শব্দজাল – ২৪

২৪

আবারও নিঃশ্বাসের মতো শব্দ করে খুলে গেল সেই দরজাটা।

বাইরে বের হতেই প্রথমবারের মতো বাইরে দাঁড়ানো কমান্ডো গার্ড প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “হ্যাপি নিউ ইয়ার, স্যার।”

প্রফেসর স্রেফ একবার মাথা নেড়ে তাকে উইশ করল। কমিউনিকেশন রুমের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই সে দেখতে পেল রুমের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এবার আর কেউই তালি দিল না। বোমাটা খুঁজে পাওয়ার খুশিতে উইশও করল না। সবাই স্রেফ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে, বিশেষ করে তার বিকৃত বাম চোখের মণির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবাই। হাতের চশমাটা সাবধানে চোখে পরে নিয়ে বাইরের দিকে রওনা দিল সে।

পেছনে একদল অবাক মানুষ রেখে প্রফেসর ধীরে ধীরে হেঁটে বেরিয়ে এলো একেবারে ভবনের বাইরে। বিরাট ভবনটার আঙিনায় দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিল বুক ভরে। পাইপটাকে মুখের কাছে এনে পকেট থেকে লাইটার বের করে অবশিষ্ট তামাকটুকুতে আগুন দিয়ে টানতে লাগল সে।

সামনে ভোরের কুয়াশা কেটে গিয়ে সকালের হালকা রোদের আভাস দেখা দিয়েছে। কোনোরকম অনুভূতি ছাড়াই সে পাইপ টানতে টানতে কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক ঠাহর করতে পারল না প্রফেসর। হঠাৎ পেছন থেকে আফসারের ডাক শুনে ফিরে তাকাল সে।

তার এক হাতে প্রায় চলটা ওঠা মলাট ছেঁড়া একটা খাকি রঙের মোটা ফাইল আর অন্য হাতে প্রফেসরের ফেলে আসা কাঠের বাক্সটা নিয়ে দৌড়ে আসছে আফসার। “স্যার, আতিকুল আলম স্যার এটা দিতে বলেছেন আপনাকে,” বলে সে ফাইলটা এগিয়ে দিল প্রফেসরের দিকে।

পাইপটাকে ঠোঁটে কামড়ে ধরে এক হাতে ফাইলটা নিয়ে দেখল প্রফেসর। পুরানো জীর্ণ একটা ফাইল। মলাটের কোনো ছিঁড়ে গেছে, উঠে গেছে চলটা I ওপরে কোনো নাম-ধাম কিছু নেই। শুধু বড় লাল সিল মেরে লেখা ‘অমীমাংসিত’। “ধন্যবাদ,” বলে সে আফসারের দিকে তাকাল। কাঠের বাক্সটা তাকে ফিরিয়ে দিল আফসার।

“স্যার, শেষ পর্যন্ত ভালোর জয় হয়েছে। আমাদের জয় হয়েছে। বোমাটা পাওয়া গেছে স্যার,” বলে সে দ্রুত যোগ করল, “অ্যালবার্ট ফাত্তাহ যেখানে বলেছিলে ঠিক সেখানেই পাওয়া গেছে ওটা। আসলেই সিকিউরিটি জোনের বাইরে হওয়াতে ওটার খোঁজ কেউ বের করতে পারেনি। আর কে ভাববে এত বড় একটা ভবনের পানির ট্যাংকির ভেতরে বোমা থাকতে পারে। ফাত্তাহ কৃত্রিম উপায়ে কোনো না কোনো ভাবে ট্যাংকে খালি করে ওটার ভেতরে বোমাটা সেট করেছিল। আর শক্তিশালী বোমাটাও এমনভাবে-এমন জায়গায় সেট করা হয়েছিল যাতে ওটা ফাটলে গোড়টা দুর্বল হয়ে ভবনটা নিজের ভারেই ধসে পড়ে সিটি রেলের লাইনের ওপরে।”

প্রফেসর কিছু না বলে স্রেফ মাথা নাড়ল।

“স্যার?” প্রফেসর তাকিয়ে আছে আফসারের দিকে।

“আমি জানি তোমার অনেক বিষয়ে জানার আছে, বলো,” প্রফেসর পাইপ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।

“স্যার কীভাবে, মানে কীভাবে সম্ভব? আপনি কোনো প্রস্তুতির সময় পাননি। আপনি একবারও বাইরে বেরোননি। আপনি এমনকি আমাদের কাছে কোনো তথ্য জানতেও চাননি। স্রেফ ওখানে বসে কীভাবে আপনি এতকিছু বের করলেন?” আফসার তার প্রশ্নের স্রোত থামাতে পারছে না। “আমি এরকম ভূতুড়ে কাণ্ড কোনোদিন দেখিনি। আপনার অধিদৈনিক কোনো ক্ষমতা আছে, আমি সেটাও ঠিক—” এই পর্যন্ত বলে আফসার একটু দ্বিধা করতে লাগল।

“কিছু বলতে চাও?” প্রফেসর আশ্বাস দিল আফসারকে। “বলে ফেল।”

“স্যার জেড থিয়োরি,” মানে–“ আফসারের গলায় রাজ্যের দ্বিধা। “মানে আমি যখন এডিনবার্গে পড়ালেখা করতাম। ওখানে এমনকি প্রফেসররাও বলাবলি করত ওটার প্রবক্তার নাকি বিশেষ ক্ষমতা আছে। মানে সে নাকি মানুষের মাইন্ড কন্ট্রোল করতে পারে, থট রিডিং করতে পারে। মানে তার নাকি আলৌকিক সাইকিক ক্ষমতা ছিল,” বলে আফসার মাথা তুলে তাকাল প্রফেসরের দিকে। “যদিও পুরো ব্যাপারটাই গুজব কিন্তু আপনিই যদি ওই থিয়োরির প্রবক্তা হয়ে থাকেন এবং আজ রাতে যা দেখলাম তাতে—”

আফসারের কথা শুনে প্রফেসর বেশ জোরে হেসে উঠল “এখানে আধিদৈবিকতার কিছু নেই আফসার,” প্রফেসর মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠল, “তুমি আজ রাতে ওই রুমে যা দেখেছ তার পুরোটাই বিজ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তি, সর্বোচ্চ লেভেলের মৌখিক এবং মাথার খেলা। তুমি বলেছিল না শেষ পর্যন্ত ভালোর জয় হয়েছে,” বলে প্রফেসর মাথা নেড়ে হেসে উঠল।

“ওসব ভালো-টালোর জয় হয় নাটক-উপন্যাস কিংবা সিনেমাতে। বাস্তবে ভালোর জয় হয় না। বহু আগে শুনেছিলাম শয়তানের সাথে এক পাত্রে খেতে বসলে তোমার হাতেও থাকতে হবে একটা লম্বা চামচ। আমি স্রেফ সেই লম্বা চামচ নিয়ে খেতে বসেছিলাম আজ রাতে। শয়তানের সাথে খেলাটা একমাত্র ওভাবেই জেতা সম্ভব ছিল।”

প্রফেসর থেমে গেছে কিন্তু আফসার একগাদা প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“আমার চোখে এই যে চশমাটা দেখছ,” বলে সে নিজের চশমাটা আবারও খুলে ফেলল চোখ থেকে। “এটা সাধারণ কোনো চশমা নয়। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সফিসটিকেটেড প্রযুক্তিতে তৈরি সবচেয়ে উন্নত একটা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাইকোলজিস্ট সিস্টেম। আসলে এই চশমাটা এর ধারক নয়। এর ধারক আমার বাড়িতে সেন্টাল একটা ডেটাবেইজ সার্ভারের সাথে সংযুক্ত। এই চশমাটা স্রেফ ডেটা ইনপুট আর আউটপুট দেওয়ার মাধ্যম মাত্র। নাম কি জানো এর ‘মিসির আলী’। এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স সাইকোলজিস্ট সিস্টেমটা ডেভলপ করেছিলাম আমি আর আমার স্ত্রী জেসমিন মিলে। মূলত আমার স্ত্রী-ই ছিল এর মূল ডিজাইনার। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের সাইকোলজিক্যাল সিরিজ মিসির অলীর অনেক বড় ভক্ত ছিল আমার স্ত্রী। আর তাই সে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমটার নাম রেখেছিল সে তার প্রিয় চরিত্র মিসির আলীর নামে।”

“আমি আজ রাতে বাড়ি থেকেই বেরোবার সমেয়ই মিসির আলীকে অ্যাকটিভ করে বেরিয়েছিলাম। একেবারে শুরুতেই লাইব্রেরিতে থাকার সময়ে যখন আমি প্রথমেই মিসির আলীকে ডেটা ইনপুট দেই মিসির আলী ডিপ ওয়েভ ঘেঁটে আমাকে তথ্য দেয় হন্ডুরান সিগার আর স্পেশাল ব্রাজিলিয়ান বাটার নাটের কফি ফাত্তাহর বিশেষ পছন্দ। আমি লাকি ছিলাম। কারণ আমার বাড়িতে দুনিয়ার সেরা সব সিগার-তামাক আর কফির কালেকশন আছে। আর তাই ওই কাঠের বাক্সে ওগুলো নিয়ে বেরিয়েছিলাম আমি, যাতে রিড টেকনিকের প্রথম স্টেজের জন্য সেগুলো আমি ব্যবহার করতে পারি,” প্রফেসর একটু থেমে যোগ করল। “এরপর তোমাদের এই ভবনে ঢুকে আমি ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড চাইলাম তোমার কাছে। সেটা পেতেই মোবাইলের মাধ্যমে আবারও মিসির আলী পূর্ণ বেগে চালু হয়ে যায়। ফাত্তাহর সাথে কথোপকথনের সময়ে আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে মস্তিষ্ক ব্যবহার করে শব্দজাল তৈরি করছিলাম আর ফাত্তাহর বক্তব্য থেকে তথ্য নিয়ে সেগুলো থেকে টুকরো-টুকরো তথ্য জোড়া লাগিয়ে বড় একটা চিত্র তৈরি করে আমাকে ব্যাকআপ দিচ্ছিল মিসির আলী,” প্রফেসর তার বাম কানের ভেতর থেকে ছোট্ট প্রায় অদৃশ্য সেই এয়ারপিসটা বের করে দেখাল।

“আমার ডান কানে থাকা এয়ার পিসে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম, আর বাম কানের এটার মাধ্যমে মিসির আলীর সাথে। আসলে ফাত্তাহর সাথে আমার খেলাটা শুধু আমি একা খেলছিলাম না। আমার সাথে খেলছিল মিসির আলীও। সেইসাথে সে ব্যবহার করছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আর ডার্ক ওয়েবের সমস্ত তথ্য। প্রথমেই ফাত্তাহ যখন তার পরিবারের গল্প শোনাল। তার বাবা যে বাংলাদেশের যশোরে ডাক্তার ছিল সেটা মিসির আলীই বের করে আমাকে জানায়। প্রথম ব্যাপারটা আমরা ধরতে পারি ফাত্তাহর বলা বাংলায় ওই বিশেষ এলাকার টান থেকে। ফাত্তাহর বাংলায় খুব সামান্য হলেও ওই এলাকার টান আছে এটা আমি ধরেছিলাম কিন্তু বাকি কাজ মিসির আলী করেছিল। সে ওটা তো বের করেই সেইসাথে ফাত্তাহর গল্পের ফাঁকগুলোও ধরিয়ে দেয়। আর আমি সেগুলো পূরণ করে চেপে ধরি তাকে। তবে শেষ খেলাটা মিসির আলী আজ রাতে দেখিয়েছে ফাত্তাহর ছেলের ব্যাপারটা বের করে।”

“ব্যাপরটা সহজ ছিল না। এখানে দুটো দিক থেকে ডেটা কাজে লাগাই আমরা। প্রথমত, কথোপকথনের এক জায়গায় ফাত্তাহ তার ডক্টরেট সুপারভাইজারের নাম জানায় আমাকে। ওই নামটা ধরে একদিকে তার অ্যাকাডেমিক লাইফের ডেটা বরে করে শুরু হয় অ্যানালিসিস। অন্যদিকে, ফাত্তাহ তার কথোপকথনের সময় বলছিল তার প্রয়াত স্ত্রীর বাবা ও ভাই নিউইয়র্কে রেস্টুরেন্ট আর বেকারির ব্যবসায় করে। মিসির আলী ম্যানহাটনের সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভারে ঢুকে অনেক ডেটা ঘাঁটার পর বের করতে পারে নিউইয়র্কের এক মুসলিম পরিবারের এক রেস্টুরেন্ট মালিকের ভাগ্নে ঢাকা সিটি রেলের প্রজেক্টে কাজ করছে। এরপরে মিসির আলীই এয়ার প্যাক সার্ভারের মাধ্যমে বের করে সেই লোক আজ আসছে ঢাকায়। ছেলেটার নামটাও মনে ধরে তার। আবদুল্লাহ আল জুবায়ের। আবদুল্লাহ আল ফাত্তাহর নামের সাথে কিছুটা মিল আছে। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, কারণ এরকম মিল হাজারো নামে থাকতে পারে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা খোঁজ শুরু করি। এরপর আমি আর মিসির আরী দুজনে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলি যখন জানতে পারি আবদুল্লাহ আল জুবায়ের নিউইয়র্কের মানুষ হলেও তার বাপের অরিজিন পাকিস্তানে এবং তার মা মৃত। সেইসাথে ওই ছেলের বাবার ব্যাপারে কোনো পরিষ্কার তথ্য নেই। বাকিটা মেলানো অতটা কঠিন ছিল না।”

“মিসির আলীর কারণেই আমাকে দেখার একটু পরেই আপনি জানতে পেরেছিলেন আমি এডিনবার্গে পড়েছি। এ কারণেই আপন কথার মাঝে একাধিকবার ডেটা শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝলাম ডেটা অ্যানালিসিস করে সব তথ্য দিচ্ছিলেন বলেই ডেটা শব্দটা বেরিয়ে যায় আপনার মুখ থেকে। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝলাম না, ফাত্তাহর ছেলে যে প্লেনে আসার কথা সেই প্লেন তো এখনও ল্যান্ডই করেনি?” আফসারের প্রশ্ন প্রফেসরকে একটু থামার সুযোগ করে দিল। “তাহলে আপনি কীভাবে এটা দেখালেন সেই ছেলে তার টিমের সাথে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোচ্ছে।”

অনেকক্ষণ টানা বলে প্রফেসর হাঁপিয়ে উঠেছিল আফসারের প্রশ্ন শুনে দম নিতে লাগল সে। “এটাও মিসির আলীর কৃতিত্ব। যদিও আইডিয়াটা ছিল আমার। আমি জানতাম ফাত্তাহকে কাবু করতে হলে কোনোদিনই সেটা শুধুমাত্র কথা দিয়ে সম্ভব নয়। তাই আমিই মিসির আলীকে পরামর্শ দেই ডিপফেইক টেকনোলজি ব্যবহার করে একটা ফেইক ভিডিও তৈরি করে সেটাকে সার্ভারে পুশ করে দিতে। তোমরা সিসি টিভির যে ফুটেজটা দেখেছ ওটা খুবই অল্প সময়ের জন্য অনেকটা ক্লোন সার্ভারের মতো একটা সার্ভারে বসানো ফেইক একটা ভিডিও। ফেইক ভিডিও বানানোর এই টেকনোলজিকে বলে ডিপফেইক টেকনোলজি। এই ব্যাপারে যদি না জানো তবে গুগলে বা ইউটিউবে সার্চ দিয়ে দেখো রবার্ট ডাউনি জুনিয়র থেকে শুরু করে বারাক ওবামা, পুতিন থেকে শুরু করে ট্রাম্প সবার ডিপফেইক ভিডিও ভরপুর পাবে। সত্যকে মিথ্যে আর মিথ্যেকে সত্য বানানোর টেকনোলজি। সেটাই আজ রাতে আমি ব্যবহার করেছি,” প্রফেসর আবারও থেমে গেল। সারারাতের ক্লান্তি তার ওপরে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে।

“তবে স্যার, কথোপকথনের শুরু থেকেই ঘড়িতে সময় বদলে ওই রুমে প্রবেশ করার ব্যাপারটা দুর্দান্ত ছিল স্যার। ব্রিলিয়ান্ট,” আফসারের গলায় মুগ্ধতা।

“গত রাতে যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে আমি হাত দিয়েছিলাম সেটাকে শেষ পর্যন্ত সম্ভব করা গেছে এটাই বড় কথা। তোমাদেরকে ধন্যবাদ,” বলে আফসারের হাঁ হয়ে থাকা থুতনিটা তুলে দিয়ে সে তার কাঁধে একটা চাপড় মারল। “অসাধারণ একটা সময় কাটল,” বলে প্রফেসর হাঁটতে লাগল।

“ও আরেকটা কথা, ফাত্তাহকে বলে দিও তার ছেলে এখনও ঢাকায় আসেনি। ছেলে যখন বাবাকে কষ্ট দেয় এর চেয়ে বড় কষ্ট আর নেই পৃথিবীতে। আমি এই কষ্ট সবচেয়ে ভালো বুঝি। আর যদি সম্ভব হয় আতিককে অনুরোধ করো, ওকে বলো যে আমি বলেছি ফাত্তাহকে ইন্টারপোলের হাতে তুলে দেওয়ার আগে যেন একবার হলেও তার ছেলের সাথে দেখা করার সুযোগ দেয়,” প্রফেসর কাঁধ ঝাঁকিয়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো।

গেটের ঠিক বাইরেই বুকে হাত ভাঁজ করে পাহাড়ের মতো কালো এসইউভির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ততধিক কালো সাদ্দাম। প্রফেসরকে দেখে একগাল হেসে সে বলে উঠল, “মশিউর ভাই আর তার পরিবারকে ভালুকা রাইখা আসছি স্যার,” বলে সে প্রফেসরের জন্য দরজাটা খুলে দিল।

দরজার হাতলে হাত রেখে এক ঠেলায় দরজাটা লাগিয়ে দিল প্রফেসর। “এখন আবার ভালুকা গিয়ে ওদের নিয়ে আয়,” প্রফেসরের কথার জবাবে সাদ্দামের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। “এখান থেকে সোজা যাবি ভালুকা।”

“স্যার আপনে?” কোনোরকম প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে সে জানতে চাইল। কেন মশিউরকে কাল রাতে তড়িঘড়ি করে রেখে অসতে হলো, আর কেনই বা নিয়ে আসতে হবে, এই নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রফেসর যা বলবে সে তাই করবে।

“আমি এখন একটু হাঁটব,” বলে প্রফেসর হাতে ধরা ফাইলটাকে দেখল। “তুই যা,” সাদ্দাম গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিতেই প্রফেসর হাঁটতে লাগল রাস্তার কিনারা ধরে সকালের মিষ্টি রোদে গা ভিজিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এলো রাস্তার পাশে ছোট পার্কের মতো একটা জায়গাতে। সবুজ ঘাসের ছাউনি দেওয়া গোল জয়গাটার পাশেই একটা ধূসর বেঞ্চে বসে ফাইলটা পাশে রেখে দিল।

“মিসির আলী,” মৃদু ডাক দেওয়ার সাথে সাথে কানের ভেতর থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিসির আলীর গলা ভেসে এলো।

“স্যার, কন।”

“তোমাকে ধন্যবাদ। আজ রাতে তুমি না থাকলে অনেক বড় বিপর্যয় হয়ে যেত।”

“আরে কী যে কন না স্যার,” মিসির আলীর কথা শুনলে সবসময় মজা পায় প্রফেসর। তার স্ত্রী জেসমিন যখন মিসির আলীকে ডিজাইন করে ইচ্ছে করেই সে হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলীর মতোই আঞ্চলিক বা চলতি ভাষায় কথা বলার ব্যবস্থা করেছিল। যখনই মিসির আলীর সাথে কথা বলে প্রফেসরের মনে হয় জেসমিনের সাথে কথা বলছে সে। “আসল কাম তো করছেন আপনে। আপনে কথা কইয়া ওইসব বাইর না করলে তো আমি কুনো কামই করবার পারতাম না। ওর গলার আঞ্চলিক টানডা না ধরতে পারলে শুরুই করবার পারতাম না স্যার। তার উপরে সময় বদলাইয়া ওকে বোকা বানানি… স্যার আপনে যা দেহাইলেন, এইটা হইলো আসল বুদ্ধির খেলা।”

“তবুও তোমাকে ধন্যবাদ মিসির,” বলে আবার যোগ করল প্রফেসর। “ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর, মানে আমার সাইকোলজিস্ট বন্ধু তার যে ছাত্রীর প্রোফাইল পাঠিয়েছিল, চেক করেছিলে ওটা?”

“হয় স্যার, হেরে আমার বালাই মনে অইছে। মাইয়া কামের আছে মনে অয়।”

“ঠিক আছে। যেহেতু এখন ফাইল হাতে এসে গেছে ওকে ডাকতে হবে। আচ্ছা, এখন থাক পরে কথা হবে মিসির।” প্রফেসর চশমার হ্যান্ডেলের পাশের ছোট একটা বাটনে চাপ দিতেই চশমাটার সামনের কাচের ওপরে ফুটে থাকা লেখাগুলো মুছে গিয়ে সাধারণ কাচে পরিণত হলো ওটা। কানের ভেতর থেকে এয়ারপিসটা বের করে রেখে দিল সে পকেটে। চশমাটাও খুলে রেখে দিল বেঞ্চে রাখা ফাইলটার ওপরে।

ছোট একটা ছেলে পার্কে ঘুরে ঘুরে ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করছে। হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল প্রফেসর। আট-দশ বছর বয়স হবে, ছোট্ট একটা ছেলে। একটা পা বিকলাঙ্গ। এক হাতে ফ্লাস্ক ধরে মহা আনন্দে চা বিক্রি করছে সে।

“এই লাল চা হবে?” প্রফেসর জানতে চাইল। “চিনি ছাড়া?”

“চিনি ছাড়া অইবো না,” সামনের সবসকয়টা দাঁত তার পোকায় খাওয়া। “কপি অছে স্যার কপি দিমু?”

“দে কপি দে,” পাইপের পোড়া তামাক ফেলে কাঠের বাক্স থেকে নতুন তামাক ভরে ধরিয়ে টান দিতে দিতে তার হাতে সাদা কাগজের কাপে ‘কপি’ ধরিয়ে দিল ছেলেটা।”

“তোর দাঁতে কী হয়েছে?”

“পুকে খাইলাইছে,” বলে সে প্রফেসরের চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। “আপনের চক্ষে কী অইছে, এরম কে?”

তার প্রশ্ন শুনে প্রফেসর হেসে উঠল। “আমার টাও পুকে খায়া ফেলছে,” প্রফেসরের কথা শুনে ফোকলা দাঁতে হেসে উঠল ছেলেটা। তার সাথে হেসে উঠল প্রফেসর নিজেও।

হাসতে হাসতেই প্রফেসর বেঞ্চে রাখা ফাইলটার ওপরে সিল মারা ‘অমীমাংসিত’ লেখাটার ওপরে একবার চোখ বুলাল।

এখনও অনেক কাজ বাকি, গল্প তো সবে শুরু হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *