ইরাক-আরব বিজয় (প্রথম পর্যায়)
পারস্য-সাম্রাজ্যের চতুর্থ যুগে সাসানীর বংশ রাজত্ব করতো। এ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাটের ন্যায়পরায়ণ নওশেরওয়া। এ যুগটাই ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের সোনালী যুগ। নওসেরওয়ার পৌত্র পারভেজ ছিলেন রসূলে আকরমের সময় পারস্যের সিংহাসনে সমাসীন; পূর্বেই উক্ত হয়েছে যে, রসূলে-আকরম পারভেজকে ইসলামে আহ্বান করে লিপি প্রেরণ করেন, কিন্তু পারভেজ উদ্ধতভাবে তাঁকে বন্দী করতে হুকুমজারী করেন। কিন্তু সে হুকুম কার্যকরী হওয়ার পূর্বেই পারভেজকে পরলোকযাত্রা করতে হয়। তারপর খসরু বা পারস্য সম্রাটের সিংহাসন নিয়ে তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে রক্তলীলা চলতে থাকে। এ রক্তলীলার শেষ অঙ্কে দেখা গেল, সাত বছরের শিশু ইয়েদর্গিদ ব্যতীত রাজবংশে কোনও পুরুষ জীবিত নেই। অগত্যা বুরান্দুখত নামে এক রমণীকে রাজসিংহাসনে বসানো হয় এই শর্তে যে, ইয়েদর্গিদ বয়ঃপ্রাপ্ত হলেই তাঁকে সিংহাসন ফিরিয়ে দিতে হবে। সিংহাসন নিয়ে এই কাড়াকাড়ি অবশ্যাম্ভাবী ফলস্বরূপ সারা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়। অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে ইরাকের ‘ওয়াইল’ নামীয় আরব- গোত্রের দুই সরদার মুসান্না সায়বাণী ও সুয়াইদ আজলী বিদ্রোহ করেন ও আশপাশে লুটতরাজ চালাতে থাকেন।
ঠিক এই সময় খলিফা আবুবকরের নির্দেশে খালিদ ইবনে-ওলিদ ইমামাহ্ ও অন্যান্য আরব-গোত্রের বিরুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। মুসান্না সুযোগ বুঝে আবুবকরের নিকট উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করলেন, ইরাক আক্রমণ করতে। প্রার্থনা মঞ্জুর হলো। মুসান্না পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। এখন নিজের সমস্ত গোত্রকে ইসলাম কবুল করিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ইরাক অভিযান করেন। আবুবকর তাঁর সাহায্যে খালিদকে প্রেরণ করেন। তাঁদের সম্মিলিত শক্তির সম্মুখে ইরাকের সীমান্তবর্তী নগরসমূহ একের পর এক লুণ্ঠিত হতে লাগলো এবং হিরাহ্ পর্যন্ত অধিকৃত হলো। হিরাহ্ বিজয়কে বলা যায় পারসিক গাছের প্রথম আপেল আহরণ। খালিদের অনন্যসাধারণ রণকুশলতায় হয়তো ইরাক বিজয়-পর্ব শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এই সময় সিরীয় যুদ্ধাঙ্গনে মুসলিমরা বড়ো বেকায়দায় পড়ে যায়। বাধ্য হয়ে আবুবকরকে তখনই আদেশ পাঠাতে হয়, খালিদ অবিলম্বে মুসান্নার হাতে ইরাকের সব ভার অর্পণ করে সিরিয়ায় গমন করবেন (রবিউস্সানি ১৩ হিজরী, ৬৩৪ খ্রি.)। তার প্রায় দুই মাস পরেই আবুবকর ইন্তিকাল করেন।
খেলাফতের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করেই ওমরের প্রথম লক্ষ্য হলো ইরাক অভিযান জোরদার করা। তিনি জনগণ সমক্ষে ওজস্বিনী ভাষায় প্রচার করতে লাগলেন। প্রথমে তেমন সাড়া জাগে নি। কিন্তু দিনের পর দিন ধরে বক্তৃতা করে শেষের দিকে ওমর জনগণের উৎসাহ জাগিয়ে তোলেন। এই সময় মুসান্নার এ যুক্তিও বাস্তবভাবে কার্যকরী হলো: আমি এই অগ্নিপূজকদের সাহসিকতা প্রত্যক্ষভাবে যাচাই করে দেখেছি, তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ পটু নয়। আমরা ইতিমধ্যেই ইরাকের বহু শহর দখল করে ফেলেছি, পারসিকরা আমাদের শক্তিমত্তায় নিকট হার মেনেছে। তাঁর এই কথায় সাকিফ গোত্রের নেতা আবুওবায়দাহ্ আবেগপূর্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠেন, আমি কার্যভার গ্রহণ করলেম। জনগণও কলরব করে উঠলো, আমরাও প্রস্তুত আছি। ওমর দশ হাজার সৈন্যের বাহিনী সংগ্রহ করে আবু ওবায়দাকে সিপাহসালার নিযুক্ত করলেন। আবুওবায়দাহ্ আঁ-হযরতের সাহাবা ছিলেন না। এজন্যে তাঁর নিয়োগে কিছুটা প্রতিবাদ ওঠে এবং একজন বলেই ফেলেন: হে ওমর! সাহাবাদের মধ্য থেকেই এ নিয়োগ করা উচিত। সেনাদলে অসংখ্য সাহাবা আছেন, অতএব সিপাহসালার একজন সাহাবাই হওয়া উচিত। কিন্তু ওমর রূঢ় কণ্ঠে বললেন: আপনারা এ মর্যাদা সাহস ও ধৈর্যের গুণে অর্জন করেছিলেন, কিন্তু নিজ দোষে সে মর্যাদা হারিয়েছেন। যুদ্ধে যাদের উৎসাহ জাগে না, যুদ্ধনেতৃত্ব তাদের সাজে না। ওমর অবশ্য আবু ওবায়দাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সাহাবাদের যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে এবং প্রতি কর্মে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করতে।
এদিকে পারস্য-সম্রাজ্ঞী বুরান্দুখত ও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। খোরাসানের শাসক রুস্তম ছিলেন একজন জবরদস্ত বীর ও ঝানু কূটনৈতিক। তাঁকে তলব করে বুরান্দুখত সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়ে সিপাহসালার নিযুক্ত করলেন, তার মস্তকে পারসিক রাজমুকুট বসালেন এবং সর্বশ্রেণীর কর্মচারীদের আদেশ দিলেন রুস্তমের নির্দেশ বিনা প্রতিবাদে পালন করতে। রুস্তম ইরাকের প্রত্যেক অংশে প্রচারক প্রেরণ করে জনগণকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলেন ধর্মের দোহাই দিয়ে। সারাদেশে যেন আগুন জ্বলে উঠলো এবং মুসলিম-অধিকৃত অঞ্চলসমূহেও জনগণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। বুরান্দুত নয়া একদল সেনাবাহিনী গঠন করলেন এবং নরসী ও জাপান নামক দুজন শ্রেষ্ঠ বীর প্রেরণ করলেন রুস্তমের সাহায্যার্থে।
আবু ওবায়দাহ্ সৈন্যসহ অগ্রসর হয়ে নমারক নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এখানে উভয়পক্ষে অস্ত্র-পরীক্ষা হয়। পারসিকদের বিখ্যাত বীর মরদান শাহ্ নিহত হন এবং জাপান মুসলিমদের হাতে বন্দী হন। কিন্তু যে সৈন্যটি তাঁকে বন্দী করে সে তাঁর পরিচয় না জানায় মুক্তি-মূল্য নিয়ে তাঁকে মুক্তি দেয়। পরে এ কথা প্রকাশ হলে অনেকে এরূপ দুর্ধর্ষ শত্রুর মুক্তিতে আপত্তি তোলে, কিন্তু আবুওবায়দাহ্ তাদের নিরস্ত্র করে বলেন যে ইসলামের প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করা বে-আইনী।
অতঃপর আবু ওবায়দাহ্ সম্মুখে অগ্রসর হয়ে সাকাতিয়াহ্ নামক স্থানে নরসীর সঙ্গে মোকাবিলা করেন। এখানে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে নরসী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হন। আবু ওবায়দাহ্ চারদিকে সৈন্য প্রেরণ করে পারসিকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন।
মুসলিমদের সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় এমন ভাগ্য-বিপর্যয়ের সংবাদ শ্রবণ করে রুস্তম চার হাজার সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী প্রেরণ করেন প্রবীণ ও মহাবীর বামন শাহের নেতৃত্বে। বামন শাহ ফোরাত নদীর পূর্বতীরে মারওয়াহ্ নামক স্থানে সৈন্যবিন্যাস করেন। মুসলিম বাহিনীর শিবির ছিল নদীর অপর তীরে। বামন শাহ মুসলিমদের আহ্বান করলেন, নদী অতিক্রম করে আক্রমণ করতে, অন্যথায় তিনিই নদী অতিক্রম করবেন। অসমসাহসিক আবুওবায়দাহ্ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বীরত্বের প্রতিযোগিতা করতে যেয়ে নদী পার হয়ে যুদ্ধ করতে আদেশ দিলেন। মুসান্না, সুলাইত ও অন্যান্য রণকুশলী সেনানী এরূপ হঠকারিতা না করতে ও নদী পার না হওয়ার পক্ষে অনেক যুক্তি দেখালেন। কিন্তু তাঁদের কোনও যুক্তি টিকলো না, সিপাহসালার আবুওবায়দার হুকুমই কার্যকরী হলো। নদী পার হয়ে মুসলিমরা দেখলো, জায়গাটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ ও অসমতল এবং যুদ্ধার্থে সৈন্যবিন্যাসের পক্ষে খুবই অনুপযোগী।
পারস্য-সেনা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল এবং নিজেদের মনোনীত ক্ষেত্রে যুদ্ধের সুযোগ পেয়ে মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের হস্তীগুলি কালো পর্বতের মতো বিচরণ করতে লাগলো এবং অশ্বারোহী লৌহবর্মে সজ্জিত সেনাবাহিনী কালান্তকসদৃশ বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলো। আবুওবায়দাহ্ হস্তীযূথ দ্বারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আদেশ দিলেন, ব্যূহ রচনা করে হস্তীযূথকে বন্দী করতে এবং হাওদাসমেত আরোহীদেরকে ভূতলশায়ী করতে। কিন্তু এ উপায়েও কোন ফল হলো না, কারণ মদমত্ত হস্তীথ যেদিকেই যায়, সেদিকেই অসংখ্য মুসলিম সেনা পদ-পিষ্ট হতে থাকে। তখন আবুওবায়দাহ্ আদেশ দিলেন হস্তীদের শুন্ড কর্তন করে নিধন করতে। তিনি নিজেই একটি শ্বেতহস্তীর শুন্ড কর্তন করতে ধাবিত হলেন, কিন্তু দুর্দান্ত পশুটিকে আয়ত্তে আনার পূর্বে সেটি তাঁকে শুন্ড দ্বারা ধরে ফেলে ও পদতলে পিষ্ট করে নিহত করে।
সিপাহসালার আবুওবায়দার মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা হাকাম এবং পরপর সাতজন আত্মীয় হস্তীযুথের পদতলে শহীদ হন। শেষে মুসান্না পতাকা নিয়ে অগ্রসর হলেন। কিন্তু তখন যুদ্ধের গতি মুসলিমদের বিপক্ষে গেছে এবং তারা পলায়নপর হয়েছে। বিপদের মাত্রা আরও ঘনীভূত করতে একজন সেতুটিও ধ্বংস করে দিল এবং পলায়নের পথও বন্ধ হয়ে গেল। অনেকে পানিতে ঝাঁপ দিল। মুসান্না অতি কষ্টে সেতুটি পুনরায় স্থাপন করলেন এবং একদল অশ্বারোহীর বেষ্টনী করে সেতু পারাপারে সুযোগ সৃষ্টি করলেন। তবু যুদ্ধ শেষে গণনায় দেখা গেল, নয় হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র তিন হাজার জীবিত, বাকি সমস্তই শহীদ।
ইসলামের ইতিহাসে এরূপ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের কাহিনী অত্যন্ত বিরল। যখন এই ভাগ্য-বিপর্যয়ের কাহিনী মদিনায় পৌঁছে, তখন ঘরে ঘরে ক্রন্দনের রোল ওঠে। ওমর প্রতি ঘরে-ঘরে শোকার্তকে সান্ত্বনা ও পলায়িত সৈন্যকে সমবেদনা জানান।
সেতুর যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ে ওমর মর্মাঘাত পেলেন, কিন্তু হতোদম্য হন নি। তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সর্বাত্মকভাবে সমরায়োজন করতে লাগলেন, দুশমনকে পুনরায় আক্রমণ করতে। আরবের প্রতি অঞ্চলে প্রচারক পাঠানো হলো, অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে জনগণ-মন উদ্দীপিত ও উৎসাহিত করে তুলতে। সারা আরবে সাড়া পড়ে গেল, ধর্মের ডাকে দেশের ডাকে প্রাণপণ করতে। দলে দলে গোত্রের পর গোত্র জমায়েত হতে লাগলো আরবের প্রতিটি অংশ থেকে। আজ্দ গোত্রপতি মক্নাফ ইবনে-সালিম এলেন, বানু তাসিমদের নায়ক হাসিন-বিন-মবিন এলেন, হাতেম তাই এর পুত্র আদি এলেন বিশাল বাহিনী নিয়ে আরও এলো রবাব, বানু কিনানাহ্ কাসাম, বানু হাজালাহ্ ও বানু দব্বাহ্ গোত্রগুলি নিজ নিজ প্রধানদের অধীনে যুদ্ধ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে। এমনকি নমর ও তগলিব নামক খ্রিস্টান গোত্র দুটিও নিজেদের দলপতির অধীনে যুদ্ধার্থে সজ্জিত হয়ে ওমরের নিকট দাবী জানালো, পারস্যের সঙ্গে আরবের এই জাতীয় মোকাবিলায় শরীক হতে। জরীর বজলী নামক বিখ্যাত আরব-বীরও উপস্থিত হলেন তাঁর গোত্রীয়দের একত্র করে। ওদিকে মুসান্নাও ইরাকের সীমান্তবর্তী জিলাসমূহে প্রচারক প্রেরণ করে বাসিন্দাদেরকে পারস্য-বিদ্বেষী করে তুলেছিলেন।
মুসলিমদের সমর প্রস্তুতির সংবাদ গুপ্তচরগণ যথাযথভাবে পারস্য-দরবারে প্রেরণ করতো। বুরাদুত রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনী থেকে বারো হাজার সৈন্য বাছাই করে মেহরানের অধিনায়কত্বে অর্পণ করলেন। মেহরান বাল্যে আরবে লালিত হয়েছিলেন; তার দরুন আরব রীতি-নীতি ও বলবীর্যের সম্যক অনুধাবনশক্তি থাকায় তাঁর অধিনায়কতায় জয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত এ চিন্তাই বুরান্দুতের মাথায় উদয় হয়েছিল।
মুসলিম বাহিনী কুফার অনতিদূরে ফোরাত কূলবর্তী বুয়ায়েব নামক প্রান্তরে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলো। মুসান্না সুশৃঙ্খলভাবে সৈন্য সন্নিবেশিত করলেন। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম বাহিনী সুদক্ষ সেনানায়কদের অধীনে সজ্জিত হলো। পারসিক বাহিনী মেহরানের অধীনে রাজধানী থেকে যাত্রা করে বুয়ায়েবে উপস্থিত হলো ফোরাতের অপর তীরে এবং পরদিন প্রত্যুষে নদী পার হয়ে সমরসজ্জায় সজ্জিত হয়ে গেল।
‘আল্লাহু আকবর’-রবে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ আরম্ভ করলো। পারসিক বাহিনী বজ্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসলিমদের উপর। অস্ত্রে অস্ত্রে সংঘাত, তীরের শনশন আওয়াজে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। তীব্র তেজে মুসান্না শত্রু পক্ষের ব্যুহের কেন্দ্ৰ মধ্যে উপস্থিত হলেন। পারসিকরা আক্রমণের তীব্রতায় টলমল করে উঠলো, কিন্তু শীঘ্রই সাহস সঞ্চয় করে দ্বিগুণ তেজে যুদ্ধ করতে লাগলো। এক সময় মুসলিম পক্ষে দৃঢ়তার অভাব দেখা গেল। কিন্তু মুসান্না বীরের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন: হে মুসলিমগণ! কোথায় যাও তোমরা? আমি এখানে। এ উৎসাহবাণীতে মুসলিমরা একত্র হয়ে নতুন বিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলো। মুসান্নার ভাই মাসুদ সহসা মারাত্মক আঘাতে ভূপাতিত হলেন। কিন্তু মুসান্না চিৎকার করে উঠলেন: হে মুসলিমগণ! আমার ভাইয়ের মৃত্যুতে কিছু পরোয়া করো না। বীরের মৃত্যু এভাবেই হয়। নিশান ঊর্ধ্বে তোলো। মুমূর্ষু মাসুদও চিৎকার করলেন: আমার মৃত্যুতে তোমরা হতোদ্যম হয়ো না। মুসলিম পক্ষের অন্যতম খ্রিস্টান সেনানায়ক আসান-বিন-হিলালও অঘাতে ধরাশায়ী হলেন। মুসান্না অশ্ব থেকে নেমে তাঁকে কোলে তুলে নিয়ে মাসুদের পাশে শুইয়ে দিলেন। জাতীয় স্বার্থের মহাসঙ্কটকালে ধর্মীয় ভেদ জ্ঞান কোথায় বিলীন হয়ে গেল। আরও অনেক মুসলিম সেনানায়ক মৃত্যু আলিঙ্গন করলেন। কিন্তু মুসান্নার দৃঢ়তা ও রণকৌশল যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিল মুসলিমদের পক্ষে। পারসিক বাহিনীর কেন্দ্রব্যুহ বিধ্বস্ত হয়ে গেল। তাদের বিখ্যাত বীর শাহবাজ ধরাশায়ী হলেন। মেহরান পূর্ণ বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে একজন তাগলিব যোদ্ধার হাতে নিহত হলেন। তাঁর মৃত্যুতে যুদ্ধের গতি সহসা থেমে গেল। পারসিকরা পাগলের মতো বিশৃঙ্খলভাবে পলায়নপর হলো। মুসান্না ক্ষিপ্রগতিতে সেতুমুখ বন্ধ করে দিলেন। তখন পারসিকগণ অস্ত্রমুখে প্রাণ দিতে লাগলো। ঐতিহাসিকগণ বলেন, পরবর্তীকালে বুয়ায়ের প্রান্তরে শুধু মানবাস্থির শ্বেতস্তূপ লক্ষিত হতো। এ যুদ্ধের সবচেয়ে স্থায়ী লক্ষণ এই যে আরবীদের নৈতিক বল সহস্র গুণে বেড়ে গেল। পারস্য সাম্রাজ্যের বিভীষিকা তাদের মন থেকে অন্তর্হিত হলো এবং খসরু সাম্রাজ্যের শেষদিনও তাদের গণনার বিষয় হয়ে উঠলো। যুদ্ধশেষে মুসলিমরা সারা ইরাকে ছড়িয়ে পড়ে।
সে সময়ে বর্তমান বাগদাদ নগরীর সন্নিহিত অঞ্চলে এক বিরাট মেলা বসেছিল। মুসান্না সৈন্যসহ মেলায় উপস্থিত হলে পণ্য বিক্রেতার ভয়ে পলায়ন করে এবং বহু মালামাল মুসলিমদের হস্তগত হয়। এই চরম পরাজয় বার্তা পারস্য দরবারে উপস্থিত হলে সকলেই হতাশ স্বরে একবাক্যে বলে উঠে; রমণীর শাসন আমলে এবং বিভেদ ও বিশৃঙ্খলার পরিণতি আর কি হতে পারে? বুরান্দুখ্ত অচিরেই সিংহাসনচ্যুত হলেন এবং ষোড়শ বর্ষীয় ইয়েজদি সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তাঁর অভিষেকে সাড়া সাম্রাজ্যে নব জীবনের সাড়া পড়ে গেল। নয়া উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে লাগলো, মরুচারী যাযাবর আরবীদেরকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। সব কিল্লা ও সমর ঘাঁটি সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করা হলো, ঘরে ঘরে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা বসে গেল। সাম্রাজ্যের দুই স্তম্ভ রুস্তম ও ফিরোজ ব্যক্তিগত বিরোধ ভুলে এ মহাসমর প্রস্তুতিতে মিলিত শক্তি নিয়োগ করলেন।
ওমরের নিকট পারসিকদের এসব প্রস্তুতির সংবাদ যথাযথ পৌঁছে গেল। তিনি প্রথমে মুসান্নাকে নির্দেশ দিলেন, সমস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্র করে আরবের সীমান্ত প্রদেশ কুক্ষিগত করে রাখতে ও সৈন্যসহ অভিযানের জন্যে প্রস্তুত থাকতে। এদিকে সারা আরবদেশ আলোড়িত করে ওমর সমরপ্রস্তুতি চালাতে লাগলেন। দিকে দিকে প্রচারকেরা ধাবিত হলো প্রতি অঞ্চল মথিত করে যত যোদ্ধা, সরদার কুটনীতিবিদ, কবি, বক্তা ও রাজনীতি-বিশারদ আছেন, সকলকে খলিফার দরবারে উপস্থিত করতে দলে দলে আরব গোত্রসমূহ জমায়েত হতে লাগলো। সা’দ-বিন ওক্কাস উপস্থিত হলেন নিজ গোত্রের তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে। হাদ্রামৌত, সদফ, ঘহজ্, কয়েস ও ইলান গোত্রের নেতাগণ উপস্থিত হলেন প্রত্যেকে বিশাল বাহিনী নিয়ে। তাছাড়াও ইয়ামনের গোত্রগুলি এক হাজার, বানু তামিম গোত্র চার হাজার ও বানু-আসাদ গো তিন হাজার সৈন্যসহ উপস্থিত হলো।
ওমর মক্কা থেকে হজ পালন করে মদিনায় ফিরে দেখলেন, শহরের আশপাশ শুধু সংখ্যাহীন সৈন্যে ছেয়ে গেছে। ওমর এই বিশাল বাহিনী একত্র করে নিজেই পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। আলীকে নিজের স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে ওমর ইরাকের দিকে অগ্রসর হলেন। বিশাল বাহিনী তিনটি প্রধান দলে বিভক্ত হলো-সম্মুখ ভাগের অধিনায়ক হলেন তালহা, জোবায়ের পেলেন দক্ষিণ বাহুর ও আবদুর রহমান-বিন-আউফ-পেলেন বাম বাহুর ভার। মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে সরার নামক ঝর্নার পাশে শিবির স্থাপিত হলো। এখানে ওমর একটা সমর-পরিষদ গঠন করলেন, আমীরুল মুমেনীন হিসাবে তাঁর স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া সমীচীন কি না, এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে। সাধারণ বাহিনী দাবী করলো, যুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমীরুল মুমেনীনকে নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রবীণ সাহাবাগণ অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে পরামর্শ দিলেন, খলিফার যুদ্ধ ক্ষেত্রে না যাওয়াই যুক্তিযুক্ত। তখন আলীকে নেতৃত্ব করতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তিনি অস্বীকৃত হন। শেষে সা’দ-বিন-ওক্কাসই সিপাহসালার নির্বাচিত হলেন। তিনি ছিলেন রসূলে-করিমের মাতুল ও বিশিষ্ট সাহাবা। ওমর সা’দের মনোনয়ন গ্রহণ করলেন। কিন্তু সা’দের রণপটুতা ও রণকুশলতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ না হয়ে তিনি অভিযান-নিয়ন্ত্রণের সর্ববিধ ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখেন। বাহিনীর অগ্রগতি, যুদ্ধকালে সেনাসন্নিবেশ, আক্রমণের কৌশল নির্দেশ প্রভৃতি যুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সর্বস্তরের পরিচালনভার তাঁরই দায়িত্বে রইল। তাঁর নির্দেশ ব্যতীত যুদ্ধসংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের মীমাংসা করা হতো না, এমনকি মদিনা থেকে ইরাক পর্যন্ত সমস্ত পথে গতিবিধি বা ছাউনি ফেলার স্থানও তিনি বাছাই করে দিতেন 1
সা’দ-বিন-ওক্কাস মদিনা থেকে যাত্রা করে প্রথম ছাউনি ফেলেন সালাবা নামক স্থানে। এখানে মেলার পর্যাপ্ত জিনিসপত্র ও প্রচুর পানি সরবরাহ বিশাল বাহিনীর কষ্ট লাঘব করে। সা’দ এখানে প্রায় তিনমাসকাল অবস্থান করেন। এই সময় মুসান্না প্ৰায় আট হাজার সৈন্য নিয়ে ধিকার নামক স্থানে সা’দের মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু বুয়ায়েবের যুদ্ধে তিনি যে গুরুতর আঘাত পান, তাই প্রাণঘাতী হয়ে অকালে তাঁর জীবননাশ করে।
সালাবা থেকে যাত্রা করে সা’দ শরফ নামক স্থানে ছাউনি ফেলেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি ওমরের নিকট থেকে যুদ্ধকালে সৈন্য-বিন্যাসের ও যুদ্ধকৌশল সম্বন্ধে বিস্তৃত নির্দেশ প্রাপ্ত হন। মোট ত্রিশ হাজার সৈন্য ছিল তাঁর বাহিনীতে। তাদেরকে তিনি সাতটি দলে বিভক্ত করে এক একজন সুদক্ষ সেনানায়কের দায়িত্বে ন্যস্ত করেন। উল্লেখযোগ্য যে মশহুর ইরানী সাহাবা সমান ফারসী রসদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত হন। বদর যুদ্ধে যোগদানকারী সত্তরজন সাহাবা এবং মক্কা বিজয়ে অংশীদার বহুলোক ও সেনাবাহিনীতে উপস্থিত ছিলেন।
শরফে অবস্থানকালেই সা’দ নির্দেশ পান, কাদিসিয়ার প্রান্তের পারসিকদের মুকাবিলা করতে। এই ছোট্ট শহরটি কুফা থেকে ত্রিশ মাইল দূরে ছিল। উহা বেশ উর্বরা ও সম্পদময়ী এবং খাল-সেতু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিরাপদ স্থান ছিল। প্রাক-ইসলাম যুগে ওমর বহুবার এদিকে সফর করেছিলেন। এজন্যে স্থানটির অবস্থান, বিস্তার ও যুদ্ধকৌশলের সুবিধাদি সম্বন্ধে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন। সা’দের উপর নির্দেশ ছিল কাদিসিয়ার বর্তমান অবস্থার সামগ্রিক বিবরণ ও ভৌগোলিক বৃত্তান্তসহ একটি নকশা প্রস্তুত করে ওমরের নিকট প্রেরণ করতে। তিনি নির্দেশমতো সমস্ত জ্ঞাতব্য বিষয় প্রেরণ করেন।
শরফ থেকে ছাউনি তুলে সা’দ খাদিব স্থানে উপস্থিত হন। এখানে অবস্থিত পারসিকদের অস্ত্রাগার ও যুদ্ধের মালখানা বিনা আয়াসে মুসলিমরা দখল করে। সা’দ প্রত্যেক দিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে শত্রুদের সংবাদ গ্রহণ করেন ও অবগত হন, পারসিকদের সিপাহসালার রুস্তম স্বয়ং রাজধানী মাদায়েন থেকে অগ্রসর হয়ে সাবাতে অবস্থান করছেন। এ সংবাদ ওমরকে পাঠানো হলে নির্দেশ এলো, যুদ্ধারম্ভের পূর্বে দূত পাঠিয়ে পারস্যরাজকে ইসলামে আহ্বান করা উচিত। সা’দ আরব-গোত্রসমূহের দলপতিদের থেকে গুণে ও মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ চৌদ্দজনকে নির্বাচন করে নুমান বিন-মাকরানের নেতৃত্বে পারস্য-সম্রাটের নিকট প্রেরণ করলেন।
নওসেরওয়ার আমল ডেকে মাদায়েন ছিল পারস্যের রাজধানী। সমকালীন শ্রেষ্ঠ নগরী শোভা-সম্পদময়ী মাদায়েন ছিল কাদিসিয়া থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে। আরব দূতগণ সুদর্শন অশ্বপৃষ্ঠে নির্ভয়ে পারস্য-রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হলেন। ইয়েৰ্গিদ্ সুসজ্জিত জাঁকজমক ভরা বিশ্ববিশ্রুত রাজদরবারে দূতগণকে গ্রহণ করলেন। প্রাথমিক আলাপের পর ইয়েদি আরব দূতগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর রাজ্যে আগমনের হেতু কি? দূতপ্রধান নুমান ইসলামের মহিমা কীর্তন করে জানালেন, ইসলামের প্রচারই তাঁদের উদ্দেশ্য; পারসিকরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে, কিংবা জিয়া কর দিয়ে মুসলিমদের আশ্রয়ে আসতে পারে, অন্যথায় অস্ত্রই এ বিরোধের মীমাংসা করবে।
ইয়েৰ্গিদ্ উষ্মামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন : তোমরা কি করে ভুলে গেলে, তোমরাই ছিলে দুনিয়ার দীনতম ও ঘৃণ্যতম জাতি? যখনই তোমরা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছ, তখনই আমাদের নির্দেশে তোমাদের বিদ্রোহ চূর্ণ করে দিয়ে তোমাদের মাথা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সম্রাটের এ রূঢ় মন্তব্যে মুগিরাহ্ বিন যুরারহ্ অপমানে গর্জে উঠে বললেন: আমার সঙ্গীরা আরব-কৌলীন্যের সুষমাস্বরূপ, নম্রতাগুণে তাঁরা অতিভাষী নন। আমি এ সুযোগে কয়েকটি উপযুক্ত কথা বলতে চাই। এ কথা সত্য, আমরা ঘৃণ্য ছিলেম, অজ্ঞ ছিলেম। আমরা পরস্পর কাটাকাটি করেছি, আমাদের শিশুকন্যাদেরকে জীবন্ত কবর দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে একজন নবী পাঠালেন, যিনি কুল-মানে আমাদের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। আমরা প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধতা করেছি। তিনি সত্য বলেছেন, আমরা তাঁকে মিথ্যুক বলেছি। তিনি অগ্রপথে চলেছেন, আমরা পিছনে পড়ে থেকেছি। ক্রমে ক্রমে তিনি আমাদের মর্মস্পর্শ করলেন। তিনি যা বলেছেন আল্লাহ্র আদেশেই বলেছেন, তিনি যা করেছেন, আল্লাহ্র হুকুমেই করেছেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, এ ধর্ম পৃথিবীর ঘরে ঘরে পৌছে দিতে। যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারাই হয়েছে আমাদের মতো সমান অধিকারে অভিষিক্ত। যারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে, কিন্তু জিয়া দিতে সম্মত হয়েছে, তারা ইসলামের আশ্রয় লাভ করেছে। আর যারা কোনটাই স্বীকার করে নি, তাদের সঙ্গে হয়েছে অস্ত্রে-অস্ত্রে পরিচয়।
ইয়েৰ্গিদ্ ক্রোধে প্রদীপ্ত হয়ে বললেন, দূত অবধ্য, অন্যথায় তোমাদের কাউকে জীবিত ফিরে যেতে হতো না। তার পর তিনি এক ঝুড়ি মাটি আনিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ কে? আসিম বিন-ওমর অগ্রসর হয়ে নির্ভয়ে বললেন, সে আমি। সম্রাট তাঁরই মাথায় মাটির ঝুড়িটি বসিয়ে দিতে আদেশ দিলেন। আসিম দ্রুত গতিতে স্বশিবিরে ফিরে এসে মাটির ঝুড়িটি সা’দের সম্মুখে রেখে বললেন: মুবারক হোক! শত্রুপক্ষ স্বেচ্ছায় নিজের দেশ সমর্পণ করেছে।
অতঃপর মুসলিম বাহিনী যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হতে লাগলো। কিন্তু রুস্তম তবু ও গড়িমসি করে সাক্ষাৎ-যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে লাগলেন। মুসলিমরা নিকটবর্তী অঞ্চলে হামলা চালিয়ে রসদ সংগ্রহ করতে লাগলেন। ইতিমধ্যে পারসিক বাহিনীতে ভাঙ্গন ধরতে লাগলো এবং জওশনমাসহ তাদের কয়েকজন সেনানায়ক মুসলিম পক্ষে যোগ দিল। কয়েক মাস ধরে এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে স্থানীয় বাসিন্দারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ইয়েদর্গিদের নিকট অভিযোগ জানালো, তাদের আর রক্ষা না করলে তারা মুসলিম পক্ষে যোগ দিতে বাধ্য হবে। তখন রুস্তম অগ্রসর হতে বাধ্য হলেন এবং ষাট হাজার সৈন্যের বিপুল বাহিনী নিয়ে কাদিসিয়ায় উপস্থিত হলেন। কিন্তু পথে তাঁর বাহিনী অত্যাচার ও ব্যভিচারের যে নারকীয় অবস্থার সৃষ্টি করলো, তাতে লোকের মনে আশঙ্কা জন্মাতে লাগলো, পারস্যে শেষের দিন সমাগত।
সা’দ সমাগত শত্রুবাহিনীর সব খবর আনয়নের জন্যে যথেষ্ট গুপ্তচর নিয়োগ করেন। এই রকম ছদ্মবেশে ভ্রমণকালে এক গভীর রাত্রে তোলায়হা রুস্তমের বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং একটি উৎকৃষ্ট সুন্দর অশ্ব নিয়ে আসেন।
তখনও রুস্তম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এড়ানোর উদ্দেশ্যে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান সা’দের নিকট। এবার রাবী বিন-আমীর অদ্ভুত পোশাকে সজ্জিত হয়ে রুস্তমের শিবিরে উপস্থিত হন। রুস্তম জাঁকজমকপূর্ণ দরবারে রাবীকে গ্রহণ করে জিজ্ঞাসা করেন, এদেশ হামলা করার উদ্দেশ্য কী? রাবী উত্তর দিলেন, সৃষ্টির বদলে স্রষ্টার ভজন সংস্থাপনই আমাদের লক্ষ্য। রুস্তম সন্ধির প্রশ্ন এড়িয়ে জওয়াব দিলেন, সাম্রাজ্যের প্রধানদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরে মীমাংসা হবে।
শেষ দূত হিসেবে মুগিরাহ রুস্তমের দরবারে উপস্থিত হন। তিনি রুস্তমের আসনের পাশে বসেই আলাপ করতে উদ্যত হলেন। কিন্তু তাঁর সভাসদরা মুগিরাহ্ ব্যবহারে অপমান বোধ করে তাঁকে জোর করে আসন থেকে উঠাতে উদ্যত হলেন। তখন মুগিরাহ্ বললেন, আমি অতিথি হিসেবে এখানে এসেছি, অতএব অতিথির যোগ্য ব্যবহার পেতে চাই। আমাদের মধ্যে এ রীতি নেই যে, একজন দেবতার মতো উচ্চাসনে থাকবে, আর অন্যরা দাসের মতো প্রণতি জানাবে। তাঁর এই তেজোদীপ্ত জওয়াবে গুঞ্জন উঠলো, এ জাতিকে তুচ্ছ ভাবা আমাদের ভুল হয়েছে। তারপর রুস্তম পারস্যের সম্পদ বৈভব, শক্তি-সামর্থ্যের দীর্ঘ ফিরিস্তি গিয়ে মুরব্বির চালে বললেন, মুসলিমরা যদি এখনও ফিরে যায়, তাহলে তাদের অপরাধ মাফ করা হবে। বরং তাদের প্রত্যেককে কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। মুগিরাহ্ তখন কোমরে ঝুলায়মান তরবারির খাপে হাত রেখে বললেন, তোমরা যদি ইসলাম বা জিয়া কবুল না কর, তাহলে এর দ্বারাই মীমাংসা হবে। রুস্তম ক্রোধে অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন, সূর্যের শপথ! কালই আমি সমগ্র আরব ধ্বংস করবো।
অতঃপর সাক্ষাৎ-যুদ্ধ ছাড়া আর গত্যন্তর রইলো না।