ফ্লাইওভার

ফ্লাইওভার

ঘটনাটা ঘটে বুধবার। বুধবার দুপুরে।

প্রথমে রাস্তার মাঝখানটা ফুলে ওঠে। উঁচু হয়ে ওঠে কুঁজের মতো। মনে হয়, একটা ঢেউ। সেই ঢেউ স্থির হয়ে অল্প কাঁপে। তারপর নিচু হয়ে মাথা নামিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় সামনে। গড়িয়াহাটের দিকে যতটা দেখা যায় কংক্রিট আর পিচে কাঁপুনি তুলে ছুটতে থাকে। ফিরেও আসে আবার। তারপর নবনীদের বাড়ি টপকে, শপিং প্লাজার বাঁক ঘুরে চলে যায় বাইপাসের দিকে। চোখের আড়ালে।

সব মিলিয়ে কয়েক মুহূর্ত। নবনী দৃশ্যটা দেখে স্থির হয়ে। চোখের পলক না ফেলে। তারপর দুটো হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বারান্দার রেলিং। এটা সে কী দেখল! কী দেখল সে? ফ্লাইওভারটা নড়ে উঠল। যেন দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাকার পর শরীরে ঢেউ তুলে প্রাণের জানান দিল!

একটু আগেই ঘরের টুকটাক কাজ সেরে স্নান করেছে নবনী। অন্যদিন আরও আগে হয়ে যায়। তথাগত অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই বাথরুমে ঢুকে পড়ে। তারপর সারাদিন তো একা। যে-কোনও একটা সময় খেয়ে নিলেই চলে। না খেলেও ক্ষতি নেই। ছিপছিপে শরীরটা ধরে রাখতে দু’-একটা দিন লাঞ্চ স্কিপ করা ভাল। এতে অন্য সময়ের হাবিজাবি খাওয়াগুলো কিছুটা ব্যালান্স হয়। নবনীও তাই করে। তথাগত যদিও হুমকি দেয়, নাটুকে ভঙ্গিতে বলে, ‘বেশিদিন এ জিনিস চলবে না প্রিয়তমা! অচিরেই তোমার এই ঝাড়া হাতে পায়ে আমি শিকল পরাব। ছেলেমেয়ে হয়ে গেলে মজা টের পাবে। তখন চলতে হবে একেবারে ঘড়ি ধরে। খাওয়া-পরা-শোওয়া সব। এমনকী আমাদের ইয়েও। এই ধরো, ওর জন্য সময় দেওয়া থাকবে রাত দেড়টায়। বাচ্চা ঘুমানোর পর, মাত্র কুড়ি মিনিট। ফার্স্ট ওয়ার্নিং বেল পড়বে ষোলো মিনিটের মাথায়। হা হা।’

নবনী স্বামীর গায়ে কিল মারে। মোরে বলে, ‘অসভ্য কোথাকার। খুব চোখ টাটাচ্ছে, না? এখন কিছুতেই ওসব হ্যাপার মধ্যে যাব না। তোমার মা-ও সেদিন ফোনে বলছিলেন। ছেলেপুলে নাকি অল্প বয়সে হওয়াই ভাল। আমি বললাম, মা, ওসব পুরনো দিনের কথা। আপনার ছেলে আর একটু গুছিয়ে নিক। আজকালকার দিনে ছেলেমেয়ে মানুষ করা অত সহজ নয়। আগে নিজেদের তৈরি হতে হয়।’

নবনী স্বামীর গায়ে কিল মারে। মোরে বলে, ‘অসভ্য কোথাকার। খুব চোখ টাটাচ্ছে, না? এখন কিছুতেই ওসব হ্যাপার মধ্যে যাব না। তোমার মা-ও সেদিন ফোনে বলছিলেন। ছেলেপুলে নাকি অল্প বয়সে হওয়াই ভাল। আমি বললাম, মা, ওসব পুরনো দিনের কথা। আপনার ছেলে আর একটু গুছিয়ে নিক। আজকালকার দিনে ছেলেমেয়ে মানুষ করা অত সহজ নয়। আগে নিজেদের তৈরি হতে হয়।’

বুধবার দুপুরে ভেজা চুলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল নবনী। দশ তলার এই বারান্দায় হাওয়া অনেক। কোনও কোনও দিন বিকেলের পর মনে হয়, ঝড় দিয়েছে। সিঁথির বাড়িতে দোতলার ছাদে উঠলেও দম চাপা লাগত। এই ফ্ল্যাট কেনার আগে তাই কম পরিশ্রম করেনি নবনী। তথাগত আর সে গাড়ি নিয়ে চক্কর মেরেছে গোটা শহর। প্রোমোটারদের চকচকে অফিস থেকে শুরু করে দালালদের চায়ের দোকানের আস্তানা— কোথায় না গেছে? কখনও আবার মিস্ত্রি, দারোয়ানকে ম্যানেজ করে উঠে গেছে আধখানা তৈরি বাড়ির টঙে। ইট-বালি লোহা-লক্কড় টপকে ঘুরেছে কঙ্কাল ফ্ল্যাটে। বোঝার চেষ্টা করেছে শেষ পর্যন্ত চেহারাটা কেমন হবে। বেডরুমের মুখ থাকবে কোনদিকে? বাথরুম হবে কত বড়?

তথাগতর ইচ্ছে ছিল ফ্ল্যাট কিনবে ওপরে। অনেক ওপরে। টাওয়ার হলে সবথেকে ভাল। এখন নাকি এটাই স্টাইল। যত ওপরে, তত শুধু ধুলো ময়লা মশা মাছি কম নয়, রোদ বৃষ্টি হাওয়াও পাওয়া যায় ফার্স্ট হ্যান্ড। নবনীর অবশ্য বায়নাক্কা ছিল অন্য জিনিসে। বাথরুমে। সিঁথির ঘুপচি স্যাঁতসেঁতে বাথরুমটা সে ভুলতে চায়। নিজের ফ্ল্যাটের বাথরুম চাই বড়। মেঝে হতে হবে মার্বেলের। সাদা নয়, হালকা গোলাপি মার্বেল। বাথটবও হবে গোলাপি। সেইসঙ্গে থাকবে একটা জানলা। বড় জানলা। বাথটবে শুয়ে শুয়ে যেন আকাশ দেখা যায়। মাথার ওপর শাওয়ার থেকে যখন জল পড়বে তখন মনে হবে সত্যিকারের বৃষ্টি হচ্ছে।

শেষপর্যন্ত অবশ্য অত কিছু দেখা হল না। দেখা হল ফ্লাইওভার।

বাড়ির পাশেই ফ্লাইওভার শুনে তথাগত ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে ওখানেই ফ্ল্যাট নেবে। দাম একটু বেশি হলে হোক, কোনও ক্ষতি নেই। পাশে ফ্লাইওভার থাকলে ফ্ল্যাট বেশি দিন ফ্ল্যাট থাকে না। ক’দিনের মধ্যে সোনা হয়ে যায়। এক শনিবার বিকেলে নবনীকে নিয়ে দেখে গেল তথাগত। ফ্লাইওভার শুধু বাড়ির পাশে নয়, একেবারে তাদের ফ্ল্যাটের গায়ে। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে! রাতে নবনী বলল, ‘সব ঠিক আছে, কিন্তু একেবারে বেডরুমের ওপর দিয়ে রাস্তা। বারান্দাটা টপকালেই। কেমন বিচ্ছিরি না?’

তথাগত চোখ কপালে তুলে বলল, ‘রাস্তা! ফ্লাইওভারকে তুমি রাস্তা বলছ নবনী! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আর ইউ মাড়?’

নাইটি পরতে পরতে নবনী বলল, ‘পাগলের কী আছে? ঘর থেকে গাছপালা দেখারও তো দরকার। বারান্দায় বসে কেবল পিচের রাস্তা আর গাড়িঘোড়া দেখব নাকি? ইস, মা গো!’

তথাগত উদাস গলায় বলল, ‘না, দেখবে না। তুমি বরং একটা কাজ করো। তুমি আমাদের দেশের বাড়িতে গিয়ে সেট্‌ল করো। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। বাইরের দিকের একটা ঘর তোমার জন্য রেনোভেট করে দেওয়া হবে। সেখানে শুধু সবুজ গাছ নয়, তুমি গোরুর গাড়ি, মাটির রাস্তা সবই দেখতে পাবে। ইচ্ছে করলে বৃষ্টির সময় এক হাঁটু কাদা মাড়িয়েও ঘুরে বেড়াতে পারো।’

নবনী রেগে গিয়ে বলে, ‘ইয়ারকি করছ? যা খুশি করো। তোমার টাকার ফ্ল্যাট, ফ্লাইওভারের ঘাড়ে কিনবে না বাইপাসের মাথায় কিনবে, তুমি ঠিক করো।’

তথাগত এগিয়ে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখে। হেসে বলে, ‘ডার্লিং, ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো। ফ্লাইওভার মানে এখন আর শুধু একটা শর্টকাট রাস্তা নয়। এটা একটা আধুনিক বিষয়। একটা ডেভলপমেন্ট। তুমি সেটার পার্ট হচ্ছ। শুধু কি তাই? স্পিডের কথাটা একবার ভেবে দেখবে না? চোখের সামনে সারাক্ষণ গাড়ি ছুটবে। মনে হবে ছুটছে না, উড়ছে। একটা সময় ইউ ক্যান ফিল দ্যাট স্পিড। মনে হবে, তুমিও সেই গতিটাকে ছুঁতে পারছ। আমাদের ছেলেমেয়েরাও একদিন স্পিডটাকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেবে। হুইচ ইজ ভেরি ইমপর্ট্যান্ট।’

নবনী চোখ সরু করে বলল, ‘বাপ রে, এত লেকচার শিখলে কোথা থেকে? আসল কথাটা বলো না বাপু, ফ্লাইওভারের জন্য ফ্ল্যাটের দাম বাড়বে। রিসেল ভ্যালু যাকে বলে।’

তথাগত হাসল। ধরা পড়ার লাজুক হাসি। হাসতে হাসতেই সে তার নবনীর নাইটির স্ট্র্যাপ কাঁধ থেকে নামাতে যায়। নবনী বলে, ‘অ্যাই কী হচ্ছে? আগে আলো নেভাও।’

মাসখানেক হল সিঁথির বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িকে রেখে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছে তারা। তবে ফ্লাইওভার এখনও চালু হয়নি। চালু হয়ে যাবে যে-কোনও দিন। বাড়ির দারোয়ানের কাছে নিয়মিত খোঁজ নেয় তথাগত। সে জানিয়েছে, মন্ত্রীর ডেট নিয়ে নাকি ঝামেলা চলছে। ডেট পেলেই উদ্বোধন। এদিকে কাজ প্রায় শেষ। ঝকঝকে কালো পিচের ওপর রোজ নতুন করে পিচ ঢালা চলছে। সাদা সিমেন্টের রেলিংগুলো দেখাচ্ছে আলপনার মতো। সারি সারি আলোর পোস্ট নিয়ে সেজেগুজে বসে আছে ফ্লাইওভার। বসে আছে? না পিলারের ওপর ভাসছে? হঠাৎ দেখলে মনে হয়, শূন্যে ভাসছে। উঁচু বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে, পাক খেয়ে, বাঁক ঘুরে গড়িয়াহাটের দিক থেকে চলে গেছে বাইপাস পর্যন্ত। নবনীর বেশ লাগে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফ্লাইওভার নয়, একটা সাপ। অজগর সাপ। কঠিন পেশি আর পুরুষালি শরীরটা নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নিথর হয়ে।

বুধবারই প্রথম অন্যরকম লাগল। অন্যরকম এবং ভয়ের। মনে হল, ফ্লাইওভারটা বুঝি নড়ে উঠল! তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছে নবনী। বুঝতে পেরেছে, আসলে গোটাটাই মনের ভুল। মন সেই ভুল চালান করেছে চোখে। নিজের মনেই হাসল সে। ঘটনাটা মজার, খুবই মজার। তবে, তথাগতকে বলা যাবে না। চিন্তা করবে। চোখের ডাক্তারও দেখাতে পারে। সুন্দরী বউ হওয়ার এই এক অসুবিধে। স্বামীরা প্রথম প্রথম বড্ড আদিখ্যেতা করে।

তবে, বলতে হল। তথাগতকে বলতে হল ঠিক তিন দিনের মাথায়। আরও দুটো ঘটনার পর।

প্রথমটা ঘটল সন্ধেবেলা। নিজের ঘরে সাজাতে বসেছিল নবনী। বিয়ের পর রোজই এটা করে। তথাগত বাড়ি ফেরার আগে গা ধুয়ে সাজগোজ করে। হালকা মেকআপ নেয়। প্রথম প্রথম কেলেঙ্কারি হত। তখন তারা সিঁথির বাড়িতে। তথাগত ঘরে ঢুকেই এমন ধামসা-ধামসি শুরু করত যে পাউডার লিপস্টিক থেবড়ে-টেবড়ে একাকার কাণ্ড। শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে বেরোনো যেত না। এখন ফাঁকা ফ্ল্যাটে আরও বেশি করে। নবনী রাগ দেখায়, বকে। তবু তথাগত ফিরে আসার আগে তৈরিও হয়। হালকা করে ভুরু আঁকে, চোখে মাসকারা দেয়। গালে পাউডার বোলায়। দেয়াল জোড়া ওয়ার্ডরোব খুলে বের করে পোশাক। সেই পোশাকে কোনওদিন কাঁধ নেই, কোনওদিন পিঠ নেই, কোনওদিন জামা থমকে গেছে নাভির ওপরে। তথাগতর মাথা ঘুরে যায়। বেচারি মুখ হাত ধোওয়ারও ফুরসত পায় না। আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সেদিনও সাজছিল নবনী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাউসকোটের দড়ি খুলতে খুলতে ভাবছিল, কী পরবে আজ? কী পরলে আজও মাথা ঘুরবে তথাগতর? ঠিক এরকম একটা সময় আওয়াজটা শুনতে পায় সে। তখন সাতটাও বাজেনি।

হিস্ হিস্ হিস্…।

নবনী চমকে ওঠে। ঠিক যেন নিশ্বাসের মতো! মানুষের নয়, অন্য কিছুর, অন্য কারও নিশ্বাস। চাপা অথচ গম্ভীর। ব্যস্ত হাতে কোমরে হাউসকোটের দড়ি আটকায় নবনী। কীসের শব্দ? কে ওখানে? মন শক্ত করে এগিয়ে যায়। কাঁপা হাতে লক টেনে বারান্দার দরজা খোলে। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল গায়ে। কোথাও কিছু নেই। কেউ নেই। ফ্লাইওভারের আলোগুলো আজ জ্বলছে। ঝলমল করছে। সুন্দর লাগছে। নবনীর নিজের। ওপর রাগ হল। এ আবার কী শুরু হয়েছে তার? এই বয়সেই চোখ, কান, মাথার ভুল! নাকি ভয়! ভয়ের কথা শুনলেই তথাগত বলবে, ‘তখনই বলেছিলাম, সন্ধের পর একা এত বড় ফ্ল্যাটে থাকতে পারবে না। আমি বরং বাবা-মাকে রাখি।’

পরের ঘটনাটা কিন্তু ঘটল দিনেরবেলা।

নবনী তখন বাথরুমে। বাথরুমে নয়, বলা ভাল বাথটবে। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে আছে ফেনার মধ্যে। সপ্তাহে অন্তত চারটে দিন সে এই কাণ্ড করে। তথাগত বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘণ্টাখানেক ফেনার মধ্যে আধশোয়া হয়ে থাকে। শুয়ে শুয়েই সাবান, লোশন, ক্রিম দিয়ে শরীরের পরিচর্যা চালায়। সেদিন নবনী ব্যস্ত ছিল হাতের নখ নিয়ে। মনোযোগ সহকারে ব্রাশ ঘষছিল। হঠাৎই অস্বস্তিটা শুরু হয়। কেমন যেন লাগে। পুরুষমানুষ বিচ্ছিরিভাবে তাকিয়ে থাকলে যেমন হয়, অনেকটা সেরকম। সে মুখ তোলে। চারপাশ দেখে। কই, সবই তো ঠিক আছে। বাথরুমের দরজাও বন্ধ। তা হলে? নবনী ফের নখে মন দেয়। গুনগুন করে গানও শুরু করে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অস্বস্তিটা ফিরে আসে আবার। ফেরে আরও তীব্র হয়ে। এবার মনে হয় কেউ যেন একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে গেছে। অপেক্ষা করছে, বাথটব ছেড়ে নবনী কখন উঠবে। দ্রুত পাশে রাখা তোয়ালের দিকে হাত বাড়ায় নবনী। হাতড়ায় কঠিন মার্বেলে। কোথায় তোয়ালে? কোথায়? বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তোয়ালেটা তো সে এখানেই রাখে। বাথটবের গায়ে। ডান পাশে, হাতের নাগালে। স্নানের পর জড়িয়ে নেমে আসে। তারপর জল ঝরিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাথরুম থেকে। তা হলে? তা হলে এখন জিনিসটা গেল কোথায়? ও পাশে? পায়ের দিকে মুখ ফেরাল নবনী। না নেই। কোথাও নেই। বুক পর্যন্ত জলে ঢেকে নবনী উঠে বসল দ্রুত। ফেনায় আওয়াজ হল। চড়চড়, চড়চড়। বিস্ফারিত চোখে সে তাকাল চার পাশে নেই, কোথাও নেই তার তোয়ালে। তার আবরু! কে সরিয়ে নিয়েছে?

জলের মধ্যে বসেই নবনী বুঝতে পারে তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে চলেছে। সেই স্রোত জলের থেকেও ঠান্ডা। সে কী করবে এখন? হাত দুটো নগ্ন বুকে ঢাকা দিয়ে চিৎকার করে উঠবে? এই দশতলার ফ্ল্যাট থেকে কে শুনবে সেই চিৎকার? সিলিং-এর কাছের আধখোলা ওই জানলা দিয়ে আওয়াজ কি বেরোবে?

খড়কুটো চেপে ধরার মতো করে নবনী মুখ তুলল জানলার দিকে। এবং তখনই দেখতে পেল।

চ্যাপটা মুখ। পিচের মতো ঝকঝকে কালো ও মসৃণ। ছোট ছোট চোখ দুটো কংক্রিটের মতো কঠিন, নিষ্প্রাণ, তবু যেন জ্বলছে! হাসছেও! হাসছে কি? মুখের অন্ধকার থেকে লকলকিয়ে বেরিয়ে আসছে জিভ। লাল জিভ। সেই জিভ মাঝখান থেকে চেরা। সাপের মতো চেরা। জানলার ফাঁক দিয়ে পিছলে গলে আসা কালো শরীরটা দুলছে, ভাসছে, শূন্যেই এঁকেবেঁকে পাক মারছে। যেন বাঁক ঘুরছে ফ্লাইওভারের মতো!

কখন, কীভাবে বাথরুম থেকে বেরোল মনে নেই নবনীর। সে কি তার তোয়ালে খুঁজে পায়? নাকি নগ্ন হয়েই বেরিয়ে আসে? বাইরে এসে তথাগতকে ফোনে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘চলে এসো। প্লিজ বাড়ি ফিরে এসো। এখনই।’

লিফ্‌ট দিয়ে নামতে নামতে ডাক্তার চৌধুরী বললেন, ‘নার্ভাস ব্রেকডাউন। চিন্তার কিছু নেই। অনেক সময় এরকম হয়। যা দেখে ভয় পাওয়ার নয় তাই দেখেও মানুষ ভয় পায়। দু’দিন বিশ্রাম করলে ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ দিয়েছি। এখন ঘুমোবে। কাল একটা রিপোর্ট করবেন।’

‘আর ওই দাগগুলো?’ তথাগত গলা নামিয়ে বলে, ‘ওই যে বুকের পাশে, উরুতে। আঁচড়ের মতো। নবনী বলল, তলপেটেও নাকি ফিল করেছে। দাঁত দিয়ে কামড়ের মতো অনুভূতি।’

ডাক্তার চৌধুরী সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘ভয়টা চেন রি-অ্যাকশনের মতো হয়েছে। একটা মনের ভুল থেকে আর একটা মানের ভুল। ব্যাপারটা এরকম কিছু নয়। বাথরুম থেকে ছুটে বেরিয়ে আসার সময় ধাক্কা লেগেছে আপনার মিসেসের। বাথটবের কোণে, বেসিনে অথবা দরজার হাতল। কেটে ছড়ে গেছে। অ্যান্টিসেপটিক ইজ এনাফ।’

এতক্ষণ পরে তথাগত হাসল। বলল, ‘ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু। অনেক ধন্যবাদ। নবনী এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।’ ডাক্তারবাবু গাড়ির দরজা খোলার আগে তথাগতর হাতটা একটু ছুঁলেন। বললেন, ‘না না, ভয়ের কিছু নেই। ভয়ের কী আছে?’

তীব্র তেষ্টা নিয়ে তথাগতর ঘুম ভাঙল। কিন্তু চোখ খোলবার পর সে বুঝতে পারল, তেষ্টা নয়, তার ঘুম ভেঙেছে ভয়ে। অজানা এক তীব্র ভয়ে। মনে হচ্ছে, ইট পাথর কংক্রিটের ভারী শরীর নিয়ে কে যেন বুকে ঘষটে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। নিয়ে আসছে রেলিং টপকে, বারান্দা পার করে। ধারালো ও গা-ছমছমে আওয়াজ তুলে।

পিচের কড়া গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে তথাগতর।

আনন্দবাজার, রবিবাসরীয়, ২০০৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *