শব্দজাল – ৩

“স্যার, সব ঠিক আছে?”

মশিউরের প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে উঠল প্রফেসর। “হুমম?”

মশিউরের প্রশ্নে তার ভাবনার সুতো কেটে গেছে। “কী বললে? সব ঠিক আছে কি না?” বলে এক মুহূর্ত ভাবল সে। “হ্যাঁ, সব ঠিক আছে,” বলে সে ফোনের রিসিভারটা ধরিয়ে দিল মশিউরের হাতে।

“শোন মশিউর, তোমার কাজ আছে এখন,” বলে সে রুম্পা আর বাচ্চাটার দিকে ইশারা করল, “তোমাদেরও কাজ আছে,” একটা আঙুল তুলে সে মশিউরের দিকে পিস্তলের মতো তাক করল। “তুমি এক্ষুনি সাদ্দামকে ডেকে তুলবে,” সাদ্দাম হলো প্রফেসরের ব্যক্তিগত ড্রাইভার। “সাদ্দামকে ডেকে তুলে আমার এসইউভিটা বের করতে বলবে। তারপর তুমি আর তোমার বউ রেডি হয়ে নেবে।”

মশিউর একবার তার বউয়ের দিকে দেখে নিয়ে অবাক ভঙ্গিতে বলে উঠল, “স্যার, আপনি কি কোথাও যাবেন নাকি?” প্রশ্নটা উচ্চারণ করে সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে আরেকবার রুম্পার দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ, আমি বেরোচ্ছি,” প্রফেসর খেয়াল করে দেখল সে মশিউরের দিকে তাকিয়ে কথা বললেও মশিউর ভুলেও তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। চশমা না পরার কারণে তার ভেতরে আবারও পুরনো অস্বস্তিটা ফিরে এলো। “শুধু আমিই বেরোচ্ছি না। তোমরাও বেরোেচ্ছ। তোমার বাড়ি ভালুকা না?”

“জি, স্যার…” মশিউর আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তাকে সে সুযোগ না দিয়ে প্রফেসর কথা বলে উঠল।

“আমি এখন রেডি হয়ে বেরোব। তুমি সাদ্দামকে ডেকে তুলে গাড়ি রেডি করতে বলো। আমার জন্য ভিন্ন গাড়ি অপেক্ষা করছে, আর সাদ্দামের সাথে যাবে তোমরা। আমি বেরোনো মাত্র সাদ্দাম তোমাদেরকে নিয়ে ভালুকার উদ্দেশে রওনা দেবে। বোঝা গেছে?” প্রফেসরের কথার জবাবে মশিউর স্রেফ মাথা নাড়ল। আর ডাইনিংরুমে তিন-তিনটে বিহ্বল প্রাণীকে রেখে নিজের বেডরুমে চলে এলো প্রফেসর।

অনেক কম সময়ের ভেতরে অনেকগুলো কাজ সারতে হবে তাকে এখন। সময় এখন সবচেয়ে মূল্যবান।

বেডরুমে প্রবেশ করেই চলে এলো একটু আগে শাট-ডাউন করে রাখা ল্যাপটপটার কাছে। ল্যাপটপটার অন বাটন চেপে চলে এলো সে বিরাট ক্লোদিং ক্যাবিনেটের সামনে। পরনের পোশাক পালটে চারকোল গ্রে স্যুটের সাথে ম্যাচ করা দুধ সাদা শার্ট, গাঢ় কফি কালারের হ্যান্ডমেড নিটেড টাই পরে নিয়ে গলায় চাপাল মেরুন রঙের একটা সিল্কের স্কার্ফ। ব্রিটিশ কায়দায় স্কার্ফটাকে টাই সমেত জড়িয়ে সেটাকে প্রবেশ করিয়ে দিল সুটর সাথে ম্যাচ করা ভেস্টের ভেতরে। পোশাক পরিধান শেষ করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে সে ল্যাপটপটাকে হাতে নিয়ে চলে এলো নিজের স্টাডিতে।

রিডিং টেবিলের ওপরে ল্যাপটপটাকে রেখে চারপাশে বইয়ে ভরা আলমারির ফাঁকে নির্দিষ্ট ক্যাবিনেটটা ওপেন করে সেটার ভেতরে বাটন চেপে চালু করে দিল একটা বিশেষ মেশিং। মেশিনটার ওপেন বাটন চাপতেই মৃদু একটা গুঞ্জন করে চালু হয়ে গেল শক্তিশালী মেশিনটা। মেশিনটার একপাশ থেকে বের হয়ে থাকা ক্যাবলগুলোর ভেতর থেকে বেছে বেছে দুটো ক্যাবল আলাদা করল সে। তারপর সে দুটোকে টেনে নিয়ে এলো ল্যাপটার কাছে। এই ক্যাবল দুটোর একটা ল্যাপটপটার পাওয়ার সোর্স হিসেবে কাজ করবে, অন্যটা ল্যাপটপটাকে সংযুক্ত রাখবে মেশিনটার সাথে। ল্যাপটপটাকে সংযুক্ত করে ওটাতে কয়েকটা কমান্ড কী চাপল সে। কাজ শেষ করে এসে দাঁড়াল গোল স্টাডিকে ঘিরে রাখা সারি সারি বইয়ের র‍্যাকগুলোর একটার সামনে।

“টাইম টু আনলিশ দ্য বিস্ট,” আনমনেই বলে উঠল সে। বড় করে একবার দম নিয়ে র‍্যাকের দ্বিতীয় সারির একটা বই টান দিয়ে খানিকটা আলগা করতেই ওটার নিচে একটা ডালার মতো খুলে গিয়ে সেখানে দৃশ্যমান হলো একটা কী-প্যাড। অত্যন্ত সাবধানতার সাথে পাসওয়ার্ড টাইপ করার সময়ে আপনাতেই প্রফেসরের দৃষ্টি চলে গেল মাথার ওপরে থাকা সিসি ক্যামেরার দিকে। পাসওয়ার্ড মিলে যেতেই স্বস্তির সাথে সে অনুভব করল নেমে আসা ডালাটার একটা অংশ আলগা হয়ে গেছে। সেখানে ভেলভেটের মসৃণ আবরণের ভেতরে ছোট ছোট চারটে খোপ। একটা খোপ খালি আর বাকি খোপ তিনটের ভেতরে আলাদা আলাদা রঙের লাইনিং দেওয়া তিনটে বাক্স রাখা। একটু চিন্তা করে লাল লাইনিং দেওয়া বাক্সটা তুলে নিল সে।

বাক্সটার ভেতরে তিনটে জিনিস রাখা। একটা মেটাল ব্যান্ডের ঘড়ি, হালকা ঘোলাটে কফি কালারের কাচ বসানো কালো ফ্রেমেরে ভেতরে হালকা লাল লাইনিং দেওয়া একটা চশমা আর ঘড়ির ব্যাটারির মতো দেখতে একটা এয়ার পিস। এয়ার পিসটা বাম কানের ভেতরে নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসিয়ে নিয়ে ঘড়িটা হাতে পরে নিল প্রফেসর। তারপর চশমাটাকে এক হাতে নিয়ে বাক্সটাকে জায়গামতো রেখে র‍্যাকের ডালাটা আটকে দিল। ডালা আটকে চশমাটাকে দুহাতে ধরে সাবধানে চোখে পরে নিল সে। এয়ার পিস, ঘড়ি আর চশমাটাকে ঠিকঠাক করে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কিছু তথ্য ঘাঁটল সে। নির্দিষ্ট ব্যাপারগুলো জেনে নিতেই তার মুখে ফুটে উঠল মৃদু হাসি। তথ্যগুলো আবারও দেখে নিয়ে কয়েকটা নির্দেশ সেট করল। কাজ সেরে সোজা হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। স্টাডির লাইট অফ করে বাইরে বেরিয়ে দেখল মশিউর দাঁড়িয়ে আছে।

“বলো,” প্রফেসর দেখল তার চোখে চশমা দেখে মশিউর আবার স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে ফিরে এসেছে।

“স্যার, সাদ্দামকে ডেকেছি। সে রেডি হচ্ছে। আর আপনাকে নিয়ে আসা গাড়িটাও দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভওয়েতে। সাথে আসা অফিসারকে ভেতরে আসতে বলেছিলাম, তিনি আসেননি।”

“রুম্পা আর তোমার ছেলেটা?” প্রফেসর হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইল। ডাইনিংরুমে এসে একটা কেবিনেট খুলে ছোট একটা কাঠের বাক্স বের করল সে। তারপর কেবিনেটের একটা তাক খুলে বের করে আনল তার বিশেষ কালেকশন। সেখান থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটা জিনিস নিয়ে ভরে ফেলল কাঠের বাক্সের ভেতরে।

“ওরা রেডি হচ্ছে স্যার,” প্রফেসরের পেছনে দাঁড়ানো মশিউর কেন জানি কাঁচুমাচু করছে। সম্ভবত সে জানতে চাইছে এভাবে তাদেরকে বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে কেন। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছে না।

প্রফেসরও ব্যাখ্যা করার গরজ বোধ করল না। বরং খানিকটা ধমকের সুরেই নির্দেশ দিল, “এত রেডি হওয়ার কিছু নেই। আমি বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই যেভাবে আছ সেভাবে রওনা দেবে সাদ্দামের সাথে। বুঝেছ?”

মশিউর কিছু না বলে মাথা কাত করে সম্মতি জানাল।

“আর হ্যাঁ,” এগিয়ে যেতে যেতে পেছন ফিরে প্রফেসর বলে উঠল। “তোমরা বেরোর আগে অবশ্যই খেয়াল রাখবে বাড়ির সেন্ট্রাল পাওয়ার সোর্স যেন চালু থাকে। আমি আবারও বলছি, তুমি দুইবার করে চেক করে বেরোবে বাড়ির পাওয়ার সোর্স যেন কোনো অবস্থাতেই বন্ধ না হয়। বিষয়টা নিশ্চিত করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে তারপর বেরোবে, মনে থাকবে?” মশিউর দ্রুতবেগে মাথা নেড়ে জানাল ব্যাপারটা নিশ্চিত করবে সে।

প্রফেসর দৃঢ় পদক্ষেপে ডাইনিংরুম পার হয়ে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো লিভিংরুমে। ঢোলা প্যান্ট আর পাতলা টি-শার্ট পরে নির্বিকার মুখে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী কুচকুচে কালো একজন মানুষ। প্রফেসরকে নেমে আসতে দেখে তার মাথাটা সামান্য কাত হয়েই আবার সোজা হয়ে গেল।

এরকম চিন্তিত পরিস্থিতিতেও প্রফেসরের মনে প্রশ্ন জাগল, সাদ্দামের কি ঠান্ডা লাগে না। “সাদ্দাম, আমি একটা কাজে বেরোচ্ছি। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর তুমি মশিউর, রুম্মা আর ওদের বাচ্চাটাকে ভালুকা দিয়ে আসবে। পারবে না?”

প্রফেসরের প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম ঠিক আগের ভঙ্গিতেই আবারও মাথা নাড়ল, পারবে সে।

“এখান থেকে ভালুকা যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে?” প্রফেসরের হাতে ধরা কাঠের বাক্সটা খুলে একবার পরীক্ষা করে দেখে নিল ভেতরের জিনিসগুলো ঠিকঠাক নিয়েছে কি না।

“স্যার,” হাতের কড়ে গুনে হিসাব করে সাদ্দাম বলে উঠল, “এহান থনে চৌরাস্তা পার অইতে এক ঘণ্টা। চৌরাস্তা পার অইলে পরে আর জাম নাই। একটানে ভালুকা। অইনতে দুই ঘণ্টা লাগবো। স্যার, সব মিলায়ে সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা।”

“ঠিক আছে, তুমি ওদেরকে ভালুকা নামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করবে না। সোজা চলে আসবে উত্তরা এক নম্বর র‍্যাব ব্যাটেলিয়নের অফিসের পাশে পুলিশ ব্যুরো অব স্পেশাল ইনভেস্টিগেশনের অফিসে। ওই যে আতিকুল আলমের ওখানে। যেখানে মাঝেমধ্যেই তুমি নিয়ে যেতে আমাকে। মনে আছে?”

আবারও সে কোনো কথা না বলে একইভাবে মাথা নেড়ে জবাব দিল।

“আমি এখন ওখানেই যাচ্ছি। সারারাত ওখানেই থাকব। তবে একবার ওই অফিসে ঢুকে গেলে আমাকে আর মোবাইলে পাবে না। কাজেই যা বলেছি মনে করে ঠিকঠাক করবে আজ রাতে,” বলে প্রফেসর রওনা দিল বাইরের দিকে। একটু এগিয়েই সে থেমে ফিরে তাকাল সাদ্দামের দিকে। “সাদ্দাম, ঢাকায় কি তোমার পরিবারের কেউ আছে? মা-বাবা বা স্ত্রী?”

সাদ্দাম মাথা নেড়ে জানাল কেই নেই তার ঢাকায়। প্রফেসর স্বস্তির সাথে একবার মাথা নেড়ে বাইরের দিকে রওনা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *