মানুষ ওমর
কান্তিসুন্দর না হলেও ওমর ছিলেন পিঙ্গল বর্ণের। তাঁর বীরত্ব ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিরাট চেহারা সহজেই সকলের দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতো। তিনি এতোখানি দীর্ঘকায় ছিলেন যে, তাঁর আশপাশের সকলকেই খর্বকায় মনে হতো। তাঁর শরীর সুগঠিত, স্বাস্থ্যদীপ্ত ও মস্তকের সম্মুখভাগ কেশহীন ছিল। ঘন-চাপদাড়ি ও বিশাল গুম্ফ-শোভিত, তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিভাদীপ্ত ও আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু তাঁর গাম্ভীর্য সকলেরই সম্ভ্রম জাগাতো এবং তারা সর্বদাই সন্ত্রস্ত থাকতো। যৌবনে তিনি কতদূর দুঃসাহসী, নির্ভীক, অভিযানপ্রয়াসী ও মল্লবীর ছিলেন, এই গ্রন্থের প্রথমেই সে-কথা উল্লেখিত হয়েছে।
ওমরের জীবন ছিল আড়ম্বরবিহীন, অত্যন্ত সাদাসিধে, ভোগ-বিলাসের লেশমাত্র তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নি। কোরা মোটা জামাকাপড়েই তাঁর সন্তুষ্টি। তাও শততালিযুক্ত এবং একখানিতে দিন চলে যেতো। অনেক সময় দেখা গেছে, ওমর একখানি মাত্র কাপড় কেচে দিয়ে রৌদ্রে মেলে ধরে শুষ্ক করেছেন, আর ওদিকে মহামান্য দূত খলিফার দর্শনলাভে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছেন। শুকনো খেজুর ও খোর্মা চিবানো ছিল তাঁর অভ্যাস, জলপাইযোগে মোটা লাল আটার রুটি ছিল তাঁর আহার, মধু হলেই বিরাট ভোজ হতো। গোশ্ত, সব্জি বা দুধ সময়ে সময়ে পাতে জুটতো, আবার কখনও কখনও তাও জুটে নি। মেহমানরাও খলিফার গৃহে এর বেশি ভোজ্যদ্রব্যে আপ্যায়িত হন নি। আরবে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি শুধু যবের আটাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। খেজুর পাতার চাটাই ছিল তাঁর প্রিয় শয্যা; অনেক সময় মহামান্য সম্রাট দূতেরা তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে মসজিদে ধূলি-শয্যাতেই তার দর্শন পেতেন। ফকিরীর ফকরে মহিমান্বিত এই ত্যাগী মহাযোগী সম্রাটের রূপকল্পনায় মুগ্ধ কবি উদাত্ত কণ্ঠে প্রশস্তি গেয়েছেন :
অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছো ধূলার ততে বসি,
খেজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক’ নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা-পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে!
শত প্রলোভন বিলাস-বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব, ছুঁইতে পারেনি পদ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি’ পার, আপনি রহিলে পিছে!
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরে ওমর কয়েকটি স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। ওসমান বিন্- মায়ুনের ভগিনী যয়নব তাঁর প্রথমা স্ত্রী। এই ওসমান ছিলেন রসূলুল্লাহ্র অন্তরঙ্গ সাহাবাদের অন্যতম। প্রথমে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেন ওসমান তাদের সংখ্যায় চতুর্দশতম ছিলেন এবং হযরতের এতোখানি প্রিয়পাত্র ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুতে হযরত অধীর হয়ে ক্রন্দন করতে থাকেন। যায়নব ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কাতেই তাঁর ওফাত হয়। আবদুল্লাহ ও ওম্মুল মুমেনীন্ হাফসা যয়নাবের দুই সন্তান। ওমরের দ্বিতীয়া স্ত্রীর নাম কারিবা; তিনি ও উমায়তুল্ মাখযুমীর কন্যা, আবার ওম্মুল মুমেনীন ওন্মে- সালমার ভগিনী। কারিবা ইসলাম গ্রহণ করেননি; এজন্যে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অমুসলিমদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধন অসিদ্ধ ঘোষিত হলে ছয় হিজরীতে ওমর তাঁকে পরিত্যাগ করেন। তৃতীয়া স্ত্রী মালায়কার অন্যতম নাম ছিল ওম্মে-কুলসুম এবং তিনিও ইসলাম গ্রহণ না করায় একই বৎসরে পরিত্যক্তা হন।
মদীনায় হিজরত করে ওমর আনসারদের সঙ্গে আত্মীয়তা বন্ধনের উদ্দেশ্যে আসিম – বিন্-সাবিতের কন্যা জমিলাকে বিবাহ করেন। জমিলার প্রথম নাম ছিল আসিয়া, কিন্তু রসূলুল্লাহ তাঁকে ইসলামে দীক্ষিত করে জমিলা নামাঙ্কিত করেন। কোন অজ্ঞাত কারণে ওমর তাকেও তালাক দেন।
জীবনের শেষের দিকে ওমরের বাসনা হয়, রসূলুল্লাহর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে জীবন ধন্য করতে। এজন্যে তিনি বিবি ফাতেমা ও আলীর প্রিয়তমা কন্যা ওন্মে-কুলসুমের পাণিপ্রার্থী হন। আলী প্রথমে অসম্মত হন কন্যার কম বয়সের কথা চিন্তা করে, কিন্তু ওমরের সনির্বন্ধ অনুরোধে শেষে রাযী হন। ১৭ হিজরীতে এই পুণ্যময় পরিণয় সম্পন্ন হয়। ওমর চল্লিশ হাজার দিরহাম দেন-মোহর দিতে অঙ্গীকার করেন।
ওমরের আরও কয়েকটি স্ত্রী ছিল: হারিস্-বিন্-হিশামের কন্যা ওম্মে হাকিম, ফকিহা য়্যামেনীয়া ও যায়েদ-বিন-আমরের কন্যা আতিকা। আতিকা ছিলেন ওমরের পিতৃব্য কন্যা ও অসামান্য সুন্দরী। তাঁর প্রথম বিবাহ হয় আবুবকরের পুত্র আবদুল্লাহর সঙ্গে। কিন্তু তায়েফের যুদ্ধে আবদুল্লাহ শাহাদত বরণ করলে ওমর আতিকাকে বিবাহ করেন বারো হিজরীতে আলীর অনুরোধক্রমে।
ওমরের অনেকগুলি পুত্রকন্যা ছিল। কন্যা হাসার প্রথম বিবাহ হয় খানিস্ বিন্ হুদায়ফার সঙ্গে। কিন্তু খানিস ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হলে রসূলুল্লাহ তৃতীয় হিজরীতে হাসাকে শাদী করে ধন্য করেন। ওম্মুল মুমেনীন ও হাসা অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং অনেক প্রবীণ সাহাবা সেগুলি শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ওমরের ছয় পুত্রের নাম আবদুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহ, আসিম, আবুশা’মা আবদুর রহমান, যায়েদ ও মুজিব। তন্মধ্যে প্রথম তিনজন প্রথিতযশা। আবদুল্লাহ্ হাদীস ও ফিকাহ্র স্তম্ভ হিসেবে সর্বজনবিদিত। তিনি পিতার সঙ্গেই ইসলাম গ্রহণ করেন। রসূলুল্লাহ্র সঙ্গে বহু যুদ্ধে শরীক হয়ে একদিকে আবদুল্লাহ যেমন বীরত্ব দেখিয়েছেন অন্যদিকে পাণ্ডিত্য ও ধর্মনিষ্ঠায় সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেছেন। তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও স্পষ্টবাদিতা প্রশংসনীয়। মহাত্রাস হাজ্জাজ-বিন্-ইউসুফ যখন কা’বাগৃহে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন নিৰ্ভীক আবদুল্লাহ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন: এ ব্যক্তি আল্লাহর দুশমন, সে আল্লাহ্-ভক্তদের নির্বিচারে নিহত করেছে। কিন্তু এ-উক্তিই তাঁর কাল হয়েছিল; হাজ্জাজ্ নিযুক্ত আততায়ীর হস্তে বিষাক্ত আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। আলী ও মুআবীয়া যখন খেলাফত নিয়ে যুদ্ধে ব্যস্ত তখন মুসলিমরা তাঁকে খলিফা হতে অনুরোধ করলে তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, মুসলিমদের রক্ত-স্রোতে স্নাত খেলাফত তাঁর কাম্য নয়। ওবায়দুল্লাহ ছিলেন বীর পুরুষ, প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর শৌর্যবীর্যে চারদিকে মুখরিত হয়েছে। আসিম পাণ্ডিত্য ও কবি-প্রতিভায় প্রখ্যাত। উল্লেখযোগ্য যে, আসিমের কন্যার পুত্র মহাপ্রাণ ওমর-বিন্-আবদুল আজিজ ওমাইয়া বংশের সবচেয়ে ধর্মভীরু ও ন্যায়নিষ্ঠ খলিফা।
কিন্তু ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত যে ওমরের জীবন নারী শাসিত ছিল না। তার কারণ এই নয় যে, নারী জাতির প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা ছিল। নারীর হৃদয়ানুভূতি, নারীর মর্মব্যথা তাঁর অন্তর স্পর্শ করতো। একবার এক প্রোষিতভর্তৃকা যুবতীর করুণ বিরহগীতি শ্রবণ করে ওমর নির্দেশ দেন, কোন সৈন্যকে চার মাসের বেশি গৃহসুখে বঞ্চিত রাখা চলবে না। ওমর কখনও নারীকে তাঁর কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে দেন নি, সব সময়ে বাহির বিশ্বের কর্তব্যের ঊর্ধ্বে রেখেছিলেন। তাঁর স্নেহভাণ্ডারও তিনি আপন সন্তানদের জন্যেই উন্মুক্ত না করে সমগ্র মুসলিমদের সেবার ব্যয়িত করেছিলেন। এমন কি উপযুক্ত শিক্ষিত পুত্রদেরকে রাষ্ট্রশাসনে প্রাধান্য দেওয়া দূরে থাক, কাউকে কোন সরকারী কাজেও নিয়োগ করেন নি। কনিষ্ঠ যায়েদ ছিল তাঁর পরম প্রিয়পাত্র। ইয়ামামাহর যুদ্ধে যায়েদ শহীদ হলে ওমর বালকের ন্যায় ক্রন্দন করেছিলেন। যায়েদের নামোল্লেখ করা হলে তিনি আবেগভরে বলতেন: ইয়ামামাত্র বাতাস প্রবাহিত হলে আমি যায়েদের দেহ সৌরভ গ্রহণ করতে পাই।
বাল্যকাল থেকেই ওমর রুক্ষ, কোপনস্বভাব এবং কড়া মেযাজের দরুন সকলের ত্রাসসঞ্চারকারী ছিলেন। আইয়ামে জাহেলিয়াতে ছিলেন মূর্তিমান রুদ্র-খোলা তরবারি নিয়ে রসূলুল্লাহকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন; কনিষ্ঠা ভগিনীকে ইসলাম গ্রহণের জন্যে প্রহারে জর্জরিত করেছিলেন। রসূলুল্লাহর সম্মুখেও তাঁর মেযাজের উগ্রতা প্রকাশ পেতো, সামান্য উত্তেজনায় তরবারি ধরতেন আবুবকর তাঁকে মনোনীত করেছেন শ্রবণ করে অনেকের ত্রাস সঞ্চার হয়; তালহা আবুবকরের নিকট ভীতি প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু ইসলামের শিক্ষার মহিমায় ওমরের কঠোরতা কোমলতায় রূপায়িত হয়েছিল ক্রমে ক্রমে এবং খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর ক্রোধ পুড়ে ছাই হয়ে স্নেহ-নির্ঝরে পরিণত হয়েছিল। আর তখন তাঁর স্নেহকরুণার ধারা উৎসারিত হতো মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের উপর।
কৈশোরে ওমর দানানের মরু-প্রান্তরে উট চারণ করেছেন, যৌবনে সিরিয়া ও পারস্যের দূর অঞ্চলে ব্যবসায় উপলক্ষে সফর করেছেন। ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ও মদীনাতেও তিনি তেজারতি করে অন্নসংস্থান করেছেন। মদীনায় এসে প্রথম দিকে ক্ষেত-জমি সংগ্রহ করে আধিয়ারী প্রথায় চাষাবাদও করেছেন। কখনও তিনি নিজে বীজ দিয়েছেন, কখনও তাঁর চাষী বীজ সংগ্রহ করেছে। ফসল উভয়ে আধাআধি গ্রহণ করেছেন। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর সাহাবারা তাঁর একটা মাসিক ভাতা ধার্য করতে অগ্রসর হলেন, তাঁকে খোরপোষ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত করতো। আলীর প্রস্তাব অনুযায়ী ওমর ও তাঁর পরিবারের জন্যে একটা সাধারণ পরিবারের উপযুক্ত খোরপোষ নির্দিষ্ট হয়। ইবনে সা’দ বলেন, ওমরের সংসারের দৈনিক খরচ ছিল মাত্র দুই দিরহাম, অর্থাৎ প্রায় দশ আনার মতো। খায়বরের যুদ্ধের পর রসূলুল্লাহ সাহাবাদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দেন। ওমরের ভাগে পড়ে ‘সুমগ’ নামাঙ্কিত উর্বর জমি। বনি হারিস নামক ইহুদী গোত্রের নিকট থেকেও ওমর ‘সুমগ’ নামধেয় আর এক খণ্ড জমি পান। পরবর্তীকালে তিনি উভয়খণ্ড জমিই গণহিতার্থে দান করেন। সহীহ্ বুখারীতে এ বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। এই ‘ফিসা-বিলিল্লাহ’ দানের শর্ত ছিল: এ জমি দান-বিক্রয় করা চলবে না, উত্তরাধিকার হিসেবে বন্টন করা হবে না। তার উৎপন্ন ফসল দীন-দুঃখী, নিকট-আত্মীয়, ক্রীতদাস, মুসাফির ও মেহমানদের সেবায় ব্যয় করা হবে। বলা বাহুল্য মুসলিম ওয়াক্ফ আইনের সূত্রপাত এ থেকেই।
ওমর ছিলেন ইসলাম-আদর্শিক জীবনের জীবন্ত প্রতীক। তাঁর সত্যনিষ্ঠা। তাঁকে ‘ফারুক’ অর্থাৎ মিথ্যা থেকে সত্য পৃথক করার ধ্রুপদী নিষ্ঠার অনুসারী করেছিল। একটি কাহিনীমতে রসূলুল্লাহ বলেছিলেন: আল্লাহ্ ওমরের রসনা ও অন্তর সত্যে সন্দীপিত করেছিলেন; এজন্যে তিনি ‘ফারুক’ কারণ তাঁর উপস্থিতিতে সত্য মিথ্যা থেকে পৃথক হয়ে যায়। বস্তুত তাঁর নাড়ীতে ছিল সত্য, দেহের তন্তুতে ছিল ন্যায়ের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ। এজন্যে তাঁর রসনায় সত্য ঝলকিত, অন্তরে ন্যায় নিকষিত। তাঁর তৌহিদ- মন্ত্রে একনিষ্ঠা ও আল্লাহ্ করুণায় একান্ত নির্ভরতা; তাঁর সাধুতা, সরলতা, আত্মত্যাগ ও অহঙ্কারহীনতা ভোগ-বিলাসবিমুখতা, ন্যায়নীতি-প্রীতি, গর্ব ও মর্যাদার প্রতি অনীহা এবং কলরব-মুখরিত খ্যাতির প্রাঙ্গণে শ্রেষ্ঠ আসনের অবিসংবাদী অধিকারী হয়ে ও ধ্যানীযোগীসুলভ নিস্পৃহতা অনন্য ও অতুলনীয় ছিল। চুম্বক যেমন লোহাকে টানে, সেই রকম ধ্রুবসত্য তাঁর অন্তরমনকে সর্বদাই আকর্ষণ করতো, উদ্ভাসিত করতো। আর আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় যেমন অন্ধকার দূরীভূত হয় যেরকম তাঁর সংস্পর্শ সকলকেই তাঁরই প্যাটার্নে রূপায়িত করতো। সুন্দরের সহবাসে যেমন সব কিছু সুন্দর হয় সেই রকম তাঁর সাহচর্যে সকলেই আল্লাহ–প্রীতিতে, সত্যনিষ্ঠায় উজ্জীবিত হয়ে উঠতো। মাসুর-বিন্-মাজামা গর্বভরে বলেছেন: তাঁর সাহচর্য লাভে আমরা উৎসুক হতেম সদ্গুণরাশি শিক্ষা করতে ও আল্লাহ্-প্রীতিতে আপ্লুত হতে। মাসুদী বলেছেন: তাঁর সদগুণরাশি তাঁর অনুগামী অনুচর ও কর্মচারী সেনানায়কদের উদ্দীপিত করেছিল। সাল্মান ফারসী, আবুওবায়দাহ্ সা’দ-বিন্-আমীর তার জীবনের উৎকৃষ্ট প্রতিচ্ছায়া।
খেলাফতের গুরু কর্মভারে তাঁর সারাদিন ব্যস্ততায় কেটে যেতো এবং রাত্রি কেটে যেতো এবাদতে-আরাধনায়। রসূলুল্লাহর একটি মহৎ শিক্ষা হচ্ছে, কর্মনিষ্ঠা এবাদতেরই শামিল। কাজ পালিয়ে যোগাভ্যাসে ইসলামের শিক্ষা নয়। কর্মবীর ওমর কর্তব্য সাধনে ও ধর্মাচরণে সমান নিষ্ঠা দেখিয়েছেন। রাত কেটে যেতো তাঁর নফল ও তাহাজ্জুদের নামাযে সকালে সারা পরিবারকে জাগিয়ে তুলতেন নামায আদায় করতে কোরআনের বাণী উচ্চারণ করে: তোমার পরিবারকেও নামাযে বাধ্য করো। ফজরের নামাযে তিনি লম্বা সূরায় কেরাত পড়তেন-প্রায় একশবিশ আয়াত। সূরা ইউসুফ, সুরা হজ্জ, সুরা ইউনুস, সুরা কাহফ্ ও সুরা হুদ্ ছিল তাঁর প্রিয়। তিনি বলতেন যে, জামাতে নামায আদায় সারারাত এবাদতের চেয়েও পুণ্যময়। কিন্তু নামাযের আগে কাজ উপস্থিত হলে কাজটি সেরে নিয়ে নামাযে বসতেন। নামাযের সময়েই তিনি জেহাদের পরিকল্পনা করে ফেলতেন। তিনি নিজেই বলেছেন: নামায আদায় কালেই আমি সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করে নিই। ফজরের নামাযের সময় তিনি বাহ্রায়েনের ভূমিকরের পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন। মৃত্যুর দু’বছর পূর্ব থেকে তিনি দৈনিক রোযা অভ্যাস করেন। প্রতি বছরেই তিনি হজ্বে যেতেন এবং নিজেই ইমামতী করতেন। তেইশ হিজরীতে হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তনকালে তিনি আতার কঙ্করাকীর্ণ প্রান্তরে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন ও দুহাত তুলে প্রার্থনা করেন: “হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্, আমি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, আমার সব অঙ্গই দুর্বল হয়ে গেছে, আমার যাবার সময় এসে গেছে।’ তার দেড় মাসের মধ্যেই ওমর শাহাদত লাভ করেন।
রোজ কিয়ামত সম্বন্ধে ওমরের দারুণ ভীতি ছিল। সহীহ্ বুখারীর একটি উক্তি-মতে ওমর একদা আবু মুসা আশারীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন: আমরা যাঁরা প্রথমেই ইসলাম গ্রহণ করেছি ও রসূলুল্লাহর সঙ্গে হিযরত করেছি, সে সব কারণেই কি নাযাত বা মুক্তি পাবো না? শাস্তি বা পুরস্কার কিছুই চাই নে। যে আল্লাহ্ ওমরের জীবন স্বামী তাঁর নামে শপথ নিয়ে আমি শুধু এই চাই, যেন বিনা শাস্তিতে আমি পরিত্রাণ পাই। মৃত্যু শয্যায় যে কবিতাটি আবৃত্তি করেন, তার ভাবার্থ এই:
আমি আত্মার প্রতি অবিচার করেছি, আমি
মুসলিম, শুধু নামায রোযা করতে পারি।
অতুলনীয় এই ইসলামের নিষ্ঠা ও রসূলে আকরমের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে ওমর ‘আশারা-ই-মুবাশশারাহ্’ অর্থাৎ সুসংবাদপ্রাপ্ত ভাগ্যবান দশজনের একজন হিসেবে প্রখ্যাত। তিরমিযী-বর্ণিত একটি হাদীসে এই দশজন মহাভাগ্যের নাম উল্লেখিত হয়েছে, জীবদ্দশাতেই বেহেশ্বাসী হওয়ার সুসংবাদ লাভের অধিকাররূপে: আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী, তালহা, জুবায়ের, সাদ্-বিন্-আবি ওক্কাস, আবদুর রহমান বিন-আউফ, ওবায়দাহ্-বিন-জর্রাহ ও সাঈদ-বিন্-যায়েদ।
এখানে উল্লেখযোগ্য, ইসলামের এক উজ্জ্বল রত্ন হয়েও ধর্মনিষ্ঠ ওমর শুষ্কভাবে কঠোর ও সংকীর্ণ মন নিয়ে ইস্লাম চর্চা করেন নি বিধর্মীর প্রতি এতোটুকু ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য কখনও তাঁর আচরণে প্রকাশ পায় নি। ইমাম বুখারী ও ইমাম শাফী বলেন : এক খ্রিস্টান রমণীর কুজার পানি নিয়ে ওমর ওজু করেছেন। বাগাবী বলেন, ওমর খ্রিস্টানদের তৈরি পানীয় খেতে বলতেন। ওমরের আপন ভৃত্য ছিল খ্রিস্টান আতিক, মদীনায় ভূমি-করের মহাফেয ছিল খ্রিস্টান। ইরাক, সিরিয়া ও মিসরে ভূমি-রাজস্বের নথিপত্র লিখিত হতো সিরীক, কপ্টিক ও ফারসী ভাষায় এবং তার জন্যে এ কাজে ওমর খ্রিস্টান ও অগ্নিপূজকদের বহু সংখ্যায় নিযুক্ত করেছিলেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েও তিনি খ্রিস্টান ও ইহুদী জিম্মীদের কল্যাণার্থে বিশেষ ওসিয়ত করে যান। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ এটিকে ওমর-চরিত্রের এক মহৎ ও বিশেষ গুণ বলেছেন। ধর্ম নিয়ে, জাতি নিয়ে আজকার পৃথিবী যেভাবে হিংসায় উন্মত্ত ও ক্রুর হয়ে উঠেছে, তখন ওমরের এ মহৎ গুণ অনুশীলনের প্রয়োজন এসেছে।
ওমর ধর্মমতে যেমন উদার, তেমনি কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন। কা’বার হজুরে আসোয়াদ্ বা পবিত্র পাথরটিকে মুসলিমরা যেমন অন্ধভাবে ভক্তি দেখাতো, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, রসূলুল্লাহ চুম্বন না দিলে এটিকে ভেঙ্গে ফেলা হতো। হজ্বের সময় ‘রমল’ বা কা’বা গৃহটির চতুর্দিকে সহজভাবে তিনবার দৌড়ানোর রেওয়ায আছে। একদা রসূলুল্লাহ যখন মদীনা থেকে মক্কায় হজ্বে এসেছিলেন, তখন অমুসলমানেরা বিদ্রুপচ্ছলে বলেছিল, মুসলিমরা দারিদ্র্যে ও অনাহারে রোগা হয়ে গেছে, কাবা তওয়াফ, বা প্রদক্ষিণ করার সামর্থ নেই। হযরত তখন মুসলিমদের নির্দেশ দেন, দৌড়ে তওয়াফ করতে। তখন থেকেই এটি রেওয়ায হয়ে গেছে। কিন্তু ওমর বলেন: ‘রমল’ আর বাধ্যকর নয়, যে বেদীনদের দেখানোর জন্যে এ হুকুম দেওয়া হয়েছিল, তারাও আর নেই। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেন, রসূলুল্লাহ্ স্মৃতি বিজরিত থাকায় ওমর রেওয়াযটি বন্ধ করেন নি। ওমরের প্রিয়তম শিষ্য আবদুল্লাহ্-বিন্-আব্বাস বলতেন : লোকে ‘রমল’ সুন্না মনে করে, কিন্তু এ ধারণা ভুল।
জ্ঞানী ও সুধীর সমাবেশ ওমরের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। তাঁর অধিকাংশ সময় সাহাবা ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাহচর্যে কাটতো। এ বিষয়ে যুবক, বৃদ্ধ কোন বয়সের তারতম্য ছিল না। বুখারী বলেন যে, ওমরের নিত্যসঙ্গী ছিলেন মশহুর প্রবীণ ও জ্ঞানবৃদ্ধ সাহাবাগণ, তরুণ শিক্ষিত ও জ্ঞানীগণ এবং সকলের সঙ্গেই অসঙ্কোচে রাষ্ট্রের এবং ধর্মের জটিল সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করতেন ও তাঁদের মতামত গ্রহণ করতেন। ফিকাহ্ শাস্ত্র এ-সব মজলিসেই সুমার্জিত ও সংশোধিত হয়ে রূপায়িত হয়। আলী, ওসমান প্রমুখ জ্ঞানবৃদ্ধ প্রবীণ সাহাবাদের সঙ্গে ওবায়বিন্-ক্কাব, যায়েদ-বিন্-সাবিত, আবদুল্লাহ্-বিন্-মাসুদ, আবদুল্লাহ্-বিন্-আব্বাস, আবদুর রহমান, হুরর-বিন্-কিয়াস্ প্রভৃতি প্রতিভাদীপ্ত শিক্ষিতেরাও এ-সব মজলিসে উপস্থিত থাকতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, নবীনেরা প্রবীণদের সম্মুখে স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে ইতস্তত করলে ওমর তাদের উৎসাহ দিয়ে বলতেন, জ্ঞান বয়স অনুপাতে পরিমাপ করা যায় না। বহুবার অল্প বয়স্ক আবদুল্লাহ্ বিন্-মাসুদের কঠিন প্রশ্নের সহজ সুন্দর মীমাংসা করার ক্ষমতা দেখে ওমর আনন্দে বলে উঠতেন: আবদুল্লাহ্ সত্যই বিদ্যার জাহাজ। ওমরের আর একটি মহৎ গুণ ছিল প্রকৃত জ্ঞানীর সম্মান রক্ষা করা। এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ওমরের সমকালে এক আলী ভিন্ন অন্য কেউই জ্ঞানে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হওয়ার যোগ্য ছিলেন না। তবুও ওমর প্রকৃত জ্ঞানীদের এমন সম্মান দেখাতেন, এমন নম্র হয়ে ও সম্ভ্রম-সহকারে কথা বলতেন, যেন তাঁরা তাঁর গুরুজন। ওবাই বি-ক্কাবকে ওমর এতোখানি ভক্তি করতেন যে, তাঁর মৃত্যুতে ওমর এই বলে শোক প্রকাশ করেছিলেন: মুসলিম শ্রেষ্ঠ মানুষ আজ বিদায় নিয়ে গেলেন। আবু-গিফারী বদরের যুদ্ধে যোগদান করেন নি, তবুও ওমর তাঁকে বদর বিজয়ী বীরদের সমান বৃত্তিদানকালে বলেছিলেন, ধীশক্তিতে ও জ্ঞান-গরিমায় তিনি কারও দ্বিতীয় ছিলেন না। এইরূপ আবুওবায়দাহ্, সালমান ফারসী, ওমর-বিন্-সা’দ, আবু মুসা আশারী, সলিম, আবুদর্দা ওমর কর্তৃক উচ্চ সম্মানে ভূষিত হতেন।
কোন ব্যক্তিবিশেষ বা শ্রেণীবিশেষের উপর ওমরের করুণা বর্ষিত হতো না। যে কেউ কোন প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে সে-ই ওমরের স্নেহদৃষ্টি লাভে ধন্য হয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, বক্তা, কুলজী-বিশারদ, মল্লবীর, যোদ্ধা সকলেই ওমরের স্নেহ-সিঞ্চিত হয়েছেন অজস্র ধারায়। সমকালীন কবিশ্রেষ্ঠ মুতামমিম্-বিন্-নুয়ায়রার ভ্রাতা মালিক খালিদের হাতে নিহত হলে, কবি যে আকুল মর্মস্পর্শী ভাষায় শোকগীতি গাইতেন, তার দ্বারা অভিভূত নরনারীবৃন্দ তাঁর শোকে আকুল হয়ে ক্রন্দন করতো। একদা ওমর মুতামিমকে ডেকে তাঁর শোকগাথা শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কবি মর্মস্পর্শী ভাষায় ব্যক্ত করেন:
আমরা দুজন জসিমার দরবারে এতোখানি ঘনিষ্ঠ ছিলেম,
লোকে বলতো, আমাদের আর বিচ্ছেদ হবে না কিন্তু
আমরা তো বিচ্ছিন্ন হয়েই গেলেম এমনভাবে, যেন আমরা
একরাতও একত্রে কাটাই নি।
ওমর এই মর্সিয়া শ্রবণ করে আকুল হয়ে বলেছিলেন: আমার মর্সিয়া রচনার শক্তি থাকলে আমি এমনি ভাষায় যায়েদের জন্যে শোকগীতি রচনা করতেম।
এই প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কবিতার সমঝদার হিসেবে ওমরের স্থান অনেক উচ্চে। তাঁর কবিতা-কর্মের তেমন প্রমাণ না থাকলেও সমকালীন সাহিত্য সমালোচকরা একবাক্যে উল্লেখ করেন যে, তাঁর কবিতা-রস গ্রহণে শক্তি ছিল খুবই উচ্চস্তরের ও মার্জিতরুচির। ইনে-রাশিক ও জাহিজ একবাক্যে বলেন, ওমর ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবিতা-সমালোচক। সমকালীন ও পূর্ববর্তী সকল প্রতিষ্ঠাবান কবির কর্মের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর পরিচয়। তবুও তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কবি ছিলেন ইমরুল কায়েস, জাহির ও নাবিগা। আবার তাদের মধ্যে জাহিরের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি, কারণ তাঁর মতে জাহির ছিলেন ‘কবিদের কবি’; তিনি কবিতায় কঠিন কথা ব্যবহার করে দুর্বোধ্য করে তোলেন নি; তার ভাষা স্বচ্ছন্দ, লীলা-কৌতুকী তার ব্যঞ্জনা। জাহির ও নাবিগার বহু কবিতা ওমরের কণ্ঠস্থ ছিল। ইমরুল কায়েসের অপূর্ব কল্পনাশক্তি ও ভাষার ব্যঞ্জনা ওমরকে মুগ্ধ করতো। ওমর বলতেন: ইমরুল কায়েস কবিকূল-শিরোমণি। তিনি কবিতা কূপ থেকে সুরের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন, অন্ধ- ভাবকে চক্ষুদান করেছেন। বস্তুত ওমরের কাব্য-প্রীতি তীব্র ছিল এবং হাজার হাজার কবিতা তাঁর কণ্ঠস্থ থাকতো। কোনও সুন্দর বয়েত তাঁর নযরে পড়লেই তিনি বারবার সেটি আবৃত্তি করে কণ্ঠস্থ করে ফেলতেন। ঐতিহাসিকেরা বলেন, ওমরের এত কবিতা কণ্ঠস্থ ছিল যে, কোন কঠিন বিষয়ের মীমাংসা দানকালে একটি কবিতাংশ আবৃত্তি করে তিনি বিষয়টির উপরে মধু ঢেলে দিতেন। যে-সব কবিতায় আত্ম-সম্মান, স্বাধীনতা, মহত্ত্ব, আত্মসচেতনতা এবং মানবিক ও কুল-গৌরব প্রকাশ পায়, সেইসব কবিতা ওমরের প্রিয় ছিল এবং সিপাহ্ সালার থেকে প্রশাসনিক কর্মচারীদের এই সব শ্রেণীর উৎকৃষ্ঠ কবিতা কণ্ঠস্থ রাখতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বিশেষভাবে বলতেন, প্রত্যেক শিশুকেই সন্তরণ, অশ্বারোহন, প্রবচন ও উত্তম কবিতা মুখস্থ করা শিক্ষা দেওয়া উচিত 1 এখানে এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ব্যঙ্গাত্মক বা অপমানকর কিংবা যৌন ভাবোদ্দীপক, অশ্লীল কবিতাচর্চা ওমর একেবারে বন্ধ করে দেন। হাইফা নামক একজন কবিকে এরূপ কবিতা রচনার জন্যে ওমর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
ওমরের বাক্শক্তি ছিল অসাধারণ তাঁর ভাষণ হতো যেমন জোরালো তেমনই আকর্ষণীয়। তাঁর বক্তৃতায় যেমন তীক্ষ্ণবুদ্ধির ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির, তেমনই রসজ্ঞানের পরিচয় মিলতো। আমর মাযি-করবকে প্রথম দেখেই ওমর তাঁর প্রকাণ্ড চেহারায় অবাক হয়ে বলে ওঠেন: মাশাল্লাহ। ওর স্রষ্টা ও আমার স্রষ্টা কি এক? আমওয়াদের মহামারীর সময় ওমর যখন নিরাপদ স্থানে যাওয়া স্থির করেন, তখন অদৃষ্টবাদী আবুওবায়দা হ্ প্রতিবাদ করে বলেন: কি ওমর! আল্লাহ্র ইচ্ছা থেকে কোথায় পালাচ্ছো? ওমর শান্ত কণ্ঠে বলেছিলেন: হাঁ! আমি আল্লাহ্র ইচ্ছা থেকে তাঁর ইচ্ছার দিকে যাচ্ছি। তাঁর বক্তব্য হতো পরিচ্ছন্ন ও হৃদয়গ্রাহী। খেলাফতের রশ্মি হাতে নিয়ে ওমর প্রথম ভাষণে বলেছিলেন: মহিমাময় আল্লাহ্, আমি কঠোর, আমায় কোমল করো, আমি দুর্বল আমায় সবল করো। এখন আরবীরা বেয়াড়া উটের মতো, কিন্তু তার নাসিকা রজ্জু আমার হাতের মুঠিতে। দেখো, আমি তাকে ঠিকপথে চালাবো। দু-তিন দিন পরেই ইরাক অভিযানের সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি যে উদ্দীপনা-সঞ্চারী ভাষণ দেন, তার ফলে সমগ্র আরবজাতি যুদ্ধে মেতে ওঠে। দামে সফরকালে জাবিয়ায় যখন তিনি বক্তৃতা করেন, সে মজলিসে বহু জাকির ও বহু ধর্মাবলম্বী শ্রোতা ছিল, খোদ খ্রিস্টান বিশপ উপস্থিত ছিলেন। বহু সামরিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আলোচনার বিষয় মুসলিমদের মনোবল উজ্জীবিত করার প্রয়োজন ছিল; অমুসলিমদের ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্য বর্ণনা করে শান্তি জেহাদের তাৎপর্য বর্ণনা করে শান্তি ও জেহাদের তাৎপর্য বুঝানোর দরকার ছিল; আবার, খালিদের পদচ্যুতির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণ বিশদ করারও প্রয়োজন ছিল। ওমর এ সময়ে যে তেজোময়ী জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন তা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়েছে। লোকের মুখে মুখে তাঁর উক্তিগুলি বহুদিন গুঞ্জরিত হতো, সাহিত্যিক তা থেকে রচনার চিন্তা-ভাবনা সংগ্রহ করতেন, নীতিবিদ তা থেকে নৈতিক শিক্ষার আদর্শ পেতেন, আর আইবিদ্, খুঁজতেন আইনের সূত্র। তেইশ হিজরীতে হজ্ব সমাপন করে মদীনায় ফিরে এসে ওমর জুমার খুত্বা দানকালে খলিফা নির্বাচন বিষয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সাকিফায়ে বানি-সাদায় গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মন্ত্রণা, আনসারগণের বিভেদ-প্রয়াস, আবুবকরের যুক্তিগর্ভ উত্তর, ওমরের সব আলোচনা তর্কের অবসান করে দিয়ে আবুবকরের আনুগত্য গ্রহণ প্রভৃতি বিতর্কমূলক প্রশ্নের উপর এমন সর্ব-তর্ক-সন্দেহ-নিরসনকারী আলোকপাত করেন, যার দরুন পরিষ্কারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল যে, এ মহাসন্ধিক্ষণে যা মীমাংসা করা হয়েছিল, তাই ছিল সর্বোত্তম এবং দ্বিতীয় কোন পন্থা ছিল না।
ওমর সাধারণত উপস্থিত-মত বক্তৃতা দিতেন, গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে পূর্ব থেকে প্রস্তুতি নিতেন। কিন্তু কখনও লিখিত ভাষণ দেন নি। যে কোন বিষয়, যে কোন সময়ে মজলিসের মেযাজ বুঝে তিনি এমন তোজোদীপ্ত যুক্তিগর্ভ বক্তৃতা দিতে পারতেন যে, শ্রোতাগণ নির্দ্বিধায় তার মতানুকূলে ঢলে পড়তো। ওমরই রাজনৈতিক বক্তা, যিনি সব সময় নিজের মতানুযায়ী শ্রোতাদের চালিত করতে পারতেন। তিনি যখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা
দিতেন তখন সমাগত মজলিসে তাঁর মাথা সকলের উর্ধ্বে ছাপিয়ে উঠতো এবং তাঁর উদাত্ত, গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে সব গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যেতো। এখানে, কয়েকটি ঐতিহাসিক বক্তৃতার অংশবিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। প্রশাসনিক কর্মচারীদের একদা তিনি বলেছিলেন:
আমার মতে তিন রকমে অর্থের ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে: প্রথমত সর্বদাই ন্যায়পথে অর্থ সংগ্রহ করবে, দ্বিতীয়ত ন্যায়ভাবে অর্থ ব্যয় করবে আর তৃতীয়ত অন্যায়ভাবে অর্থ ব্যয় করা একেবারে বন্ধ করতে হবে। আমি স্বেচ্ছাচারীকে ভূপাতিত করবো, তার একগাল মাচিতে রেখে আর একগাল পা দিয়ে চেপে ধরবো, যতক্ষণ না সে স্বীকারোক্তি করে। হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহ তাঁর নিজস্ব বিষয়ে খুবই কঠোর, তিনি ফেরেশতাদেরকে ঈশ্বর বলার অধিকার দেন নি। তোমরা নিশ্চিত জেনে রাখো! আমি তোমাদের স্বেচ্ছাচারী করি নি তোমাদের আমি মোমেনদের পদপ্রদর্শক নিযুক্ত করেছি। তোমাদের সাধুজীবনই জনগণের অনুসরণের যোগ্য হবে।
অন্য একবার তিনি বলেছিলেন :
তোমরা দুনিয়ার খলিফাতুল্লাহ্! স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর তোমাদের অবাধ অধিকার। আল্লাহ্ তোমাদের ধর্ম চিরস্থায়ী করেছেন। এখন তোমাদের ধর্মের শত্রু আর কেউ নেই। কিন্তু দুটি শত্রু এখনও আছে; প্রথম যারা ইসলামের বশ্যতা মেনে নিয়েছে অথচ তারা পরিশ্রম করছে, ব্যবসা করছে আর তোমরা যারা তাদের মুনাফা লুটে নিচ্ছো। দ্বিতীয়ত যারা কেবল বিপ্লবের প্রতীক্ষায় আছে। কিন্তু আল্লাহ্তায়ালা ভয়ার্ত করে তুলেছেন, আল্লাহ্র সেনারা তাদের বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। সেনারা এখন তাদের বাসগৃহ অফুরন্ত ভাণ্ডারে ভরিয়ে ফেলেছে এবং সীমান্তসমূহে দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ও অজেয় বাহিনী রয়েছে।
ওমর প্রায় ক্ষেত্রেই বক্তৃতা শেষ করতেন এই বলে :
হে আল্লাহ! আমায় ভুল পথে চালিত করো না, আমায় যেন সহসা জওয়াবদিহি করতে না হয়, আর আমায় তুমি যেন কখনো অবহেলা করো না, বঞ্চিত করো না।
ওমরের লেখনী চলতো বাক্শক্তির সঙ্গে সমান তালে। তাঁর ফরমানগুলি, পত্রাবলী সরকারী হুকুমনামাসমূহ প্রভৃতির আজও অস্তিত্ব রয়ে গেছে এবং সেগুলি তার লিপিকৌশল ও বর্ণনাভঙ্গির ঋজুতার অপূর্ব ক্ষমতার পরিচয় বহন করে। যে বিষয়েই তিনি কলম ধরেছেন, তাই ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যে ও গাম্ভীর্যে অনন্য হয়ে উঠেছে উদাহরণস্বরূপ তাঁর বিচার সম্পর্কীয় পূর্বোল্লিখিত ফরমানটির কথা স্মরণীয়। এখানে তাঁর দুটি লিপির কিয়দংশ উদ্ধৃত করা যায়। আবু মুসা আশারীকে লেখা একখানি পত্ৰ :
লোকে সাধারণত শাসককে ঘৃণার চোখে দেখে। পাছে লোকে আমায় সেই চোখে দেখে, তার জন্যে আমি আল্লাহ্ শরণ ভিক্ষা করি। বৃথা সন্দেহ পোষণ করবে না, দ্বেষ, হিংসা থেকে দূরে থাকবে এবং লোককে বৃথা উচ্চাশায় উৎসাহ দিও না। আর আল্লাহ্ হক সম্বন্ধ সর্বদাই সচেতন থাকবে। অসৎ লোকেরা যাতে ঐক্যবদ্ধ না হয় সে বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকবে। যদি কোন জাতিকে মুসলিম রাষ্ট্র সম্বন্ধে হিংসাপরায়ণ দেখো, তা হলে এমন শয়তানী বুদ্ধির জন্যে অস্ত্রমুখেই সে জাতিকে নির্মূল করবে, যদি তারা আল্লাহ্ বিধান না মানে ও সৎপথে না আসে।
আবু মুসাকে অন্য এক পত্রে লিখেছিলেন :
দীর্ঘসূত্রতায় গা ভাসিয়ে না দিলে মানুষের কাজ শেষ করবার প্রবৃত্তি নিজে থেকেই জন্মে। কারণ, একবার ঢিলেমি শুরু করলে কর্ম হয়ে ওঠে প্রবল আকার, তখন কোনটা করবে, কোনটা করবে না, কিছুই স্থির করতে পারবে না, ফলে সব কাজই, মাটি হয়ে যাবে।
আমর-বিন্-আল-আস্ মিসরের শাসক নিযুক্ত হয়ে খাজনা ওয়াসীল করতে দেরী করতে থাকেন। ওমর তাগাদা দিলেও আমর দেরী করতে থাকেন। তখন ওমর কড়া সুরে লেখেন:
আমি বেশ বুঝতে পারছি, তোমার অধীনস্থ কর্মচারীরা সৎ নয় বলেই তোমার জওয়াব দিতে দেরী হচ্ছে। তারা তোমায় আড়াল ভেবেছে, কিন্তু আমি এর যোগ্য ওষুধ জানি। আমি আশ্চর্য হচ্ছি যে, তোমায় বারবার বিশেষ করে লিখছি, অথচ তুমি খাজনা পাঠাচ্ছো না, সোজা জওয়াবও দিচ্ছ না। ভালকথা, আবু আব্দুল্লাহ্! কিছু ভেবো না। তোমার নিকট থেকে প্রাপ্য যথাযোগ্য আদায় হবে এবং তুমিও দেবে: দরিয়া যেমন মুক্তা বের করে দেয় সেই রকম তোমাকেও প্রাপ্য গণ্ডা বুঝিয়ে দিতে হবে।
ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ওমর আরবী ভাষা উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। মদীনায় হিজরত করার পর তিনি হিব্রু ভাষাও শিখে ফেলেন। দারিমি মসনদে উল্লেখ করেছেন, ওমর হিব্রু ভাষায় তওরাত পাঠ করে হযরতকে শোনাতেন। তওরাত পাঠ করেই ওমর ইহুদীদের মধ্যে প্রচারিত অলিক কাহিনীগুলির অসারতা সম্যক জ্ঞাত হন এবং এ সম্বন্ধে মুসলিমদের অবহিত করেন। তার বিচার-শক্তিও প্রখর হয়, দূরদর্শিতা প্রসারিত হয় এবং বুদ্ধি-বৃত্তি তীক্ষ্ণ হয়। সমসাময়িক বহু গ্রন্থে ওমরের বহু সুভাষিতের উল্লেখ আছে। এখানে কয়েকটি উদ্ধৃত করা গেল:
যে নিজের বুদ্ধিতে চলে, সে নিজের বিষয়কর্ম আয়ত্তে রাখে।
* * *
যাকে ঘৃণা করো, তাকে ভয়ও করবে।
* * *
সে-ই সবচেয়ে বুদ্ধিমান, যে নিজের কাজের জবাবদিহি করতে পারে।
* * *
আজকের কাজ কালকের জন্যে ফেলে রেখো না।
অর্থে কারও মাথা উঁচু হয় না।
* * *
যা পিছু হটে, তা আগে বাড়ে না।
* * *
যে মন্দ জানে না, সে মন্দ করবেই।
* * *
আমায় কেউ প্রশ্ন করলেই তার বিদ্যার বহর বুঝতে পারি।
* * *
অন্যকে উপদেশ দেওয়ার পূর্বে নিজের দিকে তাকিও।
* * *
যতোই সংসারে অনাসক্ত হবে, ততই স্বাধীন হবে।
* * *
তওবার তিক্ততা সহ্য করার চেয়ে পাপ না করা অনেক ভাল।
* * *
প্রত্যেক অসাধু লোকের পিছনে আমার দুটি প্রহরী আছে পানি ও কাদা।
* * *
ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা যদি দুটি উটনী হতো, তা হলে আমি নির্বিচারে একটায় চড়ে বসতেম।
* * *
যে আমার একটি ভুল আমায় উপহার দেয়, আল্লাহ্ করুণা তার উপর
* * *
কারও নাম-যশ শুনেই বিভ্রান্ত হয়ো না।
* * *
কারও নামায-রোযা দেখেই তার বিচার করো না, তার জ্ঞান ও সাধুতার দিকে লক্ষ্য রেখো।