আমি ও মানালি
১
এক ধরনের ছাত্র থাকে যারা পরীক্ষায় কখনও ভাল রেজাল্ট করতে পারে না, কিন্তু লেখাপড়ায় অত্যধিক সিরিয়াস। এই কারণে তাদের নানা ধরনের হাসি-ঠাট্টা, গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কলেজের বন্ধুরা বলে, ‘তুই হলি কর্ম করিয়া যাও, ফলের আশা করিয়ো না টাইপের ছেলে। একে মনীষী সিনড্রোমও বলতে পারিস। ওঁদের মধ্যে এই লক্ষণ প্রকট থাকে। মনে হচ্ছে খুব শিগগিরই কলেজে তোর বড় ছবি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা হবে।’ পাড়ার বন্ধুদের মত হল ‘লেখাপড়ার পিছনে না ছুটে তুই বরং দেশসেবায় মন দে। ওই ফিল্ডে ভালমন্দ সব ধরনের লোক আছে, শুধু সিরিয়াস লোকের অভাব। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল না হলেও দেশসেবায় তোর রেজাল্ট হবে মারকাটারি। চোখ বুজে ফার্স্টক্লাস।’
সিরিয়াস ছাত্রের ঘ্যানঘ্যানানিতে মাস্টারমশাইরাও বিরক্ত। ক্লাসের বাইরে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে বলেন, ‘এক জিনিস বারবার বুঝতে আসো কেন? সবকিছু যে সবাইকে বুঝতে হবে তারও তো কোনও মানে নেই। যতটুকু পেরেছ তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হও। তুমি তো আর ফেল করা ছাত্র নও। মোটামুটি ছাত্র।’
এইসব ছেলের বাড়িতেও সমস্যা। বাবা-মা, দাদা-দিদির বলে, ‘কী রাতদিন বই-মুখে বসে থাকিস! রেজাল্ট তো সেই চল্লিশ আর পঞ্চাশ। খুব বেশি হলে বাহান্ন। বাজার-দোকান করতে বললে এমন ভান করিস যেন ফার্স্ট হবি। ফার্স্ট না হলেও সেকেন্ড তো বটেই।’
এসবে সিরিয়াস ছাত্রদের কিছু এসে যায় না। সিরিয়াস ভাবটা তাদের অভ্যেসের মতো। ঠাট্টা, বিরক্তি, রাগ কোনওটাই তাদের গায়ে লাগে না।
আমি হলাম এইরকম একজন সিরিয়াস ছাত্র। রাতদিন পড়াশোনা করে স্কুল শেষ করেছিলাম। রেজাল্ট হয়েছিল মোটামুটি। মন্দ নয়, আবার ভালও নয়। তবু কলেজ করছি আরও সিরিয়াসভাবে। কখনও ক্লাস কামাই করি না। ঝড়-জল, ধর্মঘটেও চলে আসি। অল্পস্বল্প জ্বরজারি বা পেটের অসুখে পকেটে ওষুধ রাখি। সেকেন্ড ইয়ারের গোড়ার দিকে একবার ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালিতে হল হেয়ার লাইন ফ্র্যাকচার। ডাক্তার বলল, দশদিন বেডরেস্ট। আমি তিনদিনের মাথায় ট্যাক্সি নিয়ে কলেজে হাজির হলাম। অনার্স ক্লাসে আমাদের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট মুকুল গাঙ্গুলি বললেন, ‘তুমি খবর পাঠালে কদিনের জন্য ডিপার্টমেন্টটা নয় তোমার বাড়িতেই শিফট করতাম! তোমাকে আর কষ্ট করতে হত না, ট্যাক্সির ভাড়াও বাঁচত।’
ছেলেমেয়েরা খুব একচোট হাসল। বলল, ‘নো প্রবলেম স্যার, আমরা ডিসাইড করেছি, অর্ণবের এই কদিনেই ট্যাক্সি ফেয়ার চাঁদা তুলে আমরা সামলে দেব।’
সত্যি সত্যি পরের অফ পিরিয়ডে কয়েক জন তাই করল। রুমাল পেতে ঘুরে ঘুরে করিডোরে পয়সা তুলল। বন্যাত্রাণে চাঁদা তোলবার ঢঙে টেনে টেনে গান ধরল, ‘আমাদের অর্ণবের পা-টা ভেঙে গেছে গো/ ক্লাস না করে শুয়ে থাকলে ছটফটিয়ে মরে গো/ আসবে কী করে বলো গো…’
ওদের কাণ্ড দেখে আমি খুব হাসলাম। পরের দিন আবার কলেজে এলাম।
প্রত্যেক কলেজের মতো আমাদের কলেজেও দু’-একজন এমন অধ্যাপক আছেন যাঁদের লেকচারকে লেকচার না বলে বলা যায় ঘুমপাড়ানি সংগীত। যারা কঠিন ইনসোমনিয়ায় ভোগে তারাও এঁদের ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়বে এবং কিছু সময় পরে নাক ডাকাতে শুরু করবে। ছেলেমেয়েরা কেউ এই অধ্যাপকদের ক্লাসে ঢুকতে চায় না। কিন্তু আমি ঢুকি। মন দিয়ে নোটস নিই। টিউটোরিয়াল, লাইব্রেরি, টিউশন কোনওদিন মিস করি না। সিরিয়াস হওয়ার কারণে আমি বিশেষ আড্ডা-টাড্ডার মধ্যেও নেই। ক্যান্টিনে বসলে ঘনঘন ঘড়ি দেখি। বন্ধুরা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘অ্যাই অর্ণব, ঘড়ি দেখছিস কেন?’
‘আমি অবাক হয়ে বলি, ‘বাঃ, ক্লাস আছে না?’
‘আজ ক্লাস বন্ধ। আজ আমরা সিনেমা যাব। তুই আমাদের সঙ্গে যাবি।’
আমি উঠতে উঠতে বলি, ‘না ভাই, আমাকে ক্লাসে যেতে হবে। তারপর টিউশন আছে।’
ধ্রুব উঠে হাত চেপে ধরে। বলে, ‘টিউশনের গুলি মার।’
আমি কঁচুমাচু মুখে বলি, ‘আমার কাছে পয়সা নেই যে!’
সায়ন বলে, ‘তোর টিকিট আমরা কাটব। শুধু একটাই কন্ডিশন, সিনেমাহলে তোকে বসতে হবে মণিদীপার পাশে।’
তৃষা লাফ দিয়ে বলে, ‘শুধু বসলেই হবে না, মণিদীপার হাত ধরে বসতে হবে।’
মণিদীপা বলে, ‘বাপ রে, হাত ধরে হয়তো বলবে, মাই ডিয়ার, এস কে এম সেকেন্ড পিরিয়ডে যা পড়িয়েছে সেটা আরও একবার বুঝিয়ে দাও দেখি ডার্লিং! আমি ওর হাত-ফাত ধরতে পারব না বাবা।’
আমি হেসে বলি, ‘ঠিক আছে, হাত ধরতে হবে না, তুই ফিসফিস করে বলে দিস, তা হলেই হবে।’
সকলে হেসে ওঠে। আমি ওদের সঙ্গে সিনেমা যেতে বাধ্য হই। টিউশনের সময় হয়ে গেলে ‘একটু আসছি’ বলে মাঝপথেই উঠে আসি চুপিচুপি।
শুধু সিনেমা-থিয়েটার নয়, কলেজ বয়েসের আমোদ-আহ্লাদেও আমি থাকি না। অল্পবিস্তর নির্দোষ নেশা-ভাঙ তো দূরের কথা, মেয়েদের প্রতিও আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। ইন্টারেস্ট দেওয়ার মতো সময়ও নেই। সহপাঠিনীদের আমি চেহারায় যতটা না চিনি তার থেকে অনেক বেশি চিনি নোটস আর সাজেশনে। ফোর্থ পেপারের নোট তৈরিতে আত্রেয়ী না নন্দিনী কে বেশি ওস্তাদ তা আমার মুখস্থ। প্রীতমা, রাজন্যা না মধুরিমা কার সাজেশটা কতটা মিলবে তার হিসেবে আমার পকেটে। রেফারেন্স বইয়ের জন্য চান্দ্রেয়ীর কাছে গিয়ে যে ঝুলোঝুলি করতে হবে তা-ও আমার অজানা নয়। এসবের জন্য তাদের আশেপাশে আমি অসংখ্যবার ঘুরঘুর করতে পারি। বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করতেও পিছপা নই। কেউ কেউ ড্রইংরুমে বসিয়েও রাখে ঘণ্টাখানেক। আমি বসেই থাকি। কেউ কেউ কাজের লোককে দিয়ে বলে পাঠায়, ‘দিদি এখন বাড়িতে নেই। ঘণ্টাখানেক পরে আসুন।’ বুঝতে পারি কথাটা মিথ্যে; তবু একঘণ্টা পরে এসে আবার সুযোগ নিই। ভাল নোটসের কাছে খারাপ অপমান কিছু নয়।
সকলেই একথা জানে। জানে বলে ক্ষমা-ঘেন্না, হাসি-ঠাট্টা করে মেনেও নেয়। কলেজের ছেলেরা আমার নাম দিয়েছে, সিরিয়াস গাধা। মেয়েরা বলে, ‘শুকনো কাঠ।’
আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার মতো পথে চলি।
সেই আমিই হঠাৎ পাগল হয়ে গেলাম। একটু-আধটু পাগলামি নয়, ভয়ংকর রকমের পাগল। সব তালগোল পাকিয়ে গেল! আমার মতো সিরিয়াস গাধা, শুকনো কাঠের জীবনে যে এরকম ফল্গুধারার রস আসতে পারে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। পড়লাম একেবারে অথই জলে।
ঘটনার শুরুটা একটু বলি। একেবারেই সাদামাটা শুরু।
একদিন দোতলার করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে নোটসের পাতা উলটোচ্ছিলাম আর আড়চোখে তেরো নম্বর ঘরের দরজার দিকে নজর রাখছিলাম। তেরো নম্বরে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস চলছে। দিন তিনেক হল তাদের ক্লাস শুরু হয়েছে। কলেজে নতুন সেশন শুরু হওয়া আমার কাছে খুব বিরক্তিকর একটা ব্যাপার। গাদাখানেক ছেলেমেয়ে খালি ক্যাঁচোরম্যাচোর করে। পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়। এরা শান্তশিষ্ট হয়ে সেট করতে করতে মাসখানেক কেটে যায়। ততদিন কলেজে যেন একটা হুল্লোড় চলতে থাকে। আমার টার্গেট ছিল মুকুল গাঙ্গুলি। তিনি ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস সেরে বেরোবেন। আমি তাকে ধরব। টিচার্সরুম পর্যন্ত নানান ধরনের প্রশ্ন করতে করতে যাব। আমি জানি উনি বিরক্ত হবেন। অ্যাভয়েড করতে চাইবেন। তা হোক। আমায় লেগে থাকতে হবে। বাড়িতে বসে শুধু নোটস তৈরি করলেই হয় না। টিচারদের কাছে বারবার ঝালিয়ে নিতে হয়।
তেরো নম্বর ক্লাস ভাঙল। আমি সরে দাড়ালাম। হইহই করতে করতে নতুন ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে আসছে। কলেজে ঢোকার আনন্দে চোখ-মুখ ঝলমল করছে তাদের। নতুন নতুন বন্ধু পাতানোর চেষ্টায় একে-অন্যের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দেখাচ্ছে। মুকুল স্যারকে দেখলাম গোল করে ঘিরে ফেলেছে একদল। উফ, এদের টপকে যাওয়াটাই একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিছু করার নেই। এই চলবে কটাদিন। আমি তাল খুঁজতে লাগলাম। আর তখনই চোখে পড়ল!
চোখ পড়ল মেয়েটির দিকে। আমি চমকে উঠলাম।
মেয়েটি ভয়াবহু ধরনের সুন্দর। এত সুন্দর যে আমার মনে হল, এরকম আমি আগে কখনও দেখিনি। আজকের পরে আর দেখতে পাব না। সাদা সালোয়ার কামিজ পরে সে। ওড়নাও সাদা। মাঝে মাঝে নীলের পোঁচ। যেন খানিকটা শরতের আকাশ সঙ্গে নিয়ে চলছে। মাথার চুল ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে আছে কাঁধ পর্যন্ত। টিকলো নাক, থুতনি। দীর্ঘ গ্রীবা। টানা টানা দুটো চোখ। বইয়ের ব্যাগটা জড়সড় করে ধরে রেখেছে বুকের কাছে। মেয়েটি মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। চকিতে তার চোখদুটো দেখতে পেলাম। আমার গোটা শরীর টলমল করে উঠল। পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, ভালবাসা যেন জমা হয়েছে এই মেয়ের চোখে! মেয়েটি যেন সামান্য হাসল। হাসল কি? নাকি এই মেয়ের ঠোঁটদুটোই অমন? হাসি লেগে থাকে সবসময়। মনে হল, মেয়েটির হাতে একটা গোলাপ ফুলও রয়েছে। লাল গোলাপ। সেই ফুল অদৃশ্য, আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু রয়েছে।
আমি যে আমি, আমিও নোটস, সাজেশন, স্যার সব ভুলে গেলাম। করিডোরের পাঁচিল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না মেয়েটি আমার সামনে থেকে চলে যায় শান্ত পায়ে। চলে যাওয়ার পরও নড়তে পারলাম না অনেকক্ষণ। নিজের ক্লাসে ফিরলাম দেরি করে। ততক্ষণে লেকচার শুরু হয়ে গেছে। সবাই অবাক হল। এরকম আমার কখনও হয় না।
প্রথম দেখায় প্রেমের ঘটনা পৃথিবীতে রোজ আকচার ঘটছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হল বাড়াবাড়ি। কিছুদিনের মধ্যে আমি চলে গেলাম বড়সড় একটা ঘোরের মধ্যে। ক্লাসে অধ্যাপকরা লেকচার দিলে মাথামুন্ডু বুঝতে পারি না। বন্ধুদের মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকি। টিউশনে না গিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াই। রাতে থেকে থেকে ঘুম ভেঙে যায়। দিনে খিদে নষ্ট। বই-খাতা খুললে শব্দগুলো অর্থহীন মনে হয়। পড়তে চেষ্টা করি। পারি না। বাবা, মা, বড়দা, বোন দশটা কথা বললে একটা উত্তর দিই। বাসে কেউ ধাক্কা দিলে গ্রাহ্য করি না। দুম করে একদিন সিগারেট ধরে বসলাম। কিছু ভাল লাগে না, কিছু ভাল লাগে না… চোখের সামনে শুধু সেই মেয়ের মুখ। মায়া, মমতা, ভালবাসামাখা মুখ। কথাটা কাউকে বলতে পারি না। আমার মতো সিরিয়াস ছেলেরা সব পারে, প্রেমের কথা বলতে পারে না। বলতে পারার মতো কেউ তাদের থাকে না। থাকতে নেই। নিজেকে নিজেই লজ্জা পাই। সামলাতে চেষ্টা করি। সামলাতে পারি না। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অবাক হল।
‘তোর কী হয়েছে রে শুকনো কাঠ?’
আমি আরও শুকনোভাবে হেসে বলি, ‘কই, কিছু না তো!’
‘আলবাত কিছু হয়েছে। আরও শুকিয়ে গেছিস। নিশ্চয় রাত জেগে হেভি পড়ছিস?’
আমি মাথা নামিয়ে বলি, ‘পড়তে তো হবেই, ফাইনাল এসে গেল যে।’
রাত জাগছি, কিন্তু পড়ছি না। পড়তে পারছি না। এই করতে করতে দুটো মাস কীভাবে যেন গড়িয়ে গেল; সকালে রাতজাগা চোখ নিয়ে কলেজে ছুটি। গেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি, মানালির (ততদিনে ওই মেয়ের নাম জেনেছি। কিন্তু শুধু ওই নামটুকুই।) ঝকঝকে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। উর্দি পরা ড্রাইভার গেট খুলে সেলাম ঠোকে। মানালি কোনওদিকে না তাকিয়ে গটগট করে কলেজে ঢোকে। ওদের ক্লাস ভাঙলে করিডোরে বেফালতু ঘোরাঘুরি করি। স্যারেরা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হল অর্ণব? কিছু বলবে?’
আমি তাড়াতাড়ি বলি, ‘না, স্যার কিছু নয়।’
মানালি লাইব্রেরিতে ঢুকলে আমিও লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ি। অনেক দুরে মুখ নামিয়ে বসে থাকি। সামনে খোলা থাকে বইয়ের পাতা। হাওয়ায় উলটে যায়। তা-ও তাকিয়ে থাকি। মনালি একতলার লনের কাছে বন্ধুদের সঙ্গে দাড়ালে আমি তিনতলার বারান্দায় গিয়ে উঁকি দিই। তিনতলার বারান্দায় দাঁড়ালে একতলার লনে চলে আসি। মাথা তুলে তাকাতে লজ্জা পাই। তবু যেন দেখতে পাই! কখনও ক্কচিৎ পাশ দিয়ে সে হেঁটে গেলে বুক ছ্যাঁৎ করে ওঠে। শরীর ঝনঝন করে। মনে হয় সে বুঝি তার হাতে থাকা অদৃশ্য গোলাপের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে গেল।
সন্ধের সময় বাড়ি ফেরার পথে অনেকটা হাঁটি। নিজেকে বোঝাই—এ ঠিক নয়। এ ঠিক হচ্ছে না। আমার মতো একজন সিরিয়াস ছেলে এমন মায়াজালে জড়াবে কেন? ছি ছি! বাড়ি। ফিরে অনেকটা সময় ধরে স্নান করি। নিজের মনকে ধুয়ে ফেলি যেন। বই নিয়ে বসি। আর। দুটো পাতা মন দিয়ে পড়বার পরই খাতার পাতায় গোলাপের ঘ্রাণ পেতে থাকি।
এত অশান্তির মধ্যিখানে একটাই বড় বাঁচোয়া, আমাকে কেউ সন্দেহ করে না। আসলে কেউ ভাবতেই পারে না, আমার মতো ছেলে প্রেমে পড়তে পারে।
পরীক্ষা এসে গেল। আমাদের ক্লাস শেষ। দু’-একটা ছুটকো-ছাটকা স্পেশাল পিরিয়ড চলছে। এলে চলে, না এলেও চলে। আমাদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়েই ব্যস্ত। তারা কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। নোটস, সাজেশান গোছানোর কাজ কমপ্লিট। এবার সব ভুলে শুধু বাড়িতে বসে পড়ার সময়।
আমি তা-ও নিয়মিত কলেজে আসতে লাগলাম। ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। লাইব্রেরি, করিডোর, টিচার্সরুম, ক্যান্টিন। যদি একবার মানালিকে দেখতে পাই। একবার, একটুখানি… ততদিনে আমার চেহারার মধ্যে একটা উদভ্রান্ত ভাব চলে এসেছে। যারা কলেজে দেখতে পেত তারা ভাবত, পড়ার চাপ। আমার কিন্তু ভয় করতে লাগল। বুঝতে পারলাম, বড় ধরনের গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। এই গোলমাল থেকে যদি বেরোতে না পারি তা হলে সেটা হবে ভয়াবহ। এর মাঝখানেই একটা কাণ্ড করে বসলাম। কলেজের অফিসে গিয়ে আমাদের হেডক্লার্ক অনীশদার কাছ থেকে মানালির বাড়ির ঠিকানা চেয়ে বসলাম। অনীশদা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর মাথা নাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি অর্ণব।’
এবার ঘটনার শেষটুকু বলি। শুরুর মতো শেষটাও সাদামাটা।
পরীক্ষার ঠিক সাতদিন আগে কলেজে ঢুকছি মাথা নামিয়ে। সময় হিসেব করেই এসেছি। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস ভাঙবে। ছেলেমেয়েরা বেরোবে। মাথা নামিয়ে চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠছি দোতলায়। উঠছি দ্রুত। হাতে দুটো ফাইল রেখেছি ইচ্ছে করে। যেন নোটস নিয়ে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লাস ভাঙা ছেলেমেয়েরা হইহই করতে করতে নীচে নেমে আসতে থাকে। মানালি কি আমার পাশ দিয়ে চলে গেল? নাকি এখনও নামেনি?
হঠাৎ পিছন থেকে ডাক শুনি, ‘শুনুন।’
আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। আবার ডাক, ‘এই যে শুনুন।’
মুখ ফেরাতেই বুকটা ধক করে ওঠে, মানালি!
মানালি আজ শাড়ি পরেছে। শাড়ির রং ভাল করে দেখার আগেই সে খুব স্বচ্ছন্দে উঠে আসে সিঁড়ি টপকে। আমার থেকে একটা সিঁড়ি নীচে এসে থামে। দেখতে পাই মানালি একা নয়, নীচে আরও চার-পাঁচজন মেয়েও দাড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে তারা।
মানালি আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকায়। আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘আমাকে ডাকছ?’
মানালির মুখে আজও সেই হাসি। তবে সেই হাসি আজ অন্যরকম!
‘হ্যা, আপনাকেই ডাকছি। আপনি এভাবে আমার পিছন পিছনে ঘুরছেন কেন?’
আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়।
আমতা আমতা করে বলি, ‘আমি…’
‘হ্যাঁ, আপনি। কর্কশ গলায় মানালি বলে, “আমি বুঝতে পারি না ভেবেছেন? সব বুঝতে পারি। কলেজে ঢোকার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখেন। ছুটির সময় সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেন। কিছু বলিনি। সেদিন শুনলাম, অফিস থেকে আপনি আমার বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত জোগাড় করবার চেষ্টা করেছেন। হাউ ডেয়ার ইউ! ছি ছি! মুখ দেখলে তো ভালমানুষ মনে হয়। তাও যদি সামনাসামনি এসে বলতেন, একটা কথা ছিল! সরাসরি রিফিউজ করতাম। সেটুকু সাহসও তো নেই! শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে কাওয়ার্ডের মতো… আই হেট কাওয়ার্ডস।’
বুঝতে পারি একটা কিছু প্রতিবাদ করা উচিত। প্রতিবাদ না হলেও অন্তত বলা দরকার। পারি না। মাথা নামিয়ে থাকি।
মানালি আবার বলে, ‘সিনিয়র বলে এতদিন কিছু বলিনি। তা ছাড়া শুনেছি, আপনি নাকি একজন সিরিয়াস স্টুডেন্ট। এই তার নমুনা! কীসের সিরিয়াস স্টুডেন্ট? প্রেমের? এসব কী ধরনের অসভ্যতামি? দেখুন, ফারদার ডিসটার্ব করলে প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করতে বাধ্য হব। ভালমানুষিপনা বের করে দেব! আপনার কলেজে ঢোকাই বন্ধ হয়ে যাবে। মনে রাখবেন এটাই আমার প্রথম এবং শেষ ওয়ার্নিং।’
একটু থামে মানালি। ঠোঁটের পাশে ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, ‘পরীক্ষা এসে গেছে। মেয়েদের পিছনে না ঘুরে বাড়ি গিয়ে গুডবয়ের মতো বই নিয়ে পড়তে বসুন। নইলে ফেল করতে হবে।’
কথা শেষ করে মানালি নেমে যায় লাফাতে লাফাতে। আমি মাথা নামিয়েই থাকি। নীচ থেকে মেয়েদের হাসি ভেসে আসে। দল থেকে কে যেন বলে ওঠে— ‘বেচারি শুকনো কাঠ।
ওরা আমার এ নামটাও জেনে গেছে!
ক্লান্ত পায়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসি। ভিড় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে বেশ হালকা লাগে। মনে হয়, বড় ধরনের একটা ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। ভাগ্যিস মানালি আমাকে ভিতু বলে চিনতে পেরেছে। যদি চিনতে না পেরে দুম করে আমার প্রেমে পড়ে যেত? তা হলে? তা হলে যে অনেক বড় গোলমাল হয়ে যেত!
এতদিন মোটামুটি রেজাল্ট করতাম। বি. এ পরীক্ষায় রেজাল্ট হল খুব খারাপ। একদিন সবাইকে লুকিয়ে কলেজ থেকে গিয়ে মার্কশিট নিলাম। আমার কলেজের পাট চুকল। পরাশোনার জীবন শেষ হল। হন্যে হয়ে চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। হাতে অদৃশ্য গোলাপ নিয়ে মানালি আমার মন থেকে মুছে গেল।
২
‘প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি মরে যাব।’
কাতর নারীকণ্ঠে থমকে যাই। রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে উঠে পড়েছি। এবার ছুটব। কোনদিকে ছুটব জানি না। সকলেই ছুটছে। আমিও ছুটব। লাঠি, টিয়ার গ্যাস, আগুনের মধ্যে দিক ঠিক করার কোনও উপায় নেই। সবাই যেদিকে ছুটছে সেদিকেই ছুটতে হবে নিশ্চয়। কিন্তু ওইদিকটাও কি নিরাপদ? ওদিকে গেলে কি বাঁচা যাবে? বুঝতে পারছি না।
শুধু নারীকণ্ঠ নয়, এবার পিঠে হাতের ছোয়া পেলাম। আমার দশটা-পাঁচটা অফিস করা ঘামে ভেজা নোংরা জামায় কেউ হাত রেখেছে। আলতোভাবে রেখেছে, কিন্তু রেখেছে!
‘ভীষণ ভয় করছে। আমাকে নিয়ে চলুন। প্লিজ, আমাকে ফেলে যাবেন না।’
বিরক্ত হই। এই সময়টুকু শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে হয়। নিজেকে বাঁচাতে হবে। এর মধ্যে এসব আবার কী জ্বালাতন? তার ওপর আবার মহিলা।
বড় বড় পাথরের টুকরো উড়ে আসছে। দোকানের কাচ ভেঙে পড়ছে ঝনঝন করে।
‘ভয় করছে। আমার ভয় করছে খুব।’ কাতর আর্তনাদে বাধ্য হয়ে মুখ ফেরালাম এবং ফিরিয়েই চমকে উঠলাম।
মানালি না? হ্যাঁ, মানালিই তো!
বাইশ বছরে খানিকটা মোটা হয়েছে। বাইশ? নাকি তেইশ? একুশ নয় তো? মনে নেই। আজকাল আগের হিসেব গুলিয়ে যায়। বিকেল শেষ হওয়া আলোতে ভাল করে তাকাই। চারপাশের যা অবস্থা তাতে ভাল করে কারও মুখ দেখার কথা নয়। তবু চেষ্টা করি। ঠিকই, এই মেয়ে মানালিই। কলেজের হিষ্ট্রি অনার্স। তবে এখন আর মেয়ে নেই, এখন মহিলা। আমার মতোই চল্লিশ পেরিয়ে গেছে বা দোরগোড়ায়।
চারপাশ কাঁপিয়ে বোমা ফাটার আওয়াজ হল। পরপর দু’বার। দ্রুত সরে এলাম। বুঝতে পারছি এতক্ষণ যে উত্তেজনা জনতার হাতে ছিল, তা এবার গুন্ডরা দখল নিয়েছে। গলিঘুজি থেকে লাঠি-সোটা অস্ত্র নিয়ে তারা বেরিয়ে আসছে। জনতা বোমা পাবে কোথা থেকে?
মানালি এবার আমার কাঁধের কাছটা খামচে ধরল।
‘আমি কিছু চিনতে পারছি না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এই জায়গাটার নাম কী?’ কাপা, সন্ত্রস্ত গলায় বলল মানালি।
গুলিয়ে যাওয়ারই কথা। পথঘাটের চেহারাটাই বদলে গেছে! ভয়াবহ অবস্থা। মারমুখী জনতা সবদিকে ছোট ছোট দল বেঁধে তেড়ে যাচ্ছে। তারা চাক ভাঙা মৌমাছির মতো হিংস্র, নিয়ন্ত্রণহীন। কাকে তেড়ে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।
মানালির হাত কাঁপছে। বিস্ফারিত চোখ। এই কি সেই চোখ? একসময় যা দেখার জন্য হাপিত্যেশ করে থাকতাম ক্লাসে, করিডোরে? নিশ্চয় এই চোখ নয়। বয়েসের সঙ্গে যেমন চেহারা বদলায়, চোখও বদলায়। মানালির চোখ কতটা বদলেছে? তার আচরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরকম পরিস্থিতিতে পড়েনি কখনও। হিস্টিরিয়া রোগীর মতো করছে। হাঁটছে কেন? ওর গাড়ি কোথায়? নাকি গাড়ি ফেলে পালিয়ে এসেছে? হতে পারে গাড়ি ভাঙচুর হয়ে গেছে। কলকাতায় কী শুরু হয়েছে এসব? সামান্য একটা অ্যাক্সিডেন্টকে কেন্দ্র করে এতবড় গোলমাল। আজকাল প্রায়ই এরকম হচ্ছে। ছোটখাটো ঘটনায় শহর জ্বলে উঠছে। অবরোধ, বাস পোড়ানো, লাঠি, টিয়ার গ্যাসে ভয়ংকর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে আমি যে বাসটা থেকে নেমেছি সেটায় এবার ওরা আগুন দিল। লাল সরকারি বাস। আগুনে সেই লাল আরও দগদগে লাগছে। ভুকভকে কালো ধোঁয়া আকাশ পর্যন্ত লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। উফ! কী মারাত্মক! ‘আগুন লাগানোর সময় ষণ্ডা ধরনের একটা ছেলে খালি গায়ে চিৎকার করে বলছিল, কাউকে নামতে দিবিনা। কোনও শালাকে নয়। সবসুদ্ধ জ্বালিয়ে দে। হারামির বাচ্চা সব…। ভদ্রলোক এসেছে?’ চিৎকার করছিল আর হাতের ডান্ডা দিয়ে বাসের গায়ে মারছিল থেকে থেকে। কন্ডাক্টরটা চালাক। কাঁধের ব্যাগটা রাস্তার ওপর ছুড়ে ফেলে সবার আগে ছুট দিল। খুচরো পয়সা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। দেরি হলে সত্যি সত্যি হয়তো সবাইকে ওরা জ্বালিয়ে দিত। লাফিয়ে নামতে গিয়ে একজন বৃদ্ধ পিচের রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়লেন। মুখ তুলতে দেখি, ভদ্রলোকের ঠোঁট ফেটে ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে।
‘কী হবে.’ মানালির ঠোট থরথর করে কাপছে।
সেই ঠোট কি একই আছে? নাকি বদলেছে? নিজেকে দ্রুত সামলালাম। মেয়েমানুষের চেহারা দেখার সময় এখন নয়। হো হো চিৎকার করে একদল উন্মত্ত মানুষ উলটোদিকে ছুটে যাচ্ছে। ওরা নিশ্চয় আবার আগুন লাগাবে। গুটিকতক ছেলে আটকে পড়া সারিবদ্ধ গাড়ির কাচ আর হেডলাইট ভাঙছে উৎসবের মেজাজে। ছেলেগুলোর স্কুলে পড়ার বয়েস। গাড়ির ভেতর থেকে মেয়েদের কান্নার আওয়াজ আসছে। ছিটকে ছিটকে নেমে পড়ছে সবাই। মানালিও কি এরকম কোনও গাড়ি থেকেই নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে? হতে পারে। পোড়া বাসের ধোয়ায় চোক করকর করে উঠল। চারপাশ আবছা লাগছে। আমি জামার হাতা তুলে চোখ মুছলাম। কাছেই দোকানের শার্টার পড়ছে কর্কশ আওয়াজে। কে যেন চিৎকার করে বলে উঠল, ‘পালাও পালাও। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে।’
পিছনে চরচর শব্দে টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটল। ধোঁয়ায় বাতাস ভারী। অন্ধকার নামছে। দ্রুত।
আমি কী করব? কী করা উচিত? ভাবতে ভাবতেই মানালির হাত চেপে ধরে বললাম, ‘আসুন।’ তারপর প্রায় ছুটতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতেই বললাম, ‘আরও জোরে।’
হোঁচট খেতে খেতে মানালি কেঁদে উঠল। বলল, “আমি পারছি না।’
এই মেয়ের হাসি দেখেছি। কাঁদলে কেমন লাগে?
খানিকটা ছুটে গিয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে বাঁ হাতে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়লাম দু’জনে। খানিকটা গিয়ে ঝাঁপ ফেলবার মুখে প্রায় জোরজবরদস্তি করে সেঁধিয়ে গেলাম। একটা গোডাউনের ভেতর। ভাঙাচোরা লোহালক্কড়ের গোডাউন। টিমটিমে আলোয় একটা মুটে-মজুর জড়সড় হয়ে বসে রয়েছে। যাক, এতক্ষণে কিছুটা হলেও নিরাপদ। বাইরের গোলমাল না থামা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করা যাবে। মহিলা দেখে কে একজন বসবার জন্য দুটো ব্যাটারির খোলও দিয়ে গেল। না, এই শহরের সবটাই খারাপ হয়ে যায়নি। আমি মানালির মুখের দিকে না তাকিয়ে বললাম, ‘বসুন।’ ক্লান্ত মানালি বসে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হাঁপাতে লাগল। একটা আশ্রয় পেয়ে যেন স্বস্তি পেয়েছে খানিকটা। ছিপছিপে শরীর অনেকটা ভারী হয়েছে মানালির। এখনও কি একই রকম সুন্দরী রয়েছে? বুঝতে পারছি না। আসলে ওর দিকে তাকাতে কেমন একটা লাগছে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মানালি অনেকটা ধাতস্থ হল। হাতের বাহারি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে মোবাইল ফোন বের করে কানে চেপে ধরল সে।
‘…হ্যাঁ, আপাতত সেফ। না না, এখনই তোমাকে আসতে হবে না… এখানে গাড়ি ভাঙচুর চলছে। গোলমাল থামলে আবার ফোন করব… একজন ভদ্রলোক আমাকে রেসকিউ করেছেন… ইন ফ্যাক্ট আই বেগড হিজ হেল্প… খুব সাহসী মানুষ… উনি না থাকলে আজ যে কী হত… তুমি কি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলবে?… নাও বলো…’
মানালি উঠে দাড়িয়ে মোবাইলটা বাড়িয়ে ধরল। নরম, কৃতজ্ঞ গলায় বলল, ‘নিন, একটু কথা বলুন প্লিজ। আমার হাজব্যান্ড। ও আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চায়।’
আমি হাত বাড়িয়ে ফোন নিলাম। মানালির স্বামীকে জায়গার লোকেশনটা বোঝালাম। মোবাইল ফিরিয়ে দিতে দিতে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি এখান থেকে চলে যাব। গোলমাল থামার আগেই চলে যাব। মানালি এখানে থাকলে ওর কোনও অসুবিধা হবে না। নিশ্চয় ওর স্বামীও খানিকক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছোবেন। আমি চাই না মানালি কোনওভাবে আমাকে চিনতে পারুক। ভিতু, অভদ্র শুকনো কাঠের বদলে একজন সাহসী, হৃদয়বান মানুষকে সে চিনেছে। আগুন, হিংসার মধ্যে মানুষ চিনতে পারা সহজ কথা নয়।
অনেক দেরিতে হলেও আমি তার হাতের অদৃশ্য গোলাপ দেখতে পেয়েছি।
বাংলা স্ট্রিট, উৎসব সংখ্যা ১৪১৬