ না? কী করতে যাচ্ছিলাম আমরা বলতে পার? এ যে শরীরের একটা অংশ কেটে বাদ দেবার মতো ব্যাপার। তোমরা যাই বল-না কেন, আমি তা সত্য করতে পারব না, বুঝলে?’ 

পাশা খালা কেঁদে ফেলে বলে উঠল, ‘কিন্তু ও যে ওখানে গেলে মরে যাবে!’

করোস্তেলিওভ আবার বলল, ‘বাজে কথা বল না তো! আমি ওর দায়িত্ব নিচ্ছি, বুঝলে? ওখানে গেলে ও মরে যাবে না। ওসব তোমাদের প্রলাপ। এই সোনা!’ 

সেরিওজা প্রথম করোস্তেলিওভের কথা শুনে নড়তে পারছিল না। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে ভয় করছিল…তার বুক কাঁপতে লাগল, মাথায় সেই কাঁপা অনুভব করা যায়… তারপর সে একছুটে ঘরের মধ্যে ঢুকে বাঁদরিটাকে এক হাতে জাপটে ধরে আবার ভাবল, করোস্তেলিওভ যদি আবার ওর মত বদলায়! মা আর খালা হয়তো তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর মত ঘুরিয়ে দেবে। করোস্তেলিওভ তখন তারই দিকে ছুটে আসছে আর বলছে, ‘কী করছ? তাড়াতাড়ি এস, চলে এস!’ এবার ও সেরিওজার সঙ্গে ঘরে ঢুকে তার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিতে লাগল। পাশা খালা আর লুকিয়ানিচও এবার ওদের কাছে এসে সাহায্য করতে লাগল। 

লুকিয়ানিচ সেরিওজার বিছানা বেঁধে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি ঠিকই করলে, মিতিয়া! এ বেশ ভালোই হল।’ 

সেরিওজা খালার দেওয়া একটা বাক্সে যে কয়টি খেলনা হাতের কাছে পেল ঢুকিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। দেরি করা চলবে না তো…ওরা যদি আবার চলে যায়? তার ছোট্ট বুকটা ধুক ধুক করে কাঁপছে কেবল। সে উত্তেজনায় কিছু শুনতেও পাচ্ছে না, নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে যেন! 

পাশা খালা তাকে সাজিয়ে দিতে এলে সে কেবল বলল, ‘তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর!’ তারপর আকুল দৃষ্টিতে করোস্তেলিওভকে খুঁজতে লাগল। দরজার কাছে এসে দেখল লরিটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। করোস্তেলিওভ লরিতে ওঠে নি, দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। সেরিওজাকে বলল সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে। 

তারপর করোস্তেলিওভের পাশে এসে দাঁড়াতেই ও তাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর মা আর লিওনিয়ার পাশটিতে তাকে বসিয়ে মায়ের শালের নিচে ঢুকিয়ে দিল। এবার চলতে শুরু করল লরিটা। ও! এবার তাহলে আর দুর্ভাবনা নেই, এবার সে নিশ্চিন্ত। 

লরির সামনের সিটে তিমোখিন, মা, লিওনিয়া আর সে। একজন দু-জন নয়, একেবারে চার-চারজন! তিমোখিনের সিগারেটের ধোঁয়ায় সেরিওজার কাশি এল। মা আর তিমোখিনের মাঝখানটিতে সে আঁটসাঁট হয়ে বসেছে। তার টুপিটা একটা চোখের উপর হেলে পড়েছে। স্কার্ফটা খালা কী শক্ত করেই-না বেঁধে দিয়েছে! লরির আলোতে সে শুধু দেখতে পেল বরফ নাচছে কেবল। গাদাগাদি করে কষ্টেসৃষ্টে বসেছে ওরা। তাকে কী যায় আসে? তবুও তো ওরা সবাই এক সঙ্গে যাচ্ছে। আমাদের তিমোখিন আমাদের নিয়ে যাচ্ছে। আর লরির পেছনে করোস্তেলিওভ আছে। সে আমাদেরকে কত ভালোবাসে, আমাদের সব দায়িত্ব এখন ওর। বাইরে বরফের মধ্যে এত ঠাণ্ডায় সে বসেছে আর আমরা গাড়ির ভেতরে কত আরামে বসে আছি! তা হলেও ও আমাদের নিরাপদে হোলমোগোরি নিয়ে যাবে। আমরা হোলমোগোরি যাচ্ছি, কী চমৎকার! জানি না সেখানে কী আছে, কিন্তু আমরা সেখানে গেলে ভারি মজা হবে! তিমোখিনের লরিটা হঠাৎ ভোঁ ভোঁ করে গর্জে উঠল। লরির জানালায় দেখা যাচ্ছে বরফ যেন সেরিওজার হাসিভরা মুখের দিকে উড়ে আসছে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *