নেতা
তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে বিশ্বনাথের। অথচ এরকম হওয়ার কথা নয়। তার সামনেই টেবিলের ওপর কাচের গেলাস। তাতে জল টলটল করছে। গেলাসের ওপর ঘন নীল রঙের ঢাকনা। ঢাকায় সাদা পাল তোলা জাহাজের ছবি। ঢাকনা সরিয়ে গেলাসটা মুখে তুললেই তেষ্টার সমস্যা মিটে যায়। বিশ্বনাথ মাঝেমধ্যে গেলাসের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু তুলছে না। তুলছে না অন্য কোনও কারণে নয়, আসলে তার কিছুতেই মনে পড়ছে না, ঠিক কী করলে তেষ্টা মেটে। অনেক ভাবছে। তবু মনে পড়ছে না। মানুষের তেষ্টা মেটে কীভাবে? এক মুঠো ঘাস চিবালে? গলা খুলে গান গাইলে? নাকি খানকতক ডিগবাজি খেলে? এরকম হাজারটা হাবিজাবি জিনিস মনে পড়ছে, কেবল জল খাওয়ার কথাটা মাথায় আসছে না।
অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে পড়লে অনেক সময় এরকম হয়। যেটা দরকার সেটা কিছুতেই মাথায় আসতে চায় না। আলতুফালতু জিনিস মাথায় ঘুরপাক খায়। বিশ্বনাথের আজ তাই হয়েছে। এই মুহূর্তে সে অতিরিক্ত নার্ভাস। তেষ্টার সঙ্গে তার হাঁটু কাঁপাও শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বনাথ টেবিল থেকে হাতদুটো সরিয়ে হাঁটুর ওপর রাখল।
মলিনবাবু চেয়ারে হেলান দিলেন। ফতুয়ার পকেট হাতড়ে ছোট্ট একটা কৌটো বের করলেন। লম্বা ধরনের কৌটো। দেখতে সুন্দর। শুধু সুন্দর নয়, দামিও। জয়পুরের ওরিজিনাল জিনিস। পুরোটা কাঠের। মাথার কাছের ঢাকনায় হালকা রুপোর টাচ আছে। সিলভার লাইন। অল্প টান দিতেই ঢাকনা খুলে যায়। ভেতরে সারি দিয়ে সাজানো খড়কে কাঠি। মলিনবাবু অতি যত্নে একটা কাঠি বের করে মুখে পুরলেন এবং সন্তর্পণে দাঁত খুঁটতে শুরু করলেন। এই সময়টায় সাধারণত আমেজে মলিনবার একটা চোখ আধখানা বুজে থাকে। আজ দুটো চোখই আধবোজা। এর মানে আরাম বেশি হচ্ছে।
এক-একজন বড় মানুষের এক-এক রকম শখ থাকে। কারও বই পড়া, কারও গান শোনা, কেউ আবার বাগান করে। নেতা মলিনবাবুর শখ হল দাঁত খোঁটা। রাজনৈতিক জীবনের একেবারে প্রথম পর্যায়ে এই কাজে তিনি ব্যবহার করতেন দেশলাই কাঠি। বারুদের দিকটা পট করে ভেঙে ফেলে দিতেন, বাকিটা দু’আঙুলে ধরে পুরে দিতেন মুখে নিঃশব্দে। তারপর এল আলপিন। আলপিন অবশ্য বেশিদিনের জন্য নয়, মাঝখানে কিছু দিনের জন্য। সেটা ছিল খুবই টেনশনের একটা সময়। পার্টিতে তখন নিজেদের মধ্যে মারাত্মক লেঙালেঙি চলছে। একেবারে হার্ড টাইম বলতে যা বোঝায়। যায় যায় অবস্থা। সেই টেনশন পিরিয়ড কাটলে দেখা দিল প্লাস্টিকের টুথপিক। ততক্ষণে পার্টিতে একটা জায়গা হয়ে গেছে। প্লাস্টিকের টুথপিক বেশ পছন্দের ছিল মলিনবাবুর। জিমন্যাস্ট করা মেয়ের মতো। হিলহিলে পাতলা শরীর। বেঁকিয়ে চুরিয়ে ইচ্ছেমতো খেলানো যায়। এখন চলছে পাতলা কাঠের শৌখিন জিনিস। ডগায় নকশা, শেষে নকশা। মলিনবাবুর ইচ্ছে আছে, গোটা বিষয়টা চন্দন কাঠের দিকে নিয়ে যাওয়ার। বছরে দু’বার মাইশোর থেকে আসবে। প্যারিসের শ্যাম্পেন, হাভানার চুরুটের মতো মাইশোরের দাঁত খড়কে।
মলিনবাবু চোখ খুললেন। বিশ্বনাথের দিকে তাকালেন। না, গণেশ কাজটা খারাপ করেনি। সত্যি লোকটার সঙ্গে তার চেহারার মিল আছে। অল্প মিল নয়, বেশ অনেকটাই মিল। হাইটটা প্রায় সমান। গায়ের রংও কাছাকাছি, কালো। চোখের চাউনিতে মিল না থাকলেও লম্বা নাক আর নাকের পাশের আঁচিলটায় মিল আছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো চশমা পরলে চট করে বোঝা কঠিন। না, গণেশ একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। এতটা মিলের দরকার ছিল না। মলিনবাবু খুশিতে সামান্য হাসলেন। বললেন, ‘কী পারবেন না?’
বিশ্বনাথ ঢোঁক গিলল। সামনের মানুষটা কোনও রাম-শ্যাম মানুষ নয়, নেতা মানুষ। নেতা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু হলেও হাসছে। উত্তরে তারও হাসা উচিত। বিশ্বনাথ হাসল। কিন্তু গলা শুকিয়ে যাওয়ার কারণে সেই হাসি হাসির মতো হল না। উলটে মুখে একটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভয় করছে স্যার।’
মলিনবাবু খুশি হলেন। রাজনৈতিক জীবন তাঁকে শিখিয়েছে উলটো দিকের মানুষের ভয় থাকা ভাল জিনিস। অ্যাশট্রেতে খড়কে কাঠি ফেলে বললেন, ‘ভয়! দূর, ভয় কীসের? আমি আছি না? ভাই, আপনি কী করেন?’
বিশ্বনাথ একই ভাবে বিড়বিড় করে বলল, ‘কিছু করি না স্যার। দু’বছর আগে কারখানা…।’
মলিনবাবু আরও খুশি হলেন। এত বড় একটা মানুষ কিছু করে না মানে খুবই ভাল। কিছু না করা মানুষ সর্বদা একটা অস্থিরতার মধ্যে থাকে। এদের কথা শোনাতে সুবিধে হয়, খরচ কম লাগে। গণেশ কাজটা করেছে চমৎকার। শুধু প্রক্সি দেওয়ার জন্য একই রকম দেখতে লোক ধরে আনেনি, খরচাপাতির দিকটাও খেয়াল রেখেছে। ছেলেটা গুণী।
মলিনবাবু মুখে চুকচুক আওয়াজ করে বললেন, ‘আহা, এই বাজারে কিছু না করাটা খুবই বিচ্ছিরি ব্যাপার। কী বলব ভাই, দেশে সমস্যা তো এই একটাই। সব আছে, শুধু করার কিছু নেই। যাক, বাড়িতে কে কে আছে? বিয়ে-থা হয়েছে?’
এতক্ষণ পরে বিশ্বনাথ একটু উৎসাহ পেল। ভাল করে মুখ তুলে বলল, ‘স্যার, স্ত্রী আছে। মেয়ে ফুলি আছে। ভাল নাম ফুলেশ্বরী। ক্লাস ফোরে পড়ছে।’
মলিনবাবু দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন। লোকটা শুধু সস্তা নয়, বোকাও। বোকা লোকরাই আগ বাড়িয়ে ছেলে-মেয়েদের নাম বলে। চেয়ারটা পিছনে ঠেলে বললেন, ‘গণেশ নিশ্চয় আপনাকে কাজটা বুঝিয়ে দিয়েছে?’
বিশ্বনাথ চুপ করে রইল। বড় মানুষদের কাছে খানিকক্ষণ বসলে সাহস বাড়ে। তার বাড়ছে না। বরং উলটো হচ্ছে। একটু আগে হাঁটু কাপছিল, এখন মনে হচ্ছে গোটা পা-টাই কাঁপছে। বলল, ‘স্যার, আমি বোধহয় পারব না। আগে কখনও তো এরকম কিছু করিনি।’ কথাটা বলে বিশ্বনাথ বুঝতে পারল, শুধু শরীর নয়, তার গলাও কাঁপছে।
মলিনবাবু ভুরু কোঁচকালেন। তিনি জানেন, এইসময় কী করা উচিত। এই ‘পারব না, করব না’ অসুখের সহজ ট্রিটমেন্ট আছে। খুব জোরে একটা ধমক দিতে হয় সেই ধমকে ‘চোপ’ যেমন থাকবে তেমনই ‘শুয়োরের বাচ্চা’ও রাখতে হবে। ধমক শেষে মিটিমিটি হেসে বলতে হবে, ‘ভাই, এক গেলাস শরবত দিতে বলি? আমের শরবত। খারাপ কিছু না। হোম মেড। খাবেন এক গেলাস?’
কিন্তু এই লোককে ট্রিটমেন্টটা দেওয়া ঠিক হবে না। গাধাটা ঘাবড়ে যাবে। তাকে যে কাজটা দেওয়া হচ্ছে সেটা কঠিন এবং গোলমেলে। ঘাবড়ে গেলে সমস্যা হতে পারে। তা ছাড়া লোকটা ভয় পেয়ে চলে গেলে মুশকিল। এই মুহূর্তে এত কাছাকাছি দেখতে আর একজনকে পাওয়া যাবে না। একে অন্যভাবে সামলাতে হবে।
‘দেখুন কী কাণ্ড। এখনও আপনি ভয় পাচ্ছেন? ছি ছি। আরে বাবা, আগে করেননি তো কী হয়েছে? এখন করবেন। কখন কে কী করে তা কি আগে থেকে বলা যায়? এই তো আমার কথাই ধরুন না ভাই। ধরুন আমার কথা। কী ছিলাম আর কী হলাম। একটা সময় করতাম ভাঁড় ডিউটি!’
বিশ্বনাথ জামার হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। অস্ফুটে বলল, ‘ভাঁড় ডিউটি।’
মলিনবাবু কৌটো খুলে আর একটা কাঠি বের করলেন। গুড। প্রশ্ন করা মানে লোকটা সহজ হচ্ছে। বড় করে হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাঁড় ডিউটি। সে একটা সময় ছিল বটে। খতরনাক সময়। সবে কলেজে ঢুকেছি। বাবা বলল, ওনলি লেখাপড়ায় কিস্যু হবে না। পকেটে গাদাখানেক সার্টিফিকেট নিয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবি। সাইড়ে একটা কিছু কর। তারপর থেকেই ছোঁকছোঁক শুরু করলাম। পার্টিতে এন্ট্রি নেব। কিন্তু নেব বললেই কি নেওয়া যায় ভাই? সেটা এখনকার মতো সময় ছিল না। ভেরি হার্ড টাইম। খুব কঠিন সময়। পার্টিতে চলছে পুনুদা আর দিনুদার জমানা। আমরা আড়ালে বলতাম ‘নুনু এরা’। বাংলায় যাকে বলে ‘নুনু জমানা’। পুনুদার ‘নু আর দিদার নু’। দুইয়ে মিলে… হা হা। আমাদের তখন কাজ ছিল, ভাঁড়ে ওদের চা সাপ্লাই করা। সেই চা খেতে খেতে হারামজাদারা মিটিং করতেন। দেশ দশের কথা ভাবতেন। তখন কি ভাই জানতাম আমিও একটা নেতা হয়ে যাব? জানতাম আমি? ভাঁড় থেকে একেবারে… হা হা। তাই বলছি, আপনারও কী হবে ঠিক নেই। যা খুশি হতে পারে। বলা যায় না, আপনিও হয়তো… নিন, এসব ফালতু চিন্তা ছাড়ুন। কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ুন ভাই। শান্তভাবে কাজটা সেরে আসুন।’
বিশ্বনাথের তেষ্টা বাড়তে বাড়তে একটা জায়গায় এসে থম মেরে গেছে। এখন আর অত কষ্ট হচ্ছে না। সে জল-ভরা গেলাসের দিকে তাকাল। ঢাকনার ছবিটা চমৎকার। পুরনো দিনের গল্পের বইতে আঁকা ছবির মতো। কাঁচা হাতের ছবি। হয়তো সেই কারণেই বেশি ভাল লাগছে। ছবিটা ফুলিকে দেখতে পারলে হত। মেয়েটা একদম ছবি আঁকতে পারে না। ক্লাসের ড্রইং পরীক্ষায় একশোতে দুই পেয়ে সেদিন বাড়ি ফিরল। মালতী আজকাল সব সময় রেগে থাকে। সেদিন অবস্থা আরও ভয়ংকর হল। আঁকার পরীক্ষায় দুই পাওয়ার অপরাধে সে তার মেয়েকে কঠিন শাস্তি দিল। সারা দুপুর ছোট্ট ফুলিকে বারান্দায় বসে ছবি আঁকতে হয়। এক হাজারটা গোল আর এক হাজারটা চৌকো। ছবি আঁকা একটা দারুণ আনন্দের বিষয়। অথচ ফুলি সেদিন ছবি আঁকছিল “হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে। চোখের জলে তার ফ্রকের হাতা ভিজে যাচ্ছিল। বিশ্বনাথের খুব ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে গিয়ে কোলে তুলে নেয়। চোখের জল মুছিয়ে দেয়। নিজের মেয়েকে কোলে তুলে চোখের জল মুছিয়ে দেওয়া কঠিন কোনও কাজ নয়। অতি সহজ কাজ। কিন্তু এই সহজ কাজে সেদিন সাহস পায়নি বিশ্বনাথ। দীর্ঘদিন রোজগার না থাকলে বোধহয় এরকমই হয়। মানুষ অতি সহজ কাজের সাহসও হারিয়ে ফেলে।
এখান থেকে যাওয়ার সময় ফুলির জন্য জলের ঢাকনাটা চেয়ে নিয়ে গেলে কেমন হয়?
মলিনবাৰ গলা খাঁকারি দিলেন। না, এবার একটু কড়া হওয়া দরকার। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘কী হল? এখনও ভাবছেন? আপনাকে তো ভাই এখানে কবিতা লিখতে ডাকা হয়নি যে অনেক ভাবাভাবি করতে হবে। কাজ করার আগে যারা এত ভাবে তাদের আমি পছন্দ করি না। এবার আসল কথায় আসুন। কাজ করবেন টাকাপয়সা বুঝে নিয়ে চলে যাবেন। ব্যস, মিটে গেল। গণেশ আপনাকে সব বলে দিয়েছে তো?’
মলিনবাবুর চেবানো গলা শুনে বিশ্বনাথ সামান্য চমকে উঠল। মাথা নাড়ল। ‘সব’ কিনা জানা নেই, তবে গণেশ তাকে অনেক কথাই বলেছে। গণেশকে এই এলাকার সবাই বুঝেশুনে চলে। তার মোটরবাইক আছে, গলায় সোনার চেন আছে। সেই সোনার চেন আঙুলে পাকাতে পাকাতে হেসে হেসে কথা বলে। আঙুলে চেন পাকানোর মানে গণেশ হুমকি দিচ্ছে। হাসির সঙ্গে হুমকি মেশানোর কাজে গণেশ একজন ওস্তাদ ছেলে। সেই গণেশ সেদিন মোটরবাইক থেকে নেমে বিশ্বনাথের হাত ধরে রাস্তার ধারে টেনে নিল। গলা নামিয়ে বলল, ‘এই যে তোমাকেই খুঁজছি বিশুদা। একটা কাজ আছে। ভাল পেমেন্ট। গুরুর নিজের কাজ। পার্সোনাল আর কনফিডেনশিয়াল। জানো তো, দাদার এবার ইলেকশনে টিকিট পাওয়ার হাই চান্স? সুতরাং কপাল ঠুকে জয়গুরু বলে ঝুলে পড়ো মাইরি। ফ্যা ফ্যা করে অনেক দিন ঘুরছ। এবার তোমার একটা হিল্লে হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।’
বিশ্বনাথ ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কাজটা কী গণেশ।’
গণেশ মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে কনুই রেখে চোখ টিপল। বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে গলার হার পেঁচাতে পেঁচাতে হেসে বলল, ‘প্রক্সি। আমাদের নেতার প্রক্সি দিতে হবে তোমাকে। সেজেগুজে গিয়ে বলতে হবে, বন্ধুগণ আমিই মলিন সরখেল। আপনারা কেমন আছেন? ভাল আছেন তো? বুঝলে?’
‘নেতার প্রক্সি!’ বিশ্বনাথ চমকে উঠল। সে ঠিক শুনছে তো?
গণেশ চোখ নাচিয়ে বলল, ‘কত জনের ভাগ্যে এই চান্স জোটে? আমার তো হিংসে হচ্ছে মাইরি। আমি দাদাকে জিগ্যেস করলাম, কীরকম মিল চাই? দাদা বলল, বেশি চাই না, অল্প হলেই চলবে। ওই গন্ডগ্রামে আমি কোনওদিন যাইনি, আমাকে কেউ চেনেও না। সুতরাং বেশি মিল দিয়ে কী হবে? তুই খুঁজে দেখ। আমি তো এক বুক জলে পড়ে গেলাম। নেতার যমজ কোথায় পাই শালা? হঠাৎ তোমার কথা মনে পড়ল। তোমার নাকের পাশের আঁচিলটা চোখে ভেসে উঠল।’
‘না না, আমাকে ছেড়ে দাও গণেশ। আমি এসব পারব না।’
গণেশ বিরক্ত গলায় হিসহিস করে বলল, ‘আরে! মামদোবাজি নাকি? পারব না বললেই হবে? এত কষ্ট করে খুঁজে বের করলাম, এখন বলছ পারব না? এলাকায় থাকো, এলাকার লিডারকে সাহায্য করা তো তোমাদের কর্তব্য বিশুদা। ইচ্ছে না থাকলেও করতে হবে। তা ছাড়া ফ্রি-তে তো আর করছ না। যাক, ছাড়ো ওসব। মন দিয়ে শোনো, আমরাই গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব। সকাল সকাল বেরোবে। গ্রামের নাম সাহেবপুর। হাইওয়ে থেকে একটু ভেতরের দিকে। যাওয়া-আসাই যা সময়। স্পটে ম্যাক্সিমাম দশ-পনেরো মিনিট। ব্যস। কাজ শেষ। ফিরে এসে পেমেন্ট বুঝে নেবে।’
বিশ্বনাথ আমতা আমতা করে বলল, ‘কাজটা কী?’
গণেশ ফস করে একটা সিগারেট ধরাল। এক-মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব আলোচনা না করাই ভাল। তবু ছোট করে বলে রাখছি। সাহেবপুর গ্রাম এখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা চারেক হবে। বোম্বে রোড জ্যাম থাকলে একটু বেশি। তিন দিন আগে সেখানে বলাই নামে একজন অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। তুমি মলিনদা সেজে সেখানে যাবে। তার ফ্যামিলির কাছে গিয়ে মালাফালা দিয়ে আসবে। ছোট কাজ।’
‘মারা গেছে!’ রোদের মধ্যে দাঁড়িয়েও বিশ্বনাথের কেমন শীত শীত করে উঠল।
‘আস্তে, চিল্লিয়ো না! চুপ করে বাকি কথাটা শুনে রাখো। হারামজাদা বলাইটা মাস তিনেক হল গুরুর কাছে আসা-যাওয়া শুরু করেছিল। লোকটার ড্রাগ আর মেয়েছেলে পাচারের কারবার ছিল। দাদা একদিন বলল, বুঝলি গণেশ, ভাবছি, সাহেবপুরে পলিটিক্যাল বেস করব। একদিন গেলে কেমন হয়? অজ গাঁ। কোনওদিন নিতাটেতা নাকি দেখেনি। তখনই বুঝলাম, ক্যাচাল হচ্ছে। তার দু’দিন পরেই এই কাণ্ড। বোম্বে রোডে বলাইয়ের মোটরবাইকে ট্রাকের ধাক্কা। বলাই ফিনিশ। মনে মনে ভাবলাম, ল্যাঠা চুকে গেল।’
ফিনিশ! বিশ্বনাথ গণেশের মোটরবাইকে একটা হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাই গণেশ, আমাকে ছেড়ে দাও ভাই।’ নার্ভাস হয়ে পড়ার কারণে পুরো কথাটা বিশ্বনাথের মুখ দিয়ে বের হল না। শুধু শোনা গেল, ‘ভাই, ভাই…।’
‘না, ল্যাঠা চুকল না। সাহেবপুরে ছড়িয়েছে, এটা নাকি অ্যাক্সিডেন্ট নয়। মার্ডার, খুন। মলিন সরখেল লোক দিয়ে বলাইকে খুন করিয়েছে। গাঁয়ের লোকগুলো কত বড় শুয়োরের বাচ্চা একবার ভেবে দেখো।’
‘খুন!’ বিশ্বনাথ ঠিক বুঝতে পারছে না কী করবে? ছুটে পালাবে? ছুটে পালালে কি গণেশের হাত থেকে বাঁচা যাবে?
‘হ্যাঁ খুন। হারামজাদারা বলছে, বলাইয়ের ব্যাবসায় নাকি দাদা গোপনে টাকা ঢালছিল। তাই নিয়ে গোলমাল। দাদা ট্রাক দিয়ে মেরে দিয়েছে। বোঝো মাইরি, ট্রাক দাদার হতে পারে, কিন্তু সে কি আর ইচ্ছে করে মারবে? আসলে কনস্পিরেসি। দাদা যাতে এবার ইলেকশনে টিকিট না পায় তার জন্য চক্রান্ত।’ গণেশ একটু থামল। আর-একটা সিগারেট ধরাল। একটা টান দিয়ে ফেলে দিল। বলল, ‘যাক, এখন দাদা বলছে, এরকম একটা ক্রুশিয়াল সময়ে এ ধরনের নোংরা অভিযোগ টিকিয়ে রাখা ঠিক হচ্ছে না। সাহেবপুরে একবার যাওয়া দরকার। নইলে এখানকার লোকদের সন্দেহ আরও বাড়বে। এরপর বউটা থানায়-ফানায় কমপ্লেন করে দিলে ঝামেলা আছে। পার্টিতে খবর যাবে। ইলেকশনে দাঁড়ানো চৌপাট হয়ে যাবে। তাই আগে থেকে একটা গার্ড দেওয়া আর কী। বুঝলে বিশুদা?’ এই পর্যন্ত গম্ভীর মুখে বললেও গণেশ এবার হাসল। হেসে বলল, ‘তবে আমরা কোনও রিস্ক নিতে রাজি নই। ফট করে যদি বিক্ষোভ টিক্ষোভ হয়! সাহেবপুরের এই যাওয়াটা কিন্তু আসল লোকের হবে না। তাই যাবে একজন ফল্স লোক। নেতা মলিন সরখেলের প্রক্সি। সুতরাং রেডি হও বিশুদা।’
মলিনবাবু বিরক্ত মুখে উঠে পড়লেন। অনেক হয়েছে, আর নয়। একটা সামান্য কাজে এত সময় নষ্ট করলে চলবে না। সম্বোধন পালটে বললেন, ‘যা বলছি মন দিয়ে শুনে নাও বাপু। একবারই বলব। হাতে সময় নেই। কাল সকালেই তুমি ওই সাহেবপুরে যাচ্ছ। প্রথমে ভেবেছিলাম, সঙ্গে গণেশকে দেব। পরে ভেবে দেখলাম, দরকার নেই। গাঁয়ের লোকগুলো মূর্খ হয়। ভাববে ভয় পেয়েছে। তুমি একাই যাবে। বাড়িতে কাচা পাজামা-পাঞ্জাবি আছে? সাদা ঠিক আছে, রাতে গণেশ তোমাকে পৌঁছে দেবে। মাপটা বলে যাবে। গাড়িটা একটু দূরে রাখবে। গরিব মানুষগুলো বোকা হয়। শোকের সময় মাথার ঠিক থাকে না। গাড়ি-টাড়ি দেখলে রেগে যেতে পারে। স্পটে খুব বেশি হলে থাকবে দশ মিনিট। পৌঁছেই সোজা ভিক্টিমের বাড়ি। চোখে যেন সানগ্লাস থাকে। সানগ্লাস আছে? ঠিক আছে, গণেশ পৌঁছে দেবে। কথা কম বলবো একেবারে না বলতে পারলে সবথেকে ভাল। গাড়িতে একটা প্যাকেট থাকবে। প্যাকেটে থাকবে একটা সাদা কাপড়, একটা মালা আর একটা মিষ্টির বাক্স। জিনিসগুলো ভিক্টিমের বউয়ের হাতে দেবে। যদি ওই বলাই লোকটার কোনও ছবিটবি দেখতে পাও, মালাটা ছবিতে দিয়ে দেবে। দিয়ে প্রণাম করবে। না পেলে নয়। আর এই একশো টাকার নোটটা রাখো। বলাইয়ের বউকে দিয়ে বলবে, বাচ্চাদের জন্য দিলাম। বেশি দিতে পারতাম। দেব না। হারামজাদারা ভাবতে পারে টাকা ছড়াচ্ছি।’
মলিনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বনাথেরও উচিত উঠে দাঁড়ানো। তবু সে চুপ করে বসে আছে। ফুলি, ফুলির ছবি, ফুলির কান্না এরকম হাজারটা আলতুফালতু কথা তার মনে আসছে। এই সময় যে সব কথা মনে আসার কোনও দরকার নেই, সেই সব কথা। শুধু উঠে দাঁড়ানোর কথাটা মনে আসছে না!
মলিনবাবু টেবিলের এ পাশে এলেন। বিশ্বনাথের কাঁধে হাত রাখলেন। বড় ধরনের হুমকি দেওয়ার সময় এটাই নিয়ম। আগে স্নেহ দেখাতে হয়। হাসিমুখে বললেন, ‘কী যেন নাম তোমার ভাই? যাঃ ভুলে গেলাম। যাক, যে নামই হোক, নামে কী আসে যায়? কিছু আসে যায় না। কাল যত রাতই হোক, কাজ শেষ করে তুমি আগে আমার কাছে আসছ। একটা মোবাইল ফোন তোমাকে দিতে পারতাম। তা হলে টেনশন থাকত না। দরকার নেই। মোবাইল ফোন জিনিসটা খারাপ কাজে ভাল নয়। ধরা পড়ে গেলে খুব ফাঁসিয়ে দেয়। রিস্ক নেব না। তুমি নিজেই আসবে। রিপোর্ট দেবে। ভাই মনে রেখো, আমি কিন্তু চাই এই কাজটা ঠান্ডাভাবে হয়ে যাক। আগে পরে কেউ টের পাবে না। বউ মেয়ে নিয়ে তোমাকে এখানেই তো থাকতে হবে। কী, থাকতে হবে তো? সেটা মনে রেখো। বাড়ির লোকের কথা ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। দেখো কাণ্ড! তোমার নাম ভুলে গেলেও তোমার মেয়ের নামটা কিন্তু মনে আছে। ফুলেশ্বরী। চমৎকার নাম। একদিন ফুলেশ্বরীকে নিয়ে আমার কাছে আসবে। এই নাও, এক হাজার টাকা রেখে দাও। বাকিটা কাল পাবে। আমি অ্যাডভান্স দিয়ে কাজ করা পছন্দ করি।’
২
এই টেবিল ল্যাম্পটার একটা মজা আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। মলিনবাবু এটা নিজে পছন্দ করে কিনেছেন। রাত দশটার পর ঘরে শুধু এই আলোটা জ্বলে। বাকি সবকিছু কেমন ছায়া ছায়া লাগে। অন্ধকারের ছায়া। এখনও লাগছে। টেবিলের ও পাশে বসে থাকা গণেশকে ছায়ার মতোই মনে হচ্ছে।
মলিনবাবু খড়কে কাঠিটাকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিস করে বললেন, ‘তারপর? তারপর কী হল?’
গণেশ এখনও মুখ নামিয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই বলল, ‘তারপর ওই মহিলাই বিশুদাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করল।’
‘কোন মহিলা?’ মলিনবাবু ভুরু কুঁচকোলেন।
‘ওই যে, বাদলের বিধবা বউটা।’
‘কেন মারধরের সময় মেয়েছেলেটা ছিল না?’
গণেশ এবার মুখ তুলল। বলল, ‘আমি যতদূর শুনেছি, ছিল না। গাড়ির ড্রাইভার সেরকমই বলেছে। ওরা ততক্ষণে বিশুদাকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সামনের দিকে কয়েকজনের হাতে বাঁশ ছিল।’
মলিনবাবু সামান্য শিউরে উঠলেন। দাঁতে ধরা কাঠিটা ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘বাঁশ ছিল!’
গণেশ কাঁপা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, বাঁশ ছিল। ড্রাইভার এত ভয় পেয়ে যায় যে পালাবার কথাও ভুলে যায়। বেশি ভয় পেলে…’
মলিনবাবু নড়েচড়ে বসলেন। গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, ‘লোকগুলো মুখে কিছু বলছিল?’
গণেশ চুপ করে রইল।
মলিনবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আঃ চুপ করে আছ কেন? কথা বলো। গাধাটাকে মারবার সময় পাবলিক মুখে কিছু বলছিল না? ওরা ঠিক কখন বুঝল লোকটা আসলে আমি নই, জাল, একটা ফ্ৰড?’
গণেশ ফিসফিস করে বলল, ‘বুঝতে পারেনি। মনে হয়, বুঝতে পারলে মারত না। বিশুদাকে বাঁশ দিয়ে পেটাবার সময় পাবলিক বারবার আপনার নাম করছিল দাদা। বলছিল… বলছিল…।’
‘কী বলছিল? থামলে কেন? বলো।’ হিমশীতল গলায় জিগ্যেস করলেন মলিনবাবু।
অন্ধকারে গণেশের আমতা আমতা গলা শোনা গেল। বলল, ‘বলছিল, মার শালা মলিনকে… মার… পিটিয়ে মেরে ফেল হারামজাদাকে। জামাকাপড় খুলে ন্যাংটো করে দে…।’
মলিনবাবু গায়ের আদ্দির ফতুয়াটা টেনেটুনে ঠিক করলেন। একটু হাসলেন। শুকনো হাসি। এরকম যে একটা কিছু হতে পারে সে ভয় ছিল। সেই কারণেই সাহেবপুরে নিজে না গিয়ে বানানো লোক পাঠানোর পরিকল্পনা। তবে এতটা হবে ভাবা যায়নি। বড়জোর গাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ টিক্ষোভ, গাড়ি ভাঙচুর। তা বলে একেবারে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা!
মলিনবাবু সামনে রাখা গেলাসের নীল ঢাকনা সরিয়ে জলে চুমুক দিলেন। জল বিস্বাদ লাগল।
গণেশ চাপা গলায় বলল, ‘আমরা এখন কী করব?’
গণেশ কি ভয় পেয়েছে? অন্ধকারের এই একটা সুবিধে। মুখ দেখে ভয়, সাহস কিছুই আলাদা করা যায় না। সৰ মুখই একরকম লাগে। ছায়া ছায়া।
মলিনবাবু কৌটো খুলে খড়কে কাঠি বের করলেন। মুখে পুরলেন। এখন কী করা উচিত? দু’দিকেই বিপদ। ওই বিশ্বনাথ লোকটা যদি হাসপাতালে টসকে যায়, ঘটনা পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে। কেন মরল? কে মারল? কোথায় মারল? খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ সাহেবপুর পর্যন্ত ছুটবে। আবার যদি না মরে, তা হলেও বিপদ। বেটা বেঁচে ফিরে সব বলে দিতে পারে। আর যদি ডাইং স্টেটমেন্টের মতো মারাত্মক কিছু দিয়ে বসে?
‘এই মুহুর্তে আমাদের কিছু করার নেই গণেশ। অপেক্ষা করতে হবে। হাসপাতালে কে কে আছে? তুমি গিয়েছিলে?’
‘পাগল! আমি কখনও ওদিকে যাই! অন্য লোক ফিট করে এসেছি। খবর দিচ্ছে।’ হাতের মোবাইলটা তুলে অন্ধকারেই দেখাল গণেশ।
মলিনবাবু চেয়ারটা সামান্য পেছনে ঠেলে বললেন, ‘কী খবর পেলে?’
‘বিশুদার বউ আর মেয়ে এখানে আছে। আর…।’
‘আর?’
গণেশ আর কে বলার আগে মলিনবাবুর মোবাইলটা বেজে উঠল। বিরক্ত মুখে ফোন কানে তুললেও তিনি কথা বললেন নরম গলায়।
কে বলছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ বলন ভাই। আরে না না, বিরক্ত হব কেন? খবরের কাগজের সাংবাদিক ফোন করলে কখনও বিরক্ত হতে পারি! এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য হা। হা। বলুন কী জানতে চান… না, না লোকটাকে আমি চিনি না। কী করে চিনব? আমার এলাকায় তো বিশ্বনাথ নামে কত লোক থাকে, ভেরি কমন নেম। তাই না? কী বললেন। আমি সেজে গিয়েছিল। আমি সেজে মানে মলিন সরখেল হয়ে? ইন্টারেস্টিং তো! বলছেন কী? হা হা। নেতা, মন্ত্রীর সই জাল হয় শুনেছি, এ তো দেখছি চেহারা জাল হয়েছে। বলেন কী ভাই! হা হা। অনেকটা আমার মতো দেখতে। হাইট, গায়ের রং মিলে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার দেখছি। হ্যালো, ভাই, আমার একটা উপকার করতে হবে কিন্তু। হাসপাতালের নাম আর বেড নাম্বার জানাতে হবে। আমি কাল একবার যাব। আসল নেতা যাবে নকল নেতার কাছে… হা হা। ফটোগ্রাফার পাঠাতে পারেন। হা হা। আচ্ছা, গুড নাইট।’
মোবাইল বন্ধ করে মলিনবাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ‘খবর ছড়াতে শুরু করেছে গণেশ। খবর ছড়াতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি বলো, হাসপাতালে আর কে আছে? পুলিশ কি পৌঁছেছে?’
‘না পুলিশ নয়। দাদা, অবাক কাণ্ড শুনলাম, বাদলের বউটাও হাসপাতালে রয়েছে। মেয়েছেলেটা খুব ছোটাছুটি করছে। ওষুধ, ডাক্তার, রক্ত…।’
মলিনবাবু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, ‘বাদলের বউ! তুমি ঠিক বলছ? ভুল হচ্ছে না তো গণেশ?’
‘আমার সোর্স তাই বলছে দাদা। ওর ভুল হবে না।’
মলিনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন চুইয়ে পড়া আলোর দিকে। শান্ত গলায় বললেন, ‘গণেশ, আমার ধারণা কাল সকালের আগেই পুলিশ চলে আসবে। তোমার ওই গাধাটা যদি হাসপাতালে আজ রাতেই মারা যায়, তা হলে একটা নয়, একসঙ্গে দুটো মার্ডার চার্জে জড়িয়ে পড়ছি আমি। আজ রাতেই এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। এখনই। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। পুরোটা যাবে না। একটা পার্টের পর আলাদা হয়ে যাবে। চট করে বাড়ি থেকে কয়েকটা কাপড় জামা নিয়ে এসো। আসবার সময় একটা ট্যাক্সি নিয়ে আসবে। ওটাতেই আমরা স্টেশন পর্যন্ত চলে যাব। আমি ততক্ষণে রেডি হয়ে নিচ্ছি।’ এতটা বলে মলিনবাবু একটু থামলেন। লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললেন, ‘সেদিন ট্রাকটা কে চালাচ্ছিল মনে আছে গণেশ? হামিদ নাঃ হামিদই তো। তাকে কি সরানো গেছে?’
গণেশও উঠে দাঁড়িয়েছে। কাঁপা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, গেছে। হামিদ এখন মুম্বইতে।’
মলিনবাবু হাতের কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন। গলা নামিয়ে বললেন, ‘গুড। ওকে ধরতে পুলিশের সময় লাগবে। তুমি দেরি কোরো না। আশা করি আজ রাতের মধ্যে লোকটার কিছু হবে না। তোমার কী মনে হয়?’
গণেশ অস্ফুটে বলল, ‘আমার কিছু মনে হয় না।’
৩
গণেশ কি একটু বেশি দেরি করছে? মনে হচ্ছে করছে। তার বাড়ি মোটরবাইকে সাত মিনিট। তা হলে? মোবাইলটাও বন্ধ করে দিয়েছে। মলিনবাবুর একটা হাত মুখের কাছে। তাতে ছোট্ট, পাতলা কাঠি ধরা। কাঠির ডগায় নকশা, শেষে নকশা। নিয়মমতো এইসময় তাঁর একটা চোখ আধবোজা থাকার কথা। কিন্তু এখন মলিনবাবু দুটো চোখই খুলে রেখেছেন। তাকিয়ে আছেন টেবিল ল্যাম্পের দিকে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এত বড় একটা ভুল করে মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন, তব রাখতে হবে। নেতা তৈরির পরিকল্পনাটাই সব গোলমাল করে দিল। এই ধরনের পরিকল্পনাতে ঝুঁকির দিকটাই যে বেশি, এটা বোঝা উচিত ছিল। হাসপাতালে একটা ফোন করলে কেমন হয়? লোকটা বেঁচে আছে কি? বেঁচে থাকলে আর একটু সময় পাওয়া যাবে। মজা হল, এ দেশে পুলিশ মরে যাওয়ার আগে নড়াচড়া শুরু করে না।
কলিং বেলের আওয়াজে মলিনবাবু চমকে উঠলেন না। গণেশ এসেছে। তাকে ধমক দেওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হলেন। এক হাতে পায়ের কাছে রাখা সুটকেসটা, আর অন্য হাতে টেবিলের ওপর রাখা তালা-চাবি নিয়ে উঠে পড়লেন। দ্রুত। টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে কয়েক-পা এগিয়ে দরজার লক খুললেন।
না গণেশ নয়।
তবে রাস্তার আধখানা আলোয় দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে চিনতে অসুবিধে হল মলিনবাবুর। প্রায় একই রকম লম্বা। কাঁধের কাছটা সেই চওড়া। কপালটা অনেকখানি। সামনের দিকের চুল পেতে আঁচড়ানো, ঠিক যেমনটি তাঁর নিজের। নিশ্চয় নাকের পাশে আঁচিলটাও আছে।
মানুষটার এক দিকে চোখ আধখানা বোজা। হাসল? মনে হয় হাসল। তারপর খসখসে আর জড়ানো গলায় বলল, ‘স্যার, চিনতে পারছেন? পারছেন না তো? আমার মেয়ের নাম স্যার ফুলি, ভাল নাম ফুলেশ্বরী…।’
মলিনবাবু চোখ তুললেন। লোকটার ডান হাতটা মুখের কাছে। সেই হাতে খড়কে কাঠিটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ওটা কী? রক্ত নাকি?
হ্যাঁ, রক্তই তো!
পুলিশ এল শেষ রাতে। হাসপাতাল থেকে বিশ্বনাথের মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নিয়ে। মলিন সরখেল তখন তাঁর বাড়ির সদর দরজার সামনে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছেন।
শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৩