পনেরো
প্রথম থেকেই লণ্ডনের প্রেমে পড়ে গেছে বারবারা। হ্যাম্পস্টেডের বাড়িটা সত্যিই অপূর্ব। ছোট ছোট কামরা, দেয়ালে ঘেরা বাগান। অধীর হয়ে বসন্তের অপেক্ষায় আছে সে। কত সুন্দর তোড়া বানাতে পারে সেটা ফুল ফুটলে তার নতুন বান্ধবীকে দেখাবে। রাস্তাগুলো এত সুন্দর, সরু লেনগুলোয় বিভিন্ন রকম লোকের ভিড়।
বারবারা ডীনের মতে হ্যাম্পস্টেডের তুলনা হয় না। বিশেষ করে এখন সে মা হয়েছে—বাচ্চা মানুষ করার জন্যে পরিবেশটা আদর্শ।
আপন মনে গান গাইতে গাইতে বাজারের লিস্ট তৈরি করল। তারপর হ্যাণ্ডব্যাগে টাকা-পয়সা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে বাচ্চার কট থেকে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিল। একটা চুমু খেয়ে কাতুকুতু দিতেই খুশি হয়ে হেসে উঠল সে। ওকে প্র্যামে শোয়াতেই জানালায় টোকা শোনা গেল। ওরই সমবয়সী এক মাহলা বাইরে দাঁড়িয়ে। ওকে ‘ইংলিশ গোলাপ’ বলে ডাকে বারবারা—সোনালী চুল আর গোলাপী গাল ওর।
‘হাই, ক্যারল,’ হাত নেড়ে বলল বারবারা। ‘এক মিনিট আসছি।’
বাচ্চাটাকে ভাল করে কম্বল দিয়ে ঢেকে হাত দিয়ে ওর চুল ঠিক করে দিল। দরজার কাছে এসে মুখ তুলে সিঁড়ির দিকে চেয়ে চেঁচাল।
‘হারভি?’
দোতলা থেকে অস্পষ্ট জবাব শোনা গেল।
‘ক্যারলের সাথে একটু কেনাকাটা করতে যাচ্ছি আমি।‘
‘আচ্ছা।’
‘বাচ্চাকেও সাথে নিচ্ছি।‘
‘আচ্ছা।’
গুনগুন করতে করতে প্র্যাম নিয়ে বাগানে বেরিয়ে এল বারবারা। ক্যারলের প্রামটা গেটের পাশে রাখা পাশাপাশি গ্র্যাম ঠেলে ফুটপাত দিয়ে এগোল ওরা। পথচারী মহিলারা ঝুঁকে বাচ্চা দুটোর প্রশংসা করে গাল টিপছে-বাচ্চা দুটো ওদের দিকে চেয়ে উল্লাসে হাত ঝেড়ে গলা দিয়ে গার্গলের শব্দ করছে।
‘ওরা যমজ বলেও চালানো যায়,’ বলল ক্যারল।
‘যমজই তো, প্রায়,’ বলল বারবারা।
ছোট মেয়ের মত খিলখিল করে হেসে উঠল ক্যারল। ওর দিকে চেয়ে বারবারাও হাসল। একজোড়া স্কুলের মেয়ের মত হাসতে হাসতে এগোল ওরা।
দোতলার জানালা দিয়ে চেয়ে ওদের যাওয়া দেখে আবার নিজের টেবিলে ফিরে এল ডীন। টেবিলের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কাগজ। সবগুলো সাবধানে গুছিয়ে একত্র করল সে। বার্থ সার্টিফিকেটের ফটোকপি। হাচিন্স তার কাজ সুষ্ঠুভাবেই করেছে।. রেকর্ড অফিসের কেরানির সাথে ওর জানাশোনা আছে। তাই এগুলো বের করতে তার অসুবিধে হয়নি। পাতা উল্টে আর একবার কাগজগুলো চেক করে দেখে ব্রিফকেস থেকে রেডিও ফোনটা বের করল ডীন।
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বুজে থেকে বোতাম টিপে একটা নাম্বার লাগাল সে।
‘পিটারসন? হারবি বলছি।
অপর পক্ষের মামুলি কথাগুলোর জবাব দিল না সে। এত সময় তার নেই— মুডও নেই। তুমি তো ‘ও এস’ সেকশনের টি কিউ ১৪২৩ থেকে টি এস ২২২৩ এর ওপর কাজ করছ—তাই না?…ঠিক আছে লিভার পুলে তোমার তিনটে আছে।
ফটোকপির প্রথম তিনটা তুলে নিয়ে একে একে ঠিকানাগুলো পড়ে গেল সে। শেষ হলে বিদায় নিয়ে আর একটা নাম্বারে যোগাযোগ করল।
*
শপিং সেরে ফেরার পথে হ্যাম্পস্টেড হাই স্ট্রীটের কাছে একটা ‘পাব’-এর (Publ।c house) সামনে ওরা থামল। দুটো প্র্যামই শপিং-এর শেষে ঠোঙা-বোঝাই হয়েছে। বারবারার ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়লেও ক্যারলের ছেলেটা এখনও এদিক ওদিক চাইছে আর একা একাই খেলছে। ক্যারল ভিতরে ঢুকে দুই গ্লাস লাগার নিয়ে এল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বারবারা ঠট্টা করে মন্তব্য করল যে তারা দু’জন দিন দিন অ্যালকোহলিকে পরিণত হচ্ছে। নিজের ছেলেদের সামনে তারা খারাপ দৃষ্টান্ত তুলে ধরছে। এই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে গ্লাস শেষ করে ঘড়ি দেখল বারবারা। ফেরা দরকার—কিন্তু ব্রিটিশ কাস্টম অনুযায়ী তারও এক রাউণ্ড ড্রিঙ্ক কেনা উচিত
‘আর একটা নিয়ে আসি?’ জিজ্ঞেস করল সে।
মাথা নাড়ল ক্যারল। সময় নেই, ওরও তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। এখান থেকে দু’জন দু’দিকে যাবে। হাত নেড়ে বিদায় নিল ওরা।
বারবারা ঠিকমত রাস্তা পার হল কিনা দেখে ক্যারলও বাড়ির পথ ধরল। মেয়েটার সাথে প্রথম পরিচয়ের কথাটা তার স্পষ্ট মনে আছে। নার্সিং হোমে পাশাপাশি বসেছিল ওরা। কথায় কথায় জানা গেল দু’জনের বাচ্চা হবার একই তারিখ দিয়েছে ডাক্তার। দু’জনে সে কী হাসি। এরপর থেকেই বাচ্চা দুটোকে ওরা যমজ বলেই ডাকে। বারবারার ছেলেটা মাত্র চল্লিশ মিনিটের বড়।
বাচ্চাটা ঢেকুর তুলল। ওর দিকে চেয়ে হেসে, ঝুঁকে আদর করে থুতনি নেড়ে দিল ক্যারল। ‘বু-র-র-র’ করে থুতু ছিটাল খোকা। তারপরেই হাতের ঝুনঝুনিটা শূন্যে ছুঁড়ে মারল।
‘দুষ্টু,’ বলে পা দিয়ে ব্রেক টিপে ফুটপাত থেকে ঝুনঝুনিটা উঠিয়ে নিল ক্যারল। আবার মায়ের মুখ দেখতে পেয়ে ছেলেটা উচ্ছ্বসিত আনন্দে হাত আর পা একসাথে ছুঁড়ল।
বাচ্চার কাণ্ড দেখে শব্দ করে হেসে উঠে ব্রেক ছেড়ে আবার রওনা হল ক্যারল। আজ তার মনটা অতি মাত্রায় খুশি। আগামীকালই স্বামীর সাথে এক মাসের ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। করফুতে ভিলা বুক করা আছে। সারাদিন বীচে শুয়ে রোদ পোহাবে ওরা।
পাহাড়ের ঢাল ধরে নিচে নামার জন্যে প্র্যাম ঘুরাল সে। কম্বলের তলা থেকে একটা গোলাপী পা বেরিয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে পায়ে সুড়সুড়ি দিল ক্যারল। নড়ে উঠল বাচ্চা-বালিশে ওর মাথাটা আরও নিচের দিকে নেমে গেল। রাস্তাটা খুব ঢালু।
হঠাৎ চমকে থেমে দাঁড়াল ক্যারল। ওর ঠিক সামনেই কি যেন পড়ল। তার কাঁধের সাথে বাড়ি খেয়ে পিছিয়ে গিয়ে আবার দোল খেয়ে ওর মুখ বরাবর ফিরে আসছে ওটা। একটা কাঠবিড়ালী—গলাটা কাটা, চোখ দুটো কোটর থেকে বের করা। পিছনের পা দুটো সুতো দিয়ে বাঁধা। উল্টো হয়ে ঝুলছে ওটা।
আপনাআপনি ক্যারলের হাত মুখের সামনে উঠে গেল। চিৎকার করে উঠল সে। পর মুহূর্তেই ওটাকে একহাতে ঠেলে সরিয়ে আগে বেড়ে প্রামটা ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে নিচের দিকে রওনা হয়েছে ওটা। বাচ্চাটা হাত নড়ে খুশিতে হাসছে। হয়ত ভাবল মা তার সাথে নতুন কোন খেলা খেলছে।
হাতল ধরার জন্যে লাফ দিল ক্যারল, কিন্তু নাগাল পেল না। হাইহিল জুতো পায়ে, বেগে ছুটতে পারছে না। চলার মাঝেই পা ঝাড়া দিয়ে জুতো খুলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। প্র্যামের গতি বাড়ছে। ফুঁপিয়ে উঠে টাল সামলাতে সামলাতে ওটার পিছনে ছুটল ক্যারল। বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের পায়েই পা বেধে হাঁটুর ওপর পটকান খেল। আবার উঠে ছুটল। দুই হাঁটুতে বাড়ি খাচ্ছে। আতঙ্কিত মরিয়া অবস্থায় বুঝেও স্বীকার করতে মন চাইছে না যে সে আর ধরতে পারবে না ওটা।
প্র্যামটা যখন পাহাড়ের গোড়ায় পৌঁছল তখনও দৌড়াচ্ছে ক্যারল। বাড়ি খেয়ে ওটা ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার মাঝখানে চলে গেল। ট্রাকটা নিমেষে প্র্যামটাকে কার্ডবোর্ড বাক্সের মত চ্যাপ্টা করে দিল-ভয়ে চোখ বুজে ফেরারও সময় পেল না ক্যারল।
পিছনে, কাঠবিড়ালীটা অদৃশ্য টানে গাছের ওপর পাতার আড়ালে চলে গেল। হাসল ট্রেভর গ্রান্ট-নিজের সাফল্যে খুশি হয়েছে সে।
.
ইনটেনসিভ কেয়ার ওয়ার্ডে ইনকিউবেটরের ভিতর রয়েছে বাচ্চাটা। জন্মের সময়ে বেশ ঝামেলা হয়েছে। সিজেরিয়ান অপারেশন করে সময়ের আগেই ছেলেটাকে বের করে নিতে হয়েছে। বেশ তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠেছে ওর মা। ডাক্তার জানিয়েছে বাচ্চার ওজন মাত্র পাঁচ পাউণ্ড হলেও ভয়ের কিছু নেই—সময়ে সবই ঠিক হয়ে যাবে। যখন খুশি এসে সে তার বাচ্চাকে দেখে যেতে পারবে।
অক্সিজেন টেন্টের ভিতর শুয়ে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। ওই ঘরে আরও এগারোটা শিশু রয়েছে। ডাক্তার এবং নার্সরা সবাই হাসপাতালের এই ‘স্পেশাল বেবি কেয়ার ইউনিট,’ নিয়ে গর্ব বোধ করে। এটা তৈরি হবার পর থেকে ওই এলাকায় শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে।
ইউনিফর্ম আর মুখোশ পরা দু’জন নার্স চা বিরতি নেয়ার আগে একবার বাচ্চাগুলোকে পরীক্ষা করে দেখল। সন্তুষ্ট হয়ে ওয়ার্ড ছেড়ে চলে গেল ওরা। দরজার বাইরে মুখোশ খুলে রাখল। করিডোরের শেষ প্রান্তে পৌঁছতেই নার্স ল্যামন্ট ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এল। মুখোশ পরা আছে বলে ওকে চেনা যাচ্ছে না। একটু অপেক্ষা করে, ওরা চলে গেলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সে। অক্সিজেনের একটানা ‘হিস্’ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই ঘরে। প্রথম কটের সামনে গিয়ে নাম পড়ে দ্বিতীয়টার কাছে এগিয়ে গেল। এইভাবে প্রত্যেকটা চেক করে যাকে খুঁজছে সেই কটের সামনে পৌঁছল।
কৌতূহল নিয়ে বাচ্চাটার দিকে চাইল সে। জন্মের পর দু’ পাউণ্ড ওজন বেড়েছে। মুখ থেকে ফ্যাকাসে ভাবটা কেটে গেছে। হাত দুটো আগের চেয়ে অনেক মোটা তাজা হয়েছে—শ্বাসও এখন স্বাভাবিক। বাম দিকে হেলে অক্সিজেনের চাবিটা বন্ধ করে দিয়ে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। দু’ মিনিট পরে ফিরে এসে চাবিটা খুলে দিয়ে আবার কটের দিকে চাইল। স্থির হয়ে গেছে বাচ্চাটা।