শেষ অশুভ সংকেত – ১

এক

জ্যোতির্বিদ জন ফ্যাভেল ধার্মিক নয়। ছেলেবেলায় অবশ্য সে-ও বাপ-মায়ের মত ঈশ্বরে বিশ্বাস করত, কিন্তু বড় হয়ে ওসব ছেলেমানুষী ছেড়ে দিয়েছে। তার মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ফিজিক্স আর ম্যাথামেটিক্স-এর একটা জটিল ধাঁধা। তাই টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে সে কেবল আকাশই দেখে—স্বর্গ দেখার চেষ্টা করে না। সাসেক্স ডাউন্সের ফার্নব্যাঙ্ক অবজারভেটরির দুশো ইঞ্চি টেলিস্কোপটা এমনিতেই একটা জটিল জিনিস, এর সাথে আধ্যাত্মিক চিন্তা যুক্ত করে ব্যাপারটাকে আরও ঘোরাল না করাই ভাল।

আজ রাতে আকাশটা একেবারে পরিষ্কার। একটুও মেঘ নেই। রোজকার রুটিন বাঁধা কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এমন ধীরে সুস্থে আকাশ সার্ভে করে বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের ছবি তুলে একটা কমিক মানচিত্র তৈরির কাজ এগিয়ে রাখবে সে।

কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে আড়চোখে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নিল ফ্যাভেল। পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করছে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে। বিশাল টেলিস্কোপের পাশে তার টেকনিশিয়ান কন্ট্রোল প্যানেলে বসে নির্দেশের অপেক্ষায় জনের দিকে চেয়ে আছে।

নিজের ডেস্কের ওপর ঝুঁকে টেলিভিশন মনিটরের দিকে মেনোযোগ দিল জন।

‘আজকে কোন্‌দিক?’ প্রশ্ন করল সে।

‘ক্যাসিওপিয়া, স্যার,’ সাথে সাথেই জবাব দিল টেকনিশিয়ান।

একটা স্মৃতি যেন ওর মনকে নাড়া দিল, কিন্তু কিছুতেই ব্যাপারটা মনে করতে পারছে না। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎই চিন্তাটা ওর মাথা থেকে বিদায় নিল। টেলিভিশন স্ক্রীনের সামনে নড়েচড়ে স্থির হয়ে বসল জন ফ্যাভেল।

‘ক্যাসিওপিয়া,’ পুনরাবৃত্তি করল জন। উন্নতি—এক ঘন্টা ষোলো মিনিট বারো সেকেঞ্জে অবনতি-বাইশ ডিগ্রী, আট অনুপাত চার।’

টেলিভিশনের পর্দায় সঠিক এলাকার চিত্রটা ফুটে উঠতেই সন্তুষ্ট হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে আবার নির্দেশ দিয়ে চলল সে। গত পাঁচ বছর ধরে প্রায় প্রতি রাতে একই কাজ করে আসছে।

‘ব্যস। ছবি নাও।’

ডেস্ক ছেড়ে টেলিস্কোপের পাশে গিয়ে দাঁড়াল জন। অল্পক্ষণ পরেই শ্যুট দিয়ে ছবি বেরিয়ে এল। যত্নের সাথে সেটা তুলে নিয়ে আলোকিত ঘোলাটে কাঁচের ওপর বসিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।

চোখ দুটো ছোট করে নাক টানল সে।

‘আশ্চর্য,’ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল জন। খুব আস্তে হলেও তাতেই টেকনিশিয়ান ওর দিকে ঘুরে তাকাল।

‘সেদিন ঠিক এই জায়গারই আর একটা ছবি তোলা হয়েছিল না?’

মাথা ঝাঁকাল টেকনিশিয়ান, ‘সোমবারে, স্যার।’

ফাইলিং ক্যাবিনেট ঘেঁটে ছবিটা বের করে এগিয়ে দিল সে। ছবিটাকে অন্যটার উপর রেখে চোখের পাতা ফেলল জন।

‘অনেকটা সরে গেছে—তিনটে সূর্য,’ স্বগতোক্তি করল জন ফ্যাভেল।

সচকিত হয়ে ঘুরল টেকনিশিয়ান।

মুখ তুলে চাইল জন। উত্তেজনায় ওর মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে। ওই এলাকার যত ছবি আছে সব বের কর।

ফাইলিং ক্যাবিনেট ঘাঁটতে শুরু করল লোকটা। কিছুক্ষণ ওকে দেখে টেলিস্কোপের পাশে সরে গিয়ে উদাস চোখে আকাশের তারাগুলোর দিকে চেয়ে রইল জন। একমাত্র অঙ্ক আর ফিজিক্সই ঠিক আর নির্ভুল বলে বিশ্বাস করে সে। কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তবু ডিনারে, পার্টিতে লোকজন তাকে অবান্তর আর উদ্ভট সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। ফ্লাইং সসার, অন্য গ্রহে মানুষ; এই সবের অস্তিত্ব আছে কিনা জানতে চায়। মূর্খ লোকই এসব কাল্পনিক আলোচনায় উত্তেজিত বোধ করে। মাঝে মাঝে ওদের প্রতি অবজ্ঞা লুকানো জনের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে ওঠে।

একগাদা ট্র্যান্সপেরেন্সি হাতে জনের সামনে এসে দাঁড়াল ওর অ্যাসিস্টেন্ট। ওগুলো পরীক্ষা করে দেখে চোখ তুলে টেকনিশিয়ানের দিকে চাইল সে।

‘তোমার কি মনে হয়?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে হাসল সে। বলল, ‘মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি।’

‘ঠিক তাই।’ হাতের ইশারায় মনিটর দেখাল জন। ত্বরণের বেগ কত?’

মনিটরের দিকে মনোযোগ দিল যুবক। ‘কমপক্ষে সেকেণ্ডে দুহাজার,’ ফিরে চাইল সে। ‘ভীষণ একটা সংঘর্ষ হবে।’

অস্থির বিরক্তিতে মাথা নাড়ল জন। ‘সংঘর্ষ নয়, এক লাইনে হতে চলেছে।’ উত্তেজিত হয়ে টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে ড্রাম বাজাতে শুরু করল সে। ‘সিমিউলেটরে ডাটা বসিয়ে দেখ কোন বিশেষ রিডিং পাওয়া যায় কিনা।’

কন্ট্রোলের বোতাম নিয়ে ব্যস্ত হল টেকনিশিয়ান। দু’জনেই অধীর আগ্রহে মনিটরের দিকে চেয়ে আছে। তিনটে সূর্যের সিমিউলেটেড গতিপথ স্ক্রীনের ওপর ফুটে উঠেছে। ওদের চোখ তিনটে বিন্দু আর স্ক্রীনের কোনায় ইলেকট্রনিক সংখ্যাগুলোর ওপর ঘোরাফেরা করছে।

ক্যাসিওপিয়া! মুহূর্তে জনের হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ধর্মযাজকের কথা। তিন বছর আগে নীসে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই ক্যাসিওপিয়ার কথাই উল্লেখ করেছিলেন এক ধর্মযাজক। আলখাল্লা পরিহিত ইটালিয়ান পাদরী জোর করেই ভিতরে ঢুকে সম্মেলনের সদস্য সবাইকে ক্যাসিওপিয়ার দিকে নজর রাখতে বলেছিলেন। ওখানে তিনটে সূর্য দেখা গেলেই যেন ওঁকে খবর দেয়া হয়—অনুরোধ করেছিলেন।

দৃশ্যটা স্পষ্ট মনে আছে তার। উত্তেজনায় টানটান হয়ে থাকলেও প্রীস্ট-এর চেহারা অত্যন্ত সৌম্য। তাই সদস্যরা তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছিল আর ধৈর্য ধরে সব কথাও শুনেছিল। তাঁর আন্তরিক নিষ্ঠার অমর্যাদা কেউ করেনি। তবে তিনি বেরিয়ে যাবার পরে অবশ্য ওরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করেছিল।

‘স্যার,’ স্ক্রীনের দিকে জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল টেকনিশিয়ান।

বিন্দুগুলো একত্রিত হয়েছে। ঢেউ-এর মত চক্রাকারে ওটা থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ইলেকট্রনিক সংখ্যাগুলো স্থির হয়ে গেছে।

02. 26. 00. 24. 03. 84.

একটা সময় এবং নির্দিষ্ট একটা তারিখ। ধর্মযাজকের কণ্ঠটা তার কানে বাজছে। অর্থহীন কথা—মহাপুরুষের পুনর্জন্ম—যীশুখ্রিস্টের প্রত্যাবর্তন।

24. 03. 84.

জন্ম তারিখ!

অভিভূত জন বুকের সামনে হাত নেড়ে ক্রস চিহ্ন আঁকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *