দশ
গ্রোভনার স্কোয়ারের বিক্ষোভকারী দলটা সকাল থেকে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এগারোটা নাগাদ জটলাটা আরও বড় হয়ে উঠতে দেখে স্লো হিল স্টেশন থেকে বাড়তি পুলিশ আনতে হয়েছে। রিপোর্টার আর টেলিভিশনের লোকজনও এসে হাজির হয়েছে। ক্যামেরা ফিট করার পর আরও দ্রুত বাড়ছে লোকের ভিড়। এখন অক্সফোর্ড স্ট্রীট আর পার্ক লেন থেকেও ওদের শ্লোগান শোনা যাচ্ছে।
অ্যামবাসেডরের লিমোসিন এসে থামতে দেখে একসাথে আগে বাড়ল সবাই। কিন্তু পুলিশের বাধা পেয়ে ওরা থামতে বাধ্য হল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে একে ব্যানারগুলোর ওপর চোখ বুলাল ডেমিয়েন।
‘ইসরাইলী খুনীদের বিচার চাই।’
‘আমেরিকা, তুমি নীরব কেন?’
‘বেজন্মা জুদের বয়কট কর।’
কালো চশমার আড়ালে ওর চেহারার কোন পরিবর্তন হল না। ঘুরে রিপোর্টারদের ভিতর দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ডেমিয়েন।
‘এখন কেমন বোধ করছেন, মিস্টার অ্যামব্যাসেডর?’ জিজ্ঞেস করল একজন রিপোর্টার। সবাই মিলে ছেঁকে ধরল ডেমিয়েনকে।
‘চমৎকার।‘
‘আপনার কি মনে হয় বিবিসির দুর্ঘটনা আর আজকের খবরটার মধ্যে কোন যোগসূত্র থাকতে পারে?’
‘মোটেও না,’ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল সে।
দরজার কাছে পৌছল ডেমিয়েন। পিছনে ফটোগ্রাফারদের মধ্যে সুবিধাজনক জায়গার জন্যে গুঁতোগুঁতি চলছে। পরিষ্কার চড়া গলায় একজন প্রশ্ন করল, ‘শ্রোয়ডারের কথায় মনে হয় ইসরাইলীরাই আসওয়ান বাঁধ ভাঙার জন্যে দায়ী—এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?’
লোকটার দিকে ফিরে দাঁড়াল ডেমিয়েন। কথাটা সত্যি হলে এটা নিশ্চয়ই বিশ্বশান্তির উপর একটা প্রচণ্ড আঘাত।’
‘আপনি কি সরকারী ভাবে এর নিন্দে করছেন?’ চট করে প্রশ্ন করে বসল আর একজন।
‘সব নিষ্ঠুরতাই নিন্দনীয়,’ বলল ডেমিয়েন, ‘কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা ঠিক হবে না।’
‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ইজিপ্টের প্রতি তার সম্পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেছে, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?’
হাত দুটো উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল ডেমিয়েন। একজন সিকিউরিটির লোক ওর জন্যে দরজা খুলে দিল।
‘আমি দুঃখিত, এই মুহূর্তে আমার আর কিছু বলার নেই।’
ভিতরে ঢুকতে গিয়ে একটা ডাক তার কানে এল। পিছন ফিরে দেখল কেট রেনল্ডস ভিড় ঠেলে তার দিকে এগোতে চেষ্টা করছে।
‘গুড মর্নিং, মিস রেনল্ডস।’ সিকিউরিটি গার্ডের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে কেট-এর জন্যে পথ করে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। উপস্থিত আর সব রিপোর্টারদের কাছ থেকে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য শোনা গেল।
ডেমিয়েনের সাথে লিফটের দিকে এগোল কেট। এত ধস্তাধস্তির পরে দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে সে।
‘গতরাতে ফোনে আপনার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম,’ বলল সে। ‘কিন্তু ফোন ধরেনি কেউ।’ চোখ তুলে ডেমিয়েনের দিকে চাইল সে। স্টুডিওতে গতদিনের অঘটনে এখনও ওর মনটা খুঁতখুঁত করছে। ‘ওটা পূরণ করার জন্যে কি কিছু করা যায় না?’
‘যেমন?’ লিফটের বোতাম টিপল ডেমিয়েন।
কাঁধ ঝাঁকাল কেট। মাফ চাওয়া ছাড়া কিছু করারও নেই তার। ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে। শেষে ডেমিয়েনই ওকে সাহায্য করল।
‘ইন্টারভিউটা শেষ করে?’
খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল কেট।
‘তবে ওখানে আর নয়,’ বলল সে। ‘স্টুডিওর চেয়ে বরং আমাদের বাড়িতেই ভাল হবে।
আশ্বস্ত হয়ে আবার মাথা ঝাকাল কেট। লিফটের দরজা খুলে গেল। চোখ থেকে কালো চশমা নামিয়ে খোলা দরজাটা ধরে রাখল ডেমিয়েন। ‘তোমার আপত্তি না থাকলে পরে এক সাথে আমরা ডিনারও খেতে পারি-কি বল?’ এলিভেটরে ঢুকল ডেমিয়েন। ‘শুধু আমরা তিনজন।’
কথার মানে বুঝতে না পেরে চোখের পলক ফেলল কেট।
‘তুমি, আমি আর পিটার।‘
পিটার? ভাবল সে। পিটার কেন? কিছু না ভেবেই তাড়াতাড়ি কেট বলল, ‘ধন্যবাদ, কিন্তু এসবের মধ্যে আবার পিটারকে এনে কি হবে?’
‘ওকে আমার খুব ভাল লাগে,’ বলল ডেমিয়েন। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার সময়ে কেট-এর দিকে চেয়ে হাসল সে।
ঘুরে দাঁড়াল কেট। নিজের ওপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর। নিজেকে এভাবে খেলো করার কি দরকার ছিল? পিটার নয়—শুধু তুমি আর আমি’—এটাই কি বলতে চেয়েছিল সে? ছি, ছি, কি লজ্জা। পিটার তার নিজের ছেলে, তবু কেন ওর এই হিংসা? ওদের দু’জনের মধ্যে যেন কেমন একটা গোপন সমঝোতা আছে। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে এগোলো কেট। একজন সিকিউরিটি গার্ডকে ওর দিকেই চেয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হল।
দরজার কাছে পৌঁছে লোকটার দিকে চেয়ে হাসল কেট। আগামীতে এমন হলে তার চলবে না-মহিলা-সুলভ আচরণ করতে হবে। ছেলেকে নিয়ে আসতে বলেছে ডেমিয়েন—তাতে চট করে কেউ কিছু ভাবতে পারবে না-সতর্ক কূটনীতিবিদ। আর যথার্থ ভদ্রলোক। কিন্তু গতরাতে ওই যথার্থ ভদ্রলোকটি সারারাত কি করেছে? চোখ দেখে তো মনে হল এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি।
.
অ্যানড্র ডয়েলের মেহগনি আর চামড়ার আসবাবপত্রের বদলে ঘরটায় এখন রিজেন্সি ফার্নিচার শোভা পাচ্ছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে টেলিফোনে কথা বলছে ডীন। নিচে বিক্ষোভকারীদের জটলা দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। সাউণ্ড প্রুফ ব্যবস্থা থাকলেও হালকা ভাবে ওদের চিৎকার ডীনের কানে আসছে।
‘হোয়াইট হাউস ক’টার সময়ে খবর পেয়েছে?’ রিসিভারের কাছে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করল সে। জবাব শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘড়ি দেখল। ‘আচ্ছা, আমাদের সময় আড়াইটায়-তাহলে আমার বিশ্বাস ওদিক থেকে সাড়া… কি? দুপুরবেলা, তোমাদের সময়?’
স্কোয়ারের ডান দিক থেকে আরও পুলিশ আসতে দেখে একটু থামল সে। ‘গ্যাস রায়টের পরে এত উত্তেজনা আর দেখিনি আমি,’ সন্তুষ্ট স্বরে বলল ডীন। ‘ইসরাইলী এমব্যাসির অবস্থা যে কি ভাবতেই ভয় করছে।
জানালার কাছ থেকে সরে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল সে। টেলিফোনের তার লম্বা হয়ে তাকে অনুসরণ করছে। বিজয়ের হাসিতে এবার ভরে উঠল ওর মুখ।
‘না, ছেলে হয়েছে,’ বলল সে। ‘একেবারে রাজপুত্তুরের মত চেহারা।’
অভিনন্দন গ্রহণ করে চোখ তুলে ডেমিয়েনকে ঘরে ঢুকতে দেখল।
‘আচ্ছা, এখন রাখি,’ বলে ফোন ছেড়ে দিল ডীন।
ডেমিয়েনের মুখে মেকী হাসিটা এখন আর নেই। অফিসের দরজা বন্ধ হওয়ার পর তার নিজস্ব কুৎসিত চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে।
‘বুহেরের সাথে কথা হল,’ উৎসাহের সাথে জানাল ডীন। ‘এন. এল. এফ. রিপোর্টটা হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।’ কোন জবাব না দিয়ে নীরবে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। ফুল পাঠানোর জন্যে ধন্যবাদ,’ আবার বলল সে। ‘বারবারা খুব খুশি হয়েছে।’
‘ছুরিগুলোর খবর কি?’ বিরক্ত সুরে ডেমিয়েনের মুখ থেকে কথা ক’টা বেরিয়ে এল। ফুলের আলাপ করার সময় নেই তার
একেবারে চুপসে গেল ডীন।
‘খোঁজ নেয়ার জন্যে বুহের শিষ্যদের লাগিয়েছে,’ চট করে নিজেকে সামলে নিল সে। ‘একজন প্রীষ্ট ওগুলো নিলামে কিনে ইটালির একটা মনাস্টেরিতে পাঠিয়েছে।’ ডেস্কের কাছে সরে গিয়ে নোটের ওপর চোখ বুলালো সে। সুবি…কি যেন নাম।’ নামটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে ডীন।
‘সবিয়াকো,’ বলল ডেমিয়েন। ‘সান্তা বেনেডিক্টাসের মনাস্টেরি।’
‘ঠিক,’ ডেমিয়েন কথা বলায় খুশি হয়ে মাথা ঝাঁকাল ডীন। ‘আমাদের ইটালির লোকজনকে কাজে লাগানো হয়েছে…
‘লাভ নেই,’ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল ডেমিয়েন। ‘পাখি উড়ে গেছে।’
জানালা দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বাইরে চেয়ে যেন আপন মনেই সে বলে চলল, ‘নাজারীনের জন্ম উপলক্ষে ইংল্যাণ্ডে হাজির হয়েছে। নাজারীনকে আমি ধ্বংস করার আগেই ওরা আমাকে শেষ করতে চাইছে।’ আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে ডেমিয়েন। ‘গত রাতে জন্ম হয়েছে তার।
চোখের পাতা পড়ল-ভর রাখার জন্য টেবিল আঁকড়ে ধরল ডীন। তার নোট করা কাগজ বাতাসে উড়ে মেঝেতে পড়ল।
‘জন্ম মুহূর্ত থেকেই ওর উপস্থিতি আমি টের পাচ্ছি,’ বলতে বলতে ডীনের দিকে ফিরল সে। ‘ঠিক ভাইরাসের মত–কুড়েকুড়ে খেয়ে আমাকে নিঃশেষ করে ফেলছে।’
ডেমিয়েনের কথা যে কতটা সত্যি বুঝতে পারছে ডীন। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখল বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। চোখের কোণে কালি পড়েছে। বয়সের রেখা ফুটে উঠেছে মুখে। কিশোর তাজা মুখটা যেন রাতারাতি বুড়িয়ে গেছে।
‘এখন থেকে যতদিন সে বেঁচে থাকবে-বড় হবে, ততই আমার শক্তি কমবে।’
আবার চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চাইল ডেমিয়েন। ‘নাজারীন,’ ক্লাস্ত স্বরে বলল সে, ‘তুমি একটা কাপুরুষ। তাই আমার মুখোমুখি হতে ভয় পাও। কিন্তু তুমি যেখানেই লুকাও না কেন তোমাকে খুঁজে বের করব আমি। তুমি মানুষকে গজাল ঠুকে তোমার ঈশ্বর-ভক্তির ক্রুশে গেঁথেছ—তোমাকে বিস্মৃতির ক্রুশে লটকে তার প্রতিশোধ নেব। ‘
শিউরে উঠে জানালার কাছে এগিয়ে ডেমিয়েন কি দেখছে জানার জন্যে উঁকি দিল ডীন। লোকের ভিড়ে ডাইনে থেকে বামে চোখ বুলাল। মাঝখানে এসে চমকে উঠে ওদিকে ডেমিয়েনের দৃষ্টি আকর্ষণ করাল।
একটা প্ল্যাকার্ড সবগুলোর মাঝে বেশি করে ফুটে উঠেছে।
‘কি আনন্দ, যীশু আবার জন্ম নিয়েছেন।
দু’জনে একসাথে প্ল্যাকার্ড হাতে লোকটার দিকে চাইল। সেও ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে—মুখে বিজয় উল্লাস।
লাফিয়ে পিছনে সরে গেল ডেমিয়েন—কেউ যেন ঘুসি মেরেছে ওকে। বিষণ্ণ ভাবে মাথা নেড়ে ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল সে।
.
সন্ধ্যার দিকে বিক্ষোভকারীর ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। শেষ পর্যন্ত মাত্র একজন টিকল। একটা বেঞ্চের সাথে ব্যানারটা ঠেকা দিয়ে রেখে বসে বসে কবুতরকে দানা খাওয়াচ্ছে লোকটা।
মিনিটে মিনিটে দালানটার দিকে মুখ তুলে দেখছে ম্যাটিয়াস। লক্ষ্য রাখছে কখন বাতি নেভে, কর্মচারীরা কে কোন্ দরজা দিয়ে বাড়ি ফেরে। একবার থর্নের লিমোসিন গাড়িটাকে আগে বাড়তে দেখে ঘাসের ওপর দিয়ে সেও এগিয়েছিল, কিন্তু কেউ বেরাল না–টুপিটা চোখের ওপর টেনে নিয়ে ড্রাইভার ঘুমানোর জোগাড় করল।
এখন কেবল একটাই বাতি জ্বলছে। জানালায় লোক দু’জনের দিকে তাকাল ম্যাটিয়াস। ‘আর ভয় নেই,’ অস্ফুট স্বরে বলল সে, ‘প্রভু যীশু আবার ফিরে এসেছেন।
এমব্যাসির ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছে ডীন। সেই সকাল থেকে সারাটা দিন আজ নষ্ট হয়েছে। অনেক কাজ জমে গেছে, তবু একটা কাজেও ডেমিয়েন হাত দেয়নি। নীরবে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়েই কাটিয়েছে। গুমোট থেকে বাঁচার আশায় ডীন হাজার বার আজ বাথরূমে গেছে।
ডেমিয়েনের পাশে এসে দাঁড়াল ডীন। নিচে স্কোয়ারের দিকে চেয়ে বিরক্ত স্বরে সে বলল, ‘খামোকা ওখানে বসে করছে কি লোকটা?’
‘আমার জন্যে অপেক্ষা করছে,’ বৈচিত্র্যহীন একটানা সুরে জবাব দিল ডেমিয়েন। ‘ওকে অনুসরণ করে ওদের পাতা ফাঁদে আমি ধরা পড়ি, এটাই চাইছে
নাক দিয়ে অবজ্ঞার একটা শব্দ করল ডীন। ‘লোকটা একটা ইডিয়ট। ওকে আচ্ছা করে শাসিয়ে পুলিশ দিয়ে শায়েস্তা করা উচিত। আপনি এমন একটা ছেলেমানুষী ফাঁদে পা দেবেন আশা করছে কি করে?’
‘কারণ সে জানে ঠিক তাই আমি করব।’
নিরুপায় ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ডীন। এসবের কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। স্টুডিওর সেই লোকটার কথা তার মনে পড়ল।
‘কিন্তু ওর কাছেও যদি ওই রকম একটা ছুরি থাকে?’
ডেস্ক থেকে একটা বিনকিউলার বের করে চোখে লাগিয়ে ম্যাটিয়াসের ওপর ফোকাস করল ডেমিয়েন।
‘না থাকলে বৃথাই সময় নষ্ট করছি আমি,’ বলল সে।