যে যা পারে না
যে যা পারে না! এ আবার কী রে বাবা! শাম্বদা মিটিমিটি হেসে বলল, ‘দেখ না কী কাণ্ড হয়। এবারের নবমী একেবারে জমজমাট হয়ে যাবে। একেই বলে যথার্থ রিয়ালিটি শো।’ মেঘনা ভয়-ভয় মুখে বলল, ‘শাম্বদা, পুজোর সময় কোনও ঝামেলা-টামেলা হয়ে যাবে না তো? করতে গেলাম ফান, হয়ে গেল উলটো। তা হলে পুটো কমিটি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না।’ শাম্বদা মেঘনার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘দূর বোকা, সবাই দারুণ খুশি হবে। আইডিয়া কাকে বলে দেখবি। শুধু একটা নোটিশ দিতে হবে।’ আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কী নোটিশ?’ শাম্বদা বলল, ‘নোটিশে লেখা হবে— এই খেলায় নাম দেওয়ার সময় দয়া করিয়া কেহ মিথ্যে বলিবেন না। কী পারেন আমরা তাহা জানিতে চাহি না। যাহা পারেন না তাহাই করিয়া দেখান এবং পুরস্কার জিতুন। কমিটির সঙ্গে কথা বলে প্রাইজ মানিটা হেভি রাখতে হবে।’ অর্ক বলল, ‘মিথ্যে বলার উপায় নেই। আমাদের হাউজিং-এ কে কী পারে, না পারে আমাদের ভালমতোই জানা আছে। বৈশালী কাকিমা গান গাইলে কী কেলেঙ্কারি হয় তা কি আমরা জানি না ভেবেছ? কিংবা ধরো, অপূর্ব কাকুর রান্না। নুন ঝালে পোড়া। মুখে দিলে তিড়িং-বিড়িং করে টানা তিন দিন লাফাতে হবে। বিদিশা মাসিমার ড্রইং? ল্যান্ডস্কেপ আঁকলে তলায় লিখে দিতে হয়— ইহা একটি দৃশ্য। সূর্য অস্ত যাইতেছে। নৌকো চলিতেছে। তারপর ধরো অন্তরার সাজগোজ। যত সাজবে, তত পেতনি ওয়ার্ল্ড ওকে দলে নেবার জন্য টানাহেঁচড়া করবে। সবই জানি। আমাদের ফল্স উপায় নেই।’ শাম্বদা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘যে মিথ্যে বলবে, সে-ই ঠকবে। এই খেলায় কে ভাল পারল, তা তো আর জাজ করা হবে না। জাজ করা হবে কে পারল না।’ আমি বললাম, ‘আরে এর মধ্যে হেনস্তা করার কী দেখছি! আমরা তো আর কাজের এক্সসেলেন্স দেখব না। আমরা দেখব স্পিরিট। পারি না, তবু বুক ফুলিয়ে, সাহস করে করবার চেষ্টা করলাম। এটাই তো ফেস্টিভ্যালের স্পিরিট। যার স্পিরিট যত ভাল হবে, সে-ই জিতবে। ইটস্ জাস্ট ফান।’
সবাই হইহই করে উঠল। আমি চুপ করে রইলাম। শাম্বদা বাড়াবাড়ি করছে। বেশি পাকা। মজার খেলা খেলতে গিয়ে একটা গোলমাল না হয়ে যায়। মনে হচ্ছে হয়ে যাবে।
পুজোর সময় আমাদের এখানে এমনিতেই নানান ধরনের গোলমাল হয়। কাশফুল, শরতের মেঘ দেখলে সবাই বুঝতে পারে পুজোর আর দেরি নেই। মন আনন্দে নেচে ওঠে। আমরা যারা ‘সুখে আছি’ হাউজিং-এ থাকি, তাদের মন আনন্দে নেচে ওঠে জি-ব্লকের অবনী মেসোমশাইয়ের সঙ্গে এ-ব্লকের পরিতোষকাকুর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হলে বুঝতে পারি, উৎসব শুরু হয়ে গেছে। পুজো ইজ নকিং অ্যাট দ্য ডোর।
অবনী মেসোমশাই আর পরিতোষকাকুর ঝগড়া এবার কঠিন পর্যায়ে পৌঁছেছে। সামনাসামনি দেখা হলে তারা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। শুধু মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে না, নাক দিয়ে ‘ফুঃ’ ধরনের অবজ্ঞাসূচক আওয়াজও করছে। ঝগড়ার কারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। পুজোর ক’দিন হাউজিং-এর খাওয়া-দাওয়ার মেনু। সপ্তমীর দিন ছেঁচড়া, না নবমীতে আলু-পটলের তরকারি? শুনেছি অবনী মেসোমশাই এবার দু’দিনেই ছেঁচড়ার পক্ষে। পরিতোষকাকু চাইছেন ছেঁচড়া একদিন অফ করে দেওয়া হোক। আলু-পটলের সঙ্গে ছেঁচড়া যায় না। অবনী মেসোমশাই বলেছেন, ‘এ তো ফাইভস্টারের ডিশ নয়, পুজোর সময় হাউজিং-এর সবাই মিলে একসঙ্গে বসে হইচই করে খাওয়া। এখানে অত যাওয়া-আসা দেখলে চলে না।’ ব্যস। এর পরেই দু’জনের কথা স্টপ। তবে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। ষষ্ঠীর আগে ঝগড়া মিটে যাবে। গত বারো বছর ধরে মেনু নিয়ে এই কাণ্ড চলছে।
আমাদের পুজোয় মজা খুব বেশি। এত বেশি যে পুজোর ক’টা দিন হাউজিং ছেড়ে আমাদের কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। সেই স্কুলের সময় থেকেই এরকম চলছে। এখন বড় হয়েছি। কলেজে পড়ছি। উৎসাহ কমা তো দূরের কথা, উলটে বাড়ছে। মেয়ে বলে অন্য সময় মা রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে দেয় না। সন্ধে হলেই মোবাইলে জ্বালাতন শুরু হয়ে যায়। ‘কোথায় আছিস?’, ‘কখন ফিরবি?’, ‘বাবা কিন্তু রাগ করবে।’ পুজোয় নো ডাকাডাকি। রাত পর্যন্ত প্যান্ডেলে বসে থাকলেও কেউ কিছু বলে না। এগারোটার সময় ঝালমুড়ি বা এগরোল নিয়ে আমরা নতুন করে গল্প শুরু করি। হাসতে হাসতে ডেকরেটরের নড়বড়ে চেয়ার থেকে ঘাসের ওপর পড়ে যাই। মনে হয় রাত এগারোটা নয়, মোটে সন্ধে ছ’টা বাজে।
যারা সারা বছর বাইরে পড়াশোনা করে বা চাকরি করছে, তারাও এই ক’দিন হাউজিং-এ ফিরে আসে। যারা ছুটিতে বেড়াতে যায়, তারা ট্রেনের টিকিট কাটে দশমীর পর। ঠাকুর ভাসান হয়ে গেলে সুটকেস গোছাতে বসে। যদি কেউ আগে যায়, তা হলে রওনা দেওয়ার সময় এমন মুখ করে থাকে, যেন বিরাট শাস্তি পেয়েছে। ট্রেনে চেপে কুলুমানালি বা মুসৌরি বেড়াতে যাচ্ছে না, যাচ্ছে দ্বীপান্তরে। প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আসল কথা হল, আমাদের ‘সুখে আছি’ হাউসিং-এ পুজোর হাসি, হইচই, হুল্লোড়ের সঙ্গে সবসময়েই খানিকটা ঝগড়া, কিছুটা হিংসুটেপনা, বেশি মাত্রায় পরনিন্দা-পরচর্চা এবং সর্বোপরি দু’-একটা নির্দোষ ষড়যন্ত্র মিলেমিশে থাকে। ফলে উৎসব আরও ইন্টারেস্টিং হয়।
শারদীয় পরনিন্দা-পরচর্চা পর্বটি আমাদের হাউজিং-এ অতি উত্তেজনাময় একটা ঘটনা। ঘটনা খুব গোপনে ঘটলেও কীভাবে যেন সকলেই সব জেনে যায়! হাউজিং-এর মাসিমা, কাকিমা, পিসিমারা এই সময়টা এক্সটেনসিভ পরিশ্রম করেন। ই-ব্লকের মৈত্রেয়ী মাসিমা দুপুর হলেই তিনতলায় তপতী কাকিমার ফ্ল্যাটে ছুটছেন। সেখানে খানিকক্ষণ কাটিয়েই তাঁকে চলে যেতে হচ্ছে ডি-ব্লকের ইরা পিসিমার কাছে। ‘কিছুতেই বলব না’ বলেও আগের আলোচনা সব ফাঁস করে তিনি সোজা চলে যান সি-ব্লকে। কারণ, চান্দ্রেয়ী বউদি ডেকে পাঠিয়েছেন— ‘মৈত্রেয়ী, তাড়াতাড়ি চলে এসো। খবর আছে।’ কী খবর? দোতলার তন্দ্রা বউদি নাকি পুজোর কটা দিন ফরসা হবে বলে গাজর আর আপেল সেদ্ধ মুখে মেখে গোটা সকালটা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। রান্না-টান্না পুড়ে কেলেঙ্কারি। প্রতিবাদে তন্দ্রা বউদির শাশুড়ি অনশন শুরু করেছেন। পুত্রবধূকে বলেছেন, ‘বউমা, তুমি গাজর এবং আপেল খাও। আমার আজ নো মিল।’ এ ছাড়াও কে বেশি শাড়ি কিনে ডাঁট দেখাচ্ছে, কে পিছিয়ে পড়েছে, তাঁতের ব্লক প্রিন্টে কাকে পেতনির মতো লাগবে, তসরে অ্যাপ্লিক লাগিয়ে কে রাম ঠকান ঠকেছে, চুড়িদারের সঙ্গে আনারকলি কাট কামিজ কিনে কোন দুই মেয়ের মা খুকি সাজবার চেষ্টা করছে— এসব হট টপিক তো আছেই।
আমার মা একজন খুবই ভালমানুষ টাইপ মহিলা। তিনি এসবের মধ্যে থাকেন না। খবর পেলাম, এবার প্রাকপুজো পরচর্চাপর্বে তিনি নাকি ‘সুখে আছি’ হাউজিং-এ সবার আগে রয়েছেন। তাঁকে বিভিন্ন ফ্ল্যাট থেকে ঘনঘন ডেকে পাঠানো হচ্ছে। মোবাইলে দীর্ঘ সময় ফিসফিসানি চলছে। বুঝতে পারছি, এ বছর আমার মা কোনও মজাই ছাড়তে রাজি নয়।
এবার দু’-একটা হিংসুটেপনার উদাহরণ দিই।
জি-ব্লকের রঞ্জনা শুনলাম, দু’দিন আগে ই-ব্লকের আরিত্রিকাকে একটা এস এম এস পাঠিয়েছে। বয়ান এরকম— ‘তোমার মন যে এত ছোট আমি কল্পনাও করতে পারিনি আরিত্রিকা। সামান্য জুতোর হিল নিয়ে তুমি এত কাণ্ড করলে! তোমাকে সেদিন আমি গল্প করে বললাম, হাই হিলের একটা চমৎকার জুতোর খোঁজ পেয়েছি। একেবারে এক্সক্লিউসিভ। ভাবছি কিনে নেব। নবমীর রাতে আমার ফ্লোরাল প্রিন্টের কুর্তিটার সঙ্গে পরব। তুমি ভালমানুষের মতো মুখ করে বললে, ভেরি গুড়, কিনে নাও। অথচ খবর পেলাম, গতকাল তুমি ঠিক ওই দোকানে গিয়ে জুতোটা কিনে নিয়েছ। ছি ছি।’
হিল বিষয়ক হিংসের পর আসি আলো বিষয়ক হিংসুটেপনায়।
কাল দেখি শৌভিক মুখ শুকিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলল, দেবাঞ্জন তাকে থ্রেট করেছে। থ্রেট! কেন? গতবার শৌভিক সপ্তমীর সান্ধ্য গানের আসরে স্টেজে আলো ফেলছিল। বালিকাদের কোরাসের সময় সে নাকি ইচ্ছে করে দেবাঞ্জনের বোনের বদলে আলো ফেলেছিল নিজের বোনের মুখে। এবার যদি একই ঘটনা ঘটে, তা হলে গানের পর শৌভিকের বিপদ আছে বলেছে। সপ্তমীর রাতেই তার বিসর্জনের ব্যবস্থা হবে। সত্যি কথা বলতে কী, ‘সুখে আছি’ হাউজিং-এর সব থেকে বেশি গোলমাল হয় ফাংশন নিয়ে। এবারও হয়েছে। আগে একটা নাটক হত, গোলমালের কারণে এবার হচ্ছে তিনটে। কমিউনিটি হলে তিন দফায় তিন মাস ধরে অডিশনপর্বে অ্যাক্টর সিলেকশন হয়েছে। বাছাই নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ। স্বজনপোষণের অভিযোগ। বিক্ষোভ সামাল দিতে নাটকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তাতেও বিক্ষোভ সামলানো যায়নি। গান, আবৃত্তি, নাচেও একই গোলমাল। জি-ব্লকের মঞ্জু মাসিমা প্রতিবাদে আলাদা করে গীতিনাট্যের ব্যবস্থা করেছেন। প্যারালাল প্রোগ্রাম। রবীন্দ্রসংগীত-নজরুলগীতি-অতুলপ্রসাদের গান পাঞ্চ করে হিন্দি সিনেমার নৃত্য সহযোগে একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার। ফাংশন থেকে বাদ পড়া ছোট-বড়রা এতে যোগ দিয়েছে। পুজো কমিটি এই প্রতিবাদী গীতিনাট্য এখনও অনুমোদন করেনি। মঞ্জুমাসিমা জানিয়েছেন, অ্যালাও না করলে বয়ে গেল। অষ্টমীর সন্ধেবেলা তিনি দলবল নিয়ে স্টেজে উঠবেন এবং নাচ শুরু করবেন। নাচ কে থামায় তিনি দেখতে চান। সেরকম হলে পুলিশে কমপ্লেন করবেন। ভয়াবহ টেনশনের ব্যাপার। টেনশন বাড়ছে, পুজোর মজাও বাড়ছে। মনে হচ্ছে, ইস, গতবার কেন এমন টেনশনের ঘটনা ঘটেনি?
তবে আমাদের মূল ঝগড়া শুরু হয় কমিটি তৈরির সময়। মূল পুজো কমিটি ঠিক থাকলেও সাব-কমিটি নিয়ে বিরাট গোলযোগ লেগে যায়। চাঁদা, হিসেবনিকেশ, প্রতিমা, আলো, ফাংশন, ভাসান, খাওয়া-দাওয়া—সবকিছুরই আলাদা আলাদা সাব-কমিটি রয়েছে। হাউজিং-এর সবাই একটা না একটা কমিটিতে ঢুকতে চায়। জোর পলিটিক্স চলে। পাবলিক ডিমান্ডে সাব-কমিটির সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। এ বছর যেমন নতুন দুটো হয়েছে। মাইকে গান বাজানোর সাবকমিটি আর প্রসাদ বিতরণ সাব-কমিটি। আমরা কমবয়সিরা এবার আরও একটা কমিটি বানিয়েছি। ফান সাবকমিটি। ফান কমিটি প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছে, পুজোর তিনদিন হাউজিং বাসিন্দারা কী কী মজার খেলায় মাতবে। পরিকল্পনা শুনে কমিটির বয়স্করা প্রথম ভুরু কুঁচকেছিল। আমরা তাদের বুঝিয়েছি, ফান ছাড়া ফেস্টিভাল হয় না। ফানের মধ্যে রয়েছে ষষ্ঠীর রাতে ফ্যাশন শো। সেই শো-তে ‘মিস সুখে আছি’ এবং ‘মিস্টার সুখে আছি’ সিলেক্ট করা হবে। সপ্তমীর বিকেলে মিউজিক্যাল চেয়ার। অষ্টমীর সন্ধেতে গো অ্যাজ ইউ লাইক। শুধু নবনীর দিনটা বাকি। সাব-কমিটি মিটিং-এ বসেছে। কমিটিতে আমি যেমন আছি, তেমন শাম্বদা রয়েছে। শাম্বদা সেক্রেটারি। শাম্বদার কমিটিতে থাকার ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। কারণটা গোপন গোপন কারণ শুনে অনেকে মনে করতে পারে শাম্বদা ছেলে খারাপ। না, শাম্বদা ছেলে খারাপ নয়। বরং ছেলে অতিরিক্ত ভাল। শিবপুরে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। গায়ের রং কালোর দিকে হলেও দেখতে হ্যান্ডসাম। গানের গলা সুন্দর। গিটার হাতে বব ডিলান, পিট সিগার, জন ডেনভারের গান ধরলে মুগ্ধ না-হয়ে উপায় থাকে না। তবে আজকাল কায়দা করে নিজে গান লিখে সুর বসাচ্ছে। সেগুলো অবশ্য অতি অখাদ্য। সে হোক, সবার সবকিছু ভাল হয় না। তবে আমার আপত্তি অন্য কারণে। শাম্বদা গত বছর পুজোর সময় আমাকে…। থাক, গোপন জিনিস গোপন থাকাই ভাল। আমি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ‘আমার দ্বারা এসব হবে না। আমি এসব পারি না।’ এই কারণেই ওই ছেলের সঙ্গে আমার কমিটিতে থাকতে আপত্তি। তবু সবাই যখন বলল থাকতে হবে, আমি মুখে কিছু বলিনি। একটা কিছু হলেই চোখ বড় বড় করে গুজগুজ ফুসফুস শুরু করে দেবে। আমিও করি। কিন্তু শাম্বদার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে কোনও কানাঘুষো হোক, তা আমি চাই না। সেইজন্য চুপ করে মেনে নিয়েছি।
নবমীর রাতের নতুন মজার পরিকল্পনাও মেনে নিলাম। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, আমরা একটা বড় বিপদের মধ্যে পড়তে চলেছি। ‘সুখে আছি’ হাউজিং-এর বাসিন্দারা ‘যা পারে না’ তা নিয়ে কেরামতি দেখাতে গিয়ে বিরাট প্রেস্টিজের মধ্যে পড়বে। হাজার ঝগড়া, হিংসুটেপনা, পরচর্চায় পুজোর যে আনন্দ কখনও নষ্ট হয়নি, এবার হবে। সবথেকে বড় কথা, এই খেলায় কেউ যোগ দেবে না। উৎসবের দিন ফেল করতে কে চায়?
…যা বাব্বা! নবমী এবার সবথেকে আনন্দের হয়েছে। শাম্বদার নতুন খেলায় কম্পিটিটরের সংখ্যা একশো ছাড়িয়ে গিয়েছিল। প্যান্ডেলের মাঠে জায়গা করে রিয়ালিটি শো চলেছে দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত। শম্ভু কাকুর নাচ, শুভশ্রীর হাই জাম্প, লীলাবতীদির আবৃত্তি, শ্যামল মেশোর কীর্তন, অর্কপ্ৰভদার সুচে সুতো পরানো, প্রান্তিকের তবলা, সৌরভবাবুর শাড়ি ভাঁজ, অমিয়দার অমলেট রান্না, বিদিশা মাসির নাট-বল্টু লাগানো— একেবারে হইহই ফেলে দিল। সবাই এত হেসেছে যে যে হাউজিং-এর বাইরে পর্যন্ত ভিড় জমে গেল। তারা অবাক হয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে উঁকি মারতে লাগল। এত ফুর্তি!
যদিও আমি ছিলাম দূরে দূরে। প্ল্যান ছিল গোলমাল লাগলেই কেটে পড়ব। শাম্বদার পাকামির জন্য আমি কেন বড়দের গালি খাব? খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই দেখলাম ওই ছেলেকে খুব বাহবা দিচ্ছে। অনেকে পিঠ চাপড়েও দিল। পুজো কমিটির সেক্রেটারি ওর হাত ধরে বলল, ‘আগামী পুজোতে আরেকটা নতুন আইডিয়া চাই কিন্তু শাম্ব। আরও মজার কিছু। তোমার জন্য বেশি করে টাইম রাখব।’ শাম্বদার দেখি গর্বে বুক ফুলে উঠেছে। ওর সঙ্গে চোখে চোখ পড়তে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। যেন কিছুই দেখিনি।
দশমীর দিন আমি একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড করে বসলাম। আমি যা পারি না, সেই কাণ্ড। ‘শাম্ব’ নামের পাকা ছেলেটাকে লুকিয়ে একটি চিঠি দিয়েছি। দু’লাইনের চিঠি। কিন্তু লিখেছি রাত জেগে। কী লিখেছি? লিখেছি— ইস, বলব কেন? উৎসবের সব আনন্দের কথা সবাইকে বলতে নেই। তবে আমি কখনও ভাবতে পারিনি এ কাজ আমি পারব। উৎসবের এটাই মজা। যে যা পারে না, তাকে দিয়ে সে সেই কাজও করিয়ে নেয়।
আনন্দবাজার পত্রিকা ক্রোড়পত্র, জেলা ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৯