পোস্টম্যান
আমি মুখ তুলে লোকটার দিকে তাকালাম। চেহারার মধ্যে আলাদা কিছু নেই। পাড়াগাঁ থেকে কাজ করতে আসা আর পাঁচটা মুটে মজুরের মতো সাধারণ। বরং একটু বেশি রোগভোগা আর চিমসে মার্কা। কাদা মাখা গেঞ্জিটা গায়ের কালো রঙের সঙ্গে মিশে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, এখনই গর্ত থেকে উঠে এল।
লোকটা কি কুঁজো? নাকি এমনি-ই কুঁজো হয়ে দাড়িয়ে আছে? গ্রামের গরিব মানুষগুলোর এই এক অসুখ। শহরে এসে কুঁজো হয়ে যায়।
কানাইলাল বলল, ‘স্যার, এই সেই লোক।’
আমি জানি এই সেই লোক, তবু না বোঝার ভান করে ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কে? কোন লোক?’
কানাইলাল হাসি হাসি মুখে বলল, ‘ওই যে স্যার, ওদের সঙ্গে খবর দেয়া-নেয়া করে।’ আমি বললাম, ‘ও, হ্যাঁ এবার মনে পড়েছে।’
কথাটা মিথ্যে। মনে পড়েছে অনেক আগেই। গতকাল দুপুরে কানাইলাল যখন আমার কাছে গল্প করে, তখন থেকেই এই লোকের কথা আমার মাথায় ঘুরছে। কিন্তু সেকথা বলা যাবে না। বললে উদ্ভট জিনিসে গুরুত্ব দেওয়া হবে যাবে। কথাটা ছড়িয়ে যাবে। সবাই ভাববে আমিও ভুতুড়ে কাণ্ডে বিশ্বাস করে বসেছি। নইলে এত আগ্রহ কীসের?
বিশ্বাসের কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু আগ্রহ যে আমার একটা হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সামান্য একটা লেবার এরকম কথা বলে বেড়ালে আগ্রহ না হয়ে উপায় কী? অমি ঠিক করেছি, এই লোককে ডেকে জোর ধমক দেব। কাজের জায়গায় এসব জিনিস ঠিক নয়। ঘটনাটা শোনার পর থেকেই আমি চিন্তায় পড়েছি। কাল বাড়িতে ফিরে রত্নাকেও বললাম।
‘বলো কী!’ রত্না খাওয়া থামিয়ে দিল।
‘আমি কিছু বলছি না, কানাই বলছিল। কানাইলাল, আমাদের সাপ্লায়ার। লেবার সাপ্লাই করে।’
‘তুমি এই লোকটাকে দেখেছ?’
আমি মাথার কাছে হাত ঘুরিয়ে বললাম, ‘এখনও দেখিনি, নিশ্চয়ই মাথায় ক্র্যাক আছে।’
রত্না বলল, ‘পাগল?”
আমি চোখ বড় করে বললাম, ‘তা ছাড়া কী? পাগল না হলে কেউ এরকম কথা বলে? আর একটা জিনিসও হতে পারে।’
রত্না মুখের কাছে রুটি তুলে বলল, ‘সেটা কী?’
আমি ভাত খেলেও রত্না রাতে রুটি খায়। ডায়েট করে। ও মোটা নয়, তবু সারাক্ষণ ভয় পায়, এই বুঝি পেটে চর্বি জমে গেল। খাওয়া কন্ট্রোলে রাখে। আমিও রুটির চেষ্টা করেছি, সহ্য হয়নি। গ্যাসের সমস্যায় রাতে ঘুম ভেঙে যায়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আবার ভাতে ফিরেছি। আমি ভেতো বাঙালিই ভাল।
‘হাতে পারে লোকটা পাজি। ভূতপ্রেতের কথা ছড়িয়ে পয়সা কামানোর ধান্দা করছে। লোকটাকে দেখলে বুঝতে পারব।’
রত্না চেয়ারটা টেনে আমার দিকে একটু সরে এল। ফিসফিস করে বলল, ‘ও বাবা, ওই লোককে তুমি দেখবে!’
স্ত্রীর ভয় দেখে আমি হেসে ফেললাম। ভুরু তুলে বললাম, ‘ওমা দেখব না? হাতের কাছে এমন একটা মানুষ পেয়েছি, না দেখে ছেড়ে দেব? চাইলে তুমিও দেখতে পারো। ডাকব একদিন বাড়িতে?’
‘ওরে বাবাঃ। আমার দরকার নেই।’
আমি আরও জোরে হেসে উঠলাম। তবে মনের ভেতর দুশ্চিন্তাটা চেপে বসল। লোকটা এসব বলছে কেন? পয়সাকড়ির বিষয়টা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গরিব মানুষ রোজগারের জন্য কতরকম ফন্দি ফিকির বানায়। তবে এই লোকের ফন্দিটা একটু অন্যরকম। কানাইলালকে কাল জিজ্ঞেসও করেছি।
‘এসব রটিয়ে ওই লোক কি টাকাপয়সা কামাতে চায়?’
কানাইলাল মাথা চুলকে বলল, ‘না, স্যার সেরকম তো শুনিনি।’
‘তা হলে!’ আমি খানিকটা অবাক হই।
‘মনে হয় মজা করে।’ কানাইলাল হাসল।
‘এটা একটা মজা করার মতো জিনিস? মৃত মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা!’
কানাইলাল একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘দু’-একজন লেবার একটু ভয় পেয়েছে।’
আমি চেয়ার ঠেলে সোজা হয়ে বসলাম। কানাইলালের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘সে আবার কী? ভয় পেয়েছে। এরকম একটা পাগলামির কথা শুনে ভয় পেয়েছে!’
কানাই হাসল। বলল, ‘মুখ্যু সুখ্যু লেবার। একই সঙ্গে মজা পায়, আবার ভয়ও পায়। গরিব মানুষের কাছে ভয়টাও একটা মজার মতো।
আমি নড়েচড়ে বসলাম। কাজের জায়গায় এটা তো ঠিক নয়। দু’-একটা হাসি মশকরা হতে পারে, কিন্তু সিরিয়াস জিনিস কেন হবে? আমি মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললাম, ‘না কানাই, এটা ঠিক নয়।’
‘ভয় পেলে কী করব? ছেলেমানুষ তো কেউ নয়। মশকো জওয়ান সব মজুর।’
আমি বিরক্ত হলাম। বললাম, ‘কী আবার করবে, ডেকে ধমক দেবে। যে ভয় দেখাচ্ছে, তাকে ডেকে ধমক দেবে। শুধু তাই নয়, যারা ভয় পাচ্ছে তাদেরও বলতে হবে। এ একটা ভয় পাওয়ার মতো জায়গা হল? রাজারহাট তোমাদের গা ছমছমে পাড়াগাঁ নাকি যে, বাঁশবনে ভূত আসবে? এসব একদম বরদাস্ত করবে না কানাই। কোম্পানির বদনাম হয়ে যাবে। ঠিক আছে তোমাকে কিছু বলতে হবে না, কালই তোমার এই লোকটাকে আমার কাছে ধরে আনবে। যা বলার আমিই বলব।’
কানাইলাল মাথা নামিয়ে বলল, ‘তাই করব স্যার। আপনার কাছে ধরে আনব।’
আমাদের প্রজেক্ট চলছে রাজারহাটে। রাজারহাটে এখন যা হচ্ছে সম্ভবত তাকেই বলে কর্মযজ্ঞ। চারপাশে তৈরি হচ্ছে উঁচু উঁচু বাড়ি, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, শপিং মল, বাস টার্মিনামে। তবে আমাদের দিকটা এখনও ফাঁকা ফাঁকা। মানুষের যাতায়াত বলতে শুধু মিস্ত্রি মজুর। মাটি, বালি, ইট বোঝাই লরি ধুলো উড়িয়ে হেলেদুলে ছুটছে মাঠের ভেতর দিয়ে। আমার কোম্পানির অফিস হবে বত্রিশ তলা। আই টি পার্ক। শুনেছি, বারোতলার পর পরোটা শুধু কাচ। দেয়াল, ছাদ, মেঝে সব কাচের। হলে একটা দেখার মতো জিনিস হবে। তবে এখন সবে জমি টিন দিয়ে ঘিরে মাটি কাটার কাজ শুরু হয়েছে। আমি হলাম সেই মাটি কাটার সুপারভাইজার। কাজ হিসেবে খুবই সামান্য। রত্না অবশ্য বলে বেড়ায় তার স্বামী আই টি সেক্টরে কাজ করছে। আমি রাগ করি। কঠিন রাগ নয়, হালকা রাগ। কথাটা একেবারে মিথ্যে তো নয়। কাজ যা-ই হোক, জায়গাটা তো…। কোম্পানি আমার জন্য ব্যবস্থা খারাপ করেনি। ইটের গাঁথনি আর অ্যাসবেস্টসের চাল দিয়ে সাইট অফিস বানিয়ে দিয়েছে। অফিসের জানলা দরজায় পরদা। কম্পিউটারও দিয়েছে। তাতে হিসেব থাকে। মাটি কাটার হিসেব। কতটা মাটি উঠল, কাজ করছে ক’টা মেশিন, ক’জন মজুর লেগেছে— এইসব।
কানাইলাল হল আমাদের লেবার কন্ট্রাক্টর। অন্য মজুর নয়, শুধু মাটি কাটার মজুর সাপ্লাই করে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এ বিষয়ে তার একটা কোম্পানিও আছে! নাম ‘সয়েল অ্যান্ড কয়েল।’ আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এ আবার কীরকম নাম! সয়েল তো বুঝলাম, কয়েলটা কী?’ কানাইলাল লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘কোনও মানে নেই, এমনি দিয়েছি। সয়েলের সঙ্গে মিলিয়ে কয়েল। আজকাল জমি মাটির কারবারে সাহেবসুবো লোক আসে স্যার। একটা ইংলিশ নাম লাগে। নইলে ইজ্জত পাওয়া যায় না।’
নাম যা-ই হোক। সস্তায় মজুর সাপ্লাইতে কানাইলাল ইতিমধ্যেই নাম করেছে। এই লাইনে সকলেই মোটামুটি জানে, ‘সয়েল অ্যান্ড কয়েল’ থেকে লোক নিলে ঝুট ঝামেলা নেই।
শুধু এই ঝামেলাটা হল। একে কি ঝামেলা বলব?
গতকাল দুপুরে টিফিনের পর সাইটে চক্কর মারলাম। এই সময়টা কাজে একটা ভাঁটা পড়ে। লেবাররা কোদাল ঝুড়ি ফেলে খানিকক্ষণ গা ছেড়ে দেয়। একবার নিজে না ঘুরে দেখলে মুশকিল। শুধু কাজের জায়গা নয়, যে পাশটায় মিস্ত্রি মজুরদের থাকবার ছাউনি হয়েছে সেদিকটাও যেতে হয়। আয়োজন ছোট নয়, প্রায় শ’খানেক লোকের রাতদিন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। অফিসে ফেরার সময় কানাইলালকে ডেকে নিলাম। হেড অফিসে রিপোর্ট পতে হবে। কতটা কাজ এগোল তাই নিয়ে রিপোর্ট। প্রতি সোমবার করে মাটি কাটার শপ নিয়ে আমি কলকাতায় হেড অফিসে যাই। এখান থেকে দূর কম নয়। বড় রাস্তাতে পৌঁছোতে মাঠ, জল, কাদা মাড়াতে হয়।
কানাইলালের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হলাম। কাজ ভালই এগোচ্ছে।
‘তোমার লেবাররা এবার ভালই দেখছি কানাই। ফাঁকি টাকি মারে না। বর্ধমানে কাজটার সময় খুব ভুগিয়েছিল।’
কানাইলাল গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘ফাঁকিবাজগুলোকে সব তাড়িয়েছি স্যার। এই লট একেবারে এক্সপোর্ট কোয়ালিটি।’
আমি টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে বললাম, ‘ওরা বলে কী? পেমেন্টে খুশি তো।’
কানাইলাল হেসে বলল, ‘খুশি না হয়ে উপায় আছে? আপনার এখানে তো পাওনা বাকি কিছু থাকে না। সব একেবারে কারেন্ট। এদিকে স্যার এখানে একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।’
‘মজা!’ আমি মুখ তুললাম।
কানাইলাল হাসিমুখেই রয়েছে। বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, আমার এক লেবার অদ্ভুত কথা বলছে। ভুতের কথা।’
‘ভুতের কথা! সে আবার কী!’
কানাইলাল ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে দরজার দিকে তাকাল, তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘বলছে, সে নাকি মরা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।’
আমি ফাইল হাতে থমকে দাঁড়ালাম। ঠিক শুনলাম তো। কানাইলাল বলছেটা কী!
‘কী! কী করতে পারে বললে?’
কানাইলাল দাত বেবু করে হাসল। বলল, মরে যাওয়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কিছু খবর টবর দেওয়ার থাকলে পৌছে দেয় আবার নিয়েও আসে। এই যেমন এখানকার আত্মীয়স্বজন কেমন আছে। এদিককার খবরই বা কীরকম— এইসব। পোস্টম্যানের মতো।’
কথা শেষ করে ‘খ্যাঁক খ্যাঁক’ আওয়াজ করে আসল কানাইলাল।
আমি ধমক দিয়ে বললাম, ‘কী যা-তা বলছ? পাগল টাগল জোটালে নাকি?’
কানাই চেয়ারে হাত রেখে বলল, ‘তাই হবে স্যার। পাগলই হবে। লোকটা এবারই প্রথম আমার এখানে কাজ করছে। মমিতি এনেছে ওকে।’
‘মতিমতিটা আবার কে?’
‘মিতিমতি মাঝেমধ্যে গ্রাম দেশ থেকে আমার জন্য লোক ধরে আনে। এই পাগলটা ওর শ্বশুরবাড়ির দিকে কোথায় থাকত। গত মাসে নিয়ে এল। বলল, ছেলেরা বড়োকে বাড়ি থেকে বিদায় করেছে। কাজ পেলে খায়, নইলে চেয়েচিন্তে চলে। কাজ না দিলে মরে যাবে। বললাম, থাকুক। মাটি কাটতে তো বিরাট পণ্ডিত লাগবে না। এখন শুনেছি, এই কাণ্ড। তাও দু’দিন আগে শুনলাম, বেটা নাকি কয়েকজনকে এই কথা বলেছে।’
আমি আবার চেয়ারে বসে পড়লাম।
‘কী বলেছে?
‘বলেছে, তোমাদের যদি খবর টবর দেওয়ার থাকে বলোখন, অসুবিধে কিছু নাই। একজন নাকি তার শালাকে খবর পাঠিয়েছে। শালা গত বছর সাপের কামড়ে মরেছিল।’
আমি বুঝতে পারছি, আমার চোখ স্থির। পাতা কি পড়ছে? মনে হয় না পড়ছে। বিড়বিড় করে বললাম, ‘কী খবর?’
কানাইলাল ছোপ ধরা দাঁত বের করে বলল, ‘বাড়ি ঘরের খবর। চালা নাকি ভেঙে গিয়েছে। মরা শালার কাছ থেকে ঘর সারানোর পারমিশান নিয়েছে বেটা।’
কথাটা বলে আবার খানিকটা হাসল কানাই। তারপর বলল, ‘এই হারামজাদার দেখাদেখি, আরও দু’-একটা খেপেছে। কে যেন তার বাপ কেমন আছে জানতে চায় শশধরের কাছে। সে বুড়ো মরেছে তেরো বচ্ছর হয়ে গেল।’
‘শশধর! শশধরটা কে?’
‘শশধর ওই লোকের নাম স্যার। গুপি নামের এক মজুর তো মারাত্মক কাণ্ড করেছে। ছেলের সঙ্গে কথা বলবে বলে একেবারে ঝুললাঝুলি। ছেলে কলেরা না আন্ত্রিকে মরেছিল সাত বছর বয়েসে। তাও বছর তিন-চার হয়ে গিয়েছে। বুঝুন কাণ্ড! তিন বছর আগের মরা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে! শশধর বলেছে, কথা বলাতে পারব না, আমি শুধু খবর দেয়া-নেয়া পারি। খবর থাকলে বলো।’
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝতে পারছিলাম, এই জিনিস বন্ধ করতে হবে। গাঁজাখুরি গল্প খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়। এটাও ছড়াবে।
কানাইলাল বলল, ‘তবে শুধু মজা নয়, লেবারদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ও পাচ্ছে।’
এরপরই আমি কানাইলালকে জানাই, ওই লোকের সঙ্গে আমি দেখা করব। নিজে ধমক দেব।
কাল সারাদিন মনের ভেতরটা খচখচ করেছে। হেড অফিসে রিপোর্ট বলার সময় উলটোপালটাও হয়ে গেল। বাড়িতে ফিরে রত্নাকে গল্পটা করলাম।
‘বলো কী! লোকটা নিজেও ভূত নাকি?’
‘ভূত না হলেও শয়তান তো বটেই। টাকা পয়সা না চাইলে বুঝতে হবে অন্য কোনও ফন্দি আছে। এরপর হয়তো দেখব সাইটের ওখানে ভূত নামানোর পুজো টুজো বসিয়ে দিয়েছে। এর বাবা, ওর শ্বশুর, মরা কাকা-জ্যাঠারা সব সেখানে ভিড় করেছে।’
রত্না বলল, ‘ওরকম করে বোলো না, আমার কিন্তু ভয় ভয় করছে।’
আমি হেসে বললাম, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, কানাইয়ের হাতেই ব্যাপারটা পুরো ছেড়ে দেব। তারপর ভেবে দেখলাম, সেটা ঠিক হবে না। কড়া কোনও স্টেপ নেওয়া দরকার।’
রত্না কাঁপা গলায় বলল, ‘কী স্টেপ নেবে? যাই করো বাপু সাবধানে করবে। এসব লোক তন্ত্র মন্ত্র জানতে পারে। শ্মশানে এরকম তান্ত্রিক থাকে শুনেছি। বইতেও পড়েছি। মরা মানুষের খুলির সঙ্গে কথা বলে।’
আমি সামান্য হেসে বললাম, ‘আমার এটা শ্মশান নয় রত্না, প্রথমে ওয়ার্নিং দেব, তাতেও যাদ কাজ না দেয়, দূর করে দেব। আজকাল তাড়ানো খুব সহজ ব্যাপার। বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজারকে আজকাল ফুৎকারে তাড়িয়ে দেওয়া যায়, একটা সামান্য মজুরকে তো তুড়ি দিলেই হবে।’
কানাইলাল সেই লোককেই এখন এনেছে। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে।
নাম জানি তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ একটা কিছু দিয়ে তো কথা শুরু করতে হবে।
লোকটা চুপ করে রইল। কানাইলাল ধমক মেরে বলল, ‘কী রে নাম বল, চপ করে আছিস কেন? বল নাম।’
‘শশধর হুজুর।’ লোকটা জড়ানো গলায় বলল, মদ টদ খায় নাকি?
কানাইলাল দাঁত খিঁচুনি দিয়ে বলল, ‘পষ্ট করে বল।’
আমি হাত তুলে বললাম, ‘তুমি চুপ করো কানাই, ওকে বলতে দাও।’ তারপর সহজ গলায় বললাম, ‘শশধর, তুমি মাটি কাটো?’
‘হ্যাঁ হুজুর কাটি, তবে সবসময় পারি না।’
খেয়াল করে দেখলাম লোকটার চোয়াড়ে মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়িও আছে। বয়স একেবারে কম নয়। চাউনির মধ্যে একটা ফ্যালফ্যালে ভাব। একেই কি ইংরিজেতে বলে ভেকেন্ট লুক?’
‘হুজুর বাঁ হাতের এইখানটা ভেঙেছিল, তারপর থেকে অনেকক্ষণ কোদাল ধরলে ব্যথা পাই।’
শুধু পাগল নয়, লোকটা অকর্মণ্যও বটে। কানাই এটাকে জোটাল কেন কে জানে? এর সঙ্গে বেশি বকবক না করে সরাসরি আসল কথাতেই যাওয়া ভাল।
‘শশধর তোমার নামে যা শুনেছি সেটা কি সত্যি তুমি কি সত্যি মৃত মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো?’
শশধর চুপ করে রইল। ভেবেছিলাম, লোকটা লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলবে। অন্যায় কাজ ধরা পড়ে যাওয়ার পর সাধারণত সবাই যা করে। এও সেরকম কিছু করল না। একই ভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কানাইলাল ফিসফিস করে বলল, ‘কী রে বল? স্যার যা জিজ্ঞেস করছে জবাব দিবি তো।’
আমি আবার হাত তুলে কানাইলালকে থামালাম। নরম গলায় বললাম, ‘কথাটা ঠিক?’
শশধর এবারও মুখে উত্তর দিল না। শুধু একপাশে ঘাড় নাড়ল। লোকটা বলে কী! পারে! আমি ভেবেছিলাম, এসব জিজ্ঞেস করলেই পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কাজ যাতে না যায় তার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। এ তো উলটো কাও। আমি নড়েচড়ে বসলাম। মজা পাচ্ছি। একটু হেসে বললাম, ‘কীভাবে করো? নাম ধরে ডালে? মনে মনে? নাকি রাতের বেলায় ফাঁকা মাঠে হাঁক দাও?’
শশধর আমার রসিকতা ধরতে পারল না। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি মাটিতে বলি, ওরা শুনতে পায়।’
‘মাটিতে বলো!’ একটু চমকালাম কি?
‘হ্যাঁ, যখন কাজ করি তখন বলি। বলতে বলতে একসময় সাড়া পাই। মাটি দিয়ে কাজ করি তো, তাই মাটি দিয়ে ডাকি।’
লোকটা সত্যি উন্মাদ। আমি কানাইলালের মুখের দিকে তাকালাম। তার ভুরু কোঁচকানো। মুখে টেপা হাসি। ভাবটা এমন— দেখলেন তো স্যার, বলেছিলাম কি না? এখন কী করা উচিত। জোর এক ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিই?’
ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘কীভাবে ডাকো? তোমার আশেপাশে যারা কাজ করে, তারা শুনতে পায়?’
‘না পায় না। আপনে ধরেন কাউরে কিছু জানাতে চান, আমারে নামটা আর খবরটা বললেন, আমি তারে ডেকে চুপিচুপি কথাটা বলে দিই।’
‘বলে দাও! ডেডম্যান, মানে মরা মানুষকে তুমি দেখতে পাও শশধর?’
‘না পাই না, বুঝতে পারি। এলে মাটিতে কাঁপুনি লাগে। জোরে নয়, অতি সামান্য কাঁপুনি। ওই কাঁপুনির মধ্যে গলাও শুনতে পাই।’
কানাইলাল আর পারে না। ডান হাতটা তুলে বলে ‘চোপ, একদম চোপ হতভাগা। গল্প বানানোর জায়গা পাওনি। ইঃ কাঁপুনি লাগে! ফাজিলটার কানের গোড়ায় দেব এক ঘা।’
আমি কানাইলালের ধমকে গুরুত্ব দিলাম না। বুঝতে পারছি, কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে। বেশি কথা মানে মানসিক রোগগ্রস্ত এই মানুষটাকে আশকারা দেওয়া। সেটা ঠিক নয়। আমার উচিত এখনই এই লোকের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করা। একজন সামান্য মজুরের সঙ্গে ভূত বিষয়ক দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে না।
কিন্তু থামতে পারছি না। এতক্ষণ যে ঘটনা শুধু আগ্রহ তৈরি করেছিল, মজা দিচ্ছিল, সেটাই ক্রমশ আমার ভেতরে কেমন যেন দাঁত নখ বের করে চেপে বসছে!
‘মরা মানুষের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা তুমি কবে থেকে পেয়েছ শশধর? জন্ম থেকে?’
কানাইয়ের ধমকে এই লোকের চোখের চেহারা বদলেছে। এতক্ষণ ফ্যালফ্যালে ছিল, এবার খানিকটা ভয়ের ভাব এসেছে। বুকের কাছে হাতদুটো জড়সড় রেখে বলল, ‘জানিনে হুজুর। আঞ্জু বুড়ির মেয়েকে অপর দিতে গিয়ে দেখলাম আমি কাজটা পারছি।’
‘আঞ্জু বুড়ি! সে আবার কে?’ আমি টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে পড়লাম।
‘আমাদের গাঁয়ের মানুষ। একদিন বিকেলে দেখি পথের ধারে বসে হাঁপায়। বুকটা হাপরের মতো ওঠে আর নামে। ওঠে আর নামে। আমি বললুম, কী হল গো বুড়িমা? বুড়ি চোখ উলটে বললে, মেয়েটাকে একটা খপর দে বাবা, বল আমি আসছি। আমি খপর দিলুম, বুড়ি ও মরল সন্ধের পরপর।’
‘খবর দিলে মানে? বাড়ি থেকে মেয়েকে ডেকে আনলে?’
‘ডেকে আনব কী হুজুর, বুড়ির তো বাড়ি ঘর কিছু নাই। একটা মাত্র মেয়ে ছিল, সেও পাঁচ বছর আগে বাচ্চা হতে গিয়ে শ্বশুরবাড়িতে মরেছে। মুক্তি না লক্ষ্মী—কী যেন নাম ছিল তার। পথের ধারে বসে ওই মরা মেয়েকেই, খপর দিলুম।’।
লোকটা বানাচ্ছে। গল্প বানাচ্ছে। কিন্তু বানানোর ক্ষমতাটাও দারুণ। গল্পটা থেকে চট করে বেরোতে পারা যায় না। আমাকেই ধরে ফেলেছে, মিস্ত্রি মজুরদের ধাঁধায় ফেলতে কতক্ষণ?
‘কী খবর?’
কানাইলাল এবার এগিয়ে এসে শশধরের কাঁধে হাত রাখল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘ব্যস অনেক হয়েছে, অনেক হয়েছে, ভূত, পেতনি, ব্ৰহ্মদত্তি সব শুনলাম। এবার কাজে যাও তো বাপু, স্যারেরও কাজ আছে, নাকি সারাদিন তোমার বকককানি শুনলে হবে? যা ভাগ।’
মাঝপথে আটকাতে আমি বিরক্ত হলাম। কানাইলালকে ঝাঁঝালো গলায় বললাম, ‘আঃ কানাই, চুপ করো। আমার কথার মধ্যে বারবার ঢুকছ কেন?’ তারপর শশধরের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় বললাম, ‘মরা মেয়েকে কী খবর দিলে?’
শশধর ভয় পেয়েছে। কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘আমি আসি হুজুর। আমায় ছেড়ে দেন।’
আমি ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা অনুভব করছি। ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘কথা শেষ করে যাও শশধর। বুড়ির মরা মেয়েকে কী খবর পাঠালে সেটা বলে যাও।’
‘কী আর বলব? বললুম, ঘরদোর ধোওয়া মোছা করো, জল তুলে রাখো, তোমার কাছে তোমার মায়ে যায়।’
আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘ওই লক্ষ্মী না মুক্তি শুনতে পেল?’
শশধর খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাটিতে কাঁপন পেলাম হুজুর। তারপর থেকেই…।’
আমার গা কি একটু শিউরে উঠল? না মনে হয়। কী করে হবে? কেনই বা হবে? আমি তো আর ভয় পাইনি। টেবিলে রাখা জলের গেলাস তুলে এক চুমুকে শেষ করলাম। যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। শুধু গল্প বলা নয়, এই লোকের অভিনয় ক্ষমতাও চমৎকার। কত স্মার্ট ভঙ্গিতে একটা অলৌকিক বিষয়কে সত্যি বলে চালানোর চেষ্টা করছে! এরকম একটা কড়কড়ে রোদের সকালে ভূতের গল্প ফাঁদা চাট্টিখানি কথা নয়। এই লোক সেটা খানিকটা হলেও পেরেছে। ধাপ্পাবাজদের মধ্যে এই গুণ অবশ্য প্রায় দেখা যায়। তারা অভিনয়ও ভাল করে। সমস্যা হল, কথা শুনে এই আধবুড়ো লোকটাকে সেরকম মনে হচ্ছে না। সম্ভবত এই কারণেই অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে।
একটা কাজ করলে কেমন হয়? বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে? হোক। লোকটা কতখানি গোলমেলে সেটা বোঝা যাবে। জালিয়াত, পাগল— সবকিছুরই তো একটা মাত্রা আছে। এই লোকের সেই মাত্রাটা কতখানি? নিজের ইন্টারেস্টই জানা দরকার। একটা মজাও হবে। রত্নাকে বাড়িতে গিয়ে যখন বলব, ভয় পাবে। কিন্তু তার আগে কানাইলালকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া দরকার। এ কথা ওর সামনে বলা যায় না।
‘কানাই গত সপ্তাহের রিপোর্টটা আছে নাকি?’
‘আমার ব্যাগে আছে স্যার। ব্যাগটা বাইরে।’
‘চট করে নিয়ে এসো দেখি। ততক্ষণে তোমার শশধরের সঙ্গে কথা শেষ করি।’
কানাইলাল ইতস্তত করল। আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই।
‘যাও, দেরি করছ কেন?’
কানাইলাল আমার বিরক্তি বুঝতে পারে, খানিকটা যেন অবাক হয়ে ঘর ছাড়ল সে। মুহূর্ত কয়েক নিজের মনে কথাটা সাজিয়ে নিয়ে সরাসরি তাকালাম লোকটার দিকে।
‘আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?’
মাথা নামিয়ে আছে শশধর। একা ঘরে তাকে যেন এবার একটু অন্যরকম লাগছে। সে কি বেলা বাড়ছে বলে? বেলা বাড়লে মানুষের কি চেহারা বদলায়?
‘চেষ্টা করব হুজুর।’
আমি চেয়ারটা সামান্য পিছনে ঠেলে নিলাম। তারপর খানিকটা আপন মনেই বলতে থাকি—
‘মেয়েটার ভাল নাম মালবিকা। আমরা মালা ডাকতাম। কলেজের ফার্স্ট না সেকেন্ড ইয়ার চলছে, তা প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছর আগের ঘটনা। বলা নেই কওয়া নেই, একদিন কলেজে গিয়ে শুনি মালা গলায় দড়ি দিয়েছে।’
এতটা পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলাম।
‘কী খপর বলব হুজুর।’
‘না না খবর কিছু বলতে হবে না… শুধু জিজ্ঞেস করবে, জিজ্ঞেস করবে কেন এরকম করেছিল সে… বলবে আমি জানতে চেয়েছি…। পারবে?’
প্রশ্নটা শেষ করে ঠোঁটে ঠাট্টার হাসি এনে মুখ তুলে তাকাই। তাকিয়ে চমকে উঠি। কুঁজো মানুষটা একদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। চোখদুটো যেন মানুষের নয়। মাটির চোখ! মাটির দৃষ্টি! সেই দৃষ্টি তীব্র, তীক্ষ্ণ সুচের মতো আমার গভীর পর্যন্ত গেঁথে, কেটে দেখতে দেখতে চলেছে!
রাতে খেতে বসে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে উঠে পড়লাম। রত্না বলল, ‘শরীর খারাপ।’ ‘খারাপ নয়, একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কে জানে গ্যাসের প্রবলেমটা ফিরে এল হয়তো?’
‘ওষুধ খাবে?’
‘দেখি, রাতে দরকার হলে খাব।’
বিয়ের পর থেকেই দেখছি রত্না খাবার সময় চিবোয় বেশি। প্রথম প্রথম ভাবতাম হজমের জন্য করে। পরে শুনলাম, শুধু তাই নয়, এতে নাকি দাঁতের সেটিং ভাল থাকে। চিবোতে চিবোতেই রত্না বলল, ‘সেই লোকটার সঙ্গে দেখা হয়েছে? ডেকেছিলে তাকে?’
আমি চমকে ফিরে তাকালাম, রত্নার মনে আছে! |
‘কোন লোক?’
রত্না হেসে বলল, ‘বাঃ ওই যে ভূতের সঙ্গে কথা বলতে পারে, তোমাদের মাটি কাটার লেবার? ডাকোনি তাকে?’
আমি মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, ‘খেপেছ? কাজের জায়গায় পাগলামির সময় কোথায়? কোথা থেকে একটা চিটার ধরে এনেছে কানাই বেটা।’
রত্না বলল, ‘ওরকমভাবে বলছ কেন? গরিব মানুষ, অভাবে যে কত কী করে তার ঠিক আছে? মরা মানুষের সঙ্গে কথা বলা তো সহজ কাজ, আমাদের কোন্নগর স্টেশনে একটা জোয়ান লোক মরা সেজে পড়ে থাকত। পাশে ছেলে, বড় ভিক্ষে করত। পোড়ানোর খরচ চাই।’
আমি গজগজ করে উঠলাম, ‘ওসব ফাজলামি তোমার কোন্নগর স্টেশনে হতে পারে রত্না, আমার প্রজেক্টের ওখানে চলতে পারে না। হেড অফিসে যদি খবরটা পৌছোয় আমার অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখেছ? আই টি পার্কে ভূত! ছি ছি।’
রত্না অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, ‘আমার ওপর রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কী করলাম?’
নিজেকে দ্রুত সামলালাম। সত্যি তো, রেগে যাচ্ছি কেন? আর রাগ করলে নিজের ওপর করা উচিত। এই জালিয়াতটাকে হুট করে মালবিকার কথাটা বলা উচিত হয়নি। কোনও কিছুই বলা উচিত হয়নি। আর যদি বলতেই হয়, মরা লোকের কি অভাব ছিল? দাদু, মামা কাকা যে কারও কথা বলতে পারতাম। মালা কে? হু ইজ মালা? তাকে কতটুকু চিনতাম? কিছুই নয়। দু’পাঁচ দিন তার সঙ্গে ঘুরেছি মানে এই নয় এত বছর পরেও তার কথা মনে পড়বে। হঠাৎ মালবিকার কথা মানেই বা পড়ল কেন!
খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও ওই লোক কি আমাকে প্রভাবিত করেছে?
ফ্ল্যাটের একফালি বারান্দায় এসে দ্রুত হাতে নম্বর টিপলাম। মোবাইলের ছোট্টো পরদায় ভেসে উঠল—সয়েল অ্যান্ড কয়েল।
‘হ্যালো কানাইলাল? ঘুমিয়ে পড়েছ?’
স্কুটারটা গড়বড় করছিল। গ্যারেজে দেখিয়ে সাইটে আসতে খানিকটা দেরি হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে কম্পিউটার চালু করলাম। কানাইলাল ঢুকল প্রায় আমার পিছু পিছু। মুখে হাসি।
‘ভূতটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি স্যার।’
আমি মুখ তুললাম, কানাই দাঁত বের করেই আছে। সেই অবস্থাতেই বলল, ‘আপনার অর্ডার মতো আজ ভোরেই পাওনা গা বুঝিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি। বললুম বাছা, ভূতগিরি এখানে চলবে না। মাটি কাটা ছেড়ে তুমি বরং কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পোস্টম্যান হয়ে যাও। মরা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিঠি দেওয়া নেওয়া করো। সামান্য কন্মে তোমায় মানাবে না।’
কথা শেষ করে ‘হ্যা হ্যা’ করে হাসতে লাগল কানাইলাল।
‘মতি হারামজাদাকেও ধমকে দিয়েছি স্যার, বলেছি, ভবিষ্যতে এরকম পাগল ছাগল নিয়ে এলে তারও বিপদ আছে। সব সহ্য করব কিন্তু সয়েল এ্যান্ড কয়েলের বদনাম সহ্য করব না।’
আমি মাউসে ক্লিক করে চোখের সামনে মাটির হিসেব খুললাম। নিচু গলায় বললাম, ‘শশধর কিছু বলল?’
‘বলবে আবার কী? চুপচাপ পোঁটলা পুঁটুলি গুছিয়ে নিল। ও হ্যাঁ, আপনাকে জানানোর জন্য শুধু একটা কথা বলেছে স্যার।’
‘কী বলেছে?’
‘স্যার, মালা না মালবিকা কী যেন নাম বলল, ইস নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। যাই হোক, সেই মহিলা নাকি আপনাকে বলে পাঠিয়েছে…।’
কথাটা শেষ করে কানাইলাল মুচকি হাসল। নিচু গলায় বলল, ‘ভূতটুও নাকি স্যার?’
বাড়ি ফিরলাম তাড়শ জ্বর নিয়ে।
প্রতিদিন রোববার, ৬ জুলাই ২০০৮