মিসর বিজয়
মিসর, সিরিয়া ও হিজাযের মারাত্মক কাছাকাছি থাকায় তার সামরিক কৌশলসুলভ অবস্থিতি, শস্য-উৎপাদিকা মাটির গুণে কনস্ট্যান্টিনোপলের শস্যভাণ্ডার হিসাবে পরিচিত, তার রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ার বাইজান্টাইন নৌশক্তির কেন্দ্রস্থলরূপে খ্যাত এবং উত্তর আফ্রিকার প্রদেশাদ্বাররূপে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার-এ সব কারণেই এই নীলনদবাহী উপত্যকাভূমি আরব জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাদের রাজ্যবিস্তৃতির প্রথম যুগেই।
মিসর বিজয়ের কৃতিত্ব একমাত্র আমর-বিন-আসের প্রাপ্য। যৌবনকালে তিনি বাণিজ্যব্যপদেশে মিসর সফর করেছিলেন, এজন্যে মিশরের ধনসম্পদ, শহর, জনপদ, মায় অলিগলি সমস্তই তাঁর সম্যক চেনাজানা ছিল। তার বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী খালিদের মতোই একটা বৃহৎ জয়ের আশা তাঁকে প্রলুব্ধ করে মিসর অভিযান করতে। আমর একজন কোরায়েশ, এবং যুদ্ধপ্রিয় তীক্ষ্ণ কূটনীতিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আমীর মু’আবীয়াকে খেলাফত অধিকার করতে সাহায্য করেন এবং মু’আবীয়া কর্তৃক ‘ইসলামে চার জন আরব রাজনীতি বিশারদের একজন হিসেবে কীর্তিত হন। এ-কথা অনস্বীকার্য যে ঝানু রাজনীতিজ্ঞের মতোই তিনি সুবিধামাফিক ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য জ্ঞান পরিহার করে চলতেন।
ওমর যখন জেরুজালেমে সফর করেছিলেন, তখন এই আমর-বিন্-আস্ তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করেন, মশহুর ফেরাউনদের দেশে অভিযান করতে। ওমর প্রথমে এ- ঝুঁকি নিতে গর-রাযী হন, কিন্তু আমরের পুনঃ পুনঃ প্রার্থনায় রাষী হন এই শর্তে: যাও, এবং আশা করি জয়ী হও। কিন্তু মিসরের মাটিতে পা ফেলার পূর্বে যদি আমার চিঠি পাও, তা হলে বিনা ওজরে প্রত্যাবর্তন করবে। আদেশ শিরোধার্য করে চার হাজার সৈন্যর এক বাহিনী নিয়ে আমর মিসর অভিযানের অগ্রসর হন। তিনি আরিশ নামক স্থানে উপস্থিত হলেই ওমরের পত্র পান। কিন্তু তখন তিনি মিসরের মাটিতে পদার্পণ করেছেন, এ জন্যে ওমরের নিষেধে ভ্রূক্ষেপ না করে অগ্রসর হন। উল্লেখযোগ্য যে, আমর বাহিনী নিয়ে সমুদ্রোপকূলবর্তী সেই মহাপথ বেয়ে অভিযান করেন, যে পথে পূর্বকালে গিয়েছেন হযরত ইব্রাহীম, ক্যাবিসেস, আলেকজান্দার, অস্তিওকাস এবং পরবর্তীকালে নেপোলিয়ান ও জামাল পাশা।
আরববাহিনী যে-দুর্গটি আক্রমণ করে, তার নাম ফারমা (জানুয়ারী ৬৪০ খ্রি.) এটি ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী জনবহুল নগরী, এবং প্রসিদ্ধ গ্রীক চিকিৎসাবিশারদ গ্যালেন বা জালিনুসের (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক) সমাধিক্ষেত্র ধারণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। একমাস আত্মরক্ষার পর শহরটি আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর আমর ফুস্তাতের দিকে অগ্রসর হন এবং পথপাশের বাবিস্ ও অন্যান্য শহর দখল করেন। সেকালে ফুতাত ছিল নীলনদ ও মাক্তম্ পর্বতের মধ্যবর্তী হরিৎ শস্যক্ষেত্র-শোভিত উপত্যকা। এখানে ব্যাবিলন নামে একটি সুরক্ষিত কিল্লা ছিল, এবং রোম সাম্রাজ্যের মিসরীয় রাজপ্রতিনিধির রাজধানী ছিল। আমর এই গুরুত্বপূর্ণ শহরটি অবরোধ করেন। মাকাকিস্ বা সাইরাস ছিলেন তৎকালীন মিসরীয় রাজপ্রতিনিধি। তিনি একদল সুশিক্ষিত রোমবাহিনী নিয়ে আমরকে বাধা দেন। আমর আইন্-শামস নামক প্রান্তরে শিবির স্থাপন করেন ও সাহায্য প্রার্থনা করে মদীনায় দূত পাঠান। শীঘ্রই জুবায়ের-বি- আওয়াম নামক প্রবীণ সাহাবার নেতৃত্বে সাহায্যবাহিনী উপস্থিত হয়। তখন মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় দশ হাজার এবং বিপক্ষদলের সৈন্যসংখ্যা ছিল বিশ হাজার; তা ছাড়াও দুর্গস্থিত সৈন্যসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। প্রথম যুদ্ধেই রোমকবাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যায় এবং তাদের সিপাহসালার থিওডোরাস আলেকজান্দ্রিয়ায় পলায়ন করেন। শাসক সাইরাস ব্যাবিলন দুর্গে আত্মরক্ষা করেন। সাত মাস ধরে অবরোধ চলে কিন্তু দুর্গের পতন হয় না। শেষে সাইরাস মনোবল হারিয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেন। আমর তিনটি শর্ত দান করেন: আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তা হলে আপনি ও আপনার সকল প্ৰজা আমাদের ভ্রাতৃস্থানীয় হবেন। যদি তা স্বীকার করেন, তা হলে জবরদস্তি নেই, তবে আপনাদেরকে জিয়া দান করতে হবে। তখন আমরা আপনাদের কোনও ক্ষতি করবো না, বরং আপনাদেরকে ক্ষমা করতে বাধ্য হবো। আর তাও যদি স্বীকার না করেন, তা হলে যুদ্ধই এ-বিরোধের মীমাংসা করবে।
বলা বাহুল্য, পক্ষপাতমূলক মানস নিয়ে অমুসলিম লেখকশ্রেণী এই শর্তগুলিকে এরূপ বিকৃত ফর্মুলা বা সূত্রে রূপায়িত করেছেন, ইসলাম: জিয়া: তরবারি। কিন্তু মুসলিমদের ধর্মজ্ঞান কতোখানি প্রবল ছিল, তাদের ন্যায়নিষ্ঠা, তিতিক্ষা ও সাম্যনীতিজ্ঞান কতো সুদৃঢ় ও উচ্চস্তরের ছিল, তার প্রমাণ মেলে সাইরাস কর্তৃক প্রেরিত দূতগণ যখন মুসলিম সিপাহসালারকে অর্থলোভে বশীভূত করার চেষ্টায় বিফল হয়ে প্রত্যাবর্তন করে তাঁকে বলেছিল: আমরা এমন একটি জাতি দেখে এলেম, যাঁদের প্রত্যেকের নিকট জীবনের চেয়ে মরণই বেশি প্রিয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তীব্র অনীহা, এবং পার্থিক কোনো কিছুর প্রতি এতোটুকু আকর্ষণ নেই। ধূলি-আসনই তাঁদের শ্রেষ্ঠ আসন এবং জানুর উপরই খাবার রেখে তাঁরা খান। তাঁদের সিপাহসালার তাঁদেরই মতো সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত; কে ছোট, কে বড় মোটেই সনাক্ত করা যায় না, প্রভু-দাস কোন সম্পর্ক নেই। এমন জাতির সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না।
যা হোক, দীর্ঘকালেও ব্যাবিলন অধিকার না হওয়ায় জুবায়ের একদিন মরণপণ করে কয়েকজন দুঃসাহসী সৈনিক নিয়ে দুর্গপ্রাকারে আরোহণ করে দুর্গে প্রবেশ করেন ও দ্বার খুলে দেন। দ্বার খোলা পেয়ে বাইরের প্রতীক্ষারত মুসলিম সেনাগণ বন্যার মত দুর্গে প্রবেশ করে। খ্রিস্টানরা দিশেহারা হয়ে পলায়ন করতে থাকে। সাইরাস অন্যন্যোপায় হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির শর্তসমূহ নির্ধারণ করতে মুসলিম দলের নেতা হিসেবে ওবায়দাবিন্-সাবিত নামক হাবশীকে দেখে তিনি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে যান। জিয়া দেওয়ার শর্তে সন্ধি স্থাপিত হয়। সাইরাস হিরাক্লিয়াসের নিকট এ- বার্তা প্রেরণ করলে সীজার তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে দোষারোপ করেন ও বলেন: কপটরা যদি যুদ্ধ করতে না পারে, তা হলে আমার মিসরস্থ অগণিত রোমক-সৈন্য আক্রমণকদের যুদ্ধসাধ মিটিয়ে দেবে। তিনি এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেন আলেকজান্দ্রিয়ায় মুসলিমদের মোকাবেলা করতে। সাইরাসকে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
আর ফুস্তাতে কিছুদিন অবস্থান করার পর আলেকজান্দ্রিয়ার দিকে অগ্রসর হন। আমর ফুস্তাতে নিজের তাঁবু উঠাবার সময় লক্ষ্য করেন একটি কবুতর ইতিমধ্যেই বাসা বেঁধেছে। তিনি তাঁবুটি যথাস্থানে রাখার নির্দেশ দিয়ে বললেন, দেখো যেন নতুন অতিথি গৃহহারা না হয়। পরবর্তীকালে আমর এ স্থলেই ফুস্তাত শহরের পত্তন করেন। যা হোক, ফুস্তাত থেকে নিকিউ শহর অধিকার করে তিনি মিসরের রাজধানী অবরোধ করেন। ইতিমধ্যে আরও একদল সাহায্যবাহিনী উপস্থিত হওয়ায় মুসলিম সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজার।
এই বিশাল বাহিনী নিয়ে আমর এক প্রত্যুষে মিসরের রাজধানীতে উপস্থিত হন। অসংখ্য সুউচ্চ প্রাসাদ ও দুর্ভেদ্য প্রাকারবেষ্টিত আলেকজান্দ্রিয়া ছিল একরূপ অভেদ্য দুর্গ। তার একদিকে ছিল আমুদ্-অলসওয়ারী নামক সুউচ্চ প্রাসাদ, তার মধ্যে ছিল সেরাপিসের মন্দির ও গ্রন্থাগার; অন্যদিকে ছিল সেন্ট মার্কের গির্জা। কথিত আছে, গির্জাটির পত্তন করেন মিসর সৌন্দর্যের রানী ক্লিওপেট্রা স্বামী জুলিয়াস সীজারের স্মৃতিরক্ষার্থে। আরও পশ্চিমে ছিল দুটি রক্তবর্ণ আওয়ান-গ্রানাইট নির্মিত সুচ, তাও ক্লিওপেট্রার নির্মিত হিসেবে কীর্তিত: আর পশ্চাদ্ভূমিতে ছিল বিখ্যাত ‘ফারস্’ যা দিনে সূর্য-রশ্মিতে ও রাতে নিজের আগুনেই চারদিক প্রতিফলিত করে রাখতো এবং পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য হিসেবে কীর্তিত হতো। এ-অগণ্য প্রাসাদ-শোভিত জনসম্পদময়ী রাজধানীর প্রতি মরুচর আরববাসীরা ততখানি বিস্ময়-বিমুগ্ধ নেত্রে তাকিয়েছিল যেমন আধুনিক গননচুম্বী প্রাসাদরাজি শোভিত নিউইয়র্কের প্রতি আগন্তুকরা তাকিয়ে থাকে। আলেকজান্দ্রিয়ার সৈন্যসংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার, তার পিছনে ছিল প্রবল বাইজান্টাইনের দুর্ভেদ্য নৌশক্তি।
আরব আক্রমকরা সংখ্যা ছিল কম, এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল কম। তাদের একটি জাহাজও ছিল না, এবং অবরোধকারী উপযুক্ত যন্ত্রপাতিও ছিল না। এজন্যে সুউচ্চ নগরপ্রাকার ভগ্ন করা তাদের সাধ্যাতীত ছিল। মাসের পর মাস ধরে অবরোধ করেও মুসলিমরা শহরটিকে কাবু করতে পারে না। সাইরাস বন্দীবাস থেকে এসে শহররক্ষার ভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষায় পর ওমর পত্র দেন আমরকে ভর্ৎসনা করে: বহুদিন মিসরের বিলাস-জীবনে অভ্যস্ত হয়ে তোমরাও খ্রিস্টানদের মতো অকর্মণ্য হয়ে পড়েছ, তা না হলে আজও যুদ্ধজয় হয় না কেন? আমর পত্র পাওয়া মাত্র সমগ্র বাহিনীকে উগ্র বক্তৃতা দিয়ে জেহাদে উদ্বুদ্ধ করবে। তার পর সকলে একযোগে আক্রমণ করবে, সৈন্যাধ্যক্ষদেরকে সম্মুখে রেখে। দেখো, এ-আক্রমণ যেন ব্যর্থ না হয়। আমর তখন সৈন্যদেরকে রণোন্মদনায় জাগিয়ে তুলে ওবায়দাহ্ বিন্ সামিত, জুবায়ের 13 মসলামাহকে বিভিন্ন দলের ভারাপর্ণ করে একযোগে আক্রমণ করেন। সে প্রচণ্ড আক্রমণের বেগ সহ্য করতে অক্ষম হয়ে শহরটি আত্মসমর্পণ করে। সাইরাস সন্ধি ভিক্ষা করেন এবং জিয়া দেওয়ার শর্তে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয় (৮ই নভেম্বর, ৬৪১ খ্রি.) বয়স্ক লোক প্রতি দুই দিনার ও জমির জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ গম আদায় দেওয়ার শর্ত হয়। রোম সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা ধনসম্পদ ও সৌন্দর্যময়ী প্রদেশ আবরদের করতলগত হয়।
আমর এই বিজয়বার্তা মদীনায় প্রদেশ নিকট নিম্নলিখিতভাবে প্রেরণ করেন: আমি এমন একটি শহর হস্তগত করেছি, যার বিশদ বর্ণনার ভাষা জানি নে। এটুকু মাত্র বলাই যথেষ্ট যে, তার চার হাজার হামামসহ চার হাজার বাগানবাড়ী আছে, চল্লিশ হাজার জিয়া করদাতা ইহুদী আছে, এবং চারশত রাজকীয় বিলাসাগার আছে। বিশ্বত্রাস খলিফা ওমরের নিকট এই মহাবিজয় বার্তা উপস্থিত হলে তিনি আল্লাহ্র দরগাহে শুকরানা নামাজ আদায় করেন, এবং বার্তাবহ মু’আবীয়া-বিন্ খুদায়েজকে আপ্যায়ন করেন যথাসম্বল কয়েকটি শুকনো খোর্মা, এক টুকরা রুটি ও সামান্য জলপাই তেল দিয়ে!
ফুতাত ও আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর সারা মিসর আমরের পদানত হয়ে পড়ে। কয়েকটি জনবহুল শহরে রোমকদের প্রাধান্য থাকায় আমর কয়েকটি সেনাদল চতুর্দিকে প্রেরণ করেন, সারা প্রদেশভূমে অভিযান চালিয়ে সব বিরুদ্ধ শক্তি নিস্তব্ধ করে দিতে। খারিজাহ্-বিন-হুদায়ফাহ্ দখল করেন ফায়ুম, আমুনীন, আীম বাদাত, মুয়াদ প্রভৃতি অঞ্চল এবং এসব এলাকার অধিবাসীদের জিয়া দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ওমর- বিন্-ওহাব দখল করেন তানিস, দিনিয়াত, তুনা, দামিরাস, শাতা ও কালা, বনাহ ও বহির এবং ওবাহ-বিন্-আমীর সমগ্র নিম্ন মিসরভূমিতে দখল কায়েম করেন।
আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক মিথ্যাময়ী কাহিনীর প্রচলন দেখা যায়। কাহিনী হচ্ছে, ওমরের আদেশক্রমে আমর শহরের সমস্ত চুল্লিতে ছ’মাস ধরে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর হাজার হাজার পুস্তক অগ্নিদগ্ধ করেন। এরূপ গ্রন্থদগ্ধরূপ মহাযজ্ঞের কারণ হিসেবে বলা হয়, ওমর এ কর্মের নির্দেশ দেন এই যুক্তিতে-যদি গ্রন্থসমূহে কোরআনের বিপরীত শিক্ষা থাকে, তা হলে সেসব অপাঠ্যও ধ্বংসযোগ্য এবং যদি কোরআনের সমর্থক শিক্ষা থাকে, তা হলে সেসব ফজুল ও অপ্রয়োজনীয়, অতএব ধ্বংসযোগ্য। বলাবাহুল্য, কল্পকাহিনী হিসেবে তার কিছু আদর থাকলেও ইতিকাহিনী হিসেবে কিছুমাত্র মূল্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জুলিয়াস সীজার কর্তৃক সুবৃহৎ টলেমী গ্রন্থাগারটি খ্রিস্টপূর্ব ৪৮ অব্দে ভস্মীভূত হয়। পরবর্তীকালে এখানেই দ্বিতীয় বৃহৎ কন্যকা-গ্রন্থাগার ৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে অগ্নিদগ্ধ করা হয় সীজার থিওডোসীয়াসের এক ফরমান বলে। অতএব আরব অধিকারের সময় আলেকজান্দ্রিয়ায় কোনও গ্রন্থাগারই ছিল না। আর এ-জন্যে কোনও সমসাময়িক ইতিহাসকার আমর কিংবা ওমরের বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগ করেন নি। ৬২৯ হিজরীতে (১২৩১ খ্রি.) আবদুল লতিফ বাগদাদী সর্বপ্রথম এই অদ্ভট কাহিনী সৃষ্টি করেন, এবং কেন করেন, তাও বোধগম্য নয়। তার পর কাহিনীটি শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে চালু হয়ে আসছে অমুসলিম লেখকদের কল্যাণে।
মিসরের যুদ্ধসমূহে বহু কপট ও রোমক বন্দী হয়েছিল। তাদের প্রতি কিরূপ ব্যবহার করা যেতে পারে, এ বিষয়ে আমর ওমরের নির্দেশ চেয়ে পাঠান। ওমর নির্দেশ দেন: বন্দীদেরকে জানানো হোক, ইসলাম গ্রহণ করার অথবা আপন খ্রিস্টানধর্মে দৃঢ় থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। যারা মুসলিম হবে, তারা অন্য মুসলিমদের সমান অধিকার লাভ করবে, আর যারা হবে না, তারা অন্য অমুসলিমদের মতো সমান হারে জিয়া আদায় করবে। এ নির্দেশ পেয়ে আমর সহস্র সহস্র বন্দীকে একত্রিত করেন এবং খ্রিস্টান প্রধানদেরকে আহ্বান করেন। অতঃপর মুসলিমরা ও খ্রিস্টানরা মুখোমুখি আসন গ্রহণ করে এবং বন্দীদেরকে একের পর এক ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়। সে ইসলাম কবুল করবে, না স্বধর্মে নিষ্ঠাবান থাকবে। যখন কোন বন্দী ইসলাম কবুল করার ইচ্ছা জানায়, তখন মুসলিমরা গগনভেদী ‘আল্লাহু আকবার’ আওয়াজ তোলে। আর যখন বন্দী স্বধর্মে থাকার ইচ্ছা জানায়, তখন খ্রিস্টানরা আনন্দে জয়ধ্বনি করে ওঠে। এভাবে সেদিন বন্দীদের ধর্ম বিষয়ে নিষ্ঠার প্রশ্ন নিয়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানরা আপন আপন দলভারে উল্লসিত হয়ে ওঠেছিল। বিজিত ও বিজিতার মনোভাব মুছে গিয়েছিল।