সিরিয়া বিজয় (দ্বিতীয় পর্যায়)
পূর্বেই উক্ত হয়েছে যে, আবুবকর যখন চারদিকে চারজন সেনানায়ক পাঠান সিরিয়া জয় করতে, তখন আমর বিন্-আস্ প্যালেস্টাইন প্রদেশ অধিকার করতে আদিষ্ট হন। আমর পথিমধ্যের দুর্গসমূহ অধিকার করতে করতে অগ্রসর হতে থাকেন এবং ওমরের সময়ে নাব্লাস্, লুদ, আমওয়াস্ ও বায়েত জারিন নামক প্রসিদ্ধ শহর তাঁর হস্তগত হয়। যখনই আবুওবায়দাহ্ কোনও বিরাট অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন, কিংবা ভীষণ সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন, তখনই আমর দ্রুত তাঁর সাহায্য করেছেন, এবং প্রয়োজন শেষ হলে নিজের আরদ্ধ কাজ গ্রহণ করেছেন। এভাবে ক্রমে অগ্রসর হয়ে ষোল হিজরীতে (৬৩৭ খ্রি.) তিনি বয়তুল মুকাদ্দস্ বা জেরুজালেম অবরোধ করেন। খ্রিস্টানরা অকুতোভয়ে দুর্গমধ্যে আত্মরক্ষা করতে লাগলো, জেরুজালেমের পতন ঘটানো সহজ সাধ্য হলো না। ইতিমধ্যে আবুওবায়দাহ্ সিরিয়ার শেষ সীমান্তস্থিত কিনিসিরি অধিকারে করে এদিক থেকে নিশ্চিন্ত হয়ে জেরুজালেমে উপস্থিত হন। তাঁর উপস্থিতিতে জেরুজালেমবাসীদের মনোবল ভেঙ্গে যায়, এবং এ শর্তে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয় স্বয়ং খলিফা জেরুজালেম উপস্থিত হয়ে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দিবেন। আবু ওবায়দাহ্ দূত পাঠিয়ে এ বিষয় ওমরের গোচরীভূত করেন।
ওমর সাহাবাদের পরামর্শ চান, কী করা উচিত। ওসমান মত দেন, ওমরের যাওয়াই উচিত। কারণ খ্রিস্টানরা ইতিমধ্যে খুবই ভীত ও আশঙ্কিত হয়েছে, এবং খলিফা না গেলে আরও ক্ষুণ্ণ হয়ে পড়বে। আলী ভিন্নমত দিলেন। কিন্তু ওমর যাওয়াই স্থির করলেন, এবং আলীকে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে মদীনায় রেখে ষোল হিজরীর রজব মাসে জেরুজালেমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর যাত্রাপথে কোনও তোরণ সজ্জিত হয় নি, বাদ্য বাজে নি, তোপধ্বনি হয় নি। কোন দেহরক্ষী চাকর নফর নেই। একটিমাত্র উটে চড়ে সিরিয়া ইরাক বিজয়ী সমকালীন পৃথিবীর মহাশক্তিধর শাসক ওমর চলেছেন, একমাত্র চারবাসখানি সম্বল করে। অথচ ওমর চলেছেন বার্তা রটে গেল মদীনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত প্রতি ঘরে ঘরে, আর প্রত্যেকেই শঙ্কিত হয়ে দুরু দুরু বক্ষে তাঁর প্রতীক্ষা করতে লাগলো।
ওমর পূর্বেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, সিরিয়ায় অবস্থিত সকল সেনানায়ক যেন জাবিয়ায় তাঁর অপেক্ষা করেন। ইয়াজিদ বিন্ আবু সুফিয়ান, আবু ওবায়দাহ্, খালিদ ও অন্যান্য সৈন্যাধ্যক্ষ জাবিয়ায় তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। বহুদিন সিরিয়া বাস করার ফলে তাঁদের বেশভুষায় আচার ব্যবহারে আরব-সরলতার অভাব ঘটেছিল। তাঁদের বহুমূল্য রেশমী বস্ত্রের চাকচিক্যময় পরিচ্ছদ ও শান-শওকতের আধিক্য দেখেই হঠাৎ ওমরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সহসা লাফ দিয়ে কয়েকটা পাথরকুচি কুড়িয়ে তাঁদের দিকে নিক্ষেপ করতে করতে বলেন: কি আশ্চর্য! এতো শীঘ্র তোমরা ভোল পালটিয়ে ফেলেছ? এই পোশাকে এসেছ আমায় অভ্যর্থনা করতে? দু’বছরেই তোমরা বদলে গেলে? খোদার কসম! দু’শো বছর তোমরা এভাবে চললে আল্লাহ্ তোমাদেরও বদলে আর কাউকে কর্তৃত্ব দান করবেন। সেনানায়করা অধোবদন হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, তাঁদের রেশমী কাবার নিচে সৈনিকের বর্ম রয়েছে। ওমর কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন, তবু ভাল। তার পর জাবিয়া শহরে প্রবেশ করে একটা টিলায় উঠে ওমর চারদিকে দৃষ্টিপাত করেন। খোতাহ উপত্যকার শস্যশ্যামল হরিৎ ক্ষেত্র, দূরে দামেশক শহরের উচ্চ অট্টালিকাসমূহ তাঁর নয়নপথে এক অপূর্ব দৃশ্যে প্রতিভাত হলো। ভাবে অভিভূত হয়ে তিনি গভীর কণ্ঠে কোরআনের এই বাণী ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন: তারা ফেলে গেছে বহু বাগিচা, ফোয়ারা, বিহারভূমি, কুঞ্জকানন ও ধনসম্পদ; এককালে তারা এসব উপভোগ করতো। এমনি করে আমরা পরবর্তী কওমকে সে-সবের উত্তরাধিকারী করি। তার পর তিনি কবি নাবিঘাহের কয়েকটি মর্মস্পর্শী বয়েতও উচ্চারণ করতে থাকেন।
জাবিয়াহ্ প্রসিদ্ধ ইয়ারমুক যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তরে অবস্থিত ছিল। তখন এটি ছিল মুসলিমদের একটি শক্তিশালী, সামরিক কেন্দ্রস্থল। আধুনিক কালেও দামেস্ক শহরের পশ্চিমদ্বারটি জাবিয়ার নাম বহন করছে। ওমরের উদ্দেশ্য ছিল এখানে বিজয়সমূহ সম্পর্কে সেনানায়কদের সঙ্গে আলোচনা করা, খালিদের পদচ্যুতির পর নয়ানিযুক্ত সিপাহসালার আবুওবায়দাহ্ সঙ্গে ভবিষ্যৎ অভিযান সম্পর্কে পরামর্শ করা, বিজিত জনগণের স্বত্বাধিকার নির্ধারণ করা এবং সদ্য অধিকৃত অঞ্চলসমূহের শাসনবিধি প্রণয়ন করা। একদিন ওমর কর্ম-ব্যস্ত ছিলেন, এমন সময় দেখা গেল, একদল অশ্বারোহী রণসাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণতেজে আসছে। উপস্থিত মুসলিম সেনানীবর্গ তখনই অস্ত্রের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু ওমর প্রথমেই বুঝতে পারেন, আগন্তুকরা জেরুজালেমের এবং তখনই মুসলিমদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে অশ্বারোহীরা সন্ধিশর্ত স্থির করতে আসছেন। যা হোক, সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হলো, এবং ওমরের সঙ্গে বহু সাহাবাও স্বাক্ষর দিলেন।
অতঃপর ওমর জেরুজালেমে প্রবেশ করেন। শহর প্রবেশকালে আবুওবায়দাহ্ ও অন্যান্য সমরনায়ক ওমরের জীর্ণ তালিযুক্ত জামাখানি দেখে একখানি সুন্দর জামা ও একটি মনোহর তুর্কী ঘোড়া আনয়ন করেন ও ওমরকে গ্রহণ করতে বলেন। কিন্তু ওমর বলেন, আল্লাহ্ তাঁকে ইসলামের আশ্রয় দিয়ে ধন্য করেছেন, এবং তাঁর মর্যাদার পক্ষে তাই যথেষ্ট। ওমর অতি সাধারণ বেশেই বিনা আড়ম্বরে জেরুজালেমে প্রবেশ করে প্রথমে মসজিদে আসায় গমন করেন ও সেখানে হতে মিরাব-ই-দাউদের নিকট যেয়ে কোরআন থেকে হযরত দাউদ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ পাঠ করতে থাকেন। অতঃপর তিনি খ্রিস্টানদের প্রসিদ্ধ গির্জাটি ও অন্যান্য স্থান দর্শন করেন।
ওমর জেরুজালেমে কয়েকদিন অবস্থান করেন। একদিন আঁ-হযরতের মুয়ান বিলাল অনুযোগ করেন, সামরিক কর্তাব্যক্তিরা মুরগীর গোস্ত ও সাদা রুটি খান, অথচ সাধারণ লোক সামান্য খাবারও পায় না। ওমর জিজ্ঞাসানেত্রে তাঁদের দিকে তাকালে তাঁরা একবাক্যে বলেন, হেজাযে যে দামে লালরুটি ও খেজুর মেলে, এখানে সে-দামেই মুরগী-ময়দা মেলে। ওমর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন, সৈনিকরা মাসোহারা ও মালে- গনিমাতের অংশ ছাড়াও বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ পাবে।
একদিন নামাযের সময় ওমর বিলালকে অনুরোধ করেন, আযান দিতে। বিলাল বলেন, রসূলে করীমের ওফাতের পর তিনি মনস্থির করেন, আর আযান দিবেন না। কিন্তু আমিরুল-মুমেনীনের অনুরোধ উপেক্ষা করা শক্ত, অতএব আর একবার মাত্র আযান দিবেন। তার পর যখন তিনি উদাত্তকণ্ঠে সুললিত স্বরে আযান ধরেন, তখন উপস্থিত সকলেই বিগত আঁ-হযরতের উপস্থিতি-ধন্য দিনের স্মৃতিতে অভিভূত হয়ে ক্রন্দন করতে থাকেন। ওমর তো শোকে বিহ্বল হয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়েন
মসজিদ্-উল-আক্সা পরিদর্শনকালে ওমর বিশপ কা’বকে জিজ্ঞাসা করেন, কোথায় নামায পড়া যায়। এখানে একটি প্রস্তরখণ্ড ছিল, সেটি পূর্বতন নবীগণের স্মারকচিহ্ন। তার নাম ছিল ‘সাখরাহ্’ এবং ইহুদীদের চক্ষে সেটি ছিল তেমনই শ্রদ্ধার্থ, যেমন মুসলিমরা হাজরে আসওয়াদকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখে থাকেন। ওমর কা’বকে জিজ্ঞাসা করেন, কোন্ দিকে মুখ ফিরিয়ে তাঁরা প্রার্থনা করেন, তখন কা’ব ‘সাখরাহ্’কেই কিলাহ্ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওমর বললেন, এখনও তাঁদের মন থেকে ইহুদী ধর্মবিশ্বাস নিশ্চিহ্ন হয় নি। কিন্তু ওমর নিজে সঙ্গে সঙ্গে পাদুকা খুলে ‘সাখরাহ্’ পাশে রাখেন। এর থেকেই পরিষ্কার, ওমর কী দৃষ্টিতে এ-সব প্রাচীন স্মৃতিচিহ্ন লক্ষ্য করতেন।
সতের হিজরীতে (৬৩৮ খ্রি.) খ্রিস্টানরা এমেসা জয় করবার দ্বিতীয় ও শেষ চেষ্টা করে। তার দরুন জাজিরাহ্ ও আর্মেনিয়া মুসলিমদের হস্তগত করার সুযোগ হয়ে যায়।
দিনে দিনে ইসলামের অপ্রতিরোধ্য বিস্তৃতি প্রতিবেশী রাজাদের আশঙ্কা বৃদ্ধি করতে থাকে। মুসলিম সৈন্যদের নিরঙ্কুশ অগ্রগতিতে এসব রাজ্যের শাসকরা চিন্তা করতে থাকেন, কবে কার ভাগ্যদোষে স্বাধীন সত্তার লোপ পেয়ে যায়, এবং আরবদের পদানত হতে হয়। এজন্যে জাজিরাহের বাশিন্দারা সীজার হিরাক্লিয়াসের নিকট দূত পাঠায়, আর একবার পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে আরবদের মোকাবিলা করতে, এবং তারাও তাঁর পশ্চাতে আছে। সীজার উত্তম সুযোগ বুঝে এমেসায় একদল সৈন্য প্রেরণ করেন, অন্যদিকে জাজিরাবাসীরা তিন লক্ষ সুশিক্ষিত সৈন্য নিয়ে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। আবুওবায়দাহ্ যথারীতি খ্রিস্টানদের প্রস্তুতির বিষয় অবগত ছিলেন। তিনি ওমরকে সংবাদ প্রেরণ করে সাহায্য প্রার্থনা করেন। ওমর দূরদৃষ্টিবলে আটটি বৃহৎ সেনানিবাস করেছিলেন আটটি শহরে এবং প্রত্যেক সেনানিবাসে চার হাজার সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য সর্বদাই মোতায়েন থাকতো। তার ফলে বিপদ সঙ্কেতেই চারদিক থেকে উপদ্রুত অঞ্চলে সৈন্য প্রেরিত হতো। আবুওবায়দা পত্র পেয়েই ওমর কুফায় কা’কা বিন্ – ওমরকে নির্দেশ দিলেন, চার হাজার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এমেসায় যাত্রা করতে; সুহায়েল বিন্-আদিকে নির্দেশ দিলেন, জাজিরাবাসীদের এমেসার গতিপথে বাধা দিতে; আবদুল্লাহ্ নিশিবায়েনে প্রেরিত হলেন, এবং ওলিদ্ বিন্ ওকবাহ্ আদিষ্ট হলেন জাজিরা উপস্থিত হয়ে জাজিরাবাসী আরব গোত্রসমূহকে শত্রুপক্ষের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় নিবৃত্ত করতে। ওমর নিজে দামেশক উপস্থিত হলেন। জাজিরাবাসীরা স্বদেশ আক্রমিত দেখে শীঘ্র ফিরে গেল, এবং আরব গোত্রসমূহ গোপনে খালিদকে সংবাদ পাঠালো, তারা যুদ্ধমুহূর্তে খ্রিস্টানদল ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
আবুওবায়দাহ্ যুদ্ধের পূর্বে সেনাবাহিনীকে এক ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে তাদের বীরত্বপূর্ণ জাগিয়ে তোলেন, তার পর সিংহ বিক্রমে খ্রিস্টান বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি স্বয়ং কেন্দ্রস্থলের, খালিদ ও আব্বাস দুই বাহুর সৈন্যদলের চালনার ভার নিলেন। কা’কা তাঁর অশ্বারোহীর দল নিয়ে সম্মুখভাগে অগ্রসর হন। মুসলিমরা যুদ্ধ আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে আরব গোত্রসমূহ দলত্যাগ করে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তার দরুন খ্রিস্টানরা দুর্বল হয়ে যায় এবং শীঘ্রই যুদ্ধত্যাগ করে পলায়ন করতে থাকে। এটাই ছিল খ্রিস্টানদের শেষ প্রচেষ্টা এবং তার পর তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মাথা তুলতে সাহস করে নি।
সিরিয়া বিজয়-প্রসঙ্গে খালিদের সিপাহসালার থেকে পদচ্যুতি একটি উল্লেখযোগ্য অপ্রীতিকর ঘটনা। এ বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে বাদানুবাদের অন্ত নেই এবং তাদের বিবরণীতেও সামঞ্জস্য নেই। এ প্রসঙ্গে দুটি প্রশ্ন জাগে, যার সদুত্তর খুঁজে পাওয়া শক্ত।
প্রথম প্রশ্ন : কোন্ সময়ে এ ঘটনা হয়? ইবনুল্ আসির প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ বলেন, ওমরের খেলাফতির আরম্ভ হয় খালিদের পদচ্যুতির ফরমান দিয়ে। কিন্তু তাঁরা খালিদের পদচ্যুতির কাহিনী প্রথমে উল্লেখ করেন তের হিজরীতে, আবার দ্বিতীয় উল্লেখ করেন সতেরো হিজরীতে। অথচ উভয়ক্ষেত্রে একই কারণ ও ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু বিশেষ বিবেচনা করলে লক্ষ্য করা যায়, খালিদ ইয়ারমুকের যুদ্ধকাল পর্যন্ত অন্য কারও অধীন সেনানায়ক ছিলেন না, আবুওবায়দাও না। আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর এমেসায় দ্বিতীয়বার যুদ্ধকালে খালিদ আবুওবায়দা আনুগত্য করেছেন। তখন আরবগোত্রসমূহ অযথা বিলম্ব না করে খালিদকে যুদ্ধ আরম্ভ করতে অনুরোধ করলে তিনি বলেছিলেন, তাঁর দুঃখ এই যে, তিনি অন্য ব্যক্তির, অর্থাৎ আবুওবায়দার আজ্ঞাধীন, এবং আবুওবায়দাহ্ যুদ্ধারম্ভের অনুমতি দেন নি। এ-সব থেকে অন্তত এ-প্রশ্নের জওয়াবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, খালিদের পদচ্যুতি ঘটে সতেরো হিজরীতে এবং ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : এ পদচ্যুতির কারণ কি? এ কারণ অনুসন্ধানে ঐতিহাসিকরা আঁ- হযরতের সময়ের একটি ঘটনা থেকে সতেরো হিজরী পর্যন্ত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন। সংক্ষেপে কারণগুলি এই :
ওহোদের যুদ্ধকালে কোরায়েশপক্ষীয় তখন অমুসলিম খালিদ আঁ-হযরতের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করেছিলেন। মক্কা বিজয় কালে আঁ-হযরত নিষেধ করা সত্ত্বেও খালিদ অত্যাচার করে বাড়াবাড়ি করেছিলেন। আবুবকরের সময় তার বিনানুমতিতে বনুতামিম গোত্রের উপর হামলা করে খালিদ মালিক বিন্-নাবিরাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেন, এবং তার বিধবা অনিন্দ্য সুন্দরী লায়লাকে সে-রাত্রেই বিবাহ করেন। এ কারণ সমূহকে উল্লেখ করে বলা হয়, ওমর প্রথম থেকেই মাতুর সম্পর্কীয় ভ্রাতা খালিদের উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং খালিদও তা জানতেন। এ জন্যে উভয়ের মধ্যে বরাবরই মন-কষাকষি ছিল, এবং ওমর সুযোগ পেলেই খালিদকে অপদস্থ ও হেয় করতে চেষ্টা করতেন। আবুবকর খলিফা হয়ে খালিদকে ইরাক থেকে অবিলম্বে সিরিয়া যাওয়ার নির্দেশ দিলে খালিদ আক্ষেপ করেছিলেন : এ সেই খানতামাহ্ (ওমরের মাতা) পুত্রের কাজ, সে চায় না যে, ইরাক বিজয় আমার হাতে সম্পূৰ্ণ হোক।
বলিষ্ঠ কারণ হিসেবে দেখানো হয় খালিদের অমিতব্যয়িতা, যার জন্যে ওমর তাঁরা উপর খুবই অসন্তুষ্ট হন। খালিদ কখনও খরচের হিসাব দিতেন না, এ-জন্যে ওমর তাঁকে পুনঃ পুনঃ সাবধান করতেন। খালিদ উত্তরে জওয়াব দেন, আবুবকরের সময় থেকেই তিনি এ রকম করে আসছেন এবং হিসাব দাখিল করা তাঁর স্বভাব নয়। ওমর এ ঔদ্ধত্য বরদাশত করতে পারেন নি, সাধারণের অর্থ কেউ স্বেচ্ছাচারীভাবে অপব্যয় করবে, এ অন্যায়ও তাঁর সহ্যাতীত ছিল। এজন্যে ওমর কড়াভাবে খালিদকে হুকুম দেন, সিপাহসালার হিসেবে খালিদের, পদাবৃত থাকা নির্ভর করছে সামরিক ব্যয়ের যথাযথ হিসাব নিয়মিতভাবে দাখিল করা। খালিদ এ নির্দেশেও ভ্রূক্ষেপ করেন নি।
আশু কারণ হিসেবে একটি ঘটনা উল্লেখিত হয়। সতেরো হিজরীর শেষ দিকে খালিদ জনৈক কবিকে তাঁর প্রশস্তি গাওয়ার জন্যে এককালীন দশ হাজার দিরহাম দান করেন। গুপ্তচর বিভাগের কর্মকর্তারা যথাসময়ে এ কথা ওমরের কর্ণগোচর করে। ওমর তখন আবুওবায়দাকে নির্দেশ দেন, খালিদ যদি নিজের তহবিল থেকে এ দান করে থাকেন, তা হলে তাঁর চরম অমিতব্যয়িতার প্রমাণ হয়। আর যদি সরকারী খাজাঞ্চিখানা থেকে এ-অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে, তা হলে তিনি অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের দোষে দোষী হন। অতএব প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি পদচ্যুত হওয়ার অপরাধ করেছেন।
খালিদের পদচ্যুতিও হয় নাটকীয়ভাবে। পদচ্যুতির ফরমান নিয়ে যে দূত প্রেরিত হন, তিনি জুমা’বারের জনসমাবেশে প্রকাশ্যভাবে খালিদকে প্রশ্ন করেন, কোন্ তহবিল থেকে কবিকে দান করা হয়েছিল। দূতের উপর নির্দেশ ছিল, খালিদ অপরাধ স্বীকার করলে তাকে ক্ষমা করা হবে। কিন্তু আত্মগর্বী খালিদের পক্ষে আত্মদোষ স্খলনে স্বীকারোক্তি করা অসম্ভব। মজলিসে আবুওবায়দাহ্ মিম্বরে বসেছিলেন, আর বিলাল ও বহু প্রবীণ সাহাবা উপস্থিত ছিলেন। দূতবর দু’বার প্রশ্ন করেন, কিন্তু খালিদ নীরব। তখন বিলাল সহসা উঠে দাঁড়িয়ে খালিদের টুপি খুলে ফেললেন, এবং হাত দুখানি পিছনে টেনে আমমা দিয়ে বেঁধে দিলেন। খালিদের পদচ্যুতি হয়ে গেল চরম লাঞ্ছনার ভিতর দিয়ে।
সারা মজলিস নিস্তব্ধ। ইসলাম জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বীর, ইরাক ও সিরিয়া বিজয়ী অপরাজেয় বীর খালিদ নীরবে নম্র হয়ে খলিফাতুল মুসলেমীনের কঠোর শাস্তি গ্রহণ করলেন একটিও প্রতিবাদবাক্য উচ্চারণ না করে।। সারা মজলিস নির্বাক বিস্ময়ে এ শাস্তিদানের সাক্ষী হয়ে রইলো, একটুও প্রতিবাদ গুঞ্জনধ্বনি না করে। আজ্ঞানুবর্ততা ও শৃঙ্খল রক্ষার মহিমোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন নতশিরে শাস্তি গ্রহণ করে। আর অন্যদিকে প্রত্যক্ষ প্রমাণিত হলো, আমীরুল মুমেনীন ওমরের ব্যক্তিত্ব কতোখানি বিরাট ও শীর্ষবিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত, তাঁর প্রতাপ ও প্রভাব কী পরিমাণ অপ্রতিহত ও অপ্রমেয়।
ঐতিহাসিকরা বলেন, ইমেসায় প্রত্যাগমন করে খালিদ, তাঁর পদচ্যুতির বর্ণনা দান কালে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমীরুল মুমেনীন তাঁকে সিরিয়ার সিপাহসালার নিযুক্ত করেছিলেন, কিন্তু সারা দেশটি জয় করার পর তাঁকে অপসারিত করলেন। তখনই একজন সৈনিক প্রতিবাদ তুলে বলে ওঠে, হে সালার! রসনা সংযত করুন। আপনার ভাষণে বিদ্রোহ সৃষ্টি হতে পারে। খালিদ তখনই সংযত হয়ে বলেছিলেন, ওমর বেঁচে থাকতে বিদ্রোহ জন্মাতেই পারে না।
অনেকে বলেন, পরবর্তীকালে খালিদ মদীনায় উপস্থিত হয়ে ওমরের নিকট অনুযোগ করেছিলেন, তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে। কিন্তু খালিদের মদীনায় এসে ওমরের নিকট ব্যক্তিগতভাবে অনুযোগ তোলার কথায় অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তবে এ বিষয়ে সকলে একমত যে, খালিদ লিখিত অনুযোগ জানিয়েছিলেন এবং অঙ্গীকারও করেছিলেন যে, তাঁর ব্যক্তিগত তহবিলে ষাট হাজার দিরহামের বেশি থাকা প্রমাণিত হলে তিনি অতিরিক্ত অর্থ সরকারী তহবিলে জমা দিবেন। তার পর খালিদের সম্পত্তির হিসেব ধরা হয়, এবং অতিরিক্ত হিসেবে বিশ হাজার দিরহাম সরকারী খাজাঞ্চিখানায় জমা দেওয়া হয়। অতঃপর ওমর খালিদকে জানান, আল্লাহ্র কসম! আমি আপনাকে ভালবাসি এবং সম্মান করি। তারপর খলিফা প্রাদেশিক শাসকদেরকে জানান যে, তিনি খালিদকে বিশ্বাসভঙ্গের দোষে বা অন্য কোনও অপরাধে পদচ্যুত করেন নি। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, জনসাধারণ খালিদের শক্তিমত্তার প্রতি একটু বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে এ আস্থাবান হচ্ছে। এজন্যে তিনি খালিদকে পদচ্যুত করাই সমীচীন বিবেচনা করেন, যাতে খালিদ-ভক্তরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে যে, সবকিছুই আল্লাহ্র ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল এবং কোনও মানুষই অত্যাজ্য বা অপরিহার্য নয়।
এসব বিবরণী থেকে এ ধারণা করা অন্যায় হবে না যে, খালিদের পদচ্যুতিতে কোন ব্যক্তিগত রেষারেষি বা ভালো লাগা-না-লাগার প্রশ্ন ছিল না। ইসলামের শিক্ষার আদর্শিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।
আঠারো হিজরী (৬৩৯ খ্রি.) ছিল ইসলামের দুঃসময়। শত্রুপক্ষের আক্রমণে কোন যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, এক ভীষণ মহামারীর আক্রমণে আমওয়াসের সেনানিবাস প্রায় উজার হয়ে যায় এবং ইসলামের কয়েকটি বিরাট ব্যক্তিত্বেরও অবসান হয়। সিরিয়া, মিসর ও ইরাকের কয়েক স্থানে এই মহামারী আক্রমণ করে, কিন্তু সবচেয়ে তীব্র আক্রমণই ছিল আমওয়াসে। ওমর সংবাদ শ্রবণ করেই স্বয়ং উপদ্রুত অঞ্চলে যাত্রা করেন এবং মুহাজেরীন ও আনসারদের পরামর্শ গ্রহণ করেন, কী ভাবে এ মহামারী বন্ধ করা যায়। অনেকেই বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করলো, কিন্তু সকলেই একবাক্যে উপদেশ দেয়, খলিফার সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। ওমর এ-যুক্তির সারবত্ত উপলব্ধি করেন, এবং স্থির করেন পরদিনই স্থান ত্যাগ করবেন। আবুওবায়দাহ্ ছিলেন চরম অদৃষ্টবাদী তিনি ওমরকে তিরস্কার করে বললেন: আল্লাহর ইচ্ছা থেকে তুমি পালিয়ে যাচ্ছো? চরম প্রশান্তিতে ওমর এ তিরস্কার হজম করে শুধু বললেন: হাঁ আমি আল্লাহ্র ইচ্ছা থেকে পলায়ন করছি কিন্তু তাঁর ইচ্ছার দিকেই যাচ্ছি।
মদীনায় ফিরে এসেই ওমর আবুওবায়দাকে পত্র দিলেন, অবিলম্বে মদীনায় এসে শাসন-সংক্রান্ত আলোচনা করতে। কিন্তু আবুওবায়দাহ্ বুঝলেন এ শুধু তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়ার কৌশল মাত্র। তিনি প্রত্যুত্তরে জানালেন, যেখানে তাঁর সঙ্গীরা অহরহ মরছে, সে স্থান ত্যাগ করতে তিনি পারেন না। ওমর এ পত্র পেয়ে ক্রন্দন করেন ও পুনরায় আবুওবায়দাকে মিনতি জানান, অন্তত স্যাঁতসেঁতে নিচু স্থান ত্যাগ করে উঁচু স্বাস্থ্যকর স্থানে যাওয়া উচিত। আবুওবায়দাহ্ এ যুক্তি গ্রহণ করে জাবিয়ায় গমন করেন। কিন্তু মহামারী তাঁকে সেখানেও আক্রমণ করে। জীবন-প্রদীপ শেষ হয়ে আসছে বুঝে তিনি মুয়ায বিন্ জাবালকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেন। শীঘ্রই তাঁর জীবনে কুসুম ঝরে গেল। আমর-বিন-আস্ সকলকে উপদেশ দেন, এ ভীষণ মহামারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে সকলেরই স্থান ত্যাগ করা উচিত। মুয়ায এ-কথা শুনে মিম্বরে উঠে এক ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে বললেন, এ মহামারী আল্লাহ্র গযব নয়, রহমতস্বরূপ। জীবন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন তিনি আসেন এমনই করুণাধারায়। বক্তৃতা শেষ করে নিজের তাঁবুতে ফিরে মুয়ায দেখেন একমাত্র পুত্র মহামারী কবলে। পুত্রকে আশ্বাস দিলেন, কোরআনে বর্ণিত হযরত ইব্রাহিমের এই বাণী দিয়ে: বৎস! এ আল্লাহর দান, তোমার বুকে যেন কোন শঙ্কা না জানে। পুত্রকে ইসমাইলের বাণী উচ্চারণ করলেন : যদি তাই আল্লাহ্র ইচ্ছা হয়, আপনি আমাকে সে ইচ্ছায় সমর্পিত দেখবেন। কিছুক্ষণ পরে পুত্র শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মুয়ায পুত্রকে সমাহিত করে নিজে আক্রান্ত হন এবং আমরকে স্থলাভিষিক্ত করে হাসিমুখে মরণ বরণ করেন এ মহৎ ধারণা নিয়ে যে, এ জীবন শুধু আল্লাহ্ দিদার লাভের পথে একটা মিথ্যা যবনিকা মাত্ৰ।
ধর্মের নামে কী অদ্ভূত, অপূর্ব উন্মাদনা হাজার হাজার মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে অসহায় প্রাণীর মতো মৃত্যুর হাতে কবলিত হচ্ছে, অথচ এ মড়ক নিবারণের কোনও স্বাস্থ্যকর পন্থা অবলম্বন না করে তাকে আল্লাহ্র রহমত হিসেবে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে। আমর-বিন-আস্ ছিলেন যুক্তিবাদী মানুষ, তিনি মহামারীর আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে পার্বত্য অঞ্চলের স্নিগ্ধ ও স্বাস্থ্যপ্রদ স্থানে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন। তবুও তাঁকে ভীরু ও মিথ্যুক অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন নি। অবশ্য এ শুভ ব্যবস্থা গৃহীত হয় পঁচিশ হাজার মুসলিম সেনা অকালে মাটির নিচে আশ্রয় লাভ করলে পর। স্মরণীয় যে কাদিসিয়া বা ইয়ারমুকের যুদ্ধেও এতো অধিক সংখ্যক সৈন্য নিহত হয় নি এবং এই বলিষ্ঠ সেনাবাহিনীর বাহুবলে তৎকালীন জ্ঞাত পৃথিবীর অর্ধাংশ জয় করা সহজ কর্ম হতো।
এই ভীষণ মড়কের আঘাতে মুসলিম বাহিনীর অগ্রগতি সাময়িকভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার বালক-বালিকা এতিম হয়ে পড়ে, শত শত রমণী বিধবা হয়ে যায়। তাদের সুব্যবস্থার জন্যে ওমর এল্লায় আগমন করেন আলীকে মদিনায় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে। এ সময় তিনি গোলামের সঙ্গে নিজের বাহনটি পরিবর্তন করেন ও নিজে সাধারণ সেবকের বেশে এল্লায় উপস্থিত হন। এখানের পুরোহিতকে দিয়ে নিজের জীর্ণ জামাতে তালি বসিয়ে নেন এবং পুরোহিত কর্তৃক উপহার দেওয়া নতুন জামাটি নম্রভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এখান থেকে তিনি দামেশকে গমন করেন এবং সেখানে তিন চার দিন অবস্থানের পর সিরিয়ার আরও কয়েকটি শহর সফর করে কার্যাদির সুব্যবস্থা করেন।
এই বছরেই সারা আরবব্যাপী দারুণ দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। কিন্তু ওমর রিলিফ বা সাহায্যদানের এমন সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন যে, হাজার হাজার লোক অনাহারে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায়। এই সময়েই তিনি আনসার ও মুহাজেরীন এবং কয়েকটি আরব গোত্রের জন্য নিয়মিত মাসোহারার ব্যবস্থা করেন।
সিরিয়া বিজয়ের শেষ হয় সীজারিয়া বা কায়সরীয়ার পতনে। ভূমধ্যসাগরের উপকূলে উপস্থিত প্যালেস্টাইন প্রদেশের এটি একটি প্রাচীন ও উন্নত শহর ছিল। বালাজুরীর বর্ণনামতে সীজারিয়ার প্রায় তিনশত জনাকীর্ণ প্রশস্ত রাস্তা ছিল। আমর বিন্ আতের হিজরীতে শহরটি অবরোধ করেন। কিন্তু বহুদিন অবরুদ্ধ থেকেও তখন শহরটি আত্মসমর্পণ করে নি। আবুওবায়দার মৃত্যুর পর ওমর ইয়াজিদ্-বিন্- সুফিয়ানকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করেন ও সীজারিয়া অধিকার করতে নির্দেশ দেন। ইয়াজিদ সতেরো হাজার সৈন্য নিয়ে সীজারিয়া অবরোধ করেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি ভ্রাতা আমীর মুআবিয়াকে কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত করে দামে প্রত্যাগমন করেন ও মৃত্যু আলিঙ্গন করেন। মু’আবীয়া বারে বারে শহরটি আক্রমণ করেও অকৃতকার্য হন। শেষে ইউসুফ নামক একজন ইহুদী একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ দেখিয়ে শহরে প্রবেশের সুবিধা করে দেয়। তখন সহজেই শহরের প্রধান দ্বারটি খুলে ফেলা হয় এবং মুসলিম সৈন্যরা অবাধে শহরে প্রবেশ করে, প্রায় আট হাজার খ্রিস্টান সৈন্য নিহত হওয়ার পর শহরটি সম্পূর্ণরূপে অধিকৃত হয়। অতঃপর সিরিয়া-দিগন্তের সব বিপক্ষশক্তি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং সিরিয়া পূর্ণভাবে আরব সাম্রাজ্যের এলাকাভুক্ত হয়।