গর্ত
হরিপদ পড়ল নিঃশব্দে। এবং আলগোছে।
এই বনবাদাড়ের কুয়োটা যে আজও আছে সেটাই ভুলে গেছে সবাই। হরিপদ তো বটেই। সেই ভুলে যাওয়া, বহু বহু বছরের বাতিল, জীর্ণ, শুকনো, প্রায় বুজে আসা কুয়োটার মুখে ডাল পাতা সাজিয়ে কেউ যেন ফাঁদ পেতে রেখেছিল। আজ হরিপদ তাতে ধরা দিল। একপাশে ঝুঁকে থাকা ঝাপসা ঘন বটগাছটা থেকে উড়ে গেল বাদুড়ের দল। এঁকেবেঁকে উড়ে গেল। তাদের ক্রুদ্ধ ধারালো ডানায় চাপা অথচ তীক্ষ্ণ আওয়াজ উঠল। ফালা ফালা করে অন্ধকার কাটার আওয়াজ। শাট্ শাট্ শাট্।
প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে থাকা বাতিল কুয়েতে পড়তে হরিপদর তেমন সমস্যা হয়নি। প্রথমে পায়ের তলার শুকনো ডাল পাতা ভেঙেছে। তারপর ছোট একটা হোঁচটা নেশা করা এলোমেলো পা এমনিতেই গোলমাল করছিল। সামলাতে সমস্যা হচ্ছিল। হোঁচটের পর আর একেবারেই সামলানো গেল না। নিজের দুবলা, পাতলা শরীরটা নিয়ে হরিপদ ঝুঁকে পড়ল সামনে। হাত বাড়িয়ে মাটি ধরতে গেল। মাটি পেল না। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা লতা পাতা ছিঁড়ে পা হড়কে পড়ল যেন শূন্যে!
তারপর পড়তেই লাগল। ফটফটে চাঁদের আলোর পৃথিবী ছেড়ে গভীর, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে পড়তে লাগল হরিপদ। তার দু’কানের পাশ দিয়ে বদ্ধ, সোঁদা বাতাস হু হু করে উঠছে ওপরে। যেন ছুটছে, পালাচ্ছে। বহুদিন বন্দি থাকার পর আজ যেন মুক্তি পেয়েছে!
প্রথম ধাক্কায় ঘাবড়ে গিয়েছিল হরিপদ। সত্যি পড়ছে তো? নাকি নেশার ঘোরে এমনটা মনে হচ্ছে? হতে পারে। নেশায় এমন হয়। কখনও মনে হয়, উঠে যাচ্ছি। মাটি, বাড়িঘর, মানুষ ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছি। সেই ওঠা থামতে চায় না। উঠতেই থাকে। আবার উলটোটাও ঘটে। কখনও কখনও মনে হয় পড়ছি। খাদে পড়ে যাওয়ার মতো। ওঠার মতো সেই পড়াও থামতে চায় না। একটা খাদের পর আর একটা খাদ আসে। তারপর আবার আর একটা।
যদিও গাছতলার আড্ডায় হরিপদ আজ বেশি খায়নি। সময় বেশি নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু খেয়েছে অল্প। তবু ফট করে নেশাটা ধরে গেল। জিনিসটা ভাল ছিল। অনেক সময় এরকম হয়। জিনিস ভাল থাকে। কমেই কেল্লা ফতে করে। আজও তাই হয়েছে। নেশা চড়তেই মনে হয়েছে, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। অথচ বাড়ি ফেরার তাড়া হরিপদর কোনওদিনই নেই। বিয়ের পর দু’-চারদিন হয়েছিল। ব্যস, সেখানেই ইতি। নেশার কারণেই আজ মনে হল। ঠিক করল, সোজা পথে না ফিরে বনবাদাড়ের রাস্তাটা ধরবে। পথটা শর্টকাট হয়। বাড়ি পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি কম লাগে। কুড়ি মিনিটের জন্য হরিপদর মন অকারণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
চাঁদু বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘রাত বিরেতে ওই জংলা পথটা দিয়ে না-ই বা গেলে হরিদা। তার ওপর মাল খেয়ে আছ। পা হড়কে পড়ে থাকলে কেউ খবর পাবে না। সারা রাতটা ঝোপের মধ্যে শুয়ে থাকতে হবে। কেউ খোঁজ পাবে না। রাতে ওই পথে কেউ যায় না কিন্তু।’
হরিপদ চোখ সরু করে বলল, ‘কেন? যায় না কেন? কী আছে ওখানে?’
‘কী আবার থাকবে? তুমি জানো না যেন। কিছু নেই। তবু ঝোপ-ঝাড় তো আছে। সাপ খোপ যদি থাকে?’
হরিপদ হেসে বলে, ‘দূর, এই শীতের মুখে সাপ-খোপ কোথায়? আর থাকলেও ক্ষতি নেই। মাতালকে সাপে কাটলে কিছু হয় না। রক্তে বিষ কাজ করে না। তা ছাড়া জিনিসটা ভাল ছিল।’
চাঁদু বিরক্ত হয়। বলে, ‘হ্যা হ্যা করে হেসো না তো। মাতাল চাতাল লোক নিয়ে এই হল গিয়ে মুশকিল। নিজের ভাল বোঝে না।’
‘আহা, রাগ করিস কেন? দে দেখি দুটো বিড়ি দে। দুটো বিড়ি টানতেই পথ ফিনিশ হবে। তা ছাড়া আজ হল গিয়ে তোর জোছনা রাত। দেখিস না আলো কেমন ফটফটায়? চাঁদের আলোয় সাপ বেরোয় না। দে দে বিড়ি দে।’
‘আমি তোমার সঙ্গে যাব না। সাপ না থাকুক, শিয়াল থাকতে পারে। জোছনা রাতে শিয়াল তাড়াতাড়ি বের হয়।’
হরিপদ আবার দাঁত বের করে হাসে। বলে, ‘বেরোলে ক্ষতি কী? দু’জনে গল্প করতে করতে চলে যাব। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সগ্গ পর্যন্ত কুকুর গিয়েছিল, আমার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত না হয় শিয়াল যাবে। হা হা।’
চাঁদু মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘যা খুশি করো গে যাও।’
‘আহা বুঝিসই তো তোর বউদি আবার দেরি হলে চিন্তা করে। বেচারি ছেলেমেয়ে নিয়ে একা থাকে। রাতবিরেতে বাড়িতে একা মেয়েমানুর বলে কথা। গ্রামের ভেতর ভয়ের কিছু নেই। তবু বয়সটা তো বেশি নয়। আহা, বুঝিসই তো। নিজের স্ত্রী বলে বলছি না দুটো সন্তানের মা হলে কী হবে, পুষ্পর শরীরে এখনও চটক আছে। আছে না? তা ছাড়া কে জানে হয়তো না খেয়েই বসে থাকবে। মেয়েটা যা বোকা।’
চাঁদু এবার হেসে ফেলে। হাসবারই কথা। চকডিহি গ্রামের সকলেই হরিপদর এ কথা শুনে হাসবে। হরিপদকে নিয়ে চিন্তা করার মতো সময় পুষ্পর নেই। যাদের স্বামী রোজগারহীন এবং অপদার্থ সেইসব স্ত্রীদের সংসার ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় থাকে না। পুষ্পর স্বামীর আরও একটা গুণ আছে। বেকারের সঙ্গে সে বোকাও। এর ওপর সংসার যদি এভাবের হয় তা হলে তো কথাই নেই, একেবারে সোনায় সোহাগা। হরিপদর সংসার শুধু অভাবের নয়, বেশিমাত্রায় অভাবের। কোনও কোনও দিন অবস্থা খুবই মারাত্মক চেহারা নেয়। এমনি সকালে রান্নাবান্নার উপায় থাকে না। বেলা বাড়লে চেয়ে চিন্তে, ধার দেনায় জোগাড় করতে হয়। পুষ্প তার দুই ছেলে মেয়েকে তখন মিথ্যে বোঝায়। বলে, ‘আজ রান্নার দেরি হবে। উনুন গোলমাল করছে। এইবেলাটা তোমার মুড়ি আর জল খেয়ে স্কুলে দৌড় দাও দেখি। বিকেলে ফিরে এসে ভাল জিনিস খাবে।’
ছয় বছরের বিনু পেটুক প্রকৃতির মেয়ে। ভাল জিনিস শুনে তার লোভ হয়। সে মায়ের কাছে মাথার ফিতে বাঁধতে বাঁধতে চোখ বড় করে বলে, কী খাব?’
পুষ্প দাঁতে বিবর্ণ নীল ফিতের একাংশ চেপে ধরে দ্রুত হাতে মেয়ের চুলে চিরুনি বোলায়। ভান করে কথাটা শুনতে পায়নি। তখন বিনুর এক বছরের বড় দাদা শঙ্কু প্রশ্নটা করে।
‘কী হল বললে না? ফিরে এসে কী ভাল জিনিস খাব মা?’
সাধারণত এইসময় পুষ্প মেয়েকে কষিয়ে একটা চড় লাগায়। এর জন্য বড় কোনও কারণ দরকার হয় না। চুলের ফিতে নোংরা, ফ্রকের বোতাম ছেঁড়া ধরনের ছোটখাটো অপরাধই যথেষ্ট। এতে লাভ হয়। ছেলেমেয়ে দু’জনেই চুপ করে যায়। সুবিধের বিষয় হল, শঙ্কু, বিনু, তাদের মাকে ভয় পায়। অভাবের বাড়িতে ছেলেমেয়েরা মাকে ভয় না পেলে সমস্যা।
তবে আবার কোনও কোনও দিন অন্যরকমও হয়ে যায়। পুষ্প বানিয়ে বানিয়েও বলে।
‘সে হবেখন। ভাত বেঁধে অল্প ঘি দিয়ে নেড়ে রাখব। দুটো তেজপাতা দেব। এসে পোলাও খাবি।’
শঙ্কু উৎসাহ নিয়ে বলে, ‘ক’টা কিসমিস ফেলে দিয়ে মা।’
‘অনেক হয়েছে। আর পাকামো করতে হবে না। এখন যাও তো। স্কুলে দেরি হয়ে যাবে।’
শঙ্কু এবং বিনু সত্যি সত্যি দু’ঘটি জল খেয়ে স্কুলে দৌড়োয়। অবশ্য জলের ব্যাপারে শঙ্কু মাঝেমধ্যে আপত্তি করে। বলে, ‘মা, অত জল খাব না। খালি পেচ্ছাপ পায়।’
বিনু কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘মা, আজ টিপিনেও কি মুড়ি?’
এবার আর পুষ্প নিজেকে সামলাতে পারে না। তার মাথায় আগুন ধরে যায়। ছুটে গিয়ে মেয়ের যত্ন করে বাঁধা চুলের মুঠি চেপে ধরে ঝাঁকানি দেয়। হিসহিসে গলায় বলে, ‘খাওয়া নিয়ে আর একটা কথা বলবি তো মুখ ভেঙে দেব। উফ, একটা রাক্ষসের গুষ্টিকে আমি পেটে ধরেছি। শুধু খাই আর খাই। এরা একদিন আমাকেও চিবিয়ে খাবে।’
কয়েক বছর আগেও এইসময় পুষ্প তার গালাগালিতে হরিপদকে টেনে আনত। এখন আর আনে না। এনে কোনও লাভ হবে না। এইরকম ঝামেলার দিনগুলোতে হরিপদ সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। ফেরে সেই গভীর রাতে। বেরোনোর আগে এক টুকরো সাবান আর দু’বালতি জল দিয়ে গা ঘষে ঘষে ভাল করে স্নান সারে। দাঁত ভাঙা চিরুনি দিয়ে পাট পাট করে চুল আঁচড়ায়। বগল তুলে খালি পাউডারের কৌটোটা ক’বার নাড়ায়। তারপর জীর্ণ চটি দুটোকে ন্যাকড়া দিয়ে ভাল করে মুছে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে পড়ে। আগে বেরোনোর সময় হরিপদ ছাতাটা নিত। এখন নেয় না। ছাতার অবস্থা খুবই শোচনীয়। শিকে খোঁচা লাগে। তাই খালি হাতেই গাছতলার দিকে রওনা দেয়। মুখ দেখে মনে হয়, জরুরি কোনও কাজে সদরে চলেছে।
এই লোকের জন্য পুষ্প রাত জেগে, থালা সাজিয়ে অপেক্ষা করবে কেন? সেই কারণেই চাঁদু হাসে।
হরিপদ চাঁদুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হাসছিস যে বড়?’
চাঁদু দাঁত বের করে বলে, ‘না, হাসিনি। তুমি যাও হরিদা। এই নাও বিড়ি নাও। দুটো নেই, একটা নাও। সাবধানে যেয়ো। সাপ, শিয়ালের কথা মাথায় রেখো। পরে বলতে পারবে না। আমি বলিনি। পথের জন্য আর একটু খেয়ে যাবে নাকি?’
আর একটু খাবার প্রস্তাবে হরিপদ খুশি হল। সে খুশি চেপে বলল, ‘না থাক। আর খাব না। তোদের বউদিটা আবার গন্ধ পেলেই বকাঝকা করে। বুঝলি চাঁদু, ভাবছি দুম করে একদিন ছেড়ে দেব।’
চাঁদু না বোঝার ভান করে বলে, ‘কী ছেড়ে দেবে?’
‘কী আবার? নেশা। নেশা ছেড়ে দেব। সে একটা কাণ্ড হবে। বাড়ি ফিরে গিয়ে পুষ্পকে ঘুম থেকে তুলব। পুষ্প রেগে গিয়ে বলবে, কেন আমার কাচা ঘুম ভাঙালে? আমি বলব, একটা মজার ব্যাপার হয়েছে তাই ভাঙালাম। ও বলবে, মাঝরাতে মজা না দেখালেই হত না? আমি বলব, না হত না, এটা হল মাঝরাতের মজা। বলে ওর মুখের কাছে মুখ হাঁ করে বলব, গন্ধ পাচ্ছ? পাচ্ছ গন্ধ? পাচ্ছ না তো? জানতায় পাবে না। নো স্মেল। হা হা। কেমন হবে বল দেখি চাঁদু? তোদের বউদি একেবারে চমকে যাবে না?’
চাঁদু মুখ ফিরিয়ে হাসি লুকোল। বলল, ‘হ্যাঁ, চমকে যাবে।’
‘ভেরি গুড। তা হলে শেষ একটা দিয়ে দে চাঁদু। চট করে মেরে হাঁটা দিই। জল কম দিস। কড়া করে খাই। তুই আবার সাপ শিয়ালের কথা বলে ভয় পাইয়ে দিলি।’
চাঁদু সাপ, শিয়াল বলেছিল, কিন্তু কুয়োটার কথা বলেছিল কি? এরকমই হয়। নকল বিপদের কথা বলতে বলতে মানুষ তাসল বিপদের কথা ভুলে যায়। চাঁদুও কি ভুলে গিয়েছিল? কবে যেন শুনেছিল পুলের জংলা পর্থে একটা মরা কুয়ে আছে। এই কি সেই কুয়ো? এতদিন মরে থাকার পর তাকে পেয়ে প্রাণ ফিরে পেল? মাথার ভেতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে হরিপদর। মনে হচ্ছে জ্ঞান হয়ে যাবে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কুয়োর ভেতরে বাতাস কি কম থাকে। সেই কম বাতাসই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। যে-কোনও সময় সরে যাবে। যেন মারার আগে পেঁচা তার কোনো কুশ্রী ঠোঁট দিয়ে ইঁদুর নিয়ে খেলছে। নিজেকে ইঁদুরের মতো মনে হচ্ছে কেন? নেশার জন্য? নাকি মরবার মুহূর্তে এরকমই হয়। নিজেকে ইতর প্রাণীর মতো লাগে? নীচ থেকে উঠে আসা বাতাসের সঙ্গে একটা তীব্ৰ, সুচালো গন্ধ ভেসে এল। গা গুলিয়ে উঠল হরিপদর। গর্তের দু’পাশেই ধাক্কা খাচ্ছে সে। প্রথমে পাশটা ছিল কঠিন। ইট পাথরের। এখন নরম, মাটির মতো লাগছে। আর কতটা পড়তে হবে? এক-একটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে অনন্ত, অসীম। দু’দিকে হাত বাড়িয়ে দিল হরিপদ। হাতড়াল। যদি কিছু আঁকড়ে ধরার মতো পাওয়া যায়। শক্ত কিছু। গাছের শিকড়, দেয়ালের খাঁজ যা খুশি। যদি ধরে ঝুলে পড়া যায়। বাঁচার শেষ চেষ্টা করল হরিপদ। পারল না। তার হাতের মুঠোয় ভেজা ঘাস আর আগাছা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এল। নখের আঁচড়ে উঠে আসতে লাগল গুঁড়ো মাটি, শ্যাওলা। সে পড়তেই লাগল। শেষে কী আছে? জল? তাই হবে। কুয়োর শেষে তো জলই থাকে। কী হবে? সে কি সাঁতার জানে? মনে পড়ছে না। কিছুতেই মনে পড়ছে না। অথচ এখনই মনে পড়া দরকার। খুব দরকার। হরিপদ চোখ বুজে প্রাণপনে মনে করবার চেষ্টা করছে।
পুষ্প, অ্যাই পুষ্প। মুখটা ফেরাও পুষ্প দোহাই ফেরাও একবার। আচ্ছা ফেরাতে হবে না। শুধু বলো, আমি কি সাঁতার জানি? শঙ্কু, বাছা আমার। সোনা ছেলে। তুই তো জানিস। জানিস না? মায়ের মতো চুপ করে থাকিস না বাপ আমার। বল, বল, আমি সাঁতরাতে পারি? এই তো বিনু, আমার মা। আদরের ধন। আমায় বলে দে লক্ষ্মীটি। তোর বাপটা সাঁতার জানে কি না বলে দে। ঠিক আছে, তোর মাকে বলব না। কাউকে না। কানে কানে চুপিচুপি বলে দে।
হরিপদ এবার বুঝতে পারল সে মরে যাচ্ছে। নিশ্চয় মরে যাচ্ছে। মরে যাওয়ার আগে মানুষ তার প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলে। সেও বলছে। হরিপদ বুক ভরে জোরে শ্বাস নিল।
না, জল নয়। হরিপদ পড়েছে নরম মাটিতে। ভেজা ভেজা হলেও সেই মাটি মূলত শুকনো। নরম মাটির কারণেই অত ওপর থেকে পড়েও হরিপদ ব্যথা পায়নি। তবে আওয়াজ হয়েছে। বেশ জোর আওয়াজ। সেই আওয়াজ মরা কুয়োর দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে, দুমড়ে মুচড়ে, পাক মারতে মারতে উঠতে লাগল ওপরে।
একদিকে কাত হয়ে পড়েছে হরিপদ। সেই অবস্থাতেই চোখ খুলে তাকাল। গর্তটা যেন গোল একটা ঘরের মতো। চারপাশে খুব বেশি হলে হাতখানেক জায়গা। সোজা হয়ে, মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল হরিপদ। জোরে শ্বাস টানল। না, অসুবিধে কিছু নেই। শরীরে কোথাও ব্যথা না থাকলেও পা দুটো একবার টান করে পরীক্ষা করল হরিপদ। সাবধানের কোনও মার নেই। ভাঙার ব্যথা অনেকসময় পরেও শুরু হয়। না, ভাঙেনি। হাতদুটোর অবস্থাও খারাপ কিছু নয়। ডানদিকে কনুইয়ের কাছে একটু জ্বালা জ্বালা আছে। সে তো থাকবেই। ছড়ে উড়ে গেছে বোধহয়। অতখানি পড়লে একটু ছড়বে না? এতক্ষণ পর খানিকটা স্বস্তি বোধ করল হরিপদ। না, তা হলে এবার অন্তত মরা হল না। মাথা তুলে ওপরের দিকে তাকাল সে। সেখানে একটুখানি আকাশ। সেই আকাশ গোল এবং নীল। চাঁদনি রাতের নীল। সেই আকাশ থেকে শিরশিরে তাজা হাওয়া নেমে আসছে একেবারে নীচ পর্যন্ত।
হরিপদ সামান্য হাসল। বিড়বিড় করে আপনমনেই বলল, ‘বাঃ, ব্যবস্থা মন্দ নয়।’
২
বদ্রিনাথ কখনও দিনেরবেলা এ বাড়িতে আসেন না। তিনি আসেন সন্ধের পর। একা আসেন। গণেশ বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দাড়িয়ে সিগারেট খায় আর চারপাশে তাকায়। দেখে কেউ আসছে কি না। পাহারা দেয়।
বদ্রিনাথ আজ এসেছেন দিনেরবেলা। বেলা দশটার কিছু আগে পরে। আজও গণেশকে সঙ্গে এনেছেন। তবে আজ সে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে নেই। বাড়িতে ঢুকেছে। দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। বদ্রিনাথের জন্য বারান্দায় বাড়ির একমাত্র চেয়ারটা এনে দিয়েছে পুষ্প। সাধারণত চেয়ারের একটা বা দুটো পায়ে গোলমাল হয়। এই চেয়ারের চারটে পায়েই গোলমাল। সামান্য নড়াচড়াতেই ঢক ঢক করে। সব সময়ই মনে হয়, উলটে যাবে। বদ্রিনাথ সেটা জানেন। তাই তিনি বসে আছেন সতর্ক হয়ে। চেয়ারের হাতল ধরে।
সন্ধের সময় যখন বদ্রিনাথ আসেন তখন তিনি কখনও বারান্দায় বসেন না। ঘরে ঢুকে যান। পুষ্পর খাটেই বসেন। তাঁর জন্য আলাদা চাদরের ব্যবস্থা আছে। বিছানার চাদর। বদ্রিনাথ নিজেই কলকাতা থেকে পছন্দ করে কিনে আনেন। পুষ্প বাক্স খুলে সেই চাদর বের করে। খাটে যত্ন করে পাতে। বদ্রিনাথের এই একটা নেশা। বেশিদিন এক চাদর পছন্দ হয় না। নিয়মিত বদলান।
এবারের চাদরটা এসেছে কাল সন্ধেতে। রং সুন্দর। ফিরোজা। চারপাশে নকশা। সেই নকশার সবটাই সাদা। ডাল, পাতা, ফুল সব সাদা। হঠাৎ দেখলে সাদা বাগানের মতো লাগে। পুস্প তার খাটে সেই চাদর পাতার পর হ্যারিকেনের আলোতে সাদা বাগান ঝলমল করে উঠল।
দরজা ভেজিয়ে পুষ্প বলে, ‘বাঃ সুন্দর তো।’
বদ্রিনাথ তরল গলায় বলেন, ‘তোমার পছন্দ হয়েছে?’
পুষ্প হেসে বলে, ‘খুব পছন্দ হয়েছে। আসেন, খাটে আসেন। খাটে আরাম করে বসেন।’
এই সময়টায় বদ্রিনাথ একটা লজ্জার ভান করেন। প্রতিবারই করেন। কালও করেছেন। বললেন, ‘আবার খাটে কেন? এই তো চেয়ারেই বেশ আছি।’
পুষ্প চোখ তুলে হাসে। বলে, ‘বাঃ নতুন চাদর এনেছেন, বসে দেখবেন না?’
বদ্রিনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা কোথায়?’
পুষ্প মুখ নামিয়ে বলে, ‘এর পাশের ঘরে লেখাপড়া করে। বাইরে থেকে ছিটকিনি দেওয়া আছে।’
বদ্রিনাথ খাটের ওপর উঠে পা গুটিয়ে বসেন। নতুন চাদরে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন, ‘গুড। ভেরি গুড। লেখাপড়া একটা দামি জিনিস। খুবই দামি জিনিস। সবকিছু থামিয়ে কিন্তু ছেলেমেয়ের লেখাপড়া কখনও থামিয়ো না। এই ঘরে আলো আছে তো পুষ্প?’
‘কোন ঘরে?’ হাত বাড়িয়ে খাটের পাশে রাখা হ্যারিকেন কমাতে কমাতে বলে পুষ্প।
‘ওই তো যে ঘরে তোমার ছেলেমেয়েরা পড়ছে সেই ঘরে। লেখাড়ার জন্য সাফিশিয়েন্ট লাইট দরকার। অন্ধকারে সব হয়, লেখাপড়া হয় না।’
‘না, আলো নেই। মোম দিয়েছি।’
‘এটাই তো অন্যায় করো। আমি টাকা রেখে যাচ্ছি। কালই একটা বড় দেখে হ্যারিকেল নিয়ে নেবে। আচ্ছা, ঠিক আছে তোমাকে কিছু করতে হবে না। গণেশ এসে দিয়ে যাবে। হ্যাজাক দেবে?’
‘না, হ্যারিকেনেই হবে। হ্যাজাক দেখলে সবাই সন্দেহ করবে। আপনে হারিকেন পাঠাবেন। তেল ভরে পাঠাবেন।’
চিবুক দিয়ে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে দ্রুত ব্লাউজের বোতাম খুলতে থাকে পুষ্প। তার তাতে সময় কম। এখনও রান্না বাকি। ছেলেমেয়েরা খাবে। তারা ঘুমিয়ে পড়ছে।
‘মনে হয় না ওদের পড়াশোনা আর টানতে পারব। খেতে দিতেই পারি না, পড়াব কী করে?’
বদ্রিনাথ পূষ্পর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে আছেন। চোখের পলক পড়ছে না। তিনি জানেন, জামা খোলা হয়ে গেলেই মেয়েটার ধারালো চিবুক থেকে আঁচল খসে পড়বে। প্রতিদিন এরকমটাই হয়। সেই সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন বদ্রিনাথ। অপেক্ষা শেষ হলে তিনি পুষ্পকে ছোঁ মেরে টেনে নেন। কাল আগেই টেনে নিয়েছিলেন। তারপর ঘাড়ে, গলায়, বুকে মুখ ঘসে বিড়বিড় করে একটানা বলতে থাকেন, ‘চিন্তা কী? কোনও চিন্তা নেই পুষ্প। আমি তো আছি। ভাল কাজে আমি সবসময় আছি। আছি না? বলো তুমি আছি কি না? উঁ উঁ বলো, বললো, আগে বলো। উঁ উঁ।’
বদ্রিনাথের ভারে পুষ্পর দম চাপা লাগে। তবু সে মিথ্যে করে হাসে। বলে, ‘আপনে আছেন বলেই তো বেঁচে আছি। নইলে ছেলেমেয়ে নিয়ে কবে বিষ খেতে হত। বিষের পয়সাও আপনের কাছে চাইতাম। আপনি ভাল করেন না তো কে করেন? আসেন, আর একটু এদিকে সরে আসেন।
পুষ্প দ্রুত আধবুড়ো মানুষটার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে তাকে উত্তেজিত করার। আসলে সে তাড়াতাড়ি মুক্তি চায়।
তবে ভাল কাজের কথাটা মিথ্যে নয়। একটা রাইস মিল আর দুটো লং ডিসটেন্স বাসের মালিক বদ্রিনাথ সত্যি গ্রামের পাঁচটা ভাল কাজে থাকেন। বিনিপয়সায় বই বিলি থেকে শুরু করে বন্যার খিচুড়ি পর্যন্ত সবেতেই তাঁকে পাওয়া যায়। সঙ্গে পুজো, বিয়ে, ফুটবল খেলার চাঁদা তো আছেই। পার্টি পলিটিক্সের মানুষগুলোও লোকটার হাতের মুঠোয়। থানা থেকে বড়বাবু সপ্তাহে একবার জিপ চালিয়ে এসে দেখা করে যেত। সামনের পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ানোর খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর দু’বার করে আসে।
পুষ্প বদ্রিনাথকে চা দিয়েছে। হাতল ভাঙা কাপ একবার মুখে ঠেকিয়েই সরিয়ে রাখলেন বদ্রিনাথ। পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি খবরটা কখন পেলে?’
পুষ্প বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার ওপর বড় করে আঁচল টানা। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সে বলে, ‘আজ ভোরে। চাঁদু এসেছিল।’
বদ্রিনাথের মুখে একটা বিরক্তির ছাপ পড়ল। বললেন, ‘কী বলল সে?’
‘প্রথমবার কিছু বলেনি।’
বদ্রিনাথ ভুরু কুঁচকোলেন। বললেন, ‘প্রথমবার মানে? চাঁদু দু’বার এসেছিল নাকি?’
পুষ্প মাথা নাড়ে।
‘প্রথমবার এসে জিজ্ঞেস করল বিনুর বাবায় কাল রাতে বাড়ি ফিরেছে কি না। আমি বললুম, ফেরেনি। কিছু না বলে চলে গেল। ঘণ্টাখানেক বাদে আবার এল। তখনই বলল।’
‘কী বলল?’
পুষ্প গায়ের কাপড় ঠিক করল। ইস শাড়িটা বড় ছেঁড়াখোড়া। বদলে আসা উচিত ছিল। সন্ধেবেলা বদ্রিনাথ আসার আগে সে গা ধোয়, শাড়ি বদলায়। কোনও কোনও দিন কপালে একটা টিপও লাগায়।
‘বলল মানুষটা নাকি গর্তে পড়ে গেছে। সারারাত ধরেই নাকি পড়ে আছে।’
বদ্রিনাথ চাপা গলায় বললেন, ‘গর্তে! চাঁদু তোমাকে শুধু গর্তের কথা বলল?’
পুষ্প মুখ তুলল। বদ্রিনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গর্তই তো। গর্ত না?’
বদ্রিনাথ চুপ করে রইলেন। চারপাশে একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। দু’বার গলা খাঁকারি দিলেন। তারপর বললেন, ‘না গর্ত না। মাথা ঠান্ডা করে শোনো পুষ্প। তোমার স্বামী কাল রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরছিল। ফেরার সময় সে পুবদিকের জংলা বনবাদাড়ের রাস্তাটা ধরে। সময় কম লাগে ঠিকই, কিন্তু পথটা ভাল না। তুমি তো জানোই রাতে ওদিকটায় কেউ চট করে যেতে চায় না। আমি যতদূর খবর পেয়েছি, কাল অনেকেই হরিপদকে বারণ করেছিল। এমনকী ওই হারামজাদা চাঁদু পর্যন্ত। তোমার স্বামী শোনেনি। সে অন্ধকারেই হাঁটা দেয়। বলে, তার নাকি বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। ডাহা মিছে কথা। আসলে সবই নেশার লক্ষণ। সোজা কথায় মাতলামি। যাই হোক, গ্রামের প্রায় সকলেই ভুলে গেছি যে ওই বনবাদাড়ের মাঝখানে একটা পুরনো কুয়ো আছে। অনেকদিন আগের জিনিস। চারদিকের দেয়াল ভাঙতে ভাঙতে মাটির সঙ্গে জিনিসটা সমান হয়ে গেছে।’
‘কুয়ো!’ পুষ্প অস্ফুটে বলে।
বদ্রিনাথ মুখ তুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, কুয়ো। তবে ভয়ের কিছু নেই। কুয়ো শুকনে। হরিপদ কাল রাতে পথ ছেড়ে, নেশার ঘোরে গাছপালার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে যায় এবং ঝোপজঙ্গল ভেঙে সেই কুয়োর মধ্যে পড়ে। আজ খুব ভোরে কোন একটা ছোকরা ছাগল না গোরু চরাতে গিয়ে প্রথম দেখে। হরিণকে নয়, দেখে খানিকটা জায়গা জুড়ে ডালপালা ভাঙা। কাছে গিয়ে কুয়োর মুখটা আবিষ্কার করে এবং তখনই…।’
এত পর্যন্ত বলে বদ্রিনাথ থামলেন। আড়চোখে পুষ্পর দিকে তাকালেন। তিনি যেন তার কাছ থেকে প্রশ্ন আশা করছেন। পুষ্প কোনও প্রশ্ন করে না। বদ্রিনাথ, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। তারপর আবার শুরু করলেন।
‘তখনই গুনগুন করে গান শুনতে পায়।’
‘গান!’
পুষ্প চমকে মুখ তোলে।
বদ্রিনাথ শুকনো হাসেন বলেন, ‘গান মানে কি তার সেই গান? এমনি একটা সুরের মতো। অত নীচ থেকে আসছিল বলে ইকো হচ্ছিল। ইকো বোঝে? প্রতিধ্বনি। আসলে হরিপদর মদের খোঁয়ারি কাটেনি আর কী। কুয়োর গর্তে বসেও মাতলামি চলছে। যাই হোক, মাটির তলা থেকে গান আসছে শুনে সেই ছাগল চরানো ছোকরা খুবই ভয় পায়। সে ছুটতে ছুটতে গ্রামে ফিরে আসে। কয়েকজনকে বলে। ভাগ্য ভাল তার মধ্যে গণেশ ছিল। সে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেয়। আমি লোক পাঠাই। জানা যায় খবর ঠিক।’
আবার থামলেন বদ্রিনাথ। মনে হচ্ছে, ঘটনা বলতে বলতে তিনি ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছেন।
‘চিন্তা নেই পুষ্প। তোমার স্বামী ঠিক আছে। তারপর গণেশকে আমি পাঠিয়েছিলাম। সে নিজে দেখে এসেছে। কী রে গণেশ বল।’
পুষ্প গণেশের দিকে তাকাল। গণেশ হাত কচলে বলল, ‘আমার সঙ্গে কথাও হয়েছে।’
পুষ্প বিড়বিড় করে বলল, ‘কথা হয়েছে।’
গণেশ দু’পা এগিয়ে এসে বলল, ‘হ্যাঁ, কথা হয়েছে। গর্ত থেকে কথা তো, জড়িয়ে মড়িয়ে যাচ্ছিল। নিজের নাম বলল। বলল, কোনও সমস্যা নেই। খাবার চাইল।’
পুষ্প সামান্য নড়ে আবার খুঁটিতে হেলান দিয়ে স্থির হল। বদ্রিনাথ হাত তুলে গণেশকে থামালেন। তারপর ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘মন দিয়ে শোনো পুষ্প। তোমায় কিছু ভাবতে হবে না। আমি তোমার স্বামীকে গর্ত থেকে তুলে আনব। আমার সব ছকা হয়ে গেছে। তবে এমনি এমনি তুলব না। তুলব ঘটা করে।’
‘ঘটা করে!’
বদ্রিনাথ ঠোটের কোণে সামান্য হাসলেন।
‘হ্যাঁ। ঘটা করে। খবরটা পাওয়ার পরই আমার মাথায় পরিকল্পনাটা খোলে। কিছুদিন আগে কোথায় যেন একটা বাচ্চা গর্তে পড়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল না? বেশিদিন আগে নয়, এই তো সেদিন। জায়গাটার নাম এখন মনে পড়ছে না। তবে স্পষ্ট মনে আছে, টিভি, কাগজে ছবি, খবর, বিরাট হইচই হল। মিলিটারি, নেতা, মিনিস্টার, সাংবাদিক, সবাই সেখানে গিয়ে হাজির। তারপর ঢাকঢোল পিটিয়ে সেই ছেলেকে গর্ত থেকে বের করা হল। মনে পড়ছে তোমার? আমিও হরিপদকে নিয়ে তাই করব। বুঝতে পারছ?’
পুষ্প বুঝতে পারছে না। এসব সে কিছুই জানে না। টিভি, কাগজ থেকে সে অনেক অনেক দূরের মানুষ। শুধু সে লক্ষ করল, বদ্রিনাথ নামের মানুষটার চোখদুটো যেন কেমন হয়ে গেছে। স্থির, কিন্তু চকচকে। রাতেও এই লোকের চোখ চকচক করে। তবে সেটা অন্যরকম।
পুষ্প খানিকটা আপনমনেই বলল, ‘কী করবেন?’
বদ্রিনাথ এবার উঠে দাঁড়ালেন, ফিসফিস করে বললেন, ‘অতটা পারব না। তবে কিছুটা পারব। আশপাশের চার-পাঁচটা গ্রাম বদ্রিনাথের কেরামতি জানতে পারবে। ইলেকশনের আর বেশি দেরি নেই। এটা যদি করতে পারি আমার খুব সুবিধে হবে। খুবই সুবিধে হবে। পুষ্প, তোমার আপত্তি নেই তো? যতই হোক তুমি স্ত্রী। স্ত্রীর মত ছাড়া… বুঝতে পারছ তুমি?’
পুষ্প কিছু বুঝতে পারছে না। বুঝতে চাইছেও না। এই মুহূর্তে তার একটাই চিন্তা। গর্তের ভেতর মানুষটা কেমন আছে? ভাল আছে তো?
৩
ঝোপঝাড় কেটে জায়গাটা পরিষ্কার করার সময় একটা সাপ বের হল। নির্বিষ হেলে ধরনের সাপ। তাও কোনও ঝুঁকি নেওয়া হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ানো হয়েছে ভাল করে।
অন্য সব কাজ ভাগ করে দিলেও ভি আই পি আনার ব্যাপারটা বদ্রিনাথ নিজের হাতেই রেখেছেন। পঞ্চায়েতের সাতজন বড় চাঁই আসছে। বিডিও সাহেব ইতিমধ্যে লোক পাঠিয়েছেন। নিজে আসবেন আসল সময়। থানায় ওসি খানিকক্ষণ আগে এসে ঘটনাস্থল দেখে দু’জন পুলিশ পোস্টিং করে গেছেন। তাদের একজনের হাতে বন্দুক। বদ্রিনাথ এই অঞ্চলের তিন পার্টির নেতাকেই নেমন্তন্ন করে এসেছেন। তারা কখনওই একসঙ্গে কোনও অনুষ্ঠানে থাকে না। তবে এখানে তারা সকলেই আসছে। আশপাশের কয়েকটা স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। যদি কিছু ছাত্রছাত্রী পাঠানো যায়। শুভ কাজে ছাত্রছাত্রীরা থাকে। কোনও স্কুলই কথা দিতে পারেনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে ছেলেমেয়ে পাঠানো কঠিন। তবে কাদম্বরীদেবী গার্লস স্কুল একটা বড় দায়িত্ব নিয়েছে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই একটা বড় কাজ করা গেছে। সদরে লোক পাঠিয়ে স্থানীয় এক কাগজের রিপোর্টার এবং ফটোগ্রাফারকে ধরে আনা হয়েছে। তারা এখন আছে খগেনের বাড়িতে। ভাত মাংস খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। রিপোর্টার ছোকরার নাকি রোদে অ্যালার্জি। সে বলে দিয়েছে, রোদ না পড়লে বেরোবে না। কেব্ল চ্যানেলের লোকও আনার চেষ্টা চলছে। আজকাল টিভিতে না দেখালে প্রচার হয় না। কেব্লের লোকগুলো খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও আলাদা করে টাকা চাইছে। বলছে, গাড়ি করে নিয়ে গেলেও যাতায়াতের ভাড়া দিতে হবে। দরদাম চলছে। আশা করা যায়, বিকেলের আগেই একটা জায়গায় পৌঁছোনো যাবে।
সবথেকে বড় কাজটা বদ্রিনাথ করেছেন অতি গোপনে। কেউ জানে না। তিনি একজন মন্ত্রী ম্যানেজ করে ফেলেছেন। সম্পূর্ণ মন্ত্রী নয়, উপমন্ত্রী। তাতে কিছু এসে যায় না। গতকাল সদরে কী যেন সরকারি কাজে এসেছেন। রাতে ফিরে যাবেন। পার্টির সঙ্গে কথা বলে এক ঘণ্টার জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। মন্ত্রীমশাই প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। বিষয় শুনে রাজি হয়েছেন। তাঁর জন্য নতুন ধুতি পাঞ্জাবি এবং গরদের শালের ব্যবস্থা করেছেন বদ্রিনাথ। এটাই বদ্রিনাথের তুরুপের তাস। গর্ত থেকে হরিপদকে তোলার পর মন্ত্রী তাকে মালা পরাবেন।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ঠিক হয়েছে গর্ত থেকে হরিপদকে তুলে আনার পর ছোট। একটা অনুষ্ঠান হবে। গর্ত থেকে বেঁচে ফেরার সংবর্ধনা! এর জন্য ঝাপসা বটগাছের তলায় রং-চটা শামিয়ানা টাঙানো এবং চেয়ার পাতার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। প্রথম সারিতে মাত্র তিনটে চেয়ার থাকছে। মাঝখানে হরিপদকে রেখে দু’পাশে বসবেন বদ্রিনাথ আর মন্ত্রীমশাই। মেয়েদের গানের পর, দু’জনের অল্প একটু করে ভাষণ। শেষে বলবে হারপদ। বেশি নয়, দু’-একটা কথা বলবে। গর্তে থাকার ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো।
এদিকে খোদ হরিপদর দায়িত্বে আছে গণেশ। আর কাউকে ভরসা করতে পারেননি বদ্রিনাথ। গর্তের ভেতর থেকে লোকটাকে তুলে না আনা পর্যন্ত ঠিকঠাক রাখতে হবে। রাখাও হচ্ছে। ভাঙা কুয়োর মুখের চারপাশটা শুধু সাফ করা হয়নি, রঙিন কাগজের টুকরো দিয়ে সরস্বতী পুজোর কায়দায় চেন বানিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আড়াআড়িভাবে বাঁধা হয়েছে বাঁশ। বাঁশে সাদা রঙের চুনকাম। তাতে কপিকল লাগানো। কপিকলে বালতি ঝুলছে। সেই বালতি চেপে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাবার যাচ্ছে নীচে। সকালে ব্রেকফাস্ট গেছে। টোস্ট, মাখন আর সিদ্ধ ডিম। একটু আগে গেল টিফিন। চারটে গরম লুচি আর শুকনো আলুর দম। খাবারের তালিকা মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে। গাছের ডালে বাঁধা মাইকে তেমন জোর নেই। সম্ভবত ব্যাটারি কমে এসেছে। ফ্যাঁসফেঁসে আওয়াজে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। মাঝেমধ্যে গান থামিয়ে হচ্ছে ঘোষণা। সেই ঘোষণায় থাকছে, মন্ত্রী নেতাদের নাম। সমাজসেবী বদ্রিনাথের উদ্যোগ। কীভাবে তিনি গর্তে পড়া হরিপদ উদ্ধারে এগিয়ে এসেছেন, তার মর্মস্পর্শী বর্ণনা। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে গর্তে বসে থাকা হরিপদ সম্পর্কে তথ্যও গ্রামবাসীকে জানানো চলছে।
ইতিমধ্যে হরিপদর সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পদ্ধতি পুরনো দিনের হলেও খারাপ নয়। কাজ চলে যাচ্ছে। লম্বা পাইপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে একেবারে নীচ পর্যন্ত। কথা চলছে তার মধ্যে দিয়ে। হরিপদকে বালতিতে একটা ঘণ্টা পাঠানো হয়েছে। শিবমন্দিরের পুজোর ঘণ্টা। কিছু বলতে চাইলে সে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। কুয়োর দেয়ালে পাক। খেতে খেতে সেই ঘণ্টাধ্বনি ওপরে উঠে আসছে অস্পষ্ট অথচ গম্ভীর হয়ে। এর মানে, আমি কিছু বলতে চাই। কেউ এসে পাইপে কান পাতছে।
তবে হরিপদর সঙ্গে কথা বলার বিষয়ে সবাইকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বদ্রিনাথের কড়া আদেশ গণেশ আর হরিপদর বাড়ির লোক ছাড়া কুয়োর ধারে কাছে কেউ যেতে পারবে না। তার পরিকল্পনা হল, বিকেলে, উদ্ধারকার্যের আগে শুধুমাত্র বিশেষ কিছু অতিথিদের তিনি কুয়োর মুখে নিয়ে যাবেন। ইচ্ছে করলে তারা পাইপ মারফত হরিপদর সঙ্গে দু’-একটা কথা বলতে পারেন। আবার নাও বলতে পারেন। রিপোর্টার ছোকরা অবশ্য বলে রেখেছে সে এই অবস্থায় একটা ইন্টারভিউ চায়। গর্ত থেকে ইন্টারভিউ।
কুয়োর সামান্য দূরে মাটিতে শতরঞ্চি পেতে হরিপদর গোটা পরিবার বসে আছে।
গণেশ যখন দুপুরে ডাকতে এল পুষ্প বলেছিল, আমরা পরে যাই। এত আগে কী হবে?’
গণেশ বলে, ‘দাদা, আপনাদের এখনই যেতে বলেছে। বলেছে, ওখানে গিয়ে বসতে। কুয়োর পাশে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। লোকের ভিড় বাড়ছে।’
পুষ্প বিরক্ত হয়। ঘরে কাজ আছে। সব ফেলে গিয়ে এখন কুয়োর ধারে বসতে হবে! সে বলে, ‘লোক আসছে আসুক। আমাদের এখন যাওয়ার কী আছে?’
গণেশ রেগে যায়। বলে, ‘আমাকে কেন বলেন? দাদার অর্ডার। এত খরচাপাতি হচ্ছে, আয়োজন হচ্ছে, বাড়ির লোক সামনে না থাকলে কেমন দেখাবে?’
‘কেমন আবার দেখাবে? এতে দেখাদেখির কী আছে।’
‘আছে, সেন্টিমেন্টের একটা ব্যাপার আছে। বাড়ির লোেক বসে না থাকলে পাবলিকের মধ্যে সেটা থাকবে না।’
পুষ্প অবাক হয়ে বলে, ‘সেটা আবার কী?’
‘অত জানি না। আপনে ছেলেমেয়ে নিয়ে চলেন দেখি।’
শঙ্কু এবং বিনু দু’জনেই বসেছে মায়ের গা ঘেঁষে। তাদের সামনে কাচের প্লেটে দুটো করে রসগোল্লা এবং একটা করে শিঙাড়া। গেলাসে জল। শুধু রসগোল্লা শিঙাড়া নয়, বাবার গর্তে পড়ে যাওয়া উপলক্ষে ছেলেমেয়ে দুটির কপালে আজ নতুন জামাকাপড়ও জুটেছে। বাইরের অতিথিদের সামনে ছেড়া, ময়লা শার্ট প্যান্ট চলে না। সেই কারণে নতুন। বদ্রিনাথের লোকই কিনে এনেছে। শঙ্কু, বিনু সেগুলো পরেছে। সব মাপে মাপে হলেও শঙ্কর শার্ট বড় হয়েছে। একটু বেশি বড়। প্যান্ট ঢেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে শুধু শার্ট পরেছে। বিনু হাসাহাসি করায় পুষ্প শার্ট প্যান্টের ভেতর খুঁজে দিল।
পুষ্প শঙ্কুর কানে কানে কী বলল। শঙ্কু উঠে গিয়ে কুয়োর সামনে গেল। গণেশকে ইশারা করায় সে পাইপ এগিয়ে দেয়। শঙ্কু প্রথমে কথা বলে, তারপর কানে দিয়ে শোনে। ফিরে এসে মায়ের পাশে বসে৷ পুষ্প ছেলের দিকে তাকায়।
‘বলেছিস?’
‘হ্যাঁ, বলেছি।’
‘কী বলল?’
‘বলল, আলো লাগবে না। আলোতে চোখে কষ্ট হবে।’
পুষ্প মুখ নামিয়ে বলল, ‘ও। হতে পারে। এতক্ষণ অন্ধকারে আছে তো। আর কিছু বলল?’
শঙ্কু বলল, ‘হ্যাঁ, বলল।’
‘বলল তো বলছিস না কেন?’
‘তোমার কথা বলল।’
পুষ্প চমকে উঠল। বিনু-শঙ্কুর বাবা তার কথা কী বলল! লজ্জাও পেল কি? ঘোমটা ঠিক করতে করতে চারপাশে তাকাল। গলা নামিয়ে বলল, ‘আমার কথা! আমার কথা কী বলল?’
শঙ্কু খানিকটা আমতা আমতা করে। তারপর বলে, ‘বলল, তোর মায়ে কেমন আছে? কান্নাকাটি করতে বারণ করিস।’
‘কান্নাকাটি!’ পুষ্প অবাক হল। বলে কী মানুষটা! নীচে বসেও এইসব গিলছে নাকি? শঙ্কু ঠিক শুনেছে তো?
‘বলল তো তাই। আমি কী করব?’
‘আর? আর কিছু বলেছে?’
শঙ্কু বোনের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল।
‘বলেছে, মায়েরে ঠিক সময় খেয়ে নিতে বলিস। বেশি রাত যেন না করে। রাতে খেলে হজমের গোলমাল হয়।’
পুষ্প ঠোঁট বেঁকাল। ন্যাকা। এতদিন বউটা কেমন আছে একবারটির জন্য মনে পড়েন, আজ গর্তে বসে খুব মনে পড়ছে। এই মানুষটাকে আরও তিনদিন গর্তে ফেলে রাখা দরকার। যদি তার সে ক্ষমতা থাকত তা হলে তাই করত। তিনদিন গর্তে ফেলে রাখত।
বিনু তার দাদার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘অ্যাই দাদা, আমিও বাবার সঙ্গে কথা বলব।’
শঙ্কু গলা নামিয়ে বলল, ‘খবরদার যাস না বিনু। বাবা নামতা ধরছে। আমাকে বলল, সাত তেরোং কত হয় বল তো শঙ্কু। তুই কথা বললে তোকেও ধরবে। ট্রানস্লেশনও ধরতে পারে। আমার মনে হয়, গর্তে পড়ে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অ্যাই শিঙাড়া খাবি?’
এমন সময় মাইকে ঘোষণা শুরু হল—
‘আপনারা চিন্তা করবেন না। আমাদের সকলের প্রিয়, আমাদের গ্রামের গর্ব হরিপদ ভাল আছে। এইমাত্র তার সঙ্গে আমাদের প্রতিনিধি গণেশের কথা হয়েছে…। খবর শোনার জন্য সে একটা ট্রানজিস্টার রেডিয়ো চেয়ে পাঠিয়েছে। আমরা সেই রেডিয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি… দুপুরে তার জন্য যে খাবারের মেনু হয়েছে এইমাত্র সেটা আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে… সুক্ত, ভাজা মুগের ডাল, কাটা পোনা… আজ বিকাল ঠিক চার ঘটিকায় হরিপদকে গর্ত থেকে উদ্ধার করা হবে… আপনারা দলে দলে… ঠিক বিকাল চার ঘটিকায়…।
৪
চকদিহি গ্রামের কাছে কোনও ট্রেন লাইন নেই, তবু কোথা থেকে যেন মাঝেমধ্যে ট্রেন যাওয়ার শব্দ ভেসে আসে। গুম গুম গুম…। শীতের সময়তে এরকম হয়। রাত নিঃশব্দ হয়। দূর থেকে যেসব শব্দ আসার কথা নয়, তারাও আসে। চকিতে এসে চকিতেই মিলিয়ে যায়।
বদ্রিনাথ বসে আছেন তাঁর বাড়ির লাগোয়া অফিস ঘরে। টেবিলের ওপাশে গণেশ। গণেশের মাথা নিচু। সে কিছু ভাবছে। ভাবতে ভাবতে টেবিলের ওপর রাখা পেপারওয়েট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
বদ্রিনাথ মুখ তুলে ফিসফিস করলেন, ‘তুই পারবি?’
‘আপনি বললে পারব।’ গণেশ মুখ না তুলেই বলল।
‘ওখান থেকে সব সরানো হয়ে গেছে? মাইক চেয়ার, কপিকল?’
‘সব হয়নি। কিছুটা হয়েছে। বাকিটা কাল সকালে হবে।’
বদ্রিনাথ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘এখন ওখানে কে আছে?’
‘কেউ নেই। খগেনকে রাত দশটা পর্যন্ত রেখেছিলাম। তারপর তুলে নিয়েছি।’
বদ্রিনাথ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কুয়োর ভেতর থেকে খগেন কোনও আওয়াজ টাওয়াজ পেয়েছে?’
গণেশ চুপ করে রইল। বদ্রিনাথ আবার বললেন, ‘কোনও সাড়া শব্দ পায়নি?’
গণেশ বিড়বিড় করে বলল, ‘খগেন বলে গেল গানের মতো কী একটা শুনেছে। ভুলও হতে পারে।’
বদ্রিনাথ দাঁত চিপে বললেন, ‘হারামজাদা। আমার মুখ পুড়িয়ে, সর্বনাশ করে এখন গান গাইছে। এই ক্ষতি যে আমি কী করে মেকআপ করব, আমি জানি না। সামনে ইলেকশন…।’
কথাটা মিথ্যে নয়। আজ খুব বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে বদ্রিনাথের।
মন্ত্রী মশাইয়ের পোঁছোতে আধঘণ্টা মতো দেরি হয়। ঘটনাস্থলে না এসে তিনি সরাসরি চলে যান বাদ্রনাথের বাড়িতে। সেরকমই ব্যবস্থা ছিল। তিনি সাবান মেখে স্নান করেন। নতুন। ধুতি পাঞ্জাবি পরেন। দুধ ছাড়া চা খান। তারপর সন্ধের মুখে মুখে ঘটনাস্থলে আসেন। সবই অন্তত ছিল। একটা মানুষ তোলা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। ডবল খুঁটিতে কপিকল লাগানো হয়েছে। মোটা দড়ির একদিকে ঝুলছে বড় লোহার ড্রাম। পরিকল্পনা মতো এই ড্রামে চড়েই গর্ত থেকে উঠে আসবে হরিপদ। প্রথমে তাকে জড়িয়ে ধরবেন বদ্রিনাথ। কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরবেন। তারপর একে একে অতিথিরা তাকে ফুল মালায় বরণ করবেন।
গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে বন বাদাড়ের পাশে। ঘনঘন হাততালি। মুহুর্মুহু স্লোগান। বদ্রিনাথ জিন্দাবাদ… হরিপদ অমর রহে…।
স্কুলের মেয়েরা গান ধরেছে, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো…।’
বদ্রিনাথের ইঙ্গিতে ড্রাম নামিয়ে দেওয়া হল। স্লোগান, গান সব থেমে যায়। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে কুয়োর দিকে। এখনই গর্ত থেকে বেঁচে ফিরবে হরিপদ। ফিরবে।
পুষ্প চোখে আঁচল চাপা দেয়। শঙ্কু আর বিনু ভয়ে মায়ের হাত চেপে ধরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লোহার ড্রাম উঠে আসে। বদ্রিনাথ ছুটে যান। কিন্তু এ কী! হরিপদ কোথায়? ড্রাম যে খালি! কী ঘটল? কোনও গোলমাল? হরিপদকে তো পইপই করে সব বলে দিয়েছিল গণেশ। তবে?
মাটির গভীর অন্ধকার থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসে। গণেশ পাইপের কাছে ছুটে যায়। কান পাতে। হরিপদর কথা শোনে। নিজে কথা বলে। আবার কান পাতে। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর থমথমে মুখে এগিয়ে আসে বদ্রিনাথের কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে সে কী বলে শোনা যায় না। শুধু দেখা যায় বদ্রিনাথ দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছেন জীর্ণ, বাতিল কুয়োর দিকে।
বদ্রিনাথও পাইপে মুখ রেখে কথা বলেন। কান পেতে উত্তর শোনেন। তারপর পাইপ ছুড়ে ফেলে কুয়োর ওপর মুখ রেখে চিৎকার করে ওঠেন—
‘উঠবি না মানে? হারামজাদা। জুতিয়ে তোমার মুখ ছিড়ে দেব। ঠাট্টা হচ্ছে? রসিকতা? এতগুলো মানুষের সঙ্গে চ্যাংড়ামি করছ? এত খরচ, এত কিছু করার পর বলছ গর্তে থাকব। হারামজাদা, তোমার গর্তে থাকা বের করছি…। গর্তে তোমার কোন সুখ আছে শুয়োরের বাচ্চা?… বল, বল…।
দূরের মানুষগুলোও দেখতে পায় থরথর করে কাঁপছেন বদ্রিনাথ। শুধু কাঁপছেন না, মাথা নিচু এবার পাথরও খুঁজছেন। কুয়োর ভেতর ছুড়বেন নাকি?
মন্ত্রীমশাই এতক্ষণ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘটনা দেখছিলেন। এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে শান্ত গলায় সামনের মানুষগুলোকে বললেন, ‘চুপ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন আপনারা? এগিয়ে গিয়ে ধরুন। মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়বে যে। কুয়োয় পড়ে যাবে। ধরুন ওকে।’
গণেশ ছুটে যায়। ততক্ষণে কুয়োর কাছে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়েছেন বদ্রিনাথ।
ফেরার সময় গাড়িতে ওঠার আগে মন্ত্রীমশাই বদ্রিনাথকে কাছে ডাকলেন। বদ্রিনাথ ততক্ষণে অনেকটা শান্ত হয়েছেন।
‘বদ্রিনাথবাবু, লোকটা কিন্তু ডেঞ্জারাস। এমনি ডেঞ্জারাস না বেশি ডেঞ্জারাস। ওপরের থেকে গর্তে থাকাটা ভাল বলে বিচ্ছিরি একটা গোলমাল পাকিয়ে দিল। যাক চিন্তা করবেন না। দেখবেন, লোকটা কাল সকালেই বউ বাচ্চার কান্না শুনে সুড়সুড় করে ওপরে উঠে আসবে। কিন্তু তারপর? তারপর গর্তের গল্প শুরু করবে না তো? সেটাই চিন্তার। দেখুন পাগল টাগল বলে যদি ম্যানেজ করা যায়। গ্রামের দিকে নানা ধরনের পাগল থাকে। এ না হয় হবে গর্ত পাগল। যাক, সাবধানে থাকবেন। চট করে মাথা গরম করবেন না। মনে রাখবেন মাথা ঠান্ডাতে কাজ ভাল হয়। যাক, ধুতি উপহারের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। তবে ধুতির পাড়টা তত ভাল নয়। মনে হয় আপনাকে ঠকিয়েছে।’
মাথা ঠান্ডা করেই এখন কাজ করছেন বদ্রিনাথ। এত রাতে গণেশকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ‘লোকটাকে রাতে কিছু খেতে দেওয়া হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, খগেন কাগজে মুড়ে রুটি গুড় ফেলেছে।’
বদ্রিনাথ অল্প হাসলেন। নিষ্ঠুর হাসি। বললেন, ‘গুড়। খালি পেটে থাকলে ঘুমোত না। কাজে অসুবিধে হত।’
গণেশ সোজা হয়ে বসল। মুখ তুলে বলল, ‘ঘুম, জাগা কোনও কিছুতেই অসুবিধে হবে। না। প্রথমে প্লাস্টিক দিয়ে কুয়োর মুখটা ভাল করে ঢাকব। একটা না, পরপর দুটো প্লাস্টিক এনেছি। হাওয়া বাতাস ঢোকার ছিটে ফোঁটা পথ থাকবে না। তার ওপর দেব কাঠের পাটাতন। কিছু বোঝার আগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাবে। খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো-কুড়ি। ব্যস। তারপরেই ফিনিশ। কাল ভোরে গিয়ে সরিয়ে নিয়ে এলেই হবে। কোথাও কোনও প্রমাণ থাকবে না।’
বদ্রিনাথ চকচকে চোখে বললেন, ‘গণেশ, তুই নিশ্চিত হয়ে অন্য কোথাও দিয়ে ওই গর্তে হাওয়া ঢুকবে না?’
গণেশ একটু হাসে। বলে, ‘আমি নিশ্চিত।’
বদ্রিনাথ উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘গুড। তা হলে যা। আর দেরি করিস না। আমিও এখন বেরোব! পুষ্পর কাছে যাব।’
অনেকটা কান্নার পর আজ পুষ্প ঘুমিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ে দুটোও কেঁদেছে। কেন কাঁদছে তারা ভাল করে জানে না। মা কাঁদছে তাই কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
বদ্রিনাথ আসার পর ঘুম চোখেই পুষ্প ছেলেমেয়েদের কোলে করে পাশের ঘরে রেখে এল। ছিটিকিনি ছাড়াই রাখল। এত রাতে আর ছিটকিনি কীসের? ফিরে এসে খাটের চাদর বদলাল। ফিরোজা রঙের সুন্দর চাদর।
তারপর নগ্ন হয়ে এসে দাঁড়াল আধো জাগা আধো ঘুমের ঘোরে।
আর তখনই পুষ্পর শরীর থেকে গন্ধটা পেলেন বদ্রিনাথ।
একটা তীক্ষ সোঁদা গন্ধ। সেই গন্ধ যেন ধাক্কা মারল! ছিটকে সরে গেলেন বদ্রিনাথ। গা গুলিয়ে উঠল। বমি পাচ্ছে। বদ্রিনাথ দ্রুত খাট থেকে নামলেন। নগ্ন পুষ্পকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে, মুখে হাত চেপে ছুটে গেলেন ঘরের বাইরে। পুষ্প কি হাসল?
অন্ধকার দাওয়ায় উবু হয়ে বসে বমি করতে করতে বদ্রিনাথ গন্ধটা চিনতে পারলেন।
মাটির গন্ধ। অনেকদিনের ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কোনও গর্তের মাটি।
শারদীয়া কলাবৌ, ১৪১৪