সখী

সখী

সুপর্ণার গোটা শরীরটা কেঁপে উঠল। মনে হল, ব্যালান্স হারিয়ে এখনই পড়ে যাবে। সোফার হাতলটা কোনওরকমে চেপে ধরল সে।

মহিলা মাথা নামিয়ে টেবিল থেকে কাপ-ডিশ তুলতে তুলতে বলল, ‘বউদির কি শরীর খারাপ লাগে? মাথা ঘোরে?’

সুপর্ণা সোফায় বসে পড়েছে। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে। মুখ না তুলে বলল, ‘না না, আমি ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি।’

মহিলা শান্ত গলায় বলল, ‘দাদাবাবুর রাতের রুটি করে রাখব?’

কী উত্তর দেবে সুপর্ণা বুঝতে পারছে না। তার মাথার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। জল খাওয়া দরকার। ঠান্ডা এক গেলাস জল। কিন্তু তার থেকেও আগে দরকার এই মানুষটাকে সামনে থেকে সরানো। কীভাবে সরাবে? চলে যেতে বলবে? বললে, কী বলবে? তুমি আমার সামনে থেকে যাও?

মহিলা আবার বলল, ‘আমি কি রুটি করে রাখব বউদি?’

সুপর্ণা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কোনওরকমে বলল, ‘হ্যাঁ, করে রাখো।’

‘আপনি কি রাতে রুটি খান?’

সুপর্ণার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবু তাকে বলতে হল। নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, ‘না, শুধু দাদাবাবু খান।’

‘তা হলে আপনার জন্য ভাত বসাই?’

‘না, থাক, আমি আজ রুটি খাব।’

সকালে মহিলা যখন আসে তখন সুপর্ণা ভীষণ রকমের ব্যস্ত। অফিসের দেরি হয়ে গেছে। আজকাল অফিসে দেরি হয়ে গেলে ম্যানেজ দেওয়ার উপায় নেই। অনেকরকম ফ্যাকড়া হয়েছে। খাতা-টাতার বালাই উঠে গেছে। কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকতে হয়। তা ছাড়া কিছুদিন হল, কাজের চাপ খুব বেড়েছে। অনেকেই বলছে, কাজের চাপ বেড়েছে মানে, এবার প্রমোশন হবে। প্রমোশন না ছাই। প্রতিদিন একটা করে প্রজেক্ট রিপোর্ট দেখতে হচ্ছে। মুখ তোলবার সময় নেই। রোজই সাড়ে সাতটা, আটটা বেজে যায়। যাওয়ার সময় নির্মল অফিসে নামিয়ে দেয়। ফেরবার সময়ও এতদিন নির্মল তুলে আনত। আজকাল আর হয় না। বাড়ি ফিরে নির্মল ড্রাইভারকে দিয়ে আবার গাড়ি পাঠায়। নইলে মেট্রো ধরে সুপর্ণা নিজেই চলে আসে।

আজ সকালে যখন ফ্ল্যাটের বেল বাজল, তখন সুপর্ণা অফিসের কাগজপত্রে চোখ বোলাচ্ছে। নির্মল সকালে বেরিয়ে গেছে। অফিস থেকে গাড়ি এসেছিল। ওদের বস এসেছে চেন্নাই থেকে। তাকে নিয়ে হাওড়ার কোথায় সাইট দেখতে যাওয়ার কথা। এ-ক’টা দিন ওরও ঝামেলা আছে। ছুটে ছুটে বেড়াতে হবে।

বিরক্ত মুখে সুপর্ণা দরজা খুলল। অফিস বেরোনোর মুখে কারও আসা সব থেকে বিরক্তিকর। এইসময় এক-একটা মুহূর্তের দাম অনেক।

রোগাপাতলা ধরনের এক মহিলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা চটের থলি। ঢোঁক গিলে বলল, ‘আমাকে সন্তোষপুরের মাসিমা পাঠিয়েছেন। আপনিই এ-বাড়ির বউদি তো? মাসিমা আপনাকে এই চিঠিটা দিয়েছেন।’

মহিলার মুখের দিকে ভাল করে না তাকিয়ে সুপর্ণা দ্রুত কাগজের টুকরোটা খুলল। তাতে লেখা— ‘কাল রাতের কথামতো একে পাঠালাম। তুমি কথা বলে, দেখে শুনে বুঝে নাও। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবে। আশীর্বাদ জানবে, মা।’

নিমেষে সুপর্ণার মুখ থেকে বিরক্তি ভাব উধাও। উফ, শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল তা হলে। না, এই বয়সেও মা করিতকর্মা আছে। মুখে সামান্য হাসি নিয়ে সে এবার মহিলার দিকে ভাল করে তাকাল। বলল, ‘এসো, ভেতরে এসো।’

দশ দিন হল, আগের মেয়েটি কাজ ছেড়ে চলে গেছে। তার নাকি হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়েছে। তারপর থেকে চোখে অন্ধকার দেখছিল সুপর্ণা। কীভাবে ঘর আর অফিস সামলাবে বুঝতে পারছিল না। স্বামী, স্ত্রী দু’জনকেই বেরোতে হয় সকালে। অফিসেই লাঞ্চ। কোনওদিন তাও হয় না। কিন্তু শ্বশুরমশাই তো আছেন। তাঁর খাওয়াদাওয়া আছে। দু’দিন অফিসে বেরোনোর আগে শ্বশুরমশাইয়ের জন্য রান্না করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা সুপর্ণার। আপাতত পাড়ারই এক হোম সার্ভিসের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়েছে। টিফিন ক্যারিয়ারে একবেলার খাবার দিয়ে যাচ্ছে। দুপুরে নিজে নিয়ে শ্বশুরমশাই খেয়ে নিচ্ছেন। তবে সে-খাবার তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। সুপর্ণা বাড়ি ফিরলেই অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। নুন, ঝালের অভিযোগ। নির্মলও চাইছে না, এটা বেশিদিন চলতে থাকুক। কিন্তু উপায় কী? তা ছাড়া শুধু তো রান্না নয়, বাকি কাজও তো আছে। বাসন ধোওয়া থেকে ঘর ঝাড়পোঁছ, সবই তো পড়ে রইল। ফ্ল্যাটবাড়িতে হুট বলতে আলাদা আলাদা লোক নিয়ে নেওয়া যায় না। রাতে ফিরে এসে খানিকটা সামলাচ্ছিল সুপর্ণা, বেশিটাই পড়ে থাকছিল। সব মিলিয়ে একটা বিপর্যয়ের মতো।

সন্তোষপুরে বারবার টেলিফোন করে মাকে তাগাদা দিয়েছে সুপর্ণা— ‘এখনও পেলে না? একটা কাজের লোক পেতে এত সময় লাগছে তোমার? সত্যি মা, তোমার বয়স হয়ে গেছে। বলেছি তো, এনি অ্যামাউন্ট। যা টাকা লাগে দেব। গুছিয়ে সব কাজ করবে। রাতদিনের একটা কাজের লোক না হলে এবার কিন্তু আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে।’

মলিনাদেবী মেয়ের কাজের লোক নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে খুবই চিন্তিত ছিলেন। মাত্র সাত দিনে তিনি সতেরো জনের ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলেছেন। কাউকেই পছন্দ হয়নি। মেয়ের বাড়িতে লোক দেওয়ার অনেক ঝামেলা। যাকে-তাকে পাঠিয়ে দিলে চলবে না। তিন মাস আগে নাতনি পুনেতে পড়তে চলে যাওয়ার পর, অত বড় ফ্ল্যাটে এখন লোক বলতে মোটে তিন জন। মেয়ে, জামাই বেরিয়ে যাওয়ার পর বুড়ো শ্বশুর একা। তাঁর থাকা না-থাকা সমান। চোখে কম দেখেন। ইদানীং নাকি কানে শুনতেও অসুবিধে হচ্ছে। একটা কথা দু’বার বলতে হয়। সুতরাং সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, কাজের লোক যেন চোর-ডাকাত না হয়। বাপ রে, কাগজে রোজ যা-সব বের হয়। মলিনাদেবী তাই সাবধানে এগোতে লাগলেন। দিন তিনেক বাদে মেয়েকে অফিসেই ফোনে ধরলেন তিনি।

‘একটা বাচ্চা মেয়ে পেয়েছি। বছর বারো বয়স। ওর মা আমাদের পাশের বাড়িতেই ঠিকে কাজ করে। ভয় নেই। চুরিচামারি করবে না। রাখবি সুপু?’

সুপর্ণা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বাচ্চা দিয়ে কী হবে আমার? তাকে কাজ শেখানোর সময় কোথায়? তা ছাড়া বারো বছরের মেয়ে কী শিখবে? মা, উই নিড অ্যান এজেড পার্সন। একজন বয়স্ক কেউ। যে রান্না জানবে, সংসারের আর পাঁচটা কাজ জানবে। শ্বশুরমশাইকে দরকার হলে ওষুধটুকু এগিয়ে দিতে পারবে। ছোট মেয়ে এসব পারবে? ট্রেনিং-এর কোনও ব্যাপার নেই। রেডিমেড একজনকে দাও।’

‘থাম তো। রেডিমেড রেডিমেড বলে চেঁচালেই তো হবে না। তুই যেরকম বলছিস, সেরকম পেতে গেলে কত মাইনে চাইবে বল তো?’

সুপর্ণা এবার রেগে গিয়ে বলল, ‘এনি অ্যামাউন্ট। যত খুশি মাইনে হোক। টাকাপয়সা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে বলেছি? তুমি শুধু খোঁজ করে পাঠিয়ে দাও।’

সেই খোঁজ অবশেষে পাওয়া গেছে। কাল রাতে অফিস থেকে ফেরবার পর পরই সুপর্ণা মায়ের ফোন পেল।

মলিনাদেবীর উত্তেজিত অথচ হাসি হাসি গলা।

‘একজনকে পেয়েছি সুপু। ঠিক তোদের যেমন দরকার তেমন। ঘরের কাজ জানে সব। শুনলাম, নিরামিষ রান্নার হাত নাকি ভাল। তোর শ্বশুরমশাই তো আবার ওসব খেতে ভালবাসেন। বাটিচচ্চড়ি, ছেঁচকি, ধোঁকার ডালনা। উনি খুশি হবেন। মেয়েটা আজ এসেছিল। মেয়ে না বলে মহিলা বলাই ভাল। এই ধর প্রায় তোরই বয়সি। দু’-এক বছর এদিক-ওদিক হতে পারে। তবে আজকাল তো আর চেহারা দেখে মেয়েদের বয়স ধরা যায় না।’

‘উফ মা, কাজের লোকের বয়সের এত ডিটেলস্‌ দিয়ে আমার কী হবে বলো তো! ছেলেমানুষ নয়, এটাই আসল কথা। বয়স বেশি মানে সংসার বুঝতে পারবে। আমি তো ওরকমই খুঁজছি।’

মেয়ের বাধাতে মলিনাদেবী বিন্দুমাত্র দমলেন না। তিনি বলেই চললেন, ‘শুধু বয়স্ক নয়, দেখে তো মনে হল বেশ ভদ্র সভ্য। আজকাল অবশ্য মনে হয় এক, পরে দেখা যায় আসল ঘটনা অন্যরকম। তবে কথা বেশি বলে না। চুপচাপ ধরনের। কাজের লোক বেশি ট্যাঁকট্যাঁক করলে আমার অসহ্য লাগে।’

সুপর্ণা খুশি হয়ে বলল, ‘তোমার অসহ্য লাগবার কী আছে মা? কাজ তো তোমার বাড়িতে করছে না, আমার বাড়িতে করবে। অসহ্য লাগলে আমাদের লাগবে। তা ছাড়া, এ-বাড়িতে ট্যাঁকট্যাঁক করবার মতো কে আছে? শ্বশুরমশাই তো নিজের মতো বই আর টিভি নিয়ে থাকেন। ঠিক সময় খাবার পেলেই সন্তুষ্ট। ওসব তুমি ভেবো না।’

মলিনাদেবীর সমস্যা হল, মেয়েকে টেলিফোন করলেই তিনি গল্প ফেঁদে বসবার ঢঙে কথা শুরু করেন। যে-কথা চট করে সেরে নেওয়া যায়, সে-কথা তিনি শুরু করতেই দীর্ঘক্ষণ লাগিয়ে দেন। আজও তাই করছেন। বললেন, ‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। তোদের বাড়িতে আর এখন কথা বলবার তেমন লোক কই। মিমি চলে যাওয়ার পর তো বাড়ি ফাঁকা। এইটুকু মেয়েকে বাইরে পড়াতে পাঠাবার যে কী আছে, আমি বাবা বুঝি না। এই তো সে দিনও স্কুলে যাচ্ছিল। যাই হোক, ফাঁকা বাড়িতে আবার লোক দেওয়া বিপদের। আমি অবশ্য এই মহিলার ঠিকানা ফিকানা সব লিখে রেখেছি। বাইপাসের আশেপাশে কোথায় যেন থাকে বলল। ভেবেছি একদিন লোক পাঠিয়ে খবর নেব। সত্যি বলছে না মিথ্যে।’

‘ওসব কথা এখন ছাড়া তো মা, তোমার সবটাতেই ভয়। কালই তুমি পাঠিয়ে দাও। কাল থেকেই শুরু করুক। আজকাল এফিশিয়েন্ট কাজের লোক ফাঁকা বসে থাকে না। আমি এখন ছাড়ছি, এইমাত্র অফিস থেকে ফিরলাম। টায়ার্ড হয়ে আছি, তোমার সঙ্গে আর বকরবকর করতে পারছি না।’

সুপর্ণা চাইলেও, মলিনাদেবী টেলিফোন ছাড়তে চাইছেন না। বললেন, ‘আহা, আগে ভাল করে শুনে নিবি তো। মাইনেটাইনের কথা তুই আবার আগ বাড়িয়ে বলতে যাস না। ক’দিন কাজটাজ দেখে তারপর বলবি। বললি একগাদা টাকা, তারপর দেখলি কাজে লবডঙ্কা। সেরকম হলে আমিই বলে দেব।’

সুপর্ণা তাড়াতাড়ি বলল, ‘সে বিলক্ষণ। তবে দেখো দরাদরিতে বেঁকে না বসে।’

মলিনাদেবী টেলিফোন ছাড়ার আগে বললেন, ‘একটা ভাল কথা সুপু, এই মেয়ের পেটে আবার বিদ্যে আছে।’

‘বিদ্যে আছে!’

‘হ্যাঁ রে, বলল ক্লাস এইট না নাইন অবধি পড়েছে। তার শ্বশুরমশাইয়ের ওষুধের নামটাম পড়তে পারবে। মিথ্যেও হতে পারে। হলেই বা কী, ওকে দিয়ে তো আর তুই মেয়ে পড়াচ্ছিস না।’

নির্মল আসতেই সুপর্ণা খবরটা জানাল। নির্মল বলল, ‘শুনে তো ভালই লাগছে। এখন দেখো শেষ পর্যন্ত করে কি না। করলেও বেশিদিন থাকবে না। যা কোয়ালিফিকেশন শুনছি, তাতে এ ধরনের লোক এক জায়গায় বেশিদিন থাকে না। বেশি টাকায় কাজ চেঞ্জ করে। তুমি মাইনে টাইনে নিয়ে বেশি বারগেন করতে যেয়ো না যেন। তোমার মাকেও বলে দিয়ো। উনি আবার বেশি কড়া হতে গিয়ে কেঁচিয়ে না ফেলেন।’

সুপর্ণা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘অ্যাই, আমার মায়ের নামে একটা কথাও বলবে না। এমন চমৎকার একটা লোক কে খুঁজে দিল শুনি!’

সেই ‘চমৎকার লোক’ এসে গেছে। সুপর্ণার অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। কাগজপত্র ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে সে দ্রুত কথা বলতে লাগল, ‘নাম কী তোমার?’

‘শান্তি। আপনি বউদি আমায় বাতাসির মা বলে ডাকবেন।’

ফাইল ওলটাতে ওলটাতে সুপর্ণা বলল, ‘তোমার মেয়ের নাম বুঝি বাতাসি?’

‘হ্যাঁ, বউদি। বড় মেয়ের নাম বাতাসি। আরও দুটো আছে।’

‘বাঃ, তা হলে তোমার সংসার তো বেশ বড়ই দেখছি। তা বাতাসির মা, আজ থেকেই কাজ শুরু করে দাও। এ-বাড়িতে নিজের মতো করে কাজকর্ম সব বুঝে নিতে হবে। একটু দেখিয়েটেখিয়ে দিচ্ছি। ব্যস, এই পর্যন্ত। মায়ের কাছ থেকে সব শুনেছ তো?’

‘হ্যাঁ, শুনেছি।’ ঘরের একপাশে হাতের থলিটা রাখতে রাখতে বাতাসির মা বলল। সুপর্ণা আড়চোখে একবার সেদিকে তাকাল। মনে হচ্ছে, ভেতরে কিছু আছে। নিশ্চয় শাড়িটাড়ি নিয়ে এসেছে।

‘আজ সকালে তেমন কিছু করতে হবে না তোমাকে। শুধু ঘরটরগুলো চিনে নাও। ওপাশে একটা ঝাড়ন আছে। পারলে বুক র‍্যাক, শোকেস, টেবিল একটু ঝেড়েটেড়ে রেখো। তবে জিনিস কিছু সরিয়ো না। তোমার দাদাবাবু রাগ করেন। এসো রান্নাঘরটা আগে দেখিয়ে দিই। তুমি গ্যাস জ্বালাতে পারো তো, বাতাসির মা?

‘হ্যাঁ বউদি। গ্যাসওভেন, কাপড় ধোওয়ার মেশিন, সব পারি। আগের বাড়িতে মশলা বাটার মেশিন ছিল। সেটাও আমি চালাতাম।’

‘ভেরি গুড। তুমি মিক্সিও চালাতে জানো! তা হলে তো কোনও চিন্তাই রইল না। তবে সব কাজই সাবধানে করবে। অনেকটা সময় আমরা বাড়িতে থাকি না। চট করে কাউকে দরজা খুলে দেবে না। শ্বশুরমশাইকে বিকেলে চা করে দিয়ো। ক’টা দিন ফ্লাস্কের চা খেতে হয়েছে মানুষটাকে। ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমি এবার বেরিয়ে যাব। অলরেডি আমি লেট। বাকি কথা সন্ধেবেলা ফিরে এসে হবে।’

‘একটা কথা ছিল বড়দি।’

এতক্ষণ পর মহিলার দিকে ভাল করে তাকাল সুপর্ণা। তাকাতেই চমকে উঠল। মুখটা যেল চেনা লাগছে! আগে কোথাও দেখেছে নাকি? কালোর ওপর দেখতে খারাপ নয়। চটক না থাকলেও, আলগা একটা শ্ৰী আছে। দীর্ঘ অভাব-অনটনে এই ধরনের মেয়েরা সাধারণত সবরকম সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। এই মহিলা পুরোটা হারায়নি। তবে খুব ভাবলে মনে হচ্ছে, এই মুখ তার আগে যেন দেখা! কোথায় দেখেছে?

বাতাসির মা আবার বলল, ‘একটা কথা ছিল বউদি।’

চমক ভেঙে সুপর্ণা বলল, ‘বলো, কী কথা। মাইনের কথা তো? সে না হয় সন্ধেবেলা ফিরে এসে বলব।’

‘না, মাইনের কথা নয়। বড়দি, আমি কিন্তু রাতে বাড়ি চলে যাব। মাসিমাকে আমি বলেছি। মেয়েরা বাড়িতে থাকে। যাদবপুরের ওদিকটা ভাল নয়।’

সুপর্ণা খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে তাই যেয়ো। সকাল সকাল চলে আসতে পারবে তো? খুব সকালে আসতে হবে কিন্তু। আমাদের ব্রেকফাস্ট করতে হবে।’

‘হ্যাঁ, পারব।’

সুপর্ণা আরও নিশ্চিত হল। না, বাতাসির মাকে সে অবশ্যই আগে কোথাও দেখেছে। কোথায় দেখেছে, জায়গাটা মনে পড়ছে না। মায়ের ওখানে? জিগ্যেস করবে? থাক, প্রথমদিন এ ধরনের কথা বললে সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পরে কোনও সময় করা যাবে। তার আগে নিজে থেকে মনে পড়ে গেলে তো ভালই। অনেক সময় এরকম হয়, মানুষকে চেনা লাগে, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ে না মানুষটা কে। একটা খচখচ করতে থাকে। করতেই থাকে।

অফিসে সারাক্ষণ এই খচখচ ভাবটা রয়ে গেল সুপর্ণার। একটা চাপা ধরনের অস্বস্তি। কাজে মন দিলেও চোখের সামনে মুখটা ভেসে উঠছে বারবার। এইসময় মোবাইলে নির্মলকে ধরল।

ফোন ধরেই নির্মল বলল, ‘লোক এসেছে?’ বিষয়টা নিয়ে সেও উদ্বিগ্ন।

‘এসেছে। সকালে অফিসে বেরোনোর সময় এল।’

‘কেমন বুঝলে?’

‘ভালই তো মনে হল। কাজকর্ম সব জানে তো বলছে। বাবার ওষুধ, খাবারদাবার সব বলে দিলাম। আজকের দিনটা হোম সার্ভিস কন্টিনিউ করেছি। তুমি আজ ফেরবার সময় বাজার করে এনো। কাল থেকে ও-ই রান্না করবে। ক’দিন গেলে আরও বুঝব।’

‘ভেরি গুড। টিকে গেলে ভাল।’

‘একটা ঘটনা হয়েছে।’

নির্মল চিন্তিত গলায় বলল, ‘এর মধ্যেই ঘটনা?’

‘জানো, মেয়েটাকে কেমন চেনা চেনা লাগল।’

নির্মল বিরক্ত গলায় বলল, ‘এটা আবার ঘটনা কী? চেনা চেনা লাগতেই পারে। হয়তো আগে কোথাও দেখেছিলে।’

‘সেটাই তো সমস্যা। কোথায় দেখেছিলাম মনে করতে পারছি না। একটু আগে সন্তোষপুরে ফোন করেছিলাম। মাকে জিগ্যেস করলাম, ও বাড়িতে কখনও দেখেছি কি না, মা বলল, না, আগে আসেনি কোনওদিন। একটা আনইজি ফিলিংস হচ্ছে।’

‘উফ ছাড়া তো সুপর্ণা। তোমার যত্তসব পাগলামি। মনে করতে পারছ না তো পারছ না। এটা মাথা ঘামানোর মতো কোনও সাবজেক্ট হল? এরকম আমাদের কত হয়! তোমার হয় না? চেনা লাগলেও স্পট করা যায় না। রাস্তাঘাটে, অফিসে হরদম হচ্ছে। ফালতু জিনিস নিয়ে আননেসেসারি মাথা ঘামিয়ো না।’

সুপর্ণা ফোন ছেড়ে ভাবল, সত্যি, এটা নিয়ে ভাবনার কী আছে? একটা কাজের মহিলাকে চেনা চেনা লেগেছে বলে চিন্তিত হওয়া সত্যিই হাস্যকর একটা ব্যাপার। বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ফাইল খুলে প্রজেক্ট রিপোর্টটা বের করল সুপর্ণা। রিপোর্ট অনেক বড়। এত বড় রিপোর্ট পড়ে শেষ করতে অনেক সময় লেগে যাবে। অর্থাৎ আজও বাড়ি ফিরতে দেরি।

চেষ্টা করলেও বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না সুপর্ণা। লাঞ্চ টাইমে মিসেস সান্যালকে ধোসা খেতে খেতে ঘটনাটা বলে ফেলল।

মিসেস সান্যাল হেসে বললেন, ‘আচ্ছা এরকমও তো হতে পারে সুপর্ণা, তোমার ওই বাতাসা না বাতাসির মাকে আসলে তুমি চেনোই না। তোমার অন্য কোনও চেনা মহিলা হয়তো এরকম দেখতে। হতে পারে না? তুমি যা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে, দ্যাট ওম্যান ইজ নট লাইক সো কলড্‌ মেডসারভেন্ট। আর পাঁচজন কাজের লোকের মতো নয়। একটা ভদ্র সভ্য, আমাদের ঘরের মতো ব্যাপার আছে। তা হলে সেটা হতেই পারে।’

সুপর্ণার যুক্তিটা খারাপ লাগল না। অনেক সময় দুটো মানুষকে অনেকটা একইরকম দেখতে হয়। পুরোটা একরকম নয়, খানিকটা। চোখটা বা চিবুকের কাছটা, অথবা তাকানোর কায়দা। হয়তো সেই কারণে অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। কফির মগ নিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এল সুপর্ণা। রাঁচিতে থাকার সময় এরকম একটা মজার ব্যাপার ছিল। নির্মলের অফিসের দু’জন পিয়নেরই ভুরু ছিল জোড়া। চট করে আলাদা করা যেত না। একজন কোনও দোষ করলেই বলত, ‘হাম নেহি, উসনে কিয়া।’ প্রথম প্রথম তো নির্মলরা মহা ঝামেলায় পড়ত। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে হত কোনটা কে। আচ্ছা, মহিলার গলার আওয়াজ শুনলে কিছু মনে পড়বে না? পড়তেও তো পারে।

সুপর্ণা অপারেটরকে বাড়ির লাইন ধরে দিতে বলল।

অনেকক্ষণ বেজে যাওয়ার পর শ্বশুরমশাই টেলিফোন তুললেন। ইদানীং এই একটা মুশকিল হয়েছে। শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে হলে বেশ জোরে বলতে হয়। অফিসে সবার মাঝখানে বসে জোরে কথা বলা যায় না। তবু সুপর্ণা যতটা সম্ভব চেঁচিয়ে বলল, ‘বাবা, সব ঠিক আছে তো?’

বৃদ্ধ রাগরাগ গলায় বললেন, ‘একেবারেই ঠিক নেই। কী লোক রেখেছ বউমা? চায়ে গাদাখানেক চিনি দিয়েছে। এখন আবার লুচি করতে রান্নাঘরে গেছে। আমি বলেছি, খবরদার, চারটের বেশি করবে না। বেশি কড়া ভাজার দরকার নেই। সঙ্গে কয়েকটা আলু ভেজে দাও। ভাজা আলুতে একটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ো।’

সুপর্ণা খুশি হল। বাতাসির মা শ্বশুরমশাইকে দেখছে। এটা অনেকখানি। টেলিফোন ছেড়ে সুপর্ণা ভাবল, এবার সত্যি সত্যি অফিসের কাজে মন দিতে হবে। চেনা-অচেনা নিয়ে পাগলামি করবার সময় নেই। যদি মনে পড়বার হয়, নিজে থেকেই পড়বে। না পড়লেও কোনও ক্ষতি হবে না। মহিলার কাজ ভাল এটাই আসল। চেনা না অচেনা সেটা আসল নয়। মন স্থির করে সুপর্ণা রিপোর্টের পাতা ওলটাল। রিপোর্টে অজস্র ফাঁক। কাজের হিসেবের সঙ্গে টাকার হিসেব মেলেনি বহু জায়গায়। রিপোর্টগুলো দেখার সময় এদিকে খুব খেয়াল রাখতে হয়। সামান্য চোখ এড়ালে অনেক টাকা এদিক-ওদিক হয়ে যাওয়ার ভয়। আরও একবার খুঁটিয়ে দেখে নোট লিখতে শুরু করল সুপর্ণা।

মনে পড়ল সন্ধেবেলা। বাড়ি ফেরার পথে। গাড়ি তখন বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে। ছবির মতো স্পষ্ট সব মনে পড়ে গেল সুপর্ণার। কত বছর আগের কথা? সাতাশ? আঠাশ? নাকি আরও বেশি? সুপর্ণার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক মনে পড়েছে তো? ভুলও তো হতে পারে। দেখতে হবে, এখনই দেখতে হবে। মনে-পড়া মুখটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

সে ড্রাইভারকে বলল, ‘একটু তাড়াতাড়ি চালাও মহেশ। বাড়িতে একটা জরুরি কাজ আছে।’

বাতাসির মা দরজা খুলে বলল, ‘বউদি এসে গেছেন? আসুন। চা বসাই?’

একদম সেই মেয়ে। সেই চাপা নাক, সেই পানপাতার মতো মুখ, সেই সামান্য ঘাড় কাত করে কথা বলা। শুধু বয়সটা বেড়ে গেছে।

শরীর কেঁপে উঠল। সোফার হাতল ধরে নিজেকে কোনওরকমে সামলাল সুপর্ণা।

রাতে চারটে রুটি খায় নির্মল। আজ আরও একটা নিল।

‘বাঃ, রুটি তত বেশ নরম বানাতে পারে। সবজিটাও খারাপ করেনি। শুধু একটু ঝাল কম দিতে বলবে। বুঝলে সুপর্ণা, আমি দেখেছি, গরিব মানুষের ঝালের হাতটা একটু বেশির দিকে হয়। ঝালটা ঠিক মাপমতো দিতে পারে না। অথবা কে জানে, আগে যে-বাড়িতে কাজ করেছে, তারা বোধহয় বেশি ঝাল খেত। সেখান থেকেই ঝাল বেশি দেওয়ার অভ্যেস।’

কথা বলতে বলতে নির্মল স্ত্রীর দিকে তাকাল। সুপর্ণা মুখ নামিয়ে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মুখে তুলছে না।

‘কী হল? খাচ্ছ না? আঃ সুপর্ণা, সব বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা ছাড়বে? অনেক বয়স হয়েছে, ডোন্ট বি সিলি। এখন আর ছেলেমানুষি মানায় না। কী দেখতে কী দেখেছ, তাই নিয়ে মাথা খারাপ করছ? তুমি শিয়োর?

সুপর্ণা মুখ নামিয়েই বলল, ‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত।’

‘কী নিশ্চিত? এই মহিলা তোমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত?’

‘হ্যাঁ, পড়ত। আমাদের ক্লাসেই পড়ত। ক্লাস সেভেন না এইট পর্যন্ত শান্তিকে দেখেছি আমি। তারপর আর মনে নেই। তা ছাড়া ক্লাস নাইনের গোড়াতেই তো বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল। আমরা, ভাইবোন কলকাতায় এসে বড় স্কুলে ভরতি হলাম।’

‘ভুল দেখেছ। কাকে দেখতে কাকে দেখেছ।’ নির্মল বিরক্ত হয়ে বলল, ‘দয়া করে এসব ভুল ভেবে এটিকে আবার তাড়িয়ো না। অনেক কষ্টে একজন জুটেছে। তাড়ালে নিজেই ঝামেলায় পড়ে যাবে।’

সুপর্ণা প্লেট সরিয়ে দিয়ে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘একটা কালোমতো মেয়ে পেছনের দিকে বসে থাকত। কথাটথা কম বলত। কারও সঙ্গেই বেশি ভাবটাব ছিল না। আমার সঙ্গেও নয়। বেশিরভাগ সময়ই জামা আয়রন করা থাকত না। পিটি ক্লাসে যে-কেডস্‌টা পরত সেটার বুড়ো আঙুলের কাছটা ছিল ছেঁড়া। আমার খুব ভাল করেই মনে পড়ছে, সেই মেয়েটার নাম ছিল শান্তি। রোল নম্বরটা ঠিক মনে পড়ছে না। আর একটু ভাবলে হয়তো সেটাও মনে পড়বে।’

নির্মল চাপা গলায় হিসহিস করে উঠল, ‘স্টপ ইট সুপর্ণা, প্লিজ স্টপ ইট। দয়া করে আর রোল নম্বর মনে করতে হবে না। অনেক হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ। এবার গল্পটা থামাও।’

সুপর্ণা ম্লান হেসে বলল, ‘গল্প নয়, সত্যি বলছি। আমাদের এই নতুন ঝি একসময় আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত। ওয়ান্স আপন আ টাইম শি ওয়াজ মাই ক্লাসমেট।’

নির্মল ঝুঁকে পড়ে স্ত্রীর কাঁধে বাঁ হাতটা রাখল। শান্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি বাতাসির মা তোমার স্কুলের সহপাঠী ছিল। কিন্তু তা হলে তো তারও তোমাকে মনে পড়বার কথা। তুমি যেমন তাকে চিনতে পেরেছ, সেও তোমাকে চিনেছে। তাই না? তার পরেও তোমাকে বউদি বউদি করছে?’

সুপর্ণা অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলতে চাইছ তুমি? ঠিক বুঝতে পারছি না।’

নির্মল হেসে বলল, ‘কিছুই বলতে চাইছি না ডার্লিং। শুধু বলতে চাইছি, এর থেকেই প্রমাণ হয়, তোমার ভুল হচ্ছে। লজিক তো তাই বলছে। বলছে না?’

‘হয়তো চিনেও বলছে না। লজ্জা পাচ্ছে। যার বাড়িতে বাসন মাজতে ঘর মুছতে এসেছে, তাকে কখনও বলা যায়, আমি আপনার সঙ্গে পড়তাম।’

‘ঠিক আছে, না হয় বলা যায় না, কিন্তু আচরণ? আচরণে তো কিছুটা আঁচ করতে। সেটা কি পেরেছ? পারোনি। পারোনি কারণ, হয় তুমি ভুল চিনেছ, নয় সে তোমাকে মনে করতে পারেনি। সুতরাং আপাতত বিষয়টা মুলতুবি রাখাই ভাল। কালকে বরং জিজ্ঞেস করে শিয়োর হওয়া যাবে।’

সুপর্ণা উঠে রেফ্রিজারেটর থেকে পুডিং বের করল। নির্মলকে প্লেটে দিতে দিতে বলল, ‘যাঃ! তা কখনও করা যায়?’

নির্মল হেসে বলল, ‘না, করা যায় না। আর দয়া করে করতে যেয়ো না। ভাববে পাগলের বাড়িতে এসে পড়েছি। ভেবে ভয় পেয়ে কাজ ছেড়ে পালাবে। তার থেকে বরং তুমি ছুটির দিনে স্পেশাল কয়েকটা রান্নার প্রিপারেশন শিখিয়ে দাও ওকে। এই ধরো মোচার চপ, পোস্তর বড়া। তারপর তোমার ওই ধনেপাতার আলুর দমটা। ইটস আ বিউটিফুল ডিশ। ও ভাল কথা সুপর্ণা, মিমির ঘরটা রোজ একটু পরিষ্কার করতে বোলো তো। সকালে দেখলাম, খাটের তলায় অনেক ধুলো হয়েছে। নাও পুডিং খাও। প্লিজ খাও।’

ইচ্ছে না করলেও খানিকটা পুডিং খেল সুপর্ণা। অনেকদিন পর রাতে ঘুমের ট্যাবলেট খেতে হল তাকে।

সকালে ঘুম ভাঙল টেলিফোনের আওয়াজে। পুনে থেকে মিমি ফোন করেছে। তার গলায় উদ্বেগ।

‘মা, এনিথিং রং উইথ ইউ?’

সুপর্ণা ঘুম-জড়ানো গলায় হেসে বলল, ‘নাথিং সোনা। নো প্রবলেম।’

‘উফ বাঁচালে। বাবা কাল রাতে ফোন করে যা ঘাবড়ে দিয়েছিল। তুমি ঘুমের ওষুধ খেয়েছ শুনে আর ফোন করিনি, নইলে তখনই তোমাকে ধরতাম।’

সুপর্ণা রেগে গেল। নির্মলের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। ছোট মেয়ে, পড়াশোনা করতে দূরে গেছে। তাকে এসব বলার কী মানে! অযথা চিন্তার মধ্যে ফেলা। নির্মলের এই একটা বড় দোষ। মেয়েকে সব বলা চাই। সুপর্ণা বলল, ‘তোমার বাবাকে তো জানোই মিমি, সব বিষয়ে বেশি চিন্তা করে। কিছু হয়নি।’

‘বাবা বলল, একজন নতুন কাজের মাসি নাকি জয়েন করেছে আমাদের বাড়িতে। অ্যান্ড দ্যাট লেডি ওয়াজ ইয়োর ক্লাসফ্রেন্ড। ইজ ইট কারেক্ট মা? সত্যি মা?’

এতটা যখন মেয়ে জেনে গেছে, বাকিটাও বলে দেওয়া ভাল। সমস্যাটা ওর কাছে পরিষ্কার হোক। সুপর্ণা বলল, ‘এখন পর্যন্ত বিষয়টা সত্যি, না মিথ্যে, বলার জায়গায় আসেনি মিমি। আমাকে আর-একটু জানতে হবে। প্রথমে সত্যিই মনে হয়েছিল। তবে কাল রাতে ডিনারের সময় তোমার বাবা একটা লজিক দেখিয়েছে| লজিকটা খুব খারাপ নয়। সেটাতে আমি খানিকটা কনভিনসড্‌ হয়ে পড়েছি। যাক, ওসব কথা, তুমি কেমন আছ? পড়াশোনা কেমন চলছে?’

‘ওমা, কেমন আছি তো পরশুদিনই বললাম! ভুলে গেলে নাকি? ঠিক আছে, আবার বলছি। তোমাদের ছেড়ে খুব খারাপ আছি। যাকে বলে ভেরি ব্যাড। আবার নতুন পড়াশোনা, আড্ড, হস্টেল লাইফ নিয়ে দারুণ আছি। একেবারে ভেরি গুড বলতে পারো। সব মিলিয়ে গুড-ব্যাড আছি। হি হি। তোমার মেলে একটা লিস্ট পাঠিয়েছি, আজই দেখে নেবে। জিনিসগুলো কিনে রাখবে। ওর মধ্যে সব থেকে ইমপর্টান্ট হল মাটির দুল আর হারটা। আমাদের ইনস্টিটিউটে এবার রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। আমি ঠিক করেছি ওতে মাটির অর্নামেন্টস পরে গান গাইব। এখানে সবার চোখ কপালে উঠে যাবে। মনে থাকে যেন মা, সেরকম বুঝলে শান্তিনিকেতন থেকে আনিয়ে রাখতে হবে কিন্তু।’

সুপর্ণা হেসে বলল, ‘আচ্ছা,আনিয়ে রাখব। তোমার কোর্স কীরকম এগোচ্ছে মিমি?’

মিমি হাসতে হাসতে বলল, ‘এগোচ্ছে কী, একেবারেই হইহই করে ছুটছে। কাল থেকে আমাদের সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং শুরু হয়ে গেল। ভেরি ইন্টারেস্টিং। বাই মা। আমার ক্লাসের টাইম হয়ে গেল। আশা করি, নেক্সট টাইমে বাড়ি গেলে তোমার ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হবে। হি হি।’

সুপর্ণা হেসে ফেলে বলল, ‘এবার কিন্তু চড় খাবে মিমি।’

ব্রাশ করতে করতে সুপর্ণার মনে হল, নির্মলের কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। যার সঙ্গে এতগুলো বছর স্কুলে পড়াশোনা করেছে, সে চিনতে পারবে না! ঘটনা সত্যি হলে একটা জড়তা থাকত না? সে নিজেই অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে। তার নামও হয়তো শান্তি ছিল। শান্তি এমন কিছু অভিনব নাম নয় যে, একজনেরই থাকতে হবে। মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর সুপর্ণার নিজেকে বেশ হালকা লাগল। মনে হচ্ছে, একটা বিচ্ছিরি চিন্তা সে ঘাড় থেকে নামাতে পেরেছে।

নির্মল আজও বেরিয়েছে ভোরে। সুপর্ণাকে ঘুম থেকে তোলেনি। নিজেই চা বানিয়ে নিয়েছে। কাল রাতেই বলে রেখেছিল, আজ সে তার বসকে নিয়ে যাবে আসানসোল। রাতে থাকবে। দুর্গাপুর ঘুরে ফিরতে ফিরতে সেই কাল বিকেল।

সুপর্ণা ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। শ্বশুরমশাইকে দিয়ে, কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে নিজেও খেয়ে নিল। ঠিক ছিল, বাতাসির মা আজ থেকেই শ্বশুরমশাইয়ের জন্য রান্না শুরু করবে। নির্মল কাল বাজার এনে রেখেছে। কিন্তু বাতাসির মা এখনও আসেনি। টুকটাক দু’-একটা ঘরের কাজ সেরে একসময় অফিসের জন্য তৈরি হতে উঠল সুপর্ণা। দ্বিতীয় দিনেই দেরি করবে কেন? তা হলে কি কাজ করবে না? নাকি চিনতে পেরে কাজ ছেড়ে দিল? যে-চিন্তা কিছুক্ষণ আগে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল সুপর্ণা, সেটাই যেন আবার ফিরে আসছে। মা’র ওখানে একবার ফোন করবে? হয়তো এতক্ষণে সেখানে গিয়ে বলে এসেছে। থাক, দরকার নেই, না এলেই ভাল। একে না রাখাই উচিত! হয়তো দেখলে আবার আজেবাজে সব মনে হবে। আজ না-হোক, কাল আর একজনকে পাওয়া যাবে। টাকা খরচ করলে সব পাওয়া যায়। কাজের লোকও পাওয়া যাবে। সুপর্ণা টেলিফোন তুলে হোম সার্ভিসের নম্বর টিপল। বলল, ‘নিন, আমার শ্বশুরমশাইয়ের লাঞ্চের অর্ডারটা লিখে নিন। কাল গাদার মাছ দিয়েছিলেন কেন? বুড়ো মানুষ, কাঁটা বাছতে অসুবিধে হয়েছে…।’

অফিসের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে সুপর্ণার মনে হল, বাতাসির মা না-আসায়, সে একই সঙ্গে খুশি এবং বিরক্ত। খুশি হওয়ার কারণ বুঝতে পারলেও, বিরক্তির কারণ সে বুঝতে পারছে না।

বেরোনোর মুখে বেল বাজল।

দরজা খুলতেই মুখ কাঁচুমাচু করে বাতাসির মা বলল, ‘দেরি হয়ে গেল বউদি। মেয়েটার খুব জ্বর। বমি করছিল।’

কাজের লোকের সাজগোজ খেয়াল করবার সময় বা ইচ্ছে দুটোর কোনওটাই সুপর্ণার নেই। তবু আজ সে খেয়াল করল। শান্তি পরেছে বেগুনি রঙের শাড়ি, তাতে লাল পাড়। ব্লাউজের রং বেগুনি বা লাল কোনওটাই নয়। হালকা সবুজ। এমনি সবুজ নয়, রংচটা সবুজ। কপালে একটা ছোট্ট টিপ। মনে হয় কালো। অন্য কোনও ঘন রংও হতে পারে। হাতে, গলায় কিছুই নেই। তবে কানে দুলের মতো একটা কী যেন রয়েছে। সে জিনিস এত ছোট যে, চোখে পড়ে না। চোখে রাত জাগার ক্লান্তি।

সুপর্ণার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল সে। তারপর দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘দেখো বাতাসির মা, কাজের লোকদের সঙ্গে ঝগড়া করবার মতো রুচি বা সময় আমার নেই। গোড়াতেই একটা জিনিস ঠিক করে দেওয়া ভাল। মাইনে যেমন চাইবে, তেমনই পাবে। আমি কোনও দরাদরিতে যাব না। কিন্তু মেয়ের জ্বর ছেলের পা মচকে যাওয়ার কথা আমাকে শোনাবে না। কাজে ঠিক সময় আসতে হবে, ঠিকমতো কাজ করতে হবে। সেটা যদি পারো করবে, না পারলে আমার এখানে কাজ না করাই ভাল। দ্বিতীয় দিনেই কড়া কথা বলতে হল বলে খারাপ লাগছে। আমার কিছু করার নেই। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তুমি সন্ধে পর্যন্ত ভাবো। অফিস থেকে ফিরে এলে আমাকে জানাবে। যদি তার আগে চলে যেতে চাও, তাও যেতে পারো। যাওয়ার আগে শ্বশুরমশাইকে বলে দেবে উনি যেন দরজাটা আটকে দেন। চিন্তা কোরো না, আমি তোমার দু’দিনের মাইনে হিসেব করে সন্তোষপুরে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব।’

অফিসে পৌঁছোনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সুপর্ণা দুর্দান্ত খবরটা পেল। জোনাল ডিরেক্টর নিজে ডেকে তাকে খবরটা দিলেন। তার প্রমোশন হয়েছে। আজ থেকেই আলাদা ঘর। অফিসের গাড়ি। মাসে একবার করে প্লেনে চেপে মুম্বই যেতে হবে হেড অফিসে মিটিং করতে।

সুপর্ণা দারুণ খুশি হল। এত খুশি যে, নির্মলের মোবাইল নম্বরটাই ভুল টিপে বসল। ওপাশ থেকে গম্ভীর গলায় কে যেন বলল, ‘কৌন হ্যায় জি? কিসকো চাইয়ে জি?’ বলার ধরন শুনে সুপর্ণা হেসে ফেলল।

নির্মলকে ধরার পরও সুপর্ণার সেই হাসি থামেনি। নির্মল বলল, ‘অ্যাই হাসছ কেন? আঃ, বসের পাশে বসে আছি। হাসি থামিয়ে তাড়াতাড়ি বলো। এনি প্রবলেম?’

‘নো প্রবলেম। একটা গুড নিউজ আছে জি। ভেরি গুড নিউজ জি।’

প্রমোশনের কথা শুনে নির্মল বলল, ‘ইস, এখুনি কলকাতায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। কাল বিকেলের আগে কিছুতেই ফিরতে পারছি না। মেনি মেনি কনগ্রাচুলেশন সুপর্ণা। আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ।’

নির্মলের পর সুখবরটা মাকে জানাল সুপর্ণা। মলিনাদেবীর এই একটা গোলমাল। ছেলেমেয়েদের একটা কিছু ভাল হলেই হল। অমনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলবেন। আজও ফেললেন। বললেন, ‘সুপু, আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতেন…।’

মিমিকে এখন ধরা যাবে না। সে এখন ক্লাসে। মোবাইল বন্ধ করা আছে। সুপর্ণা মেয়েকে এস এম এস পাঠাল—‘ছোট্ট মিমির মা এখন মস্ত অফিসার।’ মিমি মোবাইল খুললেই মেসেজ পেয়ে যাবে। পেয়ে নিশ্চয় লাফিয়ে উঠবে।

লাঞ্চের পর নিজের ঘরে এসে বসেছে সুপর্ণা। ঘর সুন্দর। জানলায় বড় বড় পরদা। এসি মেশিনের চাপা আওয়াজ। শুধু নতুন চেয়ারে একটু অসুবিধে হচ্ছে। ক’দিনে ঠিক হয়ে যাবে। অফিসের প্রায় সকলেই এসে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে। মিসেস সান্যাল বললেন, ‘যাক, আজ থেকে আর সুপর্ণা বলা যাবে না। ম্যাডাম বলতে হবে!’ সুপর্ণা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘যাঃ কী যে বলেন।’ তপতী বলল, ‘ওসব জানি না, বাইরে ডিনার খাওয়াতে হবে।’ অজন্তা ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলল, ‘বয়ে গেছে বাইরে খেতে। সুপর্ণাদি, বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে হবে কিন্তু। কর্তা আর ছেলেকে নিয়ে যাব। তুমি এখন বস। বসের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়ার মজাই আলাদা।’

এতক্ষণ বাড়ির কথা মাথা থেকে উবে গিয়েছিল। মনে পড়ল অজন্তার কথা শোনার পর। বাতাসির মা আছে, না চলে গেছে? নিশ্চয় চলে গেছে। চেনা-অচেনা যা-ই হোক ওরকম কথার পর থাকাটা খুবই অপমানের। বাড়িতে একটা ফোন করে দেখলে কেমন হয়? এখন তো নিজের ঘর। জোরে কথা বললে কোনও অসুবিধে নেই। ঘর ফাঁকা হোক।

ঘর ফাঁকা হতে বিকেল গড়িয়ে গেল। এখন নিজের টেবিলে দুটো ফোন। তবু পুরনো অভ্যেসে সুপর্ণা অপারেটরের কাছে বাড়ির লাইন চাইল।

‘সব ঠিক আছে তো বাবা?’

বৃদ্ধ চাপা গলায় বললেন, ‘না, সব ঠিক নেই। তোমার এই কাজের লোক অতসী না বাতাসি, তার কিন্তু গোলমাল আছে বউমা।’

সুপর্ণা চিন্তিত হয়ে বলল, ‘কেন, কী হল? গোলমাল কীসের? সে এখনও আছে?’

‘আছে মানে? খুব ভাল করেই আছে। একটু আগে দেখলাম, রান্নাঘর থেকে কী যেন এনে নিজের ব্যাগটায় পুরছে। লক্ষ করে দেখি, একটা বেগুন আর ক’টা আলু রয়েছে হাতে।’

সুপর্ণা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর থমথমে গলায় বলল, ‘আপনাকে চা করে দিয়েছে?’

‘দিয়েছে। চা দিয়েছে, চায়ের সঙ্গে সুজি দিয়েছে। আজও চায়ে চিনি বেশি। তবে সুজি ভাল হয়েছে। কিশমিশ ছিল। কাল বলেছে মোচার চপ করে খাওয়াবে। আমি বলেছি, কোরো, তবে ওতে কিশমিশ দিয়ো না।’

ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর, চুপ করে বসে রইল সুপর্ণা। এরকম একটা আনন্দের দিনে হঠাৎ করেই মনটা যেন খারাপ হয়ে গেল। কাজের লোক একটু-আধটু চুরি করবে। এতে মন খারাপ করার কিছু নেই। তবু হল৷ কেন হল? সে কি ভেবেছিল, বাড়িতে ফোন করে শুনবে, অপমানিত বাতাসির মা কাজ ছেড়ে চলে গেছে? তা হলে খুশি হত সে? কেন খুশি হত?

সুপর্ণার মন খারাপ বাড়তেই লাগল।

মন খারাপের মধ্যেই সুপর্ণা কম্পিউটার চালু করে মিমির মেল খুলল। এ ঘরের কম্পিউটারটা দেখতে আরও সুন্দর। মেশিন, কী বোর্ড, মাউস, এমনকী মাউস প্যাডটাও কালো। একেবারে জেড ব্ল্যাক। কালো রং এত সুন্দর হয়।

মিমির তালিকা লম্বা। হাবিজাবি অনেক জিনিসের কথা লিখেছে। শেষে পাঁচটা বইয়ের নাম। পাশে স্টার দেওয়া। খুব জরুরি হলে মিমি পাশে স্টার দেয়। এর মধ্যে প্রথম চারটে সফটওয়্যার বিষয়ক বই, শেষেরটা গীতবিতান। একটা নিয়ে গেছে, আবার একটা চায়। নিশ্চয় কাউকে দেবে। পাগল মেয়ে।

বাড়ি ফেরার সময় একটা ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সুপর্ণা।

অফিস থেকে ফিরে গা না-ধুয়ে সুপর্ণা কিছু করতে পারে না। আজও ধুল। তারপর ড্রইংরুমে বসে শান্তভাবে সুজি খেল। চা খেল। মুখ তুলে বলল, ‘বাঃ, বেশ হয়েছে তো। এত সুন্দর সুজি করতে তুমি কোথা থেকে শিখলে বাতাসির মা? আগে যে-বাড়িতে কাজ করতে সেখান থেকে?’

বাতাসির মা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নামিয়ে। প্রশংসা শুনে সে বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। নিচু গলায় বলল, ‘বউদি, আমি জানি। সুজি জানি, গাজরের হালুয়াও জানি। বলেন তো একদিন করতে পারি।’

সুপর্ণা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে ভুরু তুলে বলল, ‘বাঃ গাজরের হালুয়াও জানো! তোমার দাদাবাবু গাজরের হালুয়া খেতে খুব ভালবাসে। আমি বাবা অতসব পারি না। তা ছাড়া, সময় কোথায়? দেখছই তো, অফিসের কাজেই পাগল পাগল অবস্থা। যাক বাতাসির মা, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাকে আর এখানে কাজ করতে হবে না। আমি তোমাকে রাখছি না। কাল থেকে আর আসতে হবে না। এখনও তোমার মাইনে ঠিক হয়নি। তবু আমি এই একশো টাকাটা দিচ্ছি। জানি দু’দিনের কাজের পক্ষে এই টাকা বেশি। তাও রাখো।’

মহিলা মুখ তুলে তাকাল। তার চোখে কি বিস্ময়? নাকি রাগ? সুপর্ণার খুব ইচ্ছে করছে তাকিয়ে দেখে। পারল না। মুখ নামিয়ে নিল। টেবিল থেকে একটা পত্রিকা তুলে ‘কিছু ঘটেনি’ ভঙ্গিতে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলল, ‘যাও, আর রাত কোরো না। অসুস্থ মেয়ে বাড়িতে আছে। যাওয়ার আগে এই কাপ-প্লেটগুলো ধুয়ে দিয়ে যেয়ো। আর ও হ্যাঁ, শোনো বাতাসির মা, রান্নাঘর থেকে তুমি নাকি বেগুন আর আলুটালু কী সব নিয়েছ? জানি না সত্যি নিয়েছ কি না, যদি সত্যি নিয়ে থাকো, তা হলে ওগুলো রেখে দিয়ে যেয়ো। তোমার দাদাবাবু আবার রাতে বেগুনভাজা ছাড়া রুটি খেতে পারে না। কী ছেলেমানুষের মতো স্বভাব বলো তো!’

রাতে মিমি তার ‘মস্ত অফিসার’ মাকে ফোন করে অবাক হয়ে গেল।

‘মা, তুমি কি কাঁদছ?’

সুপর্ণা ইচ্ছে করলে মিথ্যে বলতে পারত। সে তা করল না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘হ্যাঁ রে সোনা, আমি কাঁদছি।’

মায়ের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বাড়ি খুঁজে বের করতে অসুবিধে হল। বাইপাস থেকে অনেক ভেতরে। এসব জায়গায় ঠিকানা থাকা না-থাকা সমান। তা ছাড়া, গাড়ি রাখতে হয়েছে দূরে৷ ড্রাইভার বলল, এই সরু পথে গাড়ি ঢুকবে না। তার ওপর আবার কাদা। এই সন্ধেবেলা চাকা ফেঁসে গেলে কেলেঙ্কারি। মহেশ হলেও একটা কথা ছিল, অফিসের গাড়ি, চট করে কিছু বলা যায় না। সুপর্ণা নেমে পড়ল।

কিছুটা হেঁটে, একে ওকে জিজ্ঞেস করে একটা টিনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সুপর্ণা। বিচ্ছিরি অন্ধকার। এখানে কি আলো আসেনি?নাকি লোডশেডিং? একটা টর্চ আনলে ঠিক হত।

সুপর্ণা দু’বার দরজায় টোকা দিল, তারপর ফিসফিস করে ডাকল, ‘শান্তি, শান্তি।’

দরজা খুলল বাতাসির মা। তার হাতে একটা হ্যারিকেন। চিমনিতে কালি পড়ে আলোটা কেমন ছায়া ছায়া। সেই আলো-ছায়া পড়েছে বাতাসির মায়ের মুখে। বেশ লাগছে। ছবির মতো। সামান্য হেসে সে বলল, ‘আয়, সুপর্ণা, ভেতরে আয়। মেয়েটার আজও খুব জ্বর।’

দেশ ১৭ মে, ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *