সিরিয়া বিজয় (প্রথম পর্যায়)

সিরিয়া বিজয় (প্রথম পর্যায়)

ওমরের খেলাফত আমলে সিরিয়া বিজয়-কাহিনী শুরু করার আগে কিছুটা পূর্বকাহিনীর উল্লেখ করা দরকার।

সিরিয়া ছিল পূর্ব-রোমক বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলটি ছিল ছয়টি প্রদেশে বিভক্ত, তাদের মধ্যে দামেশক, হিম্স, জর্দান ও প্যালেস্টাইন ছিল বিখ্যাত ও শক্তিশালী। সিরিয়ার অধিবাসীরা ছিল প্রধানত গ্রীক্ বা ইস্টার্ন চার্চের অনুসারী খ্রিস্টান। ইসলামের আবির্ভাবকালে হিরাক্লিয়াস ছিলেন রোম সম্রাট। তিনি খ্রিস্টধর্মের পবিত্রতা ও বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সংহতি ও শৃঙ্খলার স্থাপয়িতা হিসেবে কীর্তিত

৬২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে হিরাক্লিয়াস যখন পারসিকদের নিকট থেকে উদ্ধারকৃত আদি ও পবিত্র ক্রুশ জেরুজালেমে পুনঃ স্থাপনের উৎসবে ব্যস্ত ছিলেন, তখন সংবাদ আসে যে, জর্দান সীমান্তে এক আরব অভিযান অনায়াসে প্রতিরোধ করা হয়েছে। এ অভিযান ছিল মুতায়, আঁ-হযরতের পোষ্যপুত্র জায়েদের নেতৃত্বে। তিনি তিন হাজার সৈন্য নিয়ে মুতায় অভিযান করেন বস্ত্রায় গাস্সানী রাজার নিকট আঁ-হযরতের প্রেরিত দূতের হত্যার প্রতিশোধ তুলতে কিন্তু তিনিও শহীদ হন। খালিদ-বিন্-ওলিদ বহুকষ্টে অবশিষ্ট সৈন্যদের মদিনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। পরবর্তী সালে (৬৩০ খ্রি.) রসূলে করীম স্বয়ং তাবুতে অভিযান করেন এবং রক্তহীন সংঘাতে কয়েকটি মরূদ্যান আরবদের হস্তগত জয়। আবুবকর ‘রিদ্দা’ বা অবিশ্বাসীদের বিদ্রোহ দমনের পর সিরিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে সক্ষম হন। তের হিজরীর প্রথম ভাগে (৬৩৪ খ্রি.) তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন অংশে একযোগে অভিযান চালাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। আবুওবায়দাহ্ হিমস্ দখল করতে, ইয়াজিদ বিন্ আবু সুফিয়ান দামেশ্বক দখল করতে, শুরাহ্বিল জর্দান আক্রমণ করতে এবং আমর বিন্-আল-আস্ প্যালেস্টাইন অধিকার করতে আদিষ্ট হন।

এ চারটি অভিযানকারী বাহিনীর সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। আরবসীমান্ত অতিক্রম করে তাঁরা প্রত্যেকেই বিরাট সংখ্যক রোমক সৈন্যের সম্মুখীন হন। রোম-সম্রাট পূর্বেই চরমুখে এসব আরব-অভিযানের পরিকল্পনা অবগত হয়ে বিপুল বাহিনী সংগ্রহ করেন, প্রত্যেককেই পৃথকভাবে যুদ্ধদান করতো। মুসলিম সেনানায়করা তখন একত্রিত হয়ে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হন ও আরও সৈন্য ভিক্ষা করে মদিনায় সংবাদ পাঠান। আবুবকর তখনই আদেশ দিলেন, ইরাক-অভিযানে ব্যস্ত খালিদকে অবিলম্বে সিরিয়ায় গমন করতে। খালিদ পথিমধ্যে শত্রুপক্ষের সকল বাধা অতিক্রম করে দামেশকের নিকট উপস্থিত হয়ে শিবির স্থাপন করেন। রোম সম্রাট একদল সেনা পাঠান আনাদায়েনে আরবদের গতিরোধ করতে। কিন্তু খালিদ ও আবুওবায়দাহ্ রোমক বাহিনীর পূর্বেই আনাদায়েনে উপস্থিত হন। শুরাহবিল, ইয়াজিদ, আমর একে একে পরে উপস্থিত হলেন। এখানে উভয়পক্ষের ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং মুসলিমদের তিন হাজার সৈন্য নিহত হলেও তাদেরই জয়লাভ হয়। অতঃপর খালিদ পুনরায় দামেশকে উপস্থিত হন এবং চতুর্দিক থেকে শহরটি অবরোধ করেন। ঠিক এই সময়ে আবুবকরের ওফাত হয় ও ওমর খলিফার পদে অভিষিক্ত হন।

দামে ছিল সিরিয়ার বৃহত্তম ও ধনসম্পদময়ী শ্রেষ্ঠ নগরী। প্রাক্ ইসলামী যুগ থেকে আরব সওদাগররা এখানে যাতায়াত করতো এবং শহরের শান-শওকত ও শোভা-সম্পদের কাহিনী সারা আরবে মুখে মুখে কীর্তিত হতো। এ সুরক্ষিত শহরটি অবরোধকালে খালিদ বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেন। নগর-প্রাকারের তিনটি দ্বারে অন্য তিন মশহুর সেনানায়ক মোতায়েন করে খালিদ স্বয়ং পূর্ব দিকের প্রধান দ্বারে পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে অবস্থান করেন। ছয় মাস ধরে এ ভীষণ অবরোধ চলে। সিরিয়ার তীব্র শীতে আরবরা কাবু হয়ে স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হবে, এ ভরসা মিথ্যা হয়। খালিদ পূর্ব থেকেই ধুঘিলায় সৈন্য মোতায়েন করে বাহির থেকে সাহায্য প্রেরণের পথও বন্ধ করে দেন। তার দরুন হিম্‌স অঞ্চল থেকে হিরাক্লিয়াস কর্তৃক প্রেরিত সাহায্য বাহিনীও পথিমধ্যে রুদ্ধ হয়ে যায়। শহরবাসীরা হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকে। এই সময়ে নগরপালের এক পুত্র জন্মে এবং শহরবাসীরা তার জন্মোৎসবে পানাহারে মত্ত হয়ে ওঠে। খালিদ অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। চারদিকের পরিখা পানিতে পরিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও অসম-সাহসিক খালিদ রাত্রির অন্ধকারে কয়েকজন সঙ্গীসহ মশক বুকে ধরে পরিখা পার হন এবং দড়ির মই বেয়ে কৌশলে সুউচ্চ প্রাচীর পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন তার পর ক্ষিপ্রগতিতে দ্বাররক্ষীদের হত্যা করে তালা ভেঙ্গে দেন। বাইরে প্রতীক্ষমাণ আরব সৈন্য বন্যার মতো শহরে প্রবেশ করে। খ্রিষ্টানরা আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে অপর দ্বারগুলিও খুলে দেয় এবং আবুওবায়াদার শরণাপন্ন হয় খালিদের রুদ্ররোষ থেকে তাদের রক্ষা করতে। বিনা যুদ্ধে শহরটি অধিকৃত হয় এবং শহরবাসীদের সঙ্গে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধিশর্তগুলি পরবর্তীকালে সিরীয়-প্যালেস্টাইনের অধিকৃত সব শহরের সঙ্গে সন্ধিকালে আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় সেগুলি উল্লেখযোগ্য:

পরম করুণাময় ও কৃপানিধান আল্লাহ্র নামে খালিদ-বিন্-অলিদ দামেশক প্রবেশকালে শহরবাসীকে এসব দান করেছেন: তিনি তাদের জীবন, সম্পদ ও মন্দিরসমূহের নিরাপত্তা প্রতিজ্ঞা করেছেন। নগর প্রাচীন ভূমিসাৎ করা হবে না, কোনও মুসলিমকে তাদের গৃহে স্থান দেওয়া হবে না। এতদ্বারা আমরা তাদেরকে আল্লাহর চুক্তি এবং তাঁর নবীর, খলিফাদের ও মুমেনদের আশ্রয় দান করছি। যতদিন তারা জিয়া আদায় করবে তাদের ভাগ্যে মঙ্গলই বর্ষিত হবে।

দামেকের পতন রোমকদের হতাশ করে। কিন্তু হতোদ্যম না হয়ে তারা সৈন্য সংগ্রহ করতে লাগলো পুনরায় শক্তি-পরীক্ষা করতে। মুসলিম বাহিনী অতঃপর জর্দান প্রদেশে অভিযান করে। সীজার হিরাক্লিয়াস দামেশক রক্ষার্থে যে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, সে বাহিনীসহ রোমকরা প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্য একত্রিত করে এবং সিফলার নামক রোমক-সেনানায়কে অধীনে প্রদেশের প্রধান শহর বাইসনে মুসলিমদের গতিরোধ করে। মুসলিম বাহিনী ফাহ নামক স্থানে যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হয়। রোমকরা মধ্যবর্তী স্থানের জলনালীগুলি পানিতে পূর্ণ করে দিয়ে মুসলিমদের অগ্রগতিতে বাধা দেয়। কিন্তু খ্রিস্টানরা জয় সম্বন্ধে আশান্বিত না হয়ে সন্ধির প্রস্তাব করে। আবু ওবায়দাহ দূত হিসেবে মুয়ায-বিন-জবলকে প্রেরণ করেন। রোমকরা সোনার জরি দিয়ে তৈরী রেশমী বস্ত্র বিছিয়ে আলোচনার জন্যে শান-শওকতপূর্ণ দরবার করে। মুয়ায মাটিতেই বসেন এই বলে যে, দরিদ্রকে শোষণ করে যে গালিচা তৈরী, তার উপর বসতে তিনি ঘৃণাবোধ করেন। দাসরা যদি মাটিতেই বসে, তা হলে তাঁর চেয়ে আল্লাহ্র হীনতম দাস আর কেউ নেই। রোমকরা তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি মুসলিমদের মধ্যে আর অছে কি-না। তিনি জওয়াব দেন, আল্লাহ্ দোহাই, আমি এ কথা চিন্তা করতে পারি নে। আমি তো সবার অধম। আলোচনা আরম্ভ হলে রোমক মুখপাত্র বলেন : আমরা জানতে চাই, কি উদ্দেশ্যে তোমরা এদেশে এসেছো। হাবশীদের দেশ তোমাদের নিকটবর্তী। পারস্যে এখন একজন রমণী মাত্র সিংহাসনাসীনা এবং তথায় বিশৃঙ্খলা চলছে। এসব দিকে নযর না দিয়ে তোমরা কোন্ সাহসে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করেছো, যেখানে সীজার সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নৃপতি আর আমরা সংখ্যায় আকাশের তারকারাশির চেয়ে কিংবা পৃথিবীর অণু-পরমাণুর চেয়েও সংখ্যাবহুল? মুয়ায জওয়াব দিলেন: আমাদের প্রথম অনুরোধ, ইসলাম কবুল করো এবং মদ্যপান ও শূকর আহার ত্যাগ করো। যদি এটি স্বীকার করো, তা হলে তোমরা আমাদের ভাই। যদি ইসলাম কবুল না করো, তা হলে জিয়া দাও। তাও স্বীকার না করলে অস্ত্রেই বিরোধের মীমাংসা হবে। তোমরা সংখ্যার ভয় দেখাচ্ছো, তার পরোয়া আমরা করি নে, সংখ্যার গুরুত্বে আমাদের কিছু আসে যায় না। রোমকরা তখন প্রস্তাব দেয়, বল্‌কা শহর আরবের নিকটবর্তী জর্দানের সীমান্ত অংশ-সমূহ তারা সমর্পণ করতে রাযী আছে এই শর্তে যে, মুসলিমরা তাদের দেশ ত্যাগ করবে। মুয়ায এ শর্তও অগ্রাহ্য করে প্রস্থান করেন।

তখন রোমকরা সেনাপতি আবু ওবায়দার সঙ্গে সরাসরি সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে দূত প্রেরণ করে। দূতবর মুসলিম শিবিরে উপস্থিত হয়ে দেখেন, সেনাপতি আবুওবায়দা হ্ সাধারণ সৈন্যের মতো পোশাক পরে সকলের মাঝে মাটিতে বসে আছেন। আলোচনা আরম্ভ হলে দূতবর প্রস্তাব দেন, প্রত্যেক মুসলিমকে দুটি ‘সোনার মোহর’ দেওয়া হবে এবং তাই গ্রহণ করে আবুওবায়দাহ্ দেশ ত্যাগ করবেন। আবুওবায়দাহ্ ঘৃণাভরে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন উভয়পক্ষ যুদ্ধাৰ্থে প্ৰস্তুত হয়।

রোমকরা প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্য দুই দিন ধরে সুকৌশলে সন্নিবেশিত করে। তার পর তিনদলে বিভক্ত হয়ে একের পর এক বীরবিক্রমে মুসলিম বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। খালিদ প্রথমে প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত থাকেন, শেষে শত্রুপক্ষকে ক্লান্ত দেখে একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। রোমকরা আক্রমণের বেগ সহ্য করতে না পেরে পিছু হটতে থাকে। সুযোগ বুঝে খালিদ ঝাঁকে ঝাঁকে সৈন্য প্রেরণ করে রোমকদের বিধ্বস্ত করতে থাকেন। হাশিম-বিন্ ওত্বা অশ্ব ছেড়ে খোলা তলোয়ার হাতে শত্রুপক্ষের মধ্যস্থলে উপস্থিত হন। মাত্র এক ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর রোমকরা পরাজিত হয়ে বিক্ষিপ্তভাবে পলায়ন করতে থাকে। আবুওবায়দাহ্ খলিফার নিকট বিজয়-বার্তা প্রেরণ করেন এবং বিজিত খ্রিস্টানদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা যেতে পারে, তার নির্দেশ প্রার্থনা করেন। ওমর নির্দেশ দেন যে, বিজিত লোকদের জিয়া করদাতার সমান অধিকার দেওয়া হবে এবং কৃষিযোগ্য কোনও জমি থেকে মালিককে বঞ্চিত করা হবে না।

এ যুদ্ধের পর জর্দান প্রদেশের অন্যান্য কিল্লা ও শহর সহজেই পদানত হয়, এবং শান্তি স্থাপিত হয়। বিজিত জাতির জীবন; সম্পদ, জমি, বাসগৃহ, মন্দির, গির্জা সমস্তই নিরাপদ ঘোষণা করা হয়। কেবলমাত্র কয়েকটি স্থান দখল করে মসজিদ নির্মিত হয়।

অতঃপর হিস অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়। সিরিয়ার মধ্যে হিম্‌স ছিল অতি প্রাচীন শহর, তার ইংরেজী নাম ইমেসা। অতি প্রাচীন কাল থেকে এখানে একটি সূর্য মন্দির ছিল। দামেশকের পর জেরুজালেম, ইমেসা ও অস্তিয়ক ছিল সিরিয়ার বিখ্যাত শহর এবং ইমেসা ছিল অন্য শহর দুটি পথিমধ্যে। তখন আন্তিয়কে সীজারের শাসনকেন্দ্র ছিল। অতএব অভিযান পথে প্রথমেই ইমেসা অধিকার করা স্থির হয়। পথিমধ্যে বল্‌বক্ শহর সামান্য যুদ্ধেই বিজিত হয়। কিন্তু রোমকরা ইমেসার নিকট গতিরোধ করতে একত্রিত হয়। পথিমধ্যে ছোটখাট বাধা সহজেই অতিক্রম করে খালিদ ও আবুওবায়দাহ্ একযোগে ইমেসা অবরোধ করেন। তীব্র শীত শুরু হওয়ায় রোমকরা চিন্তা করে, মুসলিমরা সহজেই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। সীজারও একদল সৈন্য প্রেরণ করেন ইমেসার সাহায্যার্থে, কিন্তু সা’দ বিন্ আবি ওক্কাস্ ইরাক থেকে সংবাদ অবগত হয়েই এ সৈন্যদলটিকে ইমেসার পথে আটক করেন। শীতেও মুসলিমরা কাবু না হয়ে অবরোধ আরও প্রচণ্ড করে তোলে। তখন ইমেসাবাসীরা হতাশ হয়ে সন্ধি ভিক্ষা করে।

আবু ওবায়দাহ্ ইমেসার শাসনভার ওবায়দাহ্ বিন্-সামতের হাতে অর্পণ করে হিমাত শহরের দিকে অগ্রসর হন। হিমাতবাসীরা বিনাবাধায় আত্মসমর্পণ করে ও জিয়া আদায় করতে রাযী হয়। অতঃপর আবুওবায়দাহ্ শিয়ার, মিরাতুল-নুমান প্রভৃতি স্থান অধিকারকালে লাধকিয়া বা আমাপ্‌না নামক প্রাচীন শহরের দিকে অগ্রসর হন। আবুওবায়দাহ্ কৌশল করে শহরটি অধিকার করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অন্তিয়ক পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে স্বয়ং সীজার হিরাক্লিয়াসকে বিতাড়িত করা কিন্তু সহসা খলিফার ফরমান আসে, অগ্রগতি বন্ধ করার। অতঃপর খালিদ দামেশকে আমর জর্দানে ও আবুওবায়দাহ্ ইমেসায় শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করে বিজিত প্রদেশসমূহে মুসলিম শাসন সুদৃঢ় করতে চেষ্টিত হন।

দামেস্ক ইমেসা প্রভৃতি স্থানে উপর্যুপরি ভাগ্যবিপর্যয়ের পরে রোমকরা অন্তিয়কে পলায়ন করে ও সীজার হিরাক্লিয়াসের নিকট আক্ষেপ জানায়, আরবজাতি সারা সিরিয়াকে ধ্বংস করে দিল। তিনি রাজ্যের সমস্ত আশ্রয় ভিখারী জ্ঞানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকের ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন আরবদের মতো সংখ্যাল্প এবং শক্তিতে ও যুদ্ধাস্ত্রে অপেক্ষাকৃত হীন জাতির নিকট রোমকরা বারবার মার খাচ্ছে? একজন জ্ঞান- প্রবীণ রোমক জওয়াব দেন: আরবদের নীতিজ্ঞান আমাদের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে। তারা রাতে এবাদত করে, দিনে রোযা রাখে। তার কাউকে অন্যায় আঘাত করে না এবং সকলেই সমান সমান। অন্যদিকে আমরা মদ্যপান করি, বিলাস-বাসনে সময় কাটাই। আমরা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করি নে এবং দুর্বলকে পীড়ন করি। চরিত্রের এই বৈপরীত্যের দরুন তাদের সব কাজে দৃঢ়তা ও উৎসাহের চিহ্ন সুপরিস্ফুট; আর আমাদের সব কাজে কেবল অস্থিরমতিত্ব ও দুর্বলতা। সীজার অবস্থা অনুধাবন করে সিরিয়া ত্যাগ করে কনস্টান্টিনোপলে ফিরে যাবেন স্থির করেছিলেন, কিন্তু খ্রিস্টানরা ক্রমাগত শহরে উপস্থিত হয়ে ‘রক্ষা করুন, রক্ষা করুন’ ফরিয়াদ করছিল। এতে সীজারের গর্ব ও অহমিকায় আঘাত লাগে। এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেন সাম্রাজ্যের সব শক্তি, সব সামার্থ্য একত্রিত করে আর একবার আরবজাতির উপর শেষ আঘাত হানবেন। তিনি রোম, কনস্টান্টিনোপল, জাজিরাহ্, আর্মেনিয়া প্রভৃতি সাম্রাজ্যের সব শক্তিকেন্দ্রে নির্দেশ পাঠান, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে সৈন্যশক্তি উজাড় করে রাজধানী আন্তিয়কে প্রেরণ করতে। প্রত্যেক শহরেও নির্দেশ গেল, সমগ্র জনবল সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতে। অল্পদিনের মধ্যেই আন্তিয়কের বিশাল প্রান্তর ছেয়ে গেল সৈন্য-সমুদ্রে।

আবুওবায়দাহ্ স্থানীয় বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মারফত সীজারের সমর-প্রস্তুতি সম্যক অবগত ছিলেন। তিনি পদস্থ সেনানায়কদের আহ্বান করে এক আবেগময়ী বক্তৃতায় সম্মুখ-সঙ্কটের রূপ বিশ্লেষণ করে পরামর্শ চাইলেন, কী করা উচিত। ইয়াজিদ ও সুরাহবিল নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করলেন। সকলের মত হলো, সাহায্যবাহিনী না আসা পর্যন্ত ইমেসায় অপেক্ষা করা। কিন্তু আবুওবায়দাহ্ যুক্তি দেখালেন, আর অপেক্ষার সময় নেই। শেষে স্থির হয়, ইমেসা ত্যাগ করে দামেশকে চলে যাওয়া; সেখানে খালেদের উপস্থিতি ও আরব-সীমান্তের নৈকট্য অনেকটা নির্ভরযোগ্য। তখন আবুওবায়দাহ্ খাজাঞ্চিখানার অধ্যক্ষ হাবিব বিন্-মসলেহমাকে নির্দেশ দিলেন, খ্রিস্টানদের নিকট থেকে আদায়কৃত সমস্ত জিয়া কর প্রত্যর্পণ করতে, কারণ শত্রুর হামলা থেকে রক্ষার শর্তসাপেক্ষে যে কর আদায় করা হয়েছিল, এখন নিজেদেরই নিরাপত্তা আশঙ্কিত হওয়ায় সে কর গ্রহণের আইনত অধিকার নেই। এভাবে বহু লক্ষ দিরহাম শহরবাসীদের যথাযোগ্য ফেরত দেওয়া হয়। খ্রিস্টানরা মুসলিমদের এই সাধুতায় অভিভূত হয়ে সজল নয়নে বলেছিল, ঈশ্বর আপনাদের পুনরায় ফিরিয়ে আনবেন। আর ইহুদীরা তো আরও অভিভূত হয়ে প্রতিজ্ঞা করে: জিহোবার বিধি ও নবীদের দোহাই! যতক্ষণ আমাদের দেহে প্রাণ থাকবে, সীজার কিছুতে ইমেসা দখল করতে পারবেন না। বলা বাহুল্য এভাবে সকল শহর থেকে আদায়কৃত জিয়া প্রতার্পিত হয়।

অতঃপর আবুওবায়দাহ্ দামেশকে যাত্রা করেন এবং পরিস্থিতির পূর্ণ বিবরণ দিয়ে ওমরকে পত্র পাঠান। ওমর পত্র পেয়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হন এবং বলেন, এ হয়তো আল্লাহর কোনও ইচ্ছার ফলাফল। তিনি শীঘ্রই সাহায্য প্রেরণ করতে চেষ্টিত হলেন।

এদিকে দামেস্কে উপস্থিত হয়ে আবুওবায়দাহ্ সমর পরিষদের বৈঠক ডাকালেন, কর্তব্য স্থির করতে। এই সময় জর্দান থেকে আমরের দূত এসে জানান যে জর্দানে সাধারণ বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে। বিশাল রোম বাহিনীর অভিযান আরম্ভ হওয়ায় চতুর্দিকে আতঙ্ক উপস্থিত হয়েছে এবং ইমেসা থেকে মুসলিমদের অপসারণে তাদের ইজ্জত অনেকটুকুই নষ্ট হয়েছে। আবুওবায়দাহ্ ওমরকে জানান, পরিস্থিতি এমন সঙ্কটময় হয়ে উঠেছে যে, এখন সকলের একত্রে থাকাই নিরাপদ।

পরদিন আবুওবায়দাহ্ দামেস্ক থেকে যাত্রা করে জর্দানের সীমান্তস্থিত ইয়ারমুকে উপস্থিত হন। আমরও তাঁর সঙ্গে যোগদান করেন। নিরাপত্তার দিক দিয়ে সুবিধাজনক ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে মুকাবিলা করতে ইয়ারমুকের বিশাল প্রান্তর প্রশস্ত বিবেচিত হয়। তখনও মদিনা থেকে সাহায্য বাহিনী উপস্থিত হয় নি, অথচ রোমকরা অতুল বিক্রমে অগ্রসর হচ্ছে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে। আবুওবায়দাহ্ পুনরায় খলিফার নিকট পত্র প্রেরণ করেন বিশেষভাবে সংবাদ দিয়ে যে, রোমকরা জলে-স্থলে হাজারে হাজারে অনবরত উপস্থিত হচ্ছে, খ্রিস্টানদের উৎসাহ ও রণোন্মদনা চরমে উঠেছে। এমনকি সন্তু- সন্ন্যাসীরাও মঠ ত্যাগ করে সৈন্যদলে যোগ দিয়েছে। ওমর পত্র পেয়েই সমস্ত মদিনাবাসীর সম্মেলন ডাকলেন ও পত্রের মর্ম অবগত করালেন। প্রবীণ সাহাবাদের চক্ষু ফেটে অশ্রু দেখা দিল মুসলিমদের শোচনীয় অবস্থা শ্রবণ করে এবং সকলেই সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করতে প্রস্তুত হলেন। আবদুর রহমান বিন-আউফ চিৎকার করে উঠলেন: হে আমীরুল মু’মেনীন! আপনিই সিপাহসালার হয়ে আমাদের নেতৃত্ব করুন। যা’হোক সকলের মত হলো, অবিলম্বে যথাসাধ্য সাহায্যবাহিনী পাঠানো হোক। তখনই সৈন্য নিয়োগ ও প্রেরণের দ্রুত ব্যবস্থা অবলম্বিত হলো এবং আবুওবায়দাকে উৎসাহব্যঞ্জক পত্র দেওয়া হলো: সাবধান! ওমর সালাম পাঠাচ্ছে ও নির্দেশ দিচ্ছে, হে ইসলামের সেবকগণ! তোমরা দুশমনের মুকাবিলা করবে সিংহের মতো, আর নিজেদের মধ্যে আচরণ করবে পিপিলিকার মতো নম্র হয়ে। আমরা বিশ্বাস রাখি, তোমরা জয়ী হবেই।

এ-পত্র যেদিন আবুওবায়দাহ্ পান, সেদিনই যামীর উপস্থিত হলেন এক হাজার সৈন্য নিয়ে। তার ফলে মুসলিমদের মধ্যে নয়া উদ্দীপনা ও আত্মনির্ভরতা জেগে ওঠে সৈন্যবিন্যাসের ও চালনার ভার গ্রহণ করলেন স্বয়ং খালিদ। রোমকবাহিনী ইয়ারমুকের বিপরীত দিকে অবস্থিত দায়ের-উল-জবলে ছাউনি ফেলে। স্থানটির তিনদিক উঁচু পাহাড় দিয়ে ঘেরা, এবং বাহির হওয়ার একটি মাত্র দিকে মুসলিমবাহিনী ছাউনি ফেলে বন্ধ করে দেয়। এভাবে রোমক বাহিনী নিজেরাই এমন এক জায়গায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে, যেখান থেকে সহজে বের হওয়ার পথ খোলা রইলো না। তাদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মতে এক লক্ষ থেকে দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার। চব্বিশটি পর পর শ্রেণীতে তারা সজ্জিত হলো, আর সম্মুখে সন্ন্যাসী পাদ্রীরা ক্রুশ উত্তোলন করে তাদেরকে ধর্মীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখলো। উভয়পক্ষ সামনাসামনি হলে প্রথমে একজন রোমক বীর একজন মুসলমানকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে। খালিদের ইঙ্গিতে কায়েস বিন-হাবিরাহ্ দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, এবং অল্পায়াসে রোমক-বীরকে নিহত করেন। মুসলিমরা এ বিজয়কে শুভ সূচনা হিসেবে গ্রহণ করে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

রোমকপক্ষে সিপাহসালার ছিলেন থিওডোরাস স্বয়ং সীজারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। কিন্তু তার সহকারী হিসেবে রইলেন বীরপুরুষ বাহান। বাহান সেনানায়কদের এক সভা ডেকে বললেন, সিরিয়ার সম্পদ ও আরাম-আয়েশ মুসলিমদের প্রলুব্ধ করেছে, অতএব তাদেরকে মোটা রকম বকশিশ্ দিয়ে ফেরৎ পাঠালেই হয় না? সকলেই এ যুক্তি সমর্থন করলো। পরদিন রোমক শিবির থেকে জর্জ নামক দূত এলো আবুওবায়দা নিকট শান্তির প্রস্তাব নিয়ে। খালিদ দৌত্যকর্মের মনোনীত হন। জর্জ প্রত্যেকটি মুসলিম সেনার ইসলাম প্রীতি ও প্রতিটি অনুষ্ঠানে তীব্র অনুরাগ দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি আবুওবায়দা নিকট আরও অবগত হলেন, কোরআনে হযরত ঈসা নবী হিসেবে কীর্তিত, এবং মুসলিমদের নিকট পরম শ্রদ্ধেয়। তখন তিনি আবেগভরে কলেমা পাঠ করে ইসলাম কবুল করেন। তাঁর আর রোমক শিবিরে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আবুওবায়দাহ্ সম্মত না হয়ে বললেন, তাঁকে স্বশিবিরে ফিরে যেতেই হবে, তবে মুসলিম শিবির তাঁর জন্য সর্বদাই খোলা থাকবে।

পরদিন খালিদ রোমক শিবিরে উপস্থিত হলে বাহান তাঁকে জাঁকজমক পূর্ণ দরবারে খুবই সম্ভ্রমের সঙ্গে গ্রহণ করেন। সাধারণ সৌজন্য প্রকাশের পর আলোচনা শুরু হলে বাহান সীজারের অপরিসীম ক্ষমতা ও সম্পদ রাশির উল্লেখ করে শেষে বললেন : আপনারা এখন শ্রান্তভাবে এ দেশ ত্যাগ করলে আপনাদের সিপাহসালারকে দশ হাজার দিনার, প্রত্যেক সেনানায়ককে এক হাজার এবং প্রত্যেক সৈন্যকে একশোড দিনার ইনাম দেব। বাহানের বক্তব্য শেষ হলে খালিদ প্রথমে আল্লাহর গুণগান, আঁ-হযরতের শিক্ষার মহিমা উল্লেখ করে বললেন: যে ইসলাম কবুল করে, সে আমাদের ভাই হয়ে যায়। যে কবুল করে না, কিন্তু জিয়া আদায় করে, আমরা তার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করি। আর যে একটিও গ্রহণ করে না, তার সঙ্গে হয় অস্ত্রে অস্ত্রে পরিচয়।

জিযয়ার উল্লেখে বাহান দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করে নিজের অগণিত সেনা বাহিনীর দিকে লক্ষ্য করে বললেন, তারা মৃত্যু বরণ করবে, তবু জিয়া স্বীকার করবে না। আমরা জিয়া দেই না, গ্রহণ করি। অতঃপর সন্ধির প্রস্তাবে ভেঙে যায়।

পরদিন রোমকরা রীতিমতো যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হলো। খালিদও নিজের বাহিনী নিয়ে যথারীতি প্রস্তুত। আবুসুফিয়ান, আমর নিজের বাহিনীকে উৎসাহ দিয়ে প্রাণপণ করে যুদ্ধে উদ্বুব্ধ করলেন। মুসলিমপক্ষে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ছিল। আর এ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বহু মুসলিম বীরাঙ্গনা পুরুষদের পাশে পাশে সিংহীর মতো যুদ্ধ করেছেন। আমীর মু’আবিয়ার মতো হিন্দাহ্ ভগ্নি জুয়েরিয়াহ্ শক্তি ও বীরত্ব প্রকাশে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

প্রায় ত্রিশ হাজার রোমক-বীর পায়ে পায়ে শৃঙ্খলিত হয়ে যুদ্ধে প্রস্তুত হলো, যাতে পশ্চাদসরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। হাজার হাজার সৈন্যের এ-বিপুল সমাবেশ দেখে জনৈক মুসলিম সেনা সহসা বলে উঠে, ওহ্ আল্লাহ্! কী বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ! খালিদ তাকে ধমক দিয়ে বললেন: আঃ থামো! আমার ঘোড়ার খুরগুলো যদি আরও একটু মজবুত হতো, তা হলে খ্রিস্টানদের বলতেম তারা দেদার খুশী সৈন্য জড়ো করতে পারে।

প্রায় দু’মাস ধরে বিক্ষিপ্তভাবেই যুদ্ধ চললো, জয়-পরাজয়ে কোন লক্ষণ দেখা যায় না। শুধু রণহুঙ্কারে ও আর্তের চিৎকার যুদ্ধস্থল কেঁপে উঠতে থাকে। চারিদিকে শুধু শব কিংবা কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত, রক্তের স্রোতে ঘন ঘন যোদ্ধাদের পদস্খলন। এসব বিভীষিকাময় দৃশ্য সারা ইয়ারমুকের বিশাল প্রান্তরে। আবু জহল-নন্দন ইকরামা হাসতে হাসতে প্রাণ দান করলেন এবং তাঁর মৃত্যুতে খালিদের খেদোক্তি: হে আল্লাহ! ওমরের এ কথা ভুল যে, আমরা তোমরা রাহে শহীদ হতে জানি নে! পুত্ৰ ইয়াজিদকে আবু সুফিয়ান উৎসাহ দিচ্ছেন: বৎস! তোমার সেনারা কী বীরত্বে যুদ্ধ করছে! তুমি তাদের নায়ক, দেখো, তারা যেন তোমার বীরত্বে ও সাহসে অতিক্রম করে না যায়! রণরঙ্গিণী আরব মহিলারা তাঁবুর খুঁটি তুলে নিয়ে সৈন্যদের পিছনে থেকে তাদের সাবধান করছেন: আমদের মুখপানে তাকাতেই পারে না, যদি তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর। এ সবের চেয়েও করুণ, কিন্তু বীরকে মহিমোজ্জ্বল হাবাশ-বিন- কায়েসের তীব্র যুদ্ধে একখানি পা হারিয়ে ও রণোন্মদনায় তা ভুলে যাওয়া, এবং কিছুক্ষণ পর প্রাকৃতিক অনূভূমিহেতু নিজের অবস্থা স্মরণ করে চারদিকে কর্তিত পাখানি খোঁজ করা ও অন্য সবকে জিজ্ঞাসা করা: আমার পাখানি খুঁজে দাও ভাই!

যুদ্ধ সঙিন অবস্থা ধারণ করে ২০শে আগস্ট, ৬৩৬ খ্রি.। গ্রীষ্মের সারাদিন অগ্নিঢালা রৌদ্রের প্রচণ্ড উত্তাপে যখন চারদিক ধূলি ঝড়ে ছেয়ে ফেলে, সে সময় সুযোগ বুঝে খালিদ নিজের সৈন্যদের তীব্রবেগে চালনা করলেন, এ রকম অভ্যস্ত আবহাওয়ায় শত্রুপক্ষকে মরণাঘাত হানতে। মরুসন্তানদের এমন ভীষণ আক্রমণে সীজারের বাহিনী একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেল। কত পাদ্রীর প্রার্থনা ও উৎসাহবাণী বিফল হলো, তাদের ক্রুশচিহ্নের ঘনঘন আস্ফালনও বৃথা গেল। যারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়ে নদীর দিকে পলায়ন করলো, নদীবক্ষে কিংবা রুক্‌দাদ উপত্যকায় তাদের দেহ প্রসারিত হলো। স্বয়ং থিওডোরাস যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। কিন্তু বাহান পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। তাবারীর মতে এক লক্ষ, এবং বালাজুরির মতে সত্তর হাজার সীজার সৈন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করে। মুসলিমপক্ষে প্রায় তিন হাজার শহীদ হয়।

আবুওবায়দাহ্ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়বার্তা মদিনায় প্রেরণ করেন। ওমর কয়েকদিন বিনিদ্র অবস্থায় যুদ্ধের সংবাদের প্রতীক্ষা করতেন। সংবাদ পাওয়ামাত্র তিনি আল্লাহ্র দরগায় শুকরগুজারীর নফল নামায আদায় করেন।[১]

ইয়ারমুকের যুদ্ধ বিশ্ব-ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি যুগ নির্ণায়ক ঘটনা। মুসলিমরা এ যুদ্ধে এক মহাসঙ্কটের সম্মুখীন হয়। তাদের বিপক্ষে ছিল, মহাপরাক্রমশালী রোমসম্রাটের অগণিত লোকবল, প্রচুর অস্ত্রবল, অথচ মুসমিদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ছয় ভাগের একভাগ। কিন্তু তাদের মনোবল ও নৈতিক বল ছিল বহুগুণ। এ জন্যই ইয়ারমুকের যুদ্ধে আর একবার প্রমাণিত হলো, মনোবল ও নৈতিকবলের নিকট লোকবল কত তুচ্ছ, কতো সহজে বন্যামুখে তৃণখণ্ডের মতো ভেসে যায়। এ যুদ্ধের পরেই মুসলিমরা বিশ্ব ইতিহাসে সগর্বে প্রবেশ করে এবং পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে আর একটি নতুন জাতির গৌরবময় উত্থানপথের দিকে চেয়ে থাকে। সাম্রাজ্যবাদের কবলিত যুগযুগ-নিপীড়ন, শোষিত অগণিত মানুষ সাম্য মৈত্রী মন্ত্রের উদ্‌গাতা ইসলাম পন্থীদের আশ্রয়ে মুক্তির আস্বাদ লাভে উন্মুখ হয়ে ওঠে |

ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর আবুওবায়দাহ্ হিসের দিকে অগ্রসর হলেন। খালিদ গমন করলেন কিনিসিরিনের দিকে, এবং শহরবাসীরা প্রথমে বাধা দিলেও খালিদের সম্মুখে সে-বাধা তৃণখণ্ডের মতো উড়ে গেল, তারা জিয়া দিতে অঙ্গীকার করে বশ্যতা স্বীকার করলো। তানুখ নামক বেদুইন জাতি, খ্রিস্টমতাবলম্বী বানুসালিহ্ গোত্র ও তার গোত্রের অধিকাংশই ইসলাম কবুল করে। অতঃপর আবুওবায়দাহ্ আলেপ্পোর দিকে অগ্রসর হন। শহরের চতুর্দিকে অবস্থিত আরব বেদুইনরা সহজেই ইসলাম কবুল করে। কিন্তু আলেপ্পোবাসীরা দুর্গদ্বার বন্ধ করে দেয়। আয়ায-বিন-ঘানাম্ শহরটি অবরোধ করেন এবং কয়েকদিন পর আত্মসমর্পণ করতে ও জিয়া আদায় করতে বাধ্য করেন।

অতঃপর সিরিয়ার রাজধানী আন্তিয়কের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। সে আমলে আন্তিয়ক ছিল ধন-সম্পদে ও কৃষ্টি-সম্পদে কনস্টান্টিনোপলের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার লোকসংখ্যা ছিল এক লক্ষেরও বেশি এবং খ্রিস্টান ধর্মের কেন্দ্রস্থল হিসেবে সীজারের অত্যন্ত প্রিয়। চতুর্দিকের যুদ্ধবিগ্রহে রোমকরা ও অন্যান্য খ্রিস্টানরা বিতাড়িত হয়ে এখানে দলে দলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আবুওবায়দাহ্ চারদিক থেকে শহরটি অবরোধ করেন এবং কয়েকদিন প্রতিরক্ষার বৃথা চেষ্টা করে শহরবাসীরা আত্মসমর্পণ করে। ওমর আন্তিয়কের প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধির সম্যক অবগত ছিলেন, এবং তাঁর চক্ষে জেরুজালেম বিজয়ের চেয়ে আন্তিয়ক বিজয় ছিল অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে তিনি আবুওবায়দা সাংবাদদূতের অপেক্ষা করতেন ততখানি আগ্রহ নিয়ে, যতখানি তিনি সা’দ-বিন-ওক্কাসে দূতের অপেক্ষা করতেন কাদিসিয়ার যুদ্ধের সংবাদ শ্রবণের জন্যে। তিনি আন্তিয়ক-বিজয় আরবজাতির এক শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেন।

সীজার হিরাক্লিয়াস্ কি করছিলেন? আলেপ্পো বিজিত হওয়ায় তাঁর সব আশা-ভরসা চুরমার হয়ে যায়, প্রাচ্যের রোমক রাজ্যের অস্তিত্বের স্বপ্নও তাঁর বিলীন হয়ে যায়। তিনি ভগ্নমনোরথ হয়ে চুপেচুপে আন্তিয়ক ত্যাগ করে পাহাড়ের পথ ধরেন এবং শস্যশ্যামল হরিৎ ক্ষেত্র-শোভিত সিরিয়ার দিকে তৃষিত নেত্রে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শেষ আফসোস্ করেন: বিদায় সিরিয়া! বিদায়! কি সুন্দর দেশই আজ দুশমনদের দিয়ে গেলাম!

আন্তিয়ক বিজয়ের পর আবুওবায়দাহ্ তাঁর বাহিনীকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিলেন, সমগ্র অঞ্চলটিকে অধিকার করতে। বুকা, জুমাহ, সুরমিন, তুজি, কুরাস, তিলখর্জ, দালুক, রুবান প্রভৃতি শহর ও কিল্লা বিনা রক্তপাতে অধিকৃত হয়। বালিস্ ও কারিন নামক কিল্লা দুটিও প্রথম হামলাতেই বশ্যতা স্বীকার করে। জর্জ মাইট্ গোত্রীয়রা জিয়া আদায় করতে অস্বীকার করেও বলে যে, মুসলিমদের পাশে পাশে তারাও শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। জিয়া আদায়ের হেতু সামরিক সাহায্যের প্রতিদান বিধায় তাদের শর্ত গৃহীত হয়।

আন্তিয়কের নিকটবর্তী এবং এশিয়া-মাইনর সীমান্তের শেষে বুখরাস নামে একটি বিখ্যাত কিল্লা ছিল। ঘাসান, তানুখ, আয়াজ প্রভৃতি খ্রিস্টমতাবলম্বী বহু আরবগোত্র এখানে একত্রিত হয় হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে মিলিত হতে। হাবিব বিন-মস্লামাহ্ তাদের আটক করেন, এবং জীষণ যুদ্ধে কয়েক হাজার হতাহতের পর তারা বশ্যতা স্বীকার করে। ওদিকে খালিদ মারাস শহরটি অবরোধ করলে তারা সন্ধি করে এই শর্তে যে তাদেরকে শহর পরিত্যাগ করে যথেচ্ছ গমনের সুযোগ দিতে হবে।

এখানে একটি কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে। আন্তিয়ক বিজয়ের পর সিরিয়াবাসী আরব গোত্রগুলি যখন দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে, তখন মাস্সা গোত্র-প্রধান জাবালা আত্মীয় পরিজনসহ ইসলাম কবুল করেন। এ সংবাদ ওমরের নিকট প্রেরিত হলে তিনি অত্যন্ত সন্তোষবোধ করেন ও জাবালাকে মদিনায় আহ্বান করেন। অনুমতি লাভ করে জাবালা বিশেষ শান-শওকতের সঙ্গে প্রায় পাঁচশত অনুচরসহ মদিনায় উপস্থিত হন এবং মদিনাবাসী কর্তৃক সাদরে গৃহীত হন। কিছুদিন মদিনায় অবস্থানের পর জাবালা ওমরের সঙ্গে মক্কায় গমন করেন হজ করতে। সেখানে কাবাগৃহ তওয়াফকালে সহসা তাঁর পাগড়ির প্রান্ত বানু ফরাযা গোত্রীয় এক ব্যক্তির পদতলে পিষ্ট হয়। তিনি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে লোকটিকে আঘাত করেন ও তার নাক ভেঙ্গে দেন। সে ওমরের নিকট নালিশ করে। ওমর জিজ্ঞাসা করলে জাবালা ঘটনা স্বীকার করেন। তখন ওমর নির্দেশ দেন, তুমি যখন স্বীকার করছো, তখন ফরিয়াদীকে সন্তুষ্ট করো, অন্যথায় তোমার বিচারে শাস্তি গ্রহণ করতে হবে। জাবালা বলেন, তা কি করে হতে পারে? ও তো সাধারণ লোক আর আমি বাদশাহ্। ওমর বলেন, ইসলাম বাদশাহ্ ও ফকীরে ভেদাভেদ নেই, তোমরা একই সমতলে। জাবালা তখন বলেন, এমন ইসলামে আমি থাকতে চাই নে, আমি পুনরায় খ্রিস্টান হবো। ওমর বলেন, তা হলে তোমায় মুশরেকীর অপরাধে শিরশ্ছেদ শাস্তি পেতে হবে। জাবালা ওমরকে বিচারে অনমনীয় দেখে এক রাত্রির সময় প্রার্থনা করেন। তারপর রাত্রির অন্ধকারে চুপচাপে সব অনুচরসহ মক্কা ত্যাগ করে সোজা কনস্টান্টিনোপলের পথ ধরেন ও হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে মিলিত হন।

একথা বলা দরকার যে, মাত্র কিতাবুল-আগানীতে কাহিনীটির উল্লেখ দেখা যায়। অন্যসব বিশিষ্ট ঐতিহাসিক জাবালার কাহিনী সত্য হিসেবে স্বীকার করেন না। মাত্র একটা আদর্শ নীতিকাহিনী হিসেবে তার প্রচলন রয়ে গেছে, মনে করেন।

১. ইয়ারমুকের যুদ্ধের সন-তারিখ নিয়ে একটা মতবিরোধ আছে। গীবন ও মুইর বলেন, এ যুদ্ধ হয় আবুবকরের খেলাফত আমলে ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে। আমীর আলী বলেন, ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে আগস্ট ‘এবং বাস্তবিকপক্ষে যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বেই আবুবকরের মৃত্যুসংবাদ রণস্থলে পৌঁছে’। অন্যপক্ষে আধুনিক ঐতিহাসিক শিবলী নোমানী, মাহমুদ, হিট্টী, আর্নল্ড, লিউইস প্রভৃতির দৃঢ় মত, এ যুদ্ধ হয় খলিফা ওমরের সময় ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া বিটানিকার বিভিন্ন নিবন্ধ Caliphate’, ‘Heraclius’ ‘syria’, ‘Omar’, প্রভৃতির প্রতিষ্ঠাবান ঐতিহাসিক লেখকগণও সমস্বরে এ মতেরই প্রতিধ্বনি করেন। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব-ইসলামে’ Abu Bakar, The First Caliph’ নিবন্ধেও এ উল্লেখ নেই যে ইয়ারমুকের যুদ্ধ তাঁর আমলে ঘটেছে। আমরা দুটি মতের ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষভাবে আলোচনা করে শেষোক্ত মতই অভ্রান্ত ও নির্ভুল তথ্যনির্ভর হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। শেষোক্ত ঐতিহাসিকগণ ওমরের মর্যাদা বৃদ্ধির লোভে কয়েকটি যুদ্ধ ওমরের আমলে টেনে আনবার অসাধু পন্থা অবলম্বন করেছেন, এ-চিন্তা করতেও বিবেকে বাধে। আর ওমরের বিজয় গৌরব-মুকুট এতো সব যুগ নির্ণায়ক ঘটনার স্বর্ণপাল শোভিত যে, অন্য কোনও পালক অপহরণ করে তার শোভাবৃদ্ধির হেতু সংযোজনের প্রয়োজন হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *