সাত
এমব্যাসির রিসেপশনে যাবার জন্যে ককটেল ইভনিং ড্রেস পরেছে কেট রেনল্ডস। গোড়ালি পর্যন্ত ঝুল, গাঢ় রঙের গাউন। দেখেই বোঝা যায় পোশাকটা দামি বিউটি পারলারে চুলের পরিচর্যাও করিয়েছে সে পুরো এক ঘন্টা। মেকআপ নেয়নি বললেই চলে। পরিচিত পুরুষ বন্ধুরা বলে বাড়তি প্রসাধনের প্রয়োজন তার নেই। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে পিছন ফিরে হাত নেড়ে ছেলেকে বিদায় জানাল কেট। ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পিটার—দুষ্টামি করে মা’কে কুর্নিশ জানাল সে। সন্তুষ্ট মনে ট্যাক্সিতে উঠল কেট-সত্যিই তাহলে তাকে আজ রানীর মতই দেখাচ্ছে। পিটার বলে একসাথে বেড়াতে বেরুলে নাকি লোকে তাকে ওর বড় বোন বলে ভুল করে।
ড্রাইভারকে আমেরিকান এমব্যাসি যাওয়ার নির্দেশ দিল কেট। এই মাসেই এটা দ্বিতীয়বার। প্রথমবার…অ্যানড্র ডয়েলের চোখ উড়ে যাওয়া চেহারাটা মনে করে শিউরে উঠল সে।
আত্মহত্যা রহস্যের শেষ পর্যন্ত কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। যারা তাকে চিনত তারাও কেউ ওই অপ্রত্যাশিত অদ্ভুত ঘটনার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেনি 1 বলতে গেলে একটু তাড়াহুড়া করেই যেন নতুন অ্যামব্যাসেডরকে পাঠানো হল। দেয়ালের নতুন পেইন্ট ভাল করে শুকোবারও সময় পায়নি
ডেমিয়েন থর্ন সম্পর্কে কেট-এর কৌতূহল অনেক। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সেই এতবড় একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল হয়েছে সে—তবে একথা সবাই জানে যে রাজনীতির সিঁড়িতে উপরে ওঠার এটা ওর প্রথম পদক্ষেপ। বিবিসির ওয়াশিংটন সংবাদদাতার সাথে কেটের টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। লোকটা থর্নের প্রচুর প্রশংসার পরে ঠাট্টা করে বলেছিল ডেমিয়েন থর্নের সাক্ষাৎকার নেয়াটা নাকি খুব উপভোগ্য হবে। পুরুষদের যত একরোখা চিন্তা।
ডেমিয়েন থর্ন অবিবাহিত। এই কারণেই কেট-এর আগ্রহ আরও বেশি। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে স্ত্রীরও কিছু কিছু ভূমিকা থাকে। এক্ষেত্রে ওই জায়গাটা কোন্ ভাগ্যবর্তী পূরণ করে সেটা একটা লক্ষ্য করার বিষয়। ডেমিয়েনের কোন প্রেমিকা নেই সে জানে—মেয়ে-ঘটিত কোন দুর্নামও শোনা যায়নি। সমকামী নয়ত?—মনে হওয়ার পরক্ষণেই চিন্তাটাকে সে অসম্ভব বলে বাতিল করে দিল। অমন লোককে কিছুতেই আমেরিকানরা অ্যামব্যাসেডর করে লণ্ডনে পাঠাবে না। মোড় ঘুরে গ্রোভনার স্কোয়ারে ঢুকল ট্যাক্সি। ভাড়া মেটাতে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত ঢুকাল কেট।
.
ওক কাঠের সুদৃশ্য প্যানেল দিয়ে ঘেরা রিসেপশন রূম। দেয়ালগুলোতে কালচে তৈলচিত্র শোভা পাচ্ছে। ছাদ পর্যন্ত উঁচু আয়নাগুলো সোনালী ফ্রেমে বাঁধা। ভেলভেটের ভারি পর্দা ঝুলছে জানালায়। দরাজ হাতে খরচের ছাপ রয়েছে সবখানে।
নিজের আমন্ত্রণ পত্রটা বাড়িয়ে দিয়ে আড়চোখে নিমন্ত্রিতের লিস্টটা দেখে নিল কেট। নামজাদা কাগজের কয়েকজন সাংবাদিককেই কেবল বেছে দাওয়াত করা হয়েছে।
তাকে যে কেন ডাকা হয়েছে তা ভাল করেই জানে কেট। এমব্যাসির কাছে সে অফিশিয়ালি জানতে চেয়েছিল তার প্রোগ্রামে ডেমিয়েন থর্ন অংশ নিতে রাজি হবেন কিনা। ওরা সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তাকে নিজেই সরাসরি ডেমিয়েনের কাছে প্রস্তাব দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
একটা ওয়াইন গ্লাস তুলে চারদিকে চেয়ে পরিবেশটা জরিপ করে নিল কেট। মামুলি কথাবার্তা চলছে। রসালো বা কান দেয়ার মত সিরিয়াস কিছু নয়।
ডান দিকের দু’জন ফরেন অফিসের লোক। এই ধরনের অনুষ্ঠানে সব সময়েই ওদের দেখা মেলে। সঙ্গীর গায়ে ভর দিয়ে মশগুল হয়ে মদের লেবেলটা পরীক্ষা করছে একজন।
‘লাফিট থর্ন,’ নেশা জড়ানো স্বরে মন্তব্য করল লোকটা।
শালার কোম্পানিটাই কিনে নিয়েছে,’ অন্যজন বলল।
‘সোয়াবীন দিয়ে কত কী-ই না এরা বানাচ্ছে আজকাল।’
হেসে ওদের দিকে এগিয়ে গেল কেট। ‘সত্যিই কি ওর বয়স মাত্র বত্রিশ?’ খুশি মনেই ওদের আলোচনায় যোগ দিল সে।
‘জানি না,’ বোতল হাতে লোকটা জবাব দিল। ‘হলেও অবাক হব না। আমেরিকানরা হাঁটার আগেই দৌড়োতে শেখে।’ নাক টানল সে। ‘মদের মত।
পিছন থেকে কারও গলা শোনা গেল। ‘তোমার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে—সত্যিই তাই। এত কম বয়সী অ্যামব্যাসেডর এই প্রথম।’
কেট পিছনে ফিরে দেখল একজন চমশা পরা লোক হাসিমুখে তার দিকে চেয়ে আছে।
আমি হারভি ডীন,’ বলল সে। ‘অ্যামব্যাসেডরের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি।’
ওর বাড়ানো হাতটা নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে নিজের পরিচয় দিল কেট।
‘আমার স্ত্রী বারবারা,’ বলল ডীন।
আবার হাত মেলাল কেট। মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু এই পরিবেশে একেবারে বেমানান। বাচ্চা হবে এই খুশিতেই সে ডুবে রয়েছে। ওকে বলার মত কোন কথা খুঁজে পেল না কেট
‘অ্যামব্যাসেডরের সাথে দেখা হয়নি তোমার?’ প্রশ্ন করল ডীন
‘না, এখনও সে সৌভাগ্য হয়নি।’
‘এসো, পরিচয় করিয়ে দিই।’
‘খুব খুশি হব।’ আজ তার এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্যই অ্যামব্যাসেডরের সাথে পরিচিত হওয়া। বারবারার সাথে উল বোনার নকশা নিয়ে আলাপ করে কাটালে কোন ফল হবে না। কামরার অন্যদিকে ডেমিয়েনকে দেখে ঠিকই চিনতে পেরেছে কেট। আকর্ষণ আছে বটে লোকটার। দেখতে ভাল, স্মার্ট; সম্ভবত বুদ্ধিমানও সে। কিন্তু আর কি?—ভাবছে কেট। ওর দোষগুলো?
ডীনের পিছন পিছন অতিথিদের ভিড় ঠেলে এগোল সে। ফায়ারপ্লেসের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ডেমিয়েন। লম্বা আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। হালকা ভাবে কেটের কনুই ছুঁয়ে কোথায় যেতে হবে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল ডীন।
‘মিস্টার অ্যামব্যাসেডর,’ বলল সে, ‘ইনি বিবিসির কেট রেনল্ডস। টেলিভিশনে নিয়মিত এঁর নিজস্ব প্রোগাম হয়, ‘দ্য ওয়ার্লড ইন ভিশন’।
‘ওয়ার্লড ইন ফোকাস,’ শুদ্ধ করল কেট।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইন ফোকাস,’ বলল ডীন।
‘কিংবা আউট,’ বলল কেট। ‘যখন যেমন হয়।’
মাথাটা সামনের দিকে একটু ঝোঁকাল ডেমিয়েন। ‘পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম, মিস্ রেনল্ডস। আপনি নিশ্চয়ই বিবিসির বারবারা ওয়াল্টারস?’
মাথা নাড়ল কেট। ‘এই বেতনে? বিবিসিকে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং চ্যারিটি কি সাধে বলা হয়?’
ডেমিয়েনের হাসিটা বিশদ হল। অন্তরঙ্গ ভাবে আরও কাছে সরে এসে জানাল সেও ওই ব্যবসাতেই আছে। নিজের কৃতিত্বে কেট নিজেকে দশে দশ দিল অ্যামবাসেডরের সাথে আলাপ হয়েছে কিন্তু এরই মধ্যে অনেক কালের চেনা বন্ধুর পার্যায়ে পৌছে গেছে সে। ভাগ্য ভালই যাচ্ছে দেখে আর একটু সাহসী হল কেট 1
‘লণ্ডন কেমন লাগছে?’ প্রশ্ন করল সে।
‘মনে হচ্ছে ভালই লাগবে,’ হেসে জবাব দিল ডেমিয়েন। আশেপাশে যা দেখেছি সবই খুব আকর্ষণীয় লাগছে।’
প্রচ্ছন্ন প্রশংসায় মনে মনে খুশি হল কেট
‘শুনেছেন হয়ত আপনাকে একান্তে পাওয়া আমার দরকার-অবশ্য সেটা পেশাগত কারণেই।
‘শুনিনি,’ বলল ডেমিয়েন। ‘আলাপের বিষয়টা কি হবে?’
‘তরুণদের সম্পর্কে আপনার মতামত শুনতে আমি আগ্রহী। আমার ছেলে পিটার আপনার ভক্ত। বারো বছর বয়স ওর কিন্তু ওর ধারণা…’
কথা শেষ করতে পারল না কেট। মাঝপথে বাধা দিয়ে ডীন জানাল ইসরাইলী অ্যামব্যাসেডর বিদায় নেয়ার আগে ডেমিয়েনের সাথে একটু কথা বলতে চায়…
কেট-এর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল ডেমিয়েন। আলাপ করতে পারলে ভালই হবে,’ বলল সে। আগামীকাল তুমি বরং হারভিকে ফোন করে একটা সময় ঠিক করে নিও। রোববার হলে কেমন হয়?’
নিশ্চয়ই, ভাবল কেট। কিন্তু পিটারের কথাও তার ভাবতে হবে। ওই একটা দিন ওরা দু’জনে একসাথে কাটাবার সুযোগ পায়। দোটানায় পড়ল সে। সমস্যার সমাধান করে দিল ডেমিয়েন।
‘পিটারকেও নিয়ে এসো,’ বলল সে।
লম্বা কামরার অন্যপাশে চলে গেল ডেমিয়েন। ওদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ট্রে থেকে একটা গ্লাস তুলে নিয়ে নিজেকে অভিনন্দন জানাল কেট। এত সহজেই সব হয়ে গেল—বিশ্বাসই হতে চাচ্ছে না।
সুশ্রী, আকর্ষণীয়, বুদ্ধিমান।
আর অবিবাহিত।
.
শুরু থেকেই পিটার আর ডেমিয়েনের বন্ধুত্ব জমে উঠেছে। ওদের ভাব দেখে কেট—এর একটু হিংসাই হচ্ছে। আবারও ডেমিয়েন তাকে অবাক করেছে—কারণ এর আগে কেউ এত সহজে পিটারের মন জয় করতে পারেনি। সাধারণত পিটার চুপ থাকে অথবা কাটাকাটা জবাব দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ডাল গলবে না। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু আজ সে নিজের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে-উচ্ছ্বাস আর খুশিতে উপচে পড়ছে। ডেমিয়েন যেন জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধু।
আগের প্ল্যান মতই রোববার হাইড পার্কে এসেছে ওরা। সারপেন্টাইন লেকের ধারে ডেমিয়েন আর পিটার হাঁটু গেড়ে বসে একটা মডেল স্পীড-বোট নিয়ে খেলায় মগ্ন। ছেলের উৎসাহ দেখে অবাক হয়েছে কেট। ওর বয়স এখন বারো। দিনকে দিন আরও সুন্দর আর সুপুরুষ হয়ে উঠছে। পিটারের দাদী বলে বড় হলে নাকি সে অগুণতি যুবতীর রাতের ঘুম হারাম করবে।
ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে একটা ছবি তুলল কেট। খেলা নিয়েই ব্যস্ত ওরা—এদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বিশাল কুকুর এসে হাজির হল। কুকুরটা একদৃষ্টে চেয়ে আছে কেট-এর দিকে। নিজের অজান্তেই সভয়ে এক পা পিছিয়ে গেল সে। প্রকাণ্ড চোয়াল, ওর, আর চোখের চারপাশে ভীতিকর হলুদ ছাপ।
ওকে অগ্রাহ্য করে পিটার আর ডেমিয়েনের দিকে এগোল কেট। চকিতে তার মনে হল লোকটা ছেলের মন জয় করে তার কাছে ভেড়ার চেষ্টা করছে না তো? সাথে সাথেই মন থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল—এতটা স্কুল সে নয়, আর তাছাড়া এসবের প্রয়োজনও তার নেই।
‘মা, কেটকে কাছে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল পিটার। স্পীড বোটের রিমোট কন্ট্রোলটা ওর হাতে। ‘দেখ, ডেমিয়েন আমাকে কি দিয়েছে,’ খুশিতে চকচক করছে চোখ। ‘সত্যি বলছি, আমি চাইনি।’
ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল কেট। আকাশ ছোঁয়া দাম ওটার।
‘এটা আপনার বাড়াবাড়ি, ডেমিয়েনের দিকে ফিরে আপত্তি জানাল কেট। ‘জিনিসটা আমার চেয়ে পিটারের কাছে থাকাই নিরাপদ,’ হেসে জবাব দিল ডেমিয়েন। ‘আমি চালাতে গিয়ে যদি আর কারও জাহাজের সাথে ধাক্কা লাগাই তবে তাতে আন্তর্জাতিক বিবাদ বেধে যেতে পারে।’
কেট-এর আর কিছু বলার রইল না।
দু’জনে পিটারের বোট চালানো দেখছে।
‘বেশি আস্কারা দিলে ছেলে অবাধ্য হয়ে উঠবে।’
‘মাঝে মধ্যে ছেলেপেলেদের একটু আস্কারা দিতে হয়।’
‘জানি, সব সময়েই তাই করি। পিটার যখন কোলের বাচ্চা সেই সময়ে ওর বাপ মারা যায়।’ এসব কথা কেউ জানতে চায়নি। তবু যে কেন বলছে জানে না কেট। তবু সে বলে চলল, ‘তাহলেই বুঝতে পারেন সুযোগ পেলেই ও আমাকে কিভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।’
সত্যি কথা বলতে কি, পিটারই বরং আমাকে আজ সকাল থেকে নষ্ট করছে, ‘ বলল ডেমিয়েন। ‘এতদিন পরে আবার ছেলেবেলার সেই নির্ভেজাল আনন্দের স্বাদ পেলাম আমি। ওর মত ছেলে পাওয়া গর্বের কথা।’
‘জানি,’ বলল কেট। ‘কিন্তু ওকে সেটা টের পেতে দিই না। এমনিতেই যা দুরস্ত হয়েছে জানলে একেবারে পেয়ে বসবে।’
মুখ তুলে ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে এবার সেই চিরন্তন প্রশ্নটা তুলল কেট। বিয়ে করার কথা ভেবেছেন কখনও?’
মাথা নাড়ল ডেমিয়েন। ‘আমি একটু বেশিমাত্রায় খুঁতখুঁতে—আর তাছাড়া ভাবার বিশেষ সময়ও পাইনি।’
‘তাড়াহুড়োরই বা কি আছে?’
কাঁধ উঁচালো ডেমিয়েন। ‘মাঝে মাঝে চিন্তাও হয়।’ পিটারের দিক থেকে সরে কুকুরটার ওপর গিয়ে স্থির হল ওর চোখ। ডেমিয়েনের দিকেই চেয়ে আছে ও। চোখদুটো সামান্য কুঁচকানো ব্যাপারটা যেন ঠিক পছন্দ হচ্ছে না ওর।
পিটারের কুকুর পালার খুব শখ।’
‘কিনে দিলেই পার।’ একদৃষ্টে কুকুরটার দিকে চেয়ে আছে ডেমিয়েন। ‘ওই বয়সে কিশোর ছেলেদের খুব প্রিয় সঙ্গী হয় কুকুর। ছেলেবেলায় এই রকম একটা কুকুর ছিল আমার। দু-হাজার বছর আগেও রোমান আর্মির সাথে মার্চ করেছে এরা।
‘সত্যি?’
‘পাপের মতই আদি ওরাও।’
কুকুরটা উঠে ধীর পায়ে হাঁটা ধরল। কেট আর ডেমিয়েনও ওর পিছু নিল বোট হাতে পিটারও যাচ্ছে। চলার পথে মাঝে মাঝে এটা-ওটা ছুঁড়ে কুকুরটাকে খেলা দিচ্ছে সে। পার্কের ভিতর দিয়ে পুব দিকে চলেছে ওরা। মনে হচ্ছে যেন চারে মিলে একটা আদর্শ ফ্যামিলি।
সার্পেস্টাইন লেক ছেড়ে চলার পথে কেট-এর মনে পড়ল মৃত্যুর দিন আগেকার অ্যামব্যাসেডর এনডু ডয়েল একই পথ ধরে চলেছিল। কথাটা তুলে কেট দুঃখ প্রকাশ করল…কিন্তু ডেমিয়েনের কোন ভাবান্তর হল না…কোনও মন্তব্যও সে করল না। তার মন অন্য কোন চিন্তায় মগ্ন ভেবে কাঁধ ঝাঁকাল কেট।
স্পীকার্স কর্নারে পৌঁছতেই পিটার ওদের ছেড়ে ছুটে বাম দিকের আইসক্রীম ভ্যানের দিকে চলে গেল। বক্তাদের ঘিরে রয়েছে কয়েকটা ছোট ছোট জটলা। বক্তাদের মধ্যে একজনের গলাই সব ছাপিয়ে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে।
.…’পাপ-পুরুষকে ধ্বংস করতে যীশু আবার ফিরে আসবেন,’ সাধু পল থিষলনীকীয়দের (Thessalon।ans) কাছে লেখা তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে লিখেছেন।
লোকজনের জটলার ভিতর দিয়ে রাস্তা করে এগিয়ে গেল কেট আর ডেমিয়েন।
‘কিন্তু ভুল বুঝো না, কারণ পাপ-পুরুষের অর্থাৎ শয়তানের পুত্রের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার আগে তিনি আসবেন না। ভুল করো না, কারণ যীশু-বিরোধী পাপ-পুরুষের ক্ষমতাও অসীম…’
কথাগুলো কেট-এর কানে ঢুকছে ঠিকই, কিন্তু ভিতরে ঢুকছে না।
‘আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব আনাড়ি ভাবছেন,’ বলল সে। ‘আপনাকে যেসব প্রশ্ন করব বলে মনে করেছিলাম তার বেশিরভাগই বাকি রয়ে গেছে।
‘সেইজন্যেই সময়টা আরও উপভোগ্য হয়েছে,’ বলল ডেমিয়েন। ওগুলো তোমার প্রোগ্রামের জন্যে তুলে রাখ।
সেই ভাল-ভাবল কেট। সকালটা সত্যি চমৎকার কেটেছে-সবদিক থেকেই সার্থক। পেশাগত ভাবেও সফল। ব্রিটিশ টেলিভিশনে তার প্রোগ্রামেই ডেমিয়েন থর্নকে প্রথম দেখা যাবে।
কেট-এর চিন্তায় বাধা পড়ল। হঠাৎ তার খেয়াল হল একা একাই হাঁটছে ও। কয়েক পা পিছনে দাঁড়িয়ে পড়েছে ডেমিয়েন। স্থির দৃষ্টিতে সামনের দিকে চেয়ে আছে সে।
‘প্রভু যীশুর প্রত্যাবর্তনের সময় ঘনিয়ে এসেছে…’
দৃষ্টি অনুসরণ করে কেট দেখল একটা বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে একজন সাধারণ লোক-ধর্মপ্রচার লোকটার পেশা নয়। ওর পাশে দাঁড় করানো লঠির মাথায় একটা পোস্টারে যীশুর প্রত্যাবর্তনের দিন আসন্ন বলে লেখা রয়েছে ওর পাগলামির নমুনায় হেসে ডেমিয়েনের পাশে ফিরে গেল সে।
‘এক এক করে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বলতে শুরু করেছে,’ বলে চলল লোকটা। ‘এবং চাঁদ সুরুয আর তারা থেকে সংকেত পাওয়া যাবে…’ বন্ধুগণ, বর্তমানে সেই সংকেত দেখা গেছে ক্যাসিওপিয়া তারামণ্ডলে। তিনটে তারা পরস্পরের দিকে ছুটে আসছে—তাদের সন্ধিক্ষণে আমাদের প্রভু যীশুর পুনরাবির্ভাব ঘটবে।’
এবার বক্তার চোখ পড়ল ডেমিয়েনের ওপর। চোখাচোখি চেয়ে রইল দু’জনে। কারোই পলক পড়ছে না।
কি হয়েছে তোমার, ডেমিয়েন?’ শূন্য দৃষ্টিতে ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল পিটার। ইতিমধ্যেই ‘তুমি’তে নেমে এসেছে ওদের সম্বোধন।
‘কিছু না,’ আড়ষ্টতা কাটিয়ে পিটারের দিকে চাইল ডেমিয়েন। ছেলেটা তার জন্যে আইসক্রীম কিনে এনেছে দেখে হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে ওর হাত থেকে সেটা গ্রহণ করল। ছিটগ্রস্ত লোকটার পাগলামি দেখছিলাম।’
মাথা ঝাঁকিয়ে মায়ের দিকে ফিরে তাকেও একটা আইসক্রীম দিল সে। আইসক্রীম নেয়ার সময়ে মা’কে চমকে উঠতে দেখে ঘুরে চেয়ে দেখল সেই কুকুরটা তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চারটে থাবা শক্তভাবে মাটি আঁকড়ে রয়েছে। ঘাড়ের কাছে লোমগুলো খাড়া হয়ে আছে। গলার গভীর থেকে রাগের গম্ভীর ‘গর্র্’ আওয়াজ তুলছে!
‘হ্যালো, ডগি,’ কুকুরটার দিকে হাত বাড়াল পিটার।
‘পিটার,’ চড়া সুরে ধমক দিল কেট। ‘ওর কাছে যেয়ো না বলছি!’
মায়ের ধমককে পাত্তা না দিয়ে কুকুরটার উদ্দেশে শিস দিল পিটার। একমাত্র তোমাকেই ও পছন্দ করে না, মা।’
কেট-এর পাশ দিয়ে পিছনে গাছগুলোর কাছে দাঁড়ানো মিসমিসে কালো একজনের দিকে একাগ্র চোখে চেয়ে আছে কুকুরটা। কালো আর লম্বা মানুষটার নজরও ওদের ওপরই রয়েছে।
‘কাম্ অনু, ডগি,’ তুড়ি দিয়ে ডাকল পিটার। ছেলেটার দিকে ফিরল বিশাল জন্তুটা। রাগে কাঁটা দিয়ে ওঠা লোম আবার স্বাভাবিক হল—এগিয়ে এসে পিটারের হাত চেটে ডেমিয়েনের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে বক্তাদের তামাশা দেখায় মন দিল কেট। ছেলেদের সাথে ডেমিয়েনের কি কথা হল সেটা ওর কানে গেল না।
‘অবাক কাণ্ড, মা’কে পছন্দ করছে না কেন ও?’
‘কারণ সে আমাদের একজন নয়।’
নীরবে ওদের মধ্যে যে ভাবের বিনিময় হল সেটাও দেখল না কেট।
‘…অসীম শক্তিশালী হয়ে উঠবে সেই পাপ-পুরুষ,’ বলে চলল বক্তা। ‘ক্ষমতার অধিকারী হয়ে মহৎ যা কিছু সব নষ্ট করবে। শান্তি ফিরে আসার আগে নির্বিচারে অনেক ধ্বংসযজ্ঞ সে চালাবে।’
.
সারাটা দুপুর অধীর অপেক্ষায় রয়েছে ওরা। ফাদার ডি কার্লো অস্থির ভাবে ঘরময় পায়চারি করছেন। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই ম্যাটিয়াস আর পাওলো ঘরে ঢুকল। ম্যাটিয়াসের হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। আজকের গরম খবরগুলো উগরাতে তর সইছে না—উত্তেজনায় টগবগ করছে সে।
ফাদার ডি কার্লোর অনুমতি পেয়ে মুখ খুলল ম্যাটিয়াস। আজ ওরা তার দেখা পেয়েছে, জানাল সে। দশ ফুটের মধ্যেই এসে দাঁড়িয়েছিল—সাথে ছিল একজন মহিলা, একটা বাচ্চা ছেলে আর একটা কুকুর।
‘মেয়েটা কে?’ প্রশ্ন করলেন ফাদার।
উত্তর দিল পাওলো। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে বলল, ‘টেলিভিশন রিপোর্টার। একজন লোক তার অটোগ্রাফ নিল দেখে পরে তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনেছি।’ নোট বইটা খুলে পাতা ওল্টালো সে। ‘কেট রেনল্ডস। ভদ্রমহিলার বেশ নামডাক আছে।’
‘আর ছেলেটা?’
‘সম্ভবত ওই মহিলারই ছেলে।
কনুই দুটো টেবিলে রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন ডি কার্লো। ভাবছেনঃ একজন মহিলা আর তার কিশোর ছেলে—এ আবার কোন্ ঝামেলায় পড়া গেল? ম্যাটিয়াস এতক্ষণ কথা বলতে না পেরে ছটফট করছিল, এই সুযোগে চট করে আলাপে যোগ দিল সে।
‘প্লীজ, ফাদার,’ অনুনয় করল ম্যাটিয়াস। ‘প্রভুর সেবা করার এই সুযোগটা আমাকে দিন। থর্নের সাথে আমার চোখে চোখে যোগাযোগ হয়েছে—নিজেকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে ওকে ধ্বংস করতে দিন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়লেন ডি কার্লো। কত আবেগপ্রবণ, সাহসী আর সরল এরা…অতিমাত্রায় সরল।
তুমি যেমন ওকে চিনেছ, সেও তেমনি তোমাকে চিনেছে—তোমার মনের ভাব জেনে ফেলেছে,’ বললেন ফাদার। ‘অসতর্ক অবস্থায় ওকে আমাদের ঘায়েল করতে হবে।
চোখ তুলে চাইলেন ডি কার্লো। দিনের বেলাতেও ঘরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। সাতজন মানুষ আর সাতটা ছুরি। এত বড় একটা শক্তির বিরুদ্ধে নিতান্তই তুচ্ছ।
‘জায়গা মত ছুরি বেঁধাতে হলে শিকারকে স্থির অবস্থায় পেতে হবে,’ মন্তব্য করল একজন।
‘বসা অবস্থায়,’ বলল আর একজন। ‘কিংবা ঘুমন্ত অবস্থায় হলে আরও ভাল। মাথা নাড়লেন ফাদার। ‘ওর বাড়িতে দিনরাত কড়া পাহারা থাকে। ‘
‘এমব্যাসিতে?’ প্রশ্ন করল আর একজন।
অবান্তর প্রশ্নটার জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না ফাদার। পাওলো বিড়বিড় করে উঠল ‘অসম্ভব’। ডি কার্লো গ্রোভনার স্কোয়ারের বিশাল এমব্যাসি বিল্ডিংটা আর সেখানে ডিউটিরত গার্ডদের নিজের চোখেই দেখে এসেছেন। মাত্র একখানা ছুরি হাতে ওই সুরক্ষিত দালান আক্রমণ করতে চায় ব্রাদার মার্টিন।
‘হ্যালে লুইয়া!’ মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়াল ব্রাদার বেনিটো। ঘরের কোণে তিন পায়ে দাঁড়ানো ডাঙা টেলিভিশনটা দেখিয়ে সে বলল, ‘ওই যে আমাদের সমস্যার সমাধান।’
বেনিটোর কথা প্রথমে ফাদার ডি কার্লো কিছুই বোঝেননি। কিন্তু অল্পক্ষণ আলাপ আলোচনার পর তাঁর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। উপর দিকে চেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন তিনি।