জিম্মীদের অধিকার সংরক্ষণ ও দাসপ্রথা নিয়ন্ত্রণ

জিম্মীদের অধিকার সংরক্ষণ ও দাসপ্রথা নিয়ন্ত্ৰণ

বিজাতি, বিধর্মী ও বিদেশীর প্রতি বিরূপ মনোভাব মানুষের মজ্জাগত স্বভাব। ইসলাম-পূর্ব যুগে এ মনোভাব এতোখানি বিরুদ্ধ ছিল যে তাদের কোন স্বত্ত্বাধিকারই স্বীকৃত হতো না। ইসলাম যখন প্রচারিত হয়, প্রতিবেশী দুটি পরাক্রান্ত সাম্রাজ্য পূর্ব- রোমকে এবং পারস্যে বিজাতি ও বিধর্মীরা শুধু মানুষ নামই ধারণ করতো, তাদের কোন অধিকারই ছিল না এবং সাধারণ তৈজসপত্রের শামিল ধরা হতো। সিরিয়াবাসী খ্রিস্টানরা রোমক প্রভুদের সমধর্মী হয়েও জমিতে স্বত্বাধিকার লাভ করতো না, বরং ভূমিদাসে পরিণত হয়ে সম্পত্তি হস্তান্তরকালে শুধু প্রভু-বদলের ভাগ্য লাভ করতো। ইহুদীদের ভাগ্যও কিছুমাত্র ঈর্ষাজনক ছিল না। পারস্যেও খ্রিস্টান ও ইহুদীরা সমান পর্যায়ভুক্ত ছিল।

ওমরের খেলাফতকালে এ-সব দেশবাসীর ভাগ্য পরিবর্তন ঘটে এবং মানুষের মর্যাদা-সিক্ত হয়ে তারা সাধারণ নাগরিকের সর্বাধিকার লাভ করে। বিজিত ও বিজেতা, স্বধর্মী ও বিধর্মী এবং স্বদেশী ও বিদেশীর ভেদ-রেখা লুপ্ত হয়। বিজিত দেশগুলির সঙ্গে ওমর যে সব সন্ধি করেছিলেন, সেগুলি থেকে আমাদের এ দাবী সমর্থন মিলে। বলা বাহুল্য, এ সব সন্ধিপত্রের শর্তাবলী এমনই একরূপ হতো যে পরবর্তীকালে প্রথম স্বাক্ষরিত সন্ধিপত্রের বরাত দিয়েই সে সব শর্ত অবিকৃতভাবে গৃহীত হতো। এরূপ আদর্শ-সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় জেরুজালেমবাসীদের সঙ্গে এবং স্বয়ং ওমরের বয়ান মতে। সন্ধিপত্রটির আক্ষরিক অনুবাদ এইরূপ:

এ আশ্রয়দান করছেন আল্লাহ্র বান্দা ওমর, আমীরুল মুমেনীন, আইলিয়ার সমস্ত অধিবাসীকে। এ আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাদের জানমালের, তাদের গীর্জা ও ক্রশসমূহের, তাদের আতুর ও স্বাস্থ্যবানদের এবং তাদের সমস্ত সমধর্মীর জন্য। তাদের গীর্জাসমূহ বাসগৃহরূপে ব্যবহৃত হবে না, সেগুলি ভূমিসাৎ করা হবে না, কিংবা তাদের কোন অংশের, আঙিনার বা ক্রশসমূহের কোনও ক্ষতি করা হবে না, কিংবা তাদের সম্পত্তিরও হানি করা হবে না। ধর্ম বিষয়ে তাদের উপর কোন জবরদস্তি করা হবে না, কিংবা ধর্মের কারণে কারও কোন ক্ষতি করা হবে না। ইহুদীদিগকে তাদের সঙ্গে আইলিয়াতে বাস করতে বাধ্য করা হবে না। আইলিয়ার অধিবাসীরা অন্যান্য শহরবাসীর মতো জিয়া আদায় দিতে ও রোমকদেরকে বহিষ্কার করতে অঙ্গীকার করছে। যেসব রোমক শহর ত্যাগ করবে তারা নিরাপদ স্থানে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের ধনপ্রাণ নিরাপদ, কিন্তু কোন রোমক আইলিয়ার বাসিন্দা হতে ইচ্ছা করলে তার নিরাপত্তা রক্ষা করা হবে এবং সে জিয়া আদায় দিতে বাধ্য হবে। যদি আইলিয়ার কোনও অধিবাসী রোমকদের সহগামী হতে চায় ও সম্পত্তি সঙ্গে নিতে চায়, তাহলে সে তার গির্জা ও ক্রশ নিরাপদ স্থানে স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত নিরাপদ। এতদ্বারা যা কিছু লিখিত হলো, সে-সব আল্লাহ্র দেওয়া অঙ্গীকারে ও তাঁর রসূলের খলিফাদের এবং মুসলিমদের দায়িত্ব দেওয়া গেল, যতক্ষণ তারা ধার্য জিয়া আদায় দেবে। এ দলীলে সাক্ষী রইলেন খালিদ-বিন্‌ – অলিদ, আমর-বিন্-আস্, আব্দুর রহমান-বিন্-আউফ ও মুয়াবীয়া-বিন-আবু সুফিয়ান।

লিখিত হয় ১৫ হিজরীতে।

উপরোক্ত ফরমান থেকে ধ্রুব প্রত্যয় হবে, বিধর্মীদের ধন-প্রাণ কতোদূর নিরাপদ ছিল, ধর্মমত কতোখানি স্বাধীন ছিল, ধর্মস্থান ও ধর্মচিহ্ন পর্যন্ত কিভাবে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষিত হতো। বস্তুত ধর্মবিশ্বাসে জিম্মীদের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তাদের নিজস্ব ধর্মানুষ্ঠান প্রকাশ্যে পালন করার, ঘণ্টা বাজাবার, শোভাযাত্রা করে ক্রশ বহন করার ও ধর্মীয় মেলা বসাবার নিরঙ্কুশ অধিকার ছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার যাজক বেন্‌জামিন্ তের বছর ধরে রোমক ভীতিতে দেশে দেশে আত্মগোপন করে ফিরেছেন। ২০ হিজরীতে আমর-বিন্ আস মিসর জয় করলে বেজমিন নির্ভয়ে প্রত্যাবর্তন করেন ও নিজের যাজকতায় অধিষ্ঠিত হন। প্রতিটি সন্ধিপত্রে ধর্মমতে স্বাধীনতা বিশেষভাবে স্বীকৃত হতো। হুদায়ফা কর্তৃক মাহদিনারবাসীদের সঙ্গে সন্ধিতে, জুরজান্ বিজয়ের পর অধিবাসীদের সঙ্গে সন্ধিতে, আজরবাইজন ও মুকানের সন্ধিপত্রে বিশেষ শর্ত ছিল : বানিন্দাদের ধন-প্রাণ এবং ধর্ম ও আইন নিরাপদ এবং কোন পরিবর্তন করা চলবে না। ওমরের ইসলামপ্রীতি ও ইসলাম প্রচারে উৎসাহ তুলনাহীন। কিন্তু তিনিও আপন গোলাম আস্তিকে বারবার খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম হতে উপদেশ দিয়ে হার মেনেছেন ও কোরআনের বাণী উচ্চারণ করে শান্তি খুঁজেছেন : লা ইব্রাহা ফিদ্-দীন-ধর্মে বলপ্রয়োগ নেই। বিজেতা কর্তৃক বিজিতের প্রতি এতোখানি ন্যায়পরায়ণতা ও উদারতার দৃষ্টান্ত জগতেতিহাসে আর দ্বিতীয় নেই।

জিম্মীদের ধন-প্রাণই শুধু নিরাপদ হয় নি, জিম্মীরা মুসলিমদের সমপর্যায়ের নাগরিক অধিকার লাভ করতো এবং অপরাধক্ষেত্রে কোন ভেদাভেদ করা হতো না। কোনও মুসলিম জিম্মীকে খুন করলে তাকে জীবন দিয়ে শাস্তি নিতে হতো। ইমাম শাফী বলেন, একবার বকর বিন্-ওয়াইল গোত্রের জনৈক ব্যক্তি একজন জিম্মী খ্রিস্টানকে হত্যা করে। ওমর বিচার করেন, খুনীকে মৃত ব্যক্তি ওয়ারীসানের হাতে অর্পণ করা হলে তাকেও হত্যা করা হয়। জিম্মীদের কাউকে জমি থেকে উৎখাত করা হয়নি। তাদের দেয় ভূমিকরের পরিমাণও ছিল সহনীয়। শাসন-বিষয়ে জিম্মীদেরও মতামত গ্রহণ করা হতো এবং তাদের কল্যাণার্থে ব্যবস্থা অবলম্বিত হতো। ইরাকের ভূমিকর ধার্যকরণের সময় স্থানীয় জোতদারদের মদীনায় ডেকে এনে পরামর্শ লওয়া হয়। মিসর-জয়ের পরও এ নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। ধন-প্রাণ নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ কেবল কাগজেই লিপিবদ্ধ থাকে নি। সিরিয়ার জনৈক চাষীর ক্ষেত সেনাবাহিনী নষ্ট করে দিলে ওমর তাকে দশ হাজার দিরহাম ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন। কাজী ইউসুফ বলেন, ওমর সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকালে একস্থানে লক্ষ্য করেন, কয়েজনকে নির্যাতন করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেল, তারা জিয়া আদায় না দেওয়ায় শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ওমর তখনই তাদেরকে নিষ্কৃতি দিতে আদেশ দিয়ে বলেন : আল্লাহ্র রসূল বলে গেছেন : ‘মানুষকে আঘাত করো না, যারা মানুষকে যাতনা দেয় রোজহাশরে তাদের যাতনা দেবেন স্বয়ং আল্লাহ্।

মৃত্যুশয্যায় শায়িত খলিফা ওমর উত্তরাধিকারীকে উপদেশ দানকালেও বলে গেছেন : আমার উত্তরাধিকারীকেও এই ওসিয়ত রইলো, আল্লাহ্ ও তার রসূলের আশ্রয়ে যারা রয়েছে (অর্থাৎ জিম্মী) তাদের সঙ্গে অঙ্গীকার অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালিত হবে। তাদেরকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে এবং তাদের উপর সাধ্যাতীত ভার কখনো চাপানো হবে না।

তবু অভিযোগ থেকে যায় : ওমর জিম্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুসলিমদের পোশাক গ্রহণ না করতে, কোমরবন্ধ ও লম্বা টুপী পরতে, নতুন গীর্জা না তুলতে, মদ ও শূকরের মাংস বিক্রয় না করতে, ঘণ্টা না বাজাতে এবং শোভাযাত্রা করে ক্রশ বহন না করতে। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছিলেন বনী-তগলিব গোত্রকে তাদের সন্তানগণকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত না করতে। তিনি আরব থেকে ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বিতাড়িত করে শুধু মুসলিমদের জন্যেই বাসভূমি নির্দিষ্ট করেছিলেন।

সমকালীন ইতিহাস থেকে তথ্য মেলে, ওমর এ-সব নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু যে- সব কারণে ও ক্ষেত্রে এসব হুকুম দেওয়া হয়েছিল, সেগুলি বিরুদ্ধবাদীরা হয় ইচ্ছাপূর্বক বিকৃত করেছেন, না হয় গোপন করেছেন। তিনি খ্রিস্টান, ইহুদী ও পারসিকদেরকে নিজ নিজ জাতীয় পোশাক ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেমন দিয়েছিলেন মুসলিমদেরকে দিজের কওমী লেবাসে দেহাবৃত করতে। পারসিকদেরকে কোমরবন্ধ (যুন্নার বা মুর্তিকা বা কাতি) ব্যবহার করতে বলেন তাদের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে। মুসলিম-প্রধান মহল্লাতে নতুন গীর্জা তোলা, মদ ও শূকর-মাংস প্রকাশ্যে বিক্রয় না করা, ঘণ্টা না বাজানো, শোভাযাত্রা ও বাদ্যাদিসহ ক্রশ বহন নিষিদ্ধ ছিল, ইহুদী বা খ্রিস্টান-প্রধান মহল্লায় এসব অবারিত ও প্রচলিত ছিল। বনি তগলিব গোত্রের যে-সব এতিম ও পরিত্যক্ত সন্তান ছিল, মুসলিম পিতামাতার, তাদেরকেই খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষিত করা নিষিদ্ধ ছিল, খ্রিস্টান পিতামাতার সন্তানদের জন্য নয়। খায়বারের ইহুদীদের ও নাজরানের খ্রিস্টানদের মুসলিমবিদ্বেষ, স্বদেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে রোমকদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার কাহিনী ইতিহাস-বিশ্রুত। বিশ্ব-নবীর সময় থেকে বারেবারে তারা মুসলিদেরকে হয়রান করেছে, আরবের নিরাপত্তা বিপন্ন করেছে। এ জন্যেই তাদের ইরাক ও সিরিয়ায় স্বধর্মীদের মধ্যেই বসবাস করবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এ-সব সুবিধা দান করার ফরমান দিয়ে : সিরিয়া ও ইরাকের যেখানে ইচ্ছা তারা বসবাস করতে পারবে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাদের বাসের জায়গা ও চাষের জমি দিতে বাধ্য থাকবে। স্থানীয় মুসলিমরা সব রকম সাহায্য দিয়ে তাদের পুনর্বাসন করবে। দুবছরের জন্যে তাদের জিয়া কর মাফ থাকবে।

এবার বাকী থাকে জিয়া-করের কথা।

ইসলামের গোড়া থেকেই পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, জিয়া প্রতিরক্ষার জন্যে নির্ধারিত কর, সামরিক কর্তব্য পালনের পরিবর্তে দেয়। ওমরের খেলাফতকালে এই কর ধার্যের তাৎপর্য আরও বিশদ করা হয়। প্রথমত পারস্য সম্রাট নওশেরওয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে জিয়া বিভিন্ন হারে ধার্য হতো এবং পরিষ্কাররূপে জানানো হতো, নওশেরওয়ার প্রবর্তিত করভার নয়। তিনি আরও পরিষ্কার ঘোষণা করেন, যতক্ষণ প্রতিরক্ষা দায়িত্ব নিরাপদে প্রতিপালিত হবে, যতক্ষণ জিয়া আদায়যোগ্য। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় যে, ইয়ারমুকের যুদ্ধ-সঙ্কটকালে যখন সিরিয়ার প্রতিটি শহর থেকে মুসলিম বাহিনী উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং দামেষ্ক, হিস্‌ প্রভৃতি শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন তাদের নিকট থেকে আদায়কৃত সমস্ত জিয়া কর প্রত্যার্পিত হয়। আবার যখন অধিবাসীদের নিকট থেকে সামরিক সাহায্য গ্রহণ করা হতো, জিয়া মাফ হয়ে যেতো এবং একবার সাহায্য গৃহীত হলেই সারা বছরের কর থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হতো। ১৭ হিজরীতে ওমর ইরাকের সিপাহসালারদের নির্দেশ দেন : অশ্বারোহী জিম্মী সেনাদের সাহায্য গ্রহণ করবে ও জিয়া মাফ করে দেবে। ২২ হিজরীতে আজরবাইজানের বিজিত নাগরিকদের সঙ্গে সন্ধিতে এই বিশেষ শর্ত আরোপিত হয় : যারা সেনাবাহিনীতে একবার কাজ করবে, তারা সারা বছরের জিয়া কর থেকে রেহাই পাবে। আরমেনিয়া ও শাহ্রবাজের নাগরিকদের সঙ্গে এই শর্ত ছিল : তারা প্রত্যেক সামরিক অভিযানে যোগ দিতে বাধ্য থাকবে ও শাসকের নির্দেশমতো চলবে এবং তাদেরকে জিয়া কর আদায় দিতে হবে না। জুরজান অধিকৃত হলে তাদের ফরমানে বলা হয় : আমরা তোমাদের নিরাপত্তা করতে বাধ্য এই শর্তে যে, তোমরা সাধ্যমত জিয়া আদায় দেবে, কিন্তু তোমাদের নিকট থেকে সামরিক সাহায্য গ্রহণ করা হলে জিয়া মওকুফ হবে।

এ-সব ঘোষণা সন্ধিশর্ত ও বাস্তব অনুশীলন দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে জিয়া প্রতিরক্ষা দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আদায়যোগ্য ছিল এবং জিয়া আদায় করা হতো প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তির নিকট থেকে; অন্ধ খঞ্জ প্রভৃতি আতুর ব্যক্তি এ দায় থেকে রেহাই লাভ করতো জিয়া খাতে আদায়কৃত সমস্ত কর সৈন্যদের পোশাক, খোরাক প্রভৃতি সামরিক প্রয়োজনেই ব্যয়িত হতো। জিয়া নগদ অর্থে ও ফসলাদিতে আদায় দিতে হতো। মিসরে জনপ্রতি চার দীনার জিয়া ধার্য ছিল, অর্ধেক নগদ ও অর্ধেক গম, জলপাই তেল, মধু ও সির্কায় আদায় করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে রসদ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হলে সবটা করই নগদে আদায় করা হতো।

ওমর দাস-প্রথা রহিত করেন নি এবং যুগের প্রভাব এমনই ছিল যে তাঁর পক্ষে এরূপ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে বিবিধ উপায়ে তিনি এ প্রথায় এমন বাধা সৃষ্টি করেছিলেন যার ফলে প্রথাটি নামমাত্রে পর্যবসিত হয়েছিল এবং দাসরা প্রভুর সমমর্যাদায় উন্নীত হয়েছিল। খেলাফতের ভার গ্রহণ করেই ওমর নির্দেশ দেন, যারা আবুবকরের আমলে অনুষ্ঠিত ধর্মত্যাগীদের সঙ্গে যুদ্ধে দাস হয়েছিল তারা স্বাধীন হবে। তিনি এই নিয়ম করেন, কোনও আরব দাস হতে পারে না। যদিও ইমাম আহমদ তাঁর সঙ্গে অমত হয়ে বলেছিলেন আমি ওমরের সঙ্গে একমত নই যে আরব দাস হতে পারে না-তবুও ওমরের এ অনুশাসন বাস্তাবে রূপায়িত হয়েছিল। আরবের অধিবাসীদের সম্বন্ধে ওমর এ নিয়ম প্রয়োগ না করেও বিজিত দেশসমূহে দাস-প্রথা অনেকখানি গর্ব করেছিলেন। ইরাক ও মিসর বৃহৎ দেশ এবং সেনাবাহিনীর জিদ সত্ত্বেও এ দুটি দেশের কোনও অধিবাসীকে দাস করা হয় নি। মিসরের কিছু অধিবাসীকে যুদ্ধে বিরুদ্ধতা করার দরুন দাস হিসাবে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে চালান করা হয়েছিল, কিন্তু ওমর তাদের প্রত্যেককে সংগ্রহ করে মিসরে ফেরত পাঠান ও শাসককে সাবধান করেন : তোমার উচিত কাজ হয় নি।

বসরা, দামেশ্ক্ হিম্স, হামাদ, আন্তিয়ক প্রভৃতি সিরিয়ার বহু শহরের খ্রিস্টান অধিবাসীরা প্রবল বিরুদ্ধতা করেছিল, কিন্তু তাদের কাউকে দাস করা হয় নি। ফারস্, খোজিস্তান, কিরমান, জাজিরা ও অন্যান্য স্থানের বাসিন্দাদের সঙ্গে বিশেষ শর্ত ছিল যে, তাদের কোনরূপ বিঘ্নিত হবে না। জুন্দিসাবুর, শিরাজ প্রভৃতি স্থানের বাসিন্দাদেরকে পরিষ্কার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, তাদের কোন ব্যক্তিকে দাস করা যাবে না।

ওমর আর একটি উত্তম নিয়ম করেন যে, কোনও দাসীর সন্তান হলে সে মুক্তিপ্রাপ্ত হবে। ওমর আরও নির্দেশ দেন ‘মকাতবা’ পদ্ধতিতে দাসগণ মুক্তিলাভের অধিকারী হবে। এটা একটা চুক্তি-যদি কোনও দাস নির্দিষ্ট সময় মধ্যে চুক্তিকৃত মুক্তিপণ আদায় দেয় না তা হলে সে মুক্তি পাবে। কোরআনে একটি বাণী আছে : যদি তারা ভালো হয়, তাদের সঙ্গে চুক্তি কর। ওমর এ থেকেই এরূপ চুক্তি বিধিবদ্ধ করেন। সহীহ্ বুখারীতে উক্তি আছে : সিরিন নামক আনাসের দাস এরূপ চুক্তির প্রস্তাব করলে আনাস অস্বীকার করেন। তখন সিরিন খলিফার নিকট অভিযোগ করে। ওমর আনাসকে বেত্রঘাত করে কোরআনের বিধান পালন করতে নির্দেশ দেন যে, দাসগণকে অতি নিকট আত্মীয় থেকে পৃথক করা চলবে না। অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রীকে, দুই ভাইকে, মাতা-সন্তানকে পৃথক করা বা দাসত্বে রাখা যাবে না।

ওমর দাসগণের প্রতি যে সহৃদয় ব্যবহার করতেন, তার তুলনা হয় না। বদরের ও অন্যান্য যুদ্ধকালে যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তাদেরকে বৃত্তিদানকালে তিনি দাস ও প্রভুকে সমান হারে বৃত্তি দিয়েছিলেন। তিনি প্রাদেশিক শাসকদের নিকট থেকে রিপোর্ট চাইতেন, দাসদের প্রতি সুনজর রাখা হয় কি-না। ওমর নিজে দাসদের সঙ্গে একাসনে বসেছেন, যারা দাসের সঙ্গে আহারে বসতে লজ্জাবোধ করে, তাদের উপর আল্লাহ্ অভিশাপ হোক। একবার একজন দাস নগরবাসীদের নিরাপত্তা দান করেছিল, ওমর এ- প্রতিশ্রুতি মুসলিমের উপর বাধ্যকররূপে গ্রহণ করেছিলেন।

দাসগণের প্রতি এমন মহৎ ব্যবহারের ফলে তাদের মধ্যে বহু প্রতিভার উন্মেষ হয়েছে, বহু মনীষীর সাক্ষাৎ মেলে। হাদীসের অন্যতম ইমাম ও ফকীহ্ ইকরামা ইমাম মালেকের ওস্তাদ ও হাদিস সাহিত্যের সোনালী শৃঙ্খলরূপে সম্মানিত নাফী দাস ছিলেন এবং ওমরের যুগে প্রখ্যাত হয়েছিলেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন, মদীনাবাসীরা দাসী ও তাঁর সন্তানকে অবজ্ঞার চোখে দেখতো, কিন্তু আবুবকরের পৌত্র কাসিম, ওমরের পৌত্র সলিম ও ইমাম জয়নুল আবেদীন দাসীপুত্র হয়েও শিক্ষায় ও চরিত্রবলে শীর্ষস্থানে উঠেছিলেন তখন থেকেই মদীনাবাসীরা দাসদের সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহার ও সম্মান করতে শেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *