মূর্তি
বটুকেশ্বর মাইতির মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি বিরক্ত। ভুরু কুঁচকে আছে। নাকের পাটা ফোলা। নাকের পাটা ফোলার অর্থ শুধু বিরক্ত নয়, মানুষটা রেগেও আছে।
ল’অব লিডার্স বলে একটা জিনিস আছে। নেতাদের নিয়ম। সেই নিয়মে নেতারা যেমন চট করে মনের কথা বলতে পারেন না, তেমন ফট করে মনের ভাব মুখে ফোটাতে পারেন না। কোনও কারণে মেজাজ খিঁচড়ে থাকলে তাঁদের থাকতে হয় হাসি হাসি। আবার উলটোটাও হয়। মন ভাল থাকলেও ভাব করতে হয় নিকট আত্মীয় মরণাপন্ন। এখনই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে। সব মিটিং বাতিল।
বটুকেশ্বর মাইতি নেতা, কিন্তু পুরোপুরি নেতা নন। কারণ তাঁর দল বাছাই এখনও ফাইনাল হয়নি। ‘ওয়াচ অ্যান্ড সি’ পর্যায়ে রয়েছে। ‘ওয়াচ অ্যান্ড সি’ পর্যায় জটিল ধরনের একটা পর্যায়। এই পর্যায়ে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। বটুকের মাইতিও আছেন। তিনি রোজই নানা ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছেন। সেখানে পথ অবরোধ, বাস পোড়ানো, পুলিশ পেটানো যেমন রাখতে হচ্ছে, তেমনি আবার অবরোধের প্রতিবাদ, বাস পোড়ানোর নিন্দা, পুলিশ পেটানোর ধিক্কারও থাকছে। পক্ষে মিছিল ডাকলে, বিপক্ষে মিটিং করতে হচ্ছে। বিষয় খুবই জটিল। কিন্তু উপায় কী? শেষ পর্যন্ত কোনটা গিয়ে দাঁড়াবে এখনই বলা সম্ভব না। একটাই ভাল লক্ষণ নাম, বদনাম দুটোই বাড়ছে। এখন হুটোপাটির সময় নয়। কোমরের বেল্ট টাইট করে বাঁধবার সময়। কথা অনেক দিকেই চলছে। ফিলার আসছে। নানা ধরনের প্রস্তাব। বটুকেশ্বর হ্যাঁ-ও বলছেন না, না-ও বলছেন না। আর একটু সময় যাক। যতই বিরক্ত মুখে বসে থাক বটুকেশ্বর মাইতির মন এখন ফুরফুরে থাকবার কথা।
ফুরফুরেই আছে। একটু ফুরফুরে নয়, বেশি ফুরফুরে।
সকালের দিকটায় বটুকেশ্বর মাইতি চা খান না। তিন খান দুধ। প্রতিদিন সকালে বড় এক গ্লাস দুধ নিয়ে দর্শনার্থীদের মুখোমখি হন। অনেকটা সময় ধরে আলতো আলতো চুমুক দিয়ে সেই দুধ খেতে থাকেন। শিশুর মতো তার ঠোঁটের ওপর দুধের রেখা পড়ে। সেই রেখা তিনি।মোছেন না। ইচ্ছে করেই ‘দুধের শিশু’ ভাবটা ধরে রাখেন। তবে গ্লাস শেষ হয়ে গেলে আর এক মুহূর্ত দর্শনার্থীদের ঘরে থাকার অনুমতি নেই। শত অনুনয়-বিনয় করলেও নেই। ছেলেপিলেরা ঘর ফাঁকা করে দেয়। কারণ পাবলিক মিটিং-এর পর বটুকেশ্বর মাইতিকে করতে হয় স্পেশাল মিটিং। বিশেষ বিশেষ লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এই কারণে শেষের দিকে আসা দর্শনার্থীরা থাকেন টেনশনে। তাঁরা ঘড়ির বদলে ঘনঘন বুটুকেশ্বরবাবুর গ্লাসের দিকে তাকান। বালি-ঘড়ির মতো দুধ-ঘড়ি। দুধ শেষ হতে কত বাকি? শেষ হওয়ার আগে তাঁর পালা আসবে কি? নাকি আসবে না? কেউ আবার মনে মনে দুধের দেবতাকেও ডাকডাকি শুরু করে দেন। দুধ দেবতার নাম জানা না থাকার কারণে একটু অসুবিধা হয়। নাম করে ডাকা যায় না।
‘ঠাকুর, ঠাকুর গো, তুমি ফুরিয়ে যেয়ো না ঠাকুর। গত সপ্তাহে আমার চান্স আসার ঠিক মুখে মুখে তুমি চলে গেলে। আজ একটিবারের জন্য মুখ তুলে তাকাও। শালার চাকরির কথাটা বলতে দাও। আজও যদি না পারি, বাড়ি ফিরে বউয়ের ধ্যাতানি খেতে হবে গো ঠাকুর। প্লিজ এইটুকু ধৈর্য ধরো, তোমার পায়ে পড়ি।’
আজ গ্লাস ফাঁকা হওয়ার অনেক আগেই বটুকেশ্বর মাইতি ঘর ফাঁকা করার নির্দেশ দিলেন। আজ বিকেলে অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান রাম-শ্যাম-যদু-মধু টাইপের অনুষ্ঠান নয়। বটুকেশ্বর মাইতির স্বপ্নের অনুষ্ঠান। এর জাতই আলাদা। অনেক ভাবনাচিন্তা, পরিশ্রম, খরচাপাতি করে এর ব্যবস্থা হয়েছে। অনুষ্ঠান ঠিকমতো হলে বটুকেশ্বর মাইতির নামডাক এক লাফে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। মিটিং, মিছিল, বোমা, আগুনের পাশাপাশি তিনি হবেন ‘শিল্প রসিক’, ‘পরিবেশপ্রেমী’। ইদানীং পলিটিক্সে এই ধরনের জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন আর খুব দেরি নেই যখন নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে কবিতা লেখা মাস্ট করে দেওয়া হবে। নমিনেশন পেপারের সঙ্গে প্রার্থীদের দুটো করে কবিতা জমা দিতে হবে। আধখেঁচড়া কবিতা নয়, ফুল সাইজ কবিতা।
অনুষ্ঠানটা করতে বটুকেশ্বর মাইতির সময় লেগেছে। টার্গেট ছিল চার মাস। লেগেছে সাড়ে ছ’মাস। সাড়ে ছ’মাস ধরে তৈরি হওয়া অনুষ্ঠানের আগে পাবলিকের ফালতু বকবকানি শুনে তিনি ক্লান্ত হতে চান না। একটা মেন্টাল প্রস্তুতি লাগে।
বেশ কিছুদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে এলাকার মানুষ খুশি হবে আবার ভড়কেও যাবে। আহা উহু করবে। আজকের প্রোগ্রাম সেই আহা উহু করার মতো প্রোগ্রাম।
একটা দুঃসংবাদের মধ্যে দিয়ে এই অনুষ্ঠানের চিন্তা মাথায় আসে বটুকেশ্বর মাইতির। ঘটনা এরকম— এ পাড়ার শেষ প্রান্তে একটি পার্ক ছিল। পার্ক না বলে ডাস্টবিন বলাই ঠিক। রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গায় রাজ্যের জাল জমা হত। সেখানে ঢোকা তো দূরের কথা, পাশ দিয়ে হাঁটলেই নাকে কাপড় চাপ। কাপড় না থাকলে দম বন্ধ। সান্ধের পর পার্কের ভাঙা ল্যাম্পপোস্টে একটা-দুটো টিমটিমে আলো জ্বলে। গা ছমছমে অন্ধকার। সেই সঙ্গে শুরু হয় নানা ধরনের গা ছমছমে কারবার। গাঁজা ভাঙের আস্তানা। প্রতি সপ্তাহেই ছিনতাই। বেশি রাতে ফ্যাকাশে আলোর তলায় দাঁড়িয়ে বেপাড়ার মেয়েরা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাত। এক রাতে পুলিশ জিপটিপ এনে পার্ক ঘিরে ফেলল। পুব দিকের জাল ঘেঁটে দিশি ওয়ানশটার, বস্তায় ভরা খান পাঁচ বোমা, ঝকঝকে একটা ভোজালি তুলে নিয়ে গেল। পুলিশের কাছে নাকি ‘টিপ’ ছিল।
বটুকেশ্বর মাইতি সকালে ঘুম থেকে উঠে এই সংবাদ শুনলেন। সংবাদ হিসেবে এটি তাঁর পক্ষে যথেষ্ট দুঃসংবাদ। কিন্তু দুঃখের বদলে মাথায় ঝলসে উঠল পরিকল্পনা। তিনি সোজা হয়ে বসলেন। ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি দেখা দিল। একেই বোধহয় বলে দুঃখের আড়ালে সুখ।
বটুকেশ্বর মাইতি তার ফার্স্ট এবং সেকেন্ড অ্যাসিস্টেন্ট জীবন-গজাকে তখনই মোবাইলে ডেকে পাঠালেন।
‘জীবন, ওই জঞ্জাল পার্ক সংস্কার হবে।’
হসন্তে জীবনের কিঞ্চিৎ সমস্যা আছে। সে ঘাবড়ে গিয়ে বলে, ‘কী হবে?’
‘সংস্কার, রেনোভেশন। গাধার বাচ্চা কোথাকারে। সংস্কার মানে জানো না।’
গজা বলে, ‘পরিষ্কার?’
বটুকেশ্বর মাইতি বলেন, ‘তার থেকে বেশি।’
জীবন কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘বুঝতে পারছি না গুরু।’
বটকেশ্বর খিঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘ওখান থেকে অল ক্লিয়ার করতে হবে। অল ক্লিয়ার মানে বোঝো মুর্খ? মদ গাঁজা, চুরি ছিনতাই, মেয়েছেলে, বোমা পাইপগান সব হটাতে হবে।’
জীবন আরও কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘সেটা কী করে সম্ভব গুরু। সবকটা থেকে যে হপ্তা আসছে। মেয়েদের আমাউন্ট বেড়েছে। ওদের বিজনেস ভাল হচ্ছে। কাল টাকা দিতে এসেছিল। গাঁজাভাঙের পার্টি কমপ্লেইন করল একদিকের আলোতে নাকি ডিসটার্ব হচ্ছে। পয়সা দিচ্ছে, কমপ্লেইন তো শুনতেই হবে। বিশুকে পাঠিয়ে বাল্ব ভেঙে দিয়েছি। তা ছাড়া মালপত্র রাখারও তো জায়গা চাই। বোমা ভোজালি তো বাড়িতে রাখা যায় না। পুলিশ অত মাল নিয়ে গিয়ে বিরাট লস করিয়ে দিল। কোন হারামির বাচ্চা টিপ দিল…এর মধ্যে তুমি বলছ সব বন্ধ।’
বটুকেশ্বর মাইতি শান্ত হলেন। বললেন, ‘আমি তো বিজনেস বন্ধ করতে বলিনি, বলেছি কি? বলেছি এখানে হবে না। তোরা অন্য জায়গা খোঁজ। এক বাড়ি থেকে ভাড়াটে উঠলে কি ভাড়াটে মারা যায়? সবার সঙ্গে কথা বল। এখানে এবার অন্য বিজনেস হবে!’
‘অন্য বিজনেস!’
বটুকেশ্বর ঠোঁটে মুচমুচ ধরনের আওয়াজ করে বললেন, ‘হ্যাঁ, অন্য বিজনেস।’
গজা বলল, ‘কী করতে হবে বলো বটুদা?’
বটুকেশ্বর মণি দুটো ওপরে তুলে বললেন, ‘পুরোটা এখনই বলতে পারব না। তবে আপাতত ঠিক করেছি, জঞ্জাল পার্কের চেহারা একেবারে বদলে ফেলব। আবর্জনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করব। আলো লাগবে। রং হবে। মাঝখানে ফোয়ারা। ভাঙা রেলিং সরিয়ে গাছ-পাতার নকশা দেওয়া নতুন রেলিং। সার দিয়ে বেঞ্চ। কাঠের, লোহার দু’রকমের বেঞ্চই থাকবে। গাছ লাগানো হবে কয়েকশো। নুড়ি পাথরের পথ করব। ছোটদের জন্য দোলনা, মেরি গো রাউন্ড আর ওই যে কী বলে দু’জনে বসে…একটা দিক ওঠে, একটা দিক নামে… একটা দিক ওঠে, একটা দিক নামে…কী বলে যেন?’
গজা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ঢেকুচকুচ?’
‘অশিক্ষিতের মতো কথা বলবি না। জিনিসটার ইংরেজিতে একটা নাম আছে। যাক, সে র মনে পড়বে… পার্কের রেলিং-এ ছোট ছোট টিনের প্ল্যাকার্ড লাগাব ভাবছি। সেখানে ঋষি মনীষীদের বাণী থাকবে। কবিগুরুর গান কবিতা থাকবে। আমিও দু’-একটা লিখব।’
গজা চমকে উঠে বলে, ‘তুমি লিখবে!’
বটুকেশ্বর মাইতি চোখ খুলে বললেন, ‘হ্যাঁ লিখব, সমস্যা কোথায়? ধর লিখলাম, রক্তের বদলে গাছ, হিংসার বদলে ফুল। কেমন হবে? মিল আছে না?’
জীবন ঢোঁক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ আছে, গাছ আর ফুলে সুন্দর মিল আছে।’
‘তা হলে? পারব না বলছিলি কেন? নে এখনই ব্যবস্থা শুরু করে দে। মালী, মিস্ত্রি যা লাগে দেখ। আমি চাই কাল থেকে কাজ শুরু হোক। এলাকার সবাই দেখুক বটুকেশ্বর শুধু..।’
গজা বলল, ‘এ তো অনেক খরচ!’
‘খরচ বলছিস কেন, ইনভেস্টমেন্ট বল গাধার বাচ্চা। কমপ্লিট হয়ে গেলে ঢাকঢোল পিটিয়ে পার্কের উদ্বোধন হবে। আমি এখন আর খরচটরচ নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি উদ্বোধন অনুষ্ঠান নিয়ে। কাকে কাকে ডাকা যায়…।’
গজা বলল, ‘এখনই মন্ত্রীদের ডেট চেয়ে রাখো।’
বটুকেশ্বর মাইতি ধমক দিলেন। বললেন, ‘নো না। নো পলিটিক্স। এখানে রাজনীতি লোকে নেবে না। অন্য লাইনে ভাবতে হবে। তবে তাতেও সমস্যা আছে। বেশি মাতব্বর কাউকে নিলে আমি হাওয়া হয়ে যাব। সবাই তাকে নিয়ে মাতামাতি করবে।’
গজা তাড়াতাড়ি বলল, ‘তা হলে এসব ফ্যাচাঙের দরকার কী? মাল তোমার আর ক্ষীর খাবে অন্য লোকে? তুমিই উদ্বোধন করো গুরু।’
বটুকেশ্বর মাইতি চোখ সরু করে বললেন, ‘বলছিস? কথাটা খারাপ বলিসনি। একটা গাছ পুঁতে ধর উদ্বোধন করলাম। আজকাল বড় বড় লোকেরা ধুমধাড়াক্কা গাছ পোঁতে।’
প্রথম দিন চারাগাছ ঠিক হলে দু’দিনের মাথায় বটুকেশ্বর মাইতি পরিকল্পনা বদলালেন। ঠিক করলেন পার্কের মাঝখানে মূর্তি বসবে। হাততালি, ব্যান্ডবাদ্য, বেলুন ওড়ার মাঝখানে তিনি সেই মূর্তির পরদা সরাবেন। এতে খরচ বাড়বে। মূর্তি তৈরিতে সময় লাগবে। লাগুক। খ্যাতি অনেক বেশি হবে। পরিবেশের সঙ্গে শিল্প যোগ হবে।
‘মূর্তিফুর্তি কারা বানায় দেখা। সাইজ যেন ছোট না হয়। বড় হতে হবে।’
গজা বলল, ‘গুরু কুমোরটুলিতে বলব?’
জীবন বলল, ‘কেষ্টনগরের কাজ ভাল।’
শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণনগরেই ঠিক হল। আর্টিস্টের বয়স অল্প। বটুকেশ্বর মাইতি নিজে কথা বললেন। ছোকরা একটু পাকা। তা হোক। শিল্পী মানুষ পাকা হয়। তবে পাকার সঙ্গে খুঁতখুঁতেও। চার মাস টাইমের জায়গায় আড়াই মাস বেশি টেনে দিয়েছে। তবে কাজ অত্যধিক ভাল করেছে। ভাবনাটাই দুর্দান্ত। শেষ হওয়ার মুখে এক রোববার বটুকেশ্বর মাইতি নিজে কাজ দেখতে গেলেন। গিয়ে মুগ্ধ হলেন। আহা!
মূর্তি একটা নয়, মূর্তি তিনটে। একটা গোটা পরিবার। বাবা-মা আর মেয়ে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাবা আর শাড়ি পরা মায়ের মাঝখানে হাত ধরে ফ্রক পরা খুকি। ঠিক যেন বিকেলবেলা বাবা-মায়ের সঙ্গে পার্কে বেড়াতে এসেছে।! খুকির চুলের বেণি, বাবা পাঞ্জাবির পকেট, মায়ের আঁচল সব একেবারে নিখুঁত। তাদের মুখের হাসি দেখলে কে বলবে এই পরিবারটি রক্তমাংসের নয়? এমনকী মেয়েটির ফ্রক হাওয়ায় উড়ছে! ঢালাই করে এমন কাজ হয় বটুকেশ্বর মাইতি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
আর্টিস্টকে অবশ্য মুগ্ধভাব প্রকাশ করেননি বটুকেশ্বর। করলে মাথায় চড়ে বসত। উলটে গম্ভীর মুখে বলেছেন, ‘কাজ মন্দ হয়নি, তবে পরিকল্পনায় গোলমাল আছে। পাবলিক বলবে দেশে মনীষীর তো অভাব নেই, তাদের বাদ দিয়ে হঠাৎ আলটপকা একটা ফ্যামিলি… যাক, এখন তো আর কিছু করার নেই। হাতে সময় নেই যে জিনিস পালটাবে। তা ছাড়া আমি চাই না আর্টিস্টদের নিন্দে হোক। আমি চাই শিল্পীর সম্মান। তুমি বরং মূর্তির নীচে পরিকল্পনায় আমার নাম লিখে দিয়ে বাছা। বড় করে লিখো। সমালোচনা যদি শুনতে হয় আমিই শুনব।’
কাল রাতেই মূর্তি পার্কে বসে গেছে। মূর্তি সাধারণত বসে বেদির ওপর। কিন্তু এখানে শিল্পীর পরামর্শ মতো বসানো হয়েছে প্রায় মাটিতে। এতে ন্যাচারাল ভাবটা বেড়েছে। তবে কাপড় ঘেরা। বটুকেশ্বরবাবুর কড়া অর্ডার উদ্বোধনের আগে কেউ যেন জিনিস দেখতে না পায়। বাকি সাজগোজও কমপ্লিট। ফুলের টব, রঙের পোঁচ, নতুন বেঞ্চ, ঝলমলে আলো, ঝরঝরে ফোয়ারা— সব। খবর এসেছে স্টেজের ফিনিশিং টাচ চলছে।
দর্শনার্থী তাড়িয়ে বটুকেশ্বর মাইতি একা ঘরে বসে বিকেলের ভাষণ ঝালিয়ে নিচ্ছেন। তিনি ঠিক করেছেন ভাষণের প্রথম পর্যায়ে থাকবে পরিবেশ। দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকবে শিল্প, আর একবারে শেষে থাকবে মূর্তির কথা। কেন তিনি এরকম মূর্তি বানালেন?
‘… আমি ইচ্ছে করলেই বড় কোনও নেতা, মনীষীর মূর্তি বসাতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। এই পার্ক কোনও নেতা, মনীষীর নয়। এই পার্ক কোনও কুকর্মের নয়। এই পার্ক সাধারণ মানুষের, এই পার্ক আপনাদের। বড়দের আনন্দ, ছোটদের হাসি। আমি চাই অতীতের সব কালি ধুয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বাবা-মায়েরা আসুন এখানে, নির্মল বাতাস আর সবুজ গাছের মাঝখানে তাদের বুক ভরে শ্বাস নিতে দিন। ঠিক এই মূর্তির মতো…’
বটুকেশ্বর মাইতি চোখ বুজলেন। টেনশন হচ্ছে। জীবন আলোর আরেঞ্জমেন্ট ঠিকভাবে করেছে তো? মাইক? গজা বেলুন এনেছে? ব্যান্ডের ছেলেমেয়েগুলো কোথায়? ওরা কখন থেকে বাজনা শুরু করবে?
সব কিছু ঠিকঠাকই হল। নিখুঁত ও নিপুণ। ভাষণ শেষ করবার পর বটুকেশ্বর মাইতি দড়ি ধরে হালকা টান দিলেন। অনেক সময় দড়ি আটকে যায়। এখানে আটকাল না। মূর্তি ঘিরে রাখা পরদা সরে গেল দুলকি চালে। জ্বলে উঠল আলো।
কিন্তু এ কী? ছোট্ট মেয়েটা কোথায়? বাবা-মায়ের হাত ছেড়ে সে কোথায় পালাল!
আজকাল রবিবাসর, ১৫ নভেম্বর, ২০০৯