ইরাক-আরব বিজয় (শেষ পর্যায়)

ইরাক-আরব বিজয় (শেষ পর্যায়)

ওদিকে সারা আরব যখন বিজয়োল্লাসে উন্মত্ত, তখন এদিকে ইরাকের ঘরে ঘরে বিষাদ ও হতাশার গাঢ় ছায়া নেমে এসেছে। যারা পারসিকদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিল, তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়নপর হয়েছে। কিন্তু যারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিপক্ষতা করেছিল, তারা সা’দের নিকট আশ্রয় ভিক্ষা করলো। সা’দ নির্দেশ চেয়ে পাঠালেন খলিফার নিকট। ওমর এ সম্বন্ধে সাহাবাদের অভিমত চাইলেন। সকলেরই অভিন্ন মত হলো, আশ্রয় প্রার্থীকে বিনাশর্তে আশ্রয় দান করতে হবে। সা’দ অভয় ও আশ্রয় দানের সাধারণ ঘোষণা দিলেন। তখন স্থানীয় বাসিন্দারা আবার গৃহাগমন করতে লাগলো। আবার স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা হলো, সকলেই নিজ নিজ সাংসারিক কর্মে ব্যাপৃত হলো। শান্তিও ফিরে এলো।

পারসিক সৈন্যের অবশিষ্টাংশ কাদিসিয়া প্রান্তর থেকে পলায়ন করে বাবল দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। এখানে তারা ফিরুজানের নেতৃত্বে শক্তি সঞ্চয় করে মুসলিমদের বাধা দিতে প্রস্তুত হয়। সা’দ পনেরো হিজরীর শেষের দিকে (৬৩৭ খ্রি.) বাবলের দিকে অগ্রসর হন। পথে বারস নামক স্থানে পারসিক সেনানায়ক বাসিরি বাধা দিতে চেষ্টা করে, কিন্তু পরাজিত হয়ে বাবল দুর্গে পলায়ন করে। বারসের সরদার বাস্তাম পথের নদী ও জলনালীগুলির উপর কয়েকটি সেতু নির্মাণ করে মুসলিম সেনার পারাপার সুগম করে দেন। বাবলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়। কিন্তু পারসিকদের তখন মনোবল নিঃশেষ হয়ে গেছে। হরমুজান, মেহরান প্রভৃতি প্রথিতযশা বীরও তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে অক্ষম হন। মুসলিম সেনা উপস্থিত হলেই পারসিকরা পলায়ন করে এবং কুথার বিখ্যাত দুর্গে আশ্রয় লাভ করে। এখানে শাহরিয়ার নামক সেনানায়কের অধীনে তারা একত্রিত হয় সা’দ বাবলে ছাউনি ফেলে জুহুরাকে আদেশ দিলেন সম্মুখে অগ্রসর হতে। জুরাহ্ কুথায় উপস্থিত হলে শাহরিয়ার শ্রেষ্ঠতম আরবী-বীরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেন। জুাহ্ তামিম গোত্রের গোলাম নাবিলকে পাঠিয়ে বললেন, আমার এই গোলামই আপনাকে শায়েস্তা করতে যথেষ্ট। নাবিল প্রথমে শাহরিয়ার কর্তৃক ভূমিসাৎ হয়েও শাহরিয়ারকে পরাজিত ও নিহত করেন। তারপর শারিয়ারের স্বর্ণখচিত বহুমূল্য পরিচ্ছদ নাবিল উপস্থিত করেন সা’দের সম্মুখে। সা’দ নাবিলকে নির্দেশ দিলেন শাহরিয়ারের পরিচ্ছদ পরিধান করতে। নাবিল সে পরিচ্ছদ পরিধান করলে সা’দ উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন এই চিরসত্যের প্রতি-জগৎ কী মায়াময় ও ভাগ্য কি চঞ্চল!

কুথার ঐতিহাসিক গুরুত্ব হচ্ছে, নমরুদ কর্তৃক হযরত ইব্রাহিমকে বন্দী রাখার কথিত জিন্দাখানা এখানে অবস্থিত। এটি এখনও ঐতিহাসিক স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে সংরক্ষিত। সা’দ উপস্থিত হয়ে হযরত ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে যিয়ারত করেন।

কুথার কিছু দূরেই বাহরাহশের নামে শহর অবস্থিত। এখানে একদল রাজকীয় অশ্বারোহী ছিল, যাদের দৈনন্দিন কর্ম ছিল, পারসিক সম্রাটের নামে শপথ গ্রহণ করে তাঁর অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস করা। এখানে কিা পারসিক শাহানশাহের একটি আদুরে সিংহ ছিল, তাই শহরটির নাম বাহরাহশের। সা’দ সেনাবাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে সিংহটি লক্ষ দিয়ে তাঁর সেনাদলের কেন্দ্রস্থলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু সম্মুখরক্ষীদলের নায়ক ও সা’দের ভ্রাতুষ্পুত্র হিশাম তরবারির এক কোপেই তার ভবলীলা সাঙ্গ করেন। সা’দ নগরটি অবরোধ করেন। শহরজাদ সাধারণ বাসিন্দাদের জন্যে প্রাণ ভিক্ষা করেন। স্থানীয় সকল সরদারই জিয়া দিতে স্বীকৃত হয় ও মুসলিমদের আনুগত্য সহজে মেনে নেয়। কিন্তু শহরটি প্রায় দু’মাস ধরে অবরোধের প্রতিরোধ করে। শেষে জুাহ্ জীবন বিপন্ন করে শহরে প্রবেশ করেন এবং মারাত্মকভাবে শরাহত হয়েও সেনানায়ক শহরবাজকে নিহত করেন। তখন পারসিক সৈন্যরা পলায়ন করে ও শহরবাসীরা শান্তির নিশান উড়িয়ে দেয়।

শহর বাহরাহশের ও রাজধানী মাদায়েনের মধ্যে উত্তাল-তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ দজলা নদী প্রবাহিত। সা’দ নদী পারে এসে দেখলেন, পারসিকরা সব সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। তবুও তিনি নদী পার হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন: ভাইসব! দুশমনরা শেষ উপায় হিসেবে নদীর অপর পারে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আর একবার জয় লাভ করে সব বাধা দূর করবো। তিনি অশ্বসহ তরঙ্গক্ষুব্ধ দজলায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সাঁতার কেটে নদী পার হতে। স্রোতাবর্তে নদী ফুলে ফুঁসে গর্জে উঠছে। কিন্তু কিছুমাত্র ভীত না হয়ে সমগ্র মুসলিম বাহিনী নদী-বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং পাদানীতে পাদানী লাগিয়ে হাতে হাত জড়িয়ে সকলে মহানন্দে সাঁতার কেটে চলতে লাগলো, যেন কোনও আনন্দ- মেলায় যোগ দিতে যাচ্ছে। অপর তীরে দণ্ডায়মান পারসিকরা এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলো: ওরা জীন! ওরা জীন! এবং দিশাহারা হয়ে ছুটে পালাতে লাগলো। নয়া সিপাহসালার খারাজাদ একদল সৈন্য নিয়ে মুসলিমদের বাধা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাদের সে প্রচেষ্টা স্রোতাবেগে তৃণখণ্ডের মতো ভেসে গেল। মুসলিমরা অক্ষতদেহে তীরে উপস্থিত হলো।

দজলা নদী-তটেই রাজধানী মাদায়েনের অবস্থান। কোন অতীতকালে পারস্যের কিসরা অর্থাৎ সম্রাট ইরাক জয় করে দজলার তীর পর্যন্ত অধিকার করে নিয়েছিলেন এবং সালুকিয়ার সম্মুখে অবস্থিত টেসিফনে বিজয় নিশান তুলেছিলেন। তার পর টেসিফন ও সালুকিয়া সংযুক্ত করে নয়া রাজধানী মাদায়েনের গোড়াপত্তন হয়। বহুবার রোমকরা মাদায়েনের উপর হামলা চালিয়েছে কিন্তু আশ্চর্য কৌশলে সুরক্ষিত হওয়ায় তার কিছুমাত্র ক্ষতি হয় নি। পরে শোভাসম্পদ দিনে দিনে বর্ধিত হয়েছে এবং সমকালীন বিশ্বের কেন্দ্র ভূমিতে পরিণত হয়েছে। মাদায়েনের মহিমাকীর্তনে মানব-কণ্ঠ যতো মুখর হয়েছে রোম বা কনস্টান্টিনোপলের ভাগ্যে তা হয় নি। প্রাচ্যখণ্ডের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য, শোভা ও সম্পদের মায়াপুরী হিসেবে মাদায়েনের নাম সারা বিশ্বে কীর্তিত হতো। তার নাগরিকত্ব অর্জন সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এই মাদায়েনে অবস্থিত শাহী বালাখানা পৃথিবীর বিস্ময় হিসেবে কীর্তিত হতো। কিসরা নওশেরওয়া ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে তার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তৎকালীন শ্রেষ্ঠ রোমক ও গ্রীক স্থপতিদের নিয়োগ করেন তার নির্মাণকার্যে। শ্বেতবর্ণের প্রাসাদখানি জ্যোৎস্নার প্রতিফলন বহুদূর পর্যন্ত যেন স্বপ্নপুরীর বিস্তারিত পক্ষের মতো প্রতিভাত হতো।

এই স্বপনপুরীতে বসে শাহানশাহু ইয়েদগির্দ যখন কাদিসিয়ার পরাজয়-বার্তা শ্রবণ করেন, তখন শোকে ও দুঃখে মুহ্যবান হয়ে পড়েন। দিনের পর দিন ধরে তিনি মরুচর অজ্ঞাত অখ্যাত আরববাসীদেরকে ধ্বংস করবার যে নয়নরঞ্জন ছবির কল্পনা করতেন, উন্মাদ নিয়তি সব মুছে দিল। অনন্যোপায় হয়ে তখনই তিনি সম্রাজ্ঞীদেরকে, শাহ্জাদা ও শাহজাদীদেরকে মহামূল্য মণিমাণিক্য ও অর্থসম্পদ যতোদূর সম্ভব সমস্ত দিয়ে নিরাপদ স্থান হুলওয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর দেখাদেখি আমীর ওমরাহ্ ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠীও ধনিক নাগরিকরাও মাদায়েন ত্যাগ করেছিলেন। মুসলিমরা যখন দজলা পার হয়ে রাজধানীতে প্রবেশমুখী হলো তখন ইয়েদগিদও হুলওয়ানে পলায়ন করেন। বিজয়ী-বেশে সা’দ রাজধানীতে প্রবেশ করে দেখেন নগর প্রায় জনশূন্য সর্বত্র গভীর নীরবতা বিরাজ করছে। রাজধানীর এমন রিক্ত, শ্রীভ্রষ্ট, শোকাচ্ছন্ন, নির্বাক, নীরব, স্তম্ভিত ও বিষাদময়ী সজ্জা সাদের অন্তর স্পর্শ করলো। তিনি আবেগ-মিশ্রিত কণ্ঠে ধীরে- ধীরে কোরআনের এই মহাবাণী উচ্চারণ করলেন:

তারা ফেলে গেছে বহু বাগিচা, ফোয়ারা, বিহারভূমি, কুঞ্জকানন ও ধনসম্পদ, এককালে তারা এসব উপভোগ করতো। এমনি করে আমরা পরবর্তী কওমকে সেসবের উত্তরাধিকারী করি। কই, তাদের জন্যে আসমান কাঁদে নি, জমিনও না; এবং তাদেরকে আশ্রয়ও দেয় নি।

সা’দ কিার শুভ্র প্রাসাদে মিম্বার স্থাপন করে আট রাকাত নফল নামায পড়লেন এবং সেটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করলেন। লক্ষণীয় যে সা’দ আঁ-হযরতের একজন সাহাবা হওয়া সত্ত্বেও প্রাসাদের অভ্যন্তরে যতো মূর্তি ছিল, দেওয়ালে যত চিত্র বিচিত্ৰ কারুকার্য সমন্বিত নকশাদি ছিল এবং বহু বছরের সঞ্চিত মহামূল্য জিনিসপত্র ছিল, সেসব অক্ষত অবস্থায় যথাযথ স্থানে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। শুধু হুকুম দিয়েছিলেন যে, আরবীরা হিরাহ্ ও ইরাকের অন্যান্য শহর ও বস্তি থেকে নিজেদের পরিবার পরিজনকে আনয়ন করে মাদায়েন নগর পুনরায় আবাদ করবে। শহরের গৃহগুলি মুসলিমদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়।

সা’দ আদেশ দিলেন শাহী বালাখানায় যতো সামগ্রী ও ধন-সম্পদ আছে সমস্ত একত্রিত করতে। স্তূপাকারভাবে জমে উঠলো স্বর্ণমুদ্রার রাশি, স্বর্ণের তাল, হীরা, মণি- মাণিক্য এবং সুদুর্লভ প্রস্তরখচিত অজস্র রত্নালঙ্কার। কায়ানী বংশ থেকে নওশেরওয়া পর্যন্ত কিসরাদের ব্যক্তিগত বহুমূল্য পোশাক পরিচ্ছদ রত্নখচিত তরবারাদি, রত্নখচিত শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি নয়ন-মন বিভ্রান্তিকর সামগ্রীও একত্রিত হলো। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি বিশুদ্ধ স্বর্ণজাত অশ্ব, যার জীন ছিল রূপার এবং চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল বহুমূল্য দ্যুতিময় হীরা ও মণি-মাণিক্য খচিত। আর ছিল একটি রূপার উষ্ট্রী, যার জীন ছিল স্বর্ণ নির্মিত এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল সুদুর্লভ হীরা জহরত-খচিত কিন্তু এসবের চেয়েও নয়ন-বিমোহন ও আশ্চর্য ছিল একখানি গালিচা, যারনাম ছিল ‘বাহার’ বা বসন্ত। বসন্তকাল শেষ হলে ও চির-বসন্তের আনন্দময় পরিবেশে পাহারার-উৎসবের জন্যে এখানি ব্যবহৃত হতো। ধন-সম্পদ ও কারুশিল্পের চরম নিদর্শন হিসেবে ‘বাহার’ কীর্তিত হতো। তার জমিন ছিল স্বর্ণতন্তু-মিশ্রিত রেশমের এবং বসন্তের সওয়াত তাজা ফুল ও সবুজপত্র-শোভিত বৃক্ষসমূহ ছিল রঙ-বেরঙের হীরা, মুক্তা, চুনি-পান্নার। গালিচাখানি বিস্তৃত হলে বসন্তের শোভায় নয়ন-মন বিভ্রান্ত হতো। আরব ঐতিহাসিকগণ এসব লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য নিরুপণে একে অপরকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁদের হিসাব মতে মোট দাম ছিল নয় লক্ষ কোটি দিরহাম্।

এসব কোটি কোটি মুদ্রার সামগ্রী স্তূপীকৃত হলো মুসলিমদের উৎসাহে ‘মালে- গণিমাত’ বা লুণ্ঠিত দ্রব্য হিসেবে। তাদের আদর্শ সাধুতা ও নির্লোভের দৃষ্টান্তে সা’দ মুগ্ধ হয়ে বারবার আল্লাহর শুকরগুজারী করেন। ইসলামের বিধান মতো এই মালে- গনিমাতের পাঁচভাগের চারভাগ মুসলিম বাহিনীর মধ্যে বন্টিত হয়। ষাট হাজার সৈন্যের প্রত্যেকে বার হাজার স্বর্ণমুদ্রা পায়, তাছাড়া পায় হীরা, মণি-মুক্তা ও সুদুর্লভ বস্ত্র ও পরিচ্ছদের সুনির্দিষ্ট হিস্যা এক-পঞ্চমাংশ মদিনায় প্রেরিত হয়। ‘বাহার’ গালিচাসহ অন্যান্য সুদুর্লভ স্মারক দ্রব্যও মদিনায় প্রেরিত হয়।

মদিনাবাসীরা এই ধন-সম্পদের স্তূপ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। ওমর সা’দের পত্রে মাদায়েন দখলের পূর্ণ বিবরণ ও মালে গনিমাতের নির্ভুল হিসাব পেয়েছিলেন, কিন্তু চর্মচক্ষে স্তূপীকৃত ধনসম্পদ দেখে এবং মুসলিম সৈন্যদের সাধুতা ও বিশ্বস্ততার প্রকৃষ্ট পরিচয় পেয়ে আশ্চর্য হয়ে বলেন, যারা এসব বহুমূল্য সামগ্রী নির্লোভ হয়ে মদিনায় পাঠিয়েছে, তাদের বিশ্বস্ততা তুলনাহীন। আলী একথা শুনে বলেন: আপনার অঞ্চল পবিত্র, এজন্যে আপনার প্রজাকুলের অঞ্চলও পবিত্র। আপনার মন সরল না হলে তাদের মনও সরল হতে পারে না। ওমর মদিনার প্রত্যেককে এসব সামগ্রী চাক্ষুষ দেখে নয়ন-মন তৃপ্তির ব্যবস্থা করেন। সারাকা নামক এক সুদেহী যুবককে ডাকিয়ে কিার পরিচ্ছদ ও অস্ত্রাদি পরিয়ে সকলকে দেখান ও বলেন, ভাগ্যের কী কঠোর পরিবর্তন। সারাকা! তোর দেহে কিার পোশাক উঠবে ও তোর জাতের এসব ভোগের ভাগ্য হবে, কখনও স্বপ্নেও ভেবেছিলি? কিসরা নওশেরওয়ার পরিচ্ছদ ছিল সবচেয়ে মহার্ঘ ও নয়ন-বিভ্রমকারী, এক এক সময়ে এক এক ধরনের। মুহাল্লাম নামক আর একটি যুবক ছিল সবচেয়ে কান্তি-সুন্দর। তাকে ডাকিয়েও এসব পরিচ্ছদ পর পর পরানো হয়। তার পর ওমর উপরের দিকে মাথা তুলে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন: হে আল্লাহ! এসব ধনরত্ন তুমি রসূলকে দাও নি, কারণ তিনি ছিলেন আমার চেয়েও তোমার প্রিয় বন্ধু। আবুবকরকেও দাও নি, কারণ তিনি ছিলেন আমার চেয়েও তোমার প্রিয় বান্দা। কিন্তু এখন আমায় এসব দিয়ে তুমি কি আমায় পরীক্ষা করছো?

ওমর মদিনাবাসীদের মধ্যে এসব ধনরত্ন ও সামগ্রী বন্টন করে দিলেন। যারা যুদ্ধে মারা গেছে তাদের আত্মীয়দেরকে পৃথক ভাগ দেওয়া হয়। সমস্যা ওঠে, গালিচাটি কি করা যায়? বেশি লোকের অভিমত হলো, স্মারকচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত হোক। আলী ইবনে-আবু তালেব বলেন, আপনার জ্ঞান ও সদুদ্দেশ্যে কারও এতটুকু সন্দেহ নাই। আপনি যে হোক সামগ্রী কাউকে দান করতে পারেন, সে খেতে পারে কিংবা পরতে পারে। আজ এটি সংরক্ষিত হলে কাল কেউ আত্মসাৎ করতে পারে, যদিও তার কোনও স্বত্ব বা দাবী থাকুক বা না থাকুক। ওমর এ যুক্তি মেনে নিয়ে হুকুম দেন, গালিচাটি কেটে খণ্ড খণ্ড করে সকলকে বিলিয়ে দিতে। আলীর ভাগে যে খণ্ডটি পড়ে তার দাম উঠে বিশ হাজার মুদ্রা। আধুনিক পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ এ কর্মটিকে শিল্প হত্যার চরম বর্বরতা হিসেবে কটাক্ষ করেন। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, যুগে যুগে রুচি এবং শিল্প- জ্ঞানের পরিবর্তন হয়। আরও পরিবর্তন হয় পার্থিব সামগ্রীর প্রতি অনীহা ও উপেক্ষার মান।

জালুলার যুদ্ধ ছিল ইরাক বিজয়ের চরম আঘাত। শহরটি বর্তমান বাগদাদের নিকট অবস্থিত। মাদায়েন রাজধানীর পতনের পর পারসিকরা শেষ চেষ্টা করে মুসলিমদের অগ্রগতি রোধ করতে এবং একা বাহিনী সমবেত করে চূড়ান্ত ভাগ্য পরীক্ষার্থে প্রস্তুত হয়। রুস্তমের ভাই,খারজাদ হন নয়াবাহিনীর সিপাহসালার। তিনি শহরটির চারদিকে পরিখা খনন করে পথসমূহের উপর ‘গোকুরু’ নামক লোহার বহুমুখবিশিষ্ট কন্টক ছড়িয়ে দেন। সা’দ পারসিকদের এই নয়া প্রস্তুতির সংবাদ ওমরের গোচরীভূত করেন। ওমর নির্দেশ দেন, বারো হাজার সৈন্যসহ হাশিম-বিন-ওবাকে জালুলা দখল করতে পাঠাতে। কাকা’, মুসির, আমর বিন-মালিক ও আমর বিন মাররাহ হাশিমের সহগামী হন। ষোল হিজরীতে (৬৩৭ খ্রি.) জালুলার অবরোধ আরম্ভ হয় ও কয়েক মাস ধরে চলে। পারসিকরা বারে বারে হঠাৎ বহির্গত হয়ে হামলা চালাতে থাকে এবং এভাবে প্ৰায় আশিবার সংঘাত বাধে। কিন্তু প্রত্যেকবারেই মুসলিমরা জয়ী হয়। শহরে প্রচুর রসদ মজুদ ছিল, আর ছিল হাজার হাজার সৈন্য। এজন্যে পারসিকরা সহজে দমিত হয় না। শেষে এক দিন পারসিকরা মরণপণে সংগ্রাম শুরু করে। সেদিন সহসা প্রচণ্ড বালুঝড় উঠে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পারসিকরা তার দরুন বেশ নাজেহাল হয় এবং তাদের অসংখ্য সৈন্য পরিখায় পতিত হয়ে মৃত্যু আলিঙ্গন করে। মুসলিমরাও সুযোগ বুঝে তীব্র আক্রমণ চালায়। হাশিম ও কাকা’র প্রচণ্ড আক্রমণে পারসিকরা একেবারে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে পলায়ন করতে থাকে। মুসলিমরা তাদের নির্বিচারে হত্যা করে। যুদ্ধশেষে দেখা গেল পারসিকদের নিহতের সংখ্যা লক্ষের কাছাকাছি। লুণ্ঠিত মালামালের মূল্য নির্ধারিত হয় তিন কোটি দিরহামেরও উপর।

সা’দ জালুলা বিজয়ের সংবাদ মদিনায় পাঠান জিয়াদের মারফত। মালেগনিমাতের এক-পঞ্চমাংশও যথারীতি প্রেরিত হয়। জিয়াদ বিশেষ বাগ্মিতা দেখিয়ে যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা দান করেন। ওমর মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রশংসায় বলেছিলেন, প্রকৃত বাগ্মিতা একেই বলে। সেদিন লুণ্ঠিত ধনদৌলত বণ্টিত না হওয়ায় মসজিদের আঙ্গিনায় স্তূপীকৃত করা হয় এবং আবদুর রহমান বিনআউফ ও আবদুল্লাহ বিন আরকাম সারারাত্রি প্রহরায় নিযুক্ত থাকেন। প্রত্যুষে এসব ধন-রত্নের বিচিত্র দৃশ্যে অভিভূত হয়ে ওমর অশ্রুপাত করতে থাকেন। কারণ জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন: ধন-দৌলত সঞ্চিত হলে তার পিছনে পিছনে হিংসা ও দ্বেষও সঞ্চিত হয়।

হুলওয়ান দুর্গে বসে ইয়েদি এই চরম পরাজয় কাহিনী শ্রবণ করেন। তখনই তিনি খসরু শানমকে দুর্গরক্ষার ভার দিয়ে স্ত্রী-পরিজনসহ ভগ্নহৃদয়ে রায় শহরাভিমুখে প্রস্থান করেন। সা’দ জালুলায় অবস্থান করে কাকা কে পাঠান হুলওয়ান দখল করতে। কাকা’ কসর-শিরীন পর্যন্ত উপস্থিত হলে খসরু-শানম তাঁকে বাধা দেন। কিন্তু সামান্য যুদ্ধেই পারসিকরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। কাকা হুলওয়ানে উপস্থিত হয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। স্থানীয় প্রধানরা উপস্থিত হয়ে জিয়া কর দিতে স্বীকার করেন এবং ইসলামের আশ্রয় ভিক্ষা করেন।

অতঃপর সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা নেমে আসে। হুলওয়ান অধিকৃত হওয়ায় ইরাক- আরবের সীমান্ত পর্যন্ত মুসলিমদের করতলগত হয় এবং বিজয়ের এ অধ্যায়েরও শেষ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *