পুঁইশাক
আবার একই কাণ্ড! একই ভুল!
এই নিয়ে দশ দিনের মধ্যে দু’বার ঘটল। ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মনে হল, ভেতরে এমন কিছু আছে যেটা থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, এবারের ভুলটা যেন বেশি। প্রথমবার মনে হয়েছিল, জিনিসটা ঠান্ডা! আজ মনে হল, জিনিসটা ঠান্ডার সঙ্গে শক্তও। সাধারণ শক্ত নয়, লোহা পিতল যেমন শক্ত হয়, সেরকম শক্ত। বাজারের ব্যাগে লোহা কোথা থেকে আসবে?
প্রথমবারের মতো ঝটকা দিয়ে আজও হাত সরিয়ে নিলেন প্রলয় সমাদ্দার। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি সামনের মাঘে ছাপ্পান্ন শেষ করছেন। এই বয়সে একই ভুল বারবার হতে থাকলে দুশ্চিন্তায় ভুরু কুঁচকে যাওয়াটাই উচিত। আজ বাজারের ব্যাগে ভুল হচ্ছে, কাল ভুল হবে অফিসের কাজে। প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোট পদের চাকরি। সামান্য ভুল হলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। তার ওপর অফিসের অবস্থা ভাল নয়, নড়বড় করছে। গত এক বছর ধরে অর্ডার কমেছে। ম্যানেজমেন্টও খরচ কমাচ্ছে। এ বছর বোনাস দিয়েছে আদ্দেক। কিছুদিন আগে পর্যন্ত অসুখ-বিসুখ, মেয়ের বিয়ে, ফ্ল্যাটের জন্য লোন চাইলে পাওয়া যেত। এখন হাজারটা ফ্যাকড়া তুলে আটকাচ্ছে। প্রোডাকশনের নিশিকান্ত মাইতির বউয়ের ইউটেরাসে টিউমার। অপারেশন লাগবে। গত মাসে দশ হাজার টাকার লোনে অ্যাপ্লিকেশন জমা দিয়েছিল। এখনও এক পয়সা পায়নি। অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার তিন ধরনের ব্লাড রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে। ভাবটা এমন যে, অপারেশন হাসপাতালে হবে না, অপারেশন হবে অফিসের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে। ম্যানেজার নিজে করবে। চাকরিতেও হাত পড়ছে। ইতিমধ্যে তিনজন পিয়নকে আর লাগবে না বলে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রাডাকশনে দু’জনের কনট্র্যাক্ট রিনিউ হয়নি। কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে, এবার ক্লার্ক, অফিসারদের পালা। পরিস্থিতি কঠিন। সবাই কাটা হয়ে আছে। এই অবস্থায় সামান্য ভুলও মারাত্মক।
ভুরু কেঁচকানো অবস্থাতেই প্রলয়বাবু ব্যাগের দিকে তাকালেন। না, কোনও গোলমাল নেই। রোজকার মতো রান্নাঘরের দোরগোড়ায় আধখানা মুখ খুলে কেতরে পড়ে আছে। নদোষ ভঙ্গিতে। একটু যেন লাজুক ভাব! সম্ভবত বহুদিন ভরা বাজার নিয়ে পিঠ সোজা করে দাড়াতে পারেনি বলে লজ্জা। এই ব্যাগের প্রতি অবশ্য কোনও মমতা নেই প্রলয়বাবুর। সিন্থেটিকের এই জিনিস তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। তার বিশ্বাস, বাজার করবার ব্যাগ হবে করে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি সেরকম ব্যাগ নিয়ে বাজার যেতেন। বহুদিনের অভ্যেস ছিল। করবীদেবী হুট করে একদিন অভ্যেস বদলে দিলেন। বদলালেন বড় অদ্ভুত কারণে।
‘এ আবার কী! আজকাল কেউ চটের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে বাজারে যায় নাকি? বিশ্রী। লাগে।
প্রলয়বাবু অবাক হয়ে বলেন, ‘কেন যাবে না। অনেকেই যায়।’
করবীদেবী চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘যে যায় যাক, তুমি যাবে না। বস্তার মতো দেখায়। কাল থেকে তুমি অন্য ব্যাগ নেবে। বিকেলে কিনে আনব। আজকাল অল্প দামে সিন্থেটিকের জিনিস পাওয়া যায়, সুন্দর দেখতে।’
প্রলয় সমাদ্দারের মনে হল, স্ত্রীকেও পালটা একটা ধমক দেওয়া উচিত। বলা দরকার— ‘না আমি এই ব্যাগ নিয়েই যাব। এত বছর ধরে যা করছি হঠাৎ পালটাব কেন? তা ছাড়া আমি কীসে বাজার করব চটের বস্তা না লোহার ট্রাঙ্কে, সে ব্যাপারে তুমি নাক গলানোর কে? আমি কি তোমার ব্যাপারে নাক গলাই?’
প্রলয়বাবু ধমক দিতে পারলেন না। আজ থেকে দশ-পনেরো বছর আগে হলে হয়তো পারতেন, কিন্তু এখন পারেন না। ঘরে-বাইরে কোথাওই পারেন না। এটা তাঁর পক্ষে যেমন অসুবিধের হয়েছে, তেমন আবার সুবিধেরও হয়েছে। অসুবিধে হল, এর ফলে প্রায় কোনও সময়েই উচিত কথা বলা হয় না। আর সুবিধে হল, জীবনযাপনটা ক্রমশ ঝগড়া-ঝামেলাহীন, শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রলয়বাবু হিসেব করে দেখেছে, একটা বয়েসের পর জীবনে উচিত কথার কোনও দাম নেই, দাম আছে শান্তির। শান্তির জন্য তিনি নিজেই নিজের মেকানিজম তৈরি করে নিয়েছেন। ঘরে-বাইরে খানিকটা ধমকানি, দু-পাঁচটা অপমান, কিছুটা অবজ্ঞা চুপচাপ সহ্য করে নিলেই কাজ হচ্ছে। প্রথম প্রথম সমস্যা হত। এখন আর হয় না। প্র্যাকটিস হয়ে গেছে। প্র্যাকটিসে সব হয়। আজকাল ট্রামে বাসে কেউ পা মাড়িয়ে দিলে আর গায়ে লাগে না। অসহ্য গরম রাতে টানা লোডশেডিং চললেও ঘামে ভিজে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকেন। বাজারে ছোটখাটো ওজন ঠকানোর ঘটনায় চোখ ফিরিয়ে নেন। অল্প ক’টি পয়সার জন্য ঝামেলা ভাল লাগে না। সেদিন করবীদেবীকে ধমকাতে গিয়েও থমকে গেলেন। নরম গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে বলো তো? তুমি হঠাৎ বাজারের ব্যাগের মতো সামান্য জিনিস নিয়ে পড়লে কেন?’
করবীদেবী ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, ‘আমি পড়িনি, তোমার মেয়ে পড়ছে।’
‘মেয়ে! সুমি?’
‘সুমি ছাড়া তোমার আর ক’টা মেয়ে আছে। বোকার মতো কথা বলছ কেন? এত বয়স হল, বোকার মতো কথা বলার অভ্যেস ছাড়তে পারলে না? সেদিন সুমির শ্বশুরমশাই গাড়ি থেকে তোমায় দেখেছেন।’
একমাত্র মেয়ের শ্বশুরমশাই মানুষটি অতিরিক্ত রকমের বড়লোক। তাঁর প্রসঙ্গ উঠলেই প্রায় সমাদ্দারের নার্ভাস লাগে। সেদিনও লাগল। কাঁপা গলায় বললেন, ‘সুমির শ্বশুরমশাই! আমাকে দেখেছেন?’
করবীদেবী গলায় ঝাঁঝ বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমাকে দেখবেন কেন? তুমি এমন কিছু রাজা-গজা নও যে, তোমায় দেখতে হবে। তোমার ব্যাগ দেখেছেন। দিলি না মুম্বইয়ের প্লেন ধরবেন বলে ভদ্রলোক এই রাস্তা দিয়ে এয়ারপোর্ট যাচ্ছিলেন। গাড়ি থেকে দেখলেন, হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে তুমি চলেছ। ফিরে এসে সুমির কাছে হাসাহাসি করেছেন।’
‘হাসাহাসি! হাসাহাসি কেন? বাজারে ব্যাগ নিয়ে যাব না তো কী নিয়ে যাব, করবী? প্রলয়বাবুর বিস্ময় বাড়ে।
করবীদেবী কঠিন চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, উনি ব্যাগ বুঝতে পারেননি, বলেছেন, সুমি, তোমার বাবাকে দেখলাম সাতসকালে হাতে একটা ছোট বস্তা নিয়ে। চলেছেন। ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছিল বলে দাড়াতে পারিনি,নইলে গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করতাম। ব্যাপার কী বলো তো? ছি ছি। সুমির তো লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা। আমাকে ফোন করে কান্নাকাটি করল। বলল, মা, বাবা কি আজকাল সকালে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়োতে বেরোচ্ছে?
প্রলয় সমাদ্দার ‘হা হা’ আওয়াজে বোকা ধরনের হাসলেন। বললেন, কথাটা সুমি ভুল বলেনি। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কদিন পরে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়োতে বেরোলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বেঁচে থাকতে হলে একটা সাইড বিজনেস লাগবে। সেদিক থেকে র্যাগ পিকার হওয়া সবথেকে ভাল। মূলধন লাগবে না।’
করবীদেবী এবার গলা তুলে ধমকে উঠলেন, ‘চুপ করো। আমার সঙ্গে পচা ধরনের রসিকতা করবে না। মেয়ের একটা প্রেস্টিজ আছে। আগে ছিল না, বিয়ের পর হয়েছে। তোমার মতো দু’পয়সার কেরানির ঘরে তার বিয়ে হয়নি। তুমি সম্বন্ধ দেখলে অবশ্য তাই হত। মেয়ে নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে হয়নি। সুমির শ্বশুরবাড়ির টাকা পয়সা সম্পর্কে কি তোমার এখনও ধারণা হয়নি?’
স্ত্রীর মকে দ্রুত হাসি মুছে প্রলয়বাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘অবশ্যই হয়েছে। সুমির বিয়ের দু’বছর হয়ে গেল এখনও ধাক্কা সামলাতে পারিনি। মাথার ওপর বিরাট ধার। রাতে ভাল করে ঘুম হয় না।’
করবীদেবী মুখে ‘ফুঃ’ ধরনের তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করে বললেন, ‘তোমার টাকা নেই তাই ঘুম হয় না। সেটা তো সুমির শ্বশুরবাড়ির অপরাধ নয়। তারা তো আর এসে তোমাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাতে পারবে না। যা-ই হোক, কাল থেকে তোমার ওই বস্তা বাতিল। সুমি বলে দিয়েছে, আর একদিনও যদি তার শ্বশুরবাড়ির কেউ তোমাকে ওই অবস্থায় দেখে, তা হলে সে সুইসাইড করবে।’
প্রলয়বাবু বিনীত ভঙ্গিতে বলেন, ‘ব্যাগের বদলে আমি যদি বাজার বদল করি, করবী?’ বাজার বদল! মানে?’
‘মানে, এমন কোনও বাজারে গেলাম যে-দিকটায় এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথ পড়ে না। ধরো স্টেশনের দিকে…। সুমির শ্বশুমশাই তো প্লেনে ছাড়া যাতায়াত করেন না।’
করবীদেবী স্বামীর দিকে আগুন চোখে তাকালেন। প্রলয়বাবু বুঝলেন আর কথা বাড়ালে এবার বড় ধরনের অশান্তি আসবে। চোখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ঠিক আছে করবী, তুমি ব্যাগটা বদলেই দিয়ো।’
ব্যাগ বদলেছে। তারপরে এই ঘটনা। এক দিন নয়, পরপর দু’দিন ঘটল। হাত ঢুকিয়ে মনে হল, ভেতরে এমন কিছু রয়েছে, যা বাজারের ব্যাগে থাকার কথা নয়, বিচ্ছিরি ধরনের মনের ভুল। ভুল কেন হচ্ছে?
প্রথম ঘটনাটা ঘটে এক বুধবার। বাজার থেকে ফিরে রোজকার মতো আনাজপাতি বের করতে গিয়েছিলেন প্রলয়বাবু। করবীদেবী স্বামীর এই একটা একটা করে ঝিঙে পটল বের করা সহ্য করতে পারেন না। টানাটানির সংসারে বাজার করা আনাজপাতি এমন কিছু হিরে জহরত নয় যে, বের করে সাজাতে হবে। তা ছাড়া যত দিন যাচ্ছে, আইটেম, কোয়ান্টিটি দুটোই কমছে। তাই নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কী আছে? এই কারণেই স্বামী বাজার নিয়ে ফেরার সময় করবীদেবী রান্নাঘরে আসেন না। খানিক পরে আসেন। সেই বুধবারও আসেননি। কুমড়োর ফালি বের করার সময়ে মুহূর্তের জন্য ব্যাগের ভেতরে অজানা জিনিসের স্পর্শ পেয়েছিলেন প্রলয়বাবু। একা একাই চমকে উঠেছিলেন। সাবধানে ব্যাগের মুখ বড় করে উঁকি দিলেন ভেতরে। না, অচেনা কিছু নেই। কুমড়োর ফালির পাশে পড়ে আছে ক’টা ঢেড়শ, ছোট একটা পেঁপে। সবই চেনা! বছরের পর বছর হাতে ধরে নেড়েচেড়ে দেখছেন। ভুল বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়েছিলেন প্রলয়বাবু। কেন এমন হল? স্নান করতে করতে ঘটনা মনে পড়ল। ভুল হওয়ার পিছনে কারণ আছে। বছরখানেক আগে অফিসের নীতিশবাবু একটা গল্প বলেছিলেন। তার বেকার শ্যালকের গল্প। শান্তশিষ্ট, গোবেচারা টাইপ সেই ছেলে বসিরহাট না বনগাঁ কোথায় যেন থাকে। ছোকরা এক সকালে বাজার সেরে ফিরে ব্যাগ থেকে পেঁয়াজকলি টেনে বের করতে গিয়ে ঠান্ডা, তেলতেলে কিছু একটা ধরে ফেলে। বের করতে দেখা গেল ইঞ্চি তিন-চার লম্বা একটা সাপের বাচ্চা! পেঁয়াজকলির ডাঁটিতে জড়িয়ে আছে। বড় কিছু নয়, হেলে সাপ। শ্যালক বেচারি রান্নাঘরেই জ্ঞান হারায়। মনে আছে, গল্প বলে নীতিশবাবু খুব খানিকটা হেসেও ছিলেন। ভিতু শ্যালকের কাণ্ড নিয়ে হাসি। নিশ্চয় সেই গল্প এখনও মাথায় রয়ে গিয়েছে, আর তার থেকেই ভুল। মাথা খুব আশ্চর্য জিনিস। কোন পুরনো ঘটনা কখন উকি মেরে ফিরে তাসে, কেউ বলতে পারে না।
কিন্তু সে তো বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। আজ আবার একই ভুল কেন হবে? প্রলয়বাবু মন শক্ত করে ব্যাগের মুখটা বড় করে খুলে ধরলেন। না, আজও অচেনা অজানা কিছু নেই। সাপ-ব্যাং, লোহা-পিতল কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে চিমসে চেহারার পটল, ছোট সাইজের বেগুনটা। উচ্ছে দুটোও কুড়ুলি পাকিয়ে আছে। একবারে ডানদিকে গুটিসুটি মেরে, মাথা দুমড়ে মুচড়ে রয়েছে খানিকটা সজনে ডাটা। আগে এই ভঁটা ছিল জলভাত। এখন দামি জিনিস। কেনবার সময় ভাল করে দেখে নিতে হয় ঠিকমতো বেঁকছে কি না। প্রলয়বাবু আজও বেঁকাতে চেয়েছিলেন। আজও অনুমতি দেয়নি। ঠোট বেঁকিয়ে বলেছে, ‘নেবেন তো এই ক’টা, তার আবার সোজা বেঁকার কী আছে?
প্রলয়বাবু ভেবেছিলেন, বেলা বাড়লে ব্যাগের ঘটনা মা থেকে মিলিয়ে যাবে। মেলাল না। আবছাভাবে রয়ে গেল। অস্বস্তির মতো। অস্বস্তি মানেই অশান্তি। প্রলয়বাবু বিরক্ত হলেন। তিনি অশান্তি পছন্দ করেন না।
খাওয়ার সময়ে করবীদেবী পাতে লাউয়ের তরকারি দিতে দিতে বললেন, ‘সামনের রোববার সুমি আসছে। ক’টা দিন থাকবে। জামাই দিতে আসবে। আমি জামাইকে দুপুরে খেতে বলেছি। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, আমি জোর করেছি।’
প্রলয়বাবু অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘জোর করলে কেন?’
করবীদেবী পরিবেশন বন্ধ করে বললেন, ‘মানে! ছেলেটাকে কতদিন খাওয়ানো হয়নি বলো তো?’
প্রলয়বাবু মুখ নামিয়ে ভাতের গ্রাস মুখে তুললেন। না, লাউটা ঠকিয়েছে। সজনে ডাঁটাও খারাপ হবে।
‘আমি তা বলিনি, ওর হয়তো কাজ ছিল।’
করবীদেবী বললেন, ‘কাজ ছিল তো কী হয়েছে? তা বলে নেমন্তন্ন করব না? সুমিই বা কী ভাববে? এখন কিছু বলবে না, পরে কথা শোনাবে।’
প্রলয়বাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা হলে ঠিকই করেছ।’
করবীদেবী মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘তোমার কাছে ঠিক ভুলের সার্টিফিকেট চাইনি। ওইদিন ঠিকমতো বাজার করবে। সুমি বলেছে, ছেলে চিংড়ি মাছ ভালবাসে। তুমি গলদা নেবে। বড়টা পারবে না, সে মুরোদ তোমার নেই, মাঝারিটা আনবে।’
অফিসে যাওয়ার পথে প্রলয়বাবু ট্রামেই হিসেব কষতে লাগলেন। গলদা চিংড়ির দাম এখন কত যাচ্ছে? কার কাছ থেকে ধার পাওয়া যায়? নীতিশবাবুকে একবার বলে দেখা যেতে পারে। নইলে অন্য চেষ্টা করতে হবে। হাতে ক’দিন সময় আছে।
ধার চাওয়া হল না, নীতিশবাবু অফিসে আসেননি। এদিকে অফিসে জোর গুজগুজ ফুসফুস চলছে। ইউনিয়নের সঙ্গে বসে ম্যানেজমেন্ট নাকি গোপন লিস্ট বানাচ্ছে। ছাঁটাইয়ের লিস্ট। সেই লিস্টে ইউনিয়ন নিজের লোকদের বাঁচাবে। প্রলয়বাবু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। লিস্টে তার নাম নেই তো? থাকলে কঠিন সমস্যা হবে। মাথার ওপর ধারের বোঝ। তার ওপর রয়েছে সুমি। বেচারি শত্রবাড়িতে কী বলবে? বুড়ো বয়সে বাবার চাকরি চলে গিয়েছে? চিন্তা বাড়তে থাকল। ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে একবার দেখা করলে কেমন হয়? অনেকেই নাকি করেছে। এতদিন পলিটিক্সের ধারে কাছে যাননি। এখন মনে হচ্ছে, কাজটা বিরাট ভুল হয়েছে। সেরকম বুঝলে হাতে-পায়ে ধরতে হবে। ফাইল সরিয়ে উঠে পড়লেন প্রলয়বাবু। ওদের কী বলতে হবে? ভাই, দয়া করে আমাকেও আপনাদের সঙ্গে রাখবেন? কথা বলার সময় কি হাত কচলাতে হবে? কোনও সমস্যা নেই। হাত কচলানো যাবে।
নেতারা কেউ দেখা করল না। দরজা বন্ধ করে ইমারজেন্সি মিটিং চলছে। মুখ বাড়িয়ে জানিয়ে দিল, দিন তিনেকের আগে সময় হবে না। মনে গভীর অশান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন প্রলয়বাবু।
এদিকে নীতিশবাবু পরপর তিন দিন অফিসে এলেন না। তাঁর সম্পর্কে মারাত্মক খবর পাওয়া গিয়েছে। সেই খবর সত্যি না মিথ্যে, বোঝা যাচ্ছে না, তবে অফিসে সবাই জেনেছে। নীতিশবাবুর বনগাঁর এক শ্যালক নাকি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। ছোকরার বাজারের শগে রিভলভার পাওয়া গিয়েছে। পুঁইশাকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুলিশ হাতেনাতে ধরেছে। তল্লাশির সময় তারা ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে প্রথমে ঠান্ডা, শক্ত জিনিসের হেয়া পায়। এমনি শক্ত নয়, লোহা পিতলের মতো শক্ত। এর পরই অস্ত্রটা টেনে বের করে। তখনও নলের সঙ্গে নাকি ক’টা পুঁইশাকের ভেজা ভেজা পাতা ঝুলছিল। নীতিশবার শ্যালককে বাঁচাতে থানা পুলিশ করছেন।
খবর শুনে অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন প্রলয়বাবু। সেই গোবেচারা টাইপ, ভিতু ছেলেটা না? সাপের বাচ্চা দেখে যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল?
রবিবার সকালে ধার করা টাকায় জামাইয়ের জন্য হাত খুলে বাজার করলেন প্রলয় সমাদ্দার। মাঝারি সাইজের গলদার সঙ্গে বড় ট্যাংরাও নিয়েছেন। সঙ্গে গাদাখানেক তরিতরকারি। যেমন করবীদেবী বলে দিয়েছিলেন। শুধু তার বাইরে দুম করে বেশ খানিকটা পুঁইশাক কিনে ফেলেছেন। কোনও দরকার ছিল না, তবু কিনেছেন। ঠিক করেছেন বাড়িতে ফিরে আগে গোপনে একবার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেখবেন। দেখবেন হাতে রিভলভারের ঠান্ডা, শক্ত ছোঁয়া লাগে কি না।
দু’বার ভুল হয়েছে বলেই যে বারবার ভুল হবে, তার কী মানে আছে?
আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয়, ১০ জানুয়ারি, ২০১০