চেয়ার
হ্যাটট্রিক হল। পরপর তিন দিন। শেষ ঘটনাটা ঘটে শনিবার। শনিবার রাতে। এক-একজন বাড়িওলা ভাড়া আদায়ের জন্য ভাড়াটেকে এক-এক রকম থেরাপি দেয়। গালমন্দের থেরাপি, জল বন্ধের থেরাপি, গুন্ডা লেলানোর থেরাপি। অবনী ঘোষালের থেরাপি হল ‘বসে থাকা থেরাপি’। তিনি ভাড়াটের বাড়ি গিয়ে বসে থাকেন। ভাড়ার কথা কিছু বলেন না, কোনও কথাই বলেন না। শুধু চুপ করে বসে থাকেন। চা দিলে ভাল, না দিলে ক্ষতি নেই। কিছু মনে করেন না। তবে উনি কোন সময় যাবেন সেটা নির্ভর করে কতদিন ভাড়া বাকি আছে তার ওপর। দিন যত বেশি হয় রাত তত বাড়ে। এমনও হয়েছে অবনী ঘোষাল রাত দেড়টার সময় গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। ভাড়াটে দরজা খোলার পর লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছেন, ‘এত রাতে এসে বিরক্ত করলাম। খারাপ লাগছে ভাই, খুবই খারাপ লাগছে। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। ঘুমোতে যান। আমি বরং কিছুক্ষণ বসি। অসুবিধে নেই। শুধু পাখাটা দয়া করে একটু ছেড়ে দেবেন ভাই। কী গরমটাই না পড়েছে।’
শনিবার সেই অবনী ঘোষাল এলেন। এলেন রাত ন’টার সামান্য পরে। গৌরী তখন রান্নাঘরে। দ্রুত হাতে রুটি বেলছে। মনের ভেতরে চাপা টেনশন। টেনশনের কারণে রুটির মাপে গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। গৌরীর এই এক অসুবিধে। রুটি বেলার সময় টেনশন হলে মাপে গোলমাল হয়। রুটি ছোট বড় হয়ে যায়। সেদিন গৌরীর টেনশন ছিল গ্যাস নিয়ে। যে-কোনও সময় গ্যাস ফুরিয়ে যেতে পারে। তিন দিন আগেই সিলিন্ডারের সময় পেরিয়ে গেছে। চাটুর তলায় আগুনের নীল শিখা দপ দপ করে সিগন্যাল দিচ্ছে। ‘ম্যাডাম, আমি চললাম, টা টা’ ধরনের সিগন্যাল। এই সিগন্যাল ফলস হতে পারে। হয়তো গৌরীর সঙ্গে মজা করছে। টানাটানির সংসারের সঙ্গে সবাই মজা করে। চাল, ডাল, তেল, গ্যাসের সিলিন্ডার— সবাই। গৌরী মনে মনে চাইছিল, এটাও মজা হোক। মজা হলে ভাল, নইলে বিপদ। এই মাসে নতুন গ্যাসের সিলিন্ডার আনার কোনও উপায় নেই। চাল, ডাল তাও ধার বাকিতে হয়, গ্যাস সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে এখনও ধার সিস্টেম চালু হয়নি। সেই কারণেই গৌরীর টেনশন। রুটিও হচ্ছিল ছোট-বড়। এমন সময় বাড়িওলা এলেন। তবে মানুষটা ঝামেলা পাকাননি একটুও। ভাড়া মাত্র দিন সাতেকের বকেয়া পড়েছে। সেই হিসেব কষে বারান্দার চেয়ারে মিনিট দশ বসলেন মাত্র। চা, জল কিছুই খেলেন না। তারপর ‘আচ্ছা, আজ চলি’ বলে উঠে পড়লেন।
আর তখনই ঝুম্পার নজরে পড়ে।
বারান্দায় কম পাওয়ারের হলুদ আলোতেই সে দেখতে পায়— অবনী ঘোষালের পাঞ্জাবি ছিঁড়েছে। ছিঁড়েছে কোমরের একটু ওপরে। তিন কি চার আঙুল ওপরে। ছেঁড়া খুব বড় নয়। মনে হচ্ছে কেউ নখ দিয়ে খাবলা মেরেছে। ছেঁড়া কাপড়ের চারপাশে বেরিয়ে এসেছে রোঁয়ার মতো সাদা সুতো। বারান্দার অল্প হাওয়ায় তারা উড়ছে। উড়ছে ফুরফুর করে। যেন ময়ূরের পেখম!
ঝুম্পা দরজা লাগিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে যায় রান্নাঘরে। মাকে ঘটনা বলে। গৌরী রুটি বেলা থামিয়ে চোখ বড় করে, ‘বলিস কী, আবার।’
‘হ্যাঁ মা আবার, এবার বেশ অনেকটা, এই এতখানি। চেয়ারের খোঁচে লাগলে যেমন হয়। এবারও বোধহয় পেরেক বা কাঠের টুকরোয় লেগেছে।’
গৌরী ভয়ে ভয়ে বলে, ‘দেখতে পায়নি তো?’
‘খেপেছ। ছিঁড়েছে তো পেছনে, দেখবে কী করে? বুড়োর পেছনে তো আর চোখ নেই। হি হি।’
গৌরী চিন্তিত মুখে বলল, ‘হাসিসনি ঝুম্পা। এই নিয়ে দু’দিন হল। ওই চেয়ারে জামাকাপড় ছিঁড়ল।’
ঝুম্পা ভুল ধরিয়ে বলল, ‘দু’দিন না মা, তিন দিন। পরপর তিন দিন হল। একেবারে হ্যাটট্রিক। একটা কাজ করব? চেয়ারটার গায়ে একটা কাগজ সেঁটে দেব? সেখানে লেখা থাকবে— সাবধান। সাবধান। সাবধান। এই চেয়ারে বিপদ আছে। জামাকাপড় ছিঁড়িলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নহে। হি হি। লিখব মা?’
আবার রুটিতে মন দিল গৌরী। কিন্তু মন পুরো বসছে না। বসবে কী করে। এ আবার কী অলুক্ষুনে কাণ্ড শুরু হয়েছে। রোজ রোজ মানুষের জামাকাপড় ছিঁড়ছে। ছি ছি। গৌরীর টেনশন বাড়ছে। সে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করল। নইলে সমস্যা। রুটির মাপে গোলমাল হলে শিবনাথ বিরক্ত হয়। গত মাসেই তো হল। ঝগড়াও হা এক প্রস্থ।
‘আবার তুমি ঝামেলা করেছ? এক-একটা রুটি এক-এক সাইজের। আগের তিনটে যেরকম ছিল, এটা তার থেকে বড়। একটু বড় নয়, বেশ বড়। ডবল না হোক, দেড়া তো বটেই। তুমি নিজেই দেখো।’
গৌরী জানে, ঘটনা সত্যি। তার মাথার ঠিক নেই। কয়েকটা দিন ধরে পাগল পাগল অবস্থা। এই অবস্থা নিয়ে রুটির মাপে যে গোলমাল হবে তার আর আশ্চর্য কী? কদিন পরেই মেয়ের মাধ্যমিক। সামনের সপ্তাহে ফি জমা দেওয়ার তারিখ। তার ওপর টেস্ট পেপার, পেন, পেনসিল, ক্লিপ লাগানো লেখার বোর্ড কিনতে হবে। সব থেকে বড় কথা হল, মেয়ের কোচিং-এর টাকা। এক মাসের নয়, তিন মাসের টাকা। কোচিংওলারা মহা বদ। অ্যাডভান্স না দিলে লাস্ট মিনিটের সাজেশন দেয় না। কিছু টাকা দেওয়া আছে। পুরোটা যায়নি। ইতিহাস আর অঙ্কের সাজেশন আটকে রেখেছে। পুরো পেমেন্ট হলে তবে দেবে। ইতিহাস নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু অঙ্কটা লাগবেই। মেয়ে অঙ্কে বিরাট গাধা হয়েছে। গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে অঙ্কে গাধা হলে সমস্যা। একবার ফেল মারলে বারবার ফেল মারতে থাকে। সুতরাং যে-কোনওভাবে বাকি টাকা জোগাড় করে সাজেশন আনতে হবে। অথচ তখনও মেয়ের বাবার বেতন হয়নি। এই অবস্থায় রুটি ছোট-বড় হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
স্বামীর বিরক্তি দেখে গৌরীর রাগ হয়। তবু সে নিজেকে শান্ত রাখে। ঠান্ডা গলায় বলে, ‘ও তোমার মনের ভুল। নাও হাত সরাও, তরকারি দিই। কুমড়ো কেমন হয়েছে? বাদাম দিয়েছি। কুমড়োতে বাদাম দিলে একটা চিংড়ি মাছের মতো গন্ধ হয়। গন্ধ হয়েছে কিনা। দেখো।’
গৌরীর কথায় কান না দিয়ে শিবনাথ হাত বাড়িয়ে বাটিতে রাখা রুটির গোছা তুলে ধরে। বলে, ‘নাও দেখো, মনের ভুল কিনা নিজেই দেখো। তাকিয়ে দেখো এক-একটা এক-একরকম সাইজের।’
ঝুম্পা সাধারণত খায় তার বাবার পাশে বসে। সেদিন বসেছিল উলটো দিকে। মায়ের কথামতো বাদামে চিংড়ি মাছের গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা করছিল সে। পাচ্ছিল না। না পাওয়ারই কথা। এগারো দিন হতে চলল এ বাড়িতে মাছ-মাংস ঢুকছে না। প্রথম দু’দিন স্টকে ডিম ছিল, এখন সেই স্টকও ফুরিয়েছে। ঝুম্পা নিশ্চিত, আর ক’টা দিন এভাবে চললে মাছ- মাংসের স্বাদ, গন্ধ সবই সে ভুলে যাবে। মনে হয় সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। চিংড়ি মাছ দিয়েই শুরু হয়েছে। গন্ধ ভুলে যাওয়ার বিষয়টা মাথায় আসতেই তার মজা লাগল। সে মুখ তুলে বলল, ‘বাবা, কম্পাস নিয়ে আসব? তুমি ব্যাসার্ধ মেপে মেপে দেখাবে রুটি ছোট-বড় হয়েছে কিনা!’
গৌরী নিজের মনে গজগজ করতে করতে বলে, ‘মাসের শেষ হতে চলল, এখনও মাইনে হল না। ঘরে একটা ফুটো কড়ি পর্যন্ত নেই। ওদিকে মেয়ের পরীক্ষা আর উনি বসে বসে গজ-ফিতে দিয়ে রুটি মাপছেন!’
শিবনাথ চুপ করে গিয়েছিল। না গিয়ে উপায় নেই। গৌরীর কথা মিথ্যে নয়। তখনও মাইনে হয়নি শিবনাথের। তার অফিসে বছরের মধ্যে অন্তত তিনবার এই ঘটনা ঘটে। ঠিক সময়ে বেতন হয় না। আসলে কোম্পানির অবস্থা খারাপ। পুরো খারাপ নয়। খানিকটা খারাপ। পুরো খারাপ হলে ল্যাটা চুকে যেত। কোনও কিছুই খানিকটা হওয়া ভাল নয়। গৌরীর বেশ মনে আছে, শিবনাথ চুপ করে গেলেও সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত সে একাই ঝগড়া করেছে। মাঝেমধ্যে কেঁদেছেও।
এই কারণেই গৌরী আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল রুটিতে মন বসাতে। ঝুম্পার কথাটা ঠিক। বাড়িওলাকে নিয়ে জামাকাপড় ছেঁড়ার ঘটনা তিনবার হল। প্রথম আক্রমণ ছিল শাড়ি। উমার শাড়ি। গোলগাল ফরসা সুন্দর দেখতে মেয়ে উমা। বয়স কম। পাশের ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে বিকেলে গৌরীর কাছে এসে শাশুড়ি-ননদের নিন্দে করে যায়। বৃহস্পতিবার এসেছিল জায়ের নামে বলতে। পরপর দু’কাপ চা খেল। উঠতে যাওয়ার সময় চেরা একটা আওয়াজ। কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ। গৌরী, উমা দু’জনেই সেই আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। আওয়াজ সন্ধান করতে দেখা গেল, উমার হাঁটুর পিছনে চেয়ার কামড় বসিয়েছে। ডান পায়ার পাশ থেকে মুখ বের করা পেরেক দামি শাড়ি ফালা করে দিয়েছে। প্রায় এক বিঘতের মতো কাপড় ঝুলছে। উমা কেঁদে ফেলে। শাড়ি জায়ের। গৌরীর মনে হচ্ছিল, লজ্জায় মাটিতে মিশে যায়। সমস্যা হল, লজ্জায় অনেক কিছু হয়, কিন্তু মাটিতে মিশে যাওয়া যায় না।
পরদিন চেয়ার আঁচড় বসাল বিশ্বনাথের জামায়। বিশ্বনাথ শিবনাথের কলিগ। শৌখিন মানুষ। বেতনে গোলমাল হলেও পরিপাটি করে চুল আঁচড়ায়। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামায়। রঙিন জামা পরে। সেদিন তার জামা অবশ্য রঙিন ছিল না। ছিল সাদা জামা। সেই সাদা জামার বাঁ কাঁধে বেতের ধারালো মুখ বিঁধল। একটা নয়, একসঙ্গে তিনটে মুখ। তিনটে আঙুলের মতো। উমার শাড়ি ছেঁড়ার শব্দ হয়েছিল, বিশ্বনাথের বেলায় ঘটনা ঘটল নিঃশব্দে।
রাতে খাওয়ার টেবিলে গৌরী বলল, ‘চেয়ারটা নিয়ে এবার একটা কিছু করো। ছি ছি। ভদ্রলোকের বাড়িতে এ কী কাণ্ড! রোজ রোজ মানুষের জামাকাপড় ছিঁড়ছে। ইস, মাগো, লজ্জায় মরে যাচ্ছি।’
শিবনাথ বলল,‘ওটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেই তো হয়। ঠিক আছে, কালই ঢুকিয়ে দেব।’
গৌরী মুখ তুলে বলল, ‘তারপর? ভাঙা চেয়ার না হয় লুকোলে, কিন্তু বাইরের কেউ এলে বসবে কোথায়? আমাদের কি সোফা পাতা ড্রইংরুম আছে? সে মুরোদও তোমার নেই। নতুন চেয়ার কেনার ক্ষমতাই নেই, তো সোফা।’ কথা শেষ করে গৌরী ‘ফুঃ’ ধরনের একটা আওয়াজ করে।
‘এখানে মুরোদের কী আছে? বাইরেই যে বসতে হবে তার কী মানে? ভেতরে এসে বসবে।’
গৌরী অবাক হয়। মানুষটা বলে কী? টাকাপয়সার চিন্তায় মাথাটা একেবারে গেল নাকি? ভেতরে বসবে মানে? ভেতর বলতে তো দেড়খানা মাত্র ঘর। বড়টায় তাদের দু’জনের শোওয়ার ব্যবস্থা। আর আদ্দেক যেটা, সেটা মেয়ের। সেও তো বড় হয়েছে। তারও তো একটা আলাদা জায়গা চাই। নাকি চাই না?
গৌরী খাওয়া থামিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘ভেতরে বসবে কোথায়? আমার খাটে? আর আমি কী করব? অতিথিকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাব? কোন গান শোনাব সেটাও বলে দাও।’
ঝুম্পা ‘হি হি’ আওয়াজে হেসে ওঠে। শিবনাথ তাড়াতাড়ি বলল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল রবিবার, দেখি কিছু একটা করা যাবে।’
গৌরী অবাক গলায় বলল, ‘রবিবার তো কী হয়েছে? সকালে বাড়ি বসে চেয়ারকে সহবত শেখাবে নাকি? বাবা-বাছা করে বোঝাবে?’ ঝুম্পা এবার হাসতে গিয়ে বিষম খায়। শিবনাথ থালা সরিয়ে উঠে পড়ে। না, অপমানের একটা সীমা আছে। এরা কি জানে না, হুট বলতে একটা জিনিস কেনা অত সহজ নয়? টাকা লাগে। জানে না? নাকি জেনেও না জানার ভান করছে?
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই শিবনাথ চেয়ার নিয়ে পড়ল। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, আজ একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়বে। এই ঘটনার শেষ দেখবে সে। ওই চেয়ারের সামনে, পেছনে, ওপরে, নীচে যেখানে যত দাঁত-নখ আছে, একটা একটা করে উপড়ে ফেলে তবে থামবে। স্ত্রীর অপমান, মেয়ের হাসি অনেক হয়েছে। আর নয়। এনাফ ইজ এনাফ।
ভাঙা চেয়ারের খোঁচ ওপড়ানোর জন্য শিবনাথ আয়োজন করল বিরাট। হাতুড়ি, সাঁড়াশি, স্ক্রুড্রাইভার, টর্চ। এই টর্চ সুইচ টিপলে জ্বলে না। থাবড়া দিয়ে জ্বালাতে হয়। তিন থাবড়ায় একবার জ্বলে। কাজে বসার আগে শিবনাথ মেয়ের কাছে সর্ষের তেল চাইল। খানিক পরে তেল ছাড়াই ফিরে এল ঝুম্পা। বলল, ‘মা জিজ্ঞেস করছে, চেয়ার সারাতে তেল কেন? তেল কি তুমি গায়ে মাখবে বাবা? চেয়ারের সঙ্গে কুস্তি লড়বে নাকি?’
রসিকতা গায়ে মাখল না শিবনাথ। তবে সত্যি তাকে কুস্তিই লড়তে হল। উলটে, পালটে, সোজা করে বেঁকিয়ে অনেক কসরত চলল চেয়ারের সঙ্গে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল, বিষয় অত সোজা নয়। হারামজাদা যেন চেয়ার নয়, আস্ত একটা শয়তান! তার সঙ্গে খেলছে। ভয়ংকর খেলা খেলছে! ছোট পেরেক, বেতের ধারালো মুখ, কাঠের মাথার খোঁচগুলো দেখতে দিচ্ছে না। হাতুড়ি তুললে গা ঢাকা দিচ্ছে পায়া হাতলের খাঁজে, মুখ লুকোচ্ছে বসার জায়গায় অথবা ব্যাক রেস্টের মাঝখানে। যে ক’টা দেখা যাচ্ছে তারাও সাঁড়াশি বাগালে ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে ফসকে পালাচ্ছে এদিক-ওদিক।
ঘেমে একশা হল শিবনাথ। তবু হাল ছাড়ল না। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে খোঁচগুলো সব টেনে, হিঁচড়ে, ভেঙে, মুচড়ে চেয়ার থেকে আলাদা করে ফেলল। তারপর টর্চ জ্বেলে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালাল কাঠ, বেতের আনাচে-কানাচে, ফাঁকফোকরে। আর নেই তো? না নেই। ঘাম মুছে হাঁপ ছাড়ল শিবনাথ। হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল মেঝেতে। চেয়ারের দিকে তাকিয়ে আপনমনেই হাসল। বিজয়ের হাসি। যাক, আজ থেকে মেয়েটা নিশ্চিন্তে এই চেয়ারে বসে পড়তে পারবে। কোনও ভয় নেই। সন্ধের পর বারান্দায় হাওয়া দেয়। পরীক্ষার আগে টাটকা হাওয়া শরীরের পক্ষে একটা উপকারি জিনিস।
শিবনাথ মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ওপড়ানো লোহার পেরেক, বেতের ধারালো মুখ, কাঠের টুকরো তুলতে লাগল একটা একটা করে। অতি যত্নে। ঝুম্পাকে দেখাতে হবে। আহা রে, মেয়েটা কতদিন তার গরিব বাবার কোনও কীর্তি দেখেনি।
তীক্ষ্ণ চিৎকারে বারান্দায় প্রথমে ছুটে যায় গৌরী, পরে শিবনাথ। রাত কত? দশটা? এগারোটা? নাকি আরও বেশি? বারান্দায় এসে শিবনাথ দেখল, রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার কিশোরী কন্যা। আতঙ্কে চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে তার। কাঁপছে। খুব সামান্য হলেও কাঁপছে সে। এক হাতে বই আর একটা হাত সালোয়ার-কামিজের ওড়নায়। ফিকে নীল সেই ওড়নার অন্য প্রান্ত আটকে আছে একটু দূরে। বেতের চেয়ারের হাতলে। শিবনাথের মনে হল, নিষ্প্রাণ চেয়ার যেন প্রাণ পেয়েছে। শয়তানের প্রাণ! কঠিন, নির্মমভাবে হাসছে। হাসতে হাসতে তীব্রভাবে ধরে রেখেছে ঝুম্পার ওড়না, ঝুম্পাকে, এমনকী তাদেরও!
ঝুম্পা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় ফিসফিস করে ওঠে।
‘ছাড়ছে না, ছাড়ছে না।’
আজকাল রবিবাসর, ১৩ মে ২০০৭