শেষ অশুভ সংকেত – ১৩

তেরো

ম্যানর হাউসের সামনে শিকারে বেরোবার আয়োজন চলছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে শিয়াল শিকার করা ইংল্যাণ্ডের একটা বহু পুরানো রেওয়াজ। হাউণ্ড কুকুর গন্ধ শুঁকে শিয়াল খুঁজে বার করে তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে ওকে তাড়া করে শিকার করা হয়। আরোহীরা শেষবারের মত মশলা দেয়া মদে চুমুক দিয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিয়েছে। ঘোড়া আর হাউণ্ডের শ্বাস বাষ্পের মত উপরে উঠে সকালের হালকা কুয়াশার সাথে মিশছে। ঘোড়াগুলো সামনের পা দিয়ে নুড়ি-পাথর সরাচ্ছে আর হাউগুগুলো বাঁধন ছিঁড়ে আগে বাড়ার চেষ্টা করে পরস্পরের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। তর সইছে না ওদের।

ওদের মাঝে একপাশে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে পিটারের কোটের ভাঁজ সমান করে দিচ্ছে কেট। অত্যন্ত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে, ভাবল সে। বুঝছে এতে বিরক্ত হচ্ছে পিটার। শিকারের মত একটা পুরুষোচিত কাজে মায়েরা দখল দিক এটা কেউ চায় না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছু হটে পিটারকে আর সবার সাথে মিশে এক হবার সুযোগ করে দিল কেট। স্বস্তি পাচ্ছে না সে শিকারে গিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মাথাটা ফাটিয়েছে, এমন ঘটনা তো অহরহই শোনা যায়…

উঁচু স্বরে বাঁশি বাজার শব্দে ফিরে তাকাল কেট। ঘর থেকে বেরিয়ে একটা চমৎকার তেজী গেল্ডিং ঘোড়ার দিকে এগোচ্ছে ডেমিয়েন। ঘোড়াটা দাঁত বের করে বিস্ফারিত চোখে পিছিয়ে গেল। ভয়ের গন্ধ পেয়ে অন্য ঘোড়াগুলোও একটু অস্থির হয়ে উঠল। লাফিয়ে পিছনের দু’পায়ে দাঁড়িয়ে একটা ঘোড়া তার আরোহীকে মাটিতে ফেলে দিল। বাকিগুলো নাক ফোলাচ্ছে আর নাক ঝাড়ছে।

কেটের আশেপাশে লোকজন উত্তেজিত স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। ঘোড়াগুলোর আজ কী হল? বলাবলি করছে ওরা। এমনিতে ওরা খুব শান্ত—কখনও এমন করে না। আস্তাবলের লোক কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ডেমিয়েনের ঘোড়াটাকে শান্ত করে ফেলল। পাদানিতে পা রেখে জিনের ওপর উঠে বসল ডেমিয়েন। জামাকাপড় ভিন্ন হলেও ওকে দেখে ওয়েস্টার্ন ছবির নায়কের কথা কেটের মনে পড়ছে। জিনের ওপর এঁটে বসার ধরন দেখে তাই মনে হয়। আমেরিকানদের ঘোড়ায় চড়ার স্টাইলটাই আলাদা। কিন্তু এভাবেই তাকে বেশি মানাচ্ছে এটা মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল সে। দু’জন ফটোগ্রাফার বিভিন্ন কোণ থেকে ডেমিয়েনের ছবি তুলছে। কেট হাসল-ছবিগুলো সুন্দর দেখাবে খবরের কাগজে–হন্তার বেশে ইউ এস অ্যামব্যাসেডর-এই ধরনেরই ক্যাপশন দেয় কাগজওয়ালারা।

ছোট বলে পিটারকে একটা টাট্টু ঘোড়া দেয়া হয়েছে। পেশাদার জকির মত লাফিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে মায়ের দিকে চেয়ে হাসল সে। কেট এগিয়ে গেল ওর পাশে।

‘পিছনের দিকে সুজানের কাছাকাছি থেকো তুমি,’ মাথা নেড়ে ইশারায় পাশের ছোট মেয়ারে চড়া মেয়েকে দেখাল কেট। ‘ডেমিয়েনকে বাহাদুরি দেখাতে আগে যেয়ো না।

‘মোটেও না,’ বলে একটা সুন্দর মিষ্টি হাসি দিল পিটার। কিন্তু কেট তার ছেলেকে চেনে, এখন কথা দিল বটে, কিন্তু একটু আগে বেড়ে চোখের আড়াল হলেই সে নিজের খুশিমত চলবে।

‘চিন্তা কোরো না, পিটার,’ মেয়েটা ঝুঁকে টাট্টুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ‘রক্তাক্ত করা হবে তোমাকে।

‘তার মানে?’ প্রশ্ন করল পিটার।

যারা প্রথমবারের মত শিকারে যায়, শিকার পাওয়া গেলে শিয়ালের রক্ত তাদের গালে মেখে দেয়া হয়,’ ব্যাখ্যা দিল সুজান।

শিঙা বেজে উঠল। ‘সাবধানে দেখেশুনে চল,’ বলল কেট।

‘আমার জন্যে সবসময়ে এত ভাব কেন?’ বলেই আগে বাড়ার জন্যে গোড়ালি দিয়ে টাট্রর পেটে গুঁতো দিল পিটার।

লাফিয়ে রওনা হল ঘোড়া। ‘ভালবাসি বলেই ভাবি। আর যে কেউ নেই,’ বলল কেট।

হাউণ্ড আর ঘোড়াগুলো খোলা মাঠের দিকে এগিয়ে গেল।

একটা পাহাড়ের গোড়ায় চলে এসেছে শিকারীরা। দলপতির পাশে পাশেই রয়েছে ডেমিয়েন। শিকারের ব্যাপারেই আলাপ করছে ওরা। অনেক দিন হল কোন শিকার পাওয়া যায়নি, জানাল মাস্টার। হতচ্ছাড়া শিয়ালগুলো আজকাল চালাক হয়ে গেছে।

পাহাড়ের মাথায় উঠে পিছন ফিরে মাথা গুনল ডেমিয়েন। মোট পঁচিশজন। পিছনে পিটার রয়েছে সুজানের সাথে। হাত নাড়ল পিটার, জবাবে হাত উঠিয়ে সালাম জানাল সে। ঘুরে দেখল মাস্টার সিকি মাইল দূরে একটা জংলা জায়পার দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করছে। বুড়ো কুকুরের মতই নাক টেনে গন্ধ শুঁকে হাউগুগুলোকে ঢাল বেয়ে পাঠিয়ে দিল। মাটিতে নাক লাগিয়ে শুঁকতে শুঁকতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে হাউণ্ড। আবদ্ধ কেনেল থেকে ছাড়া পেয়ে ওরা খুব খুশি।

জঙ্গলের ভিতর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কুকুর। শিকারীরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে পাহাড়ের মাথায়। কেউ বসে, কেউবা পাদানির ওপর দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীরবতা ভঙ্গ হল। মাথা তুলে ডাক ছাড়ল হাউণ্ডের দল। শিঙা ফুঁকে ঢাল বেয়ে ছুটল মাস্টার। পিছনে ডেমিয়েন আর তার পিছনে বাকি সবাই। একটা চিৎকার, আর সেই সাথে দপ করে কিছু পড়ার শব্দে পিছন ফিরে চাইল ডেমিয়েন। দেখল একজন তরুণ আরোহী চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে। পিটারকে খুঁজে বের করে সে ঠিক আছে দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হল।

শিয়ালটাকে ডেমিয়েনই প্রথম দেখল। চোখ সরু হয়ে নাক ফুলে উঠল ওর। গলা খাঁকারি দিল কিন্তু কিছু বলল না। মাস্টারকেই কৃতিত্ব নেয়ার সুযোগ দিতে চায়। কয়েক সেকেণ্ড পরেই লোকটা চিৎকার করে উঠে ঝোপের ভিতর দিয়ে হাউণ্ডের পিছনে ঘোড়া ছোটাল। মরিচা রঙের ছোট জন্তুটা ছুটে মাঠ পাড়ি দিচ্ছে।

ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে শিয়ালটাকে তাড়া করল ডেমিয়েন। অল্পক্ষণেই সবাইকে ছাড়িয়ে আগে চলে এল–কুঁজো হয়ে ঝুঁকে ঘোড়ার ঘাড়ের সাথে প্রায় মিশে রয়েছে সে। এক মিনিট পরে হাউণ্ডের দলটাকে ধরে ফেলে পিছনের কয়েকটা কুকুরকে ছাড়িয়ে গেল।

দলের সবাই ওর ঘোড়া চালানোর দক্ষতা দেখে অবাক হয়েছে। বড় গেল্ডিঙটাকে কেউ কখনও এত জোরে ছুটতে দেখেনি।

আরও আধ মাইল আগে, ব্রাদার অ্যান্টোনিও চোখ থেকে দূরবীন নামিয়ে খুশি হয়ে মুচকে হাসল।

জঙ্গলের দিক থেকে এদিকে আসতে একটা বেড়া মাঠটাকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। ওরই সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যান্টোনিও। তাদের প্ল্যান মতই এগোচ্ছে সব। ওরা আন্দাজ করেছিল ডেমিয়েনই সবার আগে থাকবে—তাই হয়েছে।

ঘুরে ঘোড়ার পিঠে উঠে একশো গজ দূরে গাছগুলোর দিকে এগোল সে শটগানের কুঁদোটা পমেলের সাথে বাঁধা খাঁচার সাথে বাড়ি খেল। খাঁচার ভিতরে শিয়ালটা ওর দিকে চেয়ে দাঁত বের করে ভেঙচি কাটল। পাহাড়ের গুহার মুখে ফাঁদ পেতে অন্য মুখ দিয়ে একটা টেরিয়ার কুকুর লেলিয়ে দিয়ে শিয়ালটাকে সে নিজেই ধরেছে। ডেমিয়েনকে মারার চমৎকার একটা ফন্দি এঁটেছে ওরা!

গাছগুলোর আড়ালে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখে পিঠ থেকে বন্দুকটা নামিয়ে কাঁধে ঠেকাল। পাহাড় থেকে নেমে আসা ট্র্যাকের দিকে তাক করে জিভ চাটল ইস, কাজটা যদি এত সোজা হত! ভাবল সে। গুলি করে কাজটা সারা গেলেই ভাল ছিল।

শিয়ালটা ছুটে তাক করা বন্দুকের লাইনে এসে পড়ল। ট্রিগার টিপল অ্যান্টোনিও। লাফিয়ে উঠে উল্টে পড়ল শিয়াল। আবার গুলি করল সে। জানে গুলির শব্দে অবাক হবে না কেউ—ভাববে কোন কৃষক কাক মারছে।

দৌড়ে গিয়ে মরা শিয়ালটাকে নিয়ে এসে একটা ঝোপের মধ্যে ফেলল। পমেল থেকে খাঁচাটা নিয়ে আবার ছুটে গেল ট্র্যাকের ওপর। হাউণ্ডের ডাক শোনা যাচ্ছে—প্রায় এসে পড়েছে ওরা। তাড়াতাড়ি খাঁচা খুলে দিতেই ছাড়া পেয়ে ট্র্যাক ধরে বেড়ার ডানদিক দিয়ে ছুটল শিয়ালটা।

চট করে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে চেয়ে দেখল অগ্রগামী কুকুরগুলোকে এখন দেখা যাচ্ছে। ডেমিয়েনও রয়েছে ওদের সাথে। অ্যান্টোনিওর ছাড়া শিয়ালটার পিছনে ছুটছে ওরা।

মরা শিয়ালটার লেজে দড়ি বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে ওটাকে হাউণ্ডের প্রধান গোছার ভিতর দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে গেল। বিভ্রান্ত হাউণ্ডের দলটা বিশৃঙ্খল হয়ে অ্যান্টোনিওর ঘোড়ার সাথে বাঁধা মরা শিয়ালটারই পিছু নিল। দশ গজ এগিয়ে বেড়ার বাম দিকের পথ ধরে ঘোড়া ছুটাল সে। পিছনে হাউণ্ডের দল।

এখন পিছনে অন্যান্য সবার ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছে অ্যান্টোনিও। অন্ধের মত সবাই হাউণ্ডের পিছন পিছন মরা শিয়ালটাকেই অনুসরণ করছে। চালাকিটা কাজে লেগেছে—ওদের বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছে সে।

দ্রুত ছুটতে ছুটতেই এক হাতে দড়ি গুটিয়ে শিয়ালটাকে টেনে নিল। পাহাড়টা খাড়া বিশ ফুট নেমে গেছে। দড়ি খুলে শিয়ালটাকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিল। ওটা কোথায় পড়ল দেখার জন্যে থামল না সে। দাঁড়িয়ে উপভোগ করার সময় তার নেই। একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে ছুটতে হবে…

ঝুঁকে, ঘোড়ার পিঠের সাথে প্রায় মিশে আছে ডেমিয়েন। মুখ দিয়ে শব্দ করে ঘোড়াটাকে আরও জোরে ছুটতে উৎসাহিত করছে। এখন শিয়ালটাকে দেখতে পাচ্ছে। অবাক হচ্ছে জন্তুটার অস্বাভাবিক দম দেখে। তার মনে হচ্ছে ওটা যেন এখন আরও জোরে ছুটছে। জঙ্গল পাতলা হয়ে এল। সামনে দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে একটা সরু গিরিপথ চলে গেছে। শিয়ালটা ওই পথেই ছুটল।

ঘোড়াটাকে আরও জোরে চালাবার জন্যে হাতের বেতটা দিয়ে কষে ওর পাছায় মারল ডেমিয়েন। গিরিপথটা পেরোলেই খোলা মাঠ। শিয়ালটা লুকাবার কোন জায়গা পাবে না।

শিয়ালটা এবারে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে আরম্ভ করল। ডেমিয়েন ওকে ধাওয়া করে উপরে উঠছে। এদিকটায় পাহাড়টা প্রায় খাড়া হয়ে নেমে গেছে নিচে। আরও খানিকটা উঠে নিজের আস্তানায় ঢুকে গেল শিয়াল।

নিজের ভাগ্যকে গাল দিয়ে লাগাম টেনে ঘোড়াটাকে থামাল সে। হাউগুলো ওকে পার হয়ে ছুটে এগিয়ে গিয়ে গুহার মুখের সামনে নিষ্ফল আক্রোশে ঘেউ ঘেউ করছে।

ঘোড়া থেকে নেমে হ্যাট খুলে ভুরু মুছল ডেমিয়েন। পরিশ্রমে জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। মাস্টার ঠিকই বলেছিল। আজও শিয়ালের নাগাল পাওয়া গেল না— চালাক হয়ে গেছে ওরা। এগিয়ে গিয়ে হাউগুগুলোকে ঠেলে সরিয়ে গুহার ভিতর উঁকি দিল সে। ভিতরটা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুখ ফিরিয়ে চেয়ে দেখল একটা লোক উপর থেকে তার দিকে আসছে। লোকটার পরনে মস্কের আলখাল্লা—হাতে উক্ত ছুরি!

ঘুরল ডেমিয়েন। দেখল সে যে পথ দিয়ে উঠেছে সেই পথ দিয়েই ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে আসছে আর একজন মঙ্ক। এর হাতেও রয়েছে একটা ছুরি।

আড়ষ্ট হল ডেমিয়েন। তাহলে ওরা তাকে ফাঁদে ফেলেছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না এটা কি করে সম্ভব হল। শিয়ালটা যে এখানেই আসবে সেটা ওরা কিভাবে জানল? কিন্তু সেসব চিন্তা করার সময় এখন নেই। সামনে এবং পিছনে দু’দিক থেকে এগিয়ে আসছে ওরা—পালাবার কোন পথ নেই।

আড়চোখে হাউগুগুলোর দিকে চাইল সে। কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা লোকটার মুখে সাফল্যের হাসি ফুটে উঠেছে। মাত্র দশ গজ দূরে রয়েছে লোকটা। চোখ নামিয়ে ওর ঘোড়াটার দিকে চাইল ডেমিয়েন। চোখের পাতা পড়ছে না। গভীর একাগ্রতা নিয়ে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করছে। কল্পনায় অনেকগুলো শিয়াল একটা ঘোড়াকে তাড়া করছে দেখতে পাচ্ছে। প্রায় ধরে ফেলেছে— খুরে কামড় বসাবার চেষ্টা করছে। পিছনের দুই পায়ে লাফিয়ে উঠে পড়ে গিয়ে পা ভাঙল আতঙ্কিত ঘোড়াটা। আর নড়তে পারছে না সে। নরম পেট কামড়ে ছিন্নভিন্ন করে ওর নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলল শিয়ালের দল। অসহায় চোখে দেখছে আর যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।

হঠাৎ থেমে দাঁড়াল ঘোড়াটা। চোখ দুটো বিস্ফারিত, ঝাড়া দিয়ে ডেমিয়েনের দৃষ্টিপথ থেকে মাথা সরিয়ে নিতে চাইছে। অপ্রত্যাশিত ভাবে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে অ্যান্টোনিওকে পিঠ থেকে ফেলে দিল। খাড়া পাহাড়ের কিনারার ওপর ওর দেহটা এক সেকেণ্ড দুলে উল্টে নিচের দিকে রওনা হল। ওর হাত দুটো শূন্যে কিছু ধরে পতন ঠেকানোর চেষ্টা করল। গলা চিরে বেরিয়ে এল একটা চিৎকার। তারপর অদৃশ্য হল।

ঘুরে দাঁড়াল ডেমিয়েন। তরুণ মঙ্ক তার থেকে কয়েক গজ দূরে থেমে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সে নিচের দিকে চেয়ে দেখছে। চিৎকারটা থেমে গেছে। ডেমিয়েনের দিকে ফিরে তাকাল বিক্ষুব্ধ মঙ্ক। ছুরিটাকে শক্ত মুঠোয় ধরে হাউগুগুলোর ভিতর দিয়ে এগোল সে।

নড়ল না ডেমিয়েন। ওর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সবচেয়ে বড় হাউওটার ওপর আবার সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত হল। এবারে ভিন্ন দৃশ্য দেখছে সে। কুকুরটা মুখ তুলে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। তারপর ওর মাথাটা একটু কাত হল—হাঁপাচ্ছে, চোখ দুটো সরু হল। এক মুহূর্ত স্থির থেকে কুকুরটা ঘুরল। ওর থেকে এক গজ দূরে সায়মন। দ্বিধা না করে বিরাট হাউণ্ডটা ওর কণ্ঠা লক্ষ্য করে লাফ দিল। মিস করে কাঁধে কামড় বসাল। আলখাল্লার কিছুটা ছিঁড়ে নেমে এল। ছুরি ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল সায়মন। বিস্মিত চোখে নিজের ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের দিকে বোকার মত চেয়ে আছে সে। এক মুহূর্ত যেন সব কিছু স্থির থাকল, কিন্তু পরবর্তী মুহূর্তেই রক্তের গন্ধ পেয়ে সব ক’টা হাউণ্ড একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। চাপের মুখে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল সায়মন। আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে দু’হাতে একটা হাউণ্ডের গলা টিপে ধরল। হাঁ করা মুখটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। ঝিমিয়ে পড়ল ওটা-কিন্তু বাকিগুলো কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল ওকে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল সে। কুকুরগুলোর দেহের আড়ালে চাপা পড়ে গেল ওর চিৎকার।

মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যেই একটা কুকুর কামড়ে ওর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলল। রক্তের স্বাদ পেয়ে, দেহটা স্থির হয়ে যাওয়ার পরও কুকুরগুলো থামল না।

হাউণ্ডের জন্য সকালটা পুরোপুরি বিফল হয়নি।

.

ম্যানর হাউসে ফিরে মায়ের কাছে আক্ষেপ করছে পিটার।

‘ডেমিয়েন নিশ্চয়ই আর একটা শিয়ালের পিছনে গেছে,’ বলল সে। আমাদেরটা পাহাড় থেকে পড়ে নদীর স্রোতে ভেসে গেছে।

কাঁধ ঝাঁকাল কেট। ‘আমি হলেও কুকুরের কামড়ে ছিন্নভিন্ন হওয়ার চেয়ে ডুবে মরাই বেছে নিতাম।’ পিটারের দিকে চেয়ে হাসল সে। ‘এটা অবশ্য আমার নিজস্ব মত।

জবাবে পিটারও হাসল। রসবোধ দু’জনেরই আছে। গুণটা পিটারের বেড়ে ওঠার সময়টাতে অনেক কাজে দেবে। আদর করে পিটারের হাতটা টিপে দিল সে। ওর কাঁধের ওপর দিয়ে পিছন দিকে কি যেন দেখছে পিটার। ঘুরে দেখল ঘোড়ার পিঠে ডেমিয়েন ফিরে আসছে। পিছনে কয়েকটা হাউণ্ড। ওদের মুখ রক্তাক্ত।

ছুটে ডেমিয়নের দিকে এগিয়ে গেল পিটার।

‘একটা শিকার পেয়েছ তুমি!’ পিটারের কণ্ঠে সম্ভ্রম।

‘কিন্তু হাউগুগুলো দেখাবার মত কিছু অবশিষ্ট রাখেনি,’ বলল ডেমিয়েন ‘তোমার জন্যে কেবল খানিকটা রক্ত আনতে পেরেছি।

পকেটে হাত দিয়ে একটা রক্তে ভেজা রুমাল বের করল ডেমিয়েন।

‘তোমার শিকারের রক্ত আমাকে মাখালেও কি একই কাজ হবে?’ মুখ তুলে ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল পিটার।

‘এতে অন্তত আমার খাতায় তোমার নাম লেখা হবে,’ বলে, ঝুঁকে পিটারের গালে রক্ত মাখিয়ে দিল সে। গাল ছুঁয়ে আঙুল ঠোঁটে চেপে ধরল পিটার।

একশো গজ দূরে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করল কেট…কিন্তু যা দেখল তা তার ভাল লাগল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *