শেষ অশুভ সংকেত – ২০

বিশ

গত সপ্তাহে বিন্দুমাত্র অবসর পাননি ফাদার ডি কার্লো। এমনও সময় গেছে যে ঠিকমত খাওয়া বা ঘুমানোও সম্ভব হয়নি। শিশু যীশুকে দেখার আনন্দ আর উত্তেজনায় সব ভুলে থেকেছেন। কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই।

ট্যাক্সিকে টেলিভিশন সেন্টারে যেতে বলে নোটবই বের করলেন ডি কার্লো গত কয়েকদিনে নিজের চাতুরীতে নিজেই অবাক হয়েছেন। বাচ্চাটাকে লুকিয়ে রাখার সব ব্যবস্থা তিনি একাই করেছেন। একাই থর্ন, মহিলা এবং বাচ্চার গতিবিধির ওপর নজর রেখেছেন। গোয়েন্দাগিরির পেশা নিলে নিশ্চয়ই নেহাত খারাপ করতেন না।

‘বিবিসি, স্যার,’ ড্রাইভিং সিট থেকে ঘাড় ফিরিয়ে জানাল ড্রাইভার।

ধন্যবাদ জানিয়ে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লেন ডি কার্লো। বিল্ডিংটা অন্ধকার, কিন্তু কেট যে তার প্রোগ্রামের পরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই থাকে এটা তাঁর জানা। গেটে কেউ নেই। কপাল ভাল, ঠাণ্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে না।

‘মিস রেনল্ডস।’ অপ্রত্যাশিত ডাক শুনে চমকে উঠল কেট। ঘুরে বিরক্ত চোখে প্রীস্টের দিকে চাইল সে। লোকটা ভিতরে ঢুকল কি ভাবে? বারবার হঠাৎ অন্ধকারে পিছন থেকে ডেকে তাকে চমকে দেয় এই লোক।

‘এখানে কি করছেন আপনি?’

‘তোমার সাথে ওর দেখা হয়েছে, তাই না?’

অসুস্থ দেখাচ্ছে ওঁকে। অন্ধকারেও চোখ আর গাল বসে যাওয়া টের পাচ্ছে কেট।

তুমি জানো থর্নই সেই পাপ-পুরুষ,’ বলে চললেন ফাদার। তবে কেন ওকে রক্ষা করতে চেষ্টা করছ?’ এগিয়ে গিয়ে কেটের কনুই ছুঁলেন।

ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নিল কেট। এখান থেকে চলে যান আপনি, নইলে সিকিউরিটির লোক ডাকব।’ ঘাড় ফিরিয়ে আশেপাশে চেয়ে দেখল কাউকে দেখা যায় কিনা। রাগে ফুঁসে উঠছে ওর ভিতরটা।

‘তোমার ছেলে কোথায়, মিস রেনল্ডস?’

নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে-আর কোথায়?’ জ্বলে উঠল কেট।

মাথা নাড়লেন ফাদার। ‘না, তোমার ছেলে ডেমিয়েনের সাথে আছে।’

বিস্মিত চোখে ডি কার্লোর দিকে ফিরে তাকাল কেট।

‘হ্যাঁ, ওরই সাথে আছে পিটার—দেহে এবং মনে। পাপ-পুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে সে।’

জোর করে একটু হাসল কেট। পুরো ব্যাপারটাতেই ঘেন্না ধরে গেছে তার। লোকটা বিদায় হলেই সে বাঁচে।

‘তোমার ধারণা পিটার গত তিন দিন স্কুলে ছিল, তাই না?’

মাথা ঝাঁকাল কেট।

‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে স্কুলে খোঁজ নিয়ে দেখতে পার। একটা ফোন কর।’ ফাদার ডি কার্লো খেয়াল করলেন কেটের চেহারা থেকে রাগের ভাব কেটে গিয়ে সন্দেহ আর ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে। ‘থর্নের হয়ে কাজ করছে পিটার,’ বলে চললেন তিনি। ‘সে এখন শয়তানের চ্যালা হয়ে শিশু যীশুকে খুন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু ব্যর্থ হবে ওরা। পবিত্র শিশু এখন নিরাপদ কিন্তু তোমার ছেলের বিপদ আছে।’

প্রবল বেগে মাথা নাড়ল কেট।

পিটারকে বাঁচাবার একটাই পথ আছে, মিস রেনল্ডস, পাপ-পুরুষকে ধ্বংস করে।’ আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা ছুরি টেনে বের করলেন। ওটার দিকে চেয়ে আতঙ্কে বিস্ফারিত হল কেটের চোখ।

‘আপনি কি আমাকে…’ আর বলতে পারল না কেট। সম্মোহিতের মত ছুরির ফলার দিকে চেয়ে আছে সে।

‘জলদি করেন, মিস রেনল্ডস,’ গার্ডের স্বর শোনা গেল। ‘তালা মারব আমি।’ লোকটার কথায় যেন সংবিৎ ফিরে পেল কেট।

‘যাচ্ছি,’ চেঁচিয়ে জবাব দিল সে। আবার ডি কার্লোর দিকে যখন ফিরল তখন নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে।

‘আমি বাড়িতে আমার ছেলের কাছে ফিরে যাচ্ছি,’ বলল কেট।

তাহলে আমিও তোমার সাথে আসছি,’ বলে উঠলেন ফাদার। ‘বাড়ি ফিরে যখন দেখবে পিটার নেই তখন আর নষ্ট করার মত সময় থাকবে না।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে রওনা হল কেট। ফাদারের পিছু নেয়া ঠেকাতে পারবে না সে। তারচেয়ে বাসায় নিয়ে গিয়ে পিটারকে দেখালেই আপদ বিদায় হবে।

.

‘পিটার!‘

তার ফ্ল্যাটে কোন বাতি জ্বলছে না। এত সকালে নিশ্চয়ই ঘুমাতে যায়নি। ইদানীং অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা তার অভ্যাস। কিন্তু ফ্ল্যাটটা নিশ্চুপ—অন্ধকার।

ফাদার ডি কার্লোকে বসার ঘরে অপেক্ষায় রেখে খোঁজ নিতে গেল কেট। একটু পরেই আবার ফিরে এল-ওর চেহারা দেখলে অনুকম্পা হয়।

‘আপনার কথাই ঠিক,’ ধরা গলায় বলল সে।

ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কেটের দিকে বাড়িয়ে দিলেন ফাদার। একটা নাম্বার ডায়াল করে ওটা কানে লাগাল কেট। অপেক্ষা করছে।

‘মিসেস গ্রান্ট? এত রাতে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, কেট রেনল্ডস বলছি—’ ফোনে কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ডি কার্লো।

‘আপনার এ কথাটাও ঠিক,’ রিসিভার নামিয়ে রেখে বলল সে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে ওর। আপনি কি বলতে চান গত রাতেও সে পেরিফোর্ডেই ছিল?’

‘ঠিক’

‘ঈশ্বর!’ চেয়ারের হাতল খামচে ধরে ধপ করে বসে পড়ল কেট। হাতের চাপে ওর মুঠির গাঁটগুলো সাদা দেখাচ্ছে।

ওর পাশে বসলেন ডি কার্লো। এবার সে সরে গেল না। তুমি আমাকে সাহায্য করবে?’ প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘নিশ্চয়ই।’

.

রাস্তাটা কেটের চেনা। ম্যাপ দেখার প্রয়োজন হল না। ড্রাইভ করতে করতে ফাদার ডি কার্লোর কথা শুনছে সে।

থর্ন ট্র্যাজেডির সব কথা ওই ফাইলে লেখা নেই। এক এক করে ঘটনাগুলো বলে যাচ্ছেন ফাদার। ফাদার ট্যাসোন, যে ডেমিয়েনের জন্মে সাহায্য করেছিল; ফটোগ্রাফার জেনিংস, মিডিজিয়মের হেড চার্লস ওয়ারেনের দুই বগির ফাঁকে পড়ে কাপলিঙের আঙটায় গেঁথে মৃত্যু…আর পারছে না কেট।

ফ্যাকাসে মুখে কম্পিত গলায় সে বলে উঠল, ‘এবার থামেন। এসব কথা আমি শুনতে চাই না।’

‘ঠিক আছে,’ বললেন ডি কার্লো। ‘এবার তোমাকে আনন্দের একটা গল্প শোনাই।’ চোখ বুজলেন তিনি। ‘আমরা তিন সূর্যের মিলন দেখেছি। তখন পর্যন্ত ওটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা। দু’হাজার বছর পরে তাঁর পুনর্জন্ম।

কেটের আড়ষ্ট ভাব কিছুটা শিথিল হল। মৃত নরনারীর ছায়াগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলল সে।

তারপর আমরা তাঁকে খুঁজতে বেরোলাম। কাজটা সহজই হল। অ্যাস্ট্রোনমার আমাদের সঠিক জায়গার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে খুঁজে পেলাম।’ একটু চুপ করে থেকে রসটা পুরোপুরি উপভোগ করলেন। ‘জিপসিদের মাঝে।’

ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে প্রীস্টের দিকে চাইল কেট

‘শিশুটা এত সুন্দর আর এমন সম্ভ্রান্ত তাঁর চেহারা যে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।’ কেটের দিকে চেয়ে হাসলেন ফাদার। পুরো ব্যাপারটার মাহাত্ম্যই ওইখানে। জিপসিদের বার্থ সার্টিফিকেট দরকার হয় না। এই এতগুলো বাচ্চা যে মারা পড়ল, কিসের জন্যে…?’

‘মৃত্যুর কথা আর আমাকে শোনাবেন না ফাদার, যথেষ্ট হয়েছে।

‘এই যে, আমরা এসে পড়েছি,’ বললেন ফাদার।

গাড়ি থামিয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখল কেট, তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে পিটারের উদ্দেশ্যে রওনা হল সে।

গেটে সিকিউরিটি গার্ড হেসে জানাল অ্যামবাসেডর তাকে আশা করছে। অবাক হল না কেট—অবাক হওয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে সে।

.

উপাসনার ঘরটা অন্ধকার, কিন্তু যেটুকু দেখা প্রয়োজন তা দেখতে পাচ্ছে পিটার। ক্রুশের সামনে দাঁড়ানো ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে আছে সে।

ভাবছ তোমারই জিত হয়েছে, না?’ যীশুর মূর্তিটাকে বলল ডেমিয়েন। মাথার পিছনটাই কেবল দেখতে পাচ্ছে ও। ‘তোমার বদলে একশো শিশুকে তুমি মনে করে হত্যা করেছি, ওদের বাঁচাবার কোনোরকম চেষ্টাই তুমি করোনি…’

নাক সিঁটকে একটু ঘুরে গিয়ে ক্রুশের কাঠের সাথে ঠাসা বেদনার্ত মুখটার দিকে চাইল ডেমিয়েন।

কিন্তু এগুলো সবই তোমার একটা খেলা। যুগ যুগ ধরে লুকোচুরি খেলেছ তুমি। এবার খেলা শেষ।

আড়চোখ পিটারের দিকে একবার চেয়ে আবার ক্রুশের দিকে তাকাল।

‘বাছারা, আমাকে পেতে হলে কষ্ট করতে হবে,’ ব্যঙ্গ করে বলল সে। এগুলো তোমারই কথা, নাজারীন—আমার নয়।’

পিটারের একটা হাত ধরে উপরে ছাদের দিকে চাইল ডেমিয়েন। প্রিয় ডেভিল, পিতা আমার, তোমারই জয়। তোমার গুণগান গাই; এই নিষ্পাপ ছেলেটাকে তুমি আমার হাতে তুলে দিয়েছ বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। শেষ পর্যন্ত এবার নাজারীনের মুখোমুখি হবার সুযোগ পাব আমি।’

পিটারের দিকে ঘুরে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে ওর মুখের দিকে চাইল ডেমিয়েন

‘আমি চাই আমার কথাগুলো তুমি খুব মনোযোগ দিয়ে শোন,’ বলল সে। ‘তোমার মা আমার কাছ থেকে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এখানে আসছে…

মাথা নাড়ল পিটার, ওর কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করল। ‘না, ডেমিয়েন, আমাকে ওর কাছে ফিরে যেতে বাধ্য কোরো না।

হাসল ডেমিয়েন। ‘ভয় নেই, এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমার।

দু’হাতে ছেলেটার গাল হালকা ভাবে চেপে ধরল ডেমিয়েন।

‘খ্রিস্টান ধর্মে দশটা আজ্ঞা আছে,’ মৃদু স্বরে বলল সে। ‘আমার আছে মাত্র একটা।

মাথা ঝাঁকাল পিটার। করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পেল ডেমিয়েন, কিন্তু মুখ ফেরাল না। পিটারের মুখের দিকেই চেয়ে আছে।

‘এখন থেকে আমরা একাত্ম হলাম।

‘আমি তোমাকে ভালবাসি, ডেমিয়েন।‘

‘সবার চেয়ে বেশি?’

‘সবার চেয়ে বেশি।‘

‘জীবনের চেয়েও বেশি?’

‘জীবনের চেয়েও বেশি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথা ঝোঁকাল ডেমিয়েন। পিছনের দরজা ঠেলে কেট ঘরে ঢুকল।

‘আমি তোমার সাথে একটা চুক্তি করতে এসেছি, ডেমিয়েন,’ বলল কেট। চমকে একটু নড়ে উঠল পিটার। মাথা ফেরাবার চেষ্টা করেও পারল না! শক্ত হাতে ওকে ধরে রেখেছে ডেমিয়েন।

‘সে কোথায়?’ পিটারের চোখ থেকে চোখ না সরিয়েই প্রশ্ন করল সে।

‘আমার ছেলেকে আগে তুমি ফিরিয়ে দাও, তারপর আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব ওর কাছে।’

ভীষণভাবে মাথা নেড়ে মুচড়ে নিজেকে ডেমিয়েনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল পিটার। ‘না, ডেমিয়েন। আমি ওর ছেলে নই। আমি তোমার।’

কেটের গলা দিয়ে অস্ফুট আর্তস্বর বেরিয়ে এল। হাসল ডেমিয়েন, তারপর ঘুরে প্রথমবারের মত কেটের দিকে চাইল সে। দরজায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেট।

‘আগে আমাদের নাজারীনের কাছে নিয়ে যাও, তারপর তুমি পিটারকে ফেরত পাবে।’

চিৎকার করে উঠল পিটার, ‘না, ডেমিয়েন! এটা ওর চালাকি!’

‘ছেলেকে যদি সত্যিই ফেরত চায় তবে চালাকি করবে না ও,’ বলার সময়ে একে একে দু’জনকেই দেখল ডেমিয়েন 1

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে গা ছেড়ে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল কেট চোখের সামনে ডেমিয়েনের হাত ধরে ওর পাশ দিয়ে এগোল পিটার।

মাথা নেড়ে চোখ বুজে ফেলল কেট। সহ্য করতে পারছে না—যাকে নিজের পেটে ধরে এতদিন পেলে-পুষে মানুষ করেছে, সে-ই আজ তার প্রতি বিরূপ।

‘চল,’ বলল ডেমিয়েন।

চোখ তুলে ক্রুশের দিকে চাইল কেট। সবকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেল। এমনটা ঘটার কথা ছিল না। এখন তার আর উপায় নেই। যে ছেলেকে সে নিজের চেয়েও ভালবাসে তাকেই পথ দেখিয়ে একটা ফাঁদে নিয়ে যেতে চলেছে।

যদি সাহায্য করতে পার, প্রভু,’ ফিসফিস করে নির্যাতিত যীশুর উদ্দেশে বলল সে। তবে এখনই সময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *