ইরাক-আরব বিজয় (দ্বিতীয় পর্যায়)
রণ-হুঙ্কারে কাদিসিয়ার প্রান্তর মুহুর্মুহু প্রকম্পিত হয়ে উঠতে লাগলো।
পারসিক সিপাহসালার সৈন্যদের আদেশ দিলেন, অবিলম্বে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হতে। তিনি নিজেও বর্মে-চর্মে সুসজ্জিত হয়ে অশ্বারোহণ করে বলদৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, এবার সারা আরবকে ধুলিসাৎ করে দেব। পার্শ্ববর্তী একজন সৈন্য বললো, নিশ্চয়ই, ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে। রুস্তম ধমক দিয়ে বললেন, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকে তবুও আমার ইচ্ছা পূর্ণ হবেই।
রুস্তম ছিলেন অমিততেজা বীর ও ঝানু রণকৌশলী। তিনি বিশেষ কৌশল করে নিজের সৈন্য-বিন্যাস করেন। তেরটি পরপর সুসজ্জিত শ্রেণীতে তাঁর বাহিনী বিভক্ত হয়। কেন্দ্রব্যুহ্যের পিছনেই ছিল রণনিপুণ হস্তীযুথ এবং তার পিছনে ছিল অশ্বারোহীর দল। দক্ষিণ ও বাম বাহুর পিছনে ছিল বিরাট মাতঙ্গযুথ। যুদ্ধ-কেন্দ্র থেকে রাজধানী পর্যন্ত সমস্ত পথে সংবাদবাহীর দল ছিল নিয়োজিত, যাতে যুদ্ধের গতি প্রতি মুহূর্তেই মাদায়েনে বিবৃত হয়।
সা’দ অসুস্থতাহেতু কাদিসিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রের ঠিক পিছনে অবস্থিত একটি প্রাসাদে শয্যাগত থেকে যুদ্ধের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করতেন। উপরের এক উন্মুক্ত প্রকোষ্ঠ থেকে সারা যুদ্ধক্ষেত্র তাঁর দৃশ্যপথে সহজে লক্ষিত হতো এবং খালিদ-বিন-আরফতাকে সৈন্য-চালনার ভার দিয়ে নিজে পদে পদে নির্দেশ পাঠিয়ে কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন।
সৈন্যদল যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলে আরবের বিখ্যাত কবি ও বক্তাগণ তাঁদের যুদ্ধোন্মাদনা জাগিয়ে তুললেন। সমগ্র বাহিনী তাঁদের কবিতা ও ওজস্বিনী বক্তৃতায় মোহিনী যাদুমন্ত্রে দুলতে লাগলো। তারপর সিপাহসালার সা’দের ‘আল্লাহু আকবর’ তকবীর-ধ্বনির সঙ্গে প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দুই পক্ষের দুই বিশাল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ‘জীবন-মৃত্যু মিশেছে যেথায় মত্ত ফেনিল স্রোতে।’ জীবন নেওয়া-দেওয়ার এই বীভৎস লীলায় সারা রণভূমি কেঁপে উঠলো।
প্রথম দিনের যুদ্ধে, পারসিকরা হস্তীযুথ দিয়ে মুসলিমদের অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। এই কালোমেঘের মতো বিরাটদেহীদের দেখেই আরবী অশ্বগুলি পিছু হটতে থাকে। বাহিলাহ্ নামক মশহূর আরবী অশ্বারোহীর দলকে এভাবে বেকায়দা অবস্থায় পড়তে দেখে সা’দ আসাদ-গোত্রের পদাতিকদের নির্দেশ দেন, তাঁদের সাহায্য করতে। আসাদ-গোত্রের সৈন্যরা বীরবিক্রমে হস্তীযুথের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ায় পারসিকরা হস্তী দিয়ে তাদেরকে নিঃশেষ করতে চেষ্টা করলো। তখন বানু-বংশের তীরন্দাজরা মুহুর্মুহু তীরবৃষ্টি করে মাতঙ্গ-বাহিনীকে পশ্চাতে হটিয়ে দিল। এভাবে কাদিসিয়ার রণাঙ্গনে প্রথম দিনের যুদ্ধ শেষ হয়।
এখানে একটি কাহিনী উল্লেখযোগ্য। সা’দ উপরতলায় শয্যাগত থেকে নিম্নে যুদ্ধরত বাহিনীকে প্রতি মুহূর্তে নির্দেশ দান করছেন, পাশে পত্নী সাল্মা বসে যুদ্ধ দেখছেন। এই সামার পূর্ব স্বামী ছিলেন মুসান্না, তাঁর মৃত্যুর পর সা’দ সালমাকে নিকাহ করেন। এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধদৃশ্যে উত্তেজনার মুহূর্তে সালমা চিৎকার করে ওঠেন, কী আফসোস্! আজ মুসান্না এখানে নেই! এ কথায় মর্মবিদ্ধ হয়ে সা’দ সালমার গালে এক চপেটাঘাত করে বললেন, মুসান্না এখানে থাকলে আর কী করতে পারতো? সাল্মা শ্লেষমাখা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, কী আশ্চর্য! কাপুরুষেরও আত্মমর্যাদাজ্ঞান থাকে!
দ্বিতীয় দিন যুদ্ধারম্ভের পূর্বে সিরিয়ার দিগন্তে কালো ধূলিমেঘ দেখা গেল। পরে জানা গেল, সিরিয়া থেকে আবুওবায়দাহ্-প্রেরিত সাহায্য বাহিনী উপস্থিত হয়েছে। ইরাক-অভিযানের পরিকল্পনার সময়েই ওমর আবুওবায়দাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সিরিয়ায় ইরাক থেকে যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল, অবিলম্বে সে দলটিকে সা’দের সাহায্যার্থে প্রেরণ করতে। এ বাহিনীতে ছিল ছয় হাজার সৈন্য, এবং কাকা’ বিন – আমরুর মতো নির্ভীক তেজোদৃপ্ত সেনানায়ক। কাকা’র নবাগত বাহিনী-বিন্যাস পারসিকদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তিনি রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়েই পারসিক বীরপুঙ্গবদের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। তাঁর আহ্বানে বানশাহ্ বিপক্ষদল থেকে ময়দানে অবতীর্ণ হন। তাঁকে দেখেই কাকা’র স্মৃতিতে সেতুবন্ধের যুদ্ধে আবুওবায়দা শহীদ হওয়ার দৃশ্য উদিত হলো। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ওই আসে আবুওবায়দার হন্তারক। সাবধান, সে যেন পলায়ন করতে না পারে। তারপর নাঙ্গা তলোয়ার হাতে নিয়ে কাকা’ বাৰ্মানকে আক্রমণ করলেন এবং শীঘ্রই তাঁকে শমন- ভবনে প্রেরণ করলেন। এইরূপ দ্বন্দ্ব যুদ্ধে সিস্তানের শাহ্ শহরবর্জ, হামদানের শাজচে-মেহের নিহত হন। অতঃপর সাধারণভাবে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। যুদ্ধ যখন তীব্র বেগে চলছিল, তখন ওমর প্রেরিত কয়েকটি উৎকৃষ্ট শ্রেণীর অশ্ব ও কিছু নয়া অস্ত্র উপস্থিত হয়। এগুলি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের মধ্যে বিতরিত হয়।
যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও একটি গৌরবমণ্ডিত কাহিনী আছে। আবু মহ্জন্ নামক মশহূর যোদ্ধা ও কবি এই সময় সা’দ কর্তৃক পানাভ্যাসের দরুন শৃঙ্খলিত অবস্থায় নিচে বন্দী ছিলেন। যুদ্ধ যখন প্রচণ্ড বেগে চলছিল, তখন তিনি খাঁচায় বদ্ধ সিংহের মতো গর্জন করতে থাকেন। সামা তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি জওয়াব দেন, যুদ্ধে সবাই বীরত্ব দেখাচ্ছে, আর আমি নিষ্ক্রিয় ও শৃঙ্খলিত হয়ে পড়ে আছি। আমায় যদি মুক্ত করে দেন ও সা’দের বল্কা নামীয় অশ্বটি দেন তাহলে আমিও এ জেহাদে শরীক হতে পারি। সালমা অস্বীকার করেন। তখন কবি আবু মন্ কবিতায় বিষাদ মাখা সুরে নিজের দুঃখ ব্যক্ত করতে থাকেন। কবিতায় বিষাদ সুর নারী হৃদয় স্পর্শ করলো। সাল্মা নিজ হস্তে কবিকে শৃঙ্খলমুক্ত করেন। তখনই আবু মন্ বলকায় সওয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন ও ভীমবেগে যুদ্ধ করতে থাকেন। তাঁর সুনিপুণ অস্ত্র চালনায় শত্রুপক্ষ কাহিল হয়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে গুঞ্জনধ্বনি ওঠে, কে এই নবাগত বীর? সা’দও আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকেন, আক্রমণের ভঙ্গিমা তো আবু মনের। কিন্তু সে তো শৃঙ্খলিত। দিবাগত যুদ্ধশেষে আবু মন ফিরে এসে নিজেই শৃঙ্খল পরলেন। তখন সাল্মা স্বামী সা’দকে আবু মর্জনের কাহিনী বলেন। সা’দ বলেন। সা’দ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজের হাতে আবু মর্জনের শৃঙ্খল মোচন করেন ও বলেন, মাশাআল্লাহ! ইসলামে তার এতো অনুরাগ, তাকে আমি শাস্তি দিতে পারি নে। আবু মনও শপথ করলেন, ‘কভু না করিব মদিরা পান।’
খাসা ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি ও আরবী ভাষার শ্রেষ্ঠ মর্সিয়া লেখিকা। তিনিও এ যুদ্ধে চার পুত্র নিয়ে শরীক হয়েছিলেন। এই দিনের যুদ্ধে এই মহীয়সী মহিলা পুত্রদেরকে যে ভাষায় সম্বোধন করে যুদ্ধে প্রেরণ করেন, বীরমাতা হিসেবে সর্বকালের ইতিহাস তা স্মরণ করবে। তাঁর চার পুত্রই দিনের যুদ্ধে শহীদ হয়।
এদিন পারসিকদের হতাহতদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার এবং মুসলিম পক্ষে ছিল দুই হাজার। ইয়েদি প্রতি মুহূর্তেই যুদ্ধের গতি সম্বন্ধে খবর রাখতেন। প্রতি দিনই তিনি নয়া সাহায্যবাহিনী প্রেরণ করতেন।
তৃতীয় দিনের যুদ্ধে কাকা নয়া কৌশল অবলম্বন করেন। সিরিয়া থেকে আরও সাতশো সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য হিশামের অধিনায়কত্বে এইদিন উপস্থিত হয়। হিশাম তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন : তোমাদেরই ভ্রাতৃগণ সিরিয়া জয় করেছে, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পারস্য তোমাদের হাতেই বিজিত হবে। এ দিনেও হস্তিযুথ মুসলিম বাহিনীকে বারবার ছত্রভঙ্গ করতে থাকে। অবস্থা সঙ্গীন দেখে তিনি সালাম ও দুখাম্ নামক দুজন পারসিক মুসলিমের উপদেশ গ্রহণ করেন। তাঁরা উপদেশ দেন, এই দুর্দান্ত বিরাটদেহী পশুগুলোকে শায়েস্তা করার একমাত্র উপায়, তাদের শুন্ড কেটে ফেলা ও চক্ষু নষ্ট করে দেওয়া। আবইয়াদ ও আজ়ান নামীয় দুটি হস্তী ছিল মাতঙ্গবাহিনীর সরদার। সা’দ কাকা’, হাম্মাল ও রাবিলকে ডেকে পরামর্শ দিলেন মাতঙ্গ-বাহিনীকে শায়েস্তা করতে। কাকা’ অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে হস্তিযুথকে বেষ্টন করেন এবং আসিমকে সঙ্গে নিয়ে বর্ণাহাতে আবইয়াদকে সুদক্ষ হাতে অন্ধ করে দেন এবং শুন্ডটাকে কেটে ফেলেন। রাবিল ও হাম্মাল আজরাবের ভাগ্য সমানভাবেই নির্ধারণ করেন। তখন বাকী হস্তিসমূহ ময়দান থেকে পলায়ন করে এবং নিমিষেই কালো মেঘের দল পরিষ্কার হয়ে যায়।
অতঃপর হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। তখন শুধু শব্দ শোনা গেল, অস্ত্রে অস্ত্রে ভীম পরিচয়, আহতের ক্রন্দন ও মুমূর্ষুর আর্তনাদ। যে শব্দ ও কোলাহলে আকাশ- বাতাস ভরে গেল, পায়ের নিচেও ঘন ঘন প্রকম্পিত হতে লাগলো। পারসিক বাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করতে লাগলো অনড় ও দুর্ভেদ্য পর্বতমালার মতো। সম্মুখে বর্শাধারী অশ্বারোহী, তার পশ্চাতে ভীম তরবারিধারী পদাতিক, তারও পশ্চাতে মুহুর্মুহু নিক্ষেপকারী তীরন্দাজগণ-এভাবে মুসলিম বাহিনীও সুসজ্জিত হয়ে ঘনঘন ‘তাকবীর’-ধ্বনিতে বিপক্ষ-মনে ভীতি সঞ্চার করতে লাগলো। কিন্তু কোন পক্ষই সূচাগ্র স্থান ত্যাগ করে না, এতোটুকু পশ্চাৎপদ হয় না। একটি পারসিক সেনাদল ছিল আপাদমস্তক ঘন- নিবন্ধ বর্মাবৃত, অস্ত্রাঘাত করলে শুধুই শব্দ-তরঙ্গ উত্থিত হয়। তখন হামিদাহ্ গোত্র- প্রধান ভীষণ বল প্রয়োগে বর্ষা নিক্ষেপ করেন এবং সেটি এক পারসিক সেনার তলপেট বিদ্ধ করে যায়। তাঁর দৃষ্টান্তে গোত্রীয় অপরাপর মুসলিমরা সমগ্র পারসিক দলটিকে বর্শাঘাতে নিপাত করে।
যুদ্ধ সারারাত ধরে চলতে থাকে। তবুও বিজয়-সুন্দরী কোন পক্ষকেই কৃপা করে না। শেষে কাকা’ এক চরম আক্রমণে ভাগ্যনির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তিনি একদল বাছাই করা সৈন্য নিয়ে সিপাহসালার রুস্তমের উপর ভীমবেগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন অন্যান্য গোত্র-প্রধানও অনুচরদের সাহস দিতে লাগলেন, এ জীবন-মরণ খেলায় আল্লাহ্র রাহে প্রাণ দিতে তোমরাও পশ্চাৎপদ হয়ো না। সমগ্র মুসলিম বাহিনী যেন এক দুর্ভেদ্য ব্যুহ করে রুস্তমকে ঘিরে ফেললো। ফিরজান ও হরমুজান তাঁকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেও কোথায় ছিটকে পড়লেন। স্বর্ণসিংহাসনে বসে রুস্তম তখন যুদ্ধের নির্দেশ দিচ্ছিলেন সহসা চারদিকে আরব সৈন্য দেখে তিনি বীরের মতো হুঙ্কার দিয়ে নিচে লাফ দিলেন ও অতুল বিক্রমে অস্ত্র চালাতে লাগলেন; কিন্তু একা এতোগুলি বীরকেশরীর সঙ্গে যুদ্ধ করা বৃথা দেখে পলায়নপর হলেন। হিলাল নামক এক পদাতিক আরবসৈন্য তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করেন। সম্মুখে একটা ছোট্ট নদী দেখে তিনি পানিতে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু হিলাল তাঁর অনুসরণ করে পা দু’টি ধরে জড়িয়ে ধরেন এবং তীরে টেনে এনে নিহত করে ফেলেন। অতঃপর হিলাল রুস্তমের শূন্য সিংহাসনে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার দেন, ‘আমি রুস্তমকে নিহত করেছি। এই চিৎকারধ্বনি পারসিক বাহিনীর অন্তরে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করে। তারা সভয়ে দেখলো, সিংহাসনে একজন মুসলিম সেনা সমাসীন। অমনি চক্ষে বিভীষিকা দেখে তার ছত্রভঙ্গ হয়ে পলয়ন করতে লাগলো। মুসলিমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে হাজারে হাজারে নিহত করে ফেললো। শারীয়ার, ইনল-হারবদ, ফরখান আয়াজন, খসরু, শান্ম প্রভৃতি পারসিক সেনানায়ক বৃথাই চেষ্টা করলেন শেষ পর্যন্ত লড়তে। একে একে তাঁরা নিহত হন। কেবল হরমুজান্, আওয়াদ ও কারান্ কোনক্রমে পলায়ন করে প্রাণরক্ষা করলেন। মুসলিম পক্ষে প্রায় ছয় হাজার শহীদ হয়। পারসিকদের নিহত সংখ্যা কারও কারও মতে লক্ষেরও বেশি ছিল।
কাদিসীয়ার যুদ্ধ তিনদিন ও একরাত্রি স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধের সঠিক তারিখ সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা একমত নন। ইবনে খলদুন বলেন, কাদিসিয়ার যুদ্ধ হয় হিজরীতে। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, ১৫ হিজরীতে, কারও মতে ১৬ হিজরীতে। আবুল ফরাদ বলেন, এ যুদ্ধ হয় ১৫ই হিজরীতে। ঘটনা পরম্পরা বিবেচনায় কাদিসিয়ার যুদ্ধ ১৫ হিজরীতে হওয়াই সম্ভব। এ যুদ্ধ হয় ইয়ারমুকের ও দামেশকের যুদ্ধের পর। ইরাক অভিযানের প্রথম পর্যায়ে আবুওবায়েদ মুসান্নার সাহায্যর্থে উপস্থিত হন সিরিয়া থেকে। তার পর নমারক, জসর বা সেতুবন্ধের যুদ্ধ হয়, সেখানে আবুওবায়েদ নিহত হন। তার পর অনুষ্ঠিত হয় বুয়ায়েবের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর সা’দ বিন-ওক্কাস সিপাহসালার নিযুক্ত হন। তাঁর অগ্রগতি ছিল ধীরে-মন্থর এবং প্রায় তিন মাসে তিনি সালাবায় অবস্থান করেন। পরে কাদিসিয়ায় উপস্থিত হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিতেও প্রায় দুমাস আড়াই মাস কেটে যায়। এসব চিন্তা করে কাদিসিয়ার যুদ্ধ ১৫ হিজরীতে হওয়াই সমীচীন মত।
কাদিসিয়ার যুদ্ধ নিঃসন্দেহে বিশ্ব-ইতিহাসের এক চূড়ান্ত যুগসন্ধির নির্ণায়ক। বহু শতাব্দীর বহু ঐতিহ্যের ধারক পারস্য সাম্রাজ্যের উপর এখানেই শেষ যবনিকা নেমে আসে। আর নয়া শক্তিমত্ত, আরব জাতির ‘পশ্চিমে হিস্পানি শেষ, পূর্বে সিন্ধু হিন্দুদেশ পর্যন্ত সুবিশাল ভূখণ্ডে বিস্তৃত এক নতুন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়। অজ্ঞাত, অখ্যাত মরুচর আরব জাতি বহির্বিশ্বে সগৌরবে আত্মপ্রকাশ করে এবং নিঃসন্দেহে সমকালীন বিশ্বসভায় আসন লাভ করে।
কাদিসিয়ার যুদ্ধবার্তা শ্রবণের জন্যে আরবের ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষ উন্মুখ থাকতো, দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতো। কারণ এ যুদ্ধ ছিল নিঃসন্দেহে সমগ্র আরব জাতির তথা নয়া মুসলিম জাতির জীবনমরণ সমস্যা, তাদের উত্থান- পতনের চূড়ান্ত নির্ণায়ক। কিন্তু তাদের সকলের চেয়ে উদ্গ্রীব ছিলেন, খোদ খলিফা ওমর। কাদিসিয়ার অভিযানের প্রথম থেকেই তিনি তার অগ্রগতির সংবাদ রাখতেন এবং সুদূর মদিনা থেকেই তার গতি নিয়ন্ত্রিত করেন। সাক্ষাতযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রতিদিন, তিনি মদিনা থেকে বাইরে যেয়ে সংবাদবাহকের জন্যে অধীর আগ্রহে সারাদিন প্রতীক্ষা করতেন।
সা’দ যুদ্ধজয়ের পরই বিজয়বার্তা এবং সংবাদ বিশদ করে দূত পাঠিয়েছিলেন। একদিন ওমর মদিনার বাইরে এমনই সংবাদের অপেক্ষারত ছিলেন, এমন সময় তাঁর লক্ষ্য পথে একজন উট-চালক উদয় হয়। ওমর দ্রুতগতিতে তার নিকট যেয়ে জিজ্ঞাসা করেন, সে কাদিসিয়া থেকে আসছে কি-না। জানা গেল সে সা’দের পত্রবাহক। ওমরের জিজ্ঞাসায় সে বললেন, ইসলামের জয়লাভ হয়েছে। উষ্ট্রচালক দ্রুতগতিতে যায়, ওমর তার পাশে পাশে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রশ্ন করতে করতে যান। শহরের কাছকাছি হলে বহু লোক উপস্থিত হয় ও তাঁকে আমীরুল মুমেনীন বলে সম্বোধন করতে থাকে। তখন উট-পালক সা’দ বিন-আমিলাহ্ ভয়ে সঙ্কোচে এতোটুকু হয়ে আরয করে, আল্লাহ্ আপনার উপর কৃপাবর্ষণ করুন! কেন পরিচয় দিলেন না যে, আপনি আমীরুল মুমেনীন? ওমর পরম আনন্দ-ঘন কণ্ঠে বললেন, কেন ভাই, কোনও দোষ হয় নি। তার পর সা’দের পত্রখানি নিয়ে ওমর মদিনাবাসীদের এক বিরাট মজলিশে পাঠ করলেন, এবং নাতিদীর্ঘ শুকরগুজারীর বক্তৃতা দিয়ে বললেন, হে মুসলিমগণ! আমি কোনও শাহা শাহ্ নই, তোমাদের গোলাম করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি নিজেই আল্লাহ্র দীনাতিদীন গোলাম, যদিও খেলাফতের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়েছে। আমি তখনই নিজেকে ধন্য মনে করবো, যখন তোমাদের নিরাপত্তা ও পরম শান্তিতে নিদ্রা যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবো। কিন্তু আমি নিজেকে চরম হতভাগ্য মনে করবো, যখন আমর উদ্দেশ্য হবে তোমাদেরকে আমার মুখ চেয়ে বসিয়ে রাখার এবং আমার দরওয়াজায় প্রহরী বসানোর। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তোমাদেরকে কথার চেয়ে কাজের দ্বারা শিক্ষা দেওয়া।