ওমর-কাহিনীগুচ্ছ

ওমর-কাহিনীগুচ্ছ

ইংরেজীতে একটি প্রবচন আছে: দৃষ্টান্ত উপদেশের চেয়ে অনেক শ্রেয়। অর্থাৎ কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হওয়াই ঢের ভাল।

বস্তুত ইসলামের এটি একটি মহৎ শিক্ষা। ইসলামের উদ্‌গাতা রসূলুল্লাহ্ একটি কাহিনী থেকেই এ শিক্ষার বাস্তব পরিচয় বিশদ হয়েছে। একদিন একজন সাহাবা রসূলুল্লাহ্র নিকট একটি বালককে হাযির করে আরয করলেন: এর মধু খাওয়ার ভীষণ লোভ, একে হিদায়েত করুন। হযরত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ছেলেটিকে তিন দিন বাদে নিয়ে এসো। তিনদিন বাদে ছেলেটিকে হাযির করা হলে রসূলুল্লাহ্ ছেলেটিকে স্নেহভরে মিষ্ট কথায় বোঝালেন, মধু খাওয়ার লোভ ত্যাগ করা উচিত। ছেলেটি উপদেশ পালন করলো। জনৈক সাহাবা এই সময় নিয়ে উপদেশ দেওয়ার কারণ কি জানতে উৎসুক হলে হযরত স্মিত হাস্যে বলেছিলেন: আমারও মধু খাওয়ায় লোভ ছিল। সময় নিয়ে নিজে মধু খাওয়ার প্রবৃত্তি জয় করে ছেলেটিকে উপদেশ দিতে পেরেছি। এ-সব তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে মহৎ শিক্ষার কি সব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রসূলুল্লাহ্ রেখে গেছেন আমাদের জন্যে! ‘আপনি আচরি ধর্ম পরে শিখাইব-এ নীতি তিনি পালন করে গেছেন সারা জীবন ধরে অক্ষরে অক্ষরে, মর্মে মর্মে।

রসূলুল্লাহ্র জীবন্ত প্রতিচ্ছায়া ছিলেন তাঁর সাহাবা বা সাক্ষাৎ শিষ্যগণ। আবার তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম রত্ন ছিলেন চারজন-আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী। এঁদেরকে হযরতের প্রতিবিম্ব বলা চলে। সৌরজগতের চন্দ্রগ্রহণে উপগ্রহগুলি যেমন সূর্যের চারপাশে অবস্থান করে এবং সৌরকিরণে প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বল রূপ ধারণ করে, সে রকম এই চারজন সাহাবা-শ্রেষ্ঠ হযরতের জীবনাদর্শের পূর্ণালোকে লালিত হয়ে তাঁর শিক্ষা, বাণী ও আদর্শকে বাস্তবায়িত করেছিলেন। এজন্যে এদের জীবনধারা আলোচনা করলে হযরতের জীবনচিত্রের চিত্রণ দেখি, এঁদের কর্মধারার মধ্যে হযরতের শিক্ষা ও বাণীর পরিচয় লাভ করি, তাঁদের মধ্যেই রসূলুল্লাহ্ উপস্থিতি অনুভব করি।

ওমর রসূলের যোগ্য প্রতিনিধি ছিলেন এই অর্থে যে, তিনি রসূলের কদম মুবারকের অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছেন জীবনের প্রতি পদক্ষেপে। তার দৃষ্টান্ত পাই ওমরের প্রতিটি কর্মে। তাঁর কর্মজীবন আলোচনাকালে বহু কাহিনীর দৃষ্টান্ত দিয়ে তার প্রকৃত পরিচয় দিতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর বাস্তব জীবনের নানাদিকে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে আরও কাহিনী বিবৃত করা যেতে পারে, তাঁর কর্মজীবনের নানা দিকে আলোকপাত করার জন্যে। এগুলি সন্ধানী আলোর মতো তাঁর জীবন ও কর্মধারাকে দ্যুতিময় করে তুলেছে তাঁর অন্তর-বাহির আমাদের নিকট আরও পরিচ্ছন্ন ও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। নিঃসন্দেহে আসল মানুষটির পরিচয় মেলে এই কাহিনীগুলির মাধ্যমে:

।।১।।

একবার এক বেদুঈন ওমরের নিকট নালিশ করে একজন কর্মচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ওমর তাকে সাক্ষী হাযির করতে বললে সে অক্ষমতা জানায়। তখন, ওমর সহসা রাগান্বিত হয়ে তাকে বেত্রাঘাত করে দূর করে দেন। পরে গোপনে সংবাদ নিয়ে ওমর নিঃসন্দেহ হন, বেদুঈনের অভিযোগ সত্য। তখনই তিনি অভিযোগের প্রতিকার করেন। কিন্তু বেদুঈনকে অনুরোধ করেন, তাকে অহেতুক বেত্রাঘাত করার দরুন তাঁকেও বেত্রাঘাত করে প্রতিশোধ নিতে। বেদুঈন সসম্ভ্রমে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন অনুতপ্ত ওমর আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা জানান :

হে খাত্তাব-নন্দন! তুমি অধম ছিলে, আল্লাহ্ তোমায় উর্ধ্বে
তুলেছেন। তুমি বিভ্রান্ত ছিলে, আল্লাহ্ তোমায় সঠিক পথে
চালনা করেছেন। তুমি দুর্বল ছিলে, আল্লাহ তোমায় সবল
করেছেন। তার পর তোমায় নিজ কওমের উপর শাসনভার
দিয়েছেন! কিন্তু তাদেরই একজন যখন তোমার সাহায্য
ভিক্ষা করলো, তাকে তুমি আঘাতই দিয়েছ! এখন আল্লাহর
সামনে উপস্থিত হয়ে তুমি কি কৈফিয়ৎ দিবে?

।।২।।

একবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু মালে-গণিমাত মদীনায় উপস্থিত হয়। এ খবর পেয়ে ওমর-তনয়া ও ওম্মুল-মুমেনীন বিবি হাস্সা পিতৃসমক্ষে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করলেন: আমীরুল মুমেনীন! আমি আপনার কন্যা, আমায় মালে গনিমাতের অংশ দিন। ওমর উত্তর দিলেন: বৎসে! আমার সম্পত্তিতেই শুধু তোমার হক আছে। কিন্তু মালে গনিমাত সর্বসাধারণের সম্পত্তি। আমি তো তোমার কথায় কর্তব্য ভুলতে পারি নে। হাসা লজ্জা পেয়ে সরে পড়েন।

।।৩।।

সিরিয়া বিজয়ের পর প্রাচ্য দেশীয় রাজা বাদশাদের সঙ্গে মুসলিমদের পত্রাদি বিনিময় হতে থাকে। একবার ওমর-পত্নী ওম্মে-কুলসুম কয়েক শিশি ভর্তি সুগন্ধি উপহার পাঠান এক সম্রাট-মহিষীকে এবং প্রতিদানে সব শিশিভর্তি মুক্তা আসে। ওমর এ খবর পেয়ে স্ত্রীকে বলেন, এ উপহার রাষ্ট্রীয় কারণে সরকারী কর্মচারী মারফত এসেছে, অতএব এসব মুক্তা বায়তুল মালে যাবে। তবে সুগন্ধির মূল্য হিসেবে কিছু খেসারত দেওয়া যেতে পারে।

।।৪।।

একবার খলিফাতুল মুসলেমীন ওমর অসুখে পড়েন। সকলেই উপদেশ দিল, মধু খেতে। কিন্তু বায়তুল-মালে প্রচুর মধু থাকলেও ওমরের গৃহে এক ফোঁটা মধু নেই। অথচ সাধারণের অনুমতি ব্যতীত খলিফা মধু নিতে পারেন না। জুমার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো এবং জনসাধারণ মসজিদে উপস্থিত হলে প্রার্থনা করা হলো, অসুস্থ খলিফার জন্যে কিছু মধু বরাদ্দ করতে। জনগণের সম্পত্তিতে খলিফার কোন অধিকার নেই, তিনি শুধু প্রহরীমাত্র, এর চেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে?

।।৫।।

যিয়াদ-বিন্ হাদি ছিলেন ইরাকের প্রধান শুল্ক-কর্মচারী। তিনি এক খ্রিস্টানের একটি ঘোড়ার কুড়ি হাজার দিরহাম মূল্য ধরে এক হাজার দিরহাম শুল্ক চেয়ে বসলেন। ঘোড়ার মালিক একহাজার দিরহাম বাদ দিয়ে উনিশ হাজার নিয়ে চলে যায়। কিছু দিন পরে খ্রিস্টান মালিক সে পথ দিয়ে যাবার সময়ে আবার তার নিকট শুল্ক দাবী করা হলো। তখন মালিক অনন্যোপায় হয়ে ওমরের নিকট নালিশ করে। খলিফা বললেন, ভয় নেই। খ্রিস্টান যিয়াদের নিকট যেয়ে মা’সুল দিয়ে ঘোড়াটি ফেরৎ চাইলে, তাকে জানানো হয়, বিনা মাসুলেই খলিফা ঘোড়া ফেরৎ দিতে ফরমান জারী করেছেন, কারণ একই পণ্যদ্রব্যের বছরে দুবার মা’সুল লাগে না। কিছুদিন পর ওমর যখন কা’বাগৃহে খুৎবা দিচ্ছিলেন, তখন এক খ্রিস্টান তাঁর নিকট শুল্ক বিষয়ে একই নালিশ জানায়। ওমর তৎক্ষণাৎ বলেন, একই পণ্যের দুবার মাসুল লাগে না। তখন খ্রিস্টানটি জানায় সে-ই পূর্বে এ বিষয়ে নালিশ করেছিল। ওমর তখন বলেন: আমিও সেই মুসলিম, যে তোমার ক্ষতির প্রতিকার করেছিল।

।।৬।।

সিরিয়া ভ্রমণ শেষ করে ওমর মদীনায় ফিরছেন। পথে মরু-প্রান্তরে একটি তাঁবু সম্মুখে পড়ে। তখনই উট থেকে নেমে ওমর তাঁবুর নিকট গিয়ে দেখলেন, একটি অসহায়া বৃদ্ধা মূর্তিমান হতাশার মতো বসে আছে। খলিফার মনে দয়ার উদ্রেক হলো। তিনি বললেন, ওমরকে তোমার অবস্থা জানাও না কেন? বৃদ্ধা উত্তর দিলে: শুনেছি, ওমর সিরিয়া থেকে ফিরছে। কিন্তু আল্লাহ্ অভিশাপ তার উপর, সে আমায় এক দিরহামও সাহায্য পাঠায় নি। ওমর বললেন: এতো দূর বিয়াবান্ থেকে তোমার খবর ওমরের নিকট কি করে পৌঁছাবে? বৃদ্ধা পুনরায় অভিশাপ দিয়ে বলে: তবে সে খলিফা হয়েছে কেন? প্রত্যেক বাসিন্দার খবরাখবর যদি রাখতে না পারে, তার খলিফা সাজা কেন? ওমর অশ্রুবিগলিত কণ্ঠে বললেন: মা, ঠিকই বলেছ, ওমর মহা অপরাধী।

।।৭।।

একবার একদল যাত্রী মদীনার উপকণ্ঠ আস্তানা ফেলে। ওমর নিজেই রাত্রি জেগে তাদের খবরদারী করতে থাকেন। একটি তাঁবুতে দেখলেন, একটি মেয়ের কোলে এক কচি শিশু অনবরত রোদন করছে, কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই স্তন্য দিচ্ছে না। ওমর ধমক দিয়ে শিশুকে শান্ত করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর আবার সেদিক যেতে যেতে ওমর দেখলেন, শিশুটি সমানে রোদন করছে। ওমর কড়া ধমক দিয়ে বললেন, এমন নিষ্ঠুর মা আর দেখিনি। মেয়েটি তখন রাগান্বিত হয়ে বললে: যা জান না, তা নিয়ে ঝাল দেখি ও না। ওমর ফরমান জারী করেছে, দুধ না ছাড়া পর্যন্ত শিশুরা বায়তুল-মাল থেকে ভাতা পাবে না। তাই আমি জোর করে একে দুধ ছাড়াচ্ছি, আর তাই এতো চেঁচাচ্ছে। ওমরের তো চক্ষুস্থির। তাঁর তীব্র অনুশোচনা হলো, এভাবে না জানি কতো শিশু অকালে প্রাণ হারিয়েছে। তিনি সেদিনই ফরমান জারী করেন, জন্মাবার দিন থেকেই প্রত্যেক শিশু বায়তুল-মাল থেকে ভাতা পাবে এবং বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ভাতাও বৃদ্ধি পাবে।

।। ৮।।

ওমরের ভৃত্য আসলাম এই কাহিনী বলেছেন। এক রাত্রে ওমরের সঙ্গে আসলাম শহর-পরিক্রমায় বের হয়েছেন। যখন তাঁরা মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে সরার নামক স্থানে উপস্থিত তখন লক্ষ্য করেন একটি রমণী চুলায় একটি ডেকচি জ্বাল দিচ্ছে, আর চার পাশে কয়েকটি অপোগণ্ড শিশু রোদন করছে। ওমর নিকটে যেয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। রমণীটি আর্তস্বরে বললে, ঘরে এক কণা খাবার নেই, অথচ ক্ষুধার জ্বালায় শিশুরা রোদন করছে। এজন্যে তাদের ভুলাবার উদ্দেশ্যে ডেকচিতে শুধু পানি জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। শিশুরা রোদন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। এ কথা শুনেই ওমরের বুকে মোচর দিয়ে উঠলো। তিনি পাগলের মতো শহরের দিকে দৌড় দিলেন এবং বায়তুল-মাল থেকে আটা, ঘি, খেজুর প্রভৃতি খাদ্য বস্তুতে ছালা বোঝাই করে আসলামকে অনুরোধ করলেন, তাঁর পিঠে বোঝা তুলে দিতে। আসলাম সবিনয়ে আর করলেন, তিনিই বোঝা বহন করবেন। কিন্তু ওমর বললেন: ভালো কথা কিন্তু রোয- কিয়ামতে আমার বোঝা বইতে তো তুমি থাকবে না; তখন আমার কি হবে? ছোট হোক বড় হোক জুলুমের বোঝা বওয়ার চেয়ে লোহার পর্বতের ভারী বোঝা বহন করা ঢের সহজ। অতঃপর ওমর নিজেই ছালা পিঠে বয়ে তাঁবুতে উপস্থিত হলেন। রমণী রুটি তৈরি করতে লাগলো, ওমর নিজে সেঁকতে লাগলেন। খাবার প্রস্তুত হলে শিশুরা মহানন্দে উদর পূর্তি করলো, ওমর গভীর তৃপ্তিভরে দেখতে লাগলেন। রমণীটি তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললে: আল্লাহ্ তোমায় কৃপা করুন! সত্যি কথা বলতে তুমিই ওমরের চেয়ে খলিফা হওয়ার উপযুক্ত। ওমর খুশী হয়ে আসলামকে বললেন : বাচ্চাদেরকে ভুখা দেখে আমার মনে হয়েছিল, যেন পাহাড় ভেঙে আমার পিঠে পড়েছে। এখন মনে হচ্ছে, সে পাহাড় আমার উপর থেকে সরে গেছে।

।।৯।।

এক রাত্রে ওমর একাকী টহল দিতে দিতে শহর থেকে অনেক দূর চলে গেলেন। সহসা তাঁর সামনে একটি তাঁবু পড়লো তিনি লক্ষ্য করলেন, একজন বেদুঈন বড় বিষণ্ণ হয়ে একাকী বাইরে বসে আছে। তিনি বেদুঈনটির নিকট যেয়ে আলাপ আরম্ভ করলেন। সহসা তাঁবুর ভিতর থেকে নারীর আর্তকণ্ঠ শ্রুত হলো। ওমর ব্যস্ত হয়ে কারণ জিজ্ঞাসা করলে বেদুঈন ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললে, তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা উপস্থিত হয়েছে। অথচ সাহায্য করতে কোন ও দ্বিতীয় স্ত্রীলোক নেই। ওমর আর কথা না বলে তৎক্ষণাৎ গৃহে উপস্থিত হলেন এবং বিবি ওম্মে কুলসুমকে বললেন, প্রসূতির সমস্ত সরঞ্জাম নিয়ে তখনই তার সঙ্গে যেতে। তাঁবুতে উপস্থিত হয়ে ওমর বেদুঈনের অনুমতি নিয়ে ওম্মে কুলসুমকে ভিতরে প্রেরণ করলেন ও নিজে কিছু খাবার নিয়ে বেদুঈনকে সঙ্গে করে আহারে প্রবৃত্ত হলেন। কিছুক্ষণ পরে ওম্মে কুলসুম বের হয়ে বললেন: আমীরুল মুমেনীন! আপনার বন্ধুকে সুসংবাদ দিন, একটি পুত্র হয়েছে। ‘আমীরুল মু’মেনীন’ সম্বোধন শুনেই তো বেদুঈনের চক্ষু ছানাবড়া! সে সঙ্গে সঙ্গে সালাম জানিয়ে সসম্ভ্রমে এক পাশে দাঁড়ালো। কিন্তু ওমর বললেন: কিছু মনে করো না ভাই! আমি স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ী যাচ্ছি, কাল তুমি দরবারে দেখা করো, শিশুর একটা ভাতার ব্যবস্থা করে দেব।

।। ১০।।

আবদুর-রহমান-বিন্-আউফ বলেছেন: এক রাত্রে ওমর সহসা আমার নিকট উপস্থিত হলেন। আমি আরজ করলেম, তাঁর এতো কষ্ট করার দরকার ছিল না, আমায় ডাকলেই হাযির হতেম। কিন্তু ওমর বললেন: ওসব কথা থাক। একদল যাত্রী শহরের উপকণ্ঠে তাঁবু ফেলেছে। তারা নিশ্চয়ই ক্লান্ত। চলো আমরা দুজনে তাদের কাজ করে দিই ও সারারাত পাহারা দিই। তাঁর সনিবন্ধ অনুরোধে আমরা সারারাত পাহারা দিয়েছি।

।। ১১।।

আহনাফ্-বিন-কায়েস একবার ওমরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে কয়েকজন গণ্যমান্য মাতবর। মসজিদে খলিফাকে না পেয়ে তাঁরা ওমরের খোঁজে বের হলেন এবং শহর-প্রান্তে দেখলেন, খোদ্ খলিফা কোমরে কাপড় গুঁজে ছুটাছুটি করছেন তাঁদেরকে দেখতে পেয়েই ওমর জোরে হাঁক দিলেন: আহনাফ্! দৌড়ে এসো, বায়তুল-মালের একটা উট ছুটে পালিয়েছে, ওটাকে ধরতে হবে। জানো তো কত এতিমের অংশ রয়েছে এই উটটিতে। একজন মাতবর বললেন: তার জন্যে খোদ্ আমীরুল মু’মেনীন দৌড়াদৌড়ি করছেন কেন? একজন গোলাম পাঠালেই চলতো। স্মিতহাস্যে ওমর উত্তর দিলেন; আমার চেয়ে বড় গোলাম আর কে আছে?

।।১২।।

একদা ওমর লক্ষ্য করেন একজন বৃদ্ধ খ্রিস্টান দুর্বল শরীর নিয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করছে। ওমর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এমন দুর্বল শরীরে সে ভিক্ষা করছে কেন? বৃদ্ধ উত্তর দিলে, তার উপর জিয়া কর ধার্য করা হয়েছে, অথচ তার সামর্থ্য নেই; এজন্যে ভিক্ষা করতে বাধ্য হয়েছে। ওমর তাকে সঙ্গে করে নিজ গৃহে আনলেন ও কিছু অর্থ দিয়ে বিদায় করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বায়তুল মালের খাজাঞ্চীকে নির্দেশ দিলেন এ রকম অক্ষম লোকদের বায়তুল মাল থেকে ভরণ-পোষণ করা কর্তব্য। এই সঙ্গে কোরআনের বাণী ‘সাদকা দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের প্রাপ্য’ উদ্ধৃত করে এই ফরমান দেন: আল্লাহ্র নামে বলছি, এটা কখনই উচিত নয় যে, আমরা জনগণের যৌবনকালের উপকার লাভ করবো, কিন্তু বৃদ্ধাবস্থায় তাদের পথে ফেলে দেবো।

।। ১৩।।

একবার এক বেদুঈন ওমরের নিকট এসে উক্তি করে: হে ওমর! বেহেশতের আনন্দই পরমানন্দ। আমার মেয়েদের ও তাদের মাকে বস্ত্র দান কর। আল্লাহ্র দোহাই! বস্ত্র দান করো! ওমর বললেন, যদি না দিই, তা হলে কি হবে? বেদুঈন বললে: তাহলে রোয-কিয়ামতে আমার জন্যে তোমার জওয়াবদিহি করতে হবে। তখন তুমি লা- জওয়াব হয়ে যাবে, আর তার পর তোমার গতি হবে বেহেশতে না হয়ে দোজখে। এ কথাই শুনেই ওমর এরূপ ক্রন্দন করতে থাকেন যে তাঁর দাঁড়ি বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। তখন তাঁর নিকট কিছুই না থাকায় গায়ের বস্ত্রখানিই খুলে নিয়ে বেদুঈনকে দান করলেন।

।।১৪।।

এক গভীর রাত্রিতে টহল দিয়ে ফিরছেন। সহসা নারীকণ্ঠে এই করুণগীতি শ্রুত হলো :

ঘোর রজনী দীর্ঘ রজনী ঘিরিছে মোরে;
প্রিয় নাই পাশে, একাকী নয়ন ঝুয়ে!

ওমর সংবাদ নিয়ে জানলেন, যুবতীর স্বামী যুদ্ধে গেছে, বহুদিন ঘরে ফেরে নি। রমণীর বিরহ-ব্যথা ওমরের মর্মে আঘাত করলো। তিনি চিন্তা করলেন, এভাবে কতো বিরহিণীকে তিনি যাতনা দিয়ে অভিশাপ কুড়িয়েছেন। কন্যা হাসাকে জিজ্ঞাসা করলেন, নারী কতোদিন স্বামীর বিরহ সহ্য করতে পারে? ওম্মুল-মুমেনীন উত্তর দিলেন, বড় জোর চার মাস। পরদিন প্রাতেই ওমর ফরমান জারী করলেন, কোনও যোদ্ধাকে চার মাসের বেশি গৃহ-সুখে বঞ্চিত করা যাবে না।

।। ১৫।।

সাইদ্-বিন্-য়ারবু ছিলেন অন্যতম সাহাবা। বৃদ্ধ হয়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। একদিন ওমর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, জুমার নামাযে তিনি শরীক হন না কেন? সাঈদ বললেন, তিনি অন্ধ হয়ে পড়েছেন, একা পথে হাঁটতে পারেন না, তাঁর কোন সঙ্গী-সহায়ও নেই। তখন তখনই ওমর এক জন ভৃত্য নিযুক্ত করলেন, সাঈদকে সাহায্য করতে।

।। ১৬।।

একদিন ওমর কয়েকজ ব্যক্তিকে ভোজ দিয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, এক ব্যক্তি বাম হাত দিয়ে মুখে খাবার তুলছে। ওমর তাকে উপদেশ দিলেন, ডান হাত দিয়ে আহার করতে। লোকটি বললে, ইয়ারমুকের যুদ্ধে তার ডান হাত কাটা গেছে। তখনই ওমরের অন্তর সমবেদনায় ভরে গেল, তিনি তার নিকট বসে নিজের হাতে তাকে খাবার তুলে দিতে লাগলেন। তার গোসল করতে, কাপড় পরতে কতো অসুবিধা হয় তা বিবেচনা করলেন এবং সেই দিনই তার সেবা করার জন্যে একজন ভৃত্য নিযুক্ত করলেন।

।।১৭।।

একদিন ওমর এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। চারদিকে বিশালজনতা নীরবে তাঁর বক্তৃতা শুনছে। এক সময়ে উচ্চকণ্ঠে তিনি জনতাকে প্রশ্ন করলেন : বন্ধুগণ, আমি যদি বিপথে চলি, যদি দুনিয়াবী লোভে পড়ে যাই, তা হলে তোমরা কি করবে? তখনই এক ব্যক্তি মাথা তুলে দাঁড়ালো এবং তরবারি উঁচিয়ে তুলে উচ্চস্বরে বললে, তা হলে ওমর! তোমার মাথা কেটে ফেলবো। লোকটির সাহস পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে ওমর ধমক দিয়ে বললেন: তুমি এ কথা খলিফাকে বলছো? লোকটি নির্ভীক কণ্ঠে বললে, হাঁ ওমর, আমি তোমাকেই বলছি। দুহাত উর্ধ্বে তুলে ওমর আল্লাহ্ শুকরগুজারী করে বললেন: আল্লাহ! আমি কী ভাগ্যবান! আমি যদি বিপথে চলি, তা হলে আমায় সঠিক পথে চালাবার লোকের অভাব হবে না।

।।১৮।।

এক জুমার দিনে ওমর খুত্বা দিতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। তখনই উপস্থিত মুসল্লীদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানালো : হে ওমর! প্রথমে আমার প্রশ্নের জওয়াব দিন, তার পর আপনার কথা শুনবো। তখনই ওমর মিম্বার থেকে নেমে বললেন: বল, কি তোমার প্রশ্ন? সে বললে: আমরা মালে-গনিমাত থেকে যে এক এক টুকরো কাপড় পেয়েছি, তা তো কুর্তা হয় না, অথচ আপনার গায়ের বড় কুর্তা বানিয়েছেন। আপনি কোথা থেকে এই কাপড় পেলেন? খলিফা পুত্র আবদুল্লাহকে ডেকে বললেন: তুমি এর কৈফিয়ত দাও। তিনি বললেন: আমি আমার অংশ পিতাকে দান করেছি, তাই দুটুকরো কাপড়ে কুর্তা তৈরি হয়েছে। তখন লোকটি বলল, আমীরুল মু’মেনীন! এবার আপনার খুত্বা শুনবো। খলিফা স্মিতকণ্ঠে বললেন: আল্লাহ! আমি কি ভাগ্যবান! আমারও কৈফিয়ত তলব করতে কারও সঙ্কোচ-ভয় হয় না।

।।১৯।।

একদা ওমর মদীনার পথে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একজন সাধারণ লোক তাঁর পথ রোধ করে বললে: ওহে ওমর! তোমার কি আল্লাহ্ ভয় নেই? তুমি বুঝি ভেবেছ যে, তোমার আমলাদের জন্যে কতকগুলি হুকুমনামা পাঠিয়ে দিয়েই তুমি আল্লাহ্র গযব থেকে ত্রাণ পেয়ে যাবে?

ওমর ভীত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন: কেন, কি হয়েছে?

লোকটি বললে: তুমি কি খবর রাখো, তোমার নিযুক্ত মিসরের শাসক আইয়ায- বিন্-ঘনম মিহি কাপড়ের শৌখিন পোশাক পরে এবং ফটকে একজন দ্বারী রাখে?

ওমর সেদিনই মিসরে দূত হিসেবে পাঠালেন মুহম্মদ-বিন্-মস্লামাকে এই নির্দেশ দিয়ে, তিনি আইয়াযকে যে-অবস্থায় পাবেন, সে অবস্থাতেই খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করবেন। দূত মিসরে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, আইয়াযের বিরুদ্ধে অভিযোগ যথার্থ। তাঁর দেহে মিহি কাপড়ের পোশাক আছে, একজন দ্বারীও ফটকে নিযুক্ত আছে। আইয়াযকে সেই অবস্থায় মদীনায় উপস্থিত করা হলো। ওমর এক নযর তাঁকে দেখেই হুকুম দিলেন, তাঁর পোশাক খুলে নিয়ে কোরা পশমের পোশাক পরিয়ে দিতে এবং এক পাল মেষ দিয়ে আদেশ দিলেন: যাও এবার বনজঙ্গলে মেষ চরাও গে।

আইয়ায বিনা প্রতিবাদে হুকুম তামিল করতে প্রস্তুত হলেন। কিন্তু নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়ে বারবার আক্ষেপ করতে লাগলেন; এর চেয়ে মরণও ভালো ছিল।

ওমর তো শুনে বললেন: এ কাজ করতে তোমার লজ্জা পাওয়ার কথা নয়। তোমার পিতা আজীবন মেষের রাখালি করে গেছে, আর এজন্যেই তার নাম হয়েছিল ঘনম্।

আইয়ায অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেন। তার পর এই চরম শাস্তি শিরোধার্য করে তিনি নীরবে আজীবন মেষের রাখালি করে গেছেন।

।।২০।।

পরমজ্ঞানী সালমান ফারসীকে ওমর একবার জিজ্ঞাসা করলেন: আমি সম্রাট না খলিফা?

সাল্‌মান উত্তর দিলেন: আপনি যদি মুসলিমদের জমির উপর এক দেরহাম কিংবা তার বেশি বা তার চেয়েও কম কর ধার্য করে থাকেন এবং তা শারীয়ার বিধানের বিপরীতে ব্যয় করে থাকেন, তাহলে আপনি সম্রাট, খলিফা নন।

ওমর এ কথা শুনে অঝোরে অশ্রুপাত করতে করতে প্রার্থনা জানালেন: হে আল্লাহ! আমায় সঠিক পথে চালনা করো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *