কালবৈশাখী
আজকের দিনটা অন্যরকম।।
আমি ঠিক করেছি আজ বেরোব না। ছোট কাজ করি। ছুটিছাটা কম। যেটুকু আছে, তাও ফুরিয়ে গিয়েছে। এবার না গেলে মাইনে কাটবে। সে কাটুক। আমার খরচ কমে যাচ্ছে। একদিন কেন এখন তিনদিনের মাইনে কাটলেও কিছু এসে যাবে না। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর লম্বা ঘুম দেব। উঠব একেবারে সেই বিকেলে। রোদ পড়ে যাওয়ার পর। উঠে এক কাপ চা খাব। চা আমাকে নিজে করতে হবে। এটা একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। নিজে করা চায়ে স্বাদ হয় না। চা-পাতা দামি হলেও হয় না। আগের সিস্টেমে ফিরে যেতে হবে। ব্যাচেলর জীবনের সিস্টেম। সামনের চায়ের দোকানটার সঙ্গে চুক্তিতে যাব। বড় কাচের গ্লাসে পাউরুটির খালি প্যাকেট চাপা দিয়ে সকাল-বিকেল চা পাঠাবে। জানলার সামনে চেয়ার টেনে বসে তারিয়ে তারিয়ে খাৰ। সবসময় অবশ্য আমাদের ঘরের জানলার সামনে বসা যায় না। সমস্যা আছে। বসা যাবে কি যাবে না সেটা নির্ভর করে হাওয়া বাতাসের ভাইরেকশনের উপর। জানলার ঠিক উলটোদিকেই খোলা নর্দমা। হাওয়া যদি পুব দিক থেকে আসে তা হলে নির্ঘাত সে বিকট দুর্গন্ধ নিয়ে আসবে। হাওয়া উত্তর বা পশ্চিমমুখী হলে সে সমস্যা নেই। আবহাওয়া দফতরের জানলা খোলাবন্ধ সম্পর্কিত কোনও বুলেটিন হয় না। হলে বেশ মজা হত। টিভির নিউজ রিডার সকালবেলা বেশ গলা কাপিয়ে বলত, এবার শৌভিক ঘোষের জন্য আবহাওয়া দফতরের বিশেষ বুলেটিন। শৌভিকবাবু, আপনি সকাল আটটা থেকে দশটা এবং বিকেল তিনটে থেকে চারটে ছাপান্ন পর্যন্ত ঘরের জানলা…।’
আমি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি দুপুরবেলা ঘর অন্ধকার করে ঘুমোনোর মতো আরাম খুব কম জিনিসেই আছে। হট ফেভারিটের মতো এই আরাম আমার কাছে কোল্ড ফেভারিট। গরমকালে জানলায় পরদা টেনে ঘর অন্ধকার করে ফেলি। তারপর ফ্যান চালিয়ে, ঘর ঠান্ডা করে ঘুম মারি। এই কারণে কোল্ড ফেভারিট। আমার স্ত্রী পায়েল এই জিনিস একেবারেই সহ্য করতে পারে না। পিরবার কথাও নয়। কাজকর্মে না বেরিয়ে একটা সুস্থ-সবল লোক যদি দিনেরবেলা ঘরে শুয়ে ঘুমোয় কোনও স্ত্রীই সহ্য করবে না। এই যে আমার এত ছুটি খরচ হয়ে গিয়েছে সে এই বেটাইমে ঘুম-বিলাসের জন্য। প্রথম থেকেই পায়েলের ঘোর আপত্তি। যদিও ঘটনা সেরকম হওয়ার কথা ছিল না। বিয়ের প্রথম প্রথম মায়ের স্বামীকে সবসময় কাছে পেতে চায়। অসময়ের আদর সোহাগের নাকি স্বাদই আলাদা। রুটিনের বাইরের ব্যাপার। পরীক্ষার ভাষায় যাকে বলে ‘আনসিন’। স্বামী ভদ্রলোক যখন সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে অফিসে বেরোয়, তখন নতুন বউ নাক মুখ কুঁচকে বলে— আজ না গেলে হয় না উঁ উঁ… দেখো না উঁ উঁ … একটা ফোন করে দাও না উঁ উঁ…।’ সেই সময় বেচারি স্বামীর জুতো মোজা খুলে সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে পড়া ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। মিনমিনে কেরানি থেকে বাঘা বাঘা অফিসার নতুন বউয়ের কোঁচকানো নাক এবং উঁ উঁ’-তে কুপোকাত হবেই। পায়েলের ঘটনা সেরকম নয়। সে কড়া ধাঁচের মেয়ে। শরীরের প্রতি তার অতিরিক্ত যত্ন। যখন তখন ঝাপাঝাপি, লাফালাফি সে মোটে পছন্দ করে না। তার সবকিছু হিসাব করা। আমিও তাকে এই বিষয়ে কখনও জোরজবরদস্তি করিনি। ইচ্ছে যে হয়নি এমন নয়, তবে সাহস হয়নি।
প্রথম দিন আমাকে বাড়িতে দেখে ভুরু কুঁচকে পায়েল জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল, শরীর খারাপ? কাজে যাবে না?’
আমি আহ্লাদি গলায় বলি, ‘আজ আর কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না পায়েল। কতদিন দুপুরে রাইস স্লিপ দিই না।’
‘রাইস স্লিপ! সেটা আবার কী?’
আমি হাসি। বলি, ‘ভাতঘুম। তুমিও ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে ভাতঘুম দিতে পারো। দেবে?’
পায়েল আঁতকে ওঠে, “আমি দুপুরে ঘুমোব? খেপেছ? দুপুরে ঘুমোনো মানে পেটে চর্বি জমা। মা যদি জানতে পায় ভীষণ রাগ করবে।’
‘তোমার মা জানতে পারবেন কী করে? তিনি কি নিয়মিত তোমার স্বাস্থ্য চেক করেন?’
পায়েল অবাক হয়ে বলে, “ওমা! করবে না? বিয়ের পর মেয়ের শরীর স্বাস্থ্য কোনদিকে যাচ্ছে সব মা-ই নজর রাখে। একটু এদিক-ওদিক হলে এমন প্রশ্ন করবে না… বলবে, নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না।’
‘ঠিক আছে তা হলে তুমি ঘুমিয়ো না। মাকে রাগিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। জানলার পরদাঞ্জলি ভাল করে টেনে দিয়ে যাও।’
পায়েল মুখ ভেটকে বলে, ‘কোথায় যাব? ঘর তো একটা।’
আমি হাই তুলতে তুলতে বলি, ‘তাও তো বটে। দোকান টোকান ঘুরে আসবে? আজকাল কত সুন্দর সুন্দর সব দোকান বাজার হয়েছে।’
পায়েল অভিমানহত গলায় বলে, ‘দোকানে ঘুরতে টাকা লাগে। যে টাকা মাইনে পাও, তাতে সুন্দর দোকানে যাওয়া যায় না। মাসকারির বাজার করতে মাসে একবার মুদির দোকান যাওয়া যায়। তাও ধারে।’
‘তা হলে বরং বাপের বাড়ি ঘুরে এসো।’
এবার পায়েল ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। বলে, “থাক, আমি আমার ব্যবস্থা বুঝে নেব। তুমি বরং ঘুমোও।’
পরের দিকে পায়েল বিরক্ত হতে শুরু করল। বিরক্তি বাড়তে লাগল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলতে শুরু করল, “যে ব্যাটাছেলে দুপুরে বাড়িতে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয় তার কিস্যু হয় না।’
পায়েল খুব সুন্দরী। একটু সুন্দরী নয়, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ধরে যাওয়া ধরনের বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী। তার উপর আবার রেগে গেলে তার সৌন্দর্য দুদ্দাড় করে বাড়তে থাকে। এত বাড়ে যে তখন আর রূপ দেখার জন্য তার দিকে তাকাতে হয় না। এত সুন্দর বলেই আমি হুট বলতে পায়েলকে বিয়ে করেছিলাম। কোনও প্ল্যান ছিল না। বরং উলটোটাই ছিল। ভেবেছিলাম, সারাজীবন একা থাকব। কাজ যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকু করব, আর বাকি সময় উপুড় হয়ে ঘুমোব। কিন্তু সব গোলমাল করে দিল ছোটমামা।। ছোটমামা। থাকে কসবায়। একদিন অফিসে এসে হাজির। তখন টিফিন টাইম। অফিসের বাইরে চায়ের দোকানের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে মুড়ি আলুর চপ দিয়ে টিফিন করছিলাম। ছোটমামাকে দেখে ধড়ফড় করে উঠে দাড়ালাম। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আমার গার্জেন বলতে এই মানুষটাই। দেখা হয় কালেভদ্রে। কিন্তু দেখা হলেই মানুষটা বিরাট গার্জেনগিরি ফুলায়।
‘শরীরের এ কী হাল করেছিস বাবলু? ছি ছি। কণ্ঠার হাড় গোনা যাচ্ছে! ছি ছি। জামাকাপড়ে ইস্ত্রি নেই কেন? ইস। সকালে কী খেয়েছিস? ভেরি ব্যাড। তোকে যে এক পোয়া করে দুধ খেতে বলেছিলাম? খাচ্ছিস? নো নো, না না এভাবে চলতে পারে না। তুই বরং আমার এখানে চলে আয়। মামা-ভাগনে টিম করে থাকব। কালই চলে আয়।’
ধমক শুনতে আমার চমৎকার লাগে। অপরাধীর মতো মাথা নামিয়ে থাকি। যাদের কপালে গার্জেনের ধমক-ধামক জোটে না তারা জানে ধমক কত দামি জিনিস। পয়সা দিয়ে ভাব-ভালবাসা কেনা যায়, ধমক কেনা যায় না।
আমি বললাম, ‘ছোটমামা, মুড়ি খাবে?’
ছোটমামা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তুই কি রোজ টিফিনে মুড়ি খাস?’
‘রোজ খাই না। কোনওদিন বিস্কুট খাই। কোনওদিন আবার কিছুই খাই না।’
‘বাড়ি থেকে টিফিন আনতে পারিস না?’ ছোটমামা চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বলল।
আমি হেসে বললাম, ‘কী যে বলো ছোটমামা। বাড়ি থেকে টিফিন বানিয়ে আনব? একা মানুষ, বাড়িতে কতদিন খাওয়া-দাওয়াই হয় না।’
ছোটমামা নাক দিয়ে ‘হু’ ধরনের আওয়াজ করলেন। তারপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘চিন্তা করিস না। তোর টিফিন বানানোর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোর বিয়ে ঠিক করেছি।’
‘বিয়ে! ছোটমামা, আমি তো বিয়ে করব না ঠিক করেছি।’
ছোটমামা আমার কথা গ্রাহ্যই করল না। বলল, ‘তুই কী করবি, কী করবি না, সেটা তো তুই ঠিক করবি না, আমি ঠিক করব। ড্রেট ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। মেয়ের ফোটো এনেছি। তুই যদি চাস দেখতে পারিস। না চাইলেও কোনও সমস্যা নেই। আমি অরিজিনাল মেয়ে দেখে নিয়েছি।’
আমি আবার দোকানের বেঞ্চে বসে পড়লাম। বললাম, “ছোটমামা, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।’
‘তোকে বুঝতে হবে না। যা বোঝার আমি বুঝে নিয়েছি। পাত্রী আমার বাল্যবন্ধুর কন্যা। অতি সুশ্রী, সুলক্ষণা। ঘর সংসারের কাজ জানে। আমি গত পরশু নিজে তার হাতে তৈরি এঁচোড়ের ডালনা খেয়ে এসেছি। অতি উপাদেয় রান্না। তারপরই ফাইনাল করেছি। ভাগনেকে বেঁধে-বেড়ে খাওয়াতে পারবে কি না নিজে দেখে নেওয়া দরকার ছিল। দেখে নিয়েছি। ঠিক আছে, শুধু একটাই গোলমাল।’
‘আবার গোলমালও আছে!’ আমি কী বলব বুঝতে পারছি না।
ছোটমামা বললেন, অন্য কেউ হলে লুকোতে পারতাম, কিন্তু তোর বেলায় লুকোনো যাবে না। শুধু আমার নিজের ভাগনে বলে নয়, ইউ আর এ ভেরি গুড বয়। তোর কোনও লোভ নেই। এই সময় লোভহীন মানুষ আর পিস অফ ডায়মন্ডের ভ্যালু এক। এরকম একটা গুড বয়কে ব্যাড জিনিস গোপন করা ঠিক নয়।’
‘ব্যাড! কী ব্যাড ছোটমামা? মেয়ের কোনও খুঁত-টুঁত আছে?’
‘খুঁত কি না জানি না, মেয়েটি এক বখাটের পাল্লায় পড়েছিল। যতদূর শুনেছি বখাটের নাম অলয় না প্রলয়। বড়লোকের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। মেয়ে দেখলেই পিছনে ঘুরঘুর করে। তবে সে অধ্যায় সব চুকে বুকে গিয়েছে। দেখতে সুন্দর মেয়ের হাজার ঝামেলা। আমার বন্ধু তার মেয়েকে অনেক বুঝিয়েছে। মেয়ে বিয়েতে নিমরাজি হয়েছে। তারা আর এক মুহূর্ত দেরি করতে চায় না। আমাকে ঘটনা বলতে, আমি বললাম, আমার হাতে ছেলে আছে। সেই ছেলে পৃথিবীর প্রথম দশটা ভাল ছেলের একটা। তোমরা যদি বলো আমি দেখতে পারি। কিন্তু তার আগে মেয়ের হাতের রান্না টেস্ট করে নেব। বন্ধু বলল, কে টেস্ট করবে? ছেলে? আমি বললাম, না, আমি।’
কথা বলতে বলতে ছোটমামা চামড়ার ব্যাগ হাতড়ে পায়েলের ফটো বের করে আমার হাতে দিল। কিছু কিছু ঘটনা আছে যা মানুষের বোধবুদ্ধি ওলোটপালোট করে দিতে সময় নেয় না। পায়েলের কোটো আমার তাই করল। মাথা ঘুরিয়ে দিল। বুদ্ধিভ্রংশ হল। এমন সুন্দর একটা মেয়ে আমার স্ত্রী হলে!
ছোটমামা আর কিছু বলার আগেই আমি নির্লজ্জের মতো প্রশ্ন করলাম—‘ডেট করে ঠিক করেছ? আমার হাতে তো পয়সাকড়ি নেই। বিয়ের খরচখরচা বলে কথা।’
ছোটমামা নাক টেনে বলল, ‘পয়সাকড়ি লাগবে না। এখন বিয়েতে ঘটা করার দরকার নেই। ওই তালয় না প্রলয় যেন জানতে না পায়। বখাটে ছেলেরা সব কিছু করতে পারে। কাগজে দেখিস না? অ্যাসিড-ট্যাসিড ছুড়ে মারে, রিক নেব না। এখন নমো নমো করে বউকে নিয়ে ঘরে ঢুকে যা।’
‘ঘর তো ভাল না।’
ছোটমামা ধমক দিয়ে বলল, ‘তুই তো ভাল।’
সেই পায়েল আমার ঘুমের বহর দেখে যখন ঘোষণা করল কিস্যু হবে না’ তখন আমি বললাম, ‘কিছু হবে না কেন বলছ? হয়েছে এতে। আমার এমন সুন্দর বউ হয়েছে।’
পায়েল ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ‘সুন্দর বড় ধরে রাখবার মুরোদ আছে তো? দেখো, ফসকে না যায়।
আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারি রাগে পায়েলের গাল লাল হয়ে গিয়েছে। তাকে আরও চমৎকার লাগছে। মনে মনে স্ত্রীর রূপের জন্য আমার গর্ব হতে থাকে। আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমে ডুবে যেতে চেষ্টা করি। পায়েল গজগজ করে—
‘ভল লোকের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা মেয়েকে হাত পা বেঁধে জলে ফেলে। আমায় ফেলেছে কাদায়। এই লোকের সঙ্গে ঘর করাও যা, গলা পর্যন্ত কাদায় ডুবে বসে থাকাও তা-ই।’
আমি আধো ঘুম আধো জাগরণে বলি, কাদার মধ্যে ঘুমোতে দারুণ মজা। গোরু মোষেদের দেখবে কাদা পেলে আর উঠতে চায় না।’
পায়েল তীক্ষ্ণ গলায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
‘আমার বাবা-মায়ের তা-ই করা উচিত ছিল। তাদের উচিত ছিল আমাকে তোমার মতো অলস, অকর্মণ্যর সঙ্গে বিয়ে না দিয়ে গোরু মোষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া। কেউ তোমায় খুঁজতে এলে বলতাম, মাফ করবেন, আমার স্বামী এখন কাদায় ঢুকে ঘুমোচ্ছেন আর জাবর কাটাচ্ছেন, তাকে ডাকতে পারব না।
আমি আওয়াজ করে হাসতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুমের কারণে পারলাম না। ঘুমের মধ্যে আওয়াজ করে হাসা কাদা যায় না। পায়েলের সেন্স অফ হিউমার চমৎকার। কোথায় যেন পড়েছিলাম, সুন্দরী মেয়েদের রসিকতাবোধ কম। আমেরিকার কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে এক সমীক্ষা হয়েছিল। সেখানে রসিকতার পরীক্ষায় সুন্দরীরা গড়ে নম্বর পেয়েছিল দশের মধ্যে তিন। কুশ্রীরা পেয়েছিল, সাত থেকে সাড়ে সাত। পায়েল সেই পরা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। সে একজন রসিক সুন্দরী। সত্যি আমার কপাল ভাল। আমি মনে মনে ছোটমামাকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
তবে আজ আমার আরাম করা নিয়ে কোনও ঝামেলা হবে না। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। যতণ খুশি ঘুমোব। ‘অন্যরকম দিন’-এর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমোব।
দিন সাধারণত ‘অন্যরকম’ হয় একটা কারণে। আমার বেলায় কারণ হয়েছে দুটো। আজ চৈএ মাসের শেষদিন। বাংলা বছর শেষ হচ্ছে। কায়দা করে যাকে বলা হয় বর্ষবিদায়। কাল পয়লা বৈশাখ, নতুন বছর শুরু হবে। কোন বছর শুরু হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না। বাংলা দিন তারিখের হিসাব মাথায় থাকে না। তবে মনের ভিতর একটা ফুর্তি ভাব বোধ করছি। জোরালো কিছু নয়, হালকা ফুর্তি ভাব। পঁচিশ বছর বয়েসের অলস এক যুবকের ক্ষেত্রে হালকা ভবিই যথেষ্ট। বাংলা ইংরেজি কোনও নতুন বছর নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা তাকে মানায় না।
দিন ‘অন্যরকম’ হওয়ার দু’নম্বর কারণ হল, আজ সকালে পায়েল আমাকে ছেড়ে চলে গেল। সে আমাকে বিয়ের ঠিক পাঁচ মাস তিন দিনের মাথায় ত্যাগ করল। বর্ষবিদায়ের মতো শত বিদায়। তবে বর্ষবিদায়ের মজা হল, পরদিন নতুন আর-একটা বছর শুরু হয়। বউ শদায়ের ক্ষেত্রে কি তাই হয়। মনে হয় না। আমার বেলায় তো একেবারেই হবে না। পায়েল ছাড়া কাউকেই আমি স্ত্রী হিসাবে ভাবতে পারব না। তবে চলে গিয়ে সে ঠিক কাজই করেছে। আমি তাকে সমর্থন করেছি। আমার মতো ‘ঘেস্টু’ লোকের সঙ্গে জীবন কাটানোর অর্থ শুধু গলা পযন্ত কাদায় ডুবে বসে থাকা নয়, কাদার মধ্যে হাবুডুবু খাওয়া। ‘ঘেসটু লোক’ ব্যাপারটা ঠিক কি আমি জানতাম না। শব্দটা প্রথম শুনি পায়েলের মুখে।
‘ঘেসটু মানে কী পায়েল? এটা কী কোনও আদরের কথা?’
‘না, এটা গালাগালি। যে লোক ঘেটে ঘেসটে চলে তাকে বলে ঘেসটু। তুমি সেরকম। ইংরেজিতে বলে অ্যাম্বিশনলেস।’
বিয়ের মাসখানেক পর থেকে পায়েল দেরি করে বাড়ি ফেরা শুরু করল। দুপুর থাকতে থাকতে সেজেগুজে বেরোত। সন্ধে পেরিয়ে গেলে ট্যাক্সি এসে তাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিত। অবিন্যস্ত পোশাকে, থেবড়ে যাওয়া টিপে, ঘাড়ে ভেঙে পরা খোঁপায় আমার ঘরের কম আলোতেও ঝলমল করত সে! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। প্রথম প্রথম পায়েল বলার চেষ্টা করত, কোথায় গিয়েছিল। আমি শুনতাম না। কী এসে যায়? একদিন মোটরবাইকে চেপে ফিরল। রাতে খেতে বসে গল্প বলার ঢঙে বলল, ‘আজ প্রলয় নামিয়ে দিয়ে গেল।’
আমি রুটি ছিঁড়ে মুখে তুলে বললাম, ‘কে প্রলয়?’
পায়েল শান্ত গলায় বলল, ‘আমার বন্ধু। বাইরে ছিল, কয়েকদিন হল ফিরেছে।’
আমি বললাম, ‘খুব ভাল। একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াও। তোমার অন্য বন্ধুদেরও ডাকো। সবাই মিলে হইচই করব। বিয়েতে কিছু করতে পারোনি।’
পায়েল চকিতে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘পাগল, এই ওয়ানরুম ভাড়াবাড়িতে প্রলয়কে আনব? সল্টলেকে তার ফ্ল্যাট কত বড় তোমার আইডিয়া আছে? যদি খেতে হয় তার বাড়িতে খাব। হইচই করতে হলে তার বাড়িতে করব। তা ছাড়া তুমি হইচইয়ের কী বোঝো? তোমার হইচই মানে তো ভিখিরির মতো একটা চাকরি করতে যাওয়া, নইলে বাড়িতে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোনো। প্রলয়ের ইয়ারলি টার্নওভার কত বলো তো?’
‘কত?’ আমি উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি।
পায়েলের চোখমুখ দেখে মনে হল প্রলয়ের টার্নওভারের ব্যাপারে আমার উৎসাহ দেখে ভয়ানক রেগে গেল। বলল, ‘থাক, জেনে লাভ নেই। বুঝবে না।’
আমি বললাম, ‘তা-ই ভাল, আমি বুঝব না।’
এক শনিবার রাতে পায়েল ফোন করে জানাল, তার ফিরতে রাত হবে। সে প্রলয়ের ফ্ল্যাটে ‘খাওয়া-দাওয়া করছে, ‘হইচই’ করছে। আমি যেন তার জন্য অপেক্ষা না করি। আমি পায়েল ফেরা পর্যন্ত জেগে বসে রইলাম জানালার পাশে। যত দিন যেতে লাগল, প্রলয়ের ফ্ল্যাটে পায়েলের ‘খাওয়া-দাওয়া,’ ‘হইচই’ বাড়তে লাগল। আমি খুশি হলাম। সত্যি তো মেয়েটা সারাক্ষণ এই খুপরিতে বসে কী করবে? আমি বাড়িতে ঘুমিয়ে আনন্দ পাই বলে সেও পাবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সে যাতে আনন্দ পায় সেটাই তার করা উচিত। এক রাতে তাকে আমি আদর করছিলাম। সে আমার বুকের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘এই…।’
আমি গাঢ় গলায় বললাম, ‘কী?’
পায়েল ফিসফিস করে বলল, ‘আমি যে প্রলয়ের ওখানে যাই তোমার রাগ হয় না?’
আমার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড়। বললাম, ‘রাগ! কেন? রাগ হবে কেন? আমার আনন্দ হয়।’
পায়েল ছিটকে সরে গিয়ে বলল, ‘আনন্দ হয়! পুরনো বয়ফ্রেন্ডের বাড়িতে গিয়ে হুল্লোড় করি বলে তোমার আনন্দ হয়!’
আমি হেসে তাকে জড়াতে যাই। পায়েল হাত সরিয়ে দেয়। আমি বলি, ‘তোমাকে খুশি দেখলেই আমার ভাল লাগে।’
পায়েল অন্ধকার হাতড়ে তার নাইটি খোঁজে। বলে, ‘তুমি কি উন্মাদ?’
‘বাঃ, তোমার আনন্দ হলে আমার আনন্দ হবে না? রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর। এমনি এমনি লিখেছেন?’
বিছানা থেকে নেমে নাইটি পরল পায়েল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এ তো দেখছি এমনি উন্মাদ নয়, বদ্ধ উন্মাদ।’
এতদিন শুধু বিরক্তি প্রকাশ করেছিল, কিছুদিন হল পায়েল বলতে শুরু করেছিল— ‘অসম্ভব, আমি তোমার সঙ্গে থাকব না। কিছুতেই থাকব না। এইভাবে আমি আমার জীবন নষ্ট করে ফেলতে পারি না।’
আমি বললাম, ‘ঠিকই, জীবন নষ্ট করা উচিত নয়।’
পায়েল বলল, ‘আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম।’
আমি বললাম, ‘কীরকম ভেবেছিলে?’
‘তোমার ছোটমামা বাবাকে বলেছিল, তুমি নাকি পৃথিবীর দশটা ভাল ছেলের একজন। তখন ভেবেছিলাম বিল গেটসের খুড়তুতো ভাই। এখন দেখছি কথাটা আধখানা সত্য। তুমি সত্যি পৃথিবীর দশজন ভালর একজন। তবে সেই দশজন মানুষ নয়, সেই দশজন ভাল গাধা।’
কাউকে ‘গাধা’ বললে তার অপমান হওয়ার কথা। আমার একেবারেই হল না। পায়েলের কোনও কথা বা আচরণে আমি অপমানিত হওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। আমি মজা করে বলি, ‘গাধা মোটেই অলস না। তারা অনেক মোট বয়।’
পায়েল কড়া গলায় বলে, ‘থামো। তোমার এইসব গাধা টাইপ ইয়ারকি ভাল লাগছে না। একমাত্র গাধাদেরই জীবনে কোনও লক্ষ্য থাকে না। তারা নিজের অধিকার কতখানি জানে না। নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে কীভাবে বাগে রাখতে হয় জানে না। স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে রাগ করে না।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘গাধার আবার স্ত্রী হয় নাকি!’
পায়েল অবাক হয়ে বলল, ‘এত গাল দেওয়ার পরও তুমি হাসছ! আশ্চর্য! আসলে এটাও ভেদামারা পুরুষদের একধরনের গা-বাঁচানো টেকনিক। রাগতে পারে না বলে হাসিঠাট্টা দিয়ে ম্যানেজ করতে চায়। যাক, তোমাকে আর জ্ঞান দিয়ে লাভ হবে না। তোমার সঙ্গে যে পাঁচ মাস সময় কাটালাম এই যথেষ্ট। এই ভয়ংকর পাঁচ মাস ভুলতে আমার পাঁচ বছর সময় লাগবে।’
‘আমার তার থেকেও বেশি সময় লাগবে। কারণ আমি তোমাকে খুবই ভালবেসে ফেলেছি পায়েল।’
পায়েল মিনিটখানেক চুপ করে থাকে। মনে হল তার টানা টানা তুলিতে আঁকা চোখদুটো ভিজে উঠল। সম্ভবত আমার কথা শুনে রাগে অপমানে চোখে জল এসে গেল। রাগে অপমানে চোখে জল আসা মেয়েদের ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। আমার কি কথাটা বলা ঠিক হল না? ইস, না বললেই হত। খামোকা সহজ সরল মেয়েটাকে দুঃখ দিলাম। মুহূর্তখানেকের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে পায়েল বলল, ‘চুপ করো। একদম চুপ করো। এই ধরনের ন্যাকা কথা শুনলে আমার গা জ্বলে যায়।’
‘তুমি চলে গেলে আর গা জ্বলবে না। কারণ আমার ন্যাকা, স্মার্ট কোনও কথাই আর তোমাকে শুনতে হবে না।’
পায়েল আবার খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যি চলে যেতে বলছ?’
‘আমি বলছি না। তুমি প্রস্তাব দিয়েছ, আমি সমর্থন করছি। তোমার যাতে ভাল লাগে তাতেই আমার সমর্থন আছে।’
‘বুঝেছি।’ বলে পায়েল আমার সামনে থেকে সরে গেল।
আজ সকাল থেকেই পায়েল মন দিয়ে সুটকেস গুছিয়েছে। তার দুটো সুটকেস। একটা ছোট, একটা ঢাউস। যে শান্ত ভঙ্গিতে সে গোছগাছ করেছে তাতে কে বলবে সে স্বামীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সিমলা কুলু মানালি বেড়াতে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘হেল্প করব?’
পায়েল শান্তভাবে বলল, ‘এখন নয়। পরে হেল্প করবে। আমি যাওয়ার সময় ছোট সুটকেসটা নিয়ে যাব। তুমি পরে ভারীটা পোঁছে দিয়ে আসবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কাল পরশু দিয়ে আসবে। যদি মনে করো রবিবারও যেতে পারে।’
আমি বললাম, ‘সেই ভাল। ভারী জিনিস বইতে গেলে তোমার হাতে হেঁচকা লেগে যেতে পারে। বিয়ের পরপরই একবার লেগেছিল মনে আছে? জলের বালতি তুলতে গিয়ে…।’
পায়েল সুটকেসের ঢাকনা বন্ধ করতে করতে বলল, ‘থাক, আর নকল দরদ দেখাতে হবে না। তাও যদি আসল দরদ দেখাতে জানতে।’
আমি দেখেছি, পায়েলের শুধু যে রসিকতাবোধ ভাল এমনটা নয়, সে হেঁয়ালি করতেও পছন্দ করে। যাদের বুদ্ধি আছে একমাত্র তারাই হেঁয়ালি করতে পারে। দরদের আবার আসল নকল কী? সত্যি, মেয়েটা পারেও বটে।
‘সুটকেস কোথায় দিয়ে আসতে হবে জিজ্ঞেস করলে না তো?’
আমি হেসে বলি, ‘কোথায় আবার? উত্তরপাড়ায়, তোমার বাপের বাড়িতে।’
পায়েল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ, গলা, ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘না, সল্টলেকে। প্রলয়ের বাড়ি।’
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, ‘ও আচ্ছা। ঠিকানাটা লিখে দিয়ো।’
পায়েল চলে গেল সাড়ে ন’টার কিছু পরে। আমি বলেছিলাম, দুপুরে খেয়ে বেরোতে। নতুন বছরের আগের দিন না খেয়ে চলে যেতে নেই। বাংলা, ইংরেজি কোনও বছরেই ঠিক নয়। পায়েল কঠিন চোখে আমার দিকে তাকাল। বাইরে রোদের তেজ বাড়ছে। আজ ভয়ংকর গরম। সকাল থেকেই রোদ গনগন করছে। একটা দমবন্ধ ভাব। হাওয়া বাতাসও নেই। বেলা বাড়লে যে অবস্থা আরও খারাপ হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, আমি পায়েলকে আটকালাম না। গরমে পায়েলের কষ্ট হবে। ভোরে উঠেই পায়েল আমার জন্য সারাদিনের রান্না করে দিয়েছে। এমনকী অফিসের টিফিন পর্যন্ত। আমি বারণ করেছিলাম। শোনেনি। বলল, ‘যখন বেরোবে জানলা দরজা আটকে বেরোবে। বাসন মাজার মেয়েটা এলে নজর রাখবে। মেয়েটার হাত টানের হাবিট আছে। রাতে শোওয়ার আগে গ্যাসের। সিলিন্ডার বন্ধ আছে কিনা দেখবে। ইস্ত্রির দোকানে তোমার দুটো জামা দেওয়া আছে নিয়ে নেবে।’
আমি বললাম, ‘বাপ রে, এ তো বিরাট লিস্টি! তোমাকে কি ট্যাক্সি ডেকে দেব?’
পায়েল কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ। আমি নিজেই পারব।’
‘প্রলয়বাবুকে বাইক নিয়ে আসতে বললে না কেন?’
পায়েল ভুরু কুঁচকে রাগী গলায় বলল, ‘মানে?’
‘মানে কিছু নয়। সঙ্গে মালপত্র আছে তো তাই বলছি। বাইকের পিছনে তুলে দিতাম।’
ঠোঁট কামড়ে পায়েল বলল, ‘বাজে কথা কম বলো।’
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোজে ফিনিশিং টাচ দিচ্ছিল পায়েল। ড্রেসিং টেবিল বলতে একটা বড় কাচ আর একটা টুল। টুলটা আবার সামান্য নড়বড় করে। লিপস্টিক লাগানোর সময় সতর্ক থাকতে হয়। সময় লাগে। আজ পায়েল যেন বেশি সময় নিচ্ছিল।
‘তুমি কি পৌঁছে আমাকে ফোন করে একটা খবর দেবে?’
‘না, দেব না।’
‘আমি কি ফোন করব?’
পায়েল লিপস্টিক মাখা ঠোঁটদুটো ঘষা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘না, তুমিও করবে না।’
পায়েল চলে গিয়েছে। খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছি। পায়েল চলে যাওয়ার আগে যেমন আমার রাতের খাবার করে গিয়েছে তেমন ঘরদোর গুছিয়ে, বিছানার চাদরও বদলে গিয়েছে। ইস্ত্রি করা সাদা চাদর। গায়ে সবুজ লতাপাতা। মাথার উপর বনবন করে পাখা ঘুরছে। পাখার হাওয়া গরম। গায়ে লেগে চিরে চিরে যাচ্ছে। ঘরের একমাত্র জানলায় পরদা টেনেছি কিন্তু তারপরও যেন রোদের হলকা আসছে। একতলার এই ঘরটা এমনই। গরমকালে ভয়ংকর গরম, শীতকালে মারাত্মক ঠান্ডা। বাড়িওয়ালারা সবসময়েই ভাড়াটেদের জন্য এই কায়দায় ঘর বানায়। পায়েল অনেকবার এই বাড়ি বদলাতে বলেছিল। আমি চুপ করে থেকেছি। এই শহরে এত কম ভাড়ায় কোথায় বাড়ি পাব? একবার পেয়েছি এই যথেষ্ট। কলকাতা নিষ্ঠুর একটা শহর। তার অজস্র রাজপথ আর অলিগলি আছে। কিন্তু বউয়ের আবদার মেটানোর জন্য গরিব স্বামীর সামনে সে কোনও পথ খোলা রাখেনি। এখন অবশ্য আর চিন্তা নেই। পায়েল চলে গিয়েছে। বাড়িও বদলাতে হবে না। প্রলয়বাবুর বাড়িতে নিশ্চয় এসি মেশিন আছে। এসি না থাকলেও খোলা জানলা দরজা তো পাবেই। পাবে না? মস্ত বারান্দা? ছাদ? আহা, বেচারি পায়েল, এবার একটু আরাম পাক। আমার ঠান্ডা গরমে কিছু এসে যাবে না। কোল্ড ফেবারিটের বদলে ক’দিন না হয় হট ফেভারিটে শুয়ে থাকব। পাশবালিশ জড়াতে জড়াতে মনে মনে পায়েলের দিয়ে যাওয়া কাজের তালিকা আওড়াতে লাগলাম।
…প্রলয়বাবুর বাড়িতে সুটকেস… দরজায় ছিটকিনি… গ্যাসের চাবি… কাজের মেয়ের উপর নজরদারি… আর কী যেন? কী যেন? মনে পড়ছে না…
ঘুম ভাঙল জানলা দরজার প্রবল খটখটানিতে। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম খাটের উপর। ঘর আধো অন্ধকার। সন্ধে হয়ে গেল নাকি? ক’টা বাজে? জানলার পাল্লায় আওয়াজ বাড়ছে। ধাক্কাচ্ছে কে? ধাক্কানোর আওয়াজ তো নয়, যেন ঝনঝন করে উঠল। ঘরের কোনও ফাঁকফোকর থেকে চোরা বাতাস ঢুকছে। ঠান্ডা, শিরশিরে বাতাস। ব্যাপারটা কী? স্বপ্ন-টপ্ন নাকি? না স্বপ্ন তো নয়। এই তো বিছানার উপর পায়েলের পেতে যাওয়া চাদর। এই তো চাদরের গায়ের সবুজ লতাপাতা। স্বপ্ন হলে রং দেখা যেত না। জানলার ঝনঝনানি বেড়ে চলেছে। বাইরে কোথায় যেন দড়াম করে আওয়াজ হল। টিনের চাল পড়লে যেমন হয়। ঘটনা কী! আর শুয়ে থাকা উচিত নয়। আমি খাট থেকে নেমে পড়লাম।
পরদা সরিয়ে জানলার পাল্লা খুলতেই থমকে গেলাম! কালবৈশাখী।
ঝাঁপিয়ে ঝড় উঠেছে। শহরের বড় বড় বাড়ি, চোখা চোখা কার্নিশ, ইলেকট্রিক, কেবল তারের জঞ্জাল ভেদ করে দেখতে পেলাম আকাশ মেঘে মেঘে কালো। মেঘ ছুটছে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে। যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি কিছু বোঝার আগেই এইটুকু জানলা দিয়ে হুড়মুড় করে খানিকটা দমকা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে। ঢুকল আমাকে ধাক্কা মেরে। সঙ্গে ধুলোবালি। অন্য সব ধুলোবালিতে নোংরা লাগে। একমাত্র কালবৈশাখী ঝড়ের ধুলোবালি গায়ে মাখতে ভাল লাগে। ধুলোর সঙ্গে গাছের কয়েকটা পাতাও রয়েছে যে! আশ্চর্য! ইট বালির শহরে গাছের পাতা এল কোথা থেকে? ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মেরে, লন্ডভন্ড করে দিল আমার ঘরের সাজগোজ।
কালবৈশাখী প্রথম দেখছি না। তবু কেন জানি যতবার দেখি মন ভাল হয়ে যায়। ভিতরের যাবতীয় গ্লানি, ব্যর্থতা কোথায় যে পালায়! কে জানে হয়তো ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায়। আজও নিয়েছে। নিজেকে মনে হচ্ছে রাজার মতো। মনে হচ্ছে, প্রকৃতির এই সাজ আমার জন্য। শুধু আমার জন্য। কোমরে দু’হাত দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই আমার ছোট্ট জানলার সামনে। যেন রাজপ্রাসাদের মাথায় উঠেছি। ঝড়ের অভিবাদন গ্রহণ করছি।
ইস পায়েল যদি আর একটা দিন অপেক্ষা করত, আমার এই দাপট দেখতে পেত। না, এটা ঠিক হয়নি। ওকে ছাড়াটা আমার অন্যায় হয়েছে। আকাশের যা অবস্থা ঝড় মনে হয় আরও অনেকক্ষণ চলবে। তারপর হইচই করে বৃষ্টি নামবে। শিল পড়বে কি?
আর দেরি করা ঠিক হবে না। এখনই পায়েলকে নিয়ে আসতে হবে। সে রাজি না হলেও নিয়ে আসতে হবে। জোর করতে হবে। হাত চেপে ধরতে হবে। নিজের বউয়ের হাত চেপে ধরার মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই। অন্তত একটা দিন তাকে এই ঘরের ঝড়বৃষ্টি দেখে যেতে হবে।
শার্ট পরতে পরতে মোবাইলে পায়েলকে ধরলাম।
‘কী?’
‘ঝড় উঠেছে পায়েল। ঘরে খুব ঝড় উঠেছে। কালবৈশাখী।’
‘জানি। দেখতেই তো পাচ্ছি।’
‘না দেখতে পাচ্ছ না। দূরে বসে এই ঘরের ঝড় দেখবে কী করে?’
পায়েল চুপ করে থাকে।
‘আমি আসছি।’
‘কী বলছ শুনতে পাচ্ছি না, বড্ড হওয়ার শব্দ।’
আমি গলা ফাটিয়ে বলি, ‘আমি আসছি।’
‘শুনতে পাচ্ছি না। আরও জোরে বলো।’
আমি ঝড় ছাপিয়ে চিৎকার করে উঠি, ‘আমি আসছি। শুনতে পাচ্ছ? তোমাকে নিতে আসছি।’
‘যদি না যাই?’
আমি রেগে যাই। বলি, ‘জোর করে নিয়ে আসব।’
মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে পায়েল ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এসো। আমি সুটকেস খুলিনি।’
প্রতিদিন রোববার, ১৮ এপ্রিল, ২০১০