খেলাফতের প্রতিষ্ঠায়

খেলাফতের প্রতিষ্ঠায়

রসূলে-আকরমের ওফাতের পর ওমরের মনে যে প্রশ্নটি প্রবল হয়ে উঠেছিল তা হচ্ছে : মুসলিমদের ভাগ্যে কি হবে?

বস্তুত আঁ-হযরতের উত্তরাধিকার নিয়ে যে প্রশ্ন প্রবল হয়ে ওঠে, তার সমাধান সহজ ছিল না। তাঁর কোনও পুত্র-সন্তান জীবিত ছিল না। সন্ততিদের মধ্যে একমাত্র জীবিত ছিলেন ফাতেমা-জোহরা, আলীর সহধর্মিণী। উত্তরাধিকারের কোনও বাঁধা পদ্ধতি ছিল না; এবং আঁ-হযরতও এ-সম্বন্ধে কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে যান নি। আরবের রীতি ছিল গোত্রীয় রীতি-সাধারণ গোত্রীয় সরদার বা শেখ নির্বাচিত হতেন বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার কিংবা উপযুক্ততার গুণে। মদিনার আনসারগণ আরবের অন্য গোত্রসমূহ থেকে ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন না, এজন্যে তাঁরা এ-প্রথার চিন্তা করতে পারেন নি। তাঁরাই সর্বপ্রথমে উপলব্ধি করেন, এই উত্তরাধিকারী বা নতুন নেতার নির্বাচন কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থপূর্ণ হবে। এ-জন্যে আঁ-হযরতের ওফাত সম্বন্ধে নিশ্চিত সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ-বিষয়ে অসম্ভব তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বলা বাহুল্য, আনসারগণই তৎপর হন নি, আরও দাবীদার উপস্থিত হন। কিন্তু এই অধ্যায়ের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ও লজ্জাকর দিক এই যে, রসূলে আকরমের নশ্বর দেহ সমাহিত করার সব ব্যবস্থা রইলো উপেক্ষিত, আর যাঁরা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর প্রতি ভক্তিতে, প্রীতিতে ও আনুগত্যে ছিলেন উচ্চকণ্ঠে, তাঁরাই অতি-ব্যগ্র হয়ে উঠলেন, যাতে রাষ্ট্রপ্রধানের আসন তাঁদের হস্তচ্যুত না হয়ে যায়।

খেলাফতের প্রশ্নে মদিনাবাসী মুসলিমরা এই তিনটি সুস্পষ্ট দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে : প্রথম, আনসারগণ। তাঁরা মদিনার আদি অধিবাসী, রসূলে আকরমের সাহায্যকারী এবং ইসলামের নতুন আশ্রয়দাতা। তাঁরা প্রকাশ্যেই দাবী করেন, তাঁদের সাহায্য ব্যতীত ইসলাম ভীষণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতো, অতএব তাঁদের মধ্য থেকেও মুসলিমদের খলিফা নির্বাচিত হওয়া উচিত। ওবায়দাহ্ ছিলেন তাঁদের নেতা।

দ্বিতীয়, মুহাজেরীন। তাঁদের দাবীর যৌক্তিকতা এই যে, তাঁরা আঁ-হযরতের গোত্রীয়, ইসলামে প্রথম-দীক্ষিত ও হযরতের সুখে দুঃখে সমভাগী হিসেবে জন্মভূমি ত্যাগ করে মদিনায় আগত। তাঁরাই ছিলেন আঁ-হযরতের নিকটতম সাহাবা। ওমর আবুবকর প্রমুখ ছিলেন তাঁদের নেতৃস্থানীয়।

তৃতীয়, বানু-হাশিম গোত্র, যাঁদের মুখপাত্র ছিলেন বিবি ফাতেমার স্বামী আলী। তাঁদেরকে বলা যায়, জন্ম-স্বত্বদাবীর, কারণ তাঁদের বিশ্বাসই ছিল যে, আঁ-হযরতের চাচাতো ভাই এবং একমাত্র জীবিত জামাতা হিসেবে তিনিই খেলাফতের যোগ্যতম দাবীদার। তাঁরা আরও বিশ্বাস করতেন যে, আলীর খেলাফতের দাবী ইলাহী স্বত্বাধিকার, কারণ রসূলের উত্তরাধিকারের মতো মহৎ অধিকার মানুষের ইচ্ছাধীন হতে পারে না।

সমসাময়িক বিবরণী থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, রসূলে আকরমের ওফাতের অব্যবহিত পরেই আনসারগণ সাকিফাহ্-বানু-সাঈদায় সমবেত হন ও নিজেদের মধ্য থেকে খলিফা নির্বাচনের বিষয় আলোচনা করতে থাকেন। লোক-মুখে এ সংবাদ পেয়েই ওমর আবুবকরকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। আলী ও ফাতেমার গৃহে বানু- হাশিম গোত্রের সভায় উপস্থিত হন। এ-সম্বন্ধে সহীহ্ বোখারী থেকে ওমরের উক্তি বিশেষ স্মরণীয়।

আমাদের ভাগ্যে এরূপ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আঁ-হযরতের ওফাতের পর আনসাররা একটি পৃথক জোটে বিভক্ত হয়ে যান এবং সাকিফাহ্-বানু-সাঈদায় একত্র হয়ে আমাদের বিপক্ষতা করতে থাকেন। অন্যদিকে আলী, জুবায়ের ও তাঁদের অনুগামীরাও আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। তখন অবস্থা এই যে, মুহাজেরীন আবুবকরের অধীনে একত্র হন।

ওমরের এ ভাষণ দেওয়া হয়েছিল পরবর্তীকালে এক বিশাল জনতার সম্মুখে, যেখানে বহুশত বিশিষ্ট সাহাবা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এ উক্তির কোনও প্রতিবাদ ওঠে নি। অতএব এরূপ অনুমান সমীচীন হবে না যে, এ উক্তি বাস্তব ঘটনার বিপরীত ছিল।

এখন বিবেচ্য এই যে, এরূপ বিভিন্ন জোটে বিভক্ত মুসলিমদের শেষ পরিণতি কী হতে পারতো?

হযরতের ওফাতের সময় মদিনায় বহু দুষ্কৃতমনা মুনাফেক ছিল, যারা শুধু ইসলামের প্রতিষ্ঠাতার মৃত্যুর অপেক্ষায় ছিল, তার উপর মৃত্যুবাণ হানতে। এরূপ কঠিন সময়ে শোকাচ্ছন্ন হওয়ার চেয়ে বেশি দরকার হয়ে উঠেছিল, ঝটিতি খলিফা মনোনীত করে ফেলে এবং অবস্থা আয়ত্তে আনয়ন করে শৃঙ্খলা স্থাপন করা। আনসারগণ সঙ্গোপনে নিজেদের মধ্যে খেলাফতের প্রশ্ন আলোচনা করে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছিলেন। অথচ এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কোরায়েশরা তাঁদের চক্ষে হেয় আনসারদের কর্তৃত্ব কখনই মাথা পেতে নিতেন না। তাছাড়া সারা আরবের কোনও গোত্রও আনসারদের প্রাধান্য স্বীকার করতো না। সাকিফায় আবুবকরের একটি উক্তি থেকেই এ-মতের পোষকতা মিলে : আরবদের অধিবাসীরা কখনও এরূপ মনোনয়নে স্বীকৃত হবে না, অন্তত যতদিন কোরায়েশরা জীবিত থাকবে।

এই সঙ্কটমুহূর্তে ওমরের কৃতিত্ব হচ্ছে কালের ঝুঁটি ধরে ঘটনাস্রোতের গতিরোধ করা এবং বিন্দুমাত্র সময় অপব্যয় না করে আবুবকরের হাতে হাত রেখে বায়আত বা বশ্যতা স্বীকার করা। তাঁর এ সিদ্ধান্তের পিছনে বলিষ্ঠ যুক্তিও ছিল: দাবীদারদের মধ্যে আবুবকর ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ, সবচেয়ে ব্যক্তিত্বশালী এবং সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি।

ওমর বায়আত কালে বলেছিলেন: আবুবকর! হযরত কি নির্দেশ দেন নি যে, আপনি মুসলিমদের নামাযে ইমামতি করবেন? আপনি খলিফায়ে রসূল এবং আমি আপনার হাতে বায়আত করছি এই কারণে যে, আপনি আমাদের সকলের চেয়ে রসূলের প্রিয়বন্ধু ছিলেন।

এমন অকাট্য ও অন্তরস্পর্শী যুক্তির পর আর মতভেদ থাকতে পারে? স্বয়ং আবু ওবায়দাহ্ সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে আবুবকরের হাতে বায়আত করলেন। আনসারদের ঐক্য ভেঙ্গে গেল এবং ওবায়দাহ্ ব্যতীত সকলেই আবুবকরের বশ্যতা স্বীকার করলো। তখন সকলে মসজিদে নববীতে উপস্থিত হলেন। সেখানে ওসমান আবদুর রহমান ইনে আউফ আবুবকরের বশ্যতা স্বীকার করলেন। তারপর বিশ্বনবীর পবিত্র দেহাবশেষ সমাহিত করার সুব্যবস্থা করা হয়।

পরদিন আবুবকর মসজিদে-নববীতে উপস্থিত হলে উপস্থিত জনগণকে ওমর এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দান করেন ও বলেন : ‘আল্লাহ্ তোমাদের কর্মসূত্র এমন এক ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন, যিনি আমাদের সবার উত্তম। তিনি রসূলুল্লাহ্ প্রিয়বন্ধু, আর যখন দুজনে গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, তখনও ছিলেন প্রিয়সঙ্গী। অতএব, তোমরা সকলেই তাঁর হাতে বায়আত করো।’ তখন সকলেই দণ্ডায়মান হয় এবং সকিফাহ্-বানু- সাঈদার পর দ্বিতীয়বার সর্বসাধারণের বশ্যতা গ্রহণ পর্ব সমাধা হয়।

একমাত্র ভিন্নমত পোষণকারী জোট রয়ে গেলেন বানু-হাশিম ও তাঁদের নেতা আলী। বানু হাশিম আলী ব্যতীত অন্য কোন ও ব্যক্তির নিকট নতি স্বীকার করতে স্বীকৃত হন নি। যতদিন বিবি ফাতেমা জীবিত ছিলেন ততদিন আলী বায়আত করেন নি। সহীহ্-বুখারীর খয়বর যুদ্ধের অধ্যায়ে একটি উক্তি আছে যে, আবুবকরের নির্বাচনের ছয়মাস পরে বিবি ফাতেমা জোহরার ওফাত হলে পর আলী আবুবকরের নিকট বায়আত গ্রহণ করবার উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। কিন্তু আলী একথাও বলে পাঠান যে আবুবকর একাকী আসবেন, কারণ ওমরের উপস্থিতি তাঁর পছন্দ নয়।

আলী ইবনে-আবিতালিব এবং বানু-হাশিম যে উপযুক্ত আবুবকরের বায়আত করেন নি, তার কারণ নির্দেশে ওমরের রূঢ় ব্যবহার ও অতি ব্যগ্রতা হেতু আলীর বিরক্তি সৃষ্টি হওয়ার দিকে অনেকে ইঙ্গিত করেছেন। এর সত্যতা একেবারে অস্বীকৃত না হলেও আসল কারণটি কি ছিল, তা নির্ণয় করা শক্ত। তবে ইতিহাসের সাক্ষ্যে এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় না যে, আলী ও বানু-হাশিম অন্য মুসলিমদের মতো নির্দ্বিধায়, একসঙ্গে আবুবকরের বায়আত কবুল করেছিলেন। প্রকৃত কারণ এই যে, রসুল-নন্দিনী ফাতেমা জোহরা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আবুবকরের প্রতি বিমুখ ছিলেন। আবুবকর তাঁকে পিতৃসম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন, এ জন্যেই তাঁর বিরাগ সৃষ্টি হয়েছিল? কিংবা তিনি স্বামী আলীকে খেলাফতের প্রশ্নে আবুবকরের চেয়ে যোগ্যতর মনে করতেন? এসব প্রশ্নের জওয়াবে যথেষ্ট মতভেদ আছে, কিন্তু একথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, ওমর আবুবকরের সঙ্গে এ সিদ্ধান্তে একমত ছিলেন যে, নবীর উত্তরাধিকার সদকাহ্, যার কেউ ব্যক্তিগত উত্তরাধিকারী হতে পারে না। আর ওমরের এ সিদ্ধান্তই ফাতেমা জোহরার সমূহ বিরাগের কারণ হয়। এখানে প্রশ্ন ওঠে যে, ফাতেমা জোহরার এই বিরাগই কি আলীর বায়আতে অস্বীকৃতি এবং ওমরের তাঁদের প্রতি অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল, যার দরুন ওমর নিজের হাতেই খলিফা নির্বাচনের বিষয়টি একান্তভাবে গ্রহণ করেছিলেন? আসল কারণ যাই হোক, এর পরিণতিতে ইসলামের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যার দুরপনের প্রভাব আজও দূরীভূত হয় নি। এবং যার কম বেশি প্রকাশ আজও শীয়া ও আলী পন্থীদের ব্যবহারে সুস্পষ্ট। তাঁরা ওমরকে শুধু অশ্রদ্ধাই করেন না, বরং বিরাগযুক্ত বিরূপ দৃষ্টিতেই দেখে থাকেন।

একথা অনস্বীকার্য যে, ওমরের প্রকৃতিই ছিল উগ্র ও কোপন স্বভাবের। এবং এই সংকট মুহূর্তে ফাতেমা জোহরার গৃহ বানু-হাশিমের যড়যন্ত্রের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হওয়া তিনি বরদাশত করতে পারেন নি। এ-জন্যে এ বিষয়ে তাঁর ব্যবহারে রূঢ়তা ও অতি- ব্যগ্রতা নবী-নন্দিনীর চক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। তবু এ-কথা অস্বীকার করা চলে না যে, ওমরের আচরণে কোমলতা না থাকলেও পরিস্থিতি উপলব্ধিতে ও ঘটনাস্রোত বিশ্লেষণে তাঁর এতটুকু ভুল হয় নি, দৃষ্টি বিভ্রান্তি হয় নি এবং দৃঢ়তার অভাব হয় নি। এ-জন্যেই যড়যন্ত্রের অঙ্কুরেই বিনাশ সাধন সম্ভব হয়েছিল। যদি বানু-হাশিমের ষড়যন্ত্র ও কুমন্ত্রণা উপেক্ষা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি এরূপ ভীষণ ঘোরালো হয়ে উঠতো, যার দরুন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের, ঐক্যের ও শৃঙ্খলার মূলেই কুঠারাঘাত করা হতো এবং তার ফলে তখনই এমন অন্তর্বিপ্লব আরম্ভ হয়ে যেতো, যা আলী ও মাবিয়ার মধ্যে পঁচিশ বছর পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এ সব কার্যকলাপ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করিলে সহজেই প্রতীয়মান হয়, খেলাফতের প্রতিষ্ঠায় ওমরের ভূমিকা ও কৃতিত্ব কী পরিমাণের ছিল।

আবুবকরের খেলাফত দুবছর তিন মাস স্থায়ী ছিল। তাঁর ওফাত হয় তের হিজরীর জয়াদিউস্-সানি মাসের তেইশ তারিখে (২২শে আগস্ট, ৬৩৪ খ্রি.)। বলা বাহুল্য যে, তাঁর আমলে অনুষ্ঠিত প্রত্যেকটি কর্মে ওমরের ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং ওমরের উপদেশের গুরুত্বও ছিল তাঁর চক্ষে অনেকখানি। এ সবের বিস্তৃত পরিচয় মিলবে আবুবকর সিদ্দীকের জীবনীতে এবং এখানে সে-সবের উল্লেখ পুনরুক্তি হবে বিবেচনায় বর্জন করা গেল। কেবল একটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করে তার ইঙ্গিত মাত্র দেওয়া যেতে পারে।

খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পরদিন আবুবকর বাজারে তাঁর দোকানে যাচ্ছিলেন। পথে ওমরের সঙ্গে দেখা। ওমর জিজ্ঞাসা করলেন: আপনি কোথায় চলেছেন? আবুবকর জওয়াব দিলেন: কেন, বাজারে, নিজের দোকানে। ওমর বললেন: আপনি যদি দোকানে বসে থাকেন, তবে দেশের শাসন চালাবেন কী করে? আবুবকর বললেন: কিন্তু আমার ঘর-সংসার চলবে কী করে?

ওমর চিন্তা করলেন সত্যিই তো খলিফার অন্য-সংস্থান না হলে দেশের শাসন চলবে কি করে! তখনই তিনি প্রধান সাহাবাদের মজলিশ ডেকে স্থির করে ফেললেন, একজন মানুষের দৈনিক যা খরচ লাগে, সেই পরিমাণ হিসেবে আবুবকরের সংসারে বায়তুল-মাল থেকে রোজ বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি সংসারের অন্য কোনও কাজ- কারবার করতে পারবেন না। এভাবে খলিফার বরাদ্দ স্থির হয় ওমরের মধ্যস্থতায়। এখানে আর একটি কাহিনীর উল্লেখ করে আবুবকরের ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না। উপরোক্ত বরাদ্দমতে আবুবকরের সংসার চলতে লাগলো। একদিন তাঁকে হালুয়া খেতে দেওয়া হলো। তিনি স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন: হালুয়া কে সওগাত পাঠিয়েছে? স্ত্রী বললেন: কেউ পাঠায় নি। আমি দৈনিক বরাদ্দ থেকে কিছু বাঁচিয়ে হালুয়া তৈরি করেছি। আবুবকর শঙ্কিত হয়ে জানতে চাইলেন, উদ্বৃত্তের পরিমাণ কতো স্ত্রী পরিমাণ জানালে ধর্মভীরু আবুবকর তখনই বায়তুল-মালের রক্ষককে নির্দেশ দিলেন, সে পরিমাণ বরাদ্দ কম দিতে।

বহুদিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে আবুবকরের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে, তাঁর পরে খেলাফতের গুরুভার দায়িত্বগ্রহণের যোগ্যতা রয়েছে একমাত্র ওমরেরই। তবু জীবন-সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এল তখন আবুবকর একবার লোকমত যাচাই করতে চাইলেন। তিনি স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে নিজেই উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাবেন। আঁ-হযরতের ওফাতের পর খেলাফতের প্রশ্ন নিয়ে আনসারদের জোট পাকানো এবং সকিফাহ্-বনি সাঈদার কার্যক্রম তাঁর চোখে ভেসে উঠলো। পুনরায় যদি তাঁর মৃত্যুর পর এই প্রশ্ন নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয় তাহলে তার সমাধান নিশ্চয়ই সহজ হবে না। এবার এ প্রশ্নের সমাধান আনসার-মুহাজেরদের মধ্যেই সীমিত থাকবে না। ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধরত মুজাহিদের মধ্যেও মতভেদ ছড়িয়ে পড়িবে; এবং তারা ইতিমধ্যেই ইরান ও রোম-সম্রাটের শক্তির স্বাদ পেয়েছে। এবার যদি একই প্রশ্ন পুনরায় প্রবল হয়ে ওঠে, তা হলে সারা আরবে তা বিস্তৃত হয়ে পড়বে এবং তার ফলে আরদ্ধ সকল কর্মই পণ্ড হয়ে যাবে। কিন্তু তিনি কাউকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলে এবং মুসলিমগণ তাঁকে স্বীকার করে নিলে বিষয়টার সহজ সমাধান হয়ে যাবে। তিনি আরও চিন্তা করছিলেন: রসুলুল্লাহ নিজের খলিফা মনোনীত করে যান নি। তার কারণ এই ছিল, পাছে জনগণ ভেবে বসে যে, এরূপ মনোনয়ন ওহী রব্বানীর সমর্থিত ছিল এবং সে খলিফা হতেন খলিফাতুল্লাহ নামাঙ্কিত। কিন্তু আবুবকর যদি কাউকে নিজের খলিফা মনোনীত করেন, তাহলে এরূপ সংশয় সৃষ্টির অবকাশ থাকে না, অথচ মুসলিমরাও মতবিরোধের শিকার হয় না। অন্যদিকে ইসলামী এলাকা বিস্তৃতির কাজও পূর্ণবিক্রমে চলতে থাকে। কিন্তু ওমরেরই খলিফা হওয়া এবং সমগ্র জনগণের তাতে সম্মতি থাকাও একান্ত দরকার। যদি জনগণকে ওমরের খেলাফতীতে একমত করানো যায়, তাহলে আল্লাহ্ দৃষ্টিতেও ইসলামের উন্নতি ও সাফল্যের হেতু হবে।

এ সব ভেবে-চিন্তে আবুবকর প্রথমে আবদুর রহমান ইবনে আউফকে এবং ওমরের মনোনয়ন সম্বন্ধে তাঁর মতামত চাইলেন। আবদুর রহমান বললেন, আপনার ওমর সম্বন্ধে যা ধারণা, ওমর তারও অনেক উচ্চে কিন্তু মেজাজ বড়ো উগ্র। আবুবকর বললেন, আমার কোমল প্রকৃতির পরিপূর্ণতার্থেই তার এই উগ্রতা। কিন্তু দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লেই উগ্রতা প্রশমিত হয়ে যাবে। আমি বিশেষ ঘনিষ্ঠভাবেই তাকে পরীক্ষা করে দেখেছি, আমি যখন রাগান্বিত হয়েছি, সে তখন নরম হতে চেষ্টা করেছে, আর আমি নরম হলে সে উগ্র হয়েছে।

তারপর ওসমানকে ডাকানো হয় এবং তাঁর অভিমত চাওয়া হয়। ওসমান বললেন, আল্লাহ্ উত্তম জানেন। আমার যতদূর ধারণা, তাঁর বাইরের চেয়ে ভিতরটা অতি উত্তম এবং আমরা কেউ তাঁর সমকক্ষ নই। ওসমান চলে গেলে সঈদ-ইবনে জায়েদ, আসাদ ইবনে-হুজায়ের এবং আরও আনসারী ও মুহাজেরীনকে ডেকে মত চাওয়া হয়। অন্য সাহাবাগণ যখন আবুকরের এ অভিপ্রায় অবগত হয় তখন তারা আশঙ্কা করেন যে, ওমর খলিফা হলে তাঁর রুঢ় ও কোপন স্বভাব মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে। অতএব তাঁকে ইচ্ছা থেকে বিরত করতে হবে। এরূপ চিন্তা করে তাঁরা আবুবকরের সমীপে উপস্থিত হন। তাঁদের মধ্যে তালহা নিজের ভীতি প্রকাশ করে বললেন: আপনি যথেষ্ট জানেন, আপনার জীবদ্দশাতেই ওমর কী রকম রূঢ়ভাবে আমাদের সঙ্গে ব্যবহার করেন। আল্লাহ্ জানেন, খেলাফতের দায়িত্ব হাতে পেলে তিনি আমাদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করবেন। আপনি তো আমাদেরকে চিরকালের জন্যে ছেড়ে যাচ্ছেন, অথচ আমাদের ভাগ্য এমন একজন লোকের হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন, যে কঠোর হাতেই আমাদের উপর শাসন চালাবে। আপনি আল্লাহ্র নিকট আমাদের সম্বন্ধে কী জবাবদিহি করবেন?

আবুবকর কিঞ্চিৎ উষ্ণভাবেই জওয়াব দিলেন: আমায় আল্লাহ্র ভয় দেখাচ্ছো? জেনে রাখো, আমি আল্লাহকে বলবো, আমি আপনার বান্দাদেরকে এমন একজনের হেফাজতে রেখে এসেছি যে, সবার শ্রেষ্ঠ।

এ কথা বলেই ওমর ওসমানকে তলব করলেন এবং ওসিওনামা লিখতে নির্দেশ দিলেন। ভূমিকাটুকু বলে দেওয়ার পরই আবুবকর মূর্ছিত হলেন। ওসমান কিন্তু লিখেই চললেন: আমি এতদ্বারা ওমরকে খলিফা নিযুক্ত করলেম। মূর্ছাভঙ্গের পর আবুবকর ওসমানকে নির্দেশ দিলেন, লিখিত অংশ পড়ে শোনাতে। সবটুকু শোনা শেষ হলেই আবুবকর বলে উঠলেন: আল্লাহু আকবর! আল্লাহ্ তোমায় পুরস্কৃত করবেন।

অতঃপর ওসিওনামাখানি একজন অনুচরের হাতে দিয়ে আবুবকর নির্দেশ দিলেন, সমবেত জনগণকে উচ্চস্বরে পড়ে শোনাতে। তারপর তিনি অলিন্দে উঠে জনগণকে সম্বোধন করলেন: আমি আমার কোনও আত্মীয় স্বজনকে খলিফা নিযুক্ত করি নি, আমি ওমরকে নিযুক্ত করেছি। তোমরা এ বন্দোবস্ত পছন্দ কর? জনগণ একবাক্যে প্রত্যুত্তর করলো: আমরা আপনার বাণী শুনেছি আপনার নির্দেশ শিরোধার্য করছি।

আবুবকর মহাপ্রশান্তি অনুভব করলেন। তারপর ওমরকে উপদেশ দান করলেন, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যেতে। আরও স্মরণ করিয়ে দিলেন, খলিফাতুল-মুসলেমীন হিসাবে কোন্ কোন্ কর্তব্যের মধ্য দিয়ে আল্লাহ্ সন্ধান মিলে। আল্লাহ্ সর্বদাই আসেন করুণাধারায়। তিনি রুদ্র আলোকেও আসেন, যাতে মানুষ তাঁর কথা ভুলে না যায় এবং তার পক্ষে যা বৈধ নয়, তার জন্যে লালায়িত না হয়। এ-ভাবেই সে অদৃশ্য সবকিছুর মধ্যে মৃত্যুকে সবচেয়ে শ্রষ্ঠ বন্ধু মনে করে।

ওমর খেলাফতের গুরুদায়িত্ব অনুভব করে অভিভূত হয়ে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *