শেষ অশুভ সংকেত – ৯

নয়

ডাউন্‌স দিয়ে ফর্নাব্যাঙ্ক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দিকে গাড়ি ড্রাইভ করছে জন ফ্যাভেল। ওর মনটা আজ বেজায় খুশি। রাতে আকাশটা যেন পরিষ্কার থাকে এটাই সে মনে মনে চাইছিল। নাস্তিক হলেও আবহাওয়ার রিপোর্টটা পড়ে অভ্যাস বশেই খুশিতে খোদাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। আজকের রাতটা অ্যাস্ট্রোনমার হিসেবে তার কাছে অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। তিন তারার মিলন ঘটবে আজ।

একজন পাদরী ধর্মযাজকেরও আসার কথা আছে। আজ রাতে অবজারভেটরিতে উপস্থিত থাকতে দেয়ার জন্যে ফ্যাভেলকে বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সেধে এমন উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেয়ার কোন দরকার ছিল না ব্যাপারটা ভদ্রলোককে জানানোই উচিত হয়নি। সাধারণত অবজারভেটরিতে বাইরের কারও থাকাটা পছন্দ করে না ফ্যাভেল। ওরা কেবল অবুঝের মত অবান্তর প্রশ্ন করে কাজের ব্যাঘাত ঘটায়।

বাঁক ঘুরতেই আকাশের গায়ে বিরাট থালার মত জিনিসটা ফ্যাভেলের চোখে পড়ল। ওর এক বন্ধু একদিন কথায় কথায় বলেছিল পনেরো বছর বিবাহিত জীবন কাটানর পরেও রাতে বিছানায় যাবার আগে স্ত্রীকে কাপড় ছাড়তে দেখলে তার রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। কাজের ব্যাপারে ফ্যাভেলেরও ঠিক তাই।

লিফটে চড়ে উপরে পর্যবেক্ষণ কক্ষে পৌঁছে দেখল তার টেকনিশিয়ান ব্যারি আগেই কাজে লেগে গেছে।

প্রথম দুঘন্টা দিনের রুটিন কাজ সারতে ব্যস্ত থাকল ওরা। কিন্তু কাজে মনোযোগ থাকছে না—বারবার ঘড়ি দেখছে। এই সময়ে দরজার মাথায় আঁটা সংকেত বেজে উঠল। ডেস্কের ওপর রাখা ফোনের রিসিভারটা তুলে কানে লাগাল ব্যারি। অল্পক্ষণ শুনে হাতের তালু দিয়ে ফোন ঢেকে ফ্যাভেলের দিকে ফিরল।

‘পাগলা পাদরী এসে পৌঁছেছে,’ জানাল সে।

‘রূঢ় হয়ো না,’ হেসে বলল ফ্যাভেল, ওঁর ঢোকার জন্যে দরজাটা খুলে দাও।’

‘ওঁ নয়, ওঁরা,’ বলে বোতাম টিপে নিচতলার দরজাটা খুলে দিল সে। ‘কী?’

‘হ্যাঁ, তিন সাধুর আবির্ভাব হয়েছে।

বিরক্ত হয়ে অস্ফুট স্বরে নিজের ভাগ্যকে গালি দিল ফ্যাভেল। ওরা হয়ত সোনা, ধূপধুনো আর সুগন্ধি নিয়ে হাজির হবে বেথলেহেমের সেই তিন সাধুর মত। কিন্তু সায়মন আর অ্যান্টোনিওকে নিয়ে ফাদার ডি কার্লোকে ঘরে ঢুকতে দেখে ওর বিরক্ত দূর হয়ে গেল। মঙ্কদের যেমন হওয়া উচিত তেমনি শান্ত, পবিত্র আর সৌম্য ওঁদের চেহারা।

পরিচয় করিয়ে দিলেন ডি কার্লো।

‘ট্রিনিটির (Tr।n।ty) খবর জানানর জন্যে আমাদের সবার তরফ থেকে আমি আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

‘তার কোন দরকার নেই,’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল ফ্যাভেল। লজ্জা পেয়েছে সে।

ঈশ্বর আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।’

‘কিন্তু ওসবে আমার বিশ্বাস…’

‘তবু তিনি আপনাকে পুরস্কৃত করবেন।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওদের ঘুরিয়ে দেখাতে শুরু করল ফ্যাভেল। টেলিস্কোপ, কমপিউটার, ডাটা প্যানেলের পরে মনিটর দেখানো শেষ করে প্রোজেক্টারে ট্র্যান্সপেরেন্সি বসিয়ে তিন সূর্যের গতিবিধি ব্যাখ্যা করে বোঝাল। এত কথা সে বলছে যে কথার তোড়ে কে কি প্রশ্ন করছে তা তার কানেই ঢুকছে না।

‘জন্মটা ঠিক কোথায় হচ্ছে আমাদের সেটা জানার আগ্রহই সবচেয়ে বেশি,’ বললেন ফাদার।

যন্ত্রে আলোর উজ্জ্বলতা থেকে সেটা আসন্ন এক বর্গগজের মধ্যে বলা সম্ভব।’ টেলিস্কোপের দিকে চেয়ে দেখল ব্যারি একদৃষ্টে তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সময় হয়ে আসছে। পথ দেখিয়ে কামরার অন্যধারে রাখা মনিটর ঘিরে ওদের বসাল ফ্যাভেল।

স্ক্রীনে অসংখ্য গ্রহ-তারা আলোর বিন্দুর মত জ্বলছে।

আপনারা ওই দিকে দেখতে থাকেন,’ বলল ফ্যাভেল। ‘বাকি আর সব আমরা করছি।’

‘সংখ্যাগুলো কি?’ স্ক্রীনের উপরে ডানদিকে দুই সেট সংখ্যা দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন ডি কার্লো

‘দিন, ঘন্টা আর মিনিট,’ বলল ফ্যাভেল। ‘দ্রুতটা সেকেণ্ডের হিসাব।’

স্ক্রীনের সামনে ওদের বসিয়ে রেখে কনসোলে ফিরে গেল ফ্যাভেল। যন্ত্রটা অত্যন্ত জটিল। মহাশূন্যযানের মত অনেক বোতাম আর কলকব্জা রয়েছে ওতে। টেলিস্কোপের কাছে গভীর একাগ্রতা নিয়ে কাজ করে চলেছে ব্যারি! ওদিকে একবার চেয়ে নিজের সামনে রাখা মনিটর দুটোর দিকে নজর দিল ফ্যাভেল। একটায় পশ্চিমাকাশ আর অন্যটায় তার একটা বিশেষ অংশ বড় করে দেখা যাচ্ছে। আড়চোখে কোনার সংখ্যাগুলো দেখে নিয়ে ইন্টারকমের দিকে ঝুঁকে সুইচ অন করল।

‘এক্স-রে চুরাশিতে টিউন কর,’ বলল সে।

পিছনে হেলে একটা নব ঘুরিয়ে মনিটরটা পুরো টিউন করে আবার সামনে ঝুঁকল।

‘ডেক্লিনেশন চুয়াল্লিশ ডিগ্রী, এ আর ফোর ফ্রেমিং।’

টেলিস্কোপ নির্দিষ্ট এলাকা তুলে ধরল। তারামণ্ডলীর ভিতর দিয়ে এত দ্রুত জুম (Zoom) করে এগিয়ে গেল যে ফাদার ডি কার্লোর মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।

‘হোল্ড।

মনিটরের ওপর স্থির হল ছবি।

‘সুপার পোলারাইজিং ফিল্টার ওয়ান এ।‘

স্ক্রীনটার ওপর আলো কমে গেল। সময় চেক করল ফ্যাভেল। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ছবিটা স্থির রইল। তারপর নিচের দুই কোনা আর উপর দিকে ঠিক মাঝখান দিয়ে তিনটে আলোর বিন্দু দ্রুতবেগে পর্দার ওপর হাজির হতে দেখা গেল। ফাদার ডি কার্লো শ্বাস নিতেও ভুলে গেছেন। তাঁর হাত দুটো আপনাআপনি প্রার্থনার ভঙ্গিতে একত্রিত হল।

ধীরে ধীরে আলোগুলো পরস্পরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আলো উজ্জ্বল হতে হতে চোখে অসহ্য হয়ে উঠল। চোখের ওপর হাত দিয়ে একটু পিছিয়ে গেল অ্যান্টোনিও।

‘সুপার পোলারাইজিং ফিল্টার দশ।’ ফ্যাভেলের কণ্ঠস্বর শোন গেল।

আবার আলো কমে গেল। সুর্য তিনটে এগোচ্ছে— ঝকঝকে গলিত তিনটে গোলক। চোখের পাতা ফেললেন ডি কার্লো। মনের চোখ দিয়ে গোলকের পিঠে লিকলিকে আগুনের শিখা খেলতে দেখলেন তিনি। কথা বলার জন্যে ফ্যাভেলের দিকে ফিরে দেখলেন কাজের মধ্যে ডুবে আছে সে। তার কি বক্তব্য বা ঘটনা সম্পর্কে একটা ধারাবিবরণী শুনতে পেলে ভাল হত।

আর একটা নির্দেশ দিল ফ্যাভেল। স্ক্রীনের দৃশ্য পাল্টে আরও কাছে চলে এল। আলোর উজ্জ্বলতা বৃটেনের ওপরই সবচেয়ে বেশি। সূর্যগুলো এক লাইনে এসে পড়ার উপক্রম করছে।

সেকেণ্ডের সংখ্যাগুলোর দিকে ডি কার্লোর চোখ পড়লো :

০০১২

০০১১

০০১০

০০০৯

০০০৮

বুকের ওপর ক্রস চিহ্ন এঁকে দম বন্ধ করে আছেন ডি কার্লো

ফ্যাভেলের চোখ চরকির মত ঘুরছে মনিটর দুটো আর তার কোণের সংখ্যাগুলোর ওপর। আঙুলগুলো ড্রাম বাজিয়ে চলেছে কনসোলের কন্ট্রোলে। সন্ন্যাসী তিনজন, মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে আছে। কারও চোখের পাতাও পড়ছে না।

০০০৩

০০০২

০০০১

০০০০!

মনিটর আলোয় সাদা হয়ে গেল। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে তিনটে উজ্জ্বল আলোর চক্র দক্ষিণ ইংল্যাণ্ডের ওপর দুলছে। তিন সাধুই একসাথে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা শুরু করল। ছোট বাচ্চার মত অঝোরে জল গড়াচ্ছে ফাদার ডি কার্লোর চোখ থেকে।

.

বিশ মাইল উত্তরে ঝাঁকি খেয়ে খাটের ওপর উঠে বসল ডেমিয়েন। পুতুল নাচের পুতুলকে সুতো ধরে টান দেয়া হয়েছে যেন। আধঘন্টা ধরে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে এপাশ-ওপাশ করছিল—সেটাই এখন বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওর সারা শরীর, বিছানার চাদর, এমনকি তোশক পর্যন্ত ঘামে ভিজে উঠেছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল, নীরব চিৎকারে মুখটা হাঁ করা। হাতের আঙুলগুলো চাদরের ভিতর দিয়ে ঊরু খামচে ধরেছে। শূন্য দৃষ্টিতে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে, কিন্তু কিছুই দেখছে না, শুনছে না। বাইরে একটা কুকুর বিকট সুরে মড়াকান্না কাঁদছে। কেউ যেন ওর প্রাণটাই নিংড়ে বের করে নিচ্ছে। ডেমিয়েনের কানে গেল না ওর কান্না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *