শব্দজাল – ১৭

১৭

ফাত্তাহর কথা শুনতে শুনতে প্রফেসর অবাক হয়ে খেয়াল করল তার নিজের গলার কাছটাও একটু ভারি লাগছে। আনমনেই ভেতর থেকে প্রশ্ন জেগে উঠল, এটা কি মানুষটার স্মৃতি কাতরতা নাকি আত্ম উপলব্ধি? কিন্তু ভেতর থেকে জবাব পাওয়ার আগেই আবারও ফাত্তাহ বলতে শুরু করল।

“বিশ্বাস করবে না প্রফেসর, আমার মতো পোড়খাওয়া লোক যে কি না ওই বয়সেই ভাবত তার আর নতুন কিছু দেখার নেই। সেই মানুষটা ওই ছোট্ট মুখটা দেখে সেদিন কী যে আনন্দ পেয়েছিল তা আজও বলার কোনো ভাষা বা অবকাশ কোনোটাই নেই। ছেলের জন্ম হলো। সে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল। পারিবারিক ব্যবসা, আমার পড়ালেখা, চাকরি, সবই ভালো চলছিল কিন্তু যদি সব ঠিকঠাকই চলবে তবে আর গল্প হবে কীভাবে। আগেই বলেছি সময় হলো মানব জীবনের সবচেয় বড় নিয়ামক। সেই সময়টাই এমন ছিল। কোল্ডওয়ারের যুগ সবে শেষ হয়েছে। রাশিয়া তখন পরাশক্তি থেকে ধ্বংসস্তূপ। দুনিয়ার একমাত্র তাবেদার তখন আমেরিকা। প্রথম বুশ সরকার সবে ক্ষমতায় এসেছে। আর সে সময়েই দেখা দিল আমেরিকার সাথে মুসলিম বিশ্বের প্রথম বড় দ্বন্দ্ব–“

“গালফ ওয়ার—” ফাত্তাহর কথাটা শেষ করে দিল প্রফেসর।

তার কথা শুনে আনমনে মাথা নাড়ল ফাত্তাহ। “একদম ঠিক। ধর্মীয় কোন্দলের যে অভিশাপ বর্তমান বিশ্ব বহন করছে সেই অভিশাপের প্রথম ধাপ। দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে গেল গালফ ওয়ার। আমাদের মতো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের ওইসব যুদ্ধ-যুদ্ধ নিয়ে মাথাব্যথা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধের ধাক্কা ঠিকই গিয়ে লাগল আটলান্টিকের ওপারের সেই দেশে,” বলে ফাত্তাহ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে আবারও বলতে লাগল।

“প্রথম ধাক্কাটা লাগল অর্থনীতিতে। যুদ্ধ মানেই খরচ। যুদ্ধ মানেই কাড়ি কাড়ি টাকার খেলা। আর টাকা মানেই দেশের সাধারণ মানুষদের ওপরে চাপ। গালফ ওয়ার শুরু হতেই সে চাপ গিয়ে লাগল আমেরিকার অর্থনীতিতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এরকম চাপে আমেরিকায় আর পড়েনি। সেই ধাক্কা গিয়ে লাগল আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্টের ফান্ডিঙের ওপর পর্যন্ত। এক ধাক্কাতেই অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রজেক্টও বন্ধ হয়ে গেলে ফান্ডিঙের অর্থের অভাবে। তবে একভাবে বলতে গেলে আমরা অনেক লাকি ছিলাম কারণ সেই চাপ তখনও আমাদের ওপরে সেভাবে পড়েনি। তবে সব জায়গাতে একটা উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছিল। সত্যি কথা হলো টিভি মিডিয়া কিংবা অন্য মাধ্যমে যা আসে সেটা হলো কোনো ঘটনা যখন ঘটে তখন। কিন্তু খবর ঘটার আগে অনেক কিছু ঘটে যা মিডিয়া কিংবা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। আমেরিকার অবস্থা তখন অনেকটা ওরকম ছিল। তবে কিছু একটা যে ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে সেটার উত্তাপ ঠিকই টের পাওয়া যাচ্ছিল। আর সে সময়ে আমেরিকাতেও তাই ঘটছিল।”

“নাইন ইলেভেনের পর পুরো বিশ্ব দেখতে পেল কীভাবে বিভিন্ন ধর্মীয় কমিউনিটির ওপরে চাপ সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু যেটা কেউ জানে না, খেলাটা শুরু হয়েছে অনেক আগে, সেই গালফ ওয়ারের সময় থেকেই। বিশেষ করে রাশিয়ার পতনের পর আমেরিকার নিজের সৃষ্ট দানবগুলো যখন বুঝতে পারল যে তারা আসলে বোকামি করেছে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়ে। এক সরকার অন্য সরকারের পতনের জন্য তাদেরকে ব্যবহার করেছে তখন তারাই উন্মত্ত হয়ে ওঠে কিছু করার জন্য। আর আমেরিকার সরকারও জানত যে তাদের নিজেদের সৃষ্ট দানবগুলো ইতোমধ্যেই ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে তাদেরই সাজানো বাগানে, তাদেরকেই ধ্বংস করার জন্য। তবে সাধারণ মুসলমান হোক কিংবা সরকার কেউই যেটা জানত না যে আসলে পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই।”

ফাত্তাহ থামতেই প্রফেসর একবার ঘড়ি দেখল। প্রফেসর দেখল ফাত্তাহও ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। তবে বেশি বিরতি না দিয়ে সে আবারও বলতে শুরু করল, “সাহিত্য কর্ম হোক কিংবা টেরোরিজম, যেকোনো ব্যাপারের পেছনের মূল শক্তিটাকে বুঝতে হলে সেই সময়কে বোঝাটা খুবই জরুরি। সামাজিক অস্বস্তি কিংবা অর্থনৈতিক চাপ আমরা টের পাচ্ছিলাম সে-সময়ে কিন্তু এর চেয়ে আরও বড় দানব যে ভেতরে ভেতরে সৃষ্টি হচ্ছিল, সমাজের দৃশ্যমান কোণের আড়ালের গহিন অন্ধকার থেকে ভয়ংকর এক ড্রাগন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল একসময় তার নিঃসৃত আগুনে সব ছারখার করে ফেলার জন্য সেটা সাধারণ জনগণ কিংবা আমেরিকার সরকার কেউই টের পায়নি।”

“আমি তখন এসব থেকে অনেক দূরে। সর্বক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম আমার ডক্টরেটের শেষ বর্ষের প্রস্তুতি নিয়ে। আমাদের জীবন খুব স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। আমার ডক্টরেরেটর গবেষণার শেষ পর্যায়ে ছিলাম আমি। আমাদের বিষয়টাও ছিল খুবই দুর্দান্ত। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে বিষয়টা অনেকটা এরকম— আমরা সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসরের অধীনে যে টিম কাজ করাতাম পুরো টিম মিলিয়ে আমরা নতুন ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপ্লোসিভ তৈরি করার চেষ্টা করছিলাম। সারা পৃথিবীতেই তখন প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়ছিল। এমনকি সন্ত্রাসী হামলার জন্যও প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। আমি যে সময়ের কথা বলছি তার ঠিক আগের বছর কি আরেকটু আগে ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট রাজীব গান্ধীকে এই ধরনের আনট্রেসেবল প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের মাধ্যমেই হত্যা করা হয়েছে। যত ধরনের শক্তিশালী বোমা আছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ডিনামাইট। আমরা তখন কাজ করছিলাম এই ডিনামাইটের একটা বিশেষ ধরন নিয়ে। ডিনামাইট জিনিসটার পূর্বপুরুষ ছিল নাইট্রোগ্লিসারিন নামে এক ধরনের তরল বিস্ফোরক। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে নাইট্রোগ্লিসারিনকে কঠিন শোষকের মাধ্যমে শোষণ করিয়েই তৈরি হয়েছে ডিনামাইট। কিন্তু ডিনামাইট দিয়ে বিস্ফোরণের একটা অন্যতম অন্তরায় ছিল এর শক্তিকে পিন পয়েন্ট করানো। আমাদের চেষ্টা ছিল কীভাবে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ডিনামাইটের বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পিন পয়েন্ট করানো যায়, সেই সাথে কীভাবে সহজলভ্য উপাদানের মাধ্যমে কীভাবে এটাকে আরও কম খরচে উৎপাদন করা যায়। আমরা সফলতার কাছাকাছিই ছিলাম।”

“এর মধ্যেই একদিন আমার টিমের এক ছাত্র এসে জানায়, এক ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রির মালিক আমার সাথে দেখা করতে চায় আমাদের প্রজেক্টের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। আমি রীতিমতো চাঁদ হাতে পাই। কারণ অ্যাকাডেমিক জগতের বেশিরভাগ ফান্ড কোলাবোরেশন এভাবেই আসে। আর ওই সময়ে যখন চারপাশ থেকে সব ফান্ড চলে যাচ্ছে একটা নতুন ফান্ডের সোর্স পাওয়া মানে চাঁদ হাতে পাওয়া। বিশেষ করে যেকোনো ডক্টরাল স্টুডেন্টের জন্য শেষ বর্ষে এসে ফান্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মানে তার বিগত কয়েক বছরের পরিশ্রম হয় আরও দীর্ঘায়িত হওয়া আর না হয় পুরো পরিশ্রম মাঠে মারা যাওয়া। কাজেই এমন এক সুযোগ আমার সামনে আসাতে আমি রীতিমতো আবেগে আপ্লুত ছিলাম। আমার টিমের সেই ছেলের সাথেই আমি লোকটার সাথে দেখা করতে গেলাম ডাউনটাউনে। ছোটখাটো একজন মানুষ, ধুরন্ধর চেহারা। আমরা প্রাথমিক আলাপের পর তিনি ডেমো দেখতে চাইলেন। কাগজপত্র আমাদের সাথেই ছিল, আমরা ডেমো দেখালাম। তিনি সবকিছু পরীক্ষা করে বললেন, একেবারে বাস্তবিকভাবে দেখতে চান। আমরা তাকে আমাদের ল্যাবে নিমন্ত্রণ জানালাম কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। বরং আমাদেরকে বললেন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে তার সাথে যেতে হবে বিশেষ এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে ডেমো দেখাতে হবে, তার কোম্পানির ফাইনেন্সিয়ারের সামনে,” ফাত্তাহ একটু থেমে আবারও বলতে লাগল।

“বিশ্বাস করো প্রফেসর, তখনই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। ইউনিভার্সিটির এই ধরনের গ্র্যান্ড ডেমো সাধারণত এভাবে করা হয় না। আগেই বলেছি তখন ব্যাপক ফান্ডিং ক্রাইসিস চলছিল, তাই আমি সুযোগটা হারাতে চাইছিলাম না। বরং আমি তাকে প্রস্তাব দেই আমরা তাকে জানাব কিন্তু তার আগে আমাদেরকে আমাদের সুপারভাইজারের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ আমি পাইনি। “

“কেন? কী হয়েছিল?” প্রফেসর এই প্রথমবারের মতো সত্যিকারের কৌতূহল অনুভব করছে।

“সেদিন মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙে প্রজেক্ট সুপারভাইজারের ফোন কল পেয়ে। মাঝরাতে সে আমাকে ফোন করে প্রথমেই একচোট গালিগালাজ করে, কারণ আমরা তার অনুমতি না নিয়ে কোথায় গিয়ে, কী করেছি সেটা তাকে জানানোরও প্রয়োজন বোধ করিনি, ব্যাপারটা নিয়ে সে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।”

“সে কি এটা বলার জন্য মাঝরাতে কল করেছিল?” প্রফেসর প্রশ্নটা করেই সাথে জানতে চাইল, “আপনাদের সুপারভাইজারের নাম কী ছিল?”

ফাত্তাহ তার সুপারভাইজারের নামটা জানিয়ে প্রফেসরের মূল প্রশ্নের জবাব দিতে লাগল। “না প্রফেসর সেজন্য মাঝরাতে ফোন করেনি সে। বরং সে অন্য একটা খবর জানানোর জন্য ফোন করেছিল। আমার টিমের সেই মেম্বারকে এফবিআই ধরে নিয়ে গেছে সেদিন সন্ধেয়। খবরটা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়ি না বলে আমার বলা উচিত আমি মাটি ফুঁড়ে শূন্যে উঠে যাই। কোনো অবস্থাতেই বুঝতে পারি না কেন তাকে এফবিআই ধরে নিয়ে যাবে। আমি প্রফেসরের কাছে জানতে চেয়েও কোনো জবাব পাইনি। বরং সে আমাকে উলটো উপদেশ দেয় আমি যেন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সবকিছু তাকে বিস্তারিত জানাই। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। এমন সময় আমার আরেক টিম মেম্বার কল করে তার ওখানে যেতে বলে। তার কাছে নাকি গরম খবর আছে। আমি রাতের পরোয়া না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই গাড়ি নিয়ে। দুই ব্লক যাওয়ার আগেই একটা রোডব্লকের কাছে আমার গাড়ি থামিয়ে আমাকে অপহরণ করা হয়।”

প্রফেসর নিভে যাওয়া পাইপটা আবারও ধরিয়ে টানতে লাগল। ফাত্তাহর কাহিনি জমে উঠেছে। কিন্তু সে এখনও তার ক্ষতগুলো নিয়ে কিছু বলেনি। “কিন্তু এতসব কাহিনির সাথে আপনার—” বলে সে ফাত্তাহর মুখ দেখাল।

“আরে প্রফেসর, অধৈর্য হলে চলে? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, আমাকে বুঝতে হলে তোমাকে আগে পেছনের গল্পটা জানতে হবে। আর এখন সরাসরি এগুলোর প্রসঙ্গেই বলব,” এই পর্যন্ত বলে সে সামনে থাকা কফি কাপের দিকে ইশারা করে বলে উঠল। “আরেকটু কফি হবে কি?”

“অবশ্যই,” ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাটা বলে প্রফেসর কাচের জানালাটার দিকে ইশারা করল। “এরপর কী হলো?”

“আমাকে কে বা কারা অপহরণ করেছে আমি কিছুই দেখতে পাইনি। কারণ আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর দুই ব্লক পার হতেই একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে আমার গাড়িকে। আমি ওতেই অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার জ্ঞান ফিরে আসে একটা গুদামঘরের মতো জায়গাতে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে জায়গাতে একটা লম্বা ওয়ার্কবেঞ্চের ওপরে নিজেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করি আমি। মুখ থেকে কালো কাপড়ের আবরণ সরানোর পর আমার সামনে উপবিষ্ট কয়েকজনকে দেখতে পাই। যাদের ভেতরে ধুরন্ধর চেহারার ছোটখাটো সেই কোম্পানির ফান্ডিং এজেন্টকে চিনতে পারি আমি। ব্যাপার কী? কেন আমাকে এভাবে ধরে আনা হয়েছে জানতে চাইলে তারা আমাকে সোজা-সরল একটা প্রস্তাব দেয়। আগের দিন ওই লোকটাকে আমি যে মডেল দেখিয়েছি ঠিক সেই জিনিসটাই তাদেরকে প্রয়োজনমতো যথেষ্ট পরিমাণে বানিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি রাজি হইনি। সোজা কথায় আমার রাজি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এরপর শুরু হয়—”

“শারীরিক অত্যাচার,” বলে প্রফেসর যোগ করল।

কিন্তু তার কথার জবাবে ফাত্তাহ হেসে উঠল। “সেটা হলেও এক ভালো ছিল কিন্তু প্রথমে শুরু হয় জোকস। আমি কেমন মুসলমান, আমার ইমান আসলে দৃঢ় নয় এসব কথা বলা হয় কিছুক্ষণ। আমি একজন মুসলমান হয়ে বিশ্বের তাবৎ মুসলমান সমাজের জন্য আসলে কী করছি। ইত্যাদি ইত্যাদি,” বলে ফাত্তাহ আবারও হেসে উঠল। “মজার ব্যাপার কি জানো প্রফেসর? এখন এসব শুনলে হাসি পায় কিন্তু সেদিন যে কথাগুলো মনের ভেতরে খানিকটা প্রভাব সৃষ্টি করেনি তা কিন্তু নয়। এসব মনস্টারেরা এভাবেই আসলে সাধারণ মানুষদের দুর্বল করে,” বাক্যটা সে উচ্চরণ করল বেশ হালকা সুরে। “তবে আমি ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম যে-কারণে তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিইনি। আর আমি এটাও খুব পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে, আমার এই সৃষ্টি ভালো কোনো কাজে লাগানো হবে না।”

রুমের দরজাটা খুলে যেতেই অস্ত্র হাতে গার্ড প্রবেশ করল তার সাথে কফির ট্রে হাতে মেসেঞ্জার। দুই মগ কফি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তারা। প্রফেসর আশা করেছিল আফসার আসবে কিন্তু এবার সে আসেনি। প্রফেসর মনে মনে ভাবল ভালোই হয়েছে আফসার না আসাতে। প্রফেসর ফাত্তাকে কফির মগ তুলে নিতে বলে সে নিজেরটা উঠিয়ে নিয়ে চুমুক দিল। ফাত্তাহ শুধু কফির মগটাই উঠাল না সে আরেকটা সিগারও ধরাল।

“প্রফেসর, তোমার সব সিগার তো আমি শেষ করে ফেলছি,” ফাত্তাহ হাসতে হাসতে বলতে লাগল।

“সমস্যা নেই,” ঠিক একইরকম হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে প্রফেসরও জবাব দিল। “কাল তো জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারে তখন এই সিগার আর কফি দিয়ে কী হবে?” বলে সে মৃদু হেসে উঠল

কিন্তু ফাত্তাহ তার কথায় হাসল না বরং গম্ভীর মুখে সে সিগার ধরাতে লাগল।

প্রফেসর ইচ্ছে করেই আবারও পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে গেল। “এরপর তারা কী করল?”

“এবার শুরু হলো টর্চার,” ফাত্তাহর গলা পাথরের চেয়েও শক্ত, যেন গলন্ত ইস্পাত ঝরে পড়ছে তার মুখ দিয়ে। “যেই সময়ের কথা বলছি তখন আমি একজন অ্যাকাডেমিক মানুষ। এর আগের কয়েক বছর পড়ালেখা ছাড়া আর কিছুই করিনি। সেই মানুষটার ওপর দিয়ে যখন আক্ষরিক অর্থেই স্টিম রোলার চালানো হলো,” বলে সে আপনাতেই মাথা নাড়ল যেন ভয়াবহ সেই অতীত স্মৃতির যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতাগুলো এখনও তাকে মুক্তি দেয়নি। “সেই দুঃসহ যাতনা কোনোদিন ভুলবার নয়, প্রফেসর। এখনও ঘুমের মাঝে রাতের অন্ধকারে সেই দুঃসহ গুদামের ভয়াবহ স্মৃতি, সেই ভেজা পচা গন্ধের সাথে মিশে থাকা নিজের রক্তের গন্ধ পরিষ্কার অনুভব করতে পারি আমি। নিজের আর্তনাদ এখনও ঘুরে ফেরে আমার নিজেরই কানে। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় আশেপাশে কেউ যেন চিৎকার করছে। প্রথমে মনে হয় অন্য কেউ, তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে পারি অন্য কেউ নয় বরং আমিই নিজের কানের ভেতরে অতীতের সেই আর্তনাদ টের পাচ্ছি। এই স্মৃতির হাত থেকে কোনোদিনই হয়তো আমার নিস্তার নেই,” বলে ফাত্তাহ থেমে গেল। তার গলার স্বর ভারি হয়ে গেছে। নিঃশ্বাসের গতিবেগও বেড়ে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক গুণ। দ্রুতগতিতে সে কফির মগ উঠিয়ে তাতে চুমুক দিল, সেই সাথে সিগারেও টান দিতে লাগল ঘনঘন।

প্রফেসর একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে কী হয়েছিল সেখানে। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করার আগেই ফাত্তাহর চেহারার দিকে তাকিয়ে ক্ষতগুলো দেখে সেটা আর জিজ্ঞেস করল না। বরং তার মনে প্রশ্ন জাগল এই প্রসঙ্গ তোলাটা কতটা যুক্তিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। কারণ প্রফেসর জানত এই বিষয়টা তোলা ছাড়া ফাত্তাহর কাছ থেকে আর অন্য কোনো প্রসঙ্গে কথা বলে এত সময় নিতে পারত না সে। আর যে খেলাটা সে খেলতে যাচ্ছে তাতে সময়টাই এখন সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তার জন্যও, ফাত্তাহর জন্যও। তবে দুজনের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা দুটো জায়গা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা দুই ধরনের প্রক্রিয়ায়। প্রফেসর অনুমান করতে পারে যে যেভাবে এখন ব্যাপারটাকে নিয়ে ভালো খেলতে পারবে শেষ পর্যন্ত তারই জিত হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। তবে ফাত্তাহর ক্ষতগুলো নিয়ে কথা বলার পেছনে সময় ছাড়া আরেকটা যে বিষয় কাজ করছে এখন ধীরে ধীরে সময় আসছে সেটাকে কাজে লাগানোর।

কিন্তু প্রফেসরের মনে যে জিজ্ঞাসা ছিল সেটা সে মুখে করতে না পারলেও ফাত্তাহ নিজ থেকেই সে প্রসঙ্গে বলা শুরু করল- “একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপেল কাটতে গিয়ে হাত কেটে গেলে কিংবা রান্নাঘরে ডিম ভাজতে গিয়ে হাত পুড়ে গেলে কিংবা শেভ করতে গিয়ে কেটে গেলে আয়োডিন লাগানোর সময়ে যে জ্বলুনি হয় তাতেই মনে হয় আমাদের জীবনটা বেরিয়ে যাচ্ছে। এরকম একজন মানুষকে যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ট্রেনিং পাওয়া লোকেরা টর্চার করে তখন ব্যাপারটা কেমন হতে পারে তোমার কোনো ধারণা আছে?” বলে সে নিজেই হেসে উঠল। “তোমার মতো অভিজাত শ্রেণির মেধাবী মানুষদের এসব সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকার কোনো কারণ নেই। টর্চার সম্পর্কে তোমাদের মতো মানুষেরা ধারণা নিজেদের দামি ভেলভেটের বিছানায় সাটিনের কাপড় পরে শুয়ে টিভির রিমোট হাতে টিভি চ্যানেল উলটানোর সময়ে সিনেমাতে দেখা হাস্যকর টর্চারের দৃশ্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। আমারও তাই ছিল প্রফেসর,” বলে সে একটু থেমে কফির মগটা টেবিলের ওপরে রেখে সিগার ধরা হাতটাকে একপাশে ঝুলিয়ে দিয়ে অন্য হাতটা নিয়ে এলো টেবিলের ওপরে। সেটার ওপরে নিজের ক্ষতবিক্ষত বীভৎস মুখটাকে রেখে বলতে শুরু করল আবার।

“যে লোকগুলো আমাকে ধরে নিয়ে যায় ওরা একটা টেরোরিস্ট সংগঠনকে রিপ্রেজেন্ট করছিল। তারা কারা আমি তখন জানতাম না। কিন্তু এখন সারা পৃথিবীই তাদের চেনে,” প্রফেসর খেয়াল করল ফাত্তাহ ইচ্ছে করেই নামটা উচ্চারণ করল না। “এদের অনেকেই রাশিয়া-আমেরিকার যুদ্ধে আফগানিস্তানে মাঠ পর্যায়ের যোদ্ধা ছিল। এরা প্রায় সবাই আমেরিকানদের কাছেই ট্রেনিং পাওয়া। কাজেই এরা জানত কীভাবে কী করতে হবে। ওরা সাত দিন আমাকে সেই গুদামঘরের ভেতরে আটকে রেখেছিল। সাত দিন,” শেষ শব্দ দুটো সে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল ফাত্তাহ।

আর প্রফেসরের মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে তুমি পরবর্তীতে কেন এদের সাথেই বারবার কাজ করেছ। কিন্তু প্রশ্নটা সে করল না। কিন্তু মনের ভেতরে নোট করে রাখল প্রশ্নটার উত্তর যদি ফাত্তাহর কথা থেকে বেরিয়ে আসে তবে তো কোনো কথাই নেই। কিন্তু যদি তা-না হয় সেক্ষেত্রে তাকে এর উত্তর জানতে হবে। এত চিন্তা না করে সে বরং ফাত্তাহর কথায় মনোযোগ দিল। প্রফেসরের ধারণা এই বিষয়টার একটা সম্মুখ ধারণা সে ফাত্তাহর কথা থেকেই পেয়ে যাবে।

“প্রথমে ওরা শুরু করে খুবই বেসিক দিয়ে। একেবারে পায়ের পাতা থেকে। কিন্তু খুব সাবধানে। যাতে পায়ের তলার নার্ভপয়েন্টগুলো যেন সব নষ্ট হয়ে না যায়। এরপর একটা একটা করে পায়ের নখগুলো তুলে ফেলে ধীরে ধীরে ওরা উঠতে থাকে ওপর দিকে। আমার পুরুষা—” এই পর্যন্ত বলতেই প্রফেসরের গা শিউরে উঠল। সে প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল ফাত্তাহ একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে।

খানিকটা টিটকিরির হাসি হেসে সে বলে উঠল, “কি প্রফেসর যা বলতে যাচ্ছি তা শুনতেও বুঝি কষ্ট হচ্ছে তোমার। তাহলে একবার চিন্তা করে দেখ যা শুনতেও তোমার কষ্ট হচ্ছে সেটা আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, সেই যান্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে,” বলে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। “তবে একটা ব্যাপার তুমি চাইলে জিজ্ঞেস করতেই পার। যে আমি বারবার বলছি আমি একজন সাধারণ মানুষ আর ওরা ট্রেনিং পাওয়া ফান্ডামেন্টালিস্ট তবে আমি সাত দিন কীভাবে টিকে রইলাম,” বলে সে একটু থেমে যোগ করল।

“প্রফেসর আমি জানি না তুমি সন্তানের পিতা কি না, তোমার কোনো পরিবার আছে কি না। যদি থেকে থাকে তবে তুমি বুঝতে পারবে মানুষ তার পরিবারের জন্য, তার সন্তানের নিরাপত্তার জন্য কি না করতে পারে। আমি ওদের হাতে যত নির্যাতিত হচ্ছিলাম ততবারই স্রেফ নিজের পরিবার আর নিজের সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলাম। কারণ আমি ভালোভাবেই জানতাম যদি একবার ভেঙে পড়ি এদের হাতে, তবে আমি তো শেষ হবই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে আমার পরিবারকে। আমার একমাত্র ছেলেটাকে বড় হয়ে উঠতে হবে একজন বেইমানের সন্তান হিসেবে। আমার পরিবার আমার কমিউনিটির লোকদেরকে নিগৃহীত হতে হবে আমার কারণে। স্রেফ আমি কিছু মানুষের অত্যাচার সহ্য করতে পারিনি বলে একাধিক মানুষকে ধ্বংস হতে হবে এসব বেনিয়াদের কাছে। তবে এগুলো সবকিছুর চেয়ে বড় হয়ে আমার চোখে শুধু ভাসছিল আমার সন্তানের মুখটা। আমার একমাত্র সন্তানের চেহারাটা। আর তাতেই আমি এই দানবদের সাথে মোকাবিলার শক্তি পাচ্ছিলাম। আর এখানেই ঘটে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টা,” ফাত্তাহ এই পর্যন্ত বলে একটু দম নেওয়ার জন্য থামল।

“ওরা আমাকে নিয়ে এমনভাবে খেলছিল যাতে আমি সর্বোচ্চ যন্ত্রণা পাই, কিন্তু আমার স্থায়ী কোনো ক্ষতি না হয়। আমার পা-কোমর-হাত,” বলে সে হাত তুলে দেখাল প্রফেসর আগে খেয়াল করেনি ফাত্তাহর হাতও চূড়ান্ত রকমের ক্ষতবিক্ষত। এমনকি দুই হাতের অন্তত চারটা আঙুলে তার কোনো নখ নেই। “কোনোকিছুই আর ঠিক ছিল না। এমনকি পায়ের আর বুকের কয়েক জায়গাতে পচন ধরতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমি মচকাইনি। এক পর্যয়ে এরা বিরক্ত হয়ে যায়, যখন বুঝতে পারে আমাকে কোনোভাবেই ভাঙতে পারবে না। বিরক্ত হয়ে ওরা উলটো পথ ধরে। এবার ওরা আমার বিশেষ অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোর দিকে নজর দিতে থাকে। প্রথমেই আমার এই বা চোখটা,” বলে সে নিজের একটা নখবিহীন আঙুল দিয়ে নষ্ট শিরা বের হওয়া চোখটা দেখাল। “ওরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সম্ভবত আর সহ্য করতে পারছিল না। তাই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে একটু একটু করে এই চোখটা তুলে ফেলতে থাকে,” বলে সে নিজের ভালো চোখের দৃষ্টিটা পুরোপুরি স্থির করে প্রফেসরের দিকে দেখিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল, “একটু একটু করে প্রফেসর, একটু একটু করে,” বলে সে উন্মাদের মতো হেসে উঠল।

ফাত্তাহ ঘর কাঁপিয়ে হাসছে, প্রফেসর এই প্রথমবারের মতো অনুভব করল একটু আগে সম্ভাব্য বিজয়ের যে অনুভূতি তার ভেতরে এসেছিল সেটা পুরোপুরি উবে গেছে। চোখ-মুখ আপনাতেই শুকিয়ে উঠল তার। একটা শুকনো ঢোক নেমে গেল গলা দিয়ে। মগের অবশিষ্ট ঠান্ডা হয়ে আসা কফিটুক গলায় ঢেলে দিল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *