শেষ অশুভ সংকেত – ২১

একুশ

ব্যাপারটা এখনও ওর মাথায় ধরছে না। ছোটকাল থেকেই দেবদেবী শয়তান এসবে তার বিশ্বাস ছিল না। এটা অসম্ভব। দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেলেই সে দেখবে পিটার তার বিছানার পাশে সকালের বেড-টী নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে 1

ড্রাইভিং মিররে চেয়ে দেখল দু’জোড়া হলুদ চোখ তার দিকেই চেয়ে রয়েছে পিছন থেকে। ফিসফিস করে মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে গোপনে পরামর্শ করছে।

কেটের মাথার ভিতরে ঝড় বইছে। উপায় খুঁজতে গিয়ে হাজারো চিন্তা তার মাথায় আসছে—যুক্তি মানছে না ওর চিন্তা। গাড়িটা কোনকিছুর সাথে ধাক্কা খাওয়াতে পারে, কিংবা কোন খানাখন্দে ফেলা যায়, কিন্তু তাতে পিটার আঘাত পেতে পারে। তাহলে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে। কোন পুলিশকে থামিয়ে—না, তাতেও কাজ হবে না। পুলিশ তার কথা বিশ্বাসই করবে না।

‘আর কতদূর?’ প্রশ্ন করল পিটার।

‘দু’মাইল,’ বলল ডেমিয়েন।

চোখের পাতা ফেলল কেট! চোখ ফেটে কান্না আসছে ওর। শয়তানটা জানে! তার মনের কথা টের পাচ্ছে। কেটের উদ্ভট প্ল্যানগুলোর কথা টের পেয়ে নিশ্চয়ই মনে মনে হাসছে লোকটা।

একটা খরগোস গাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে রাস্তা পার হল। পোকাগুলো উইণ্ডস্ক্রীনের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেঁতলে যাচ্ছে। এত রাতে রাস্তায় কোন লোক নেই, গাড়ি নেই, কেউ হাঁটছেও না। আকাশে তারা মিটমিট করছে-মেঘ নেই। গোটা পৃথিবীটাই যেন দম বন্ধ করে কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছে।

পাহাড়ের মাথায় উঠল গাড়ি—সামনে একটা বিরাট ক্যাথিড্রালের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে। চূড়াটা রাতের আকাশে অনেক উঁচুতে দেখা যাচ্ছে। হাঁ হয়ে গেছে পিটার। আয়নায় কেট দেখল চোখ ফিরিয়ে নিল সে যেন দৃশ্যটা ওর চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে। কিন্তু ডেমিয়েন স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে প্রত্যাশায় জিভ চাটছে।

গিয়ার বদলাবার সময়ে ফেঁসে গিয়ে গাড়িটা বিচ্ছিরি আওয়াজ করে উঠল এক ঝাঁক কাক ভয় পেয়ে গাছের ওপর থেকে কা-কা শব্দ তুলে আকাশে উড়ল। ওর উদ্দেশ্যে একটা গাল বকে পিটারকে কাছে টেনে নিল ডেমিয়েন–আয়নায় দেখল কেট।

ক্যাথিড্রাল থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে গাড়ি থামিয়ে সুইচ অফ করে দিল সে আকস্মিক স্তব্ধতার মাঝে মগজ খাটাবার চেষ্টা করল কেট।

‘আমি আগে গিয়ে দেখে আসি,’ বলল সে।

‘আমরা সবাই একসাথেই যাব,’ জোর দিয়ে জানাল ডেমিয়েন।

পিটার সাথে যাক, এটা চায় না কেট। ডেমিয়েনের দিকে ফিরল সে। ‘বিশ্বাস কর, ডেমিয়েন, আমি—’

‘না,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল পিটার। ‘ওকে বিশ্বাস কোরো না।’

পিটার আর ডেমিয়েন গাড়ি থেকে নেমে কেটের জন্যে অপেক্ষা করছে। এক মুহূর্ত ওদের দিকে চেয়ে থেকে কেটও নামল। ব্যাপারটা ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

‘পথ দেখিয়ে আগে বাড়,’ আদেশ করল ডেমিয়েন।

মুখ তুলে ক্যাথিড্রালের দিকে চাইল কেট। ভবিষ্যৎহীন অন্ধকার আর শূন্যতা। উপেক্ষিত ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার ভগ্ন নিদর্শন। বিশাল দরজার সামনে স্তম্ভ আর দেয়াল, যেটা যেখানে ধসে পড়েছে সেখানেই আছে। উদগ্রীব হয়ে খুঁজল কেট, কিন্তু অন্ধকারে কাউকে দেখতে পেল না।

‘কই, এগোও,’ তাড়া লাগাল পিটার।

কম্পিত পায়ে ধীর গতিতে আগে বাড়ল কেট। পা এত কাঁপছে তার মনে হচ্ছে সে বুঝি পড়ে যাবে।

দরজা থেকে দশ গজ আগে বেড়ে থামল কেট। ওর এক পা পিছনেই ডেমিয়েন। বাম দিকে আর একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। ওটা দেখিয়ে কেট বলল, ‘ওর পিছনে।‘

‘খোল,’ হিসহিসিয়ে বলল ডেমিয়েন

দরজার খিল খোলার জন্যে আগে বেড়ে ঝুঁকল সে। চোখের কোনা দিয়ে দেখল ফাদার ডি কার্লো ছুরি হাতে একটা পিলারের পিছন থেকে বেরিয়ে আসছেন। নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠল সে।

‘না, ফাদার!’

একটু থমকালেন ফাদার ডি কার্লো। এই অবসরে পিটারকে টেনে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ডেমিয়েন। ফাদার ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই নিজেকে বাঁচাতে পিটারকে তুলে নিয়ে ঢালের মত উঁচু করে ধরল। ডেমিয়েনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে মারা কোপটা পিটারের পিঠে বিধে গেল।

‘পি-টা-র!’ রাতের স্তব্ধতা চিরে চিৎকার করে উঠল কেট। ছেলেটাকে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে প্রীস্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেমিয়েন। দু’হাতে তার গলা টিপে দেয়ালের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে সে।

‘পিটার,’ ছুটে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে হাঁটুর ওপর পড়ল কেট। ছেলেটা পশুর মতো চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ওর পিঠের ওপর ছুরির বাঁটটা বেরিয়ে আছে।

‘ওহ্, সোনামানিক আমার…’ কেন চিৎকার করতে গেল সে? কেন সে ওকে সাবধান করে দিল? দু’হাতে পিটারের মাথাটা ধরে ওর চোখে চোখ রাখল কেট। ‘আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, পিটার…’

কিন্তু ওর চোখ ইতিমধ্যেই ঘোলা হয়ে এসেছে। শ্বাস নিতে গলার ভিতর ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে।

‘মরো না, প্লীজ মরো না…

‘তোমাকে ভালবাসি আমি,’ বিড়বিড় করল সে।

‘পিটার…’

‘জীবনের চেয়েও বেশি। আমি তোমাকে ভালবাসি, ডেমিয়েন…’ হাসল সে, তারপরেই চোখ বুজে কেটের কোলে লুটিয়ে পড়ল।

‘না, পিটার, না…’

এক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে চেয়ে আদর করে ওকে উপুড় করল কেট। দম নিয়ে দু’হাতে টেনে ছুরিটা ওর পিঠ থেকে খুলে নিল। তারপর ঘাসের ওপর ওকে শুইয়ে মুখ তুলে চাইল।

গায়ের জোরে ফাদার ডি কার্লোকে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে ফেলেছে ডেমিয়েন ঝুঁকে পড়ে গলা টিপে ওঁকে শেষ করার চেষ্টা করছে। কেট যে পিছন থেকে এগিয়ে আসছে টের পেল না সে। বিকট হুঙ্কার ছেড়ে ছুরিটা ডেমিয়েনের শিরদাঁড়ার ওপর বসিয়ে দিল কেট। প্রথমে হাড়ে একটু বাধা পেল, তারপরেই সড়সড় করে বাঁট পর্যন্ত ঢুকে গেল ছুরি। পিছিয়ে গেল কেট।

সিধে হয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। হাত দিয়ে ছুরিটা ধরার চেষ্টা করছে। ‘ঘোঁৎ’ করে একটা শব্দ করে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। হেঁচড়ে নিজেকে টেনে তুলে আবার দাঁড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে দরজাটার ওপর পড়ল। দরজা খোলার চেষ্টা করল সে।

এক মুহূর্ত স্থির থেকে অন্ধকার শূন্যতার মাঝে কি যেন খুঁজল।

‘নাজারীন,’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘কোথায় তুমি, নাজারীন?’

দুলছে, একবার হোঁচট খেল, দু’পায়ে খাড়া থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ‘নাজারীন, শুনছ?’

যেন ওর কথার জবাবেই বিল্ডিঙের কোনার দিকে একটা আলো কেঁপে উঠল। একটা আলোর চক্র-হেলো (halo)। আলোটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছে। মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে ওদিকে রওনা হল। দ্রুত তালে পা ফেলছে, টলতে টলতে ছুটেছে সে। কুঁজো হয়ে রয়েছে ওর পিঠ-মুখটা ব্যথায় বিকৃত হয়ে আছে।

‘ইবলিস,’ হুঙ্কার ছাড়ল সে। ‘আমাকে পরিত্যাগ করলে কেন?’

শব্দটা ধাক্কা খেয়ে আবার ওর কাছে ফিরে এল। ওর সামনের আলোটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ডেমিয়েন। জন্তুর মত হামাগুড়ি দেয়ার চেষ্টা করল।

‘সব শেষ, পিতা,’ ফিসফিস করে বলল সে। ‘তোমার স্বর্গে আমাকে আবার ঠাঁই দাও।’

থরথর করে কেঁপে উঠল ওর দেহ। মাথাটা নিচু হতে হতে মাটিতে মিশল—স্থির হয়ে গেল ডেমিয়েনের দেহ।

উজ্জ্বল আলোটা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে এখন। নিষ্পলক চোখে ফাদার ডি কার্লো চেয়ে আছেন আলোর দিকে। চোখ ফিরিয়ে কেটের দিকে চাইলেন তিনি। ছেলের দেহের পাশে বসে আছে সে। মেয়েটার চুল ছুঁয়ে ছেলের চোখের ওপর বাতাসে ক্রস চিহ্ন আঁকলেন ফাদার। ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল কেট। আলোটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। ওদের গালে অশ্রু চিকচিক করছে।

সকাল হয়েছে। সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন দিন।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *