বড় মায়ের শবযাত্রা

বড় মায়ের শবযাত্রা 

বড় মা নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। দু-দিন ধরে সবাই বলাবলি করল তাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া উচিত, কিন্তু কেউই আর গিয়ে উঠতে পারল না। তারপর তৃতীয় দিন হঠাৎ নানি এসে উপস্থিত। তখন বাড়িতে শুধু সেরিওজা আর পাশা খালা আছে। নানি আগের চাইতেও যেন আজ অনেক বেশি গুরুগম্ভীর, হাতে সেই কালো ব্যাগ। গতানুগতিক কুশল প্রশ্নের পর নানি বসে পড়ে বলল, ‘মা মারা গেছেন। 

পাশা খালা তক্ষুনি হাত দিয়ে ক্রশ করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, ‘তার আত্মার শান্তি হোক। 

নানি এবার তার ব্যাগটা খুলে একটা বেরি বের করে সেরিওজার দিকে এগিয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘আমি মায়ের জন্য কয়েকটা জিনিস নিয়ে যেতে ওরা বলল মা আর নেই, ঘণ্টা দুয়েক হল মারা গেছেন। এই যে নাও সেরিওজা, বেরিগুলো ধোয়াই আছে, খেয়ে ফেল। বেশ মিষ্টি। মা খুব ভালোবাসতেন। চায়ের মধ্যে রেখে নরম করে তিনি খেতেন। ওগুলো তুমিই নাও, খেয়ে ফেল। নানি ব্যাগ থেকে অনেকগুলো বেরি বার করে টেবিলের উপর রাখল। 

পাশা খালা এবার বলল, ‘সব দিয়ে দিচ্ছেন কেন? আপনিও কয়েকটি খান।’

নাস্তিয়া নানি কাঁদতে শুরু করল। 

কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘না, আমি খাব না। মায়ের জন্য কিনেছিলাম।’ 

‘ওঁর বয়স কত হয়েছিল?’ খালা প্রশ্ন করল। 

‘বিরাশি বছর। অনেকে তো আরো কত বেশি দিন বাঁচে। মা আমার নব্বুই বছর বাঁচলেই-বা কী হত। 

খালা বলল, ‘নিন, এই দুধটা খেয়ে ফেলুন। খুব ঠাণ্ডা। শোক দুঃখ মানুষের জীবনে আছেই, তবুও আমাদের খেতে হবে, চলতেও হবে।’ 

নাক ঝেড়ে নানি বলল, ‘দাও একটু। দুধ খেতে খেতে সে বলে চলল : 

‘আমি যেন মাকে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মা কত বিদ্বান ছিলেন, কত বই পড়তেন, কত কী জানতেন, আশ্চর্য…এখন তো শূন্য পুরীতে থাকতে হবে আমাকে। ভাড়াটে বসাতে হবে। 

খালা দরদ-ভরা কণ্ঠে বলল, ‘আহা!’ 

বেরিগুলো দু-হাতের মুঠোয় ভরে নিয়ে সেরিওজা এবার উঠানে বেরিয়ে এল। মিঠে রোদে বসে ও কত কী ভাবতে লাগল। নানির বাড়ি শূন্য হয়ে গেছে বলল কেন? তাহলে বড় মা আর নেই, মারা গেছে বুঝি। ওরা দু-জনেই তো এক সঙ্গে থাকত। তাহলে বড় মা ঝুঝি এই নানির মা? এখন থেকে নানির ওখানে বেড়াতে গেলে আর কেউ ভুরু কুঁচকে মুখভঙ্গি করে ওকে বকবে না, খেপাবেও না। 

মৃত্যু কাকে বলে সেরিওজা জানে। মৃত্যু কয়েকবার ও দেখেছে। একবার ও ওদের হুলো বেড়ালটাকে একটা ইঁদুরছানা মারতে দেখেছে। মেরে ফেলবার আগে ইঁদুরছানাটাকে নিয়ে বেড়ালটা এদিক-ওদিক কেমন খেলা করেছে। তারপর আচমকা একটা লাফ দিয়ে ইঁদুরছানাটাকে গপ করে টুটি চেপে ধরে ওর লাফালাফি এক নিমেষে ঘুচিয়ে দিল। তারপর বেশ আমিরি চালে ওটাকে খেতে লাগল থ্যাবড়া লোভী মুখটাকে নেড়েচেড়ে… আর একবার ও একটা মরা বেড়ালছানা দেখেছে, এক মুঠো নোংরা তুলো যেন। মরা প্রজাপতি তো কতই দেখেছে। ওদের অপূর্ব সুন্দর ডানাগুলো জায়গায় জায়গায় কেমন খুলে গেছে আর ফুলের রেণুর মতো যে মিহি কণাগুলো ওদের ডানার উপর ছড়িয়ে থাকে সেগুলোও কোথায় উঠে গেছে। নদীর তীরে অনেক মরা মাছও পড়ে থাকতে দেখেছে। ওদের রান্নাঘরের টেবিলে তো মরা মুরগিছানা দেখতে পায়। হাঁসের মতো লম্বা গলার এক জায়গায় ছোট্ট কালো একটা ফুটো দিয়ে একটা পাত্রের মধ্যে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ে। মা কিংবা পাশা খালা মুরগিছানা মারতে জানে না কিন্তু। লুকিয়ানিচই এই কাজটা করে। লুকিয়ানিচ একটা ছানাকে ধরলে ও কিচির মিচির করে ডানা ঝটপট করতে থাকে। ওর এই করুণ কান্না শুনতে সেরিওজার ভালো লাগে না বলে ও দৌড়ে পালায় তখন। তারপর রান্নাঘরে ঢুকলে ও আড়চোখে মরা মুরগিছানাটার দিকে তাকায় আর ঐ ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখে ওর গা কেমন গুলিয়ে ওঠে। মনটা ভারি খারাপ হয়ে যায়। ওরা বলে এখন আর ওটার জন্য কষ্ট লাগবার নাকি কোনো কারণ নেই। খালা তার নিপুণ হাতে পালক ছাড়াতে ছাড়াতে বলবে, ‘এখন আর এটা কিছুই টের পাচ্ছে না।’ 

সেরিওজা একবার একটা মরা চড়ুই ছুঁয়ে ফেলেছিল। এত ঠাণ্ডা ছিল যে ও ভয় পেয়ে তক্ষুনি হাত সরিয়ে নিয়েছিল। বরফের টুকরোর মতো ঠাণ্ডা চড়ুই, সকালবেলাকার নরম রোদের আঁচে তেতে ওঠা লাইলাক ঝোপের কোলে বেচারি যেন ঘুমিয়ে আছে। 

একেবারে ঠাণ্ডা নিথর হয়ে যাওয়াকেই তাহলে মৃত্যু বলে। 

সেই মরা চড়ই দেখে লিদা সেদিন বলেছিল, ‘এস, ওকে শোভাযাত্রা করে কবর দিতে নিয়ে যাই। 

তারপর ও ছোট্ট একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স এনে তার মধ্যে ছেঁড়া ন্যাকড়া পেতে, হিজিবিজি জিনিস দিয়ে ছোট্ট একটা বালিশ তৈরি করে, চারধারে লেসের জালি দিয়ে পরিপাটি করে একটা বিছানা পেতে ফেলল। লিজা সত্যিই সব কাজে অদ্ভুত পটু এ কথা স্বীকার করতেই হবে। তারপর ও সেরিওজাকে একটা গর্ত খুঁড়তে বলল। বাক্সের মধ্যে মরা চড়ুইটাকে শুইয়ে দিয়ে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে সেই গর্তের ভেতরে বাক্সটা ঢুকিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। সেই মাটির মাঝখানটিতে একটা গাছের ডাল সোজা দাঁড় করিয়ে দিল। 

তারপর বলল, ‘দেখ, কেমন সুন্দরভাবে ওকে আমরা কবর দিয়ে দিলাম! এটা কি ও আশা করেছিল নাকি?’ 

ভাস্কা আর জেঙ্কা এই শবযাত্রায় কোনো অংশ নেয় নি সেদিন। ওরা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটু দূরে বসে দুঃখিতভাবে আনমনে শুধু ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। কিন্তু এ নিয়ে ওদের এতটুকু উপহাসও করে নি। 

মানুষরাও মাঝে মাঝে মরে যায় একথাও সে জানে। তখন কফিন বলে লম্বা একটা বাক্সের মধ্যে তাদের পুরে রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেরিওজা দূর থেকে অনেকবার তা দেখেছে। কিন্তু মরা মানুষ সে কখনো দেখে নি। 

…পাশা খালা একটা প্লেটে একরাশ শাদা ধবধবে ভাত বেড়ে তার চারপাশে লাল মিষ্টি সাজিয়ে ঠিক মাঝখানটিতে ভাতের উপর কয়েকটি মিষ্টি দাঁড় করিয়ে দিল, ঠিক যেন ফুল নয়, আবার তারাও নয়। 

সেরিওজা প্রশ্ন করল, ‘তারা করলে বুঝি?’ 

‘না, তারা নয়। এটা ক্রশ করেছি। আমরা বড় মায়ের শবযাত্রায় যাচ্ছি কিনা।’

তারপর খালা ওকে হাত-মুখ ভালো করে ধুইয়ে মুছিয়ে জামা জুতো মোজা পরিয়ে দিল। নাবিকের নীল স্যুটটা আর নীল টুপি ওকে পরান হল। খালাও ভালো করে সেজে কালো লেসের স্কার্ফটা গলায় জড়িয়ে নিল। তারপর সাদা রুমালে সেই ভাতের প্লেটটা বেঁধে এক হাতে সেটা আর অন্য হাতে ফুলের একটা তোড়া নিল। সেরিওজার হাতেও খালা দুটো বড় ডালিয়া দিল। 

সেরিওজা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে ভাস্কার মা বালতি হাতে জল আনতে যাচ্ছে। ও চিৎকার করে উঠল, ‘নমস্কার! আমরা বড় মায়ের শবযাত্রায় যাচ্ছি!’ 

লিদা তখন ওদের বাড়ির দরজায় ভিক্তরকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে সেরিওজা বুঝতে পারল লিদাও ওদের সঙ্গে আসতে চায়। কিন্তু ওর ফ্রকটা যা ছেঁড়া আর ময়লা। সেরিওজা আজ কেমন সেজেছে আর লিদা ঐ বিশ্রী পোশাকে খালি পায়ে যাবে কেমন করে? সত্যি, ওর জন্য সেরিওজার বড্ড কষ্ট হচ্ছে কিন্তু। তাই ওকে ডেকে বলল, ‘এস-না আমাদের সঙ্গে! কী আর হবে!’ 

কিন্তু লিদা অহংকারী মেয়ে। সেরিওজা পথের বাঁকটা না-ঘুরে যাওয়া পর্যন্ত একটা কথাও না বলে লিদা ওর দিকে তাকিয়ে রইল শুধু। 

ওরা এবার বাঁকটা ঘুরে অলিগলি দিয়ে চলল। কী গরম লাগছে! দু-দুটো বিরাট ডালিয়া ও আর যেন বইতে পারছে না। তাই খালাকে ও বলল : 

‘ফুল দুটো তুমি নাও।’ 

পাশা খালা ওর হাত থেকে ফুল নিল কিন্তু তারপরেও, হোঁচট খেতে খেতে চলল। পথের উপর কাঁকর পাথর কিছু নেই তবুও ও হোঁচট খাচ্ছে। 

খালা এবার প্রশ্ন করল, ‘কী, ব্যাপারটা কি বল তো?’ 

‘গরম লাগছে যে। এত কাপড়-চোপড় পরে থাকা যায় নাকি? শার্টটা খুলে নাও, আমি শুধু প্যান্ট পরেই যাব।’ 

‘বোকার মতো কথা বল না তো! শবযাত্রায় কেউ কখনো শুধু প্যান্ট পরে যায় নাকি? এই যে আমরা বাস-স্টপে এসে গেছি। এক্ষুনি বাসে উঠব।’ 

বাসে উঠবে জেনে সেরিওজা একটু উৎসাহ নিয়ে পথ চলতে আরম্ভ করল। পথের ও বেড়ার যেন শেষ নেই আর বেড়ার ওদিকে গাছগুলো। 

সামনে থেকে একরাশ ধুলো উড়িয়ে একদল গরু আসছে দেখে খালাকে বলল, ‘জল  খাব। তেষ্টা পেয়েছে।’ 

‘বোকামো কর না। তোমার তেষ্টা পেতেই পারে না।’ 

পাশা খালাটা যেন কী! কেন বিশ্বাস করছে না যে ওর সত্যিই খুব তেষ্টা পেয়েছে? কিন্তু খালার ঐ ধমকে এখন আর তেমন করে জল খেতে মন চাইছে না। 

গরুগুলো ওদের গুরুগম্ভীর মাথাগুলো হেলিয়ে-দুলিয়ে ভরা বাঁট নিয়ে ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। 

তারপর ময়দানের কাছে এসে ওরা বাসে চাপল। বাচ্চাদের বসবার নির্দিষ্ট জায়গায় ওরা বসল। সেরিওজা বাসে খুব কমই চড়েছে। তাই আজকের দিনটা তার জীবনে সব দিক দিয়ে একটা বিশেষ দিনই বলতে হবে। হাঁটু মুড়ে বসে সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে লাগল, আবার মাঝে মাঝে তার পাশের সঙ্গীটিকেও দেখতে লাগল। সঙ্গীটি তার চাইতে বয়সে অনেক ছোটই হবে, তবে দেখতে বেশ নাদুসনুদুস। মিষ্টি চুষছে ছেলেটা। ওর গাল দুটো চিনির রসে জবজবে হয়ে গেছে। 

সেরিওজার দিকে ও কেমন গর্বভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ওর সেই দৃষ্টি যেন সেরিওজাকে বলছে : দেখ, আমি কেমন খাচ্ছি। তোমার তো নেই। 

কনডাকটার ওদের কাছে এসে দাঁড়াতেই পাশা খালা তাকে প্রশ্ন করল, ‘এই বাচ্চাটার ভাড়া লাগবে নাকি?’ 

কনডাকটার তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খোকা, এদিকে এস তো, মেপে দেখি।’ বাসের গায়ে একদিকে কালো দাগ আছে বাচ্চাদের উচ্চতা মাপবার জন্য। যে বাচ্চার মাথা সেই দাগটাকে ছুঁতে পারবে তার জন্য টিকিট লাগবে। সেরিওজা সেই দাগ পর্যন্ত এসে ওর পায়ে আঙুলের ওপর একটুখানি উঁচু হয়ে দাঁড়াল। কনডাকটার রায় দিল, ‘হাঁ, এর টিকিট লাগবে।’ 

সেরিওজা এবার গর্বিতভাবে সেই মোটাসোটা ছেলেটার দিকে তাকাল। ভাবটা যেন এই : ‘তোমার জন্য তো টিকিট লাগে নি, কিন্তু আমার টিকিট লাগছে। কিন্তু এই নাদুসনুদুস ছেলেটারই শেষ পর্যন্ত জিত হল, কারণ সেরিওজা আর খালার যখন বাস থেকে নামবার সময় এল ছেলেটি তখনো বসেই রইল। 

ওরা বাস থেকে নেমেই একটা শ্বেতপাথরের বিরাট ফটকের সামনে এসে পড়ল। ফটকের ওদিকে অনেকগুলো লম্বা লম্বা শাদা বাড়ি। বাড়িগুলোর চারধারে ছোট ছোট গাছের সারি। গাছের গুঁড়িগুলো শাদা রঙে রঙানো। নীল ড্রেসিং-গাউন পরা কত লোক এদিক-ওদিক বেড়াচ্ছে, অনেকে আবার বেঞ্চের উপর বসে বসে গল্প করছে। 

সেরিওজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’ 

‘হাসপাতাল’, জবাব দিল পাশা খালা। 

সব শেষে যে বড় বাড়িটা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ওরা এবার সেদিকেই চলল। রাস্তার একটা বাঁক ঘুরতেই দেখল করোস্তেলিওভ, মা, লুকিয়ানিচ আর নানি দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় রুমাল বাঁধা তিনজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাও তাদের পাশে। 

সেরিওজা ওদের দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে বলে উঠল, ‘আমরা বাসে করে এলাম!’

কেউ তার কথার কোনো উত্তর দিল না। খালা মুখে আঙুল দিয়ে শ্-শ্-শ্ করে উঠল। সে এবার বুঝল এখানে কথা বলা বারণ। ওরা অবশ্য চুপি চুপি ফিসফিস করে কথা বলছিল। মা পাশা খালার দিকে চেয়ে বলল : ‘ওকে আবার আনলে কেন?’ 

করোস্তেলিওভ টুপি হাতে নিয়ে শান্ত অথচ চিন্তিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেরিওজা দরজার দিকে একটু এগিয়ে দেখল একটা অন্ধকার ঘরের দিকে কয়েকটি সিঁড়ি নেমে গেছে তা থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে…এবার ওরা সবাই ধীর পায়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঐ ঘরটায় ঢুকল। 

প্রখর দিনের আলো থেকে এসে প্রথমে তো সেরিওজা চোখে প্রায় অন্ধকারই দেখল। তারপর একটু একটু করে দেখতে পেল দেওয়ালের দিকটায় একটা চওড়া বেঞ্চ পাতা রয়েছে। ঘরের মেঝেটা কী এবড়োখেবড়ো। মাঝখানটিতে বেশ অনেকটা উঁচুতে একটা কাঠের কফিন রয়েছে। কফিনটার চারধারে মসলিনের ঝালর। ঘরটা কী স্যাঁতসেঁতে, কেমন একটা সোঁদা গন্ধ নাকে ঢুকছে। নানি তাড়াতাড়ি সেই কফিনটার কাছে এগিয়ে মাথা নত করে দাঁড়াল। 

পাশা খালাও তার কাছটিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, ‘হায় ভগবান! এ কী কাণ্ড? দেখ, দেখ, ওঁর হাত দু-খানি কেমন দু-পাশে নামানো রয়েছে।’ 

নানি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা ওসবে বিশ্বাস করতেন না। ‘ 

খালা বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? এভাবে মিলিটারি কায়দায় ঈশ্বরের দরবারে যাওয়া যায় নাকি?’ অন্য তিনজন ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে খালা প্রশ্ন করল, ‘আপনারা কোথায় ছিলেন?’ 

তিনজনে শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। সেরিওজা এত নিচু থেকে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এবার সে বেঞ্চের উপর উঠে ঘাড় উঁচু করে কফিনটার ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করল। 

সে ভেবেছিল ওটার মধ্যে বড় মাকে দেখতে পাবে। কিন্তু ঠিক বড় নানি তো নয়, অন্য একটা অদ্ভুত কিছু যেন ওখানে শুয়ে আছে। বড় মায়ের মতো কিছুটা দেখতে হলেও ভাঙাচোরা মুখ আর হাড়গোড় বের করা থুতনি এ-তো বড় মা হতেই পারে না। এভাবে মানুষ কি কখনো চোখ বন্ধ করে থাকে নাকি? লোকে ঘুমোলেও কিন্তু ঠিক এমন অদ্ভুতভাবে চোখ বন্ধ করে না… 

আর ওটা কী লম্বা! কিন্তু বড় মা তো দেখতে ছোটখাটো মানুষটি ছিল। চারদিকে কেমন একটা ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে গুমোট ভাব। সবাই যেন গভীর দুঃখে মুষড়ে পড়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কী জানি সব ফিসফিস করে বলছে। সেরিওজার হঠাৎ কেমন ভয় করতে লাগল। এখন যদি ওটা জীবন্ত হয়ে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে ‘হাঁরে-রে’ বলে চেঁচায় তাহলে কী সাংঘাতিক ব্যাপারই-না হবে। একথাটা ভাবতেই সেরিওজা প্ৰাণপণ শক্তিতে চেঁচিয়ে উঠল। 

সেরিওজা চেঁচাল আর তক্ষুনি যেন উপর থেকে, সূর্যের আলো থেকে একটা তীক্ষ্ণ প্রাণবস্তু পরিচিত স্বর তার চিৎকারের প্রত্যুত্তর দিল। মনে হল একটা গাড়ির ভেঁপু… মা ওকে হেঁচকা টানে ওখান থেকে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ফটকের কাছে একটা লরি দাঁড়িয়ে ছিল। কত লোক এদিক-ওদিক বেড়াচ্ছে, সিগারেট খাচ্ছে। তোসিয়া খালা লরিটার কেবিনে বসে আছে। এই খালাই সেদিন করোস্তেলিওভের জিনিসপত্তর ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। তোসিয়া খালা ‘ইয়াসি বেরেগ’ ফার্মে কাজ করে আর মাঝে মাঝেই করোস্তেলিওভকে লরি করে নিয়ে যায়। মা সেরিওজাকে খালার পাশে ধপ করে বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘ওখানে বসে থাক। এবং দরজাটা বন্ধ করে দিল। 

মা চলে গেলে তোসিয়া খালা ওকে প্রশ্ন করল, ‘বড় মাকে কবর দেওয়া দেখতে এসেছ? ওকে তুমি খুব ভালোবাসতে বুঝি? 

‘না, একটুও ভালোবাসতাম না।’ 

‘তা হলে এসেছ কেন? ওঁকে যদি ভালো না-ই বাস তাহলে কবর দেখতে আসতে নেই।’ 

বাইরের আলো আর এই কথাবার্তায় তার সেই অদ্ভুত ভয়টা, গা ছমছম ভাবটা একটু কমল। কিন্তু ঐ স্যাঁতসেঁতে ঘরটার অদ্ভুত দৃশ্য সে সহসা ভুলতে পারল না। তার শরীরটা থেকে থেকে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল, চারদিকে কয়েকবার তাকিয়ে কী জানি মনে মনে চিন্তা করে নিয়ে অবশেষে বলল, ‘আচ্ছা ঈশ্বরের দরবারে যাওয়ার মানে কী?’ 

তোসিয়া খালা হেসে বলল, ‘ও একটা কথার কথা।’ 

‘কিন্তু ওরা এরকম করে বলে কেন?’ 

‘বুড়োরা ওরকম কথাবার্তাই বলে থাকে। ওদের কথায় কান দিও না যেন। ওসব একদম বাজে কথা।’ 

তারপর ওরা দু-জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তোসিয়া খালা তার সব্‌জে চোখ দুটোকে কেমন একটু ছোট করে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে বলল, ‘হাঁ, আমরা সবাই ওখানে একদিন না একদিন যাব।’ 

‘ওখানে…কোনখানে? কী বলছে ওরা?’ কিন্তু আরো স্পষ্ট করে সে কিছু জানতে চায় না, তাই আর প্রশ্ন করল না। তারপর যখন কফিনটাকে ঐ অন্ধকূপ থেকে বার করে বাইরে বয়ে আনতে দেখল তখন সে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তবে এখন কফিনের উপর ওর ডালাটা ফেলে দেওয়া হয়েছে এই যা বাঁচোয়া। কিন্তু ওদের এই লরিটাতেই ওটাকে এনে তোলা হল বলে সে বড় অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। 

কবরখানায় পৌঁছে সবাই মিলে কফিনটাকে ধরাধরি করে ভেতরে বয়ে নিয়ে চলল। সেরিওজা আর তোসিয়া খালা লরি থেকে নামল না। বাইরে গাড়ি দাঁড়াবার জায়গায় লরিটা দাঁড়িয়ে রইল। সেরিওজা তাকিয়ে দেখল কবরখানার চারদিকে কেবল ক্রশ আর কাঠের পিলার এক-একটা লাল তার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেরিওজা আরো দেখল ফটকের খুব কাছে একটা ঢিবির ফাঁটল দিয়ে লাল পিঁপড়ে সারি বেঁধে আসছে যাচ্ছে। অন্য অনেকগুলো ঢিবিতে আবার ছোট ছোট আগাছা জন্মেছে… সেরিগুজা এবার ভাবল : ‘আচ্ছা, এই কবরখানাতেই সবাইকে একদিন আসতে হবে তোসিয়া খালা তাই বলেছে নাকি?…’ কিছুক্ষণ পর ওরা সবাই ফিরে এল। লরি আবার ওদের নিয়ে বাড়ির দিকে চলল। 

সেরিওজা প্রশ্ন করল, ‘বড় মাকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে নাকি?’

তোসিয়া খালা উত্তর দিল, ‘হাঁ, বাছা।’ 

বাড়ি ফিরে সেরিওজা লক্ষ করল পাশা খালা ওদের সঙ্গে ফেরে নি! 

লুকিয়ানিচ বলছে, ‘পাশা শবযাত্রীদের ভাত খাওয়াবে। সারাদিন ধরে সব রান্না করে নিয়ে গিয়েছে…’ 

নাস্তিয়া নানি মাথার রুমালটা খুলে ফেলে হাত দিয়ে চুল পরিপাটি করল। তারপর বলল, ‘ওদের সঙ্গে এ নিয়ে তর্ক করে কী লাভ? ও আর ঐ তিনজন ভদ্রমহিলা এবার প্রার্থনা করবে। আর তাতেই যদি শান্তি পায় ওরা পাক না। 

ওরা সবাই আবার স্বাভাবিক স্বরে কথা বলতে শুরু করেছে। এমনকি একটু-আধটু হাসছেও। 

মা আবার বলল, ‘সত্যি, পাশার অনেক কুসংস্কার।’ 

কিছুক্ষণ পর ওরা টেবিলের চারপাশে খেতে বসল। কিন্তু সেরিওজা খেতে পারছে না। তার কেমন বমি বমি করছে। সে নীরবে বসে আছে আর ডাগর দুটি চোখ মেলে বড়দের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। এতক্ষণ যা ঘটনা ওসব কিছু মনে করতে চায় না, ভাবতে চায় না। কিন্তু কী আশ্চর্য, ঘরে ফিরে সব কথা তার ভাবনায় এসে পড়ছেই–সেই গা ছমছমানি ভাবটা। স্যাঁতসেঁতে ঘরের কেমন আবছা অন্ধকার, গুমোট ভাব আর মাটির সোঁদা গন্ধ, সব মনে হচ্ছে। 

হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আমরা সবাই একদিন ওখানে যাব, ওকথা বলল কেন?’

বড়রা কথাবার্তা থামিয়ে ওর দিকে তাকাল এবার। 

করোস্তেলিওভ বলল, ‘কে বলল, এ কথা? 

‘তোসিয়া খালা।’ 

‘তার কথা শুনো না তুমি। সব শুনতে হয় নাকি?’ 

‘কিন্তু একদিন আমরা সবাই তো মরব?’ 

ওরা কেমন অদ্ভুতভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে! এই প্রশ্নটা করা যেন তার খুবই অন্যায় হয়ে গেছে। সে সবার দিকে আগ্রহভরে তাকিয়ে রইল ওরা কী বলে শোনবার জন্য। 

একটু পরে করোস্তেলিওভ বলল : 

‘না, আমরা কেউ মরব না। তোমার তোসিয়া খালার ইচ্ছে হলে মরুকগে। কিন্তু আমরা মরব না। বিশেষ করে তুমি কোনোদিন মরবে না সে কথা আমি হলফ করে বলছি সোনা।’ 

‘আমি কোনোদিন মরব না?’ 

‘না, কোনোদিন না!’ করোস্তেলিওভ দৃঢ়স্বরে সগাম্ভীর্যে তার চোখে চোখ রেখে বলল। সেরিওজা এবার কেমন হালকা বোধ করল, সুখী মনে করল। খুশিতে লাল টুকটুকে হয়ে উঠে সে হাসতে শুরু করল। কিন্তু আবার তার ভয়ানক তেষ্টা পেল যে! অনেকক্ষণ আগেই তো তার তেষ্টা পেয়েছিল, শুধু পাশা খালার ধমকে সে-কথা এতক্ষণ বেমালুম ভুলে বসে ছিল। এখন গ্লাসের পর গ্লাস ঢকঢক করে জল খেল সে প্রাণভরে বেশ মজা করে। করোস্তেলিওভ যা বলে তার মধ্যে এতটুকুও মিথ্যে নেই, তার প্রতিটি কথা সে সমস্ত মন দিয়ে বিশ্বাস করে। একদিন সে মরে যাবে এ কথা মনে হলে কী করে সে বাঁচবে? আর করোস্তেলিওভ যখন বলেছে সে কোনোদিন মরবে না তখন আর ভাবনা কীসের! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *