কৃষ্ণচূড়া
ভয়ংকর ঘটনাটা জানা গেল লাঞ্চ আওয়ারে। অতি ব্যস্ততার মধ্যেও ইনস্টিটিউটের সকলেই কম বেশি খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলার মুখে হলেও ডিরেক্টর মণিময় সামন্ত লাঞ্চ প্রত্যাখান করেছেন। শুধু এক বাটি টক দই নিয়েছেন তিনি। তবে সেটাও খাচ্ছেন না। টেনশন হচ্ছে, ভয়ংকর টেনশন! দু’রাত ঘুম হয়নি তাঁর। কাল থেকে খিদেও নেই। মণিময় সামন্ত, রোবোটিক্স বিষয়ে তিনি একজন পণ্ডিত রোবট বিজ্ঞানে তাঁর আর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তাঁর ‘জেড এমপি টেকনিক’-এর উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। ‘জেড এমপি টেকনিক’ দিয়ে রোবটের চলাফেরার বিষয়টা নির্দিষ্ট করা হয়। হাঁটাচলা, লাফানো এমনকী সাঁতার পর্যন্ত। মণিময় সামন্ত অ্যাকাচুয়েটর মোটর, হাইড্রলিক সিস্টেম, ইলেকট্রিক সার্কিটের অদলবদল ঘটিয়ে মানুষের চেহারার রোবটকে দিয়ে হাই তুলিয়েছে৷ দেখিয়েছেন, ভিতরের শক্তি কমে এলে রোবট হাই তুলে বুঝিয়ে দিতে পারবে। এই কাজ নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। এমন মানুষের টেনশন করা মানায় না। মণিময় সামন্ত নিজেও সেটা বোঝেন। নিজের উপর রাগও হচ্ছে। মনে হচ্ছে, শুধু লেখাপড়া নিয়েই ভাল ছিলেন। কেন যে মরতে এত বড় একটা গবেষণা কেন্দ্রে ডিরেক্টর হতে গেলেন! মণিময় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সামনের এগজিবিশনটা পার করেই তিনি ডিরেক্টরের পদ থেকে ইস্তফা দেবেন। এত ঝামেলা নেবেন না। রোবট নিয়ে কাজ করলেও তিনি রোবট নন, মানুষ!
তিন দিন পর এই ইনস্টিটিউটে যে এগজিবিশন হতে চলেছে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। প্রতিষ্ঠানের মানসম্মান তো বটেই, এমনকী, টাকাপয়সাও। সবকিছু ঠিক মতো হলে আগামী কয়েক বছর আর ফান্ড নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে না। অনেক ভাবনাচিন্তা আর পরিশ্রম করে এই রোবটগুলো তৈরি হয়েছে। অতিথিরা আসছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। তার মধ্যে রোবোটিক্সের ছাত্রছাত্রী, বিজ্ঞানীরা যেমন আছেন, তেমন নামীদামি। কোম্পানির প্রতিনিধিরাও থাকছেন। রোবট পছন্দ হলে, অর্ডার পাওয়া যাবে। যাঁরা গোটা রোবট অর্ডার দেবেন না, তাঁরা সার্কিট, ডায়াগ্রাম বা সফটওয়্যার কিনে নিয়ে ফিরে যাবেন। ঠিক এইসময় মণিময় সামন্তর কাছে ভয়ংকর খবরটা এল। ইন্টারকমে খবর দিলেন ডক্টর সুফল সরকার। খবর শোনার পর কয়েক মুহুর্তের জন্য তার যাবতীয় বোধবুদ্ধি যেন লোপ পেয়ে গেল। মাথাটা ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে। হঠাৎ খুব খিদে পাচ্ছে। মণিময় এক চামচ দই তুলে মুখে দিলেন। অতিরিক্ত টেনশনের উপর টিনশন চাপলে কি এরকমই হয়? পালিয়ে যাওয়া খিদে ফিরে আসে? ঘটনাটা এরকম, নিজের ঘরে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে ডক্টর সুফল সরকার ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছিলেন। ক’দিন থেকে ‘আর থ্রি’ মডেলে একটা সেন্সর। গোলমাল করছে, ফলে ‘আর থ্রি’ অ্যালজেব্রা, জিওমেট্রি বা ক্যালকুলাসের জটিল ফর্মুলা ঝরঝর করে বলে দিতে পারছে, কিন্তু সহজ যোগ-বিয়োগে হোঁচট খাচ্ছে। কাল বিকেলে উনিশের নামতা বলতে গিয়ে বাষট্টির ঘরে এসে থমকে গিয়েছে। রোবট যদি সামান্য উনিশের নামতা বলতে গিয়ে চুপ করে যায়, তবে সেটা খুবই বিশ্রী ব্যাপার হবে। তার উপর এগজিবিশনে ‘আর থ্রি’-কে একজন প্রোফেসর হিসেবে দেখানো হবে। ইউনিভার্সিটির স্তরে সে পড়াতে পারবে। প্রোগ্রামিং-এ সিলেবাস বদলে দিলেই হল। সেদিক থেকে এই ‘আর থ্রি’ এগজিবিশনে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মডেলের একটা। সুফল সরকার গোলমাল নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। ডিরেক্টরের কানেও গোলমালের খবর পৌঁছেছে। আজ সকালে তিনি সুফল সরকারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ‘এটা কী ব্যাপার, ড. সরকার? আমি শুনলাম আর থ্রি-তে সমস্যা হচ্ছে। ঘটনাটা কি সত্যি?’
ড. সরকার মাথা চুলকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ স্যার সত্যি। কঠিন প্রবলেম সলভ করছে, কিন্তু ছোটখাটো অঙ্কে আটকে যাচ্ছে।’
মণিময় বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, ‘তিনদিন বাদে প্রোগ্রাম। কাল রাতে গেস্টরা আসতে শুরু করবেন। লাস্ট মোমেন্টে এই ধরনের গোলমাল কী করে হয়?’
‘সেটা বুঝতে পারছি না। তবে ধরে ফেলার চেষ্টা করছি।’
মণিময় সামন্ত এই কথায় আশ্বস্ত হলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ‘ভেরি ব্যাড ড. সরকার। এতদিন ধরে আমরা প্রিপারেশন নিয়েছি। তারপরও যদি এরকম হয়। বাকিগুলোর খবর কী? সেগুলোও গোলমাল শুরু করেছে নাকি?’
‘না না স্যার! বাকি মডেলগুলো একেবারে পারফেক্ট। এক্স ফাইভের হাইড্রলিক পিস্টনে একটা সমস্যা ছিল। মডেল ঘাড় ঘোরানোর বেলায় একটা এক্সট্রা জার্ক পাচ্ছিল। ড. ভাদুড়ি কালই রিপেয়ার করে ফেলেছেন।’
মণিময় ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ওর ফাংশনটা কী যেন…’
‘খেলার সঙ্গী হওয়া। ধরুন, মর্নিংওয়াকের সময় পাশে পাশে হাঁটল বা জগিং করল। কিছু গেমে পার্টনারও হতে পারবে।’
মণিময় সামন্ত চোখ থেকে চশমা খুলে বললেন, ‘ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। খেলার মধ্যে আপনারা কি ব্যাডমিন্টন আর পোলোটা রাখতে পেরেছেন? আমি কিন্তু বলে দিয়েছিলাম বাইরে পোলোটা খুবই পপুলার গেম আবার ব্যাডমিন্টন না থাকলে মেয়েরা এই মডেলে ইনটারেস্ট পাবে না। আর এন টু? তার খবর কী? সেও আবার কোনও গড়বড় করছে না তো?’
‘এন টু-কে ডোমেস্টিক হেল্পর হিসেবে রেডি করা হয়েছে। রান্না থেকে শুরু করে গেস্ট অ্যাটেন্ড পর্যন্ত সব কিছুই করতে পারবে।’
মণিময় সামন্ত ফোঁস করে একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘করলেই ভাল। আচ্ছা ড. সরকার ওই ম্যানেজার মডেলের কোডটা কী?’
‘ওটা স্যার জেড ফোর। অ্যাকাউন্টস, কো-অর্ডিনেশন, প্রোডাকশন, মার্কেটিং সব ধরনের কাজে এই মডেল অ্যাসিস্ট করতে পারছে। সবচেয়ে বড় কথা স্যার, জেড ফোর মিটিং-এ বসে সকলের সঙ্গে আলোচনাও করতে পারে। সমস্যা একটাই ছিল, ম্যানেজারবাবুর মুখে একটু বেশি হাসি হাসি ভাব চলে এসেছিল।’
মণিময় সামন্ত চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘হাসি! ম্যানেজার হাসছে! কোম্পানির সিরিয়াস মিটিং-এ বসে ম্যানেজার যদি হাসে, সেটা কেমন হবে ভাবতে পারছেন, ড. সরকার? এই মডেল তো শুধু হাসি মুখের জন্যই বাতিল হয়ে যাবে!’
ড. সরকার তাড়াতাড়ি বললেন, ‘সমস্যাটা আর নেই। ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন মানে ফাইবারের কাজে ভুল হয়ে গিয়েছিল।’
ঘাম জমেনি, তবু মণিময় সামন্ত রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। সুফল সরকার সামান্য হেসে বললেন, ‘এতটা চিন্তা করবেন না, স্যার। এগজিবিশন সেমিনার সবই খুব ভাল হবে। এম ফাইভ এবং কে সিক্স তো দারুণ মডেল। আপনি তো জানেনই স্যার, কে সিক্স ইজ রিয়্যালি আ ব্রিলিয়ান্ট জব। ড. শকুন্তলা মিত্র নিখুঁতভাবে মেয়েটিকে বানিয়েছেন।’
‘এখন নিখুঁত বলছেন। কাল হয়তো ড. শকুন্তলা মিত্র এসে বলবেন যে, মডেলে খুঁত পাওয়া গিয়েছে। সোলানয়েড গোলমাল হয়েছে বা এই মেয়ে ঘনঘন হাঁচছে।’
সুফল সরকার কোনওরকমে হাসি চাপলেন। ড. সামন্তর টেনশন সত্যি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। না হলে, রোবট হাঁচছে, এমন কথা মাথায় আসত না।
‘না স্যার আপনি দেখবেন,’ বললেন ড. সরকার, ‘কে সিক্স শুধু ভাল মডেলই হয়নি, তার অ্যাপিয়ারেন্সও চমৎকার হয়েছে। শাড়ি পরিয়ে টিপিক্যাল বাঙালি অল্পবয়সি মেয়ের ইমপ্রেশন দেওয়া হয়েছে। ড. মিত্র মডেলের জন্য শান্তিনিকেতন থেকে গয়না পর্যন্ত আনিয়েছেন। হাইড্রলিক সিস্টেম এমনভাবে প্রোগ্রাম করেছেন, যাতে মেয়েটা নির্দিষ্ট ইন্টারভ্যালে কপালের উপর পড়া চুল ঠিক করতে পারে। রোবট বলে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সত্যিকারের কলেজপড়ুয়া মেয়ে। আমরা সকলে ড. মিত্র কনগ্রাচুলেট করেছি। আপনিও করেছেন স্যার!
‘আমিও করেছি নাকি? কী জানি, হয়তো করেছি! বললাম না, সবই ভুলে যাচ্ছি। তা এই কে সিক্স-এর কর্মকাণ্ডটা কী যেন? এত সাজগোজ কীসের? ফ্যাশন শো-তে হাঁটবে নাকি?’
এবার আর না হেসে পারলেন না সুফল সরকার, ‘স্যার কে সিক্স ইজ জাস্ট আ ফ্রেন্ড। কম্পানি দিতে পারে। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে পারবে, ইন্টারঅ্যাক্ট করবে। বহু দেশে তো স্যার আজকাল এটা একটা সিভিয়ার প্রবলেমের আকার নিয়েছে। বন্ধু নেই, কথা বলার লোক নেই। কাজটা ডিফিকাল্ট ছিল। ড. মিত্র খুব সাকসেসফুলি কাজটা করতে পেরেছেন। মেয়েটিকে যেমন দেখতে অ্যাট্রাকটিভ করা হয়েছে, আলাদা করে একটা পার্সোন্যালিটি ইমপ্রেশনও দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, অন্য কোনও মডেলের নাম না থাকলেও কে সিক্স-এর একটা নাম দেওয়া হয়েছে।’
‘নাম! রোবটের নাম!’
‘হ্যাঁ স্যার, ড. শকুন্তলা মিত্রই নামটা দিয়েছেন। বাঙালি নাম। মডেলকে ল্যাবরেটরিতে কৃষ্ণচূড়া বলে ডাকা হচ্ছে।’
সুফল সরকার চলে যাওয়ার পর মণিময় সরকার ভাবলেন, মডেলদের ক্যাটালগে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন। আসল বিষয়টি এতটা গুলিয়ে ফেলা উচিত হচ্ছে না। টেবিলে ছড়ানো কাগজ হাতড়েও তিনি ক্যাটালগ খুঁজে পেলেন না। ল্যাপটপে হাত দিলেই পাওয়া যাবে, কিন্তু হাত দিতে ইচ্ছে করছে না। এমন সময় টক দইয়ের বাটি এল, সেই বাটি রেখে চুপ করে বসে রইলেন। আর তখনই ড. সরকার খবরটা দিলেন। খবরটা দেওয়ার সময় তাঁর গলাটা কেঁপে গেল, ‘স্যার ল্যাব থেকে বলছি, কৃষ্ণচূড়া নেই।’
‘কৃষ্ণচূড়া? সে কে? হু ইজ শি?’
‘আমাদের কে সিক্স মডেল স্যার। আমি আর থ্রি-কে ঠিক করতে ল্যাবে এসেছি। কাজ শেষ করে বেরোতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, কে সিক্স-এর জায়গাটা ফাঁকা।’
‘ফাঁকা! মানে?’
‘মানে বুঝতে পারছি না স্যার। ড. শকুন্তলা মিত্রকে ফোন করেছিলাম। উনি নিজের কোয়ার্টারে ছিলেন। এখনই আসছেন।’
মণিময় সামন্ত ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাকিগুলো?’
‘সব আছে স্যার। ওনলি কে সিক্স…’।
ইন্টারকম রেখে মণিময় খিদে অনুভব করলেন। এক চামচ দই তুলে মুখে দিতে দিতে ভাবলেন, কী করা উচিত? এখনই কি রেজিগনেশন লেটার লিখে ফেলা দরকার? নাকি মাথায় দেওয়ার জন্য বরফ আনতে বলবেন? জেলখানা থেকে কয়েদি পালালে, পাগলা ঘন্টি বাজানো হয়, ল্যাবরেটরি থেকে রোবট পালালে কী ব্যবস্থা আছে? তা ছাড়া কে সিক্স পালিয়েছে এমন উদ্ভট কথা তাঁর মাথায় আসছেই বা কেন? রোবট খারাপ হতে পারে, পালাতে পারে না। বিজ্ঞানী মণিময় সামন্তর মনে হল, তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন!
কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল একটি অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েকে গেট থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। মেয়েটির মাথায় গোলাপি রঙের ছাতা। বড় রাস্তা পার করে মেয়েটি ছাতা বন্ধ করে এবং ট্যাক্সিতে ওঠে। ঘণ্টাখানেক পর ডিরেক্টরের ঘরে জরুরি মিটিং-এ ড. শকুন্তলা মিত্র জানালেন, শুধু কে সিক্স মডেল নয়, তাঁর ছাতাটিও পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর টোকিওতে একটা সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে এই ছাতাটি কিনেছিলেন তিনি। গতকাল ড. মিত্র সেটি ল্যাবরেটরিতে ফেলে যান। মণিময় সামন্ত কঠিন চোখে মিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কে সিক্স-এর চিপসে কোনও ল্যাঙ্গোয়েজ দেওয়া আছে কি? সে কি মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবে?’
শকুন্তলা মিত্র বড় বড় চোখ করে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার পারবে। তাকে কথা বলার জন্য ভাষা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। মডেলকে আমরা একটা সময় নানা ধরনের পোশাক পরিয়ে দেখেছিলাম। দ্যাট ব্যাগ ইজ মিসিং মানে, পোশাক ভরতি ব্যাগটাও ল্যাবে নেই।’
মণিময় সামন্ত নিচু গলায় বললেন, ‘আমাদের গোপনে খোঁজখবর করতে হবে। ঘটনাটা যেন কোনওভাবেই ফাঁস না হয়। মডেলের একটা ফোটো দিন। আমি পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি।’
পুলিশকে খবর দেওয়া হল, কিন্তু ফোটো দেওয়া হল না। কারণ কে সিক্স-এর কোনও ফোটো নেই, শুধু সার্কিট ডায়াগ্রাম আছে। পুলিশ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, সার্কিট ডায়াগ্রাম হাতে নিয়ে মানুষের ভিড়ে মিশে যাওয়া রোবট খুঁজে বের করা অসম্ভব!
তিন মাস পর
কৃষ্ণচূড়া মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। সিঞ্চনের বেশিরভাগ কথারই সে উত্তর দিচ্ছে না। যে ক’টা দিচ্ছে, মুখ ফেরানো অবস্থাতেই দিচ্ছে। এই কাণ্ড নতুন। গত তিনমাসে এই মেয়েটার সঙ্গে সিঞ্চনের মান-অভিমান কম হয়নি। কিন্তু কখনও এই পর্যায়ে যায়নি। তার উপর আগে সবই ছিল ছোটখাটো রাগ। ঠিক সময়ে না আসা, রাতে ফোন না করা, অফিস কামাই করে বেড়াতে না যাওয়া, এই ধরনের। অভিমান ভাঙাতে অবশ্য অসুবিধে হয়নি। কখনও সিনেমা, কখনও আইসক্রিম, কখনও ছোটখাটো গিফটেই কাজ হয়ে গিয়েছে। আজ অবস্থা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেন জানি সিঞ্চনের মনে হচ্ছে, এই মেয়ে অন্য কিছু ভাবছে। কঠিন কিছু! যদিও কাল সন্ধেবেলা যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে রাগ করার কথা সিঞ্চনেরই। অপমানিত যদি কেউ হয়ে থাকে, সে হয়েছে, কৃষ্ণচূড়া নয়। সেই সময় রাগও হয়েছিল খুব, খানিকটা দুঃখও। কাল অনেক রাত পর্যন্ত মন খারাপ ছিল। ঠিক করেছিল কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে সে কোনওদিনই যোগাযোগ করবে না। প্রেম করলে রাগ দেখানোর অধিকার শুধু মেয়েদেরই থাকবে, এমন কথা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখে, মন থেকে রাগ-টাগ সব ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। একেই বোধহয় প্রেম বলে। মোবাইলে কৃষ্ণচূড়াকে ধরল সিঞ্চন, ‘গুড মর্নিং কৃষ্ণচূড়া।’
‘গুড মর্নিং’, থমথমে গলায় বলেছে কৃষ্ণচূড়ার’
সিঞ্চন গলায় ঠাট্টার ভাব এনে বলল, ‘গলা শুনে মনে হচ্ছে, এখনও খেপচুরিয়াস? নিজে কাণ্ড বাধিয়ে নিজেই রেগে গেলে?’
ওপাশে শান্ত গলায় কৃষ্ণচূড়া বলল, ‘তোমার কি আজ একটু সময় হবে সিঞ্চন? আমি দেখা করতে চাই। তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
ফোন রেখে দেওয়ার পর সিঞ্চন কিছুটা থমকে গেল। কৃষ্ণচূড়া এত সিরিয়াস কেন? আসলে এই মেয়েটিকে এখনও সে ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। ঠিকমতো বোঝার পক্ষে তিন মাস যদিও খুব সামান্য সময়। তবুও… হাসিখুশি সরল মেয়েটা সামান্য কারণে… বেশ কিছুটা সময় হল এই কফিশপে কৃষ্ণচুড়াকে নিয়ে ঢুকেছে সিঞ্চন। কাপুচিনো কৃষ্ণচূড়ার ফেভারিট। যদিও সিঞ্চনের জঘন্য লাগে, তবে আজ সে এমন হাসিমুখ করে এই কফি খাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে, এমন অপূর্ব জিনিস সে আগে কখনও খায়নি। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া সেটা লক্ষই করছে না। মেয়েটা গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। সিঞ্চন নরম গলায় বলল, ‘কৃষ্ণচুড়া, তুমি কিন্তু বেশি রাগ করছ। এত রাগ করার মতো ঘটনা কি কাল আদৌ ঘটেছে?’
কৃষ্ণচূড়া জিনসের উপর বেগুনি রঙের একটা টপ পরেছে, দারুণ লাগছে দেখতে! তবে তিন মাস আগে সিঞ্চন যখন এই মেয়ের প্রেমে পড়ে, সেদিন জিনস-টপ নয়, কৃষ্ণচূড়া পরেছিল শাড়ি!
সেদিন অফিস থেকে বেরোতে রাত বেশি হয়ে গিয়েছিল সিঞ্চনের। আই টি কোম্পানিতে কাজের চাপ সবসময়ই বেশি। তার উপর সিঞ্চন চাকরিতে ঢুকেছে সদ্য। ডিউটি টাইম পেরিয়ে গেলেও বসের দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট পেন্ডিং রেখে বেরিয়ে পড়া খারাপ দেখায়। কাজ শেষ করতে রাত হয়ে গেল। সিঞ্চন বেরিয়ে দেখল, সেক্টর ফাইভের মতো সরগরম এলাকাও বেশ ফাঁকা। এদিকটায় বাস-টাস এমনিতেই কম, রাত বাড়লে আরও কমে যায়। খানিকটা হেঁটে শেয়ার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াল সিঞ্চন। স্ট্যান্ডে ভিড়। ট্যাক্সি দেখলেই গলায় কার্ড ঝোলানো ছেলেমেয়েরা ছুটে যাচ্ছে। যে ক’জন পারছে ঢুকে পড়ছে গাদাগাদি করে। ভিড়ের কারণে দুটো ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে হল সিঞ্চনকে। তিন নম্বর ট্যাক্সি দেখে ছুটে গিয়ে কোনওরকমে ঠেলেঠুলেই উঠে পড়ল সিঞ্চন। জানলার ধার পেয়েছে। বাইপাসের ফুরফুরে হাওয়ায় সে চোখ বুজল। গোটা পথই অন্য প্যাসেঞ্জারদের দিকে তাকায়নি সিঞ্চন। পাশে বসা মেয়েটির দিকেও নয়, খেয়াল করতে হল যাদবপুরে নামার সময়। তখন ট্যাক্সি প্রায় ফাঁকা।
‘এক্সকিউজ মি, কিছু মনে করবেন না, পার্সটা মনে হয় ফেলে এসেছি। ক্যান ইউ হেল্প মি?’
নিচু গলার মিষ্টি নারীকণ্ঠ শুনে চমকে ফিরে তাকায় সিঞ্চন। বাইপাসের অন্ধকারে মেয়েটির মুখ ভাল করে দেখতে না পেলেও গলার স্বরে তার কাঁচুমাচু ভাবটা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, মেয়েটি সত্যি বিপদে পড়েছে। মেয়েটি শাড়ি পরে আছে। আজকাল কলকাতায় শাড়ি পরা কমবয়সি বাঙালি মেয়ে চট করে চোখে পড়ে না। বিশেষ সেক্টর ফাইভে যাতায়াত করে এমন মেয়ে তো নয়ই। দাঁড়িয়ে পড়ে সিঞ্চন। মেয়েটি কাতর গলায় বলে, ‘ট্যাক্সিতে ওঠার আগে ঠিক বুঝতে পারিনি…’
সিঞ্চন হেসে বলে, ‘ইটস ওকে, কত লাগবে বলুন?’
মেয়েটি লাজুক গলায় বলে, ট্যাক্সি ভাড়াটুকু দিলেই হয়ে যাবে।’
সিঞ্চন ওয়ালেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটিকে দিতে গেলে সে বলে, ‘প্লিজ আমাকে দেবেন না, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ড্রাইভারকে দিয়ে দিন।’
সিঞ্চন খুশি হয়। সে ঠিকই বুঝেছে। মেয়েটি সত্যিই বিপদে পড়েছে। সে ড্রাইভারকে দু’জনের ভাড়া দিয়ে দেয়। মেয়েটি গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘আপনার অ্যাড্রেস বা মোবাইল নম্বরটা যদি দেন, আমি কালই…’
সিঞ্চন হেসে বলে, ‘ইটস ওকে। ওইটুকু টাকা ফেরত দেওয়ার দরকার নেই। আপনি সাবধানে যান। টেক কেয়ার।’
মেয়েটিও হাসে। অস্ফুটে বলে, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ, গুড নাইট।’
ট্যাক্সি আবার স্টার্ট দেওয়ার আগে উলটোদিকের গাড়ির হেডলাইটে চকিতের জন্য মেয়েটির মুখ দেখতে পায় সিঞ্চন। ভাসা ভাসা সুন্দর দুটো চোখে কৃতজ্ঞতা মাখিয়ে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের পিঠ চাপড়ায় সিঞ্চন। ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর দিলে এই অপূর্ব দৃষ্টি থেকে সে অবশ্যই বঞ্চিত হত। মেয়েরা খুব বুদ্ধিমতী হয়। ফোন নম্বর দিলে হয় ভাবত কিপটে, নয় ভাবত অন্য কোনও মতলব আছে। এই দৃষ্টি কপালে জুটত না। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরল সিঞ্চন।
পরদিন নিজের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ অফিসে থাকল সিঞ্চন। রাত করে বেরোল আগের দিনের সময় হিসেব করে। ভেবেছিল হিসেবে ভুল হবে। কিন্তু তা হল না। জীবনের বোধহয় এটাই নিয়ম। খানিকটা যাওয়ার পরই সে দেখতে পেল, সেই মেয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। স্ট্যান্ডের ঝলমলে আলোয় তাকে আরও ঝলমলে লাগছে। দূর থেকে সিঞ্চনকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনার জন্যই ওয়েট করছি।’ বুক ধুকপুক করে উঠল সিঞ্চনের। সে স্মার্ট। মেয়েদের ব্যাপারে ওস্তাদ না হলেও, ঘাবড়ে যাওয়ার মতো ছেলে সে নয়। কিন্তু সেদিন যেন অন্যরকম হল। মনে হল, এই মেয়েটি তার কাছে শুধু একজন মেয়ে-ই নয়, আরও একটু বেশি কিছু। নার্ভাস হেসে সিঞ্চন বলল, ‘আপনি জানলেন কী করে আমি এখানে আসব?’
‘আমি অনেক কিছুই জানতে পারি,’ হাসিমুখে বলেছিল কৃষ্ণচূড়া।
‘আর কী জেনেছেন?’
কৃষ্ণচূড়া মিটিমিটি হেসে বলল, ‘জেনেছি, আপনি একজন নাইস পার্সন, সুন্দর মানুষ।’
সিঞ্চন হেসে বলল, ‘বাবা, মাত্র কুড়ি টাকার জন্য ‘নাইস পার্সন’ জেনে গেলেন!’
‘কুড়ি টাকা তো অনেক, দু’টাকার জন্যও বোঝা যায়। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। আমার সেন্সরগুলো খুব পাওয়ারফুল।’
‘সেন্সর? সে আবার কী?’ ভ্রূ তুলল সিঞ্চন। মেয়েটা শুধু সুন্দরী নয়, মজারও!
‘কিছু নয়। এসব বাদ দিন। ট্যাক্সি ধরবেন, না, আমার সঙ্গে এক কাপ কফি খাবেন। অবশ্য যদি আপনার হাতে সময় থাকে। টাকা ফিরিয়ে আপনাকে হার্ট করতে চাই না। ক্যান ইউ গিভ মি দ্য চান্স? কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা সুযোগ।’
অন্যদিন হলে এই রাতে কফি খেতে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারত না সিঞ্চন। কিন্তু সেদিন তার মনে হয়েছিল এক কাপ কেন, এই মেয়ে চাইলে সে দশ কাপ কফিও খেয়ে ফেলবে।
‘চলুন কফি খাওয়া যাক। আপনার নামটা জানতে পারি কি?’
‘কৃষ্ণচূড়া।’
‘বাঃ, খুব সুন্দর নাম তো!’
‘আরও একটা নাম আছে, সেটা কিন্তু তত সুন্দর নয়।’
‘ডাকনাম?’
কৃষ্ণচূড়া হেসে বলল, ‘না কোডনেম। শুনতে চাইবেন না।’
সিঞ্চন বলল, ‘আপনি কিন্তু চমৎকার হেঁয়ালি করতে পারেন কৃষ্ণচূড়া। পাজলের মতো।’
‘আমি পাজল ভাঙতে পারি!’
সিঞ্চনের মনে হল, এই সেই মেয়ে যার জন্য চব্বিশ বছর ধরে সে অপেক্ষা করছে। সে প্রেমে পড়ে গেল।
কিন্তু সেই কৃষ্ণচূড়া যে একটা ছোট বিষয় নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করবে, কে জানত! সিঞ্চনের এবার বেশ বিরক্তই লাগছে। তবু সে নিজেকে সামলেই রাখল। হালকা গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, অনেক রাগ হয়েছে, এবার মুখ ঘোরাও তো। সুন্দর মুখটা অনেকক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।’
কৃষ্ণচূড়া মুখ না ঘুরিয়েই বলল, ‘দেখার দরকার নেই,’
সিঞ্চন হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, দেখব না। এই আমি চোখ বুজলাম। এবার তো ফেরাবে।’
মুখ না ফিরিয়েই কৃষ্ণচূড়া থমথমে গলায় বলল, ‘কালকের ঘটনা আমি ভুলতে পারছি না
সিঞ্চন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কী ছেলেমানুষের মতো কথা বলছ কৃষ্ণচূড়া? আমি কিছুই করিনি, যা করার তুমিই তো করলে। কিছু না বলে, দুম করে চলে গেলে। আমি কি তোমাকে জোরজবরদস্তি করেছি? বাধ্য করেছি? তোমার ইচ্ছে নেই বুঝতে পেরেই আমি থেমে গিয়েছিলাম। আমি তো আর প্রসিড করিনি।’
কৃষ্ণচূড়া এবার মুখ ফেরাল। সিঞ্চনের মনে হল, তাকে আজ সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে। বিষন্ন হলে কি সব মানুষকেই বেশি সুন্দর লাগে? কৃষ্ণচূড়া চোখ নামিয়ে খানিকটা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘প্রসিড করলে তোমারই সমস্যা হত সিঞ্চন।’
‘কী যা তা বলছ কৃষ্ণচূড়া! আজকালকার দিনে এটা কোনও বিষয়? তুমি তো দেখছি ঠাকুমা-দিদিমাদের আমলে পড়ে আছ!’
কৃষ্ণচূড়া শুকানো হাসল। চোখ-মুখের মতো তার দাঁতের সেটিংও চমৎকার। শুধু মুক্তোর মতো ঝকঝকে নয়। মনে হয়, কেউ যেন মেপে মেপে বসিয়ে দিয়েছে।
‘তুমি বুঝতে পারছ না সিঞ্চন, বুঝতে পারবেও না।’
‘থাক আমার আর বুঝে কাজ নেই। কালকের দিনটা এবার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো তো দেখি। কাম অন কৃষ্ণচুড়া! আজ আর অফিস যাব না ঠিক করেছি। চলো, টুক করে কোথাও ঘুরে আসি। অ্যাই, গঙ্গায় নৌকো চড়বে?’
কৃষ্ণচূড়া নৌকা চড়ার প্রস্তাব শুনল বলে মনে হল না। একই রকম বিষগ্ন গলায় বলল, ‘তুমি বুঝতে না পারলেও আমি বুঝতে পারছি। কালকের পর থেকেই বুঝতে পারছি। আমি তোমাকে ঠকাতে পারব না সিঞ্চন। গত তিন মাসে আমি তোমার সঙ্গে বড্ড ইনভলভড হয়ে পড়েছিলাম। এটা উচিত হয়নি।’
কপালের উপর এসে পড়া চুল সরাল কৃষ্ণচূড়া। সিঞ্চন লক্ষ করে দেখেছে, এই কাজটা সে মাঝেমধ্যেই করে। কপাল থেকে চুল সরায়। এই সময় তাকে দারুণ লাগে। শরীরে কেমন একটা শিরশিরানি হয়। ইচ্ছে করে, ঝাঁপিয়ে পড়ে আদর করি। সত্যি কথা বলতে কী, গতকালের ঘটনাটা সেরকমই ছিল। আগে থেকে কোনও পরিকল্পনা ছিল না। গত মাসে তার বস সৌমদা কোয়ার্টার পেয়েছে। রুবি পার্কের কাছে চমৎকার জায়গা। থার্ড ফ্লোরে দুটো বড় বড় ঘর। দক্ষিণের জানলাটা খুললেই মস্ত একটা লেক। এতদিন সেই কোয়ার্টার ফাঁকাই পড়ে ছিল, টুকটাক কাজকর্ম করিয়ে পাটনা থেকে মাকে আনতে গিয়েছে সৌম্যদা। এবার পাকাপাকিভাবে সেট্ল করবে। যাওয়ার আগে কোয়ার্টারের চাবি সিঞ্চনকে দিয়ে বলে গিয়েছে, ‘একদিন অন্তত গিয়ে দেখে আসিস। ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে থাকবে ক’দিন। চিন্তা হয়।’
কাল সেই ফ্ল্যাটই দেখতে গিয়েছিল সিঞ্চন। বেশিক্ষণ নয়, শুধু একবার ঢুঁ মেরে আসা। কৃষ্ণচূড়াকে নিয়ে যাওয়ার কোনও কথাই ছিল না। সে-ই জোর করল। বলল, ‘যাই না, তোমার সঙ্গে তো খানিকটা বেড়ানো হবে।’
‘ধুর, এটা আবার বেড়ানো নাকি। এ তো চৌকিদারি। দরজা-জানলা বন্ধ আছে কি না দেখেই চলে আসব।’
কৃষ্ণচূড়া কৌতুক ভরা চোখে বলল, ‘আমিও দেখব। দরজা-জানলা বন্ধ আছে কি না আমি দেখতে পারি না বুঝি? টেনেটুনেও দিতে পারি। আমার হাইড্রলিক সিস্টেম, এয়ার মাসল তোমাদের চেয়েও ভাল।’
সিঞ্চন হেসে বলল, ‘কী যে ঠাট্টা করো হেঁয়ালিরানি, বুঝতেও পারি না। না না, তোমার গিয়ে দরকার নেই।’
কৃষ্ণচূড়া ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দিল, ‘তোমার যখন আপত্তি…’
সিঞ্চন তাড়াতাড়ি বলে, ‘দেখো কাণ্ড! আবার রাগ করলে তো! ঠিক আছে বাবা, চলো।’
জানলা বন্ধ কি না দেখার বদলে ঘরে ঢুকে, বেডরুমের জানলা খুলে দিল সিঞ্চন। লেকের বাতাস হু হু করে ঘরে ঢুকে পড়ল। জানলার কাছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ঝাপসা হয়ে আছে। ফুলে ফুলে সেই গাছ লাল হয়ে আছে। চুল এলোমেলো করে দেয় কৃষ্ণচূড়ার। সে হাত তুলে চুল ঠিক করতে করতে বলে, ‘বিউটিফুল!’
এরপর আর সিঞ্চন নিজেকে সামলাতে পারে না। সে এগিয়ে এসে কৃষ্ণচূড়ার দুটো গাল দু’হাতে আলতো করে ধরে। ঠোঁট নামিয়ে দেয় মুখের উপর। কৃষ্ণচূড়া দ্রুত সরে যেতে চেষ্টা করে। পারে না, সিঞ্চন তার ঠোঁট ঘষতে থাকে কৃষ্ণচূড়ার চোখের পাতায়, কপালে, কানের লতিতে। কৃষ্ণচূড়া বাধা দিতে থাকে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বের হয়। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে সিঞ্চনের মুখ। ততক্ষণে সিঞ্চন তার বুকের উপর একটা হাত নামিয়ে এনেছে। আঙুলগুলো নড়তে থাকে গভীর আদরে। সরে যেতে গিয়ে জানলার গ্রিল কৃষ্ণচূড়ার মাথা ঠুকে যায়। কৃষ্ণচূড়া মুখ ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। সিঞ্চন তার ঠোঁট রাখতে চেষ্টা করে কৃষ্ণচুড়ার ঠোঁটে। কখনও পারে, কখনও পারে না। একটা হাত ঘাড়ের পিছনে ধরে অন্যহাতে কৃষ্ণচূড়ার টপের বোতাম খুঁজতে থাকে পাগলের মতো। গাঢ় গলায় ফিসফিস করে বলতে থাকে, ‘কৃষ্ণচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, আমার কৃষ্ণচূড়া…’
ছিটকে সরে আসে কৃষ্ণচূড়া। সিঞ্চন অবাক হয়। কৃষ্ণচূড়া দ্রুত হাতে অবিন্যস্ত জামা ঠিক করতে করতে বলে, ‘আমি চলে যাব…’
‘কী হল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সিঞ্চন।
‘কিছু হয়নি, আমি চলে যাব।’
‘সরি কৃষ্ণচূড়া। হঠাৎ কী যে হল,’ সিঞ্চন হাত তুলে শান্ত করার চেষ্টা করল। বলল, ‘কাম ডাউন কৃষ্ণচূড়া। ইটস ওকে। আই অ্যাম সরি। বলছি তো, আমার ভুল হয়েছে।’
‘প্লিজ আমায় ফিরে যেতে দাও, প্লিজ।’
নিজের মাথার চুল ঠিক করতে করতে সিঞ্চন বলে, ‘ঠিক আছে বাবা। আমিও তো যাব আরে, হঠাৎ কী যে হল…’
কৃষ্ণচূড়া আর উত্তর দেয় না। সে সিঞ্চনকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায় একাই, লিফট ধরে সোজা নেমে আসে নীচে। হতবাক সিঞ্চন নীচে নেমে কৃষ্ণচূড়াকে দেখতে পায় না। মেয়েটা গেল কোথায়? ভ্যানিশ হয়ে গেল নাকি?
এরপরও রাগ করবে না সিঞ্চন। প্রেমিকাকে একটা চুমু খাওয়ার অধিকারও কি তার নেই। শারীরিক আদর বা জামা খোলার চেষ্টাটা না হয় একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। ওরকম সময়ে কি সবকিছু হিসেব করে করা যায়? এর মধ্যে বোঝাবুঝির কী আছে। সে কফির মগ সরিয়ে রেখে বলল, ‘তুমি কী বলতে চাইছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কৃষ্ণচূড়া। যদি মনে করো, আমি বাড়াবাড়ি কিছু করছি, আবার বলছি আয়্যাম সরি।’
কৃষ্ণচূড়া সিঞ্চনের চোখের উপর চোখ রাখল। নরমভাবে একটু হাসল। সে হাসিতে আনন্দ নেই। বলল, ‘তোমার সরি বলার দরকার নেই। সরি বলছি আমি। সরি সিঞ্চন। আমি অনেক পাজল ভাঙতে পারি, কিন্তু সবটা পারি না। আমাকে ভুলে যাও।’
সিঞ্চন প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘সে কী! কী বলছ তুমি! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? আর ইউ ম্যাড। সামান্য ঘটনার জন্য…’।
কৃষ্ণচূড়া কপালে পড়া চুল সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার কাছে সামান্য হলেও আমার কাছে নয়। আমাকে মুখের ভাষা দেওয়া হয়েছে, শরীরের ভাষা দেওয়া হয়নি। এটা কতটা জরুরি এতদিন বুঝিনি, কাল বুঝলাম। আমি তোমার শরীরের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারলাম না। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারলাম না।’
‘মানে?’
কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল কৃষ্ণচূড়া। সামান্য হাইয়ের মতো তুলল। মেয়েটা কি ক্লান্ত? সিঞ্চন হতবাক হয়ে বসে রইল।
কফির বিল মিটিয়ে দেওয়ার পর কৃষ্ণচুড়া বলল, ‘তুমি কি আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দেবে? আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।’
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সিঞ্চন বলল, ‘দেব।’
কৃষ্ণচূড়া হেসে বলল, ‘ভাড়া দিয়ে দিতে হবে কিন্তু। রাজি তো?’ কফি শপ থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণচূড়া তার গোলাপি রঙের ছোট্ট ছাতাটা খুলে মাথায় ধরল। সিঞ্চন পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘তুমি কি আর-একবার ভাবতে পারো না কৃষ্ণচুড়া?’
কৃষ্ণচূড়া মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘না পারি না। যে ক্ষমতা আমার নেই, আমাকে দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে ভাবতে পারি না।’
কে সিক্স মডেলকে পাওয়া গেল কাকভোরে। ইনস্টিটিউটের গেটের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। যেন ঘুমিয়ে আছে। তার এয়ার মাসল, পিস্টন, চিপস, সেন্সর, হাইড্রলিক সিস্টেম কোনওটাই কাজ করছে না। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, মডেল তার যাবতীয় ইন-বিল্ট চার্জ ফুরিয়ে ফেলেছে। ড. মণিময় সামন্ত খবর পেয়েই ছুটে এলেন।
উনিশ কুড়ি, ১৯ জুন ২০০৯