মোবাইল
এক
তন্দ্রা মোবাইলটা এবার ডান কান থেকে বাঁ কানে নিল। জিনিসটা এতক্ষণ ডান হাতে ধরা ছিল, এবার ধরল হাঁ হাতে। কান ও হাত বদল এই নিয়ে হল মোট সতেরো বার। তাও কথা ফুরোয়নি। চট করে ফুরোবে বলে মনেও হচ্ছে না। গভীর রাতে প্রেমিক-প্রেমিকার ভাব-ভালবাসার কথাও একসময় ফুরিয়ে যায়। ঝগড়া বোধহয় ফুরোয় না।
তন্দ্রা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। রাগের নিশ্বাস। বলল, ‘সুপর্ণ’ তুমি কচি খোকা নও যে কথাটা বুঝতে পারবে না। আসলে ইচ্ছে করেই বুঝছ না। তোমার সঙ্গে প্রেম করাটাই আমার ভুল হয়েছিল। খুব বড় ভুল।’
সুপর্ণ বলল, ‘শুধু আমি কেন, তুমিও তো বুঝতে পারছ না তন্দ্রা। সে অর্থে ভুল শুধু তোমার হয়নি, আমারও হয়েছে। যাক ভুলে ভুলে কাটাকাটি হয়ে গেল। শোনো, তুমি অমন ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলো না তো। কানে লাগে।’
তন্দ্রা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘কানে লাগলে, তুলো দিয়ে নাও। ফোন ছাড়ছি। ইস, রাত দেড়টা বাজে।’
সুপর্ণ ও ধার থেকে ‘ফুঃ’ ধরনের একটা আওয়াজ করল। বলল, ‘দেড়টা বাজল তো কী হল? আমেরিকায় রাত দেড়টা মানে কী জানো? রাত দেড়টা মানে হল বিকেল। প্রেম করতে যাবে বলে ছেলেমেয়েরা তখন সাজতে বসে। বুঝলে?’
তন্দ্রা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এটা আমেরিকা নয় সুপর্ণ। যাদবপুর বাইপাসের ধার। এখানে রাত দেড়টার সময় শেয়াল বেরোতে পারে।’
সুপর্ণ গলা নরম করে বলল, ‘আহা, শেয়াল তো তোমার ঘরে ঢুকে পড়ছে না। ঠিক আছে আর পাঁচ মিনিট। ওনলি ফাইভ। প্লিজ, তন্দ্রা এসো আজই আমরা একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলি। এই সুযোগ আর পাব না। ঠাকুমার কাছে শুনেছি, রাত বারোটার পর যে-কোনও সিদ্ধান্ত খুব মঙ্গলজনক।’
তন্দ্রার ইচ্ছে করল চিৎকার করে। অনেক কষ্টে রাগ সামলাল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ঠাকুমা, দিদিমা লাগবে না। সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি সুপর্ণ। আমি এখন বিয়ে করছি না। আগে তুমি কাজকর্ম পাও। বিয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না।’
‘উফ তুমি সেই একই ভুল করছ। আজকাল ওই কনসেপ্টটাই উঠে গেছে। ছেলেকে চাকরি-বাকরি করতে হবে এমনটা আর নেই। এক জন করলেই চলে। পাত্র অর পাত্রী। এনিবডি। তিন মাস হয়ে গেল তুমি স্কুলে জয়েন করে গেছ। তা হলে বিয়েতে অসুবিধে কোথায়? অ্যাই তন্দ্রা, শুনছ? অ্যাই শোনো না, হানিমুনের জন্য একটা জায়গা যা ভেবেছি না, উঁহুঁ এখন বলব না। সারপ্রাইজ দেব। ঠিক করেছি, চোখ বেঁধে তোমাকে নিয়ে যাব। তারপর পৌঁছে যখন দেখবে… অ্যাই শুনছ, চুপ করে আছ কেন? কী হল?’
তন্দ্রা মোবাইল বন্ধ করে দিয়েছে। তার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। উফ, কী ভয়ংকর! চাকরি নেই, বিয়ে নেই, এদিকে হানিমুনের প্ল্যান হয়ে গেছে। এরপর নিশ্চয় ছেলেমেয়ের পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে আলোচনা শুরু করত। না, কাল ভোরে এ ছেলেকে আরও জোর ধমক দিতে হবে। এ ছেলে জোর ধমকের ছেলে।
পাঁচ তলার ওপরে এই ফ্ল্যাটটা ছোট কিন্তু চমৎকার। তার ওপরে তন্দ্রার ঘরটা দক্ষিণমুখী। টেবিলটাকে সে রেখেছে একেবারে জানলা ঘেঁষে। সেখানে ঘন নীল রঙের টেবিল ক্লথ। নীল পেপারওয়েট। এমনকী পেনস্ট্যান্ডটা পর্যন্ত নীল। জোরে হাওয়া দিলে মনে হয়, ঘরের বদলে টেবিল চেয়ার পেতে আকাশে বসে আছে। টেবিলের ওপর মোবাইলটা রেখে তন্দ্রা চেয়ারে বসল। সামনে এক গাদা খাতা। কাল দুপুরে স্কুলে যাওয়ার আগে এগুলো দেখতে হবে। উপায় নেই। বড়দি খ্যাচখ্যাচ করবে। অন্য টিচাররা যদিও পাত্তা দেয় না, বকাঝকার মাঝখানেই তারা জিরে-হলুদ বাটা আর ছেলের প্রাইভেট টিউটর নিয়ে সিরিয়াস ধরনের আলোচনা শুরু করে দেয়। মাত্র তিন মাস চাকরিতে ঢুকে তন্দ্রার পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
সে খাতাগুলো সামনে টেনে নিল এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমোনোর আগে মোবাইল ফোনে আঙুল ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘পাগল ছেলে… পাগল ছেলে কোথাকার।’
রাতে কখন চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় গেছে মনে নেই তন্দ্রার। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকালের আলোয় ঘর ভাসছে। সকালে ঘুম ভাঙলে প্রিয় কারও মুখ মনে পড়ে। তন্দ্রার মনে পড়ল বড়দির গম্ভীর মুখ। ইস, খাতা দেখা বাকি। টেবিলের দিকে তাকাল তন্দ্রা। সব অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। ছড়ানো খাতা। খোলা পেন। সব। শুধু মোবাইলটা নেই!
তন্দ্রা ছুটে গিয়ে ঘরের দরজা খুলল। মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ‘মা, মা, আমার মোবাইল কোথায়? মোবাইল ফোন!’
কমলাদেবী রান্নাঘর থেকে বললেন, ‘আঃ সকালে উঠেই মোবাইল মোবাইল করিস না তো৷ এই সাতসকালে তোর বন্ধ ঘর থেকে মোবাইল কে নেবে? ভূতে? দেখ হয়তো ভূতেই নিয়েছে।’
২
আঠাশ তলার কার্নিশে পা ঝুলিয়ে বসে আছে কানন। মা বলে, ‘অমন ফটফটে আলোয় বাইরে থাকিসনি। কে দেখে ফেলবে।’
মায়ের বড্ড ভয়। বসলে কে দেখবে? বাইপাসের পাশে আকাশ ছোঁয়া এই বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। এখনও মানুষের ঝামেলা শুরু হয়নি। মিস্ত্রি-মজুর এসে গেলে দেয়াল, সিলিং বা মেঝেতে ছায়ার মতো মিশে থাকলেই চলে।
অন্য দিন হলে এই সময়টায় কানন জোরে জোরে পা দোলাত। আজ একবারে চুপ। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে নিজের কঙ্কাল হাতের দিকে। সেই হাতে ধরা রয়েছে ছোট্ট একটা মোবাইল ফোন! মানুষের মোবাইল ফোন।
এই জিনিস কানন আজ প্রথম দেখছে এমন না। আগেও আড়াল-আবডাল থেকে দেখেছে। লোভ হত। বড় অদ্ভুত জিনিসটা! মাথার কাছের ছোট্ট কাচটুক যেন এক চিলতে জানলা! বাজনা বেজে, যন্ত্র চালু হলে সেই জানলায় চাপা আলো জ্বলে ওঠে। মনে হয়, জানলা খুলে কেউ ডাকছে, আয় আয়…! কানন দেখেছে, মানুষ তখন কান পেতে কথা শোনে। ফিসফিস করে কথা কয়। কাননের হিংসেও হয়েছে। আহা, মানুষের জীবন কী আনন্দের! সেই আনন্দের জীবন আর পাওয়া যাবে না, কিন্তু মজার জিনিসটা যদি একবারটির জন্য পাওয়া যেত।
পাওয়া গেছে।
প্রতিদিনের মতো কালও অনেক রাতে আকাশ পথে চক্কর মারতে বেরিয়েছিল কানন। মানুষের মর্নিং ওয়াকের মতো ভূতেদের নাইট চক্কর। তখনই চোখে পড়ে। একেবারে জানলার পাশে। নিজেকে সামলাতে পারেনি। জানলা দিয়ে সে তার লম্বা হাত বাড়িয়ে দেয়।
এখন মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হয়নি। যতই তোক চুরি তো। মা জানতে পারলে রাগারাগি করবে। তবে এখনই ফেরত দিয়ে আসা যায়। জায়গা মনে আছে। ফ্ল্যাটটা পাঁচ তলায়। টেবিলে নীল কাপড় পাতা। ভেসে যেতে কতক্ষণ আর লাগবে?
রিং রিং রিং…। মোবাইল বেজে উঠল।
কানন চমকে উঠে আঁকড়ে ধরল জিনিসটা। শুধু বাজছে না, থিরথির করে কাঁপছেও! কী করবে সে? ছুড়ে ফেলে দেবে? ওই তো ছোট্ট জানলায় আলো জ্বলছে! কী মিষ্টি বাজনা! কে ফোন করছে? শুনবে? ওরে বাবা, কথা বলতে হবে নাকি? একটু বললে কী ক্ষতি? কীভাবে বলবে? পারবে কি? মানুষের সঙ্গে সে যে অনেক দিন কথা বলেনি।
এলোমেলো বোতাম হাতড়াতে যন্ত্র চালু হল নিজের খেয়ালে। কাঁপা হাতে তুলে কানে ঠেকাল কানন।
‘কেমন আছ তন্দ্রা? নিশ্চয় স্কুলের খাতা নিয়ে বসে পড়েছ। এই চমৎকার সকালে কাউকে যেন গোল্লা দিয়ে বোসো না। সব দশে দশ করে দাও। কী হল কথা বলছ না কেন? যাঃ বাবা, এখনও রাগ কমেনি। তুমি দেখছি বিয়ের পর জ্বালাবে।’
কানন পারছে না। কথা গলা পর্যন্ত এসে যেন আটকে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ফিসফিস করে বলল, ‘না, মানে আমি…।’
‘ওরে বাবা, রাগের চোটে গলাটাও বদলে ফেলেছ! হা হা। নাকে কথা কিন্তু সুন্দর লাগছে তন্দ্রা। বিউটিফুল! বেশ পেতনি পেতনি লাগছে। আচ্ছা, একবার বলো তো আমি তোমাকে ভালবাসি। দেখি পেতনি গলায় কেমন শোনায়। হা হা।’
হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কাননের। মানুষটা এসব কী বলছে! কানন ঢোঁক গিলে বলল, ‘দেখুন, আপনি…।’
‘ওরে বাবা, একেবারে আপনিতে চলে গেছ! ভেরি গুড। বাপ রে, বিয়ে করতে চেয়েছি বলে এত রাগ! প্লিজ তন্দ্রা, রসিকতা ছাড়া, বিশ্বাস করো, আমি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছি। রাতে ঘুমোতে পারি না। দিনে খালি ঘুম ঘুম পায়। চূড়ান্ত ডিসঅর্ডার। সকলে বলছে, এ সবের একটাই ওষুধ। বিবাহ। এই দেখো মোবাইলের ভেতর দিয়েই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। বিয়ের মুখে একটু-আধটু গা ছুঁলে কোনও ক্ষতি নেই তন্দ্রা।’
এই মানুষটা সত্যি সত্যি গায়ে হাত দেবে নাকি! দূর, এরকম হয় না। কাননের শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। সে বুঝতে পারছে জিনিসটা এবার ছুড়ে ফেলে দেওয়া উচিত। কিন্তু পারছে না! কত দিন যে কোনও পুরুষ তাকে ছোঁয়নি৷ কত দিন তা মনেও পড়ে না। সে নিজের মনে বলল, ‘আমি, আমি…।’
‘তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না, তন্দ্রা। বিয়ের ব্যাপারে যা করবার, সব আমি করব। লক্ষ্মীটি, তুমি শুধু একবার রাজি হয়ে যাও। আর, দয়া করে গলাটা স্বাভাবিক করো। দিনের বেলা ভূতের গলা শুনতে ভয় করছে। নাও, ফোন ছাড়ার আগে একটা চুমু দাও দেখি। আচ্ছা, আমি দিচ্ছি…।’
কাননের কান গরম হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, তার শরীর দিয়ে তাপ বেরুচ্ছে। তার লজ্জা করছে। ভীষণ লজ্জা। কানন নিজের অজান্তেই হাত তুলে ঠোঁটে চাপা দিল।
৩
স্কুল থেকে হাফছুটি করে বাড়ি চলে এসেছে তন্দ্রা। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। কাল রাতে ঘুম হয়নি। মনও খারাপ। ফিরেই খোঁজ নিয়েছে। না, মোবাইল এখনও পাওয়া যায়নি। এত রাগ হচ্ছে, যে মনে হচ্ছে, মা ঠিকই বলেছে। ভূতেই নিয়ে গেছে। তা ছাড়া আর যাবে কোথায়? তন্দ্রা ভেবেছিল, বাড়ি ফিরে লম্বা ঘুম দেবে। এখন আর ঘুম আসছে না। শাড়ি বদলে বসবার ঘরে এল। সুপর্ণকে মোবাইল হারানোর ঘটনাটা জানানো দরকার। বেচারি নিশ্চয় অনেক বার ফোন করে বসে আছে। সে টেবিলে রাখা ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করল।
বেকার হওয়ার সুযোগে সুপর্ণ দুপুরে একটা ছোট্ট ঘুম দেয়। ফোন ধরে বিস্মিত গলায় বলল, ‘তন্দ্রা! তুমি? কী হল, স্কুলে যাওনি?’
‘গিয়েছিলাম। তবে শরীরটা ভাল লাগছে না বলে বাড়ি ফিরে এসেছি।’
সুপর্ণর গলায় উদ্বেগ, ‘শরীর খারাপ! সে কী! কী হয়েছে? দাঁড়াও আমি এখনই একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আসছি।’
মনের এই অবস্থার মধ্যেও তুন্দ্রার হাসি পেল। বলল, ‘ট্যাক্সি ধরে আসতে পারো, তবে পকেটে টাকা আছে তো? ভাড়া কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে।’
সুপর্ণ নাটকীয় ঢঙে বলল, ‘সামান্য ট্যাক্সি ভাড়ার ভয় দেখাচ্ছ তন্দ্রা? দরকার হলে একটা গোটা ট্যাক্সি কিনে চলে যেতে পারি। তুমি শুধু একবার হ্যাঁ বলো।’
‘দুঃখিত, আমি হ্যাঁ বলছি না। যাক, এখন এসব কথা ছাড়ো তো। অ্যাই জানো, আজ একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে।’
‘বিচ্ছিরি কাণ্ড যে হয়েছে সে সকালে তোমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেই বুঝতে পেরেছি। ভাল কাণ্ড হলে কারও গলা অমন ভূতের মতো হয় না। মনে হচ্ছিল, ঠিক যেন একটা পেতনির সঙ্গে কথা বলছি! শুধু পেতনিগলা? রাগের চোটে আপনি আজ্ঞেও করছিলে। যাক, শেষ পর্যন্ত গলা যে তোমার ঠিক হয়েছে তার জন্য ধন্যবাদ। সব ধরনের বউ মেনে নেওয়া যায় তন্দ্রা, কিন্তু পেতনিগলার বউ মেনে নেওয়া অসম্ভব। নাও, এখন তোমার বিচ্ছিরি ঘটনা বলো। দাঁড়াও আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই।’
তন্দ্রা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। সে সুপর্ণর কথা ঠিক বুঝতে পারেনি। সকালে মোবাইলে কথা হয়েছে মানে! ছেলেটা নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘মন মেজাজ ভাল নেই সুপর্ণ। এখন ঠাট্টা ভাল লাগছে না। আজ সকাল থেকে আমি মোবাইলটা হারিয়ে বসে আছি। তাই তো বাড়ির ল্যান্ডফোনে তোমাকে এখন ধরলাম। তুমি বলছ সকালে মোবাইলে কথা বলেছি! সকালে তোমার সঙ্গে কথার প্রশ্নই ওঠে না।’
ও পাশে সুপর্ণ যেন লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘আলবাত হয়েছে। একশো বার হয়েছে। তখন ন’টা বেজে দশ মিনিট। আমরা দু’জনে ঠিক সাত মিনিট তেরো সেকেন্ড কথা বলেছি। শুধু কথা বলিনি, কথা শেষ হয়ে গেলে আমি তোমাকে চুমু খেয়েছি। একটা নয়, পরপর দুটো চুমু খেয়েছি। প্রেমিকাকে সব নিয়ে মিথ্যে বলা যায় তন্দ্রা, চুমু নিয়ে বলা যায় না। আর একটা কথা বলব তন্দ্রা? যদি রাগ না করে তা হলে বলতে পারি। বলো, রাগ করবে না। বলো আগে। অন্য দিন নরম লাগে, আজ কিন্তু চুমু দেওয়ার সময় কেমন শক্ত শক্ত লাগল। মনে হল, ঠোঁটে নয়, হাড়ে চুমু খাচ্ছি। হা হা। সত্যি বলছি। হা হা। অ্যাই রাগ করলে? অ্যাই তন্দ্রা, রাগ কোরো না প্লিজ। বিয়ের মুখে একটু-আধটু অসভ্য কথা চলে।’
তন্দ্রা রিসিভার ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হিমশীতল গলায় বলল, সুপর্ণ, মোবাইল কোম্পানিকে বলে আমার লাইনটা কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা করো প্লিজ। আজই। এখনই।’
৪
মা বকে। বলে, ‘অত সাজিসনি রে ছুঁড়ি। অত সাজিসনি। ওসবে আমাদের অমঙ্গল হয়। রং ঢং হল মানুষের জিনিস আমাদের কি মানায়?’
কানন শোনে না। সে সাজতে বসে। কঙ্কাল হাতে চুড়ি পরে। করোটি কপালে টিপ লাগায়। পাতাহীন কোটর চোখের চার পাশে হালকা কাজল টানে। তারপর মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে আকাশ ছোঁয়া বাড়ির অনেক ওপরে গিয়ে বসে। অপেক্ষা করে, যদি আবার কখনও গান বেজে ওঠে। যদি ফের মোবাইলের এক চিলতে জানলায় জ্বলে ওঠে আলো। হয় না। কিছুই হয় না। কানন কাঁদতে ভুলে গেছে। সে শুধু মোবাইলটা গালে বোলায়। ঠোঁটে ঠেকায়।
সুপর্ণ এখনই চাকরি পাক না পাক, তন্দ্রা ঠিক করেছে বিয়েটা করে ফেলবে। আজকাল রাতে একা থাকতে তার কেমন ভয় ভয় করে।
আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয় ৩০ অক্টোবর ২০১৫