শেষ প্রসঙ্গ

শেষ প্ৰসঙ্গ

বিশাল ওমর-চরিত কাহিনী সাঙ্গ হলো। সৃষ্টির আদি কাল থেকে কতো মহৎ ব্যক্তি, বীরপুরুষ, ন্যায়দর্শী, সত্যদর্শী মহাপ্রাণ মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁদের পুণ্যময় জীবন-কাহিনী যুগে যুগে মানুষকে আদর্শ দান করছে, প্রেরণা যোগাচ্ছে। আমরা সে সব কীর্তিধর স্মরণীয় ও বরণীয় মহামানবের পথ লক্ষ্য করে চলবার অনুপ্রেরণা লাভ করছি। এসব বিশ্বনন্দিত মহৎ ব্যক্তির চরিতমালায় ওমর-চরিত সংযোজিত হলো। নিরপেক্ষ জ্ঞানী পাঠকবৃন্দ নিজেরাই বিচার করবেন, বিশ্বেতিহাসে ওমর-চরিতের তুলনা কোথায়!

আমরা যে তরুণ ওমরের প্রথম সাক্ষাৎ পাই, সে ছিল বীর্যবান, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা আইয়ামে-জাহেলিয়াতের এক কুলিশ-কঠোর মূর্তি। দাজানের মরু-প্রান্তরে উট-পালক হিসেবে তার পরিচয়। পরিণত বয়সে তাঁর সাক্ষাৎ পাই, আমীরুল মুমেনীন হিসেবে মহাশক্তিধর, অর্ধ-পৃথিবীর মহাশাসক হিসেবে, পরমজ্ঞানী, ন্যায়দর্শী, সত্যদর্শী, রাজর্ষিরূপে। আলেকজান্দার, নেপোলিয়ানের মতো বিশ্ববিজয়ী, আরিস্টটল, প্লেটোর মতো মহাজ্ঞানী, আবদুল কাদের জিলানী, জালাল উদ্দীন রুমীর মতো মহাতাপস, নওশেরওয়ার মতো ন্যায়দর্শী এবং অতুলনীয় ওমরের মতোই মিথ্যা থেকে সত্য বিচ্ছিন্নকারী সত্যদর্শী, একাধারে এতোগুলি মহত্ত্বের অপূর্ব সমাবেশ আর কোথায়? এর তুলনাই বা কোথায়? মহৎ শব্দের এমন মণিকাঞ্চনযোগ ওমর ভিন্ন অন্য কোন চরিত্রে সম্ভব? আরবীতে একটি সুবচন আছে-আল্লাহ্ পক্ষে এটা অসম্ভব নয় যে, তিনি একটা মানব-চরিত্রেই বিশ্বরূপ দেখাতে পারেন। কিন্তু ওমর চরিত ভিন্ন অন্য কোন্ মানুষে এমন বিশ্বরূপের সার্থকতা রূপায়িত হয়েছে? তিনি নবী নন, রসূল নন, কিন্তু রসূলুল্লাহর শিক্ষা ও আদর্শের এমন সার্থক রূপায়ণ আর কোন্ চরিতে সম্ভব হয়েছে? তাইতো মুগ্ধ কবি বিস্ময় বিমুগ্ধ কণ্ঠে গেয়েছেন:

আজ বুঝি, কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর,
মোর পরে যদি নবী হতো কেউ-হতো সে এক ওমর।

যে আরবভূমিতে ওমরের জন্ম, সেখানে শাসনতন্ত্র, নিয়মতন্ত্রের বালাই ছিল না। দাজ্নানের উট-পালকের স্বপ্নেও জাগে নি, একদিন অর্ধ-পৃথিবীর কোটি কোটি জনগণের শাসন-রশ্মি হাতে তুলে নিতে হবে, মহান রাষ্ট্রনায়কের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কর্তব্যের ডাক যখন এলো তখন দেখা গেল, শ্রেষ্ঠ নরপালক হিসেবে তাঁর তুলনা নেই, রাষ্ট্র রূপায়ণে তাঁর মতো কুশলী শিল্পীর দ্বিতীয় সাক্ষাৎ আজও পৃথিবী পায় নি। একটা অজ্ঞাত, অখ্যাত, অনুন্নত জাতিকে মাত্র দশ বছরের কর্মব্যস্ততায় বিশ্বের মহাশক্তিতে উন্নীত করা এবং আদর্শ জাতিতে রূপায়িত করা ওমরের মতো প্রতিভার পক্ষেই সম্ভব ছিল। অথচ এ রাজর্ষি বাস করেছেন পর্ণকুটিরে, শয্যা পেতেছেন ধুলি ধূসরিত মাটির কোলে, গায়ে তুলেছেন অসংখ্য তালিশোভিত জীর্ণ বস্ত্রখণ্ড। এখনই তিনি মহামান্য রাজদূতের দর্শন দিয়ে ধন্য করেছেন কিংবা ক্রান্তিকালীন যুদ্ধবিগ্রহের নির্দেশ দিচ্ছেন, অথবা মহাশক্তিধর প্রদেশ পালদের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রসংক্রান্ত উপদেশ দিয়েছেন। আবার পরমুহূর্তেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে, অসহায় বিধবার পানি তুলে দিচ্ছেন, তার উট দোহন করছেন; কিংবা এতিমের উট চারণ করছেন, অসহায় ক্লান্ত পথিকের সেবায় ব্যস্ত আছেন। আবার হয়তো তার পরেই জ্ঞানী ও বিচক্ষণ সাহাবাদের সঙ্গে বসে শারিয়ার কঠিন মালায় সুষ্ঠু মীমাংসা করে দিচ্ছেন। ইসলামের একনিষ্ঠ সেবকরূপে, ধর্মভীরু, আল্লাহ্ভীরু ন্যায়নিষ্ঠ তাপস হিসেবে, আবার মানুষের পরম সহায় ও বন্ধু হিসেবে ওমরের তুলনা কোথায়? তাঁর সত্যনিষ্ঠা, ন্যায়নিষ্ঠা, সাধুতা, সরলতা, আড়ম্বরলেশহীনতা, নম্রতা, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ বাস্তবিকই বিস্ময়কর। আরও বিস্ময়কর, এই বাহ্যত রুক্ষ কঠোর মূর্তির হৃদয়ে এতো স্নেহ-মমতা ছিল, এতো মানবপ্রীতি ছিল, এমন করুণার ফল্গুধারা ছিল।

রসূলুল্লাহর আবির্ভাব বিশ্বলোকের অপূর্ব নিয়ামত ও চিরন্তন আশিসরাশি স্বরূপ। ধর্মপ্রচারণা তাঁর প্রধান ভূমিকা হলেও মানবতার কল্যাণসাধন তাঁর একটি অনন্য কর্মসূচী ছিল। আর এ কর্মসাধনে তাঁর একটি লক্ষ্য ছিল এমন একদল আত্মভোলা ত্যাগীর সৃষ্টি করতে হবে, যারা পৃথিবীর হাতছানিকে অগ্রাহ্য করে বহু জনহিতায় বহুজন সুখায়’ মরণ বরণ করে নিয়ে মানবতার সেবায় হাসিমুখে অগ্রসর হবে, আত্মোৎসর্গ করবে। যারা আত্মত্যাগের মহামন্ত্র মুখে প্রচার না করে কাজে দেখাবে। মাত্র তেইশ বছরের কর্মমুখর জীবন একটা অত্যুচ্চ ধর্ম সংস্থাপনে, একটা আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ও একটা ঐক্য শৃঙ্খল সুসংবদ্ধ নয়া জাতিগঠনের শুধু নজীরবিহীন নজীর রেখেই যান নি, যে কেউ তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, সাহচর্যলাভে ধন্য হয়েছে, সে-ই তাঁর ভাবধারায়ও চিন্তা-ভাবনায় উদ্দীপিত হয়েছে এবং নয়া জীবন-রসে সজীবিত হয়ে উঠেছে। জগৎ ও জীবনে তিনি যে আদর্শিক বিপ্লবের সহস্রধারা প্রবাহিত করে গেছেন, আজও তা মানবেতিহাসে অনুপম ও অপ্রমেয় হয়ে আছে; মিথ্যা ও ভ্রান্তির বিনাশ সাধনে যে সিরাজুমমুনীরা বা সত্যের আলোকবর্তিকা তুলে ধরেছিলেন, আজও তা অনির্বাণ আছে এবং মানুষের হৃদয়ে যে বহ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন, শত শতাব্দীর পরেও তা প্রতিটি নরনারীকে সন্দীপিত করে তুলেছে। তাঁর আলোকধারায় সন্দীপিত, তাঁরই আদেশে অনুপ্রাণিত হয়ে মহাপ্রাণ ওমর মাত্র দশ বছরে যে বিস্ময়কর কীর্তি রেখে গেছেন, তার মহিমা কীর্তনে স্বধর্মী ও বিধর্মী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য লেখকবর্গের প্রতিযোগিতায় আজও শ্রান্তি আসে নি। আদর্শ মহৎ কিন্তু তার রূপায়ণের ও বাস্তবায়নের কৃতিত্ব মহত্তর। এজন্যেই ওমর হয়তো মহীয়ান, ওমর-চরিত বিশ্বের বিস্ময়।

এই বিস্ময়কর প্রতিভার প্রশস্তি-রচনায় আঠারো শতকের পাশ্চাত্য ক্লাসিক ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবন বলেছেন:

ওমরের সংযম ও সৌজন্যে আবুবকরের চেয়ে ন্যূন ছিল না। তাঁর খাদ্য ছিল যবের রুটি, কিংবা খেজুর; পানীয় ছিল সাদা পানি। তিনি ধর্মবক্তৃতা দিতেন একখানি জীর্ণ জামা পরে, তার তালি ছিল বারো জায়গায়। আর পারসিক প্রাদেশিক শাসক যখন তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে এলেন, তখন তিনি ঘুমিয়ে রয়েছেন, দীন-দুঃখীর সঙ্গে মদীনার মসজিদের সোপানের উপর। মিত্যব্যয়িতা উদারতা আনে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুসলিমদের গতকালের ও সমকালীন কর্মের পুরস্কার হিসেবে উপযুক্ত স্থায়ী বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। নিজের মাসোহারা সম্বন্ধে তিনি ছিলেন নিস্পৃহ অথচ পয়গম্বরের পিতৃব্য আব্বাসের জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা করেন সর্বাধিক হারে, মাসিক পঁচিশ হাজার দিরহাম। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বৃদ্ধ যোদ্ধাদের প্রত্যেকে পান পাঁচ হাজার মুদ্রা, এমন কি মুহম্মদের সর্বনিম্ন সাহাবারও বার্ষিক বৃত্তি নির্ধারিত হয় হাজার মুদ্রা। তাঁর পূর্বকালীন শাসনকালে দেখা গেছে, প্রাচ্যের বিজেতা ছিলেন আল্লাহ্ ও জনগণের বিশ্বাসী ভৃত্য। বায়তুল মালের অধিকাংশই ব্যয়িত হতো শান্তি ও যুদ্ধের জন্যে। ন্যায়নিষ্ঠা ও বদান্যতার পরিণামদর্শী সংমিশ্রণের ফলে সারাদিনের মধ্যে এসেছিল আশ্চর্য নিয়মানুবর্তিতা। আর একনায়কত্বের আশু কর্মবিধান ও সফল প্রচেষ্টার সঙ্গে আশ্চর্য দক্ষভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসুলভ নীতি সমূহের মিশ্রণ ঘটেছিল।

উনিশ শতকের মুসলিম-বিদ্বেষী বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক স্যার উইলিয়াম মুইরও ওমর চরিত্র মূল্যায়নে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন:

মাত্র কয়েক ছত্রে ওমর-জীবন আঁকা যেতে পারে। সরলতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল তাঁর ধ্রুব লক্ষ্য। নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তা ছিল তাঁর শাসননীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। দায়িত্বজ্ঞান তাঁর এতো প্রখর ছিল যে, প্রায়ই তাঁকে আক্ষেপ করতে শোনা যেতো: হায়! আমায় যদি মা জন্ম না দিতেন! আমি যদি তৃণখণ্ড হয়ে থাকতে পারতেম! প্রথম বয়সে অগ্নিমূর্তি ও অসহিষ্ণু হিসেবে পরিচিত, এমন কি পয়গম্বরের সময়ে শেষের দিকেও তিনি প্রতিশোধের প্রধান সমর্থক ছিলেন। সর্বদাই তরবারি উঁচিয়ে-ধরা স্বভাবের মানুষটি বদর যুদ্ধের সময় উপদেশও দিয়েছিলেন যে, সমস্ত বন্দীকে হত্যা করা হোক। কিন্তু বয়োগুণে ও কর্ণদায়িত্বে রুক্ষতা কোমল হয়ে এসেছিলো। তাঁর ন্যায়নিষ্ঠা ছিল সুদৃঢ়। কোন কোন বর্ণনামতে মাত্র খালিদের ক্ষেত্রে তিনি নির্দয় প্রতিহিংসায় চালিত হলেও একটি অত্যাচার কিংবা অবিচারে তাঁর জীবন কলঙ্কিত হয় নি; এমন কি খালিদের ক্ষেত্রেও এক বিজিত শত্রুর প্রতি বিবেকজ্ঞান-বর্জিত ব্যবহারেই ওমরের ক্রোধ জন্মেছিল। ওমরের সৈন্যাধ্যক্ষ ও প্রাদেশিক শাসক নির্বাচন ছিল পক্ষপাতশূন্য এবং আল্-মুগিরা ও আম্মার ব্যতীত ফলও হয়েছিল আশ্চর্যরূপে শুভ। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গোত্র ও সংস্থাগুলির বহুবিধ স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়েও তাঁর ন্যায়পরায়ণতায় ছিল অকুণ্ঠ বিশ্বাসী এবং তাঁর সবল বাহুতে সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা ও আইন ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। বেত্রদণ্ডটি হাতে নিয়ে ওমর মদীনার পথে-ঘাটে ভ্রমণ করেছেন এবং অকুস্থলেই অপরাধীর শাস্তিবিধান করেছেন। এজন্যেই প্রবাদ বাক্য শোনা যেতো ওমরের বেত্রখানি অন্যের তরবারীর চেয়েও ভয়াবহ। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কোমল প্রকৃতির এবং তাঁর বহু করুণা-সিক্ত কাহিনী ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে— যেমন বিধবাদের এবং এতিমদের দুঃখ ও অভাব মোচন।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি আর একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ওয়াশিংটন আরভিং ওমর সম্বন্ধে বলেছেন:

ওমরের সমগ্র ইতিহাসে এই সাক্ষ্য মেলে যে, তাঁর মনের জোর ছিল অসাধারণ, সততা ছিল অনমনীয় এবং ন্যায়নিষ্ঠা ছিল সুদৃঢ়। অন্য কারও চেয়ে তিনিই ছিলেন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা-পয়গম্বরের প্রত্যাদেশগুলিকে সফল ও রূপায়িত করেছেন, আবুবকরের ক্ষণস্থায়ী খেলাফতকালে সুপরামর্শদানে সাহায্য করেছেন এবং জয়ের-পর- জয়ে দ্রুত বর্ধমান মুসলিম সাম্রাজ্যের সর্বত্র কঠোর আইনের শাসন প্রবর্তন উদ্দেশ্যে সুবিবেচিত বিধি-বিধান স্থাপন করেছেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈন্যাধ্যক্ষদের উপরে সৈন্যচালনাকালে কিংবা পূর্ণবিজয়গৌরব মুহূর্তেও তাঁর যেমন সুদৃঢ় কৰ্তৃত্ব ছিল, তা থেকে শাসনকার্যে তাঁর অভূতপূর্ব দক্ষতাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। তাঁর সরল প্রকৃতি এবং বিলাস ও আড়ম্বরের প্রতি অনীহা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি পয়গম্বর ও আবুবকরের দৃষ্টান্ত অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এবং সিপাহ্ সালাদেরকে পত্রালাপের সময় এই নীতি ও দৃষ্টান্তের উপকারিতা সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত করেছেন। তিনি বলতেন: পারসিক খাদ্যবস্তু ও বসন-ভূষণের বিলাসিতা থেকে সাবধান। স্বদেশের সাদা-সিদা অভ্যাস আঁকড়ে থাকো, আল্লাহ্ তোমাদের চির-বিজেতা করবেন; কিন্তু এ সব ত্যাগ করলেই তোমাদের ভাগ্য বিপর্যয় অনিবার্য। এ নীতির উপকারিতায় তাঁর এমনই ধ্রুববিশ্বাস ছিল যে, তাঁর কর্মচারীদের বাহ্যিক আড়ম্বর ও বিলাসপ্রিয়তা এন করতে তিনি কঠোর শাস্তি দান করতেন।

তাঁর বহু আদেশ-নির্দেশ তাঁর মগজের এবং হৃদয়ের উৎকৃষ্ট পরিচয় বহন করে। তিনি বিশেষভাবে নিষিদ্ধ করেন কোন বন্দিনী সন্তানের মাতা হলে তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রয় করা চলবে না। বায়তুলমালের সাপ্তাহিক বিতরণকালে তিনি অভাবের মানানুযায়ী পরিমাণ নির্ধারিত করতেন, প্রাপকের যোগ্যতানুযায়ী নয়। তিনি বলতেন: আল্লাহ্ আমাদের অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন, আমাদের পার্থিব অভাব মোচন করতে; আমাদের সদ্গুণের পুরস্কার হিসেবে নয়, কারণ এ সবের পুরস্কার মিলবে অন্য জগতে।

দুই শতাব্দীর ঐতিহ্য-ধন্য সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বকোষ ‘এসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিয়া’– বলা হয়েছে:

ওমরের খেলাফতকালে দশ বছর প্রধানত মহা-মহা বিজয় লাভ ঘটে গেছে। তিনি নিজে কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে যান নি, মদীনাতেই থেকেছেন কিন্তু তবুও কর্তৃত্ব-রশ্মি কখনও তাঁর হস্তচ্যুত হয় নি, এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের দুর্দান্ত প্রভাব এবং মুসলিম জাতির তাঁর উপর আস্থা। তাঁর রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টিতে পরিচয় মেলে, মুসলিম বিজয়ের সীমা নির্ধারণে তাঁর উৎকণ্ঠা থেকে, ইসলামী গণতন্ত্রে আরবের জাতীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ ও বলিষ্ঠ রাখায় এবং আভ্যন্তরীণ শাসনকার্যে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁর অক্লান্ত সাধনায়। যে মহাবাণী উচ্চারণ করে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তা কখনও পুরাতন হওয়ার মতো নয়: আল্লাহ্র নামে শপথ! তোমাদের মধ্যে যে দুর্বলতম, সে আমার চক্ষে সবলতম থাকবে, যতক্ষণ না তার অধিকার সংরক্ষিত হয়। আবার তোমাদের মধ্যে যে সবলতম, সে আমার চক্ষে দুর্বলতম থাকবে, যতক্ষণ না সে আইনানুসারী হয়। রাষ্ট্রবিধির এর চেয়ে উচ্চতর সংজ্ঞা আর দেওয়া যায় না।

সর্বশেষে উদ্ধৃত করা যেতে পারে পাক-ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও মুতাকাল্লামুন বা মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক দার্শনিকদের শেষ প্রতিনিধি শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্র ওমর সম্বন্ধে উক্তি। ওমর-চরিত্র চিত্রণের শেষ প্রসঙ্গে তার চেয়ে মহৎ উক্তি আর হতে পারে না। শাহ্ সাহেব বলেছেন:

ওমর-হৃদয়কে এক বহু-দ্বারবিশিষ্ট গৃহের সঙ্গে কল্পনা করা যেতে পারে। তার প্রত্যেক দ্বারে এক একটি মহৎ প্রতিভার অধিষ্ঠান। একটি দ্বারে উপস্থিত মহান আলেকজান্দার তাঁর বিশ্বজয়ী, রণকৌশলী শত্রু নিপাত-ক্ষম প্রতিভা নিয়ে, অন্য দ্বারে উপস্থিত নওশেরওয়া, তাঁ মধুরতা ও মহানুভবতা নিয়ে, প্রজাকুলের জন্যে প্রেম ও ন্যায়দণ্ড হাতে নিয়ে (অবশ্য ওমর-চরিত্র চিত্রণে নওশেরওয়ার সঙ্গে তুলনায় ওমরকে) ছোট করা হয়। অপর একটি দ্বারে বসে আছে সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানি কিংবা খাজা বাহাউদ্দীনের মতো ধর্মীয় নেতা। অন্য দ্বারে আছেন আবু হোরায়রাহ্ ও ইনে- ওমরের মতো নিষ্ঠাবান হাদীস-বিশারদগণ এবং আরও একটি দ্বারে আছেন মওলানা জালালউদ্দিন রুমী ও শেখ ফরীদউদ্দীন আত্তারের পর্যায়ের চিন্তানায়কবৃন্দ। আর বিশাল জনতা ভীড় জমিয়ে আছে গৃহটির চারপাশে এবং প্রত্যেকেই আপন আপন রুচি-মাফিক ইমামের নিকট নিজের অভাব জানাচ্ছে এবং পূর্ণ পরিতোষ লাভ করে হৃষ্টমনে ফিরে যাচ্ছে…….।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *