শব্দজাল – ৯

পাইপটাকে নামিয়ে রেখে নিজের সুটটা একটু টেনে সোজা করে নিল প্রফেসর। কফি কালারের চশমার অন্য পাশে তার দৃষ্টিতে কী চলছে বোঝার উপায় নেই। নিজের ধূসর হয়ে আসতে থাকা কাচা-পাকা চাপদাড়িতে সামান্য হাত বুলিয়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল সে।

“এ ধরনের ফর্মাল মিটিঙে যখন কেউ কথা বলে প্রথমেই একে-ওকে ধন্যবাদ জানায়, নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আমি সেরকম কিছু করব না। কারণ আসলেই আমাদের হাতে ওসব ফর্মালিটির জন্য সময় নেই। আর তাছাড়া আমি এসব পারিও না। তার ওপরে যে পরিস্থিতিতে আমাকে ডেকে আনা হয়েছে তাতে আমি কতটুকু কী করতে পারব নিজেও জানি না। “

প্রফেসর এই পর্যস্ত বলতেই আতিকুল আলম প্রায় হতাশার সাথে জিভ কাটল আর টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে বিরক্তির শব্দ করে উঠল কুমড়ো আর টুথপিক, তৃতীয় মানুষটা মনোযোগ দিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছে।

“এক মিনিট, এক মিনিট,” কেউ কিছু বলার আগেই প্রফেসর একটা আঙুল তুলল। “আপনারা আমার কথার ভুল অর্থ বুঝছেন। আমি সঠিকভাবে পারব না বলছি দুটো কারণে। প্রথমত, আমি সরাসরি এই লাইনের লোক নই। আমি কোনো ইন্টারোগেশন এক্সপার্ট নই। তবে এই ব্যাপারটা আমার এরিয়ার বাইরে হলেও একসময় আমি এই ফিল্ডে কাজ করেছি। তাই সেই অভিজ্ঞতা আমি কাজে লাগিয়ে দেখতে পারি, যেহেতু আপনাদের,” বলে নিজেকে সংশোধন করে নিল সে। “মানে আমাদের হাতে অন্য কোনো অপশন নেই। আর দ্বিতীয় কারণটা হলো, পরিস্থিতি যা দেখা দিয়েছে তাতে কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না কোন প্রক্রিয়াতে কাজ হবে। আমি রাজনীতির লোক না যে মিথ্যে ওয়াদা করব,” শেষ কথাগুলো বলার সময়ে প্রফেসরের গলা লোহার মতো দৃঢ় শোনাল, সেইসাথে তাতে যথেষ্ট উত্তাপের তেজ।

“আমি আমার সম্পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করছি প্রফেসর জাকারিয়ার ওপরে,” আতিকুল আলম বলে উঠল।

“আমিও,” বলে আফসার তার টিমের দিকে তাকাল। “সেইসাথে আমার টিমের সবাই।”

“আমরাও,” বলে উঠল তৃতীয় সেই প্রতিনিধি। “যদিও আসলে আমাদের আর কিছু করার নেই। যদি প্রফেসর তথ্যগুলো বের করতে পারে তবে তো কথাই নেই। আর তিনি যদি না পারেন তাহলে কী হবে আমি আসলে জানি না। তবে আমি জানতে চাইব প্রফেসরের পরিকল্পনাটা কী? তিনি আসলে কী করতে চাইছেন?”

প্রফেসর সামনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ পাইপ টানছে। সে কোনো জবাব দিল না।

“প্রফেসর?” টেবিলের সামনে থেকে আফসার ডেকে উঠল আবার।

“হুমম,” বলে সে পাইপটাকে রেখে শেষবারের মতো ধোঁয়া ছেড়ে সবার ওপরে একবার নজর বুলিয়ে নিল। “কয়েকটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করে নেই; নির্দিষ্ট কোনো মেডিসিন এই লোকের ওপরে আদৌ কাজ করবে কি না নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। যেসব মেডিসিন আসলে এসব ক্ষেত্রে অপরাধীদের ওপরে প্রয়োগ করা হয় সেগুলোর নির্দিষ্ট কোনো প্রয়োগ প্রক্রিয়া নেই। আর তাছাড়া মানুষ ভেদে সেগুলোর রিঅ্যাকশনও ভিন্ন হয়। আর তাছাড়া এই মানুষটার ফিজিওলজি এবং নার্ভ সিস্টেম একেবারে আলাদা। কাজেই ওগুলো প্রয়োগ করলে উলটো ফল হওয়ার সম্ভবনা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। কাজেই ওটা বাদ। এরপর আসে হিপনোটিজম বা ব্রেইন ওয়াশ বা মেমরি রিডিঙের মতো ব্যাপারগুলো। আমার ডেটা বলে,” বলে সে একটু থেমে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে উঠল, “আমার অ্যানালিসিস বলে এগুলোর সবগুলোই সমস্যা জর্জরিত। হিপনোটিজম এর ওপরে কাজ করবে না কারণ এই লোক হিপনোটিজমে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। আমরা টিভি কিংবা সিনেমায় বা নভেলে এসব ব্যাপারকে যেভাবে দেখি ব্যাপারগুলো আসলে মোটেও সেভাবে কাজ করে না। হিপনোটিজম কাজ করতে হলে এর ওপরে উভয় পক্ষের বিশ্বাস থাকতে হয়। থট রিডিং সম্ভব হবে না কারণ এই লোকের থট প্রসেস আর্টিফিসিয়ালি গার্ডেড থাকার সম্ভবনা প্রায় শতভাগ। যারা জানেন না তাদের জন্য বলছি, বিশ্বের বড় বড় নেতা থকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিইওদের পর্যন্ত এরকম আর্টিফিসিয়াল মেন্টাল গার্ডের ব্যবস্থা থাকে, যাতে খুব সহজে তাদেরকে হিপনোটাইজ করে বা থট রিডিং করে কেউ তথ্য বের করে নিতে না পারে। এই লোকের অবশ্যই সেটা আছে। কাজেই এগুলো সব বাদ,” এই পর্যন্ত বলে প্রফেসর থেমে গেল।

সবাই তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে।

“তাহলে আপনি কী করতে চাচ্ছেন?” সেই তৃতীয় প্রতিনিধি প্রশ্ন করল।

প্রফেসর নীরবে পাইপ টানছে। তার পাইপ নিভে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু সে টেনেই চলেছে, পাইপ দিয়ে কোনো ধোঁয়াও বেরোচ্ছে না। হঠাৎ সে বলে উঠল, “আমি মানুষটার সাথে কথা বলব।”

“শুধু কথা…?” প্রশ্নটা কে করেছে বোঝা গেল না।

“হুমম, শুধুই কথা,” বলে প্রফেসর আবারও নিভে যাওয়া পাইপে দুবার টান দিল। “শুধুই কথা। এই একটা মাত্র উপায়ই আছে বলতে গেলে। কথা দিয়েই তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে হবে। আমাদের সময় খুব কম, “ বলে সে উঠে দাঁড়াল। “আমাদের এক্ষুনি কাজ শুরু করা উচিত। এই লোকটা আছে কোথায়?”

“এই ফ্লোরের নিচের ফ্লোরেই নিয়ম অনুযায়ী তাকে আইসোলেটেড ইনসিমুলেশন রুমে রাখা হয়েছে। আপনার সাথে ওখানেই তার কথোপকথন চলবে,” বলে আফসার আতিকুল আলমের দিকে তাকাল অনুমতির অপেক্ষায়। আতিকুল আলম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “আর সেক্ষেত্রে আমরা এই পুরো টিমের সবাই পাশের অবজারভেশন এবং কমিউনিকেশন রুম থেকে পুরো ব্যাপারটা মনিটর করব। সেইসাথে আপনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করব। সেখানে নিরাপত্তার ব্যাপারটা দেখার জন্যও লোক থাকবে।

প্রফেসর টেবিল থেকে তার কাঠের বাক্সটা তুলে নিয়ে বলে উঠল, “আমাদের এক্ষুনি অবজারভেশন রুমে যাওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করব ততই বেটার হবে। কাজেই,” বলে সে দরজার দিকে নির্দেশ করল।

ওদের সবাইকে পথ দেখিয়ে আফসার নিয়ে এলো নিচের ফ্লোরে। সেখানে স্টুডিওর মতো হালকা লাল লাইট জ্বালানো একটা রুমে প্রবেশ করল তারা। রুমের বাইরে দুজন গার্ড পুরোদস্তুর কমান্ডোর পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে সাবমেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা সবাই ভেতরে ঢুকে দেখল, কমিউনিকেশন সেটের সামনে কাজ করছে দুজন। আর কমিউনিকেশন সেটের পেছনে তিন সারি চেয়ার রাখা। আর পুরো রুমটাই মুখ করে আছে দেওয়াল জোড়া একটা বিরাট ঘোলা কাচের দিকে।

ভেতরে প্রবেশ করেই প্রফেসর বুঝতে পারল এই কাচের ওপাশের রুমেই আছে আন্তর্জাতিক ডেমোলিশন এক্সপার্ট কুখ্যাত অপরাধী অ্যালবার্ট ফাত্তাহ ওপরে মাস্টার অব ডেমোলিশন ওরফে মাস্টার ডি, যার কাছ থেকে তাকে আজ রাতের ভেতরেই আদায় করতে হবে কিছু তথ্য। আর এর ওপরে নির্ভর করছে বহু মানুষের প্রাণ, দেশের ভবিষ্যৎ এবং আরও অনেক কিছু।

অবজারভেশন রুমের ভেতরে প্রবেশ করে সবাই যার যার মতো বসে যেতে নিচ্ছিল তার আগেই আতিকুল আলমকে উদ্দেশ করে প্রফেসর বলে উঠল, “আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি, যতটুকু জানি এই কাচটাকে চাইলেই ক্লিয়ার গ্লাসে কনভার্ট করা যায়,” বলে সে দেওয়ালজোড়া লাগানো কাচটা দেখাল। “আমি চাই এটাকে ক্লিয়ার করা হোক, যাতে আমি লোকটাকে দেখতে পারি। সেইসাথে অনুরোধ করব আমি আগামী দশ মিনিটের জন্য একা এই রুমে থাকতে চাই গার্ডরা চাইলে থাকতে পারে। অন্য কেউ নয়। আমি রুমে ঢোকার আগে অ্যালবার্ট ফাত্তাহকে কিছুক্ষণ অবজার্ভ করতে চাই এখানে থেকে। “

“অব্যশই অবশ্যই,” বলেই আতিকুল আলম সবাইকে বেরোনোর জন্য ইশারা করল। সবাই বেরোনোর পর শুধু গার্ড দুজন, আতিকুল আলম, আফসার আর প্রফেসর রইল রুমে। আতিকুল আলম আফসারকে নির্দেশ মতো কাজ করতে বলে সে প্রফেসরের কাছে এসে বলল, “দোস্ত, এখন সব তোর হাতে,” বলে সে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।

প্রফেসরের সামনে এসে আফসার একটা প্লাস্টিকের ফাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল। “স্যার, এখানে ফাত্তাহর ব্যাপারে সব আছে। আপনি তো স্যার প্রস্তুতির কোনো সুযোগই পেলেন না। তবুও চাইলে শেষ মুহূর্তে এটাতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন।

“ধন্যবাদ, আফসার তুমি গ্লাসটাকে ক্লিয়ার করে বাইরে অপেক্ষা করো, এই ফাইলটা আমার লাগবে না,” বলে সে ফাইলটাকে ফেরত দিয়ে দিল।

আফসার কিছু না বলে সে খুব দ্বিধান্বিত একটা চাহনি দিয়ে গ্লাসটার সামনে গিয়ে একটা বাটনে চাপ দিতেই সেটা ক্লিয়ার হয়ে গেল। প্রফেসর ভেতরে তাকিয়ে দেখল ভেতরে ধূসর রঙ করা একটা রুম। মাঝখানে একটা টেবিল। আর টেবিলটার দুপাশে দুটো চেয়ার। টেবিলের মাঝখানে থাকা একটা হুকের সাথে চেন দিয়ে হাতকড়া পরানো অবস্থায় সেটাতে বসে আছে একজন মানুষ। আর কিছু না দেখে সে আফসারের দিকে ফিরে বলে উঠল—

“ঠিক দশ মিনিট, এরপরে তুমি সবাইকে নিয়ে এখানে চলে এলেই আমি ভেতরে ঢুকব। দশ মিনিট,” প্রফেসরের কথা শেষ হতেই আফসার বেরিয়ে গেল।

প্রফেসর ওয়ান ওয়ে মিররের সামনে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ভেতরের দিকে। তারপর আনমনেই তার দৃষ্টি চলে গেল নিজের হাতঘড়ির দিকে।

ঠিক দশ মিনিট পর একে একে সবাই প্রবেশ করল রুমে। আফসার এগিয়ে এসে একটা এয়ার পিস ধরিয়ে দিল প্রফেসরের হাতে। ওটা ডান পাশের কানে পরে নিল প্রফেসর। এটা দিয়ে সে ভেতর থেকে এই রুমের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবে।

“স্যার, এটাও রাখুন,” বলে আফসার ছোট একটা রিমোটের মতো জিনিস তার হাতে দিল। “স্যার, এটার প্রথম বাটন চাপলে এখানে একটা বেল বাজবে। আপনার কোনো নির্দেশনা থাকলে সেটা আমরা বুঝতে পারব। যদিও আমরা এখানেই আছি, সিকিউরিটিরাও। তবুও ইমার্জেন্সি হলে এই দ্বিতীয় বাটনটা চাপলে টেবিল বা চেয়ার থেকে একটা ইলেকট্রিসিটি পাস করবে অপর পাশের চেয়ারে বসা মানুষটার শরীরে।

প্রফেসর হেসে উঠল, “এটা লাগবে না,” বলে সে ফেরত দিল জিনিসটা। “তবে আমার একটা নির্দেশনা আছে,” প্রফেসর বলে উঠল। নিজের কাঠের বাক্সটা থেকে একটা প্যাকেট বের করে আফসারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিল সে। আফসার খুব অবাক হয়ে একবার তাকে দেখল আরেকবার আতিকুল আলমকে দেখল।

“বুঝতে পেরেছ?” প্রফেসর জানতে চাইল। “আর আমি কয়েকটা জিনিস নিয়ে ভেতরে ঢুকব। যেমন আমার মোবাইল। এই বাক্সটা। যদিও সিকিউরিটি হিসেব অনুযায়ী এমনটা করা উচিত নয় তবুও এগুলো আমার দরকার হবে।”

আফসার আবারও আতিকুল আলমের দিকে দেখতেই সে মাথা নেড়ে অনুমতি দিল। “ঠিক আছে স্যার। তবে খুব সাবধানে। “

“আরেকটা কথা,” প্রফেসর এগোতে গিয়েও আরেকবার ফিরে তাকাল। “রুমের ভেতর থেকে আমি যদি কোনো নির্দেশনা দেই সেটা যত অদ্ভুতই শোনাক না কেন মানতে হবে, এই ব্যাপারে কোনো আপত্তি চলবে না। বোঝা গেছে?” প্রশ্নের শেষ অংশটুকু সে উচ্চারণ করেছে আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে।

আতিকুল আলম মৃদু হেসে মাথা নেড়ে অনুমতি জানাল।

“বেস্ট অব লাক স্যার,” আফসার শুকনো মুখে বলে উঠল।

প্রফেসর মুখে কিছু বলল না। কারণ সে প্রফেশনাল মানুষ। ভাগ্যে তার খুব বেশি বিশ্বাস নেই। কিন্তু আজ রাতে মনে হচ্ছে সেটাই তার সবচেয়ে বেশি দরকার হবে।

রুমের কাছকাছি যেতেই পটপট বেশকিছু শব্দ শুনে একটু অবাক হয়ে রুমের বাইরের জানালা দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল তার। নতুন বছর শুরু হয়ে গেছে। রাতে মেডিটেশন শুরু করার পর মাত্র দুই ঘণ্টা পার হয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে কত সময় পার হয়ে গেছে। সময় ব্যাপারটা সবসময়ই আপেক্ষিক। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুমের সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সে সিকিউরিটিকে নির্দেশ দিল দরজা খোলার।

সিকিউরিটি লোকটা নিজের বাম হাতের গ্লাভসটা খুলে দরজার পাশের একটা বিশেষ কি-প্যাডে পাসওয়ার্ড টাইপ করে নিজের আঙুল রাখল স্ক্যানারে। পাসওয়ার্ড ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে যেতেই অনেকটা এসি বাসের দরজা খোলার সময় যেমন নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো শব্দ হয় সেরকম শ্বাস ফেলার মতো শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। শেষবারের মতো একবার ঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল প্রফেসর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *