সেনাবিভাগ

সেনাবিভাগ

ইসলাম-পূর্ব যুগে রোমক সাম্রাজ্যে ও পারস্য সাম্রাজ্যে সেনাবিভাগ সুগঠিত ও সুব্যবস্থিত ছিল। সেনানায়কত্ব সাধারণত কুলপ্রথা ও উচ্চ বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো এবং জায়গীর প্রথার মতই প্রদত্ত হতো। রণ-প্রভুরা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিকানা স্বত্ব ভোগ করতেন এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য পালন করতেন। যুদ্ধকালে স্ব-স্ব বাহিনীসহ রণক্ষেত্রে সম্রাটের পক্ষে লড়তেন, আবার সুযোগ উপস্থিত হলে বিরুদ্ধেও লড়তেন। এ রকম জায়গীয় প্রথানিষ্ঠ সেনাবাহিনী ব্যারন ও ডিউকদের অধীনে ইউরোপখণ্ডেও বিরাজ করতো। ফরাসী দেশের সেনাবাহিনীর কোন বেতন ছিল না। যুদ্ধকালে লুণ্ঠনই ছিল তাদের একমাত্র আকর্ষণ।

আরবের ইয়ামেন ও অন্যান্য রাজার কোনও সুগঠিত সেনাবাহিনী ছিল না। ইসলামের প্রথম যুগে সেনা সংগঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয় নি, প্রত্যেক মুসলিমই ছিল মুজাহিদ, আল্লাহর রাহে সত্যের সৈনিক। আরব উম্‌মাহ অর্থাৎ সমগ্র জাতি ছিল সক্রিয় সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। আবুবকরের খেলাফতকালে মালে গনিমাত প্রত্যেককে বন্টন করে দেওয়া হতো। প্রথম বছরে প্রত্যেক মুজাহিদ পায় দশ দিরহাম ও দ্বিতীয় বছরে পায় বিশ দিরহাম। তখনও কোন সৈন্য তালিকা রক্ষিত হতো না, কোনও সমর দফতর সৃষ্টি হয় নি। ওমরের খেলাফতের প্রথম দু বছর একই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কিন্তু ১৫ হিজরীতে সমর বিভাগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়।

আবু হোরায়রাহ্ বাহরায়েনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়ার পর ১৫ হিজরীতে পাঁচ লক্ষ দিরহাম ভূমি কর হিসেবে সংগ্রহ করে মদীনায় আনয়ন করেন। পূর্বে কোনও আরববাসী এরূপ অগাধ অর্থের সংখ্যা শোনেনি। ওমর মজলিস-ই-শুরার’র পরামর্শ চাহিলেন, এই অগাধ অর্থ নিয়ে কী করা যায়। আলী, ওসমান ও অন্যান্য সাহাবা বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেন। ওলিদ বিন হিশাম সিরিয়ার শাসকদের সমর দফতর ও সেনাতালিকার বিষয় ও অর্থ সঞ্চয়ের জন্যে কোষাগারের বিষয় উল্লেখ করেন। তিনি ইরাকের দিওয়ান অর্থাৎ দফতরের কথাও উল্লেখ করেন। তখন এই বিপুল অর্থ নিয়ে খাজাঞ্চিখানা স্থাপিত হয় এবং সৈন্যদের মধ্যে বন্টনের সুবিধার্থে একটি সৈন্য রেজিস্টারী প্রণয়ন ও একটি দিওয়ান বা সমর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সাহিব-ই-দিওয়ান নামে সমর-দফতরের প্রধান কর্মচারীর পদ সৃষ্টি হয়। সৈন্য-রেজিষ্টারী আরম্ভ হয় প্রথমে কোরায়েশ ও আনসারদের নিয়ে। পরে প্রত্যেক কবীলা বা গোত্রের জন্যে রেজিস্টারী প্রস্তুত হয়।

রেজিস্টারীভুক্ত প্রত্যেক পুরুষ যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য ছিল। তারা দুভাবে বিভক্ত ছিল, যাঁরা সর্বক্ষণ যুদ্ধার্থে প্রস্তুত থাকতো এবং দ্বিতীয় ছিল ‘মাতুআই’ বা রিজার্ভ বাহিনী। রিজার্ভ-বাহিনী বাড়ীতে বাস করতো ও নিজ নিজ পেশায় নিযুক্ত থাকতো, কিন্তু ডাক পড়লেই যুদ্ধে গমন করতে হতো। ২১ হিজরীর মধ্যে সেনাবিভাগ ওমর কর্তৃক সর্বাংশে সুগঠিত ও সুসংবদ্ধ হয়ে ওঠে।

সেনাবিভাগের সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্যে ওমর কয়েকটি সামাজিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেন ‘জুন্দ্’ নাম দিয়ে। নামটি আজও সেনাবিভাগে তাঁর স্মৃতি বহন করছে। প্রথমে মদীনা, কুফা, বসরা, মসুল, ফুস্তাত, দামেস্ক উবদান ও প্যালেস্টাইনে আটটি জুন্দ্ স্থাপিত হয়। ওমরের সময় মুসলিম অধিকার বিস্তৃত ছিল বেলুচিস্তান পর্যন্ত; কিন্তু জাজিরাহ্, সিরিয়া, ইরাক ও মিসরকেই সাধারণত ‘স্বদেশ’ বলা হতো, আর তার দরুন এ দেশগুলির নিরাপত্তা নিরঙ্কুশ করতে ওমর আটটি জুন্দ স্থাপন করেছিলেন। প্রত্যেক জুন্দে এ-সব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। সেনাদের বাসের জন্যে সেনাবারিক নির্মিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, কুফা, বসরা ও ফুস্তাতে (বর্তমান কায়রো) প্রথমে সেনাবারিক ছিল, পরে সেগুলি প্রসিদ্ধ শহর হিসেবে গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক জুন্দ্ েচার হাজার যুদ্ধাশ্বের আস্তাবল নির্মিত হয়। এভাবে বত্রিশ হাজার নিয়মিত যুদ্ধাশ্ব সর্বদা প্রস্তুত থাকতো, অতি স্বল্প সময়ে সমরাঙ্গণে প্রেরণ করার জন্যে। ১৭ হিজরীতে জাজিরায় সহসা বিদ্রোহ উপস্থিত হলে, মুহূর্ত মধ্যে অশ্বারোহী সেনাদল উপস্থিত হয়ে অঙ্কুরেই সে বিদ্রোহ নির্মূল করে। এ-সব যুদ্ধাশ্বের রক্ষণাবেক্ষণ ও শিক্ষার জন্যে বিশেষ যত্ন নেওয়া হতো। মদীনার আস্তাবলগুলি খোদ ওমরের তত্ত্বাবধানে থাকতো। তাঁর খাস্ সেবক হানী চারণভূমির তদারককারী ছিল। উল্লেখযোগ্য যে, মদীনার নিকটবর্তী চারণভূমি সমূহে শুধু যুদ্ধের ঘোড়াই থাকতো না, চল্লিশ হাজার উট ও প্রতিপালিত হতো যুদ্ধের জন্যে। যুদ্ধের ঘোড়াগুলির উরুদেশে ছাপ মেরে দেওয়া হতো ‘জাইশ্-ফি-সাবিলিল্লাহ্র; অর্থাৎ আল্লাহ অশ্ববাহিনী। তৃতীয়ত প্রত্যেক জুন্দে যুদ্ধের নথিপত্র হেফাজতের জন্যে সমর- দিওয়ান থাকতো; এবং চতুর্থত সেনাবাহিনীর রসদ বিভাগের পৃথক গুদাম ছিল এবং সেখান থেকে সমস্ত রসদ সমরক্ষেত্রে সরাসরি চালান হতো।

এ-সব জুন্দ্ ব্যতীত ওমর প্রত্যেক শহরে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সেনানিবাস স্থাপন করেন, এবং এভাবে সমগ্র মুসলিম অধিকারে আরবজাতিকে ছড়িয়ে বাস করতে বাধ্য করেন। কোন নতুন শহর বা অঞ্চল অধিকার করা হলেই সেখানে একটা সেনানিবাস স্থাপিত হতো। সিরিয়া বিজিত হলে ওমর প্রত্যেক শহরে একদল সৈন্য মোতায়েন করে বিজেতা আবুওবায়দা শক্তি বৃদ্ধি করেন। সিরিয়ার সমুদ্রোপকূলবর্তী স্থানসমূহে-আরবী ভাষায় বিলাদ ই-সাহিলিয়াহ্-সেনাবাহিনীর সহজগতি ছিল এবং তার দরুন রোমক আক্রমণ থেকে নিরাপদ করার উদ্দেশ্যে সমুদ্রোপকূলবর্তী প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সমরঘাঁটি স্থাপিত হয় ও উপযুক্ত সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখা হয়। এ-সব স্থানে আগুন জ্বালিয়ে শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে সাবধান করার ব্যবস্থাও অবলম্বন করা হয়। মিসরে আমর-বিন্-আসের অধীনে যে বাহিনী ছিল তার এক-চতুর্থাংশ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত থাকতো, এক চতুর্থাংশ থাকতো সমুদ্রোপকূলে টহলদারী করতে এবং বাকী সৈন্য সারা মিসরে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার হেতু ফুস্তাতে মোতায়েন থাকতো। বসরা ও কুফা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঞ্চলে অবস্থিত হলেও চল্লিশ হাজার সৈন্য বসরায় অবস্থান করতো এবং তার মধ্যে দশ হাজার সর্বদা প্রস্তুত থাকতো, বহিরাক্রমণে যাত্রা করতে। ইরাকের প্রতিটি পুরাতন পারসি কসেনানিবাস পুননির্মিত হয়, খারিযা ও জাবুকাস্থিত সাতটি সেনানিবাস নতুনভাবে নির্মিত হয়। রায় ও আজরবাইজানের সেনানিবাসে দশ হাজার সৈন্য থাকতো। সারা মুসলিম অধিকৃত অঞ্চলে এ-সব সমরঘাঁটি ও সেনানিবাস স্থাপনের কারণ ছিল দুটি: ইরাকে বহু মারজাবান্ বা সামন্ত ছিলেন, যাঁরা সুযোগ দেখলেই বিদ্রোহ করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করতেন, এজন্যে তাঁদেরকে শায়েস্তা করতে হতো আর মুসলিমদের মোটেই নৌশক্তি ছিল না। এজন্যে সিরিয়ার উপকূলভাগ রোমক নৌশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষার হেতু এ সব সমরঘাঁটি শক্তিশালী রাখার প্রয়োজন ছিল।

সেনানিয়োগ ও সেনাবাহিনী সংগঠনেও ওমর নয়া নীতি প্রবর্তন করেন ও সামরিকশক্তি বৃদ্ধি করেন। প্রথমভাগে আনসার ও মুহাজেরদের মধ্যে সৈন্যবিভাগে নিযুক্তি সীমিত থাকলেও পরে সমগ্র আরববাসীর জন্যে সেনাবিভাগে নিয়োগ উন্মুক্ত করা হয়। মদীনা ও আস্ফানের মধ্যবর্তী আরবরা এবং সুদূর বাহ্রায়েনবাসী আরবরাও সৈন্যবিভাগে নিযুক্ত হয় এবং তালিকাভুক্ত হয়। এমন কি, কুকা, বা, ফুস্তাত্, জাজিরাহ্ প্রভৃতি ভিন্ন দেশবাসী আরবরাও সেনাবিভাগের প্রবেশাধিকার লাভ করে। এভাবে প্রায় আট দশ লাখ আরব-সৈন্য তালিকাভুক্ত হয়। ইবনে সা’দের বয়ান মতে প্রতি বছর ত্রিশ হাজার রংরুট বাহিনী যুদ্ধস্থলে প্রেরিত হতো। তাবারীর বর্ণনা মতে প্রায় একলক্ষ যুদ্ধক্ষম বাসিন্দা কুফায় ছিল এবং তাদের মধ্যে চল্লিশ হাজার স্থায়ী সৈন্য পর্যায়ক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরিত হতো। কালক্রমে ওমর সেনাবিভাগ পারসিকদের এবং অন্যান্য বিদেশীদের জন্যেও উন্মুক্ত করে দেন। সায়াহ্, খরো, শাহ্রীয়ার ও আফরুদ্দীন নামক পারসিক সেনানায়কগণ প্রত্যেকে আড়াই হাজার ও আরও একশত পারসিক নায়ক প্রত্যেকে দুই হাজার মুদ্রা বেতনভোগী ছিলেন। তুস্তারের যুদ্ধ সায়ার রণ-কৌশলে জয় করা হয়েছিল। ইয়ামনের পারসিক শাসক বাধানোর সমগ্র পারসিক বাহিনী ইসলাম গ্রহণ করে ও সৈন্য-তালিকাভুক্ত হয়। আনন্দের সঙ্গে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, ওমরের সেনাবিভাগে পাক-ভারতীয়রাও প্রবেশেধিকার লাভ করেছিল। পারসিক খসরু ইয়েগির্দের সেনাবিভাগে সিন্ধুর জাঠরা নিয়োজিত ছিল এবং ২০ হিজরীতে সুস্ অধিকৃত হলে জাঠ সৈন্যরাও ইসলাম গ্রহণ করে সৈন্যতালিতাভুক্ত হয়। আরবরা তাদেরকে ‘যাত’ নামাঙ্কিত করেছিল। মুসলিম সেনাবাহীতে রোমক ও গ্রীকরাও ছিল এবং তাদের পাঁচশত সেনা মিসর জয়কালে ইসলামের পতাকাতলে যুদ্ধ করেছিল। রিজার্ভ বাহিনীতে প্রায় দশ হাজার অগ্নিপূজক ছিল এবং তারা মুসলিমদের সমান বৃত্তিলাভ করতো। স্থায়ী বাহিনীতেও তাদের সংখ্যা ন্যূন ছিল না। সংক্ষেপে বলা যায়, উদার ও ন্যায়দর্শী ওমর সেনাবিভাগ সকল দেশের সকল গোত্রের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, জাতি ও ধর্মের কোন ভেদাভেদ রাখেন নি।

কোনও রকম ব্যবসা বা কৃষিকাজে লিপ্ত হওয়া আরবসৈন্যদের পক্ষে একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। এজন্যে তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হয় ও সব রকম প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও হাতিয়ার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। ওমর সৈন্যদের সর্বনিম্নবেতন বার্ষিক দু থেকে তিনশত মুদ্রায় বৃদ্ধি করেন। কর্মচারীদের বেতন ছিল সাত থেকে দশ হাজার। পূর্বে সেনাদের সন্তানরা মাতৃস্তন্য ত্যাগ করার পর নির্ধারিত বৃত্তি পেত। ওমর তাদের জন্মদিন থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া সেনাদের পৃথক ভাতা ছিল। বেতন দেওয়া হতো বছরের প্রথম মাস মহরমের প্রথম ভাগে, ভাতা দেওয়া হতো বসন্তকালে। প্রতি গোত্রের দশজন সৈন্যের অধিনায়ককে আরিফ বলা হতো: এবং আরিফরাই নিজ নিজ অধীনস্থ সৈন্যমধ্যে বেতন বিলি করতো। বেতন ব্যতীত সেনারা একটা নির্দিষ্ট হারে ‘মাউনাহ্’ বা ভাতা লাভ করতো। চাকরীর মেয়াদ অনুসারে পদোন্নতি হতো ও বেতন বৃদ্ধি হতো। বেতন ও ভাতা ব্যতীত মালে-গনিমাতের অংশও সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হতো এবং এভাবে প্রাপ্যের পরিমাণে কোনও সীমারেখা ছিল না। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখযোগ্য যে, জালুলার যুদ্ধজয়ের পর প্রতিটি অশ্বারোহী সৈন্য দশ হাজার এবং নিহাওন্দের যুদ্ধজয়ের পর ছয় হাজার মুদ্রা প্রাপ্ত হয়। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, আরব সেনারা পারসিক বা রোমক সেনাদের চেয়ে বেশি বেতন লাভ করতো, তার উপর মালে গনিমাতে ছিল নিশ্চিত লাভ। যুদ্ধ-ব্যবসা শুধু লাভজনক ছিল না, সবচেয়ে মহৎ ও আল্লাহর নিকট প্রিয় ছিল। আরব সৈন্যর শক্তি শুধু সংখ্যাধিক্য উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রে বা সংগঠন-নীতিতে ছিল না; উচ্চ নীতি জ্ঞান, অনমনীয় মনোবল এবং ধর্মীয় প্রীতির মধ্যেই তা নিহিত ছিল।

সৈন্যদের পোশাক কি ছিল তা জানা যায় না। তবে তাদেরকে পারসিকদের পোশাক পড়তে দেওয়া হতো না। ২১ হিজরীতে যখন মিসরে জিম্মীদের উপর জিয়া প্রবর্তিত হয়, তখন সৈন্যবিভাগের জন্যে পোশাকও অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং তা ছিল একটি পশমী কোট, একটি লম্বা টুপী বা আমামা, পাজামা ও চামড়ার থলিয়া। প্রত্যেক গোত্রের নিজস্ব নিশান ছিল, এক টুকরা বিশেষ ধরনের কাপড় বর্ণায় গেঁথে গোত্রের বীরশ্রেষ্ঠ তা বহন করতো। পদাতিক বাহিনীর অস্ত্র ছিলো, তীর ধনুক ফিঙ্গা, ঢাল ও তয়োয়ার; খাপে-ঢাকা তলোয়ারখানি ডান কাঁধে ঝুলে থাকতো, পরবর্তীকালে আবিসিনিয়া থেকে ‘হারবাহ’ বা বর্শা আমদানি করা হলে পদাতিকরাও ব্যবহার করতো। অশ্বারোহী বাহিনীর অস্ত্র ছিল ‘রুম্হ বা দীর্ঘ বর্শা; তার ‘খত্তি’ বা দণ্ডটি বাহ্রায়েনের আল্-খাত্ নামক সমুদ্রোপকূলবর্তী স্থানের বাঁশ থেকে নির্মিত হতো। তীর-ধনুকও অশ্বারোহীদের অস্ত্র ছিল। তরবারি স্থানীয় কারখানায় প্রস্তুত হতো, তবে ‘হিন্দী’ নামক উচ্চ শ্রেণীর তরবারী পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকে আমদানি করা হতো। আত্মরক্ষার্থে সৈন্যরা ঢাল ও বর্ম ব্যবহার করতো। সৈন্যরা নিজেরাই অশ্ব সংগ্রহ করতো। যাদের বেতন অল্প এবং অবস্থা ভাল হয়, তাদের জন্য সরকার থেকে অশ্ব সরবরাহ করা হতো।

প্রথম দিকে সৈন্যদের রসদ যোগানোর ব্যবস্থা (কমিসরিয়ট) কিছুই ছিল না। কাদিসিয়ার যুদ্ধে নিযুক্ত সেনাবাহিনী আশপাশের গ্রামগুলি থেকে নিজেরাই খাদ্য-শস্য সংগ্রহ করতো, খলিফা মদিনা থেকে গোশত পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীকালে জিম্মীরা জিয়ার সঙ্গে মাথাপিছু পঁচিশ সের খাদ্যশস্য আদায় দিত এবং এভাবে সংগৃহীত সব খাদ্যশস্য সেনাবিভাগে চালান যেতো। মিসর থেকে জলপাই তৈল, মধু ও সির্কাও সংগৃহীত হতো এবং সৈন্যরা তা দিয়ে রুটি মেখে খেত। জাজিরাহ্ থেকেও এ-সব সংগ্রহ হতো। পরবর্তীকালে ‘আহরা’ নামক রসদ যোগান দফতর সৃষ্টি হয়। সব রকম খাদ্যদ্রব্য এক স্থানে সঞ্চিত হতো এবং মাসের প্রথম মাথাপিছু এ রকম হারে বন্টন করা হতো-খাদ্যশস্য এক মণ দশ সের, জলপাই তৈল বার সের ও সিকা বার সের। ইয়াকুবী বলেন, পরবর্তীকালে ওমর যখন সিরিয়ায় সফরে যান, তখন সৈন্যদেরকে খোরাকী দেওয়ার পরিবর্তে পাক করা খাবার দেওয়া হতো।

সৈন্যদের সুস্থ ও কর্মঠ রাখার জন্যে কয়েকটি বিধি-নিয়ম পালন করা হতো। তাদেরকে দৈনিক ঘোড়দৌড়, তীরছোঁড়া, কুস্তিবাজী, সন্তরণ ও খোলা পায়ে হাঁটা প্রভৃতি ব্যায়াম করতে হতো। দৈনিক আধুনিক পন্থার ড্রিল করানোর কোনও নিয়ম ছিল কি-না জানা যায় না। অভিযান পরিকল্পিত হতো। ঋতু পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে। শীত-প্রধান দেশে গ্রীষ্মকালে এবং গ্রীষ্মপ্রধান দেশে শীতকালে সাধারণ অভিযান করার চেষ্টা করা হতো। ঋতু অনুযায়ী এভাবে চালানোর আরবী নাম ছিল ‘শাতিয়াহ্’ ও ‘সাফিয়াহ্’। ১৭ হিজরীতে মাদায়েন অধিকৃত হওয়ার পর লক্ষ্য করা গেল, সৈন্যদের স্বাস্থ্য ঋতুর কঠোরতার দরুন ভেঙ্গে পড়েছে, তখন ওৎবাহ্ বিন্-খাওয়ানের উপর নির্দেশ হয়, বাহিনী প্রতি বছর বসন্তকালে স্বাস্থ্যপ্রদ স্থানে অপসারণ করতে। উত্তম আবহাওয়ার সঙ্গে উপযুক্ত চারণভূমির দিকেও দৃষ্টি রাখা হতো। মিসরের শাসক আমর- বিন্-আস্ বসন্ত সমাগমে সেনাবাহিনীকে গ্রামাঞ্চলে স্থানান্তরিত করতেন; তখন তারা শিকারে ও আমোদ-প্রমোদ স্বাস্থ্যোন্নতি করতো এবং চারণভূমিতে উট ও ঘোড়াগুলি মোটা হয়ে উঠতো।

সেনানিবাসে ও সেনাবারিক নির্মাণের সময় আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যবিধির দিকে লক্ষ্য রাখা হতো। এজন্যে খোলা উঁচু জায়গা নির্বাচিত হতো ও প্রতিটি গৃহের সম্মুখে প্রশস্ত উঠান রাখা হতো। কুফা, বসরা, ফুস্তাত প্রভৃতি বৃহৎ শহরের সেনানিবাসগুলির প্রশস্ত পথ ছিল। ওমর নিজেই এসবের পরিকল্পনা প্রস্তুত করতেন এবং রাস্তার প্রস্থ ও অবস্থান নির্দেশিত করতেন।

সৈন্যরা অভিযানে মার্চ করার সময় শুক্রবারে বিশ্রাম করতো। তারা একদিন ও একরাত বিশ্রাম করে শ্রান্তি দূর করতো এবং পোশাক ও অস্ত্র পরিষ্কার করে নিতো। খাদ্যদ্রব্যের ও পানির সহজপ্রাপ্যতা দেখে ছাউনি ফেলা হতো। সা’দ-বিন-ওক্কাসের নিকট প্রেরিত ফরমান থেকে এ-সব নির্দেশের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সৈন্যদের নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ছুটি দেওয়া হতো। দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত সেনারা বছরে একবার ছুটি ভোগ করতো। একবার ওমর এক যুবতীকে বিরহের গান গাইতে শুনে জানতে পারেন, তার মুজাহিদ স্বামী বহু দিন ঘরে ফেরে নি। ওমর তখনই সিপাহসালারদের নির্দেশ দেন, কোনও সৈনিকের চারমাসের বেশি গৃহসুখ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

ওমর সৈন্যবিভাগে আরও কয়েকটি নতুন নিয়ম প্রবর্তন করেন। প্রত্যেক বাহিনীর সঙ্গে একজন হিসাবরক্ষক, একজন কাজী, কয়েকজন দোভাষী ও চিকিৎসক থাকতেন। কাদিসিয়ার যুদ্ধকালে আবদুর রহমান-বিন্-রাবিয়া কাজী হিসেবে, যিয়াদ-বিন্- আবিসুফিয়ান হিসাব পরীক্ষারূপে এবং হিলালহিজরী দোভাষী হিসেবে অনুগমন করেছিলেন।

যুদ্ধকালে সৈন্যবিন্যাস করা হতো শ্রেণীবদ্ধরূপে। সৈন্যদের বিভক্ত করা হতো দক্ষিণ, বাপ, সম্মুখ ও পশ্চাৎসারি হিসেবে। প্রত্যেক সারি পৃথকভাবে যুদ্ধ করতো, সমগ্র বাহিনীর কোন নির্দিষ্ট সিপাহসালার থাকতো না প্রথম দিকে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় সর্বপ্রথম খালিদ-বিন্-ওলিদ একক সিপাহসালার হিসেবে সেনাবাহিনী সুসংবদ্ধরূপে পরিচালনা করেন। চল্লিশ হাজার সৈন্য ছত্রিশটি অংশে বিভক্ত হলেও খালিদের নেতৃত্বে সুগঠিত হয়ে এক যোগে যুদ্ধদান করেছিল। ওমরের নির্দেশমতে সৈন্যদল এরূপভাবে সারিবদ্ধ হতো : কর্ বা মধ্যভাগ, এটির সঙ্গে সিপাহসালার যুক্ত থাকতেন; মকাদ; দামাহ্ বা সম্মুখদল; মায়ামানাহ্ বা দক্ষিণবাহু; মায়সারাহ্ বা বামবাহু; সাকাহ্ বা পশ্চাদ্দল, তালাইয়াহ্ বা টহলদারীদল, যাদের কাজ ছিল শত্রুপক্ষের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখা; রিদ্ অর্থাৎ সর্বপশ্চাদ্ দল, যাদের কাজ ছিল সম্মুখের দলগুলিকে শক্তিশালী করা; রাইদ্ অর্থাৎ রসদ যোগানদার; রুকবান্ অর্থাৎ উষ্ট্রবাহিনী; ফরসান্ অর্থাৎ অশ্বারোহী বাহিনী; রাজিল্ অর্থাৎ পদাতিক বাহিনী; রমাত্ অর্থাৎ তীর ধনুকধারী বাহিনী। কিল্লা দখল করতে ও দুর্গপ্রাচীর ভূমিসাৎ করতে প্রস্তরক্ষেপক যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার করা হতো। ১৬ হিজরীতে বসির দুর্গ আক্রমণকালে ন্যূনপক্ষে কুড়িটি এরূপ যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়। দবাবহ্ নামক আর একটি যন্ত্র অবরোধকালে ব্যবহৃত হতো। এটি কাঠের কয়েকটি তালাযুক্ত উঁচু যন্ত্রবিশেষ। চাকায় চালিত যন্ত্রটিতে প্রস্তর নিক্ষেপকারী, প্রাচীর রন্ধ্রকারী ও তীরন্দাজগণ আত্মগোপন করে শত্রুর দুর্গপ্রকারের কোলে উপস্থিত হতে পারতো এবং সহজে দুর্গপ্রাকার বিধ্বস্ত করে দিত। অভিযানকালে সড়ক, সেতু ও অস্থায়ী গৃহ নির্মাণ করবার পৃথক বাহিনী থাকতো। মারিযী বলেন, আলেকজান্দ্রিয়া অভিযানকালে মিসরবাসীরা স্বেচ্ছায় এ-সব কাজের ভার গ্রহণ করে ছিল এবং সারাপথে বাজার বসিয়ে মুসলিমবাহিনীর রসদ যোগাড়ের ব্যবস্থা করেছিল।

ওমরের খেলাফতকালে গুপ্তচর নিয়োগ ও গোয়েন্দাগিরি উচ্চ পর্যায়ের ছিল। গুপ্তচর হিসেবে ইরাক ও সিরিয়া নও-মুসলিম আরবদিগকে নিযুক্ত করা হতো। তারা বহু বছর এ সব দেশে বাস করে দেশের অবস্থা ও বাশিন্দাদের স্বভাব-প্রকৃতি সম্যক অবগত ছিল এবং সহজেই অগ্নিপূজক অথবা খ্রিস্টানদের বেশ ধরে শত্রুদলে মিশে যেতো এবং শত্রুপক্ষের সৈন্যশক্তি, গতিবিধি প্রভৃতি মূল্যবান সংবাদ সংগ্রহ করতো। ইয়ারমুক, কাদিসিয়া ও তিরকিতের যুদ্ধে এ-সব গুপ্তচর খুবই সাহায্যকারী হয়েছিল। সিরিয়ার বড়ো বড়ো শহরবাসীরা নিজেরাই গুপ্তচর নিয়োগ করতো এবং রোমক সৈন্যবাহিনীর গতিবিধি সম্বন্ধে মুসলিমদেরকে সন্ধান দিতো। প্যালেস্টাইন ও জর্ডানের উত্তরাঞ্চলের সুমারিতান গোত্রীয় ইহুদীরা গুপ্তচর হিসেবে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল এবং কাজের পুরস্কার হিসেবে তাদের নিষ্কর ভূমি দান করা হতো।

ওমরের সেনাবিভাগ-প্রশাসনের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সেনাবাহিনীর উপর সর্বদাই সামগ্রিক কর্তৃত্ব স্থাপন; এবং তা এতোখানি চূড়ান্ত ছিল যে, যদিও বিশাল বাহিনী মুসলিম অধিকারের দেশে দেশে অতিদূর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, বহু জাতি ও গোত্রের সংমিশ্রণে গঠিত ছিল, তবুও তাঁর উপস্থিত প্রতিটি সৈন্যঘাঁটিতে অনুভূত হতো এবং তার দরুন সিপাহসালার থেকে সামান্য সৈন্য পর্যন্ত সর্বদাই সন্ত্রস্ত ও শঙ্কিত থাকতো। আর তার কারণ ছিল দুটি: ওমরের সমুদ্রবৎ অসীম মহিমাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও নিরঙ্কুশ প্রভাব। দ্বিতীয়ত প্রতিটি সেনাদলে ওমরের এমন বিধ্বস্ত সংবাদদাতা ছিল, যার মারফত তিনি প্রতিটি সংবাদ সংগ্রহ করতে সক্ষম হতেন। তাবারী বলেন: প্রত্যেক সেনাদলে ওমরের সংবাদদাতা ও গোয়েন্দা নিযুক্ত থাকতো এবং তারা প্রতিটি সংবাদ খলিফার গোচরে আনতো। তার ভয়ে কেউ কোনও অপরাধ করলে অনতিবিলম্বে খলিফা অবহিত হতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবিধান করতেন। পারসিকদের সঙ্গে যুদ্ধকালে আমর মাযি-করর্ সেনাপতির সঙ্গে অভদ্র আচরণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তা খলিফার গোচরে আসে এবং মাযি-করর্ এমন কঠিন ভর্ৎসনা লাভ করেন যে, পরবর্তীকালে আর কেউ অবাধ্যতা করার কল্পনাও করতে পারতো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *