ইরাক-আযম বিজয় (প্রথম পর্যায়)
মাদায়েনের পতনের পর পারসিক জাতি নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্যক অনুধাবনে তৎপর হয়। এতোদিন তারা আরব জাতিকে অসভ্য ভেবে অবজ্ঞার চোখে দেখতো। এখন বাস্তব অবস্থা তাদের মোহমুক্তি ঘটলো। এখন আরব নামেই তাদের অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। প্রতিটি পারসিক শাসক নিজের নিরাপত্তা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন এবং নিজ অনুচরদের একত্রিত করে নিজ নিজ অধিকার সংরক্ষণে প্রস্তুত হতে থাকেন। এভাবে পারস্যের প্রতি অংশে আরব অভিযানের বিরুদ্ধে সমর-ঘাঁটি গড়ে ওঠে এবং দুর্দম আরবশক্তি প্রতিহত করতে যত্নবান হয়।
সর্ব প্রথমে জাজিরার শাসক আরবদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অগ্রসর হন। জাজিরাহ ইরাক-আরবের সীমান্তেই অবস্থিত ছিল। সা’দ এসব সংকাদ ওমরের গোচরীভূত করলে আবদুল্লাহ বিন-আলুমুতামকে একটি বাহিনীসহ প্রেরণ করেন। ওমর অবস্থায় গুরুত্ব বিবেচনা করে সম্মুখরক্ষীদলের নায়ক রাবি বিন আল-আফকল, দক্ষিণ বাহুর নায়ক হারিস বিন হাসান, বাম বাহুর নায়ক ফারাতে বিন্-হাযান ও পঞ্চাতদলের নায়ক হানি বিন্-কয়েসকে নিয়োগ করেন। আবদুল্লাহ পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রথমে তারকিক দুর্গ অবরোধ করেন। প্রায় একমাস ধরে এ অবরোধ চলে এবং কুড়িবার চেষ্টা করা হয় সুরক্ষিত দুর্গটি বাহুবলে অধিকার করার। শেষে যেসব আরব-গোত্র পারসিকদের সহযোগী ছিল, তাদেরকে বশীভূত করে পারসিকদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা হয়। তাদের সহযোগিতায় পারসিকদেরকে বিধ্বস্ত করা হয় ও দুর্গটি অধিকৃত হয়।
সতেরো হিজরীতে (৬৩৮ খ্রি.) সা’দ পাঁচ হাজার সৈন্যসহ আয়ায বিন ঘানামকে পাঠান জাজিরাহ অধিকার করতে। আয়ায শীঘ্রই অভিযান শুরু করেন এবং রিহা নামক শৈলদুর্গে ছাউনি ফেলেন। এখানকার শাসক প্রথমে বাধা দান করেন। কিন্তু সহজেই পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন এবং জিয়া কর প্রদান করতে স্বীকৃত হন। অতঃপর সমগ্র জাজিরাহ আয়াযের হস্তগত হয়। আয়ায আরও কিছুদিন অভিযান চালিয়ে রিকাহ, হারান প্রভৃতি স্থানীয় অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে অধিকার করেন।
পনেরো হিজরীতে মুগিরাহ বিন-শুবাহ বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি লক্ষ্য করলেন, বস্ত্রার অতি সন্নিকটে খুজিস্তান অবস্থিত। অতএব বস্ত্রার শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে এ পারসিক রাজ্যটি আশু অধিকার করা বাঞ্ছনীয়। সতেরো হিযরীতে তিনি হরমুষ শহর নামে প্রখ্যাত আওয়ায আক্রমণ করেন। তথাকার শাসক শালিয়ানা সামান্য পরিমাণ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে শান্তি প্রার্থনা করেন। মুগিরাহ এ শর্তেই সন্তুষ্ট হন। পর বছরে মুগিরার স্থলে আবু মুসা আশারী শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। শাসক পরিবর্তনের সুযোগে আওয়ায শাসক শালিয়ানা কেবল কর দেওয়া বন্ধ করেন নি, প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করতেও প্রস্তুত হলেন। আবু মুসা ক্রুদ্ধ হয়ে আওয়ায অবরোধ করেন। পারসিকরা অসম সাহসে যুদ্ধ করে পরাজিত হয় এবং প্রায় দশ হাজার বন্দী হয়। ওমরের আদেশে পরে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। অতঃপর আবু মুসা মনাযির নামে বিখ্যাত সুরক্ষিত শহর অবরোধ করেন। কিন্তু শহরবাসীরা অতুল বিক্রমে প্রতিরোধ করে এবং মুহাজির বিন্-জিয়াদ নামক একজন মশহূর সেনানায়ককে বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আবু মুসা-মুহাজিরের ছোট ভাই রাবিকে মনাযির দখলের ভার দিয়ে শুস্ অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হন। রাবি কয়েক দিনেই মনাযির ভূমিসাৎ করে ভ্রাতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন! আবু মুসা শুস্ অবরোধ করে বাইরের সব যোগাযোগ বন্ধ করেন। তখন স্থানীয় শাসক বাধ্য হয়ে সন্ধি করেন এই শর্তে যে, তার পরিবারের একশত মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। শাসক নাম উচ্চারণ করতে করতে শতপূর্তি হয়ে গেল, তবু তার নাম উচ্চারিত শেষ হলো না। আবু মুসা শাসককে হত্যা করেন। অতঃপর রামহর্ষ অবরুদ্ধ হলে বার্ষিক আট লক্ষ দিরহাম কর দেওয়ার শর্তে নিষ্কৃতি পায়।
এই সময় কিা ইয়েজ্দগির্দ কুম শহরে অবস্থান করছিলেন। বিখ্যাত পারসিক বীর হরমুযান কিার সমীপে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা করেন, আওয়ায ও ফারস্ প্রদেশের শাসনভার তাঁর হস্তে দেওয়া হোক। তিনি আরবদের অগ্রগতি রোধ করবেন। ইয়েজর্দি তাঁকে এই দুটি বিশাল প্রদেশের শাসক নিযুক্ত করেন এবং এক বিরাট বাহিনীও অর্পণ করেন। খুজিস্তানের রাজধানী শুস্তারে বহু শাহী বালাখানা ও সেনানিবাস ছিল। হরমুযান কিল্লাটির সংস্কার করে শক্তিশালী করেন এবং চারদিকে পরিখা নির্মাণ করেন। অতঃপর চারদিকে প্রচারকদল পাঠিয়ে তিনি বাসিন্দাদের ক্ষেপিয়ে তোলেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে। যে জাতীয়তা জ্ঞান ও আরবদের প্রতি সাধারণ ঘৃণা পারসিকদের মজ্জাগত ছিল, পুনরায় তা সন্দীপিত হয় এবং দলে দলে সৈন্য সমবেত হয়। আবু মুসা খলিফার নিকট আশু সাহায্য প্রার্থনা করেন। প্রথমে কুফা থেকে নুমান বিন-মাকরান আসেন এক হাজার সৈন্য নিয়ে। কিন্তু শত্রুপক্ষের সুবিশাল বাহিনীর শাসক আমর উপস্থিত হন আরও ঊর্ধ্ব সংখ্যক সৈন্য নিয়ে। জুলুলা থেকে জরীর বেলী উপস্থিত হন একদল সৈন্য নিয়ে। এভাবে শক্তিবৃদ্ধি হওয়ায় আবু মুসা শুস্তারের শহরতলীতে উপস্থিত হয়ে শিবির স্থাপন করেন।
হরমুযান বিশাল সংখ্যক বাহিনীর গর্বে প্রথমেই আক্রমণ করা স্থির করেন এবং অতর্কিতে মুসলিমদের আক্রমণ করেন। আবু মুসা অপূর্ব কৌশলে সৈন্য বিন্যাস করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। উভয়পক্ষ বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে, কিন্তু মীমাংসা হয় না। শেষে বারা বিন মালিক অসমসাহসে একদল সৈন্য নিয়ে দুর্গ প্রাকারের দ্বারদেশে ছুটে যান। এখানে হরমুযান অমিতবিক্রমে যুদ্ধরত ছিলেন। দুই বীরের মিলন হলো। বারু শহীদ হলেন। তখন মুজজাত বিন সাত্তার ঝাঁপ দিয়ে হরমুযানের উপর পড়েন ও এক মারাত্মক আঘাত হানেন। হরমুযান ও এ আঘাত ও প্রতিরোধ করেন এবং আততায়ীকে হত্যা করেন। শেষে মুসলিমদেরই জয় হয় এবং এক হাজার শত্রুসেনা নিহত ও ছয়শত বন্দী হয়। হরমুযান দুর্গমধ্যেই আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ চালাতে থাকে।
যুদ্ধের আর শেষ হয় না। শেষে একজন শহরবাসী আবু মুসার নিকট প্রস্তাব করে, তাকে প্রাণভিক্ষা দিলে সে নগর-প্রবেশের গুপ্তপথ দেখিয়ে দিতে পারে। আবু মুসা এ প্রস্তাবে সহজেই স্বীকৃত হন। লোকটি তখন আশরাশ নামক এক আরবীকে ভৃত্যের ছদ্মবেশে নগর প্রদেশের ভূগর্ভস্থ গুপ্তপথ দেখায়। আরও দেখায় হরমুযানের শাহী বালাখানা এবং সমগ্র শহরের প্রধান প্রধান স্থান। হরমুযান সে রাত্রে নিশ্চিন্তে সভাসদদের নিয়ে পানাহারে মত্ত ছিলেন। সবকিছু অন্ধি-সন্ধি বিশেষভাবে জ্ঞাত হয়ে আশরাশ্ আবু মুসার নিকট ফিরে আসেন এবং দাবী জানান তাঁকে দুশো প্ৰকৃত সাহসী ও বিশ্বাসী সৈন্য দিলে তিনি শহর অধিকার করতে পারেন। তখনই দুশো নির্ভীক সাহসী সৈন্য প্রস্তুত হয়ে গেল আল্লাহ্র রাহে প্রাণ দিতে। আশরাশ্ তাদেরকে নিয়ে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রাত্রিতে পূর্বে দেখানো গুপ্তপথ দিয়ে দুর্গপ্রাকারের সদর দরওয়াজায় উপস্থিত হন এবং অতর্কিতে শাস্ত্রীদেরকে নিহত করে দুর্গদ্বার খুলে দেন। আবু মুসা বাহিনী নিয়ে বাহিরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। দুর্গদ্বার খোলা পেয়ে মুসলিম বাহিনী পঙ্গপালের মতো শহরে ঢুকে পড়ে এবং হতভম্ব শহরবাসীদেরকে সহজেই দমন করে ফেলে।
হরমুযান হতাশ হয়ে দুর্গশীর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আক্রমক মুসলিমরা তাঁর নিকটবর্তী হতে চেষ্টা করলে তিনি হুমকি দিয়ে বলেন : আমার তৃণীরে এখনও একশোটি শর আছে এবং একশো জন ধরাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত আমায় কেউ বন্দী করতে পারবে না। তবে আমি এ শর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাযী আছি, আমায় অক্ষত দেহে মদিনায় পাঠিয়ে দিতে হবে এবং আমার ভাগ্য নির্ধারণ-তা সে যা-ই হোক- ওমরের হাতেই হবে। আবু মুসা এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং আনাস বিন্-মালেকের সঙ্গে হরমুযানকে মদিনায় প্রেরণ করেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর পরিবারবর্গ ও অধীনস্থ কয়েকজন সরদারও যান। মদিনার নিকটবর্তী হয়ে তিনি শাহের মূল্যবান পরিচ্ছদ ধারণ করলেন, মাথায় দিলেন ‘আযিন’ নামধেয় মূল্যবান মণিমুক্তাখচিত তাজ এবং কটিতটে ঝুলতে লাগলো মহামূল্য প্রস্তরাদি খচিত তরবারির খাপ। এভাবে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সজ্জিত হয়ে হরমুযান মদিনায় প্রবেশ করেন ও জিজ্ঞাসা করেন, খলিফার বালাখানা কোথায়? তিনি ভেবেছিলেন, যাঁর সেনাবাহিনী কিসারার গর্ব ধূলিস্যাৎ করতে পারে এবং যাঁর নাম-যশ পৃথিবীময় কীর্তিত, তিনি নিশ্চয়ই বিশাল শাহী বালাখানায় বিশেষ সমারোহে বাস করেন। কিন্তু যখন তাঁকে মসজিদে চত্বরে ধূলিশয্যায় শায়িত ওমরকে দেখিয়ে দেওয়া হয়, তখন তাঁর বিস্ময়ের অবধি থাকে না।
ওমর রাজসমারোহের মূর্ত প্রতীক হরমুযানকে দেখে শুধু বললেন, এসব মিথ্যাময়ী পৃথিবী মায়াময় ছলনা মাত্র। তারপর আলাপ শুরু হলো। হরমুযানের পরিচয় পেয়েই ওমর অন্তরে রোষে ফুলে উঠেছিলেন। কাদিসিয়ার যুদ্ধের পর এই লোকটি বারেবারে সা’দের সঙ্গে সন্ধির প্রতারণা করেছে। শুস্তারের যুদ্ধে এর হাতেই দু’জন মুসলিম বীর নিহত হয়েছেন। এসব চিন্তা করতে করতে ওমরের দু চোখে বহ্নিশিখা জ্বলে উঠেছিল। তিনি এমন ব্যক্তিকে প্রাণদণ্ডেরই আদেশ দিবেন, স্থিরসিদ্ধান্ত করছিলেন। কিন্তু আত্মসমর্পনের সুযোগ দিলে হরমুযান নিজের কার্যাবলীর কী সাফাই দেন, তাই তিনি নীরবে শ্রবণ করছিলেন। হরমুযান ওমরের চোখ-মুখের ভাব দেখে নিজের জীবন সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে বললেন : হে ওমর! যতদিন খোদা আমাদের সহায় ছিলেন, আপনারা আমাদের ক্রীতদাস ছিলেন, এখন আল্লাহ্ আপনাদের সহায় ছিলেন, তাই আমরা গোলাম হয়েছি। অতঃপর তিনি পানি চাইলেন। তাঁকে পানি দেওয়া হলো। কিন্তু পাত্রখানি হাতে নিয়ে আরয করলেন, যতক্ষণ না তাঁর পান শেষ হয়, ততক্ষণ যেন তাঁকে হত্যা করা না হয়। ওমর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।
সহসা পানপাত্রটি নামিয়ে হরমুযান বললেন, আমি এ পানি পানই করবো না, এবং আপনি ওয়াদা মতো আমায় হত্যা করতে পারেন না। ওমর এ যুক্তির ফাঁকিতে আশ্চর্য হয়ে ভাবছেন, সহসা হরমুযান উচ্চকণ্ঠে কলেমা শাহাদত পাঠ করে ইসলামে তাঁর নিষ্ঠা প্রকাশ করে বললেন আমি পূর্বেই হৃদয় দিয়ে ইসলাম কবুল করেছি, কিন্তু প্রথমে তা প্রকাশ না করে এই ফন্দির আশ্রয় নিয়েছি, যাতে লোকে না ভাবে, হরমুযান তলোয়ারের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছে। অতঃপর ওমরের সব রাগ পানি হয়ে গেল। তিনি হরমুযানকে ক্ষমা করলেন এবং মদিনায় বাস করার অনুমতি দিলেন। হরমুযানের বার্ষিক বৃত্তিও নির্দিষ্ট হলো দুই হাজার মোহর। অতঃপর হরমুযান ইসলামের হিতৈষী হয়ে ওঠেন। তিনি প্রায়ই ওমরের সাহচর্যে থাকতেন। ফারস্ ও পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান চালাবার সময় ওমর বহুবার তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছেন। পরে যখন ওমর শহীদ হন, তখন তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ ওঠে হরমুযানের বিরুদ্ধে। ওবায়দুল্লাহ্ বিনওমরের এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না এবং তিনি হরমুযানকে নিহত করেন।
অতঃপর শুস্তারের অনতিদূরে অবস্থিত জন্দিসাবুর অবরোধ করা হয়। কয়েকদিন ধরে এ অবরোধ চলে, কিন্তু শহরটি শায়েস্তা হয় না। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, শহরবাসীরা সদর দরওয়াজা খুলে রেখেছে এবং নিশ্চিন্তে আপন আপন কর্ম করে যাচ্ছে। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা গেল, মুসলিমরা জিয়া কর গ্রহণ করার শর্তে তাদের নিরাপত্তা ও শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আরও অনুসন্ধানে সঠিক জানা গেল, একজন মুসলিম গোলাম তাদের সঙ্গে এ সন্ধি করেছে। আবু মুসা এরূপ অবস্থার স্বীকৃতি দিতে রাযী না হয়ে বিষয়টি ওমরের গোচরে আনেন। ওমর নির্দেশ দেন, মুসলিমের গোলাম ও মুসলিম, অতএব তার সন্ধি করায় মুসলিমদেরই অঙ্গীকার করা হয়েছে এবং তা অবশ্য পালনীয়। জন্দিসাবুরের অধিকারে সমগ্র খুজিস্থান প্রদেশে ইসলাম বিস্তৃত হয়ে পড়ে।
আমরা পূর্বেই লক্ষ্য করেছি, শাহানশাহ্ ইয়েজর্দি মাদায়েন থেকে ফেরার হয়ে হুলওয়ানে আত্মগোপন করেন। কিন্তু সেখানেও তাড়া খেয়ে রায় পলায়ন করেন। সেখানের শাসক আবাজাদুয়াহ্ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তিনি ইস্পাহান ও কিরমানের পথ ধরে খোরাসানে উপস্থিত হন এবং মার্ভ শহরে বাস করতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে আছে পবিত্র ও অনির্বাণ পারসী অগ্নি, শাহী তাজ মহামূল্য হীরামণি-মাণিক্যাদি এবং আপন শাহী আত্মীয়স্বজন। এখানে তিনি পবিত্র অগ্নির জন্যে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং আপাতত কোন দিক থেকে বিপদের আশঙ্কা নেই দেখে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে পূর্বতন শানশওতসহ শাহী দরবার স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে দুঃসংবাদ আসে যে, খুজিস্তান আরবদের অধিকারে চলে গেছে এবং সাম্রাজ্যের প্রধান স্তম্ভ হরমুযানও বন্দী হয়ে মদিনায় প্রেরিত হয়েছেন। এসব সংবাদে ইয়েজ্গিদ পিঞ্জরাবদ্ধ কেশরীর ন্যায় রাগে ফুলতে লাগলেন। সত্য বটে তিনি রাজধানী থেকে বিতাড়িত ও পূর্বেকার সুখস্বর্গ থেকে বিচ্যুত কিার সে ত্রাসসঞ্চারী শক্তিমত্তা ও মানমর্যাদা ধুল্যবলুণ্ঠিত; কিন্তু তবুও তিনি তিন হাজার বছরের ঐতিহ্যশালী শাহী বংশের উত্তরাধিকারী। এ সুনাম এতো সহজে মুছে যেতে পারে না। আর এতোদিন পারসিকদের ও প্রদেশসমূহের শাসককুলের ধারণা ছিল যে, আরব-অভিযান একটা সাময়িক ঘূর্ণিবায়ু মাত্র, যার আবর্তে পারস্য- সীমান্ত পর্যন্ত আবর্তিত হয়ে সব শান্ত হয়ে যাবে, অভ্যন্তরে তার স্পর্শ লাগবে না। কিন্তু খুজিস্তান পর্যন্ত আরব অধিকার বিস্তৃত হওয়ায় তাদের মোহমুক্তি হয়ে গেল। তারা সভয়ে দেখলো, মুসলিমরা তাদের গৃহে প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে, তাদেরকে আশ্রয়চ্যুত করে তাদের ঘরবাড়ী, ধনসম্পদ দখল করেছে। তখন শাসককুল পরস্পর যোগাযোগ করে এই বহিঃশত্রুকে আর অগ্রসর হতে না দেওয়ার উদ্দেশ্যে এক যোগে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হতে লাগলেন। তাবারিস্তান, জুর্জান, দমাত্তন্দ, রায়, ইস্পাহান, হামদান এমনকি সুদূর খোরাসান ও সিন্ধুর সীমান্ত পর্যন্ত সমগ্র পারসিক সাম্রাজ্যের প্রত্যেক প্রদেশের শাসকরা একযোগে সমর-প্রস্তুতিতে সমগ্র জনগণকে মাতিয়ে তুললেন।
সময় ও সুযোগ বুঝে ইয়েজর্দি এসব শাসকের নিকট বিশেষ দূত পাঠিয়ে নির্দেশ দিতে লাগলেন আর একবার সকলের শক্তির সমবায়ে সাধারণ শত্রুকে প্রতিরোধ করতে ও নিশ্চিহ্ন করতে হবে। এসব উদ্যম আয়োজনের ফলে দেড় লক্ষ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী সমবেত হলো কুম্ শহরের বিশাল প্রান্তরে। এখানে বিভিন্ন কারখানায় সমরাস্ত্র প্রস্তুত হতে লাগলো। হরমুযের পুত্র মরদান শাহকে ইয়েজর্দি এই বিশাল বাহিনীর সিপাহসালার নিযুক্ত করেন এবং নির্দেশ দেন, অবিলম্বে নিহাওন্দে যাত্রা করে আরবদের মুকাবিলা করতে। পুরাকালের মন্ত্রপূত ‘কাভাহ্’ ঝাণ্ডা উড়তে লাগলো মরদান শাহের মাঙ্গলিক ধ্বজা হয়ে।
কুফার শাসনকর্তা আম্মার বিন-ইয়াসির পারসিক পক্ষের সব সমরায়োজনের বিস্তৃত বিবরণী পাঠালেন ওমরের নিকট। ওমর মসজিদে-নববীতে সমবেত জনগণের সম্মুখে সে বিবরণী পাঠ করে বললেন: হে আরবের জনগণ! এবার পারসিকরা একযোগে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছে, দুনিয়া থেকে মুসলিমদের চিহ্ন মুছে দিতে। এখন কী করণীয় আমাদের? তালহা বিন্ ওবায়দুল্লাহ্ বললেন: হে আমিরুল মুমেনীন! দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তোমায় বিচক্ষণ করে তুলেছে। আর আমরা তোমার হুকুম তামিল করা বই কিছু জানি নে। ওসমান পরামর্শ দিলেন: আমার মতে এখনই সিরিয়া, ইয়ামেন ও বসরার শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হোক, অবিলম্বে নিজ নিজ বাহিনীসহ ইরাক রওয়ানা হতে, আর আপনি স্বয়ং মদিনাবাসীদের নিয়ে রওয়ানা হোন। কুফার সমস্ত সৈন্য আপনার ঝাণ্ডার নিচে সমবত হোক, আর সেখান থেকে আমরা একত্রে নিহাওয়ন্দের দিকে রওয়ানা হবো। সকলেই সমন্বয়ে এ প্রস্তাব সমর্থন করলো, শুধু আলী প্রথম নীরব রইলেন। ওমর তাঁর দিকে দৃষ্টিপাত করলে তিনি পরামর্শ দিলেন: সিরিয়া ও বসরা থেকে সমস্ত সৈন্য চলে গেলে সীমান্তস্থিত শত্রুরা আমাদের অধিকৃত অঞ্চল দখল করে ফেলবে, আর আপনি মদিনা থেকে চলে গেলে সারা আরবে এমন সাংঘাতিক আন্দোলন উঠবে, যা দমন করা কঠিন হবে। অতএব, আমার মতে আপনি মদিনাতেই থাকুন, আর সিরিয়া, ইয়ামেন ও বসরা থেকে এক তৃতীয়াংশ করে সৈন্যসংখ্যা ইরাকে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হোক। ওমর এ পরামর্শ সমীচীন মনে করেন। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, কার হাতে এ অভিযানের ভার দেওয়া যায়?
ওমরের একটি প্রকৃষ্ট গুণ এই ছিল যে, তিনি মানুষের গুণ ও সামর্থ্যের প্রকৃত সমঝদ্বার ছিলেন। সকলেই তাঁর এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জ্ঞাত ছিল। এ জন্যে সকলেই একবাক্যে জানালো, ওমরই সমর-নেতা নির্বাচন করুন। ওমর নুমান বিন্ মাকরানকে সিপাহসালার নিযুক্ত করেন। নুমান ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নিহাওন্দের দিকে যাত্রা করেন। বহু প্রবীণ সাহাবা এ যুদ্ধে শরীক হন। চরমুখের সংবাদ অবলম্বন করে নুমান বিনা বাধায় নিহাওন্দ থেকে নয় মাইল দূরবর্তী স্থান ইস্পাহানে উপস্থিত হয়ে ছাউনি ফেলেন। ওমরের নির্দেশে ফাসে অবস্থিত মুসলিমরা সেদিকের পারসিকদের নিহাওন্দ যাত্রাপথে বাধাদান করে।
উভয়পক্ষে প্রস্তুতি হতে লাগলো সম্মুখ যুদ্ধের। পারসিকরা প্রথমে সন্ধির প্রস্তাব দিয়ে দূত চেয়ে পাঠালো। এ কাজে পারদর্শী মুগিরাহ বিন-শুবাহুকে প্রেরণ করা হয়। তিনি পূর্বে ইয়েজগির্দের নিকট ও রুস্তমের নিকট দৌত্যগিরি করেছিলেন। মরদান শাহ্ শান-শওকতের সঙ্গে দরবার সাজিয়ে স্বর্ণসিংহাসনে বসলেন হীরা-মাণিক্য-খচিত মুকুট পরে। তাঁর দুপাশে বসলেন শাজাদারা ও সাম্রাজ্যের আমীররা স্বর্ণমুকুট মাথায় দিয়ে সোনার জরি-মিশ্রিত রেশমী পরিচ্ছদে এবং দুহাতে স্বর্ণ বলয়ে শোভিত হয়ে। পিছনের দুসারিতে খাড়া হলো উন্মুক্ত ও ঝলসিত তরবারি হস্তে রক্ষী সেনাদল। সন্ধি সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হলে মরদান শাহ্ প্রভুত্বব্যঞ্জকস্বরে বললেন: হে আরববাসীরা! যদি কোনও জাতি ঘৃণ্য হিসেবে অন্য সব জাতিকে অতিক্রম করে থাকে, তা সে তোমরাই। আমার সিংহাসনের চতুর্দিকে দণ্ডায়মান তীরন্দাজরা এক নিমেষে তোমার ভাগ্য শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু তোমাদের দূষিত রক্তে তাদের তীর কলঙ্কিত করতে চাই নে। তোমরা এখনই আমাদের রাজ্যসীমা ত্যাগ করলে তোমাদের ক্ষমা করে দেবো। মুগিরাহ্ শ্লেষমিশ্রিত কণ্ঠে জওয়াব দিলেন: আপনি সত্যই বলেছেন, আমরা ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য। কিন্তু এদেশের সম্পদরাশি আমাদের দেহ যতক্ষণ ভূমিসাৎ না হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা এসব বিলাস ত্যাগ করে এক পাও নড়বো না। মুগিরাহ্ আর বাক্যব্যয় না করে স্থান ত্যাগ করলেন এবং সন্ধির সব আশা নির্মূল হয়ে গেল।
অতঃপর উভয়পক্ষে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। পারসিকরা নিজেদের সম্মুখে বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে গোখরু কাঁটা ছড়িয়ে দিল। তাঁর ফলে মুসলিমদের সম্মুখে অগ্রসর হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে, কিন্তু পারসিকরা সুযোগ মতো আক্রমণ করতে থাকে। তখন তোলায়হার উপদেশ মতে মুসলিম বাহিনী ছয় সাত মাইল দূরে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হয়ে রইলো এবং কাকা’ একদল বাহিনী নিয়ে নগর আক্রমণ করতে অগ্রসর হলেন। পারসিকরা শহর ছেড়ে তাদের আক্রমণ করলে তারা পিছু হটতে লাগলো এবং এভাবে পারসিকরা গোখরু কাঁটার এলাকা ছাড়িয়ে মুসলিমদের ধাওয়া করলো। তাদের আক্রমণে মুসলিমরা হতাহত হতে লাগলো, তবুও নুমান প্রতি আক্রমণের নির্দেশ দেন না। মুগিরাহ ও অন্যান্য সেনানায়করা বারবার আক্রমণ করতে চাইলেন। কিন্তু নুমান আঁ-হযরতের নিয়মানুযায়ী দ্বিপ্রহর অতীতের অপেক্ষা করতে লাগলেন। সূর্য দ্বিপ্রহরের রেখা অতিক্রম করলেই মুসলিমরা বীরবিক্রমে যুদ্ধ আরম্ভ করে। হতাহতের সংখ্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং রক্তেরও স্রোত বইতে থাকে। সহসা নুমানের অশ্ব হোঁচট খেয়ে তাঁকে নিয়ে পড়ে যায় ও তিনি মারাত্মক আঘাত পান। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নুয়ায়েম তাঁর টুপি মাথায় পড়ে ও ঝাণ্ডা হাতে করে তাঁর অশ্বে সওয়ার হয়ে যুদ্ধের নির্দেশ দিতে লাগলেন। সাধারণ সৈন্যরা নুমানের অবস্থা জানতে পারলো না। নুমান কড়া আদেশ দিলেন, তাঁর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। সন্ধ্যার পূর্বেই মুসলিম পক্ষের জয় সূচিত হলো এবং পারসিকরা বিধ্বস্ত হয়ে গেল।
নুমান তখনও জীবিত ছিলেন। একজন সেনা তাঁকে বিজয়-সংবাদ দিলে তিনি আল্লাহ্ শুকরগুজারী করে নির্দেশ দেন, এখনই খলিফার নিকট সংবাদ পাঠাও। তারপর তিনি জান্নাতবাসী হন।
অতঃপর হুদায়ফাহ্ বিন্-ইয়ামান মুসলিমদের সিপাহসালার নিযুক্ত হন। তিনি বিজয়-গৌরবে নিহাওন্দে প্রবেশ করেন। সেখানে একটি অতি প্রাচীন অগ্নি-মন্দির ছিল। মন্দিরের পুরোহিত তাঁর সম্মুখে কিরা পারভেজের সঞ্চিত এক পেটিকা বহুমূল্য মণি মুক্তা উপস্থিত করে। হুদয়াফাহ্ মালে-গনিমাত বিজয়ী সেনাদের মধ্যে বিভাগ করে দিয়ে তার এক পঞ্চমাংশ ও উক্ত পেটিকাটি মদিনায় প্রবেশ করেন। ওমর কয়েক সপ্তাহ যুদ্ধক্ষেত্রের সংবাদ না পেয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। এখন বিজয় বার্তা পেয়ে আনন্দে অধীর হলেন। কিন্তু নুমানের শাহাদতের সংবাদ শোনা মাত্র তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন। কাসেদ তাঁকে মৃতদের নাম বলতে থাকে। শেষে বলে, আরও যারা শহীদ হয়েছে তাদের নাম সে জানে না। ওমর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদের চিনে নেবেন। মণি-মুক্তার পেটিকা তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করা হলে তিনি বললেন, এসব আমার সম্মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও। হুদায়ফাকে বলো, এ সমস্ত বিক্রয় করে সংগৃহীত অর্থ সৈন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে। সেগুলি বিক্রয় করে পাঁচ কোটি দিরহাম পাওয়া যায়। মুসলিমরা যুদ্ধের পর পারসিকদের হামাদান পর্যন্ত তাড়া করে। প্রায় ত্রিশ হাজার পারসিক নিহাওন্দের যুদ্ধে নিহত হয়। মুসলিমরা এ যুদ্ধকে ‘বিজয়ের বিজয়’ নামে অভিহিত করেন।
এখানে একটি কথা উল্লেখযোগ্য, এই যুদ্ধেই ফিরোয় নামে একজন পারসিক বন্দী হয়। এই ফিরোযই পরবর্তীকালে ওমরকে হত্যা করেছিল।