শহর পত্তন ও পূর্তবিভাগ
ওমরের খেলাফত আমলে নয়া নয়া শহরের পত্তন একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। এ-সব শহর নির্মাণকল্পে খলিফা কেবল ইচ্ছা প্রকাশ করে কিংবা নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন নি, নিজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন এবং অনেক সময় পরিকল্পনাও স্বয়ং প্রস্তুত করে দিতেন। এভাবে বসরা, কুফা, ফুস্তাত, মুসাল জাজিরাহ্ প্রভৃতি ইতিহাস প্রসিদ্ধ নগরের সৃষ্টি হয়।
পূর্বে পারস্য-উপসাগর বেয়ে পারসিক ও ভারতীয় জাহাজগুলি আবালাহ্ বন্দরে নোঙ্গর ফেলতো এবং তার দরুণ খাসআরব অঞ্চল সহজে পারস্য ও ভারত থেকে হঠাৎ আক্রমণীয় ছিল। এজন্যে ওমর নিরাপত্তা রক্ষার্থে বন্দর থেকে অনতিদূরে একটি শহর পত্তন করার জন্যে ১৪ হিজরীতে ওবা-বিন্ খাওয়ানকে নিয়োগ করেন। ওমর স্থান নির্মাণ ও পরিকল্পনাও প্রস্তুত করে দেন। খারিবার আশপাশ নিয়ে বসরা শহরের পত্তন হয়। তখন এটা মুক্ত প্রান্তর ও কঙ্করাকীর্ণ ছিল, কিন্তু পানি ও চারণভূমিও ছিল, আর এজন্যেই আরবী মেযাজের অনুকূল স্থান ছিল। ওৎবা শহর নির্মাণকালে স্থানটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের জন্যে নির্দিষ্ট মহল্লায় বিভক্ত করেন এবং বাসের জন্যে মাটি কুটা দিয়ে অসংখ্য কুটির নির্মাণ করেন। সেগুলি বিভিন্ন গোত্রের নয়া বাসিন্দাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। জামে-মসজিদ ও দফতরখানাসহ রাষ্ট্রভবনটি সবচেয়ে বৃহৎ দর্শনীয় ছিল। ১৭ হিজরীতে এক অগ্নিকাণ্ডে অধিকাংশ বাসগৃহ ভস্মসাৎ হয়ে যায়। তখন কুফার শাসক সা’দ-বিন-ওক্কাসের আবেদনক্রমে ওমর ইটের ঘর প্রস্তুতের অনুমতি দেন, কিন্তু নির্দেশ দেন, কেউ তিনটির চেয়ে বেশি কামরাবিশিষ্ট ঘর তুলতে পারবে না। দজলা (ট্রাইগ্রিস) নদী কুফা থেকে দশ মাইল দূরে প্রবাহিত ছিল। ওমরের আদেশে নদীটি থেকে একটি খাল খনন করে শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বসরা নামকরণ সম্বন্ধে আরব অভিধানিকরা বলেন, আরবী ‘বাহ’ শব্দের অর্থ কঙ্কর, এজন্যেই কঙ্করময় স্থানটি বসরা নামাঙ্কিত হয়। পারসিক পণ্ডিতদের মতে ‘বিস্াহ্’ অর্থাৎ বহু সড়কের সংযোগস্থল বিধায় বস্রা নামের উৎপত্তি হয়েছে। যা হোক, আবহাওয়া প্রীতিপ্রদ হওয়ায় শীঘ্রই শহরটি জনবহুল হয়ে ওঠে এবং প্রায় আশি হাজার শহরবাসীর নাম সৈন্য তালিকাভুক্ত হয়। কালক্রমে বা ওলামাপ্রধান আরবী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। এখানেই খলিল বস্ত্রী কর্তৃক প্রথম আরবী অভিধান ‘কিতাবুল-আইন্’ সঙ্কলিত হয়, আরবী ছন্দ-প্রকরণ ও সংগীত চর্চার সৃষ্টি হয়। আবার এখানেই ইমাম আবু হানিফা জন্মগ্রহণ করে হানাফী মযহাবের সৃষ্টি করেন এবং কাজী আবু ইউসুফ, ইমাম মুহম্মদ প্রমুখের সহযোগিতায় ফিকাহ্র উন্নতি সাধন করেন। হাদিস ও ফিকাহ্র বহু মহামনীষীর জন্ম ও কর্মক্ষেত্র হিসেবেও বস্ত্রা মুসলিম ধর্মেতিহাসে অমর হয়ে আছে।
মাদায়েন অধিকৃত হওয়ার পর সা’দ বিন্-ওক্কাস্ খলিফার নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন যে, স্থানীয় আবহাওয়ায় সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে। ওমর তখনই নির্দেশ দেন, সাগর ও বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটা নতুন শহর পত্তন করে সেখানে সেনানিবাস স্থাপন করতে। তখন হুদায়ফা ও সালমন কুফায় নতুন শহরের স্থান নির্বাচন করেন। ফোরাত (ইউফ্রেতিস) নদীকূল থেকে দুমাইল দূরে অবস্থিত স্থানটি বালু ও কঙ্করময় ছিল এবং আবহাওয়া আরামদায়ক ছিল। ১৭ই হিজরীতে কুফার পত্তন হয়। আরবরা কুফাকে ‘খাদ্ উল্ আযরা’ বা প্রেমিকের গণ্ডদেশ নামে উল্লেখ করতো, আর তার কারণ এই যে, এখানে নানাবিধ আরবী ফুল অজস্রভাবে ফুটতো। প্রথমে চল্লিশ হাজার বাসগৃহ নির্মিত হয় কুটা-মাটি দিয়ে এবং সেগুলিকে বিভিন্ন মহল্লায় বিভক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন আরব গোত্রের মধ্যে বন্টন করা হয়। ওমর নিজে শহরের নির্মাণ পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। প্রধান সড়কগুলি চল্লিশ হাত, দ্বিতীয় শ্রেণীর সড়ক ত্রিশ হাত, তৃতীয় শ্রেণীর সড়ক কুড়ি হাত ও গলিরাস্তাগুলি সাত হাত প্রশস্ত ছিল। জামে-মসজিদটি বৃহৎ আকারে একটা উঁচু টিলার উপর নির্মিত হয়, সেখানে চল্লিশ হাজার মুসল্লী একযোগে নামায আদায় করতে পারতেন। মসজিদের সম্মুখে একটি বিরাট মণ্ডপ নির্মিত হয়, সেটি একশো গজ লম্বা ছিল এবং খামগুলি ইরানের খসরুদের বালাখানা থেকে সংগৃহীত মর্মর নির্মিত ছিল। কুফাতেও অগ্নিকাণ্ডে মাটির ঘরগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ওমর ইষ্টক নির্মিত গৃহনির্মাণের অনুমতি দান করেন। মসজিদ থেকে মাত্র একশো গজ দূরে রাষ্ট্র ভবন নির্মিত হয়। সেখানে খাজাঞ্চীখানাও অবস্থিত ছিল। তার সংলগ্ন একটি সাধারণ অতিথিশালা নির্মিত হয়। এখানে পথিকেরা বিনামূল্যে আহার ও বাসস্থান লাভ করতো। সাত শতক পরে ইবনে বতুতা কুফা সফর করতে এসে সা’দ কর্তৃক নির্মিত রাষ্ট্রভবনের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
জামে মসজিদ ব্যতীত আরও বহু মসজিদ প্রত্যেক মহল্লায় নির্মিত হয়েছিল। কুফায় বার হাজার ইয়ামেনবাসী ও আট হাজার নযরগোত্রীয় লোক বসতি করে; তা ছাড়া প্রায় আরও কুড়িটি গোত্রের অধিবাসীর নামোল্লেখ দেখা যায়। কুফায় প্রধানত আরবরাই বাসস্থান নির্মাণ করে এবং আরব-শক্তি ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে 1 ওমরের জীবদ্দশাতেই কুফা এরূপ জনবহুল ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে, তিনি কুফাকে ইসলামের শিরোমণি হিসেবে অভিহিত করেন।
মিসরে ফুতাত শহরের পত্তন হয় একটি তাঁবুকে কেন্দ্র করে, এবং তাঁবুর আরবী শব্দ ‘ফুসতার্ত’ বিধায় শহরটি এভাবে নামাঙ্কিত হয়ে যায়। কথিত আছে, আমর-বিন্- আস্ যখন আলেকজান্দ্রিয়ায় অভিযান উদ্দেশ্যে কসরউল্-সামা ত্যাগ করেন, তখন লক্ষ্য করেন যে, তাঁর নবনির্মিত তাঁবুতে একটি কবুতর বাসা তৈরী করেছে। তিনি হৃষ্টকণ্ঠে বলেন, এটি অক্ষত রেখে দাও, যাতে আমাদের অতিথির অসুবিধা না হয়। এখন ওমরের নির্দেশে তিনি তাঁবুটিকেই কেন্দ্র করে ফুস্তাত শহরের পত্তন করেন। এখানেও কয়েক হাজার কাঁচাঘর তোলা হয় ও বিভিন্ন গোত্রীয় লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। জামে-মসজিদটি নির্মাণে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। জুবায়ের প্রমুখ আটজন বিশিষ্ট সাহাবা মসজিদের কিলাহ্ নির্ণয় করেন। মসজিদটি পঞ্চাশ গজ প্রস্থে হয় ও তিনটি দরওয়াজা থাকে। তার একটি দরওয়াজার সম্মুখে মাত্র সাত গজ দূরে বিশাল রাষ্ট্রভবন নির্মিত হয়। শহরটির পত্তন হয় ২১ হিজরীর শেষভাগে।
ফুস্তাত শীঘ্রই জনাকীর্ণ সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে, এবং আলেকজান্দ্রিয়ার নাম-যশ অবলুপ্ত করে দিয়ে মিসরের প্রাণ-কেন্দ্রে পরিণত হয়। শহরের আরব বাসিন্দাদের সংখ্যা চল্লিশ হাজারের উর্ধ্বে ছিল। কুদাই-এর বিবরণ মতে ফুস্তাতে ছত্রিশ হাজার মসজিদ, আট হাজার সড়ক ও প্রায় বারো শত সাধারণ স্নানাগার ছিল। মারিযী কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণীতে শহরটির ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকের উল্লেখ করেছেন। বহু শতাব্দী ধরে ফুস্তাত মিশরের রাজধানী এবং শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল। চারশো বছর পরে বশারী পৃথিবী পরিক্রমণকালে ফুস্তাতের সমৃদ্ধিতে অভিভূত হয়ে নিজের ভূ- বিবরণীতে লিপিবদ্ধ করেন: এই শহরটি বাগদাদের নাম রাহুগ্রস্ত করেছে, এটি পাশ্চাত্যের ধনাগার ও ইসলামের গৌরব। মুসলিম জগতের মধ্যে এখানকার মসজিদের ন্যায় এতো আলেমের সমাবেশ অন্য কোনখানে নেই, এবং এখানকার বন্দরের ন্যায় কোথাও এতো বেশি জাহাজের সমাগম হয় না।
মুসাল্ শহরের পত্তন হয়েছিল ইসলামের বহু পূর্বে; কিন্তু ওমরের আমলে তার ভগ্নদশা উপস্থিত, একটি দূর্গ এবং কয়েকটি গীর্জা ও মঠ নিয়ে ছিল তার অস্তিত্ব। ওমর শহরটি নয়ারূপে পত্তন করেন। হারসামা বিন্-আরফজা নির্মাণকাজে নিযুক্ত হন এবং কয়েক হাজার বাসগৃহ নির্মাণ করে বহু আরব গোত্রের পুনর্বাসন করেন। একটি জামে- মসজিদ ও কয়েকটি সরকারী বালাখানা নির্মিত হয়। শহরটির রাজনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য, কারণ এটি ছিল, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনক্ষেত্র এবং এজন্যেই তাঁর মুসাল্ নাম সার্থক। বিখ্যাত ভৌগোলিক ইয়াকুত হাম্বী বলেন: লোকে বলে, পৃথিবীতে তিনটি বৃহৎ নগরী আছে-প্রাচ্যের প্রবেশদ্বার নিশাপুর, পাশ্চাত্যের প্রবেশদ্বার দামেক এবং প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন পথ মুসাল। যে কেউ পৃথিবী পদচারণে বহির্গত হলে তাকে মুসালের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
সর্বশেষে ওমরের নির্মিত অন্যতম শহর জামিরার বর্ণনা করা যেতে পারে। এটি নির্মিত হয় নীলনদের পশ্চিম তীরে ফুস্তাতের ঠিক বিপরীত দিকে। আমর প্রথমে আলেকজান্দ্রিয়াতেই রাজধানী স্থাপনের কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু ওমরের নির্দেশে তা সফল হয় নি। তবু নীলনদের অপর পারে একটি ঘাঁটি প্রস্তুত করার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেন, যার উপস্থিতিতে রোমকরা নীল নদের অপর তীরে সময়-অসময় হানা দিতে না পারে। আমর এ প্রস্তাব খলিফার নিকট পেশ করলে ওমর একটি কিল্লা নির্মাণের অনুমতি দেন। ২১ হিজরীর মধ্যে কিল্লাটি ও তাঁর চতুর্দিকে শহর গড়ে ওঠে কালক্রমে জাজিরা ইসলামী ধর্মশিক্ষার একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বহু বহু মশহুর আলেম ও মুহাদ্দিসের জন্মভূমি এই জাজিরা। ‘মুজ্জ্মা-উল্-বুল্ দানে’ জাজিরার সমৃদ্ধি ও মনীষীবৃন্দের চিত্তাকর্ষক কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে।
শহর পত্তনের সঙ্গে পূর্তবিভাগীয় কার্যসমূহের আলোচনা বাঞ্ছনীয়। বলা বাহুল্য, পূর্তবিভাগ বলতে আজকাল যা বোঝায়, তেমন কোনও প্রতিশব্দ আরবী ভাষায় লক্ষ্য করা সুদুর্লভ। মিসর ও সিরিয়ায় তার নাম ছিল নযারাত্-ই-নাফিয়া। এই বিভাগের উপর ন্যস্ত কার্যভার ছিল সরকারী ভবন হাসপাতাল, খাল, পথ ও পুলের নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ওমরের খেলাফতকালে এ সব কাজের জন্যে কোনও স্বতন্ত্র বিভাগ গড়ে ওঠে নি, কিন্তু এক হাসপাতাল ব্যতীত এ বিভাগের অন্য সব কাজের উপযুক্ত বন্দোবস্ত হয়েছিল ওমরের আমলে।
প্রথমে ধরা যাক সরকারী ভবন নির্মাণের উদ্যোগ। ওমর মোটামুটি তিন শ্রেণীর গৃহ নির্মাণ করেছিলেন সরকারী ব্যয়ে; মসজিদ; সমরবিভাগীয় ভবন, যথা, সেনাবারিক, সেনানিবাস ও দুর্গ; এবং প্রশাসনিক গৃহাদি। বিভাগীয় নির্মাণকার্যের বর্ণনা অন্যত্র বিশদ হয়েছে। প্রশাসনিক গৃহাদি ছিল: দারুল-আমারত বা প্রাদেশিক ও জেলা- মহকুমার সরকারী কর্মচারীদের বাসভবন; দিওয়ান বা সরকারী দফতরখানা; বায়তুল- মাল বা সরকারী খাজাঞ্চিখানা; জেলখানা, যা প্রথমে মদীনায় ও বসরায় নির্মিত হয় এবং মুসাফিরখানা। বালাজুরী বলেন, ওমর নির্দেশ দেন যে, মুসাফিরদের আরাম ও আহারের ব্যবস্থার জন্যে প্রত্যেক শহরে মুসাফিরখানা নির্মিত হবে। মদীনায় মুসাফিরখানা স্থাপিত হয় ১৭ হিজরীতে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এ সব সরকারী ভবন ওমরের আমলে যথাসম্ভব কম খরচে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত হতো। বায়তুল-মাল থেকে অনর্থক ব্যয় এরূপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল যে, প্রয়োজনাতিরিক্ত একটি মুদ্রাও ব্যয়িত হলে তার কৈফিয়ৎ দিতে হতো জনগণের সম্মুখে মজলিস-ই-শুরায়। খলিফা যতোই ব্যক্তিত্বশালী হোন, বায়তুল-মাল নিয়ে যথেষ্ট ব্যয় তাঁর ক্ষমতাতীত ছিল।
ওমরের আমলে কৃষিকাজের উন্নতিকল্পে যে সব খাল খনন করা হয়েছিল, পূর্বে তার উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব ছাড়াও বহু খাল খনিত হয়েছিল পানীয় জলের অভাব পূরণের জন্যে এবং ব্যবসার প্রসারকল্পে। আবু মুছা খাল খনন করা হয়েছিল বস্ত্রার লোকের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে। এ খালটির দৈর্ঘ্য ছিল নয় মাইল, এবং দজলা নদী থেকে সুমিষ্ট পানি বসার ঘরে ঘরে প্রচুর পরিমাণে সরবরাহ করা হতো।
আরবীতে একটা প্রবচন আছে, “আল্লাহ্র খাল প্রবাহিত হলে মাকালার খাল অকেজো হয়ে পড়ে”। বলা বাহুল্য এ খালটি ও মা-বিন্-ইয়াসার কর্তৃক খনন করা হয়েছিল দজলা নদী থেকে খাবার পানি স্থানীয় লোকদের সরবরাহ করতে। আনবারের বাসিন্দাদের আবেদনক্রমে কুফার শাসক সা’দ পানীয় জলের অভাব মোচনার্থে একটি খাল খনন আরম্ভ করেন, কিন্তু মধ্যপথে পাহাড়ের বাধা দেখা যায় ও সেখানেই পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তীকালে হাজ্জাজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সুড়ঙ্গ কেটে খালটি প্রবাহিত করেন, কিন্তু খালটি সাদেরই নামাঙ্কিত থেকে যায়।
সবচেয়ে দীর্ঘ ও প্রয়োজনীয় খাল ওমরের আমলে করা হয়েছিল নীলনদ থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত। এটির নাম ছিল আমীরুল মুমেনীনের খাল। ১৮ হিজরীতে আরবে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। ওমর প্রত্যেক প্রাদেশিক ও জেলা-শাসককে নির্দেশ দেন প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য ক্রয় করে মক্কায় প্রেরণ করতে। সিরিয়া ও মিসরে প্রচুর খাদ্যশস্য সংগৃহীত হলো, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল, আরবে কিভাবে সে-সব শস্য চালান করা যায়। আমর-বিন্-আস কয়েকজন বিশিষ্ট মিসরবাসীকে নিয়ে মদিনায় আলোচনা করতে আসেন, কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়। সব কিছু বিবেচনা করে ওমর নির্দেশ দেন, নীলনদের সঙ্গে খাল কেটে লোহিত সাগর যদি সংযুক্ত করা যায়, তা হলে জলপথে মাল-চলাচল সহজ ও দ্রুত হবে, এবং আরবে কখনও দুর্ভিক্ষ হবে না। আমর ফুতাত থেকে ঊনসত্তর মাইল খাল কেটে লোহিত সাগরে যোগ করে দেন। মাত্ৰ ছয় মাসে কাল সম্পূর্ণ খনিত হয় এবং প্রথমেই কুড়িটি জাহাজভর্তি ষাট হাজার আরুব ওজনের খাদ্য-শস্য মদীনায় উপস্থিত হয়। এভাবে খালটি বহুকাল আরব ও মিসরের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ রক্ষা করে। উমাইয়া খলিফা ওমর-বিন-আবদুল আযিযের (৭১৯-৭২০ খ্রি.) সময় খালটি স্থানে স্থানে মজে যেয়ে ধান্ বুল তামসাহ-নামক স্থানে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, আমর লোহিতসাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ ঘটাবার উদ্দেশ্যে একটি বৃহৎ খাল খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং সত্তর মাইল দীর্ঘখালের একটি নক্শাও প্রস্তুত করেন। ওমরের নিকট প্রস্তাব পাঠানো হলে তিনি এই যুক্তিতে অননুমোদন করেন যে, এ খাল প্রস্তুত হলে গ্রীক নৌবহর সহজেই লোহিত সাগরে হানা দিয়ে আরবে হামলা করবে ও লুটতরাজ চালাবে। আমরের পরিকল্পনা বাস্তবে রূপায়িত হলে প্রায় সাড়ে বারো শো বছর পূর্বে সুয়েজ ক্যানেলের অনুরূপ পৃথিবী-বিশ্রুত খাল খননের কৃতিত্ব আরবদেরই হতো।
ওমরের আমলে বহু সড়ক ও পুল প্রস্তুত হয় এবং আরব থেকে সিরিয়া ও পারস্যের প্রত্যন্ত অঞ্চল যাতায়াত সুগম হয়। তাঁর খেলাফতকালে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যে-সব সন্ধি হতো, তার মধ্যে একটা শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো যে, স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের শ্রম ও অর্থে পথগুলি ও পুলসমূহ প্রস্তুত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে। আবুওবায়দাহ্ সিরিয়া জয় করলে সন্ধিপত্রে এই বিশেষ শর্তটি সন্নিবেশিত হয়।
মক্কা শরীফ যদিও বহু শতাব্দী ধরে সারা আরবের তীর্থ কেন্দ্র ছিল, মক্কা যাওয়ার রাস্তাগুলি সুগম ছিল না। ১৭ হিজরীতে ওমর যখন মক্কা শরীফ গমন করেন, তখন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় এবং তাঁর নির্দেশে অবিলম্বে মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত দীর্ঘ ২২০ মাইল (মতান্তরে ২৭০ মাইল) রাস্তা নতুনরূপে প্রস্তুত হয় এবং প্রত্যেক মনযিলে সরাইখানা নির্মিত ও কূপ খনন করা হয়। এ সম্বন্ধে পাক-ভারতের শ্রেষ্ঠ মনীষী শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ‘ইয়ালাতুলখিফ’য় বলেছেন: অন্যান্য কাজের মধ্যে ওমর যখন মক্কায় ওমরাহ করতে যান, তখন প্রত্যাবর্তনকালে নির্দেশ দেন, যেন দুটি পবিত্র শহরের মধ্যবর্তী পথের প্রত্যেক মনযিলে মুসাফিরখানা নির্মাণ করা হয়, মজে যাওয়া কূপগুলির সংস্কার করা হয় এবং দরকারক্ষেত্রে নতুন কূপও খনন করা হয়। এভাবে হাজীদের যাত্রাপথে সুগম ও আরামপ্রদ করা হয়েছিল।
ওমরের খেলাফতকে বলা যেতে পারে মসজিদ-নির্মাণের স্বর্ণযুগ। মুহাদ্দিস্ জামালুদ্দিন তাঁর ‘রওযাতুল-আহবার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ওমর চার হাজার মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পূর্বেই উক্ত হয়েছে যে, প্রত্যেক নব-প্রতিষ্ঠিত শহরে জামে-মসজিদ নির্মিত হয়, প্রত্যেক সেনানিবাসে একটি করে মসজিদ স্থাপিত হয়। সিরিয়ার প্রত্যেক কর্মচারীর উপর নির্দেশ ছিল, প্রতিটি শহরে ও মুসলিম অধ্যুষিত পল্লীতে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত করতে। সে-সব মসজিদের কোন কোনটি আজও কালের করাল কবল অপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
ওমর পবিত্র কা’বাগৃহের সংস্কার করেন, কিছুটা আয়তন বৃদ্ধি করেন এবং অলঙ্কৃত করেন। ইসলামের দ্রুত প্রচারের সঙ্গে প্রতি বছরে হাজী-সমাগম বৃদ্ধি পেতে থাকে; তার দরুন কা’বাগৃহের আয়তন বৃদ্ধির প্রয়োজন অনুভূত হয়। এজন্যে সতের হিজরীতে ওমর কা’বার চতুষ্পার্শের বাসগৃহগুলি ক্রয় করেন এবং সেগুলি ভূমিসাৎ করে মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করেন। পূর্বে কা’বার চতুর্দিকে প্রাচীর ছিল না। ওমর মসজিদের প্রাঙ্গণ ঘিরে চারদিকে প্রাচীর তুলে দেন ও রাত্রিতে জ্বালার বন্দোবস্ত করেন। পুরাকাল থেকেই সমগ্র কা’বাগৃহটি আচ্ছাদিত করার রেওয়ায ছিল। পূর্বে গিলাফ-ই-কা’বা প্রস্তুত হতো নুতা নামীয় বস্ত্রে, ওমরের সময় থেকে মিসরে-প্রস্তুত ‘কাবাতি’ নামক মূল্যবান বস্ত্র দিয়ে গিলাফ-ই-কা’বা প্রস্তুত আরম্ভ হয়। বলা বাহুল্য, আজও মিসর গিলাফ সরবরাহের গৌরব রক্ষা করে আসছে। এই কা’বাগৃহের চতুঃসীমা একদিকে তিন মাইল ও অন্যদিকে সাত মাইল বিস্তৃত। চতুঃসীমা আসাব্ নামাঙ্কিত প্রস্তর-স্তম্ভ দিয়ে চিহ্নিত। সতের হিজরীতে ওমর এই চতুঃসীমা মাহ্যামা প্রমুখ প্রবীণ ও মশহুর সাহাবা কর্তৃক নির্ধারিত করিয়ে আসাব্ প্রোথিত করিয়েছিলেন।
মদীনায় অবস্থিত মসজিদ-ই-নববীও ওমরের আমলে বর্ধিত ও সুসংস্কৃত হয়। রসূলুল্লাহর সময় মসজিদটি তদানিন্তন মদীনাবাসীদের পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কালক্রমে মদীনার লোকসংখ্য অসম্ভবরূপে বর্ধিত হয় এবং নামাযীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মসজিদের আয়তন বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৭ হিজরীতে ওমর এতদুদ্দেশ্যে মসজিদে-নববীর চতুষ্পার্শ্বের গৃহগুলি খরিদ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। প্রথমে আব্বাস তাঁর বাড়ী বিক্রয় করতে অস্বীকার করেন ও ওবাইয়া-বিন্-কাবের এজলাসে ওমরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। আদালত রায় দেন যে, বলপূর্বক বাড়ী ক্রয়ের অধিকার ওমরের নেই। তখন আব্বাস ইচ্ছা প্রকাশ করেন, বাড়ীখানি তিনি মুসলমানদেরকে দান করবেন। ওমর উম্মুল মুমেনীনদের বাসগৃহগুলি অক্ষত রেখে চারদিকের মসজিদটির আয়তন বৃদ্ধি করেন। পূর্বে মসজিদটি ছিল একশত গজ লম্বা, এখন তার দৈর্ঘ্য হলো একশত চল্লিশ গজ, তাছাড়া তার প্রস্থও কুড়ি গজ বৃদ্ধি পায়। মসজিদের সংস্কার কার্যে পুরাতন সাদাসিধা ভাব বজায় রাখা হয়, এমন কি, হযরতের আমলের কাঠের খাম্বা গুলিও যথাস্থানে অক্ষত রাখা হয়। মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি উচ্চ মঞ্চ প্রস্তুত হয়। এখান থেকে কবিতা আবৃত্তি বা বক্তৃতা করা হতো।
পূর্বে মসজিদে কোনও আলোর ব্যবস্থা ছিল না। ওমরের নির্দেশে তমিমদারী আলো জ্বালার ব্যবস্থা করেন। ওমর মসজিদে লোবান জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। একবার মালে-গনিমাত কিছু অগুরু পাওয়া যায়। প্রথমে খলিফা ইচ্ছা করেন, দ্রব্যটি সকলকে বিতরণ করে দেওয়া, কিন্তু পরিমাণে স্বল্প হওয়ায় তিনি নির্দেশ দেন, মসজিদে জ্বালানো হোক, তা হলে সকলেই সুগন্ধ উপভোগ করবে। তখন মুয়াযিন একটি আধারে অগুরু জ্বালিয়ে মসজিদে সমাগত মুসল্লীদের সারে সারে সেটি প্রদক্ষিণ করান, সকলে সৌরভে আমোদিত হয়ে ওঠেন। মসজিদের মাঝে গালিচা না বিছিয়ে সাধারণ মাদুর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
* আনন্দের সঙ্গে বর্তমান লেখক বলতে চান যে, গত বছর (১৯৬৫ সালের জুলাই) নিউইয়র্ক সফর শেষে প্রত্যাবর্তনকালে বৈরুতে তিনি ওমর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদে নামায আদায় করেন।