তালিকা
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দোলা রিকশওলার সঙ্গে ঝগড়া করছে। গলা ফাটানো ঝগড়া নয়, শান্ত ভঙ্গিতে নিচুগলার ঝগড়া। সাত বছরের কিটি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে সেই ঝগড়া শুনছে। তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, মায়ের ঝগড়া শুনতে তার ভাল লাগছে।
দোলা রিকশওলাকে বলল, ‘ভাই, তুমি এরকম কোরো না।’
বুড়ো রিকশা অবাক হয়। বলে, ‘ওমা! আমি কী করেছি! করছেন তো আপনি। টাকার নোট নিয়ে প্যাঁচাল করছেন।’
দোলা বলল, ‘দেখো, আজ আমার মন খুব খারাপ। আমার বাবার অসুখ। সহজ অসুখ নয়, কঠিন অসুখ। অসুস্থ বাবাকে আমি দেখতে এসেছি। টাকার নোট ছেঁড়া না ময়লা এরকম একটা সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করবার মতো মনের অবস্থা আমার নয়।’
রিকশওলা কাঁধের গামছা তুলে কপালের ঘাম মোছে। অবাক গলায় বলে, ‘তা হলে খামকা ঝগড়া করেন কেন? ঝগড়া করার জন্য আমি কি আপনার পায়ে পড়েছি?’
দোলা নিচু গলায় বলল, ‘তুমি এরকমভাবে কথা বলছ কেন ভাই?’
রিকশওলা আরও বিরক্ত হয়। ঠোঁট উলটে বলে, ‘তা হলে কীরকমভাবে বলব?’
‘কোনওভাবেই বলবে না। শুধু ময়লা নোটটা বদলে দেবে।’
রিকশওলা বিরক্ত মুখে কোমরের কাছে লুঙ্গির গিট খোলে। হাতের মুঠিতে খানকতক নোট বের করে দোলার সামনে মেলে ধরে। হতাশ ভঙ্গিতে বলে, ‘নেন, যেটা আপনার পছন্দ তুলে নেন!’
দোলা মুখ বাড়িয়ে দেখে সব নোটই মলিন। একটাও তুলে নেওয়ার মতো নয়। সে মেয়ের হাত ধরে গেট খুলে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এটা দোলার স্বভাব। যখনই সে বাপের বাড়িতে আসে রিকশওলার সঙ্গে ঝগড়া করবে। স্টেশন থেকে রিকশতে উঠেই ঝগড়া শুরু করে দেয়। ঝগড়ার বিষয় এক-এক দিন এক-এক রকম। কোনওদিন নড়বড়ে সিট, কোনওদিন বেশি ঝাঁকুনি, কোনওদিন হাতলে পেরেক। সবই খুব হালকা পলকা বিষয়। চাপা গলার কারণে ঝগড়ার ফলাফল চট করে বোঝা যায় না, তবে ঘটনা হল প্রতিবারই সে ঝগড়ায় পরাজিত হয়। দোলার অবশ্য এতে কিছু আসে যায় না। পরেরবার যখন আসে একইভাবে আবার ঝগড়া করে।
আজ ঝগড়ার সময় দোলার গলা ছিল সামান্য উঁচুর দিকে। বারান্দা থেকে পার্থ দিদির ঝগড়া শুনতে পেয়েছে। পার্থর মুখে বিরক্তি, হাতে সিনেমার পত্রিকা। পত্রিকা এক বছরের বাসি। বাইশ বছরের এক বেকার যুবক সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে বাসি সিনেমা পত্রিকা পড়ছে, এটা একটা অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। পার্থর কোনও উপায় নেই। এই কাজ তাকে নিয়মিত করতে হয়। পত্র-পত্রিকা ঘেঁটে সিনেমার নায়ক নায়িকাদের সম্পর্কে গুজব বের করতে হয়। গসিপ। সেই তালিকায় প্রণয়, বিবাহ, চুম্বন যেমন থাকে তেমন দিনদুপুরে সহকারী পরিচালককে উপ-নায়িকার চড় মারা, মধ্যরাতে খলনায়ককে কোরাস গায়িকার গান শোনানো ধরনের ঘটনাও থাকে। পার্থ জানে এই কাজ খুবই নিচু মানের। কিন্তু সে কী করবে? তার সুন্দরী, বোকা, প্রেমিকা আত্রেয়ী একজন গুজব সংগ্রাহক। শুধু সংগ্রাহক নয়, আত্রেয়ী সব ধরনের গুজব বিশ্বাসও করে। এই মেয়েকে নিয়মিত গুজব সাপ্লাই না করতে পারলে বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়। মেয়ে ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ফোন কিছুই ধরে না। এমনকী বাড়িতে গেলে দেখা পর্যন্ত করে না। কাজের মেয়ে এসে গম্ভীর মুখে অপমান করে। বলে, ‘দিদিমণির মাথা ধরেছে। আপনি এখন যান।’
দিদির গলা শুনে মুখ তুলল পার্থ। গ্রিলের ফাঁক থেকে দোলাকে দেখা যাচ্ছে। তার পায়ের কাছে সুটকেস। বাপের বাড়িতে এলেই দোলা সুটকেস আনবে। একবেলার জন্য এলেও আনবে, একমাসের জন্য এলেও আনবে। এটা তার মায়ের পরামর্শ। মা বেঁচে থাকতে মেয়েকে এই পরামর্শ দিয়ে গেছেন।
‘বাপের বাড়িতে যখনই আসবি সবসময় রেডি হয়ে আসবি। সঙ্গে ব্যাগ, সুটকেস আনবি। কখন হুট বলতে থেকে যেতে ইচ্ছে করে তার কোনও ঠিক আছে? কোনও ঠিক নেই। একটা কথা মনে রাখবি দোলা, বাপের বাড়ি হোটেল বা হলিডে হোম নয় যে আগে থেকে বলে কয়ে ঘর বুক করে আসতে হবে। তা ছাড়া সুটকেস আনার পেছনে আরও একটা ব্যাপার আছে। সেটাই আসল।’
দোলা অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘কী ব্যাপার মা?’
মা আনাজ কুটতে কুটতে এদিক ওদিক তাকান। তারপর গলা নামিয়ে বলেন, ‘বাড়ির বউ ব্যাগ, সুটকেস নিয়ে বেরোলে শ্বশুরবাড়ি চাপের মধ্যে থাকে। আমার যখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিল, আমিও তোর বাবার ওখানে এই চাপ দিয়েছি।’ কথা শেষ করে মা সামান্য হাসলেন।
‘চাপ! কী চাপ মা?’
‘সে তুই এখন বুঝবি না। দু’দিন পরে বুঝবি। একে বলে সুটকেস চাপ।’
‘সুটকেস চাপ!’
মা বঁটি থেকে চোখ তুলে বলেন, ‘হ্যাঁ সুটকেস চাপ৷ এই চাপের আলাদা ব্যাপার আছে। হাতে সুটকেস দেখলে মনে হয়, বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে বউ বাড়ি ছেড়ে চলল। এতে শ্বশুরবাড়িতে খাতির যত্ন বাড়ে। তবে রোজ রোজ ভারী জিনিস বয়ে আনবি না। হালকা দেখে একটা খালি সুটকেস আনবি। তোর শাশুড়ি চাপের মধ্যে থাকবে, সুটকেস যে খালি এই কথা তার মাথায় আসবে না।’
মা মারা গেছেন আড়াই বছর। দোলা সুটকেস আনা বন্ধ করেনি। কেউ বারণ করলে বলে, ‘তোমাদের কোনও অসুবিধে আছে? সুটকেস তোমরা বইছ না আমি বইছি?’
কিন্তু আজ শুধু দোলার হাতে সুটকে নয়, কিটির কাঁধে স্কুলের ব্যাগও রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সেই ব্যাগ তার মায়ের সুটকেসের মতো মিথ্যা নয়। বই খাতায় বোঝাই। পার্থ সতর্ক হল। একটা বিপজ্জনক ইঙ্গিত। এর মানে হল, দিদি তার মেয়েকে নিয়ে সত্যি সত্যি এখানে থাকার জন্য এসেছে। আর দিদি থাকা মানেই বাড়িতে নানা ধরনের ঝামেলা শুরু হওয়া। সকলের সঙ্গে খিটিমিটি, কাজের লোকদের ওপর মাতব্বরি, কিটিকে মারধর, ভাড়াটের জল খরচ নিয়ে চেঁচামেচি এবং সর্বোপরি ভাইয়ের প্রতিটি কাজে নাক গলানো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির সিস্টেমে একটা বড় রকমের গোলযোগ তৈরি করে ফেলে। কী হবে এখন? চিন্তিত মুখে পার্থ পত্রিকার পাতা ওলটাতে লাগল।
গ্রিলের গেট খুলে বারান্দায় উঠতেই কিটি মায়ের হাত ছাড়িয়ে ভেতরে দৌড় দিল। দোলা মাটিতে সুটকেস রেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। পার্থর দিকে ফিরে বলে, ‘বাবা কোথায়?’
পার্থ মুখ না তুলে জবাব দেয়, ‘ভেতরে।’
‘ভেতরে কী করছে?’
পার্থ উত্তর দিল না। দোলা বলল, ‘কী রে বললি না বাবা কী করছে?’ দোলার গলায় অসন্তোষ।
পার্থ গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, ‘কী আর করবে? কাগজটাগজ পড়ছে। ব্রেকফাস্টও করতে পারে। সকালবেলায় বুড়োমানুষ যা করে তাই করছে। বাবা তো আর ডন বৈঠক মারবে না।’
পার্থর গলার ঝাঁঝ বুঝতে পেরেও দোলা যেন বুঝতে চাইল না। আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বউদি যা বলল সত্যি?’।
এবার পার্থ চোখ তুলে দোলার দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমি কী করে জানব বউদি তোকে কী বলেছে?’
‘কাল রাতে বউদি ফোনে আমায় কী বলেছে তুই জানিস না?’
পার্থ মুখ নামাল। ও, গোলমালটা তা হলে বউদি পাকিয়েছে। দিদির এখানে ছুটে আসার জন্য সে-ই দায়ী। এদিকে বউদি নিজে কিন্তু কেটে পড়েছে। দাদা আর মিঠুকে নিয়ে আজ ভোরেই কলকাতায় গেছে। মাসতুতো না পিসতুতো বোনের বিয়ে। দু’দিন এমুখো হবে না। যাওয়ার আগে গোলমাল যা পাকানোর পাকিয়ে দিয়ে গেল। দিদিকে সব বলে দিয়েছে। শুধু কি আর বলেছে? নিশ্চয় কয়েক গুণ বাড়িয়েই বলেছে। যে-কোনও ঘটনা নিয়ে টেনশন ছড়াতে ওই মহিলার জুড়ি নেই। ব্যস, দিদিও বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে ছুটে এসেছে। এখন গোটাটা তাকে একা সামলাতে হবে। সামলানোর দুশ্চিন্তায় পার্থর কপালে অল্প অল্প ঘাম জমতে শুরু করল।
অথচ সেদিন অন্যরকম কথা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, বাবার এই পাগলামির গল্প কাউকে বলা হবে না। একাশি বছরের বুড়োমানুষ কী আবোল তাবোল বললেন, কী আবোল তাবোল করলেন সেটা বাইরে বলে বেড়ানোর কিছু নেই। এই ঘটনা তো একেবারেই নয়। কেনা এই ঘটনা যে শুনবে সেই হাসবে। হাসবারই কথা। বউদি কথা রাখল না। দিদি অবশ্য হাসছে না। তার হয়েছে উলটো রি-অ্যাকশন। চোখ মুখ থমথম করছে। বোকা মানুষদের অনেকসময় এরকম হয়। যা হওয়া উচিত তার উলটো হয়। পার্থর রাগ বাড়ছে। সে বলল, ‘বউদি তাকে কী বলেছে আমি কী করে জানব? আমি তো আর বউদির টেলিফোনে আড়ি পাতি না।’
‘এরকমভাবে বলছিস কেন? এর মধ্যে আড়ি পাতার কী হল?’
পার্থ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিছু হয়নি। বউদি যদি বলে থাকে তা হলে আর আমার কাছে জানতে চাইছিস কেন? একটা জিনিস বারবার জানার কী আছে?’
দোলা বারান্দার কোণে রাখা মোড়া টেনে ভাইয়ের সামনে বসে পড়েছে।
‘নিজের বাবার অসুস্থতার কথা বারবার জানতে চাওয়াটা অপরাধ নাকি?’
পার্থর দুটো ভুরুই কুঁচকে আছে। পত্রিকায় সংগ্রহ করার মতো ছোট বড় কোনও গুজবই নজরে পড়ছে না। এটাও একটা ভয়ের ব্যাপার। দশ দিন হতে চলল আত্রেয়ীকে কিছুই সাপ্লাই করা যায়নি। এবার যে-কোনওদিন মেয়েটা অ্যাকশন নিয়ে বসবে। পরিকল্পনা ছিল, আজ সারা দুপুর ছাদের ঘরে উঠে পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাঁটা হবে। নিশ্চয় কিছু পাওয়া যেত। তারপর নাম বদলে আত্রেয়ীকে বললেই চলবে। গুজব তো একই থাকে, শুধু নায়ক নায়িকার নাম পালটায়। কিন্তু দিদি চলে আসায় পরিকল্পনা মনে হয় বাতিল করতে হবে।
পার্থ রাগ-রাগ গলায় বলল, ‘রেগে যাচ্ছি কোথায়? বাবা অসুস্থ এটা তোকে কে বলল?’
দোলা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ওমা! অসুস্থ নয়! কাল ঘটনা শোনার পর সারারাত ঘুমোতে পারিনি। একটা মানুষ এরকম করছে আর তুই বলছিস অসুস্থ নয়?’
ঘটনা সত্যি। কাল সুপর্ণার টেলিফোনের পর দোলা রাতে ঘুমোত পারেনি। আজ সকালে কোনওরকমে মুখহাত ধুয়ে ছুটে চলে এসেছে। শ্বশুরবাড়িতে বলে এসেছে, কবে ফিরবে ঠিক নেই।
কাল সন্ধেবেলা সুপর্ণা দোলাকে ঘটনা বলেছে। ঘটনার বেশিটাই বুঝতে পারেনি দোলা। এ আবার কী কথা? এরকম আবার হয় নাকি? টেলিফোনে শুনতে শুনতেই গা ছমছম করে উঠেছে তার। সুপর্ণাকে বলেছে, ‘তুমি কী বলছ বউদি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
সুপর্ণা রিসিভারে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে, ‘অত দূরে বসে তুমি কী বুঝবে দোলা? আমি তো এখানে থেকেও কিছু বুঝতে পারছি না। আমার ভীষণ ভয় করছে। বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে মানুষটাকে ভূতে পেয়েছে। ভূতে পেলে এরকম হয়। মানুষ উলটোপালটা কাজ করে। তোমার দাদাকে বলতে গিয়ে ধমক খেলাম।’
নিজের বাবাকে ‘ভূতে পেয়েছে’ কথাটা শুনতে দোলার ভাল লাগল না। তবে এখন ভাল-মন্দ লাগার ব্যাপার নেই। এখন বিপদের সময়। সে কাঁপা গলায় বলল, ‘ওই জিনিস তুমি নিজের চোখে দেখেছ?’
‘না, আমি দেখিনি, পরশুদিন তোমার দাদা দেখেছে। তোমার বাবাই দেখিয়েছেন। বিকেলবেলা আমাকে ডেকে বলল, বউমা, তীর্থ কখন অফিস থেকে ফিরবে? আমি বললাম, ফোন করেছিল। আজ একটু দেরি হবে, মিটিং আছে। সাতটা দশের গাড়িতে ফিরবে। তখন তোমার বাবা বললেন, সাতটা দশের ট্রেনটা ভাল না, লেট করে। যাই হোক তীর্থ এলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি জেগে থাকব। দরকার আছে।’
দোলার শ্বশুরবাড়িতে টেলিফোনে কথা বলতে হয় দাঁড়িয়ে। শ্বশুরমশাই নিজে এই ব্যবস্থা করেছেন। টেলিফোনের কাছ থেকে চেয়ার, টুল, মোড়া, সোফা সব সরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হল, টেলিফোন পার্কের লেক নয় যে তার পাশে বেঞ্চ পেতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতে হবে। টেলিফোন একটা জরুরি জিনিস। দাঁড়িয়ে কাজের কথাটুকু বলে ছেড়ে দিলেই চলবে। দোলার অবশ্য কোনও অসুবিধে হয়নি। প্র্যাকটিস হয়ে গেছে। টেলিফোনের রিসিভার কানে নিয়ে ঘণ্টাখানেক দাঁড়ানো তার কাছে আজকাল জলভাত। কাল রাতেও সুপর্ণার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল সে। তবে পা-টা একটু যেন কাঁপছিল। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নিজের বাবার এই ঘটনা শুনলে যে-কোনও মেয়েরই পা কাঁপবে।
‘তারপর কী হল বউদি?’
‘কী আবার হবে? রাতে তোমার দাদা এসে বাবার ঘরে গেল। তখন উনি দেখালেন।’
‘কী দেখালেন?’
‘ওমা, শুরুতেই তো বললাম। নিজের হাতে লেখা একটা তালিকা দেখালেন, লিস্ট। পার্থও ঘরে ছিল। সেও দেখেছে। আমিও ছিলাম। তবে ঘরে ছিলাম না, ঘরের বাইরে পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরের বাড়ির মেয়ে তো, তাই উনি ডাকেননি।’ সুপর্ণার গলায় অভিমান।
দোলা অভিমানে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘পরদার আড়াল থেকে কী দেখলে?’
‘অত দূর থেকে কিছু দেখা যায় নাকি? শুধু দেখলাম তোমার বাবা একটা খাতার পাতা ওলটাচ্ছেন। হলুদ মলাটের বেঁটে খাতা, লাইন টানা। আর তাঁর দুই ছেলে ঝুঁকে পড়ে সেই খাতা দেখছে। পরে তোমার দাদা বলল, মোট অভাই পাতার তালিকা হয়েছে। তাতে নাম লেখা আছে।’
‘নাম লেখা!’
সুপর্ণা থমথমে গলায় বলল, ‘হ্যাঁ নাম, সব মরা মানুষের নাম। তোমার বাবার আত্মীয়স্বজন, ছোটবেলার বন্ধু, অফিসের লোক, পাড়ার মানুষ। অনেক নাম। যেখানে যত মরেছে। নামের পাশে ছোট ছোট করে লেখা কার জন্য কী নিয়ে যাবেন।’
একটু আগে দোলার পা কাঁপছিল। এবার হাতও কাঁপতে থাকে। শক্ত হাতে রিসিভার চেপে ধরে বলে, ‘মানে! নিয়ে যাবে মানে?’
‘মানে আমি জানি না। তোমার দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে গম্ভীর হয়ে বলল, পাগলামি। বাবার মাথাটা পুরো গেছে। উনি নাকি বুঝতে পেরেছেন আর বেশিদিন নয়, এবার মারা যাবেন। আর তার পরই চেনাজানা সব মরা মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। সেই কারণেই লিস্ট বানাচ্ছেন! কার জন্য কী নিয়ে যানে, কে কী ফেলে গেছে, সেই লিস্ট। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না দোলা, তোমার বাবা ছেলেদের নাকি বলেছেন, কাউকে যদি চিঠিটিঠি লিখতে চাস অসুবিধে নেই। আমাকে দিয়ে রাখিস। হাতে হাতে পৌঁছে দেব। বউমাকেও বলব। ওর যদি কাউকে কিছু দেওয়া টোওয়ার থাকে। তোমার কথাও বলেছে।’ এতটা বলে সুপর্ণা থামল।
দোলা চমকে উঠল। বলল, ‘আমার কথা! আমার কথা কী বলল বাবা?’
সুপর্ণা ফিসফিস করে বলল, ‘বলেছে, দোলাকেও খবর দিতে হবে। ওরও তো কেউ থাকতে পারে। তোমাকে ডেকে পাঠাবে বলেছে। দোলা, আমার ভয় করছে। কী হবে?
আমি আবার দুটো দিন থাকব না। তুমি কালই চলে এসো।’
দোলা চলে এসেছে। শুধু বউদি চলে আসতে বলেছে বলে নয়, নিজে থেকেই সে আসত। যে মেয়ের বাবা মরা মানুষদের জন্য জিনিসের লিস্ট বানাতে বসে সেই মেয়ে না এসে পারে না।
পার্থ পত্রিকা হাতে উঠে দাঁড়াল। সে মনকে শক্ত করেছে। বিপদের সময় মেজাজ হারালে চলে না। বিপদ সামলাতে হয় ঠান্ডা মাথায়। এই মুহূর্তে দিদি একটা বিপদ। তাকে বাড়ি পাঠাতে হবে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে শুনিয়ে। নইলে সব কাজ পণ্ড। শুধু বাড়িতে ঝামেলা নয়, এই মেয়ে ‘বাবা মারা যাচ্ছে,’ বলে আত্মীয়স্বজনদের খবর পর্যন্ত দিতে পারে। তখন একটা বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। থামাতে হবে, যে করেই হোক একে থামাতে হবে। পার্থ অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফোটাল। দোলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবার পাগলামির গল্প তুই পুরোটা শুনিসনি দিদি। হাফ শুনেই টেনশন করছিস। ফুল শুনলে হাসতে হাসতে মোড়া থেকে পড়েই যাবি। বাবার কিছু হয়নি। মরা টরা তো দূরের কথা, মানুষটা অসুস্থই নয়। দিব্যি খাচ্ছে দাচ্ছে, হাঁটছে চলছে। প্রেশার, সুগার, হার্ট সব নর্মাল। এই তো শনিবার চেকআপ হল। পরশু বিকেলে কী করেছে জানিস? কাজের মেয়েটাকে দিয়ে স্টেশন মোড় থেকে তিন টাকার আলুকাবলি আনিয়ে চুপিচুপি খেয়েছে। তেঁতুল জল, লঙ্কার গুঁড়ো ছড়ানো মারাত্মক জিনিস। আমি এক টাকা দিয়ে কাজের মেয়ের মুখ সিল করলাম। খবর লিক না হয়। আহা, বুড়োমানুষ একটা শখ করেছে। দাদা-বউদি শুনলে বকাবকি করবে। যে মানুষ এইট্টি ওয়ানে রাস্তার আলুকাবলি চমৎকার হজম করে ফেলল সে এখন মরবে কী রে? নো চান্স। বউদি তোকে ভয় দেখিয়ে দিল আর তুই ভয় পেয়ে গেলি?’
দোলা উঠে দাঁড়াল। ভাইয়ের কথা পুরো বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার একেবারে উড়িয়েই বা দেয় কী করে? মানুষটা এতটা যখন সুস্থ, মৃত্যুর প্রশ্ন উঠবে কেন? সে অস্ফুটে বলল, ‘আর তালিকা? ওই যে বাবা লিস্ট না কী বানাচ্ছে। সেটা কী?’
পার্থ বুঝতে পারল দিদিকে খানিকটা নরম করা গেছে। এবার বাকিটুকু করতে হবে। ব্যাপার কিছুই নয়, সুতরাং এখানে থেকে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না— এটা বুঝিয়ে সুটকেস এবং মেয়েসহ কলকাতার ট্রেনে তুলে দিতে হবে দ্রুত। সে দিদির দিকে এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘ভীমরতি। বুড়োবয়সের ভীমরতি বুঝিস? বাবা যখন খাতা খুলে লিস্ট দেখাচ্ছিল, তখনই আমি আর দাদা মুখ চাওয়াচায়ি করছিলাম। হাসিও পাচ্ছিল। ভীমরতি না হলে কেউ মরা মানুষের জন্য জিনিস গোছানোর কথা ভাবে? তাও আবার অমন সিরিয়াস মুখ করে! বাপ রে।’ পার্থ আওয়াজ করে হাসল। ইচ্ছে করেই আওয়াজ করে হাসল। অনেক সময় যুক্তির থেকে আওয়াজের হাসি বেশি কাজ দেয়।
‘বাবার ওই লিস্ট দেখলে তুইও হাসতে হাসতে মরবি দিদি। ছেলেবেলায় তার টগর না পলাশ নামে এক বন্ধু ছিল। গাঁয়ের বন্ধু। পুকুরে ডুবে মরেছিল। সেভেন্টি ইয়ার্স আগের ঘটনা। বাবা তার জন্য ডাংগুলি নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে। আমাকে বলল, ডাংগুলি কোথায় পাওয়া যায় খোঁজ করে বলিস তো৷ দেরি করবি না, হাতে টাইম নেই। দিদি, তুই ভাব একবার কাণ্ডটা। যতীনকাকুকে মনে আছে? আরে ওই যে বাবার কলিগ ছিলেন, রোগা করে। সরু গোঁফ। অফিসে বাবার উলটোদিকের টেবিলে বসতেন। হুট করে একদিন অফিসের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। বাবা সারারাত বারান্দায় বসে রইল জেগে। মনে পড়েছে এবার? খাতায় দেখলাম সেই যতীনকাকুর নামের পাশে বাবা লিখেছে— নস্যির ডিবে। দাদুর জন্য ছড়ি, বড়পিসির জন্য লবঙ্গ, মল্লিককাকুর জন্য নাক্সভোমিকা থাট্টি। বাবার এক কাকিমার জন্য বাতের তেল। এসব নাকি ওরা ফেলে গেছে! হি হি। আর কত বলব? ভূগোল স্যারের জন্য কলমের কথা বলেছি? স্কুল জীবনের ভূগোল স্যার। তার নামও বাবার লিস্টে আছে। অঞ্জলিদি নামে কোন মহিলার নামের পাশে লেখা রয়েছে দেখলাম, শাড়ি। ব্রাকেটে লেখা লাল পাড়, গরদ। দাদাকে বলল, এই মহিলা নাকি মায়ের পক্সের সময় দারুণ সেবাযত্ন করেছিল। তোকে এত ডিটেলসে বলছি কেন জানিস দিদি? বলছি, এই কারণে যে শুনলে পাগলামিটা ধরতে পারবি। চিন্তা কমবে। গঙ্গা নামে একজনের জন্য গোলাপ গাছের চারাও নেবে বলে ঠিক করেছে বাবা। ছোট চিনা গোলাপ। তিন পাতার লিস্ট তো কম নয়। এইট্টি ওয়ান ইয়ার্সে এতগুলো মরা মানুষের নাম মনে করে লেখা কি সহজ ব্যাপার?’ পার্থ দম নিতে থামল। দোলার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পাগলামির কথাটা অনেকটাই বিশ্বাস করিয়ে আনা গেছে। পার্থ নতুন উদ্যমে আবার শুরু করল।
‘মনে হয়, বেশ কিছুদিন ধরেই বাবার এই রোগটা ডেভেলপ করেছে। শুধু কি নাম, দেখলাম অনেক ঘটনাও মনে আছে রে! হ্যাঁরে দিদি, মামাবাড়িতে ভবানী নামে কোনও ড্রাইভার ছিল? মনে পড়েছে তোর? বাবা বলল, সেই ভবানী ড্রাইভার নাকি বাবার কাছে জুতো চেয়েছিল। ক্যাম্বিসের জুতো। পরে লোকটা মরল অ্যাক্সিডেন্টে। বাবার জুতো দেওয়া হল না। বাবা এখন ঠিক করেছে, একজোড়া ক্যাম্বিসের জুতো বাক্সে করে নিয়ে স্বর্গে যাবে। ভীমরতির বিরল দৃষ্টান্ত। গবেষণা করার মতো।’
এবার দোলাও হেসে ফেলল। পার্থ বলল, ‘অতএব নো টেনশন। বাবা তোকে কিছু বলতে গেলে হয় হেসে উড়িয়ে দিবি, নয় ধমক দিবি। ভীমরতির রোগীকে ধমক দেওয়া কোনও দোষের নয়। তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে বরং একটা সিনেমা দেখে আয়। মাথা ঠান্ডা হবে। বলিস তো টিকিট কেটে দিই। বিকেলে নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যাবি। মিছিমিছি কিটির স্কুল কামাই করার কোনও দরকার নেই। আন্ডারস্ট্যান্ড মাই বিলাভেড সিস্টার?’
দোলা আবার হাসল। সে এখন পুরোপুরি চিন্তামুক্ত। না, বউদি বেশি টেনশন করেছে। পার্থর কাছে ঘটনা সবটা শুনে বোঝা যাচ্ছে, গোলমাল শরীরে নয়, মাথায়। এই বয়সে একটু আধটু পাগলামি অস্বাভাবিক কিছু নয়। দোলা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিনেমায় কাজ নেই, দুটো চল্লিশের গাড়ি ধরে কলকাতা ফিরে যাব বরং। কিটির আবার গাদাখানেক হোমটাস্ক আছে। ছাড় ওসব, হ্যাঁরে, তোর নিজের কাজকম্মের কিছু হল?’
পার্থ হাঁপ ছাড়ল। অপারেশন সাকসেসফুল। এবার ছাদের ঘরে ওঠার প্রস্তুতি নিতে হবে। একটা হাতপাখা চাই। ছাদের ঘর মানেই বেজায় গরম। মাথায় অ্যাসবেসটস। থেমে নেয়ে একসা হতে হবে। এত পরিশ্রমের পরও যদি গুজব না পাওয়া যায় তা হলে কিছু করার নেই। বানাতে হবে। দোলার দিকে তাকিয়ে পার্থ বলল, ‘না, কাজকম্ম এখনও কিছু হয়নি। তবে ভাবছি খুব শিগগিরই একটা মিউজিয়ম খুলব। সংগ্রহশালা। দেখনা জামাইবাবুকে বলে কিছু টাকাপয়সা ম্যানেজ করতে পারিস কিনা।’
ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও দোলা থমকে দাঁড়াল। চোখ সরু করে বলল, ‘মিউজিয়ম! কীসের মিউজিয়ম?’
পার্থ মুচকি হেসে বলল, ‘গুজবের। গুজবের সংগ্রহশালা। খারাপ হবে?’
অক্ষয়বাবু নিজের ঘরে বসে আছেন ইজিচেয়ারে। ঘরের জানলাগুলো খোলা। সকালের টাটকা হাওয়া এবং রোদ দুই-ই ঢুকছে। সাদা ফতুয়া পায়জামা পরা বৃদ্ধ মানুষটার সাদা চুল উড়ছে। হাতে মাঝারি মাপের একটা কাচের বাটি। তাতে দুধ মুড়ি। বুড়বুড়, বুড়বুড় করে আওয়াজ হচ্ছে। দুধে মুড়ি ভেজার আওয়াজ শুনতে বেশ লাগে অক্ষয়বাবুর। তিনি বড় একটা চামচ দিয়ে আরাম করে দুধ মুড়ি খাচ্ছেন আর আওয়াজ শুনছেন। মেয়েকে দেখে অক্ষয়বাবু খুশি হলেন।
‘আয়, চেয়ারটা নিয়ে বোস। কাছে এসে বোস। কেমন আছিস?’
দোলা বসল না। পাশে দাঁড়িয়ে বাবার কাঁধে হাত রেখে চুপ করে রইল। বাবার খাওয়া দেখতে লাগল। পার্থ ঠিকই বলেছে, মানুষটার মুখে অসুখের কোনও ছাপ নই। বরং বেশ সুন্দর লাগছে। একটা ফ্রেশ ভাব। রাতে ভাল ঘুম হলে এমন হয়। বউদি মিছিমিছি ভয় দেখাল। পরের বাড়ির মানুষের এই হল সমস্যা। মুখ দেখে ভাল মন্দ বুঝতে পারে না।
‘তুমি কেমন আছ বাবা?’
‘খুবই ভাল৷ তোর সঙ্গে দরকার আছে। এসে ভালই করেছিস। নইলে আজই তোকে খবর পাঠাতাম।’
দোলা সতর্ক হল। সে বাবার ঘরে ঢোকার আগেই ঠিক করে নিয়েছে ভাইয়ের পরামর্শ মতোই চুলবে। বাবার কোনও ধরনের পাগলামি প্রশ্রয় দেবে না। বলল, ‘বাবা, শুনলাম তুমি নাকি কী সব কাণ্ড করেছ? কথাটা সত্যি?’
খাওয়া শেষ। কাচের বাটি সাবধানে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন অক্ষয়বাবু। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাণ্ড! আমি আবার কী কাণ্ড করলাম রে বাবা!’
পাশের টেবিলে রাখা জলের গেলাসটা দোলা এগিয়ে দিল। বলল, ‘নাও, খাও। কী কাণ্ড তুমি জানো না? কী সব ছাই ভস্ম লিস্ট বানাচ্ছ নাকি। তালিকা।’
অক্ষয়বাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসলেন। বললেন, ‘ওমা ছাই ভস্ম হবে কেন? এই কারণে তোকেও তো খবর দেব ভেবেছিলাম। তোর যদি কেউ…’
দোলা চাপা গলায় ধমক দিল, ‘চুপ করো। চুপ করো। একদম। ছি, বাড়িসুষ্ঠু মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এ আবার কী? দিব্যি সুস্থ শরীরে আছ। প্রেশার, সুগার, হার্ট সব নর্মাল। খাচ্ছ, দাচ্ছ, বেড়াচ্ছ। তুমি এখন মরবে কেন?’
অক্ষয়বাবু মেয়ের হাত থেকে গেলাস নিয়ে দু’চুমুকে পুরো জল শেষ করলেন। এই বয়সে মাত্র দু’চুমুকে এক গেলাস জল শেষ করা সহজ কাজ নয়। কঠিন কাজ। কঠিন কাজটি করতে পেরে তিনি খুশি হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললেন, ‘সব নর্মাল থাকলে বুঝি মানুষ মরে না? মানুষের মৃত্যুই তো একটা নর্মাল জিনিস। সম্ভবত সবথেকে বেশি নর্মাল।’
দোলা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, ‘রাখো তোমার জ্ঞানের কথা। কাল রাতে শুনে আমি এমন ভয় পেয়ে গেলাম… শোনো বাবা, ওইসব লিস্টফিস্টের পাগলামি আজই বন্ধ করো। একটা শিক্ষিত মানুষের এসব কী? কিটি শুনলে দাদু সম্পর্কে কী ভাববে বলো তো? তোমার ওই খাতা কোথায়? খাতা পুড়িয়ে তবে আমি আজ বাড়ি ফিরব।’
অক্ষয়বাবু চোখ বড় করে তাকালেন। চোখে কৌতুক। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি মজা পাচ্ছেন। বললেন, ‘বাপ রে, মনে হচ্ছে একেবারে যুদ্ধ করবি বলে তৈরি হয়ে এসেছিস। হা। হা। ওই খাতা তোমরা এখন আর হাতে পাবে না বাপু। তালিকা তৈরি করতে বিস্তর খাটাখাটনি করতে হয়েছে। খাতা আমি লুকিয়ে রেখেছি। ছেলেদের দেখানো হয়ে গেছে, এখন শুধু তোকে আর বউমাকে একবার দেখাব।’ অক্ষয়বাবু থামলেন। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন খানিকটা আপনমনে বললেন, ‘বুঝলি দোলা, মনে হচ্ছে না আর বেশি সময় পাব। যা করার দ্রুত সারতে হবে।’
দোলা চুপ করে রইল। এবার কিন্তু তার কান্না পাচ্ছে। সত্যি মানুষটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। সে গলা তুলে বলল, ‘বাবা, তুমি যদি এরকম করো আমি কিন্তু এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দেব। এই বলে রাখলাম।’
অক্ষয়বাবু হাসলেন। মানুষ শিশু এবং বৃদ্ধ বয়েসে সবথেকে সুন্দর করে হাসতে পারে। অক্ষয়বাবুর হাসিও সুন্দর হল। তিনি হাত বাড়িয়ে মেয়ের ডান হাতটা ধরলেন। হাত একটু কাঁপছে। কঁপবেই তো। এতটা বয়স হয়েছে।
‘ঠিক আছে, করব না। কথা দিলাম খাতা বন্ধ করে দেব। যেটুকু হওয়ার হয়েছে আর নয়। তবে তুই শুধু একটা কাজ করে দে মা। লাস্ট কাজ।’
দোলা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী কাজ?’
‘তোর মায়ের উল বোনার দুটো কাঁটা খুঁজে দিয়ে যা। বেচারি ওগুলো ফেলে গেছে।’
এই ঘটনার ঠিক সাত দিনের মাথায় মারা যান অক্ষয়বাবু। সকালবেলা, ইজিচেয়ারে বসে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। হাতে দুধ মুড়ির বাটি। সেই বাটি তিনি মেঝেতে নামাতে চেষ্টা করেন। পারেন না। বাটি হাত থেকে গড়িয়ে পড়ে। বিশ্রী আওয়াজ করে ভাঙা কাচ ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে।
এরও অল্প কিছুদিন পরে পার্থ তার বাবার আলমারির কোণ থেকে একটি বাঁধানো ছোট খাতা উদ্ধার করে। হলুদ মলাট, লাইন টানা। খাতাটি তার চেনা। কাপড় জামার মাঝখানে যত্ন করে লুকোনো ছিল। দ্রুত পাতা ওলটায় পার্থ।
তালিকা লেখা সেই পাতাগুলো নেই। কাঁপা হাতে কে যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
শারদীয় আনন্দবাজার, ১৪১৪