ধর্ষিতা

ধর্ষিতা

ঠান্ডা একটা শিরশিরানি পিঠ থেকে পা পর্যন্ত নেমে গেল বিদিশার। নিচু গলায় বলল, ‘মানে! কী বলছ তুমি!’

মোবাইলের ওপ্রান্তে ক্রুদ্ধ অনিকেত দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘মানে আবার কী, রেপ্‌ড মানে জানোও না? ধর্ষিতা। সি ওয়াজ রেপ্‌ড । একজনও করতে পারে, মে বি মোর দেন ওয়ান।’

মুহূর্তখানেক থমকে বিদিশা বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। না, পারে না। ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আস্তে বলো। আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? আমার কী দোষ?’

চাপা গলায় হিসহিসিয়ে ওঠে অনিকেত। বলে, ‘না, তোমার দোষ নয়। দোষ আমার। লোক তো তুমি রাখোনি, আমি রেখেছি।’

মাথার ভেতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল বিদিশা।

‘আমরা দু’জনেই রেখেছি অনিকেত। দু’জনেরই দরকার ছিল।’

বিদিশার শান্ত গলা শুনে অনিকেত আরও রেগে গেল। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘আমার দরকার ছিল না, দরকার ছিল তোমার। তুমি ভয় পাচ্ছিলে। পাছে চাকরি ছাড়তে হয় সেই ভয়। এই তো দু’পয়সার চাকরি। প্রাইভেট কোম্পানিতে পেটি ক্লার্ক।’

বিদিশা আবার নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। মোবাইলে প্রায় মুখ ঠেকিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে কী অনিকেত? তোমার ওখানে সবাই শুনতে পাচ্ছে। তুমি কি ঝগড়া করতে চাইছ? খবরটা কে বলল?’

অনিকেত নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করল। গলা নামিয়ে বলল ‘শিবু’।

‘শিবু কে?’

‘আমাদের ওয়ার্কশপের স্টোরকিপার। বলেছিলাম না, শিবুকে দিয়ে খোঁজ নেব? মনে পড়ছে? মেয়েটার গ্রামেই শিবুর শ্বশুরবাড়ি। ক’দিন আগে বলেছিলাম। আজ বলল।’

‘কী বলল?’

‘বললাম তো কী বলল। এত এখন বলতে পারব না। ও সব জেনেছে। নামধাম ঘটনা সব। পাটখেত না ধানখেতে পড়ে ছিল। ফুল অব ব্লাড। বাকিটুকু ফিরে বলব। এইজন্যই বলেছিলাম, লোকটোক রাখার আগে ভেবেচিন্তে রেখো। এখন কী হবে বুঝতে পারছ?’

অনিকেতের গলা নার্ভাস।

মুঠোয় ধরা ফোনটাকে কানে চেপে ধরে চারপাশে দ্রুত তাকিয়ে নিল বিদিশা। অন্যদের নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা পাশের টেবিলের মঞ্জুদিকে নিয়ে। অন্যের টেলিফোনে আড়িপাতায় এই মহিলা নিজেকে একটা চূড়ান্ত দক্ষতায় নিয়ে গেছে। শুধু অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে নয়, গোটা অফিসেই এ ব্যাপারে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মহিলা কীভাবে যে এমন ছেলেমানুষি করে! ফোনে কথা বলার সময় মহিলা কাছাকাছি থাকলে সবাই সাবধান হয়ে যায়। বিদিশাও সাবধান হল।

ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তো দেখেশুনেই রেখেছি। কাশীপুরের রান্নার মাসি তো এর আগেও লোক দিয়েছিল। রিচি হওয়ার সময়।’

নার্ভাস গলাতেই অনিকেত ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলল, ‘কাশীপুরের রান্নার মাসির কথা বলে কী হবে? এই মেয়ে তো তার বাড়িতে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ওঠেনি, আমাদের ফ্ল্যাটে উঠেছে। ছি ছি! আমি ভাবতেও পারছি না, একটা রেপ্‌ড মেয়ে বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে!’

বিদিশা ঢোঁক গিলে বিপন্ন গলায় বলল, ‘বাইরে থেকে দেখে এ জিনিস বোঝা যায়?’

অনিকেত বিরক্ত গলায় বলল, ‘বাইরে থেকে কোন জিনিস বোঝা যায় আর কোন জিনিস বোঝা যায় না, আমি জানি না। চেনো না, জানোও না একটা ওই বয়েসের মেয়েকে হুট বলতে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিলে কোন আক্কেলে? তোমার তাড়াহুড়ার জন্যই এরকম হল। যে- ভাবে চাকরিটা রাখব। দরকার হলে চোর ডাকাত খুনির হাতে রেখে তুমি অফিসে ছুটবে। এ তার থেকে কমই বা কীসের? বরং অনেক বেশি। ভাগ্যিস লালগোলা নামটা চেনা লেগেছিল। মনে পড়ে গেল, শিবুর শ্বশুরবাড়ি ওখানে।’

স্বামীর ধমকে বিদিশার একই সঙ্গে ভয় করছে, আবার রাগও হচ্ছে। হাতের পেনটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, ‘কী খোঁজ নেব? রেপ্‌ড কি না? কাজের লোক চোর কি না খোঁজ নেওয়া যায়, রেপ্‌ড কি না খোঁজ নেওয়া যায় না। তা ছাড়া ওই মেয়ে তো কাজের লোক নয়, রিচির অ্যাটেনডেন্ট।’

অনিকেত উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘সেই কারণেই তো চিন্তা। একটা আট বছরের মেয়ের অ্যাটেনডেন্ট যদি একটা… যাক যা ভাল বোঝো করো। তোমার মেয়ে, তোমার চাকরি, তোমার লোক— সবই তুমি ডিসাইড করছ, এটাও করো।’

অনিকেত ফোন কেটে দেওয়ার পর বিদিশা পাশের টেবিলের দিকে তাকাল। মঞ্জুদি টেবিলের ওপর পানের কৌটো খুলে খিলি পরীক্ষা করছে। আগে অফিসে বসেই পান সাজত, এখন কৌটোতে সেজে নিয়ে আসে। মুখে দেওয়ার আগে খিলি খুলে পরীক্ষা করে নেয়, চুন সুপুরি, খয়েরের ভাগে গোলমাল হয়ে গেছে কি না। বিদিশার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। কিছু শুনল কি? শুনলে শুনবে। মঞ্জুদির আড়িপাতা নিয়ে ভাববার সময় নয় এখন। কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে বিদিশার। সে কী করবে? এইসময় কী করা উচিত?

টেবিলে পড়ে থাকা পেনটা তুলতে গিয়ে বিদিশা বুঝতে পারল তার হাত কাঁপছে। ভয়ে? বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে এলে হত। এই সবে টিফিন শেষ হল, এখনই আবার উঠবে? আজকাল অফিসে ঘনঘন টেবিল ছাড়া মুশকিল। সেকশন অফিসার খিটিরমিটির করে। বেচারি চাপে আছে। চাপে শুধু সে নয়, সকলেই আছে। নতুন ম্যানেজারের চাপ। অফিসে ম্যানেজার বদলালে প্রতিবারই এরকম হয়। কিছুদিন চাপাচাপি চলে। এবার একটু বেশি সময় ধরে চলছে। তিনমাসের ওপর হয়ে গেল। অ্যাটেনডেন্স নিয়েও কড়াকড়ি চলছে খুব। এই তিনমাসে ম্যানেজার নিজে সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়েছে অন্তত সতেরোবার। টেবিল ফাঁকা দেখলেই ধরে ধরে খাতায় লাল কালি মেরেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কঠিন। ইতিমধ্যে দু’জনকে কলকাতার বাইরে ট্রান্সফার করেছে। সকলেই ভয়ে ভয়ে আছে।

এই কারণেই রিচির জন্য পাগলের মতো লোক খুঁজছিল বিদিশা। মেয়েটার জন্য সপ্তাহে তিনদিন পর্যন্ত লেট হয়ে যাচ্ছিল। সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোতে হয়। তার আগে মেয়েকে তৈরি করে শুধু স্কুলে পাঠানো নয়, ফিরলে কী খাবে, কী পরবে সব গুছিয়ে রাখতে হবে। ওইটুকু মেয়েকে বাড়িতে কার কাছে রেখে আসবে? শিলিগুড়ি থেকে মা এসে একমাসের ওপর রইল। কতদিন থাকবে? ওখানেও তো সংসার আছে। বাবার শরীর ভাল নয়, বয়স হয়েছে। কিছুদিন অফিসে আসার পথে রিচিকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসত। আবার ফেরার পথে নিয়ে যেত। সেও সমস্যা। সল্টলেক থেকে কাশীপুর একদম উলটোপথ হয়ে যায়। পরিশ্রম হত খুব। মেয়ে বড় হচ্ছে। স্কুলের টাইম বেড়েছে। অত টানাহেঁচড়া তারও পোষাচ্ছিল না। তার ওপর রিচিও সমস্যা করছিল। বুড়ো দাদু-দিদার কাছে এখন আর বেশি থাকতে চায় না। দুরন্ত মেয়েকে ওরাও সামলাতে পারে না। সবসময় অ্যাটেনশন চায়।

পেন বন্ধ করে বিদিশা উঠে পড়ল। করিডর পেরিয়ে বাথরুমে এল। বেসিন খুলে চোখে মুখে জলের ছিটে দিল। বেশি দিতে পারল না। পাউডার, লিপস্টিক সৰ উঠে বিশ্রী দেখাবে। মনে হবে কান্নাকাটি করেছে।

টেবিলে ফিরে এসে ফাইল খুলে বিদিশা বুঝতে পারল, তার কান্নাই পাচ্ছে। এই অবস্থায় কাজে মন দেওয়া অসম্ভব। অনিকেত যা বলল তা যদি সত্যি হয় তা হলে মারাত্মক।

অনেক কষ্টে উমাকে পাওয়া গেছে। একটা সবসময়ের লোকের জন্য বিদিশা কাকে না বলেছিল? প্রতিবেশী, অফিসের কলিগ, আত্মীয়স্বজন, বাড়ির ঠিকে কাজের লোক, এমনকী বাজারের সবজিওলাকে পর্যন্ত।

‘দেখো না কাউকে যদি পাও। অন্য কাজ করতে হবে না, শুধু মেয়েটাকে দেখবে। দিনরাত থাকবে, খাওয়া-পরা তো দেবই, পুজোআচ্চায় জামাকাপড় সব পাবে। ছোটখাটো মেয়ে হলে সবথেকে ভাল। রিচির সঙ্গে গল্প করতে পারবে, খেলতে পারবে। বন্ধুর মতো থাকবে। স্কুল থেকে ফিরলে খেতে দেবে, দুপুরে ঘুম পাড়াবে, বিকেলে ছাদে নিয়ে যাবে। তারপর তো আমি অফিস থেকে ফিরেই আসছি।’

একেবারে ছোট মেয়ে পাওয়া গেল না। কাশীপুরের রান্নার মাসি উমার কথা বলল।

‘বয়স কিন্তু একেবারে কম নয় গো দিদি।’

বিদিশা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কত?’

‘কমও নয় যেমন, তেমন আবার খুব বেশিও নয়, চোদ্দো-পনেরো হবে।’

বিদিশা বলল, ‘ওমা, সে তো বেশিই হল।’

‘দেখলে বুঝতে পারবে না। রোগভোগা চেহারা।’

‘কাজকর্ম পারবে?’

‘করেনি কখনও, শিখে নেবে। তুমি তো বলছ ভারী কিছু করতে হবে না।’

বিদিশা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘ভারী না হোক, রিচিরটা তো করতে হবে। সকালে টিফিন করে দেওয়া, ড্রেস পরিয়ে স্কুল বাসে তুলে দেওয়া। দুপুরে ফিরলে স্নানটান করিয়ে ঠিকমতো খেতে দেবে, তার ওপর এটা-সেটা টুকটাক তো থাকবেই।’

‘সে কেন পারবে না? খুব পারবে।’

‘রিচি কিন্তু খুব ছটফটে। তুমি তো জানোই। দুরন্ত মেয়েকে সামলাতে হলে গায়ে জোর লাগে। একটুতে হাঁপিয়ে পড়লে চলবে না।’

রান্নার মাসি হেসে বলে, ‘ওমা, কিছু না পারলে চলবে কেন? টাকা যখন পাবে কাজ তো করতেই হবে।’

বিদিশা মনে মনে খুশি হল। একটু বড় হলেই ভাল। ভরসা করা যাবে। শুধু রিচির জন্য রাখলেও, সংসারের আর পাঁচটা কাজ পারবে। অফিস থেকে ফিরে আর নিজে চা বানিয়ে খেতে ইচ্ছে করে না। ক্লান্ত লাগে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে আজকাল খাটায় খুব। ছুটিছাটার দিনে সঙ্গে থেকে ঘরদোর গোছাবে। ফ্ল্যাটের ঝুল ঝাড়তে হাঁপ ধরে যায়। তার ওপর মাসে একদিন করে রান্নাঘর, বাথরুম পরিষ্কার। অনিকেত তো কুটোটি নাড়ায় না। দোকান বাজার করতে বললেও বিরক্ত হয়। তার ওপর মাসের মধ্যে দশদিন টুরে থাকে। মনের খুশিভাব লুকিয়ে বিদিশা বলল, ‘মাসি, ওই মেয়ে আবার পাকা নয় তো? এই বয়সের মেয়ে, ভয় করে। পাড়া বেড়ানো, সিনেমা, টিভি দেখা মেয়ে হলে কিন্তু আমার চলবে না। দাদাবাবু রাগ করবেন।’

‘গ্রামের মেয়ে, ওসব এখনও শেখেনি।’

‘কোন গ্রাম?’

‘আমার ননদের যেখানে বিয়ে হয়েছে। লালগোলার কাছে। মেয়ের বাবা খুব করে কাজ খুঁজছে। মেয়ে বড় হচ্ছে, রোজগারপাতি ছাড়া ঘরে বসে গিললে সংসারে চলে? পাড়াগাঁয়ে মেয়েদের রোজগারের পথ কই? বিয়ে থা ছাড়া বেশিদিন পড়ে থাকলে গোল্লায় যায়। আমি শুনে বললাম, দাঁড়া দিদিকে আগে জিজ্ঞেস করি। দিদি লোক খুঁজছে।’

বিদিশার খুশিভাবটা বাড়ল। সদ্য গ্রাম থেকে এলে একদিক থেকে ভাল। ক’দিন একটু হয়তো শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে, তা হোক। পাঁচ বাড়ির কাজ করে আসা হলে প্যাঁচ পয়জার বেশি থাকে। দরদাম বোঝে। অল্পে মন ভরে না। কথায় কথায় হাত পাতে। এটা চাই, এটা চাই। প্রথমে সাবান দিয়ে শুরু হয়, তারপর পাউডার, লিপস্টিক পর্যন্ত চলবে। তাদের অফিসের বটুকবাবুর এই কাণ্ড হয়েছে। ড্রাইভারকে মাসে একবার সিনেমা দেখার ছুটি দিতে হয়। সেই সঙ্গে টিকিটের দাম। এরও হবে, তবে সময় লাগবে। ততদিনে রিচি আরও একটু বড় হয়ে যাবে।

বিদিশা বলল, ‘আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই মাসি, তুমি ওই মেয়েকে নিয়ে আসতে বলো। ক’দিন রেখে দেখি কাজকর্ম ঠিকমতো পারে কি না, টাকা-পয়সার কথা পরে হবে। আচ্ছা, মেয়ের স্বভাবচরিত্র কেমন? হাতটানের অভ্যেস নেই তো? আমরা কিন্তু বাড়ি ওর হাতে ফেলে বেরিয়ে যাব।’

‘সেসব আমি বলেই নিয়েছি দিদি, সেদিক থেকে কোনও গোলমাল নেই।’

সেদিক থেকে যে গোলমাল নেই, উমাকে দেখে প্রথমদিনই বুঝেছিল বিদিশা। সত্যি রোগা চেহারা। বয়স চোদ্দো বলে মনেই হয় না। পনেরো তো নয়ই। বিদিশা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নেয়, এই বয়েসে যে স্বাভাবিক বাড়বাড়ন্ত হওয়ার কথা এই মেয়ের তা প্রায় কিছুই নেই। থাকলেও চট করে চোখে পড়ার মতো নয়। এটাও ভাল। চেহারা ছবি সেরকম হলে দোকান বাজারে পাঠানো যেত না। রাস্তায় ছেলেপিলে থাকে। অপুষ্টির শরীরে সেদিক থেকে নিশ্চিন্তই করল বিদিশাকে। শুধু অপুষ্টি নয়, গায়ের রংও ময়লা। সাধারণ ময়লা নয়, অতিরিক্ত ময়লা। তবে গরিব ঘরের কালো মেয়েরা কোনও এক আশ্চর্য কারণে লুকিয়েচুরিয়ে খানিকটা সৌন্দর্য পেয়ে যায়। এই মেয়েও পেয়েছে। উমার চোখে মুখে একটা আলগা শ্ৰী আছে। বালিকাসুলভ নিস্পাপ ভাব। একমাথা জট পাকানো চুল, আর বড় বড় দুটো চোখ থাকায় ভাবটা যেন আরও বেড়েছে। সবথেকে আনন্দের বিষয় হল, প্রথম দর্শনেই উমাকে রিচির পছন্দ হয়ে গেল। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। রোববার সকালে ছেঁড়া ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে বাড়িতে গুটিগুটি পায়ে ঢোকার মিনিট পনেরোর মধ্যে রিচি তার ‘উমাদিদি’কে পুতুল সাম্রাজ্য চেনাতে বসে গেল। বিদিশা অবশ্য অ্যালাউ করেনি। জট পাকানো চুল থেকে উকুন মারতে গোটা বেলা মাথায় কেরোসিন মাখিয়ে বারান্দায় বসিয়ে রেখেছিল ঠায়ে।

অনিকেত ঘরে ডেকে নাক সিটকে বলে,‘শুধু উকুন নয়, তুমি ওই মেয়ের জন্য নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থাও করে দাও বিদিশা। এখনই দোকানে যাও। রিচির কাছে সারাক্ষণ থাকবে, ওর ওইসব ছেঁড়া, নোংরা জামা তো জার্মসে ভরতি মনে হচ্ছে।’

বিদিশা তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ‘আরে বাবা যাচ্ছি। যাক, রিচি যে ওকে অ্যাকসেপ্ট করে নিয়েছে এটাই নিশ্চিন্তি।’

অনিকেত খবরের কাগজে চোখ রেখে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘নিশ্চিন্তে অফিসে যেতে পারবে বলছ তো? তবে এত তাড়াতাড়ি নিশ্চিন্ত না হওয়াই ভাল বিদিশা। ক’দিন যাক, চুরিটুরির অভ্যেস আছে কি না দেখে।’

বিদিশা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘সে আমার দেখা হয়ে গেছে। টেবিলে দশটা টাকা আর খুচরো ক’টা পয়সা পড়ে ছিল। আমি আড়াল থেকে নজর করেছি, ওই মেয়ে তাকিয়েও দেখল না।’

‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে অনিকেত বলল, ‘দশ টাকা দিয়েই বুঝে গেলে!’

‘যা বোঝার দশ টাকা কেন, দশ পয়সাতেও বোঝা যায়। মেয়েরা লোভের চোখ চিনতে পারে। ওই মেয়ে চোর নয়।’

অনিকেত খবরের কাগজ সরিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আমার লোভের চোখ কি তুমি চিনতে পারছ বিদিশা? যদি পারো তা হলে খুবই ভাল, না পারলেও ক্ষতি নেই। দরজাটা বন্ধ করে এদিকে এসে আমি চিনিয়ে দিচ্ছি।’

বিদিশা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘অ্যাই সাতসকালে অসভ্যতামি হচ্ছে?’

মুখে যা-ই বলুক, মনে মনে খুশি হল বিদিশা। আসলে উমাকে পাওয়ার কারণে অনিকেতেরও টেনশন অনেকটা রিলিভড হয়েছে। রিচিকে নিয়ে সেও কম দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল না। প্রতিদিন কাজে বেরোনোর আগে বলত, ‘তুমি চাকরিটা এবার ছেড়ে দাও বিদিশা। মেয়েকে দেখো।’ সে কি জানে না, এই বাজারে চাকরি ছাড়া মুখের কথা নয়। যতই কম হোক, টাকা তো। তা ছাড়া বিদিশাও পারবে না। সবসময় স্বামীর কাছে হাত পাতা যায় না।

প্রথমদিনই বিকেলে সস্তার ডোরাকাটা নতুন স্কার্ট ফ্রক পরে উমা ছাদে রিচির সঙ্গে বেদম ছোটাছুটি করল। কে বলবে, এই মেয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা হল এ বাড়িতে এসেছে!

বহুদিন পর সেই রাতে, রিচি ঘুমিয়ে পড়ার পর, বিদিশা শাড়ি ছেড়ে রেখে স্বামীর কাছে উঠে এল। অনিকেত দ্রুত হাতে তার ব্লাউজ খুলতে খুলতে বলল, ‘তোমার ওই উমা না রমা শুয়েছে কোথায়?’

‘বসার ঘরে বিছানা করে দিয়েছি।’

বউয়ের ব্রায়ের হুকে হাত দিয়ে অনিকেত বলে, ‘দেখো, যদি টেকে।’

‘পিছনে বেশি টিকটিক না করলেই টিকবে। উফ আস্তে খোলো, খোঁচা লাগছে।’

অনিকেত খানিকটা উচু হয়ে বিদিশার পিঠ দেখতে চেষ্টা করে। হুকটা কোথাও গোলমাল করছে। আটকে যাচ্ছে।

‘তোমার মা এসে টিকটিক না করলেই হবে। এবার এইসব কেরানি মার্কা ব্রায়ের হ্যাভিট ত্যাগ করো বিদিশা, রাতে নাইটি পরে শোবে। চট করে খোলা যায়।’

নিজেকে অন্তর্বাস থেকে মুক্ত করতে করতে বিদিশা ঠোঁট টিপে হাসে। বলে, ‘কেরানির কাজ করি, অভ্যেস ছাড়ব কী করে? আর আমার মাকে একাই বা দোষ দিচ্ছ কেন বাপু, তোমরা বাড়ির লোকই বা কম কী? এই তো সেদিন রান্নার মাসি বলছিল…।’

বহুদিন পর স্ত্রীর বুকে আদর করতে লাগল অনিকেত। বিদিশা গাঢ় স্বরে বলল, ‘অ্যাই তাড়াতাড়ি করো, রিচি উঠে পড়বে।’

‘পড়লে পড়ুক, এই সুন্দর জিনিস আমি ছাড়ছি না।’ জড়ানো গলায় বলে অনিকেত।

বিদিশা আদর খেতে খেতে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘অ্যাই জানো, ওই মেয়েটার শরীর এখনও ডেভেলপই করেনি।’

‘সে আবার কী!’

‘কী আবার, বুকটুক বোঝাই যায় না। ভাল করে একবেলা খাওয়াই জোটে না, বুক হবে কোথা থেকে? আমার অবশ্য সুবিধেই হল।’

ডান পা দিয়ে বউয়ের কোমর জড়াতে জড়াতে অনিকেত বলল, ‘তোমার আবার কী সুবিধে হল?’

ভরা বুক, ভারী নিতম্ব, সুডৌল উরু স্বামীর শরীরে পেতে দিতে দিতে বিদিশা বলল, ‘বাঃ, সুবিধা নয়! পুরুষমানুষের কুনজরে পড়বে না।’

অনিকেত বউয়ের কাঁধে আলতো কামড় বসিয়ে বলে, ‘তোমার ওপর আমার নজর কেমন?’

স্বামীর গালে নিজের নাক ঘষে বিদিশা বলে, ‘খুব খারাপ, একদম কু।’

‘আমি কিন্তু তোমার মতো এখনই মার্কশিট দিতে পারছি না বিদিশা। ওই মেয়ে সম্পর্কে খোঁজখবর নেব। আমাদের ওয়ার্কশপের কার যেন শ্বশুরবাড়ি ওই লালগোলার দিকে। কার যেন? এখনই মনে করতে পারছি না। মনে পড়লে বলব, বাপু একটু খোঁজখবর দিয়ে দেখি।’

বিদিশা চাপা শীৎকার দিয়ে বলে, ‘তুমি এখন আমার দিকে মন দাও তো…।’

একটা সময় তৃপ্ত বিদিশা চিত হয়ে শুয়ে অনুভব করে, উমা নামের রোগাভোগা, কালো মেয়েটি তাদের মনের টেনশন শুধু কমিয়ে দেয়নি, শরীরের টেনশনও কমিয়েছে। শরীর শিথিল হয়েছে। দরিদ্র মেয়েটির প্রতি তার এক ধরনের কৃতজ্ঞতা তৈরি হয়! অন্ধকারে ঠোঁটের ফাঁকে হেসে নগ্ন শরীর চাদরে ঢেকে পাশ ফিরে শোয়।

সেই মেয়ের এই ভয়ংকর কাণ্ড! মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়েছে বিদিশার।

অন্যমনস্কভাবে হাতের ফাইলটা দেখা শেষ করে পাঠিয়ে দিল বিদিশা। আচ্ছা, অনিকেত ভুল করছে না তো? হতেও তো পারে। শিবু না কী নাম যেন লোকটার? সে হয়তো গোলমাল করছে। একজনের ঘটনা অন্যজনের ঘাড়ে ফেলছে। লালগোলার গ্রামে একজনই উমা থাকে তার কী মানে আছে? টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্রের আড়ালে মোবাইলে দ্রুত অনিকেতের নম্বর টেপে বিদিশা। তারপর হাতের মুঠোয় যতটা সম্ভব লুকিয়ে ফোনটাকে কানে চেপে ধরে।

‘আবার কী হল?’

‘অ্যাই শোনো, খবরটা ঠিক তো?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। আমি আবার শিবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ও ডিটেইলসে বলল।’ এই পর্যায়ে অনিকেতের গলা বেশ নার্ভাস।

বিদিশা কাঁপা গলায় বলল, ‘কী ডিটেইলস?’

‘তিন মাস আগের ঘটনা। ভোরবেলা পুকুরে স্নান সেরে ফিরছিল, পাটখেতে টেনে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে বাড়ির লোক এসে দেখল, শি ওয়াজ ন্যুড। রক্তে মাখামাখি।’

বর্ণনা শুনে শিউরে উঠল বিদিশা।

‘থাক, থাক, আর বলতে হবে না ইস, এই সকালে?’

‘রেপের সকাল বিকেল বলে আলাদা কিছু হয় না। বাড়িতে ফোন করেছিলে?’

‘বাড়িতে ফোন করব কেন?’ কাঁপা গলায় বলে বিদিশা।

‘না, রিচি আছে। তাই বলছিলাম’

‘রিচির এখনও স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়নি, তা ছাড়া থাকলেই বা কী?’ আতঙ্কে চোখমুখ কুঁচকে যায় বিদিশার।

অনিকেত চিন্তিত গলায় বলে, ‘ওই মেয়ের সঙ্গে থাকলে অনেক কিছু হতে পারে।’

বিদিশা একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘উমার বাড়ির লোক পুলিশে কমপ্লেইন করেনি?’

‘গ্রামে চট করে ওসব পুলিশ-টুলিশ হয় না। কেলেঙ্কারির ভয় থাকে। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে না! নিশ্চয় মেয়ের বাবা-মা ভয় পাচ্ছিল। কে জানে যে লোক করেছে, তার হয়তো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে। এসব নরমাল ব্যাপার। নিশ্চয় এই কারণেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এক ধরনের শেল্টার। পরে এখানেই ছেলে জুটিয়ে বিয়ে দেবে।’

বিদিশার ভয় বাড়ছে। কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘কী করা যায় বলো তো? আমার তো রান্নার মাসির ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। আজই ফেরার সময় কাশীপুরে যাব। ওকে সব বলব।’

অনিকেত চাপা গলায় ধমক দিল।

‘ও কাজটি করতে যেয়ো না। অনেক করেছ, দয়া করে আর জিনিসটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কোরো না। বাবা-মা জেনে যাবে, টেনশন করবে। তা ছাড়া রিচিকে দেখার জন্য একটা রেপ হওয়া মেয়েকে বাড়িতে এনে তুলেছি এটা ঢাকপিটিয়ে বলার মতো কিছু নয়। যদি জানাজানি হয়ে যায়, বিচ্ছিরি হবে। ঠান্ডা মাথায় কেসটা সামলাতে হবে।’

কান্না চেপে বিদিশা বলে, ‘ঠান্ডা মাথায় কী করব সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’

‘কী আবার করবে? বাড়ি গিয়ে মেয়েটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। তা ছাড়া আরও ঘটনা থাকতে পারে।’

‘কী ঘটনা?’ মোবাইলের ভেতর প্রায় মুখ গুঁজে দিয়েছে বিদিশা।

‘এসব মেয়ে অনেক সময় নিজে থেকেই এসব কাণ্ড ঘটায়, বাড়ির লোক তারপর মেয়েকে সরিয়ে ফেলে। গ্রামগঞ্জে কত কী হয় তুমি জানো না বিদিশা।’

‘নিজে থেকে করেছে! এটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না অনিকেত। ওই মেয়েকে আমি এতদিন দেখছি।

ও প্রান্তে অনিকেত ফের রেগে ওঠে।

‘এতদিন মানে? কতদিন? কুড়ি-বাইশ দিনও তো হয়নি, এর মধ্যে চিনে ফেললে! রাবিশ। এইজন্যই তোমাদের নিয়ে বিপদে পড়তে হয়। বিদিশা, বাড়ি ফিরে ওই মেয়ের মুখ যেন আমি না দেখি। তুমি ওকে তাড়াবে। তুমি না পারলে, আমি বাড়িতে থেকে রিচিকে পাহারা দেব।’

দুম করে ফোন কেটে দিল অনিকেত। বিদিশা বাড়িতে রিং করল। ফোন বেজে গেল। ধরছে না কেন! প্রথম প্রথম ফোন ধরতে ভয় পেত মেয়েটা। কিছুদিনের মধ্যে শিখে নিয়েছে। মাথা পরিষ্কার। শুধু ফোন নয়, এখন গ্যাস, টিভি, গিজার পর্যন্ত চালাতে পারে। যত্নও আছে। কাজের লোকেরা ফ্রিজের দরজা জোরে বন্ধ করবেই। ক’দিনের মধ্যে দরজার দফা রফা হয়। রাবার প্যাড, ম্যাগনেট গোলমাল করে। এই মেয়ের বেলায় তা হচ্ছে না। শহুরে কায়দাকানুনে দ্রুত অভ্যস্ত হচ্ছে। বিদিশা আবার বাড়ির নম্বর টিপল। না, ধরছে না। কী হল? ভেতরে ভেতরে সামান্য কাঁপুনি অনুভব করল বিদিশা। কবজি উলটো ঘড়ি দেখল। রিচির ফেরার সময় হয়ে এসেছে। আজকাল রিচির খাওয়ার সময় উমা গল্প বলে। নিজের গ্রামের গল্প। খেত, মাঠ, পুকুর, ঝুরিনামা বুড়ো বটগাছ। অবস্থা এমন হয়েছে, ‘উমাদিদি’র গল্প না শুনলে রিচি এখন মুখে ভাত তুলতে চায় না। নিশ্চিন্ত হয়েছিল বিদিশা। তার নিজের গল্পের স্টক ফুরিয়ে আসছে। সারাদিন এত কাজের পর মেজাজও ঠিক রাখতে পারে না। রাতে বকাঝকা করে মেয়েকে খাওয়াতে হত। উমার গল্প একটা সুন্দর অভ্যেস তৈরি করেছে।

এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে বিদিশার। গ্রামের গল্প বলতে গিয়ে মেয়েটা ওইসব ঘটনা বলবে না তো? খারাপ লোকের গল্প? পরক্ষণেই মনে হল, ছি ছি, এসব কী ভাবছে? কেন ভাবছে? ভয় পেলে মাথায় হাবিজাবি চিন্তা আসো। ওইটুকু বাচ্চার কাছে অমন নোংরা ঘটনা কেউ বলতে পারে? অসম্ভব! রুমাল দিয়ে কপাল, ঘাড়ের ঘাম মুছল বিদিশা। কল্পনাও করা যায় না। ওরকম রুগ্‌ণ চেহারার একটা মেয়েকে…।

শরীরের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে। গা-টা কেমন গুলোচ্ছে। বমি পাচ্ছে? আবার মোবাইলের নম্বর টিপল। উমা ফোন ধরছে না কেন? খারাপ কিছু হয়নি তো?

এবার হাত দিয়েই কপাল মুছল বিদিশা।

তিনবারের বার ফোন ধরল। তবে উমা নয়, ফোন ধরল রিচি। তার গলায় হাসি। সম্ভবত আগে থেকেই হাসছিল, ফোন ধরেও হাসি থামাতে পারছে না। বিদিশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।

‘এ কী, তুমি স্কুল থেকে ফিরে এসেছ সোনা!’

‘হি হি, হ্যাঁ মা, আজ হাফ ছুটি দিয়েছে, হি হি।’

বিদিশা কষ্ট করে হেসে বলল, ‘তুমি হাসছ কেন সোনামণি? খেয়েছ? উমাদিদি কোথায়?’

রিচি হাসি না থামিয়েই বলল, ‘আমি খাচ্ছি মা, উমাদিদি একটা খুব মজার গল্প বলছে। হি হি।’

মেয়ের হাসিতে বিদিশা খানিকটা আশ্বস্ত হল। ফিসফিস করে বলল, ‘তাই নাকি! কী গল্প?’

‘রাক্ষসের গল্প মা, একটা রাক্ষস একদিন উমাদিদির গ্রামে পন্ডের পাশে ঘাপটি মেরে বসে ছিল, হি হি… যেই রাজকন্যা স্নান সেরে পন্ড থেকে উঠেছে… হি হি… মা, আমি এখন ফোন ছাড়ছি, গল্প শুনতে যাচ্ছি। গল্প শেষ হলে তোমায় ফোন করব, কেমন?’

থম মেরে বসে রইল বিদিশা। শরীরটা ঝিমঝিম করছে। দুর্বল লাগছে। হাতের তালুদুটো মনে হচ্ছে বরফের মতো ঠান্ডা। উমা তার মেয়েকে পুকুড়পাড়ের গল্প বলছে! সেই গল্প!

পাশের টেবিল থেকে মঞ্জুদি গলা বাড়িয়ে বলল, ‘কী হল, আজ যে কর্তার সঙ্গে ম্যারাথন ইয়ে চালাচ্ছ। ব্যাপারটা কী ভাই? ঝগড়া না প্রেম?’

বিদিশা চুপ করে রইল। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। মাথাটা অল্প ঘুরছে। প্রেশারের গোলমাল হল? এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেকশন অফিসার ডেকে পাঠায়।

‘আপনার কি শরীরটা খারাপ বিদিশাদেবী?’

‘কেন বলুন তো স্যার?’ ভুরু কুঁচকে বলল বিদিশা।

‘না, সেরকম কিছু নয়, আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া এইটুকু ফাইলে সাত জায়গায় ভুল করেছেন। তার মধ্যে তিনটে ভুল তো মারাত্মক। তাই ভাবছিলাম নিশ্চয় কোনও সমস্যা হয়েছে। এই ফাইল যদি সাহেবের হাতে চলে যেত কী কাণ্ড হত বলুন দেখি?’

খানিকটা সময় মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বিদিশা। বিড়বিড় করে বলল, ‘স্যার, আমি বাড়ি যাব। প্রেশারটা মনে হচ্ছে গোলমাল করছে। আপনি কি একটা ট্যাক্সি ডেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন?’

ট্যাক্সির সিটে মাথা এলিয়ে দিল বিদিশা। খানিক আগে পর্যন্ত মেয়েটার ওপর মায়া হচ্ছিল, এখন ঘেন্না হচ্ছে। গল্পটা কি ইতিমধ্যে রিচিকে ওর বলা হয়ে গেছে। রাজকন্যা পুকুর থেকে স্নান সেরে ওঠার পর…। ইস, তারই দোষ। অনিকেত ঠিকই বলেছে, তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে। অফিসের চাপে নিজের চাকরি সামলাতে গিয়ে দুম করে অচেনা অজানা কাউকে রেখে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। আরও অপেক্ষা করা উচিত ছিল। চেনাজানা কাউকে রাখা উচিত ছিল। সেরকম হলে না হয় নিজে চাকরি ছেড়ে দিত। ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য কত মেয়েকেই চাকরিবাকরি ছেড়ে ঘরে ঢুকে যেতে হয়। হয় না? ভাগ্যিস খবরটা অনিকেত জেনেছে। নইলে আরও ভয়ংকর কিছু হতে পারত। শুধু গল্প বলা নয়, উমা যদি নিজে থেকে ওই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকে তা হলে খারাপ লোকের সঙ্গে নিশ্চয় এখনও তার যোগাযোগ আছে। না থাকলেও বা কী? মেয়েটা লুকিয়ে থাকবে কতদিন? ওরা ঠিক এখানকার ঠিকানা পেয়ে যাবে। এই তো ওর অফিসের শিবু জেনে গেছে। ওই লোকও জানবে। পুকুরের পাশে একটা লোক না পাঁচটা লোক অপেক্ষা করেছিল কে জানে। যটাই হোক, ঠিক খবর পেত— উমা অনেকটা সময় কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে একলা থাকে। সঙ্গে রিচি নামের একটা শিশু। তারপর একদিন দুপুরে এসে…। পশুগুলো কি রিচিকে ছাড়ত?

মাগো! শিউরে উঠে চোখ বুজল বিদিশা। এই ক’দিনে যে কিছু হয়নি তাই যথেষ্ট। হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল বিদিশা।

বড় রাস্তা ছেড়ে বাড়ির গলিতে ঢোকার মুখে বিদিশা সিদ্ধান্ত নিল, আজই উমাকে কাশীপুরে রেখে আসবে। এই ট্যাক্সিতেই যাবে। পরে রান্নার মাসি যেমন পারবে মেয়েটাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। শুধু বলবে, মেয়েটাকে আর রিচির পছন্দ হচ্ছে না, মানিয়ে নিতে পারছে না। ব্যস। কুড়ি দিনের বদলে না হয় পুরো মাসের মাইনেটাই দিয়ে দেবে।

কাশীপুর থেকে ফিরে রিচিকে খাওয়াতে বসলে মেয়েটা কান্না জুড়ল। বারকয়েক বারণ করার পরও সেই কান্না থামাল না। ভাত মাখা এঁটো হাতেই মেয়ের গালে কষে চড় মারল বিদিশা।

খবরটা যে ভুল ছিল জানা গেল একমাস পর। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শুতে এসে কথাটা বিদিশাকে বলল অনিকেত। শিবুই তাকে বলেছে। অনিকেতের কাছে এক হাত জিভ কেটেছে।

‘সরি দাদা, গ্রাম আর মেয়ে দুটো নামই ভুল করেছিলাম। সেই মেয়ের নাম উমা নয়। তার নাম হল…’

স্বচ্ছ একটা নাইটি পরে বিদিশা বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চুল বাঁধছে। এরপর হাতে পায়ে ক্রিম দেবে। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কারণে তার হাতে এখন অঢেল সময়। দুপুর ঘুমোয়, রাতে অনেকটা সময় ধরে প্রসাধন সারে। কখনও টিভি দেখে। ইচ্ছে হলে পত্রিকা পড়ে। স্বামীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘তুমি কী বললে? আমরা ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি বলেছ?’

অনিকেত মৃদু হেসে বলল, ‘খেপেছ? আমাদের সম্পর্কে কী ভাবত বলো তো?’

‘ঠিকই করেছ।’

গভীর রাতে আদর সেরে ক্লান্ত অনিকেত ঘুমিয়ে পড়ে। নগ্ন বিদিশা জেগে থাকে অনেকক্ষণ। ঘুমোতে চেষ্টা করে, পারে না। একটা সময় তার মনে হতে থাকে সে রক্তাক্ত। পড়ে আছে অচেনা একটা পাটখেতে।

‘কে’ নামে ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে উদিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *