চাপা

চাপা

উদ্ভট চিন্তাটা প্রতীকের মাথায় এল বাড়ির একেবারে কাছে এসে।

গাড়ির গতি কমাল প্রতীক। কী করবে এখন? গাড়ি থামাবে? ঘুরিয়ে নেবে? নাকি উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে চলে যাবে? কী করতে হয় এই সময়?

স্টিরিয়োতে চাপা গলায় গান চলছে। রনেন কিটিং-এর গান। ইউ সে বেস্ট হোয়েন ইউ সে নাথিং অ্যাটঅল… তুমি তখনই সবথেকে ভাল বলো, যখন কিছুই বলো না। এইসব প্রেমের গান কিঙ্কির কালেকশন। গাড়িতে সিডি রেখে দেয়। প্রতীককে চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খবরদার বাপি, আমার সিডিগুলো সরাবে না।’ সুশ্রী মেয়ের ওপর রাগ করে। বলে, ‘ওসব আবার কী রাজ্যের হাবিজাবি।’ প্রতীক সিডি সরায় না। পনেরো বছরের মেয়ে নানাভাবে ভালবাসার কথা শুনতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক।

আজ প্রতীকও শুনছিল। পার্ক স্ট্রিটের মুখটা পার হয়ে স্টিরিয়ো চালিয়ে দিল। বেশ লাগছে কিন্তু শুনতে। তুমি যখন কিছুই বলো না…। গান শুনতে শুনতেই মোবাইলে সুশ্রীকে ধরল।

‘আমি রওনা দিয়েছি।’

সুশ্ৰী হাই তুলে বলল, ‘সে তো বুঝতেই পারছি। কোথা থেকে রওনা দিয়েছ?’

‘পার্ক স্ট্রিট থেকে।’

‘আজও গিলেছ নাকি?’

প্রতীক হাসতে হাসতে বলল, ‘দু’পেগ, ওনলি টু। জাস্ট কম্পানি দিতে বসেছিলাম। তুমি তো জানো সুশ্রী, আমি যে ধরনের কাজ করি তাতে একটু-আধটু…।’

সুশ্রী চাপা গলায় বলল, ‘থাক, একই এক্সকিউস রোজ শোনাতে হবে না। কতক্ষণ লাগবে?’

‘হাফ আন আওয়ারও নয়। বাইপাস হয়ে নিউটাউনের মধ্যে দিয়ে সাঁই সাঁই করে উড়ে চলে যাব।’

‘এই রাতে ফাঁকা রাস্তাটা দিয়ে আসবে? উলটোডাঙা দিয়ে ঘুরে এলে পারতে।’

‘রাস্তা কোথায় ডার্লিং। বললাম তো উড়ে যাব। ওহো, তোমায় তো বলাই হয়নি, আজ সকালে গ্যারাজে গিয়ে গাড়িতে দুটো ডানা লাগিয়ে নিয়েছি। উইংস। ওরা জিজ্ঞেস করল, কোনটা নেবেন? আমি বললাম, যেটায় সবথেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায় সেটা দাও। দাম একটু বেশি পড়ল।’

সুশ্রী আবার হাই তুলল। জড়ানো গলায় বলল, ‘মাতলামি কোরো না, সাবধানে ড্রাইভ করো। তুমি কি ডিনার করেছ?’

‘না করিনি। ওরা খুব জোরাজুরি করছিল। আমি বললাম, নো, নেভার। স্ত্রী কন্যা ডিনার টেবিলে না থাকলে আমার ডাইজেশন প্রবলেম হয়। খাবার হজম হতে চায় না।’

‘আদিখ্যেতা কোরো না, অপেক্ষা করছি।’

‘কিঙ্কি কোথায়? শুয়ে পড়েছে?’

‘ওমা শোবে কেন? খেয়ে নিয়ে পড়তে বসেছে। নেক্সট উইকে ওর এক্মাম। ফোন রাখো, গাড়ি চালাতে চালাতে বকবক কোরো না। বরং আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। তুমি এলে উঠব।’

সুশ্রীর এই একটা মজা। দুম ধাড়াক্কা ঘুমিয়ে নিতে পারে। প্রতীক হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, ঘুমিয়ে নাও। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখো তুমিও আমার সঙ্গে উড়ছ। জাস্ট লাইক আ বার্ড।’

‘বয়ে গেছে।’

নিউটাউনের রাস্তাটা ধরতেই অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিল প্রতীক। আশি, নব্বই, একশো…। চারপাশ শুনশান, নিঝুম। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু লাইটপোস্ট থেকে উজ্জ্বল হলুদ আলো ঠিকরে এসে পড়েছে নীচে। আজ হঠাৎ-ই প্রতীকের মনে হল, ভারী চমৎকার তো! কালো অন্ধকার কেটে হলুদ পথ চলে গেছে রূপকথার গল্পের মতো। শেষে নিশ্চয় একটা সোনালি দুর্গ রয়েছে। দুর্গে ছলছল চোখের বন্দিনী রাজকন্যা। প্রতীক গাড়ির গতি আরও বাড়াল। সিগন্যালের ঝামেলা নেই। এই নতুন রাস্তার এটা একটা বড় সুবিধে। দু’পা এগোলে কলকাতার মতো চোখ পাকিয়ে কেউ থমকে দেয় না। মনের আনন্দে ছোটো। যত খুশি ছোটো। যতক্ষণ না হাঁপাচ্ছ ছুটতে থাকো। শুধু কোনও কোনও বাঁকে টিনের বোর্ড লাগানো— সাবধান! গোরু পারাপারের পথ, সাবধান! মানুষ পারাপারের পথ।

প্রথম প্রথম নোটিশগুলো দেখে কিঙ্কি খুব হাসত।

‘দু’পাশে হাইরাইজ, আই টি পার্ক, শপিং মল হচ্ছে, সেখানে আবার গোরুর জন্য নোটিশ। হি হি। একটু পরে হয়তো দেখব, অ্যারো দিয়ে লেখা, ওই দিকে নৌকোর ঘাট, এই দিকে পালকি পাবেন। হি হি।’

প্রতীক বলত, ‘তা নয়, এদিকটায় এখনও গ্রামটাম আছে। গ্রাম না থাকলেও মাঠ তো দেখতে পাচ্ছিস।’

রাতে সে ঝামেলাও নেই। ‘সাবধান’ লেখা বোর্ডগুলো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে। কোনও বাধা নেই। এত রাতে যে অল্প কয়েকটা গাড়ি ছুটছে তারা সকলেই ভ্রূক্ষেপহীন এবং দুঃসাহসী।

প্রতীকও সাহসী হল। সে অ্যাক্সিলেটরে আরও চাপ দিল। এবার সত্যি মনে হচ্ছে, গাড়িতে ডানা লেগেছে। সে উড়েই চলছে। শরীরটাও যেন হালকা পলকা। মাথায় ঝিমঝিমে ভাব। অল্প নেশার এটাই মজা। অনেক কিছু বোঝা যায়, আবার অনেক কিছু বোঝা যায়ও না। নিজের মনেই হাসল প্রতীক। আধখোলা, আধবোজা চোখে স্টিয়ারিং-এ আঙুল রেখে তাল দিতে লাগল। রনেন কিটিং-এর সঙ্গে গলা মেলাল— ‘ইউ সে বেস্ট হোয়েন ইউ সে নাথিং অ্যাটঅল…।’

নিউটাউনের বাধাহীন, মসৃণ পথ পেরিয়ে ফ্লাইওভারের মুখে এসে পড়তে মিনিট পনেরোও লাগল না প্রতীকের। এবার রাস্তা ছেড়ে ইউ টার্ন নিয়ে বাঁদিকের গলি। ঢুকলেই ছ’তলা ফ্ল্যাট। গলির মুখে এটিএম কাউন্টার। রাতে হীরকখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করে। আজও করছে। প্রতীকদের বাড়ি চেনার এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশ। কিঙ্কি মজা করে বলে, ‘গলির মুখেই দেখবে টাকার পাহাড়, পাশ কাটিয়ে চলে আসবে।’

প্রতীকও পাশ কাটাতে গেল এবং ঠিক এই সময়ে উদ্ভট চিন্তাটা মাথায় বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল।

আসার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করল না তো? কাউকে কি চাপা দিল? নিদেন পক্ষে ধাক্কা মারেনি তো? মনে হচ্ছে যেন এরকম কিছু একটা ঘটেছে। কী ঘটেছে?

ব্রেক চেপে গাড়ি দাঁড় করাল প্রতীক। গান বন্ধ করল, গাড়ির ভেতর শুধু এসির ফিসফিসানি। বেশি ঠান্ডা লাগছে। ভুরু কুঁচকে গেল প্রতীকের। স্টিয়ারিং-এর ওপর রাখা দুটো হাতই ইঞ্জিনের কারণে মৃদু কাঁপছে।

অসম্ভব কিছু নয়। গোটা পথটা সে যেভাবে গাড়ি চালিয়েছে তাতে এ ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। সারাক্ষণই সে ছিল অন্যমনস্ক। ফুরফুরে মেজাজে। মোবাইলে সুশ্রীর সঙ্গে হাসিঠাট্টা করল। গান শুনল। চালকের মধ্যে যে টানটান ভাবটা থাকা দরকার, তার বিন্দুমাত্র ছিল না। এখন মনে পড়ছে, সবসময় যে রাস্তার ওপর সমানতালে নজর রাখতে পেরেছে এমনটাও নয়। সে খেয়ালই ছিল না। অভ্যেসে ছুটছিল। ছুটতে ছুটতেই ধাক্কা মেরেছে হয়তো। মারার পরও খেয়াল হয়নি। অ্যাক্সিডেন্টের এটাই সমস্যা। অকস্মাৎ ঘটে যায় বলে বিপদ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। কিছু সময় লাগে। ততক্ষণে চারপাশের মানুষ হইচই করে ওঠে, ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ির ওপর। কাচ ভেঙে, দরজা খুলে ড্রাইভারকে টেনে নামায়। কিল, চড়, লাথির মাঝখানে পেট্রলের ঢাকনা খুলে আগুন লাগিয়ে দেয়।

প্রতীকের পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি টপকে সাইকেল রিকশ চলে গেল। লাস্ট ট্রেনের মতো সম্ভবত এটা এ পাড়ার শেষ রিকশ। চলে যাওয়া রিকশর দিকে তাকিয়ে প্রতীক ঠোঁট কামড়ায়। ঘাম হয়নি তবু পকেট হাতড়ে রুমাল বের করতে যায়। পারে না। রুমাল নিয়ে বেরোয়নি আজ।

মন বলছে, চাপা দিয়েছে, অবশ্যই দিয়েছে। কিন্তু এটা সম্ভব কী করে? ঘটনার সময় একেবারেই কিছু বুঝতে পারবে না। ধাক্কা দিলে একটা আওয়াজ তো হবে। হবে না? কে জানে হয়তো হয়েছেও। গাড়ির কাচ তোলা। ভেতরে এসি চলছে, গানও বাজছে। মিষ্টি একটা গন্ধও ছিল। গাড়িতে গন্ধের ব্যবস্থা সুশ্রীর করা। ড্যাশ বোর্ডের ওপর সেন্টের শিশি রেখেছে। শিশি আর এডিকোলন ভেজানো ন্যাপকিন। ন্যাপকিন ব্যবহার হয় না, তবু রেখেছে। বাইরের আওয়াজ তো দুরের কথা ধুলো, বালি গন্ধ কিছুই ঢোকার উপায় নেই। নিশ্চয় তাই হয়েছে। মুখোমুখি না হয়ে ধাক্কাটা হয়তো লেগেছে পাশ থেকে। বড় কোনও ধাক্কা নয়, ছোট ধাক্কা। তারপরই মানুষটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এই ধরনের অ্যাক্সিডেন্টে এটাই হয়। যে ধাক্কা খায় প্রথমে ব্যালান্স হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। লাগে না বিশেষ। ভাবে ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়বে। আর তখনই গাড়ির চাকা চলে যায় শরীরের ওপর দিয়ে।

এই মানুষটার কোথা দিয়ে চাকা গেছে? পা? পেট? মাথা নয় তো?

পা থেকে পিঠ পর্যন্ত ঠান্ডা একটা স্রোত উঠে এল হামাগুড়ি দিয়ে। একটু কাঁপুনিও হল যেন। এসি বন্ধ করল প্রতীক। ডানপাশের জানলার কাচ নামাল। বাইরে গরম হাওয়ার ঝলক। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করল প্রতীক।

নেশা কি বেশি হয়ে গেছে? প্রতীক মাথা ঝাঁকাল। দূর, আবোল তাবোল ভাবছে। একটা আস্ত মানুষকে চাপা দিয়ে চলে আসবে, অথচ বুঝতে পারবে না। এরকম কখনও হয়? একদিন-দু’দিন নয়, এগারো বছর গাড়ি চালাচ্ছে সে। তার আগে লাইসেন্স ছাড়াই। কলকাতার রাস্তায় কয়েক মাস ঘুরেছে। তখন অবশ্য পাশে ড্রাইভার থাকত। এতদিন গাড়ি চালালে চোখ, কানের পর একটা অন্য ইন্দ্রিয় তৈরি হয়। সেটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নয়, ড্রাইভারের ইন্দ্রিয়। চলন্ত গাড়িতে সেই ইন্দ্রিয়ই সব নিয়ন্ত্রণ করে। ঘুমিয়ে পড়লেও হাতের স্টিয়ারিং কাঁপে না। বাঁকে, মোড়ে ভুল হয় না। নিজে থেকেই হর্নে হাত পড়ে। গতি বাড়ে-কমে, গিয়ার বদল হয়। সামনে কেউ পড়লে গাড়ি যেন নিজেই দেখতে পেয়ে পাশ কাটায়। দু’-একটা ছোটখাটো অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া প্রতীকের ড্রাইভার জীবন পুরোটাই নিষ্কলঙ্ক। তাও সেসব অ্যাক্সিডেন্ট মানুষের সঙ্গে ছিল না। একবার মেটাডোর মেরেছিল বি টি রোডে। দরজায় ঘসে দিয়েছিল। আর একবার পিছোতে গিয়ে ট্যাক্সিতে লেগে ব্যাক লাইট ভাঙল। সে বলা নেই কওয়া নেই একেবারে মানুষ চাপা দিয়ে ফেলবে! ফেলবে শুধু না, ফেলে বুঝতেও পারবে না। ভুল হচ্ছে না তো? মনের ভুল? তার এমন কিছু নেশা হয়নি যে সে এ ধরনের ভুল করবে। তা ছাড়া এমন নয় যে মদ খেয়ে সে কোনওদিন গাড়ি চালায়নি। বহুবারই চালিয়েছে। কখনওই বাড়াবাড়ি ধরনের নেশা সে করে না। গাড়ি চালালেও করে না, না চালালেও করে না।

প্রতীক মনে মনে সাঁইতিরিশের নামতা আওড়াতে শুরু করল। কলেজ জীবনে প্রলয় বলত, মদ্যপানের পর সেন্সে আছিস কিনা বুঝতে নামতা মনে করবি। অড নাম্বারের টেবল। সাতাশ, সাঁইত্রিশ, সাতচল্লিশ।

প্রতীক বিড়বিড় করছে। থার্টিসেভেন ওয়ান জা থার্টিসেভেন, থার্টিসেভেন টু জা সেভেনটি ফোর, থার্টিসেভেন থ্রি জা ওয়ান হান্ড্রেন্ড ওয়ান…।

পাঁচ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই লজ্জা পেল প্রতীক। ছি, ছি, মাঝরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কী পাগলামি শুরু করছে। বাড়ি ফিরে ঘটনা বললে কিঙ্কি নিশ্চয় খুব একচোট হাসবে।

প্রতীক নিজেও হাসল। হাত বাড়িয়ে গাড়ি চালু করে গিয়ারে হাত রাখল। আর তখনই মনে হল। যদি পাগলামি না হয়? ঘটনা যদি সত্যি হয়? নিশ্চয়ই সে কিছু একটা করেছে। না হলে, এ ধরনের চিন্তা তার মাথায় আসবে কেন? মানুষকে চাপা দেওয়া গান বা কবিতা নয় যে হুট করে মাথায় চলে আসবে। ঘটনা কিছু ঘটেছে বলেই তার এরকম মনে হচ্ছে। তার অজান্তেই ঘটেছে। ড্রাইভারের ইন্দ্রিয় তখন জানায়নি। এখন জানাল।

প্রতীক গাড়ি ঘোরাল। বড় গাড়ি। ঘোরাতে সময় নেয়।

নিউটাউনের রাজকীয় রাস্তাকে আরও উজ্জ্বল, আরও ঝলমলে লাগছে। হলুদ আলোর সঙ্গে কোথা থেকে যেন একটা ভাঙা চাঁদ এসে হাজির হয়েছে সামনে। এই ধরনের পথের ওপর আকাশ সর্বদাই অনেকটা নেমে আসে। এখনও এসেছে। কালো আকাশ। চাঁদ অবশ্য পথে আলো ফেলেনি। আলো ফেলেছে দু’পাশের বিস্তীর্ণ মাঠে। তাদের দেখাচ্ছে রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। অনেক দূরে দূরে আকাশছোঁয়া বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে ছায়ার মতো। সিকিখানা, আধখানা তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে।

প্রতীক গাড়ি চালাচ্ছে একপাশ ধরে। প্রায় গড়িয়ে গড়িয়ে। কড়া হেডলাইট চকচকে রাস্তায় পড়ে পিছলে যাচ্ছে। আপ ডাউন দুটো পথেই সমান তালে চোখ রাখতে হলে গাড়ি এভাবেই চালাতে হবে। এতে যে সমস্যা হচ্ছে না এমন নয়, হচ্ছে। তবু চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতীক। ফেরার সময়ও উলটোদিকটা আরও ভালো করে দেখতে হবে।

ডানপাশে চিত হয়ে শুয়ে থাকা ওটা কী?

প্রতীক তাড়াতাড়ি জানলা দিয়ে মুখ বের করে। গাড়ি সরিয়ে আনে। মানুষ একটা? না, মানুষ নয়, কংক্রিটের পাটাতন। হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে গুটিসুটি মেরে।

গোটা পথেই কিছু নেই! হুমড়ি খেয়ে, উপুড় হয়ে পড়ে নেই কেউ! ধারে এমন কোনও ঝোপঝাড় নেই যে গাড়ি চাপা দেহ গড়িয়ে সেখানে গিয়ে পড়বে। পাশের মাঠ পর্যন্ত। পৌঁছোতে হলেও বেশ খানিকটা জায়গা পার হতে হবে। ছিটকে অতদূর যাওয়া শক্ত। দেয়াল করে আছে বালি, স্টোনচিপসের ঢিপি, পিচের ড্রাম। কোথাও লোহার বিম, পাইপ পড়ে আছে ঝিম মেরে। কোথাও আবার খুঁটিতে মাপজোক আর সীমানার ফিতে বাঁধা। ফিতেগুলো ফরফর করে হাওয়ায় উড়ছে পতাকার মতো। পাশ দিয়ে তীক্ষ্ণ হুইস্‌লের শীৎকার তুলে দুটো গাড়ি ছুটে গেল। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ঢুকছে। নির্জন পথটুকু পেরিয়ে যেতে চাইছে পড়িমড়ি করে।

প্রায় শেষের মুখে আসতে অন্ধকার অনেকটা কাটল। এদিকটায় ইতিমধ্যে অনেকগুলো বাড়ি চালু হয়ে গেছে। মানুষের বসবাস শুরু হয়েছে। দৈত্যের মতো দু’হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটার পর একটা কাচের অফিস। আই টি পার্ক। নিয়ন আলোর শরীর জ্বলছে তাদের। এখানে দুর্ঘটনা কিছু ঘটলে চোখ এড়ানো অসম্ভব। প্রতীকের এবার অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে। মনের অস্বস্তিটা যেন কমছে।

হঠাৎই চুপিসারে একটা জিপ প্রতীকের গাড়ি টপকে সামনে এসে দাঁড়াল। গায়ে ডোরাকাটা পুলিশের টহলদারি জিপ। মাথায় গনগনে লাল আলো ঘুরছে। গাট্টাগোট্টা চেহারার যে ভদ্রলোক জিপ থেকে লাফ দিয়ে নামলেন তাঁকে ঠিক চেনা পুলিশের মতো লাগছে না। এত রাতেও টিপটিপ ইউনিফর্মে স্মার্ট। ডানদিকের কোমরে রিভলভারের খাপ। জুতোয় আওয়াজ হচ্ছে। ঝকঝকে রাস্তায় টহলদারির জন্য ঝকঝকে পুলিশ অফিসার!

স্টার্ট বন্ধ করে জানলা দিয়ে মুখ বের করল প্রতীক। অফিসার মানুষটা বললেন, “এনি প্রবলেম স্যার?’

পুলিশের মুখে ‘স্যার’ শুনে একটু থমকে গেল প্রতীক। এদের কি আলাদাভাবে ট্রেনিং দেওয়া? হতে পারে। এই এলাকাটা জুড়ে বিদেশি অফিস, বিদেশি লোকজন, বিদেশি গাড়ির যাতায়াত। এখানে পুলিশ যে আলাদা হবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

প্রতীক ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন বলুন তো?’

অফিসার কাছে এসে জানলায় ঝুঁকে পড়েন। নরম গলায় বলেন, ‘স্যার, অনেকক্ষণ থেকেই আমরা লক্ষ করছি, আপনি আস্তে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়িতে কি কোনও সমস্যা?’

কী বলবে? এদের যদি বলা হয় যে, লাশ খুঁজতে বেরিয়েছে, তা হলে বিরাট গোলমাল পাকিয়ে যাবে। হয় মাতাল ভেবে ফাইন করবে, নয় পাগল ভেবে চড় লাগাবে। প্রতীক দ্রুত ভেবে নিল।

‘বড় কিছু নয়, সামান্য একটু…। অ্যাক্সিলেটরে কিছু হয়েছে হয়তো। তারে…’।

‘প্রবলেম হলে আমাদের বলতে পারেন, উই ক্যান হেল্‌প ইউ। আমাদের অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে।’

‘না না ইটস ওকে। একটু এগিয়ে হয়তো গ্যারেজ পেয়ে যাব।’

‘ফাইন। আসলে রাস্তাটা তো ফাঁকা। তার ওপর এত রাত… যাক, শুভরাত্রি।’

অফিসার সুন্দর করে হাসেন। নিশ্চয় এঁদের হাসির জন্য বলা আছে। এই রাস্তায় ধমকের বদলে হাসি।

গাড়ির চাবিতে হাত রেখে প্রতীক এক মুহূর্ত থেমে বলল, ‘ধন্যবাদ। আচ্ছা একটা ইনফরমেশন দিতে পারেন?’

অফিসার ভদ্রলোর বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী স্যার?’

‘এই রাস্তার ওপর কোনও অ্যাক্সিডেন্টের খবর আছে?’

‘অ্যাক্সিডেন্ট! কখন বলুন তো?’ অফিসারের গলায় টেনশন।

প্রতীক গলা স্বাভাবিক করে বলল, ‘বেশিক্ষণ নয়, এই ধরুন কুড়ি-পঁচিশ মিনিট বা আধ ঘণ্টা আগে?’

পুলিশ অফিসার এবার নিশ্চিন্ত হলেন।

‘না স্যার, রাত আটটায় আমি ডিউটি নিয়েছি। তারপর থেকে কোনও ঘটনা নেই। কালকেও নেই। পরশু একটা হয়েছিল। তাও ভোররাতের দিকে। দুধের গাড়ি সাইকেলে ধাক্কা মারে। ফেটাল কিছু নয়। আপনি কি কিছু শুনেছেন? আপনার পরিচিত কেউ?’

প্রতীক তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না, আমার পরিচিত কিছু নয়। আসার সময় ওদিকের মুখটায় শুনলাম দু’-চারজন ছেলেছোকরা বলাবলি করছিল। কী জানি হয়তো পরশুর কথাই বলছিল। ইটস ওকে।’

‘তাই হবে। গুড নাইট স্যার।’

কথা শেষ করে অফিসার ভদ্রলোক একটু সরে গেলেন। যার অর্থ ‘এবার আপনি চলে যান।’

প্রতীক গাড়ি গড়াল। আর নয়, অনেক পাগলামি হয়েছে, এবার ফিরে যেতে হবে। দ্রুত ফিরে যেতে হবে। হাত উলটে ঘড়ি দেখল প্রতীক। বারোটা পার হয়ে গেছে। ছি ছি, কী বকামিই না হল এতক্ষণ। কত দেরি হয়ে গেল। প্রতীক ঠিক করল, সামনে প্রথম যে জায়গাটা পাবে সেখান থেকেই গাড়ি ঘোরাবে। ঘুরিয়ে সুশ্রীকে একটা ফোন করবে। নিশ্চয়ই বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই হবে। নইলে এতক্ষণ খুব টেনশন করত। মোবাইলে বারবার ডাক আসত।

সামনেই জায়গা পাওয়া গেল, কিন্তু গাড়ি ঘোরানো হল না।

স্টিয়ারিং বেঁকানোর আগের মুহূর্তে খচখচানিটা ফের মাথা নাড়া দিয়ে বসল। যেন সাপের মতো সেটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল এতক্ষণ, আবার ফণা তুলছে!

চাপা দিয়েছে মানে এই রাস্তার ওপরই যে দিয়েছে এমন তো নয়। সে যাত্রা শুরু করেছিল সেই পার্ক স্ট্রিট থেকে। তারপর বাইপাস হয়ে সল্টলেকের অনেক পথ পার হয়েছে। ঘটনা কি সেখানে ঘটতে পারে না? গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারার জন্য বাইপাস তো আদর্শ। তবে? এতটাই যখন এল, বাকিটুকু দেখে এলে ক্ষতি কী? ক্ষতি যেমন নেই, লাভও নেই। কিছুই পাওয়া যাবে না। যা হয়নি, যা হতে পারে না, তা পাওয়া যাবে কী করে? তবু মনের অস্বস্তিটা তো কাটবে। প্রতীকের এখন মনে হচ্ছে, পড়ে থাকা রক্তমাখা দেহের হদিশ পাওয়া থেকে মনের অস্বস্তি সরানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা সরাতেই হবে। হটাতেই হবে। নইলে সে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে।

পিছনের বাড়িঘর ও পথ ফেলে প্রতীক আবার গাড়ি ছোটাল।

একই সঙ্গে তার রাগ হচ্ছে, আবার ভয়ও করছে। এটা কি কোনও অসুখ? হঠাৎ করে তাকে চেপে ধরল? নইলে এ কী করছে সে? কীসের পেছনে ছুটছে? সত্যি যদি যাওয়ার পথে কাউকে ধাক্কা মেরে, চাপা দিয়ে, থেঁতলে পিষে চলে গিয়ে থাকে তো গেছে। সমস্যা কোথায়? অ্যাক্সিডেন্ট করে অনেকেই তো পালায়। সে তো তাও করেনি। তার দোষ কোথায়? তাকে কেউ তাড়াও করেনি। তা হলে কেন এমন করছে সে? কেন যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে মনকে শান্ত করতে পারছে না? আর যদি সত্যিই কাউকে পায়, তা হলেই বা কী করতে পারে সে। হাড় ভাঙা, রক্তাক্ত মানুষটাকে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? অসম্ভব। এতটা মনের জোর প্রতীকের নেই। ফিরে যাওয়াই ভাল ছিল। ঠিক ছিল। কিন্তু পারছে কই?’

কখনও আলোয়, কখনও অন্ধকারে হেডলাইটের চোখ ধাঁধানো আলো ফেলে গাড়ি ছুটছে।

পরমা আইল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছে সত্যি সত্যি একজনকে দেখা গেল। পথের ওপর নয়, বাঁ দিকে মূল পথ থেকে বেশ খানিকটা সরে গিয়ে পড়ে আছে লোকটা। গায়ের পোশাক এলোমেলো। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, পাশ ফিরে শুয়ে আছে। এরকমই হয়। মরা মানুষকে মনে হয় নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

এদিকটায় বাইপাস চওড়া করার কাজ চলছে। খোয়া, বালি বিছানো। দ্রুত হাতে গাড়ি পাশ করল প্রতীক। দরজা খুলে নামল সর্তকভাবে। রাত বাড়ছে, বাইপাসের মতো ব্যস্ত পথেও গাড়ি কমে গেছে। যে গুটিকয়েক আছে, তারা ছুটছে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। মনে সাহস এনে কয়েক পা এগোল প্রতীক। এদিকটায় আলোর অভাব নেই। মাথার ওপর ঝলমলে বোর্ডিং-এ অর্ধনগ্ন নারী হাসছে। সেই আলো এসে পড়েছে পথের ধারে পড়ে থাকা লোকটার গায়ে।

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই প্রতীক ঠিক করে নিয়েছে কী করবে। কিছুই করবে না। দূর থেকে শুধু বোঝার চেষ্টা করলে আঘাতটা কতখানি। ঢাকা কোথা দিয়ে চলে গেছে? নাকি শুধুই ধাক্কা মেরেছিল? এই সময় যদি পুলিশ চলে আসে আবার? সেটাও ভেবে ফেলেছে। বাঁ হাতের কড়ে আঙুল তুলে বলবে, ‘বাথরুম।’

কিছুই করতে হল না। দু’পা এগোতেই পড়ে থাকা মানুষটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে। খোলা জামার পকেট হাতড়ে বিড়ি বের করে দেশলাই জ্বালায়।

গাড়িতে উঠতেই প্রতীকের মোবাইল বেজে ওঠে।

‘কী হল! তুমি কোথায়?’ সুশ্রীর ঘুম ভাঙা উদ্বিগ্ন গলা।

প্রতীক নিজেকে সামলে শুকনো গলায় বলল, ‘আসছি। আসছি ডার্লিং।’

‘আসছি মানে। কোথায় তুমি? কী হয়েছে তোমার?’ চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠল সুশ্রী।

কাঁধ দিয়ে মোবাইল চেপে ক্লান্ত গলায় প্রতীক বলল, ‘রিল্যাক্স সুশ্রী। কিছুই হয়নি, টায়ার ফাটল। স্টেপনি বদলাতে গিয়ে দেখি সেটাও ড্যামেজ। আমি আসছি, প্লিজ আর একটু, একটুখানি।’

আরও একটু এগোল প্রতীক।

এত রাতেও পার্ক স্ট্রিট জেগে আছে। টলমল পায়ে পুরুষ হাঁটছে। মহিলাকে ইশারা দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। ‘খদ্দের’-এর কাছ থেকে পয়সা তোলার জন্য ভুঁড়িওলা পুলিশ ওত পেতে আছে পানের দোকানে। প্রতীকের ধীরে চলা গাড়ি দেখে রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা বুকের কাপড় সরিয়ে হাসল।

না, কোথাও কিছু নেই। অ্যাক্সিডেন্টের পর কলকাতা স্বাভাবিক হতে সময় নেয় না। পুলিশ জানে ‘বড়ি’ কীভাবে দ্রুত সরাতে হয়। তবু একটা চাপা টেনশন থেকে যায়। একটু জটলা, দুটো তৎপর ট্রাফিক সার্জেন্ট। সেসব কিছুই নেই।

পেট্রোল পাম্পে ঢুকে তেল ভরল প্রতীক। ক্যাশে বসা আধা ঘুমোনো ছোকরা ক্রেডিট কার্ড টানতে ভুল করল বেশ কয়েকবার। গাড়িতে উঠে বিধ্বস্ত প্রতীক বুঝতে পারল, এতক্ষণে অস্বস্তিটা সত্যি সত্যি কেটেছে। নিজেকে শুধু পাগল নয়, জোকারের মতো লাগছে। উদ্ভট একটা চিন্তার জন্য কী কাণ্ডই না করল! পরক্ষণেই মনে হল, বেশ করেছে। সামান্য কাঁটাও গলায় ঢুকে বিরাট গোলমাল পাকায়। ভোলা না পর্যন্ত সব এলোমেলো করে ছাড়ে। এটাও সেরকম। মনের কাঁটা। সেই কাঁটা উপড়ে ফেলতে সে না হয় গাদাখানেক তেল আর সময়-ই খরচ করল।

বোতাম টিপতেই আলগোছে উঠে এল কাচ। এসি চলল। স্টিরিয়ো কি চালাবে? তুমি তখনই সবথেকে ভাল বলো…। দ্রুত ফুরফুরে মেজাজে ফিরে এল প্রতীক। এবার সত্যিই উড়ে যেতে হবে। আরও জনহীন রাস্তা আরও সুন্দর। কাচের ঘরদোর, অফিসবাড়ি যেন উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ। আকাশে ওড়ার পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে তাদের মাঝখান দিয়ে।

প্রতীক নিজের মনেই হাসল। টেম্পোরারি ইনস্যানিটি? কোথায় যেন পড়েছিল, বিচিত্র সব চিন্তা, উদ্ভট কল্পনা বারবার মনে আসাটা আসলে একটা মনের অসুখ। তারা মনকে তোলপাড় করে দেয়। না চাইলেও বারবার ফিরে আসে। অর্থহীন, অযৌক্তিক জানা সত্ত্বেও এড়ানো যায় না। ফেরানো যায় না। অসুখটার নাম কী? যা খুশি হোক। সাপ, ব্যাং, যা খুশি। সে তো এখন মুক্ত। তা হলেই হল। মনের অসুখ হোক, প্রাণের অসুখ হোক, মাথা একেবার ঝরঝরে। পালকের মতো ফুরফুরে লাগছে নিজেকে।

প্রতীক আক্সিলেটারে চাপ বাড়াল।

বাঁকের মুখে মাথায় আলো ঘুরিয়ে টহলদারি জিপ এখনও দাঁড়িয়ে আছে। প্রতীক হাত নাড়ে। ওদের দেখতে পাওয়ার কথা নয়। কাচ তোলা, তার ওপর অন্ধকার। তবু একটা সৌজন্যের ব্যাপার তো আছে।

গান চালাল প্রতীক। সুশ্রীকে একটা ফোন করে দেবে? থাক, লিফটে ওঠার আগে একেবারে ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়ে চমকে দেবে।

হর্ন বাজাতে হল না প্রতীককে, গাড়ি দেখতে পেয়েই টুলে বসে থাকা ঘুমন্ত দারোয়ান ধড়ফড় করে উঠে এসে গেট খোলে। মাথার টুপি ঠিক করতে করতে সেলাম ঠোকে।

পার্কিং-এ গাড়ি রেখে হাতে ব্যাগ নিয়ে নেমে এল প্রতীক। গাড়ি রাখার জায়গায় আলো পর্যাপ্ত। পরপর অনেক গাড়ি। নিরাপত্তার কারণেই করা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় শোরুম। গাড়ি লক করল প্রতীক। মাথা তুলে তাকাল ওপরে। তার ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। কিঙ্কির ঘরটা শুধু অন্ধকার। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। ভালই করেছে। কতক্ষণ জাগবে? কাল সকালে ঘটনাটা বলতে হবে। ব্রেকফাস্ট টেবিলের পক্ষে বাবার এই পাগলামি যথেষ্ট মজার হবে। গা ছমছমেও। তবে ভাগ্যিস টায়ার পাংচারের গল্পটা ঠিক সময় মাথায় এসেছিল। নইলে সুশ্রী খুব টেনশন করত। কে জানে হয়তো ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। অনেক সময় যে ঘটনা রাস্তায় চিন্তা বাড়ায়, বাড়িতে কফি খেতে খেতে সেটাই হয়ে যায় হাসির।

ক্লান্ত প্রতীক নিজের মনেই আবার হেসে ফেলল। কয়েক পা এগিয়ে ঘাড় ঘোরাল গাড়ির দিকে। বহুদিনের অভ্যেস। ড্রাইভার ইন্দ্রিয় গাড়ির দিকে তাকিয়ে বোধহয় ‘শুভরাত্রি’ জানায়।

আর তখনই দাগটা চোখে পড়ল প্রতীকের। তার গাড়ির চাকা থেকে চলে গেছে গেট পর্যন্ত। তারপর গেট পেরিয়ে আরও…

আলোয় বুঝতে অসুবিধা হল না, দাগটা রক্তের।

শারদীয়া বর্তমান, ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *