শেষ অশুভ সংকেত – ১৭

সতেরো

লক্ষণগুলো চেনে হারভি ডীন। পাগল হওয়ার দশা হয়েছে ওর। দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পায়, কিন্তু জেগে উঠতেও সাহস হয় না। কাজে যেতে ক্লান্তি আসে আর ডেমিয়েন উপস্থিত থাকলে তটস্থ থাকে। সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেও পায়নি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তার। নিজের ভবিষ্যৎ এখন তার হাতের বাইরে। সুখ অন্যের হাতে।

মুশকিল হচ্ছে বুঝতে পারছে ছেলেটাকে খুব বেশি ভালবাসে সে। ওর সবকিছুই তার কাছে ভাল লাগে। পুতুলের মত ছোট ছোট পায়ের নখ থেকে শুরু করে রেশমের মত নরম চুল পর্যন্ত সব ভাল লাগে। বাচ্চাকে সে বারবারার চেয়ে, এমনকি ডেমিয়েনের চেয়েও বেশি ভালবাসে। ওকে নিয়ে যদি কোথাও পালিয়েও যায় তবু শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা পড়তেই হবে। আর পালিয়ে গেলে ডেমিয়েনের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করা হবে-ডেমিয়েনের চোখে সেটা সবচেয়ে বড় অপরাধ।

এতসবের পরেও বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত ইসরাইলী অপারেশনটাও ভেস্তে যেতে বসেছে।

রিসিভারের ভিতর ঘোঁৎ করে একটা আওয়াজ করে ডেমিয়েনের দিকে চাইল ডীন। ইসরাইলীরা শ্রোয়ডারের চালাকি ধরে ফেলেছে,’ বলল সে। ‘এখন তার থেকে কোন কথা বের করার আগেই তাকে সরিয়ে ফেলা দরকার।’

কাগজ থেকে মুখ না তুলেই ডেমিয়েন বলল, ‘তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর।’

‘আমরা ওর কাছেই ঘেঁষতে পারছি না। ওকে তেল-আবিবে রাখা হয়েছে—একাজ এখন আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।’

‘তুমি পারবে।‘

‘কিন্তু বললাম তো…’

‘আমিও বলেছি,’ বলল ডেমিয়েন। এতক্ষণ পরে মুখ তুলে চাইল সে। ওর দৃষ্টি যেন ডীনের গায়ে বিধছে। ‘তোমাকে আগেই বলেছি এক একটা দিন নাজারীন বাঁচবে আর আমার শক্তিও একটু একটু করে কমে যেতে থাকবে।’

ঢোক গিলল ডীন। কথাটা সে না বললেই ভাল ছিল। আবার সেই পুরানো বিষয়টাই এসে পড়ল। ডেমিয়েন যা বলে তাই কর, ডীন, ভাবল সে। ঢেউ দিও না।

‘আর কয়টা ছেলে বাকি?’ জিজ্ঞেস করল ডেমিয়েন

‘মাত্র একটা বা দুটো।’ দয়া করে আর না—মনে মনে প্রার্থনা করল ডীন।

‘তোমার ছেলে সহ।‘

‘আমার ছেলে?’ তাড়াতাড়ি বলে উঠল সে। ‘ আমি তো বলেছি আমার ছেলে তেইশে মার্চ জন্মেছে। বিশ্বাস করেন সে…’

‘নাজারীনকে ধ্বংস কর, তখন বিশ্বাস করব।’

ফোন বেজে উঠল। থাবা দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল ডীন। ওই কথা থেকে আপাতত রেহাই পেয়ে বাঁচল। আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে কল-বক্স থেকে কেউ ফোন করছে। কে হতে পারে? সাধারণ মানুষের এই নাম্বারটা জানার কথা নয়।

‘হ্যাঁ,’ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে। ‘কে?’

ডেমিয়েনের দিকে ফিরল সে। ‘কেট রেনল্ডসের ছেলে পিটার-পাবলিক টেলিফোন থেকে রিঙ করেছে।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর দিকে এগিয়ে এল ডেমিয়েন।

‘এই নাম্বার ও কি করে জানল?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ডীন।

‘আমি দিয়েছি। আপত্তি আছে?’

কাঁধ ঝাঁকাল ডীন। তার কি দরকার ছিল জানার? অদম্য কৌতূহলই তাকে একদিন শেষ করবে।

ওদের মাঝে কি কথা হয় সেটা না শোনার ভান করছে ডীন। ডেমিয়েন যদি একটা লোককে অনুসরণ করতে অনুরোধ জানায় ওই পিটার ছোঁড়াকে, তাতে তার কি? কেউ যেন টের না পায় এজন্যে সাবধান থাকতে বলছে-এতেও তার কিছু আসে যায় না।

ফোন রেখে দিল ডেমিয়েন। আবার যেন আগের কথায় ফিরে না যায় সে বিষয়ে সচেষ্ট হল ডীন।

‘ওর মা সকালে টেলিফোন করেছিল, আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিল—আমি কোনমতে ঠেকিয়েছি…’

‘আমাকে জানাওনি কেন?’ চটে উঠল ডেমিয়েন। ‘ওর সাথে আমার কথা বলার দরকার ছিল।‘

‘মেয়েটা সাংঘাতিক,’ নাছোড়বান্দা ডীন। ‘ওর টেলিভিশন শো যথেষ্ট ভজঘট বাধিয়েছে…’

‘কে বিপদজনক আর কে নয় সেটার বিচার আমি করব,’ রাগে কালচে হয়ে গেছে ডেমিয়েনের মুখ। ‘এক্ষুনি ওকে ফোন করে আজ দুপুরেই আমার বাসায় আসতে বল। কিন্তু পিটারের ব্যাপারে ওকে কিছু জানিও না।

কাঁধ ঝাঁকাল ডীন। আপনি যেমন বলেন তাই হবে,’ বলল সে। ডেমিয়েনকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।

.

অফিস থেকে সেই রাতে একটু তাড়াতাড়িই বেরুল ডীন। ওর মন ভয় আর উৎকণ্ঠার মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। সন্ধ্যার যানবাহনের ভিড় ছেড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে হীথের নির্মল হাওয়ায় এসে কিছুটা আশ্বস্ত হল। বাড়ি ফিরে যেতে খুব ভাল লাগছে তার। ভাবছে, টেলিফোনটা না থাকলেই ভাল ছিল—তবে আর ডেমিয়েন থর্ন তার নিরিবিলি অবসর পণ্ড করার সুযোগ পেত না। সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে যদি পৃথিবীর সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যেত! আজ সে আর বারবারা ডিনার সেরেই সকাল সকাল বিছানায় যাবে। তার স্ত্রী শহরের সচবেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে নয়, হয়ত একট সেকেলেও। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। সহজ সরল সেকেলে মেয়ে, যে তাকে ভালবাসে, এমন—একজনের সান্নিধ্যই আজ তার কাম্য।

গাড়ি গ্যারাজে রেখে ঘরে ঢুকে উপর তলার উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল।

কোন জবাব নেই। রান্নাঘর বা খাবার ঘরেও কেউ নেই। হয়ত বাইরে গেছে। কিন্তু বাইরে গেলে লিখে রেখে যায়। গ্লাসে খানিকটা হুইস্কি ঢেলে নিয়ে দোতলায় নিজের স্টাডির দিকে রওনা হল সে। ঠেলে দরজাটা খুলেই পাথর হয়ে জমে গেল। সারা ঘর এলোমেলো হয়ে রয়েছে।

তারই চেয়ারে বসে আছে বারবারা। কোলে বাচ্চা। ঘরময় ছিটিয়ে রয়েছে তার কাগজপত্র। ফাইলিং ক্যাবিনেটটা লুট হয়েছে-ড্রয়ারগুলো সব খোলা।

‘ব্যাপারটা কি?’ বলে ঘরের মধ্যে এক পা এগোল ডীন। সুই চেয়ারটা ঘুরিয়ে ওর দিকে ফিরল বারবারা। বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠল সে। মুখটা ঘৃণায় বিকৃত। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলে রয়েছে।

‘ওর কাছেও এসো না তুমি…’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘খুনী!’

দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়েই যেন থেমে দাঁড়াল ডীন। চোখের পাতা পড়ল।

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

আরও এক পা আগে বাড়ল সে। হাত বাড়িয়ে কাগজ কাটার ছুরিটা তুলে নিল বারবারা। আবার থামল ডীন। অপ্রত্যাশিত ধাক্কায় একেবারে সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ।

‘ওর ওপর হাত তুলেছ কি একেবারে খুন করে ফেলব। অন্য বাচ্চাদের খুন করে রেহাই পেয়েছ কিন্তু খোকনকে মারতে পারবে না।’

প্রতিবাদ করতে মুখ খুলেছিল সে কিন্তু কিছুই বলতে পারল না।

‘আজ বিকেলে একজন প্রীস্ট এসেছিলেন, ডেমিয়েন সম্পর্কে তিনি আমাকে সাবধান করেছেন,’ বলল সে। ‘সে যে আসলে কে তাও জেনেছি আমি। একই দিনে জন্ম বলে আমার ছেলেকেও সে হত্যা করবে অন্যান্য বাচ্চাগুলোর মত।’

‘একজন পাগল প্রীস্ট এসে আবোল-তাবোল যা খুশি বলল আর তুমি তাই বিশ্বাস…’

কথা শেষ হতে দিল না বরাবারা। ‘না!’ বলল সে। ‘আমার কাছে প্রমাণ আছে।’ ছুরিটা টেবিলের ওপর রেখে বার্থ সার্টিফিকেটগুলো বাড়িয়ে দিল।

বলার আর কিছু থাকল না। মাথা নেড়ে হাত দিয়ে মুখ মুছল ডীন। অসহায় আর রিক্ত দেখাচ্ছে ওকে। উঠে দাঁড়াল বারবারা, আবার তার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করেছে-রাগ আর নেই।

‘ঈশ্বরের দোহাই, হারভি, ডেমিয়েনকে ধ্বংস করায় প্রীস্টকে তোমার সাহায্য করতেই হবে।’ মুখ তুলে স্ত্রীর দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল ডীন। ওর কাছ থেকে মৌন সম্মতি পেয়ে উৎসাহিত হয়ে কাছে এগিয়ে গেল বারবারা। ‘প্রীস্ট বলেছেন তুমি পারবে-ডেমিয়েন তোমাকে বিশ্বাস করে। প্লীজ, হারডি, ঈশ্বরের দোহাই, তোমার ছেলের দোহাই তুমি তাঁর সাথে যোগযোগ কর।’

দু’ হাত বাড়িয়ে বারবারাকে জড়িয়ে ধরল ডীন। লণ্ডভণ্ড ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবেশে দুলছে ওরা। বাচ্চাটা মাঝখানে ওদের দিকে চেয়ে হাসছে-আর ডীনের চুল টানছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *