শেষ অশুভ সংকেত – ৩

তিন

শিকাগোর রাস্তা ছেড়ে অনেক উপরে একটা ছোট প্রজেকশন ঘর। পর্দা টেনে অন্ধকার করা হয়েছে ঘরটাকে। ভিতরে বাতি জ্বেলে কয়েকজন লোক ‘দুরুদুরু’ বুঝে অপেক্ষা করছে।

দরজা খুলে ঢুকল বোর্ডের চেয়ারম্যান ডেমিয়েন থর্ন। দরজায় দেখা যাচ্ছে ছয় ফুট লম্বা, সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারা। ইদানীং একটা প্রভাবশালী ম্যাগাজিনে তাকে পশ্চিমের তিনজন সবচেয়ে কাম্য ব্যাচেলারদের একজন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। থর্ন করপোরেশনের মালিক হিসেবে সে অবশ্যই পৃথিবীর অন্যতম ধনীদের একজন—তবে তার বয়স এখনও বত্রিশ পার হয়নি। ডেমিয়েনের পিছন পিছন তার ব্যক্তিগত অ্যাসিস্টেন্টও রূমে ঢুকল।

‘গুড আফটারনুন,’ বলল ডেমিয়েন।

‘গুড আফটারনুন, স্যার,’ সবাই একসাথে জবাব দিল। ওদের পাশ কাটিয়ে সোজা সামনের সারির দিকে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন।

‘হারভি ডীনকে তোমরা সবাই চেনো।’

সবার সাথে অভিবাদন বিনিময় করল ডীন। মাঝারি গড়নের হলেও অত্যন্ত তৎপর লোক। তাকে ডিঙিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে কারও পৌঁছানোর সাধ্য নেই। তাই সে সবার খাতির পায়। একবার একজন মন্তব্য করেছিল যে হিটলারের বোরম্যান আর ডেমিয়েনের ডীনে নাকি কোন তফাৎ নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সে বেচারা চাকরি হারিয়েছিল।

সবাই বসার পর ডেমিয়েনের ভুড়ির সাথে বাতি নিভল। অন্ধকারে কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না-কিন্তু ডেমিয়েন পাচ্ছে। শিয়ালের পেটে ওর জন্ম। তাই অন্ধ—কারে দেখতে ওর অসুবিধে হয় না।

এক মুহূর্ত পরেই পর্দা আলোকিত হল। দেখা গেল প্রচণ্ড তাণ্ডবলীলা চলেছে। ধীরে ধীরে ঝড় থেমে গেল। একটা মরুপ্রান্তর ফুটে উঠল পর্দায়।

ডেমিয়েনের পিছনে বসা লোকগুলো উৎকণ্ঠায় শ্বাস ফেলতেও ভুলে গেছে। চারটে স্পীকারে গমগম করে উঠল বিবরণ দাতার কণ্ঠস্বর:

‘পঞ্চাশ হাজার বছর আগে মানবজাতি বিলুপ্তির একটা বিরাট হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল…’

কান চুলকাল ডেমিয়েন।

‘দুর্যোগটা ছিল প্রাকৃতিক। পাঁচ হাজার বছর স্থায়ী থেকে আইস এইজ এই পৃথিবীর পাঁচ ভাগের চার ভাগ অংশকেই বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছিল। কঠিন-প্রাণ প্রাণী ছাড়া আর সব নিশ্চিহ্ন হল।’

স্ক্রীনে একটা গুহা আর আদিম মানুষের হাতে আঁকা কিছু ছবি দেখা গেল।

‘অল্প কিছু প্রাণী যারা বাঁচল, তার মধ্যে একটা হল মানুষ। দুর্যোগের পর এক নতুন যুগের সাথে নতুন আশার সূচনা হল। ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা বিজন এলাকা ছেড়ে মানুষ তার স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে সচেষ্ট হল।

এবারে কিছু মরা গাছপালা দেখা গেল। পানির অভাবে নষ্ট হয়েছে।

‘এরপরে মানুষ বিভিন্ন সঙ্কট উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষ আজ যে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে এমন আর আগে কখনও হয়নি। গত দশকের অর্থনৈতিক সঙ্কট পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে-কানাচে মুদ্রাস্ফীতি, দুর্ভিক্ষ আর দুর্দশা এনেছে।’

জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল ডেমিয়েন।

‘কেউ কেউ একে ‘মহাসঙ্কট’ আখ্যায়িত করেছে,’ বলে চলল ন্যারেটর। আবার কেউ বলছে এটাই ‘আর্মাগেড্ডন’। অর্থাৎ মহাপ্রলয় বা কেয়ামত। ধার্মিক মহাপুরুষেরা এই ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। কিন্তু এই চরম নৈরাশ্যের মাঝেও একটা কণ্ঠ আমাদের আশার বাণী শোনাচ্ছে। সে কণ্ঠ থর্নের ‘

উপস্থিত সবাই নড়েচড়ে সিটের আরও ভিতরে ঢুকে বসল। স্ক্রীনের ওপর থর্ন বিল্ডিংটা দেখা যাচ্ছে। দালানটা উঁচু হয়ে রাতের আকাশের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে যেন। কতগুলো জানালায় বাতি দেখা যাচ্ছে। আলোকিত জানালাগুলো একটা বিরাট ‘T’ এর আকারে জ্বলজ্বল করছে।

‘যেখানেই দুর্ভিক্ষ বা মহামারী দেখা দিয়েছে থর্ন কর্পোরেশনই সবচেয়ে আগে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে…’

পৃথিবীর ম্যাপ দেখা গেল পর্দায়। ছোট ছোট উজ্জ্বল বাল্ব জ্বেলে কোথায় কোথায় থর্ন কর্পোরেশনের কাজ চলছে দেখানো হয়েছে।

…অক্লান্ত সংগ্রাম করে চলেছে, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মানুষের দুর্দশা দূর করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

কমার্শিয়াল ছবি শেষ হল। অন্ধকার দূর করে ঘরের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে উপস্থিত সদস্য প্রত্যেকেই সচেতন ভাবে উৎকণ্ঠা ঢাকার চেষ্টা করছে। কারও চোখের পাতাও পড়ছে না। ডেমিয়েনের মাথার পিছনে সবার একাগ্র দৃষ্টি আবদ্ধ। কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর ওদের একজন সাহস করে কিছু বলার জন্যে গলা পরিষ্কার করল।

‘কেমন হয়েছে?’ ঢোক গিলে প্রশ্ন করল লোকটা।

‘রাবিশ!’ বিরক্ত স্বরে জবাব দিল ডেমিয়েন। ‘দর্শক এসব আজেবাজে ফালতু কথায় মোটেও ভুলবে না।’ কথাটা হজম করার জন্যে একটু সময় দিয়ে সে আবার বলল, ‘কথার মারপ্যাচ চাই না–আমি চাই অ্যাকশন। চোখের সামনে দেখতে চাই থর্ন কি কি কাজ করছে-শুনতে চাই না। ‘

মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। কেউ ডেমিয়েনের চোখে চোখে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না।

‘হাজার হাজার ক্ষুধার্ত শিশু একমুঠো থর্ন সোয়ার জন্যে হাহাকার করছে, বলে চলল ডেমিয়েন। থর্ন চিকিৎসক দল কাজ করছে-থর্ন এঞ্জিনিয়ারিং, থর্ন কন্ট্রাকশন,’ একটু থেমে যে লোকটা প্রথম কথা বলছিল তার দিকে ফিরল ডেমিয়েন থর্ন। ‘অথচ তার বদলে কমার্শিয়ালের অর্ধেক সময় অযথা নষ্ট করা হয়েছে অবান্তর ‘বরফ যুগের’ ইতিহাস দিয়ে।’

কথাগুলো জায়গা মতই বিধল। পাঁচশো ডলার সুটের ভিতর লোকটা আরও কুঁকড়ে গেল। অনেক সময় ব্যয় করে অনেক খেটে বেচারা তৈরি করেছে ওই ছবি-কিন্তু কি ফল হল? কান দুটো লাল হয়ে উঠেছে ওর।

এবার সবাইকে উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত সহকারীর দিকে ফিরল ডেমিয়েন। ‘অস্ট্রেলিয়ায় খরা রিলিফের ওপর কোন ফিল্ম নেই?’

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সে। ‘আছে, কিন্তু ওগুলো এমন বিশেষ কিছু নয়—তাছাড়া ওর বেশিরভাগই টেলিভিশনে দেখানো হয়ে গেছে।’

‘ঠিক আছে,’ অ্যাডভারটাইজমেন্ট-এর লোকটাকে বলল ডেমিয়েন। ‘তোমাদের জন্যে অন্য কিছু খুঁজে দেয়া হবে, কিন্তু ওটা…’ আঙুল দিয়ে স্ক্রীন দেখাল সে, ‘দেখানো চলবে না।’

কথা শেষ করে ওদের দু’ভাগে চিরে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন। ডীন তার পিছন পিছন ছুটল।

‘গুডবাই, মিস্টার থর্ন,’ অপ্রতিভ স্বরে বিদায় জানাল ওরা। কিন্তু এবার আর কোন উত্তর এল না।

করিডোর ধরে নিজের অফিস কামরার দিকে এগোল ডেমিয়েন

‘এখন আমাদের হাতে কি রয়েছে?’ ডীন ওকে ধরে ফেলতেই প্রশ্ন করল সে।

‘আগামী সপ্তাহে বয়ানা তারপর মাসের শেষ দিকে আসওয়ান বাঁধ।’

নিজেই মাথা ঝাঁকাল ডীন। বয়ানা নিয়ে তার বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু যে কর্মী দলটাকে ওখানে কাজে লাগানো হয়েছে তারা খবর পাঠিয়েছে আগামী তিনচার দিনের মধ্যেই ‘কু’ হবে। তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে ওখানে। হাজার হাজার রেফিউজিকে মাসের পর মাস খাবার জোগাতে হবে। আর বাঁধের ব্যাপারে, যদিও সব ব্যবস্থা নেয়া এখনও শেষ হয়নি, তবু বলা যায় তাদের চেষ্টা সফল হবে। পৃথিবীর সেরা বিস্ফোরক এক্সপার্ট লোক নিয়োজিত হয়েছে—তাছাড়া কার্পোরে—শনের প্রেসিডেন্ট পল বুহের নিজে এই প্রোজেক্টের চার্জে রয়েছে। পল বুহেরকে আজ পর্যন্ত কোন কাজে বিফল হতে দেখা যায়নি।

অফিসের রিসেপশন এলাকায় পৌঁছে গেল ওরা। দু’জন সুন্দরী যুবতী সেক্রেটারি ডেমিয়েনের দিকে চোখ তুলে তাকাল। ওদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন

‘সময় মত বয়ানায় আমাদের ফিল্ম ইউনিট পাঠানো যাবে?’

‘নিশ্চয়,’ জবাব দিল ডীন। ‘তবে আমাদের রিলিফ টীমকে কু-র আগে পাঠানো সম্ভব হবে না। ওটার সঠিক তারিখও এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।’

বসের পিছন পিছন অফিস কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ডীন। প্রথম দিন নতুন আর পাঁচজনের মত সেও আশা করেছিল ক্রোম, স্টীল, কাঁচ আর চামড়া দিয়ে সাজানো চৌকস একটা ঘর। কিন্তু তার বদলে রাজকীয় চেয়ার, সুন্দর কারুকাজ করা টেবিল আর শিকারের দেয়াল-ছবিগুলো দেখে খুব অবাক হয়েছিল সে। কর্মব্যস্ততার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই ওই ঘরে।

এগিয়ে গিয়ে কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে চাইল ডেমিয়েন। এত উপর থেকে নিচে শিকাগো শহরের ছাদগুলো দেখতে ওর খুব ভাল লাগে। নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে হয়।

‘ঠিক আছে, বাঁধটা ভাঙার আগে আমাদের লোকজন ওখানে উপস্থিত থাকার ব্যবস্থা কর।’

মাথা ঝাঁকাল ডীন।

ছবি তোলার সময়ে আমাদের রিলিফ টীমের নিঃস্বার্থ কাজগুলোকে বড় করে, তুলে ধরতে হবে। রেড-ক্রস যেন আমাদের আগে ওখানে পৌঁছতে না পারে।’

‘ওসব ব্যাপার আমার ওপর ছেড়ে দেন-আমি সব ব্যবস্থা করব। ওখানে আপনি নিজে উপস্থিত থাকলে কিন্তু সুপার ইমপ্যাক্ট হয়–ডেমিয়েন থর্ন স্বয়ং রিলিফের কাজ দেখাশোনা করছেন–দর্শক মুগ্ধ হবে।’

সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল ডেমিয়েনের ঠোঁটে। মাথা নাড়ল সে।

‘আমাকে এখানেই থাকতে হবে,’ বলল ডেমিয়েন

‘কেন?’ অনেক খুঁজেও এর যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ দেখতে পেল না ডীন।

‘প্রেসিডেন্ট যখন আমাকে খুঁজবে তখন হাতের কাছে থাকতে চাই।’

কথাটা অন্য কেউ বললে অসম্ভব আর অবাস্তব শোনাত। হয়ত ঠাট্টা—কিন্তু ডেমিয়েন কখনও ঠাট্টা করে না।

‘আমাকে গ্রেট ব্রিটেনের অ্যামবাসেডর হতে অনুরোধ করা হবে। ‘ কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বোকার মত অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ডীন। দেয়ালের পাশে সার দিয়ে রাখা বইয়ের শেলফের দিকে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন

‘বুক অভ হিবরন পড়েছ?’

‘কার বই?’ প্রথমে গ্রেট ব্রিটেন, ভাবল সে, এখন হিবরন। লোকটা হেঁয়ালির ভাষায় কথা বলছে।

শেলফ থেকে একটা বই তুলে নিল ডেমিয়েন

‘নিউ টেস্টামেন্টের সর্বশেষ গ্রন্থ।

কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল ডীন। ব্যাখ্যার জন্যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে সে। বই খুলে পাতা উল্টে একটা বিশেষ অনুচ্ছেদে এসে থামল ডেমিয়েন।

‘এবং তা কেটে যাবে,’ পড়ল সে। ‘শেষ দিনগুলোতে সেই পশু একশো-কুড়ি আর তিরিশ দিন এবং রাত (১০০×২০+৩০ দিন) রাজত্ব করবে। আর বিশ্বাসী লোক কেঁদে প্রভুকে ডাকবে, ‘হে প্রভু, এই সঙ্কটের দিনে তুমি কোথায়?’

‘প্রভুর কানে সেই ডাক পৌছুবে, তিনি ‘অ্যাঞ্জেল আইল’ থেকে পবিত্র মেষ পাঠাবেন… পশুর সাথে তার প্রচণ্ড লড়াই হবে…সমূলে ধ্বংস হবে পশু।

শব্দ করে বইটা বন্ধ করল সে।

‘পশু একশো-কুড়ি তিরিশ দিন রাজত্ব করবে, অর্থাৎ ৬.৬৬ বছর। থর্ন কোম্পানির হেড হয়েছি—সেও প্রায় ছয় বছর হল।

‘অ্যাঞ্জেল আইল’,’ একটু থামল ডেমিয়েন, ‘খাঁটি ল্যাটিনে ‘angelo—rum,’ অর্থাৎ ইংল্যাণ্ড।’

ভুরু কুঁচকে হেঁয়ালির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করছে ডীন। ধীরে ধীরে একটা ক্ষীণ যোগসূত্র যেন দেখতে পেল সে।

কিন্তু হায়, পশুর বিনাশ এতে ঘটবে না,’ বলল ডেমিয়েন। ‘নাজারিনই (নাসরত শাহরবাসী যীশু) ধ্বংস হবে।’

এত কিছু একসাথে ডীনের মাথায় ঢুকবে না। বাধ্য হয়ে বাস্তব একটা প্রশ্নে ফিরে এল সে।

‘কিন্তু আমাদের লণ্ডনস্থ বর্তমান অ্যামব্যাসেডরের কি হবে?’

একটু হাসল ডেমিয়েন। আপাতত এটুকুই জানবে ডীন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *