বিজয়ীর বেশে ফিরে দেশে দেশে
ওমরের খেলাফৎ আমলে সাড়ে বাইশ লক্ষ বর্গমাইলেরও বেশি ভূ-ভাগ ইসলামের এলাকাভুক্ত হয়েছিল। এই বিশাল ভূভাগের অন্তর্গত ছিল পশ্চিম মিসর থেকে শুরু করে সিরিয়া, খোজিস্তান, ইরাক-আরব, ইরাক-আযম, আযরবাইজান, ফারস, কিরমান, খোরাসান, মাকরান, মায় বর্তমান বেলুচিস্তান বৃহদংশ পর্যন্ত। আবার এ ভূভাগের মধ্যে ছিল সমকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুইটি প্রবল প্রতাপান্বিত ও বহু শতাব্দীর বহু ঐতিহ্যমণ্ডিত সাম্রাজ্য-পশ্চিমে রোম সাম্রাজ্য ও পূর্বে (বর্তমান ইরানে) পারসিক সাম্রাজ্য। মাত্র এক দশকের শাসনকালে (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি.) এবং মাত্র এক ব্যক্তির শাসন আমলে এমন পৃথিবী-বিশ্রুত শক্তিধর দুটি সম্রাটের মুকাবিলা করে এতো বিশাল ভূভাগ অধিকারের তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
এমন অনন্যসাধারণ বিজয়সমূহ আলোচনার পূর্বে সমকালীন রাজনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা শিক্ষাপ্রদ।
রসূলে-করিমের ওফাতের পর যে সব আরব গোত্র ও মোশরেকদল উদ্যত হয়েছিল ইসলামের উপর মারাত্মক আঘাত হানতে, আবুবকর কঠোর হস্তে তাদের নির্মূল করে দেন। অতঃপর আরবের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা আর উৎপীড়িত হয়নি, নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়নি কোনও বিদ্রোহ-বিপ্লবে। আবুবকরের আমলেই আরবের বহির্বিশ্বের ইসলামের এলাকা বিস্তার ও তদুদ্দেশ্যে সৈন্য চালনার পরিকল্পনা গৃহীত হয়। বারো হিজরীতে ইরাকে একদল সৈন্য প্রেরিত হয় এবং হিরার অঞ্চলসমূহ অধিকৃত হয়। তের হিজরীতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে আর একটি সেনাবাহিনী প্রেরিত হয়। এ-সব অভিযান তখন প্রাথমিক পর্যায়ে, এমন সময় আবুবকর ইন্তেকাল করেন এবং ওমরের উপর খেলাফতের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয়। ওমরের কৃতিত্ব হচ্ছে, এ-সব অভিযান প্রয়াসকে গৌরবের সঙ্গে পরিচালনা করা এবং সর্বক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করা।
আরব উপদ্বীপের সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক এবং সংগ্রাম-সংঘাত অতি প্রাচীন কাল থেকেই বিজড়িত। পুরাকাহিনী থেকে জানা যায়, আরবের অতি প্রাচীন প্রজাতি আরব বায়েদার দুটি গোত্র এককালে ইরাকের উপর প্রভুত্ব করতো। ইয়ামনের আর আরিবা গোত্র এরূপ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, তারা বহুবার আরব-পারসিক-সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধতা করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতো। ক্রমে ক্রমে আরও বহু আরব-গোত্র পারসিক রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। তারা একতাবদ্ধ জয়ে শক্তি সঞ্চয় করতো এবং সুযোগ ও সুবিধা বুঝে স্বাধীনতা ঘোষণা করে নিজেদের রাজ্য স্থাপনও করতো। এরূপ একটি রাজ্যের শাসক আমর-বিন-আদি হিরায় রাজধানী স্থাপন করেন এবং নিজেকে ইরাকের রাজা হিসাবে ঘোষণা করেন। তাঁর বংশ বহুদিন ইরাকে শাসন করতো।
সাসানীয় বংশের দ্বিতীয় সম্রাট শাপুর বিন-আদর্শির সর্বপ্রথম হিজায ও ইয়ামেন জয় করে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু আরবীরা ছিল চির-চঞ্চল, দুর্বিনীত ও দুর্ধর্ষ। কারো অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। বারে বারে তারা বিদ্রোহ করেছে, আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়েছে পারসিক সম্রাটের বিরুদ্ধে। শাপুর একবার তাদের দমন করতে মদিনা পর্যন্ত অভিযান চালিয়েছিলেন এবং আরব সরদারদের বন্দী করে তাদের স্কন্ধের হাড় ভেঙ্গে দিয়ে ‘ফুল-আক্তাফ’ উপাধিও অর্জন করেছিলেন। সম্রাট পারভেজের রাজত্বকালে বকর গোত্রসমূহ একত্র হয়ে পারস্য- সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে জয়লাভ করে। এ-যুদ্ধে রসূলে- আকরমও উপস্থিত ছিলেন এবং শত্রুপক্ষের পরাজয়ে উল্লসিত হয়ে ঘোষণা করেছিলেন: এই প্রথম আরব পারস্যের উপর প্রতিশোধ তুলতে সক্ষম হলো।
ষষ্ঠ হিজরীতে আঁ-হযরত প্রতিবেশী শাসকসমূহের নিকট পত্রসহ দূত প্রেরণ করেন, ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে। এসব পত্রে ছিল শান্তির চিরন্তন বাণী, শক্তি বা বল প্রয়োগের বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত ছিল না। তবু পারভেজ পত্র পাঠ করে ক্রোধে চিৎকার করে উঠেছিলেন: আমার দাস হয়ে আমায় এভাবে পত্র দিতে সাহস করে? তিনি তখনই ইয়ামনের শাসনকর্তা বাজাকে নির্দেশ পাঠান, আঁ-হযরতকে বন্দী করে সরাসরি তাঁর দরবারে হাজির করতে। কিন্তু পারভেজের ভাগ্যলিপি এমনই ছিল যে, ইতিমধ্যে তারই পুত্র বিদ্রোহী হয়ে তাঁকে হত্যা করে ফেলে এবং তার ধমকও স্তব্ধ হয়ে যায়।
প্রাক-ইসলাম যুগে কয়েকটি আরব-গোত্র সিরিয়ার প্রত্যন্ত দেশেও বসতি স্থাপন করে; এবং কালক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে সিরিয়ার অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে অনেক অঞ্চল দখল করে নেয়। তাদের সরদারগণ সিরিয়ার রাজা হিসেবে কীর্তিত হলেও, আসলে তাঁরা ছিলেন রোমের প্রতিনিধি মাত্র। এসব আরব-গোত্রজরা ঈসায়ী ধৰ্ম গ্ৰহণ করে এবং সমধর্মী হিসেবে তাদের ও রোমকদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে। ইসলাম প্রচারণা শুরু হলে আরবের অন্যান্য প্রতিমাপূজকের মতো তারাও ঘোরতর ইসলাম- বিদ্বেষী ছিল।
পূর্বে উল্লিখিত মতো ষষ্ঠ হিজরীতে রসূলে করীম রোমান সম্রাটকেও পত্র প্রেরণ করেন, ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়ে। পত্রবহ প্রত্যাবর্তনকালে এসব সিরীয়- আরবীর হস্তে লাঞ্ছিত ও লুণ্ঠিত হন। অনুরূপভাবে আঁ-হযরত হারিস ইবনে ওমায়েরকে প্রেরণ করেন বসরা শাসকের নিকট ইসলামের আমন্ত্রণ-লিপি দিয়ে। কিন্তু হারিস পথিমধ্যে নিহত হন। এর প্রতিশোধ তুলতে আঁ-হযরত অষ্টম হিজরীতে একদল বাহিনীসহ অভিযান করেন; এবং মুতায় বিপক্ষের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে কয়েকজন মশহুর সাহাবা শহীদ হন এবং শেষ পর্যন্ত খালিদের রণকৌশলে মুসলিম বাহিনী রক্ষা পেলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদেরই পরাজয় ঘটে। নবম হিজরীতে রোমকরা আরবের অভ্যন্তরে হানা দিয়ে মদিনা আক্রমণের চেষ্টা করে। আঁ-হযরত পূর্বেই সংবাদ পেয়ে একদল সৈন্য নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে তাঁবুতে উপস্থিত হন। তখন রোমকরা অবস্থার গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করে আর অধিক অগ্রসর হতে সাহস পায় না। কিন্তু অবস্থার উত্তেজনা প্রশমিত হয় না এবং মুসলিমরা সর্বদাই আশঙ্কায় থাকতো, কোন্ সময়ে শত্রুপক্ষ সুযোগ বুঝে মদিনা আক্রমণ করে বসে। সহীহ বুখারীতে একটি উক্তি আছে, যখন গুজব রটে যে, আঁ-হযরত পত্নীদেরকে তালাক দিয়েছেন, তখন এক ব্যক্তি ওমরকে জিজ্ঞাসা করে, তিনি কিছু খবর রাখেন কি? ওমর সহসা জিজ্ঞাসা করেন: কি খবর? ঘাসানীরা আক্রমণ করতে আসছে না কি? এ থেকেই অনুমেয়, শত্রুদের হঠাৎ আক্রমণ কতোখানি আশঙ্কিত ছিল। যাহোক, এ আশঙ্কা নিঃশেষ করার উদ্দেশ্যে এগারো হিজরীতে আঁ-হযরত সিরিয়ার বিরুদ্ধে এক বিশাল বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন ওসামাহ্ ইবনে যায়েদের নেতৃত্বে। কিন্তু ওসামাহ্ সমরযাত্রা করার পূর্বেই আঁ-হযরতের ওফাত হয়। আবুবকর এ অভিযানের প্রস্তুতি সমাধা করে সিরিয়ায় বাহিনী প্রেরণ করেন। ওসামাহ্ চল্লিশদিন পরে সিরিয়ার প্রান্তদেশ শাসন করে ফিরে আসেন। কিন্তু সিরিয়ায় সংগ্রাম তখনও চলতে থাকে।
এভাবে দুই ফ্রন্ট যুদ্ধ চলা অবস্থায় ওমরের খেলাফত আরম্ভ হয়। আরব তথা ইসলাম তখন বহির্বিশ্বের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এবং পশ্চিমে রোম-সম্রাট ও পূর্বে পারস্য সম্রাট তার সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় প্রস্তুত হচ্ছেন।
ওমরের বিজয়সমূহ বর্ণিত হবে প্রথমে পূর্বদিকের ইরাক বিজয় সম্বন্ধে। তৎকালে ইরাক বলতে আরবের প্রান্তস্থিত ইরাক অঞ্চলকে বোঝাত ইরাক আরব এবং পারস্য বা বর্তমান ইরাককে বলা হতো ইরাক-আযম। উত্তরে তাবারিস্তান, দক্ষিণে সিরাজ, পূর্বে খুজিস্তান ও পশ্চিমে মরাগাহ্ শহর পর্যন্ত ছিল তৎকালীন ইরাক-আযমের বিস্তৃতি। ইস্পাহান, হামদান ও রায় ছিল সে আমলের মশহুর শহর। অধুনা প্রায় ধ্বংসাবস্থায় এবং তার সন্নিকটে ইরানের বর্তমান রাজধানী তেহরান গড়ে উঠেছে। সিরিয়ার বিজয়- কাহিনী তারপরে এবং সর্বশেষে মিসরের বিজয়-কাহিনী আলোচিত হবে।